মো: আসাদুজ্জামান
প্রিয়, এক বন্ধুর ওয়ালে দেখলাম সহস্র মৃত্যু ছুঁয়ে রেড জোনে আমরা!
তুমি নিশ্চয়ই জানো মার্চ ‘২০ এর আগে শুধু তোমার জন্য, তোমার দেওয়া যন্ত্রণাময় যাপিত জীবনে প্রতিদিন হ্বদয়ে রক্তক্ষরণ হতো, ছটফট করতাম । তুমি শুনতে, বুঝতে, আর আমার নীলবেদনা উপভোগ করতে , আরো বেশী দহনে পোড়াত ! আজ আর তোমার জন্য নয় , দেশের জন্য রক্তক্ষরণ হয় । তোমার দেওয়া নিত্যদিনের যন্ত্রণা এখন নগণ্য হয়ে পড়েছে, ভাটি গাঁ’য়ের মরা নদীর মত । কবি নবারুন ভট্রাচার্যের মৃত্যু উপত্যকা কবিতা পড়েছো তো? তোমার কি এখনও মনে হয় না সেই মৃত্যু উপত্যকার মহাসড়কে তুমি, আমি, আমরা , আমাদের স্বজন, বন্ধু, আত্মীয়সহ আমাদের প্রিয় দেশবাসী দাঁড়িয়ে আছি? আমরা কি এক অনির্ধারিত অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছি না? আমি জানি অনির্দিষ্ট , অগণিত মানুষের মতো, আমার মতো, আমাদের মতো তুমিও এই নিকষ কালো আঁধারসম সময় পেরোবার অপেক্ষায় । এই করোনা মহামারিতেও যশোরে এক ছাত্রনেতা নিখোঁজ রয়েছে জুন ১৩, ২০২০, থেকে । পরিবারের অভিযোগ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে। এই কঠিন প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রতিটি মানুষ যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে, তখনও গুমের সংস্কৃতি চলমান । এগুলো তো তোমাকে কাঁদাবে না, আমাকে কাঁদায় ।
প্রিয় , আমার মতো তুমিও হয়তো দেখো নিত্যদিনের প্রেসব্রিফিং, বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলার পারদ । অনেক আগে থেকেই সোস্যাল মিডিয়ায় নিন্দুকেরা বলছেন প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশী । বিশ্বখ্যাত সংবাদ মাধ্যম The Economist ইতোমধ্যেই রিপোর্ট করেছে শুধু ঢাকা শহরেই আক্রান্ত সাড়ে সাত লাখ। খবর পাচ্ছি হাসপাতালে কোবিড নাইনটিন রোগীদের জন্য বেড’র তীব্র সংকট । সাধারন চিকিৎসা ব্যবস্থা ভংগুর প্রায়, তবুও অনেক চিকিৎসক তাঁদের মানবিক মূল্যবোধ, পেশাদারিত্ব এবং নৈতিকতা দিয়ে প্রাণপণ মানব কল্যাণে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন । পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসন এই মহামারির সময় সরকারের নীতিনির্ধারকদের সংকোচন এবং একলা চলো নীতিমালার আলোকে নির্দেশনা অনুযায়ী করোনাকালীন সময়ে মানুষের পাশে থাকার জন্য তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যেই করোনা আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েকজন ডাক্তার ও পুলিশ মারা গেছেন । সাংবাদিকবৃন্দও ঝুঁকি নিয়ে ফ্রন্টলাইনারদের তালিকায় থেকে অনবদ্যভাবে ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন । এসো আমাদের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে এদের শ্রদ্ধা জানাই ।
ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই শুনেছো বা জেনেছো যে , শুরুর দিকে প্রধানত: সরকারী দল এবং এর অঙ্গ সংগঠন সমূহের বিরুদ্ধে ত্রাণ চুরির মহোৎসবের অভিযোগ উঠেছে যা সকলের মত তুমিও অবগত । তুমি জানো মাধবী, এ নিকষ কালো আঁধারের মাঝে কয়েকটি প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । সেই চিন্তার জগতে অবশ্য তুমি নেই, কিছু যেন মনে করো না । এ দু:সময়ে প্রশ্ন জাগছে আমাদের প্রিয় দেশ কি নবারুন ভট্টাচার্যের কবিতার উপমার মতো মৃত্যু উপত্যকায় রয়ে যাবে? প্রশ্ন হলো - এই মৃত্যুর মিছিল কি রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্র এবং জনবিচ্ছিন্ন আমলাতান্ত্রিক মোকাবিলা নীতির কারণে?
আমি বলছি না অপশাসন, দূর্নীতি, চালচোর, গমচোর, ত্রানের টাকা চোর , গনতন্ত্রহীনতা, অবিচার, অনাচার, দলীয়করণ, খুন, গুম , হেফাজতে হত্যা ইত্যাদির কারণে আমরা করোনার ক্রান্তিকালে এসে পড়েছি; আমি বলছি না এ সবই বিচারহীনতার শিকার অতৃপ্ত আত্মাদের দীর্ঘশ্বাসের জন্য, আমি বলছি না এগুলো কোন স্বজন হারানোর আর্তনাদের কারণে হয়েছে! তবে, এটা বিশ্বাস করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না যে প্রশ্নবিদ্ধ ভাবে নির্বাচিত সরকার বাহাদুরের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ নীতি করোনা বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে, সরকার সেই ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেনা। শুরুর দিকে বিমানবন্দর লকডাউন করলে হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতো । সেটা করা হয় নি বরং সরকারী দলের একজন মন্ত্রী বলেছিলেন তাঁরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী! এই দাম্ভিক মানসিকতা আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে, তোমারও কি তা মনে হয় না মাধবী? করোনাকালীন সময়ে আমাদের স্বাস্হ্যব্যবস্থা এবং এর অবকাঠামো দৃশ্যমান ভংগুর অবস্থার জন্য অবশ্য শুধুমাত্র এই সরকারই দায়ী এমন বিবেকহীন মন্তব্য আমি করবো না, করলেও তুমি মানবে না তা আমি জানি! তবু বলি, বিগত এক দশকে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবিরাম বেতন বাড়ানো হয়েছে, দেশে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় দূর্নীতি-লুটপাটের সচিত্র প্রতিবেদন বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, খুন-গুমের বিভৎস মহড়া চলেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে , ভোট ডাকাতির মাধ্যমে গনতন্ত্র হত্যা করার মতো সাংবিধানিক অপরাধ হয়েছে , কিন্ত একটি ভ্রাম্যমান অ্যামবুলেন্স কেনার কথা মনে পড়েনি কারও। কি অদ্ভূত এক স্বদেশে আমাদের জীবন বহমান প্রিয়! এই কি আমাদের জীবনের অর্থ প্রিয়?
তুমি নিশ্চয়ই অবগত আছো যে, সরকারের তথ্যমতে ৫০ লক্ষের সরকারী ত্রাণের তালিকায় ৮ লক্ষই ভুয়া। তোমার কি মনে হয় না যে, উক্ত তালিকায় কোটিপতিদের, চেয়ারম্যানদের কিংবা নেতাদের বা তাদের আত্মীয়দের নাম থাকাটা অপরাধ, তুমি কি ভাবতে পারো না যে ভোট ডাকাতির নির্বাচনের ফলে, গনতন্ত্রহীনতার নির্যাসে, স্বৈরতন্ত্রের চর্চায়, ‘আইনেস’ কিংবা ‘মাইওপিকে’ কারণে এই মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে আমার এ স্বদেশ, আমার জননী জন্মভূমি , আমার চিন্তার পূর্ণভূমি?
এ দু:সময়ে প্রমাণিত যে এ রোগের চিকিৎসা কুয়াশাচ্ছন্ন, অর্থ-বিত্ত মৃত্যু এবং আক্রান্ত হওয়া ঠেকাতে পারছে না। সরকারী শীতল সংকোচন এবং একলা চলের মতো ভুল নীতির কারণে সংক্রমন ঠেকানো যাচ্ছে না । মানুষ ক্ষুধা এবং জীবিকার প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। এই অবস্থায় এখনই উচিত সর্বদলীয় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা, রাজনৈতিক সংকীর্ণতা পরিহার করা, লুটপাটের সব পথ বন্ধ করা, এলাকা ভিত্তিক নয়, গোটা দেশ একই সাথে দুই সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা। এরপর আক্রান্তদের দ্রুত সনাক্ত করে আইসোলেশনে নিয়ে যতটুকু চিকিৎসা আছে ততটুকু দিয়ে সুস্থ করে তোলা । সেটা না করে যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে দেখে নিও প্রিয় , এই মৃত্যুর মিছিল বাড়বে, যে মিছিলের শব্দহীন-বাক্যহীন সতীর্থ হয়তো তুমি আমি আমরা হয়ে যাবো। মন্ত্রী-এমপি-ধনী-ক্ষমতাবান কেউ সেই মিছিল থেকে পিছিয়ে থাকবে না, পিছনে পড়ে থাকবে বিরান ভূমি!
এই জীবনে তোমার সাথে দেখা হবে না, ঐ জীবনে হয়তো বেহেস্তের বাগিচায় কোন নির্জন নীরবতায় কথা হবে ফিসফিসিয়ে !
ভালো থেকো আমার কুঁয়াশাচ্ছন্ন মাধবী, আমার কল্পনার মাধবী, আমার দু:খ বিলাস, আমার সুখের অনুভূতি!!
— লেখক আইনজীবি ও রাজনৈতিক কর্মী
জুন ১৫, ২০২০, ঢাকা
No comments:
Post a Comment