গোলাম মোর্তোজা
একটি মিসাইল ছোঁড়ার পর তার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেই প্রযুক্তি মানুষের আয়ত্তে। কিন্তু মুখ দিয়ে একটি কথা বলে ফেললে, তা ফেরানোর সামর্থ্য মানুষ আয়ত্ত করতে পারেনি। সেই কথাটি যদি অসত্য হয় এবং তা যদি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তবে আরও দশটি অসত্য কথা বলতে হয়। এতে পূর্বের কথাটা চাপা তো দেওয়া যায়ই না, অসত্য-বিভ্রান্তির পরিধিই শুধু বাড়ে।
আর তা যদি মুখের কথা না হয়ে লিখিত হয় এবং সঙ্গে ছবি থাকে, তবে চাপা দেওয়ার কোনো সুযোগই থাকে না। তারপরও চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলে, পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর আকার ধারণ করে। এমন নজির তৈরি করে জটিলতায় আটকে পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরীক্ষা না করে কোভিড-১৯ রোগের সনদ বাণিজ্য করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদন পাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট ও জেকেজি।
সাম্প্রতিক সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুটি সিদ্ধান্ত ও তার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি লিখিত বিজ্ঞপ্তির আলোকে কিছু কথা।
১. স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর ও জেকেজি নামক প্রতিষ্ঠানকে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের অনুমতি দেওয়ার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে ১১ জুলাই একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সহকারী পরিচালক ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবির স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে:
ক. মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।
খ. সাহেদ করিম বিষয়ে আগে থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অবহিত ছিল না।
গ. এ বছরের মার্চ মাসে দেশে আকস্মিকভাবে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়।
ঘ. বেসরকারি হাসপাতাল কোভিড-১৯ রোগী ভর্তি করতে চাইছিল না।
ঙ. ক্লিনিক দুটি পরিদর্শনকালে চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ দেখতে পেলেও ক্লিনিক দুটির লাইসেন্স নবায়ন ছিল না।
চ. ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ওভাল গ্রুপের সত্ত্বাধিকারী আরিফুল হক চৌধুরী। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চিকিৎসকদের সংগঠনের অনুষ্ঠানের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করে ওভাল গ্রুপ। আরিফুল হক চৌধুরী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এসে বলেছেন তিনি ‘জোবেদা খাতুন হেলথকেয়ার (জেকেজি)’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়ক। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার মডেলে বাংলাদেশে কিছু বুথ স্থাপন করতে চান। সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হবে। পুরো কাজের জন্যে তাদের কোনো অর্থ দিতে হবে না। তাদের অনুমতি দেওয়া হয়।
গোলাম মোর্তোজা |
২. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে সচিব বা মন্ত্রীকে বোঝায়। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তারা দুজনই উপস্থিত ছিলেন। তার মানে সচিব বা মন্ত্রীর বা দুজনের নির্দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিল বলে প্রতীয়মান হয়। যদি না ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’র আলাদা কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাহেদ করিমের বিষয়ে আগে থেকে অবহিত ছিল না। নির্দেশদাতা ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’ নিশ্চয় হয় জেনে-বুঝেই নির্দেশ দিয়েছিলেন। অথবা না জেনে নির্দেশ দিয়েছিলেন। মহামারিকালে বা জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ‘নির্দেশ’ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়েছে?
মার্চ মাসে ‘আকস্মিকভাবে’ কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়, তথ্য বিশ্লেষণ করলে বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ হয় না। মার্চ মাসের ৮ তারিখে দেশে কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় এবং সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। শনাক্তও ‘আকস্মিকভাবে’ হয়নি, প্রত্যাশিতভাবেই হয়েছে। সংখ্যাও ‘আকস্মিকভাবে’ নয়, সাধারণ ধারণা অনুযায়ী বেড়েছে।
‘বেসরকারি হাসপাতাল কোভিড-১৯ রোগী ভর্তি করতে চাইছিল না’-এই বক্তব্য খণ্ডিত বা আংশিক সত্য। সম্পূর্ণ সত্য হলো, শুরুতে বেসরকারি হাসপাতাল বা বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতকে কোভিড-১৯ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বেসরকারি কোনো হাসপাতালকে কোভিড-১৯ পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। পরীক্ষা বা শনাক্তের অনুমতি না থাকলে তারা কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা করবেন কীভাবে?
সরকারি প্রণোদনা ঘোষণার ক্ষেত্রেও বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতকে বাইরে রাখা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আইইডিসিআর’র সেব্রিনা ফ্লোরা একাধিকবার ধারণা দিয়েছেন, কোভিড-১৯ পরীক্ষা তারা ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না। বেসরকারি হাসপাতালগুলো কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা করতে রাজি ছিল না, তা পুরোপুরি অসত্য নয়। তবে তাদের বাধ্য করার সুযোগ ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুরের হাসপাতাল দুটি পরিদর্শনে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ’ দেখেছে। জেনেছে লাইসেন্স নবায়ন না থাকার বিষয়টি। লাইসেন্স নবায়ন নেই, এই তথ্য পরিদর্শনে যাওয়ার আগে থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জানা ছিল। কারণ গত ৮ জুলাইয়ের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়েছে ‘তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও তারা লাইসেন্স নবায়ন করেনি’।
আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিশ্চয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের আগেই হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। নির্দেশদাতা ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’কে কি লাইসেন্স নবায়ন না থাকার বিষয়টি জানিয়েছিলেন?
‘চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ’ বলতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কী সাধারণ চিকিৎসার কথা বোঝাচ্ছেন? বিজ্ঞপ্তির ভাষায় তেমনই ধারণা হয়। কারণ কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা বা সক্ষমতা যে রিজেন্ট হাসপাতালের ছিল না, তা তো পরবর্তীতে পরিষ্কারভাবেই জানা গেল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিদর্শন করে রিপোর্টে কী লিখেছিল? সাধারণ চিকিৎসার জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ, না কোভিড-১৯ চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ? আরেকটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা পরিষ্কার করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর?
এবার আসি জেকেজি প্রসঙ্গে। আরিফুল হক চৌধুরী ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘ওভাল’র সত্ত্বাধিকারী। একজন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক এসে বললেন, তিনি জেকেজির প্রধান সমন্বয়কারী-কোরিয়া মডেলে বুথ করতে চান, এ কথার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনুমতি দিয়ে দিল? কোরিয়া মডেলের বুথ স্থাপনের জন্যে একটি প্রতিষ্ঠানের কতটা সক্ষমতা থাকতে হয়, তা নিশ্চয় জানা ছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কি জেকেজি পরিদর্শন করেছিল, তাদের সক্ষমতা যাচাই করেছিল? বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। পরে জানা গেল জেকেজি একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিদর্শনে গেলেই তার প্রমাণ পেতেন। তার মানে পরিদর্শন না করে, যাচাই না করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের নমুনা সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছিল। অথবা স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবায় কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের আরিফুল হক চৌধুরীকে অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো কিছুই অজানা ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছিল, জেকেজিকে কোনো সহায়তা দিতে হবে না। পরে জানা গেল, বিছানাসহ অনেক কিছুই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের সরবরাহ করেছিল।
এখানে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ এসেছে আরিফুল হক চৌধুরীর স্ত্রী ডা. সাবরিনা আরিফুল হকের মুখ দিয়ে। ডা. সাবরিনা জেকেজির চেয়ারম্যান। ‘সময়’ টেলিভিশনকে তিনি বলেছেন, জেকেজির প্রতারণা বিষয়ে তিনি ‘ডিজি স্যার’ ও ‘এডিজি ম্যাডাম’কে আগেই জানিয়েছিলেন। ডা. সাবরিনার বক্তব্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জেকেজির প্রতারণা বিষয়ে আগে থেকেই অবহিত হয়েছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
এই লেখা চলাকালে জানা গেল ডা. সাবরিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও জানা গেল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট এবং হাসপাতাল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। সাহেদ-সাবরিনা-আরিফুলরা কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে। টাকার চেয়েও বড় বিষয়, মানুষের জীবন নিয়ে খেলেছে। সেই খেলার অংশীজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
নজিরবিহীন সমন্বয়হীনতা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকাণ্ডে জনস্বাস্থ্য পরিপন্থী সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা দৃশ্যমান। এসব সিদ্ধান্ত যারা নিচ্ছেন, তারা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থেকে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতেও অস্বচ্ছ, অসত্য বা অর্ধ-সত্য তথ্যের উল্লেখ থাকছে। দায় এড়ানোর প্রবণতা সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে কোনো বিভ্রান্তি দূর হচ্ছে না। পরিণতিতে জাতীয়ভাবে জন অনাস্থা বা অবিশ্বাস বাড়ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। সাময়িকভাবে হলেও বাংলাদেশ ইতিমধ্যে পৃথিবীর একটি বড় অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ‘সাময়িক’ বিচ্ছিন্নতা যাতে স্থায়ী রূপ না পায়, তার জন্যে স্বচ্ছতার সঙ্গে কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।
- কার্টসি - The daily star bangla/ july 12, 2020
No comments:
Post a Comment