Search

Wednesday, July 29, 2020

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও ভোটাধিকার নিয়ে বিএনপির ‘মাথাব্যথা’ কেন

আহাদ আহমেদ

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি’র মূল পরিচয় তারা সার্বভৌমত্বের পক্ষের রাজনৈতিক দল। সার্বভৌমত্ব কথাটার সঙ্গে একটা দেশের শুধুমাত্র ভৌগোলিক স্বাধীনতা বুঝায় না। বুঝায় তার

 

রাজনৈতিক স্বাধীনতা, নিজের শাসক নির্বাচনের স্বাধীনতা,তার সম্পদের উপর দখল ও ব্যবহারের স্বাধীনতা। এর সবকিছু নিয়েই সার্বভৌমত্ব। তাই বাংলাদেশের বন, বাংলাদেশের নদী, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, বাংলাদেশের খনিজ ইত্যাদির উপরে দখল থাকার এবং জনগনের নিয়ন্ত্রণ থাকার অর্থই হলো সার্বভৌমত্ব। অন্যদিকে রাষ্ট্রে একমাত্র জনগণ হলো সার্বভৌম।
জনগণ তার এই সার্বভৌম ক্ষমতার ব্যবহার করে থাকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে। জনগণের ভোটাধিকার হরণ হওয়া আর সার্বভৌমত্বের বিনাশ একই কথা। 

কোন একটি রাষ্ট্রে তার সার্বভৌমত্বের পক্ষে লড়াই করা সেই দেশের জনগণের দেশপ্রেমের মধ্যে পড়ে ও  এটা একান্ত কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে । 

ভারতীয় উপমহাদেশে সত্যাগ্রহ, স্বাধীনতা, স্বদেশী আন্দোলন গুলি আসলে জনগণের সার্বভৌম অধিকার হিসেবে বিবেচিত।এই সব অনেক আন্দোলনে জনগণ জীবন দিয়ে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছিল যেটা ছিল তার সার্বভৌম অধিকার।

সার্বভৌমত্ব মানে জীবনের ওপর অধিকার, ভোটাধিকার, নেতা নির্বাচিত করার অধিকার, সম্পদের ওপর অধিকার। আজকের বাংলাদেশে দেশের জনগণের নিজের জীবনের ওপর তার কোন অধিকার নাই। যে কোনো ঠুনকো অজুহাতে আজ বাংলাদেশের মানুষের উপরে নেমে আসে বিভীষিকাময় অত্যাচার। দেশের ‘স্বনির্বাচিত’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়শঃ তার পিতা-মাতা-ভাই-বোনসহ আত্মীয়  পরিজনদের  হত্যা নিয়ে শোকাভিভূত হন ও কান্না করেন। যা অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। তিনি তখন বিদেশে ছিলেন। কিন্তু কক্সবাজারের  ইকরাম কে যখন হত্যা করা হয় তখন ‘দৈব দূর্বিপাকে’ পড়ে গুলিতে মৃত্যুপথযাত্রী  পিতার গোঙ্গানি শুনতে হয় তার ‘ভাগ্যবতী’ কন্যাদের ও স্ত্রীর।এমন ঘটনা বিরল। এমন কি  নাজী ক্যাম্পেও এই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। দেশে গুম খুন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সব চলছে নির্বিচারে। 
ঢালুর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উজানের দেশের পানি প্রত্যাহারের শিকার। কয়লাভিত্তিক  বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নামে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। জল, জমি, জলাশয় বিষাক্ত বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। সিলেটের নীচু সুনামগঞ্জসহ হাওর বাওর আজ হুমকির শিকার। উত্তরের জনপদে মরুকরণ স্পষ্ট  হচ্ছে। দক্ষিণে লবনাক্ততা গ্রাস করছে। লবন সহিষ্ণু ধান আবিষ্কার এটার সমাধান নয়।
বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে একদিকে ভারত কাটাতারের বেড়া দিচ্ছে। অন্যদিকে মায়ানমার তার দেশের প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এথনিক ক্লিনঞ্জিংয়ের নীতিতে বাংলাদেশের ভুমিতে ঠেলে দিয়েছে। তাই শুধু ভারত নয়, মায়ানমারও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সীমান্তে দাড়িয়েই শুধু  যে সার্বভৌমত্বকে হুমকি দেয়া যায়, তা নয়। আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় স্যাটেলাইট রাষ্ট্রও একটা দেশ  বা অন্য একটি দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকিতে ফেলে দিতে পারে। 


বাংলাদেশে যে মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক নির্ধারণের চেষ্টা করে একটি বিশেষ দল তার প্রতিবন্ধক হিসেবে সামনে এসে দাঁড়ায় দলটির নাম আওয়ামী লীগ। আওয়ামীলীগ একটি ধারণা ভারতের জনমানসে ও তাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দেবার চেষ্টা করে। ধারণাটি হলো আওয়ামীলীগ ব্যতীত প্রায় সব রাজনৈতিক দলই ভারতের বিরুদ্ধে। ভারতের বিরুদ্ধে ও ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে এটির মধ্যে সীমারেখা টানা অত্যন্ত জরুরী।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি যখন ভারতের ব্যাপারে কোন বক্তব্য দেয় তখন সেটাকে ভারতের পক্ষে অথবা ভারতবিরোধী হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে যে বক্তব্য দেয়া হয় সেটা ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। অনেক সময় ভারতের শাসক রাজনৈতিক দল গুলি বাংলাদেশের বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। ফলে সেই দলের সাথে সম্পর্ক রক্ষাই হয়ে দাঁড়ায় ভারতের বাংলাদেশ সম্পর্ক নীতি। এটার সাথে দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্বের, সহযোগিতার কিংবা সম্পর্ক উন্নয়নের কোন দূরবর্তী সম্পর্কও নেই। ভারত যে কারণে নগ্ন হয়ে গণবিচ্ছিন্ন সেই রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের জনগণ তখন আহত হয়। প্রতিবেশী দেশকে তখন তার বন্ধুপ্রতিম ভাবতে অনেক সমস্যা হয়। ভারত একটি দলের হয়ে যখন তার সকল অপকর্ম হত্যা, নির্যাতন, গুম , বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মেনে নেয় বাংলাদেশের মানুষ তখন ভারতকেই তার সাক্ষাতশত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। প্রতিবেশী যখন একটি ইচ্ছা নিরপেক্ষ বিষয় তখন সেই বৃহৎ প্রতিবেশী দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় তার নামে কোন নিপীড়ন যখন অন্য দেশে চলে সেটাকে প্রতিরোধ করা। এই জায়গায় ভারতের প্রতি বিএনপি'র দৃষ্টিভঙ্গি হল যদি ভারত নিজেকে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয় তবে জনতার পক্ষ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা তার নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে দাঁড়ায়।

২০০৫ থেকে ভারত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করছে ইউএসএ'র সেক্রেটারি অফ স্টেট  ২০০৫ সালে ভারতের সঙ্গে এ ধরনের একটা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। একসময় যখন আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ও মুসলমান রাষ্ট্রগুলিকে দেখার জন্য চোখ হিসেবে ব্যবহার করত পাকিস্তানকে। ঠিক একইভাবে ২০০৫ সালের পর থেকে আমেরিকা ভারতকে দক্ষিণ এশিয়া দেখার একটি চোখ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এর পিছনে মূল যে কারণ সেটা হল ভূমিতে চায়না কে ঘিরে ফেলা। ইতোপূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে মধ্য এশিয়ার সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র গুলি ইতোমধ্যেই আমেরিকার সেই লক্ষ্যের সাথে একমত পোষণ করেছে। মোল্দাভিয়া, কিরগিজস্তান, তাজাকিস্তান, উজবেকিস্তানসহ চায়নার সীমান্তবর্তী সব কয়টি সাবেক সোভিয়েতভুক্ত রাষ্ট্রগুলিতে আমেরিকা একটি শক্ত পোক্ত অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। একমাত্র চীনের সীমান্ত জুড়ে  ভারতের স্থল সীমান্ত দখলে ছিল আমেরিকার লক্ষ্য।

আমেরিকা চীনের সীমান্ত জুড়ে স্থল বিভাগে অবস্থান নেয়া একটা মাইন্ড গেইম ছাড়া কিছুই নয়।

ভারত নিজে ১৭২১-১৯৪৯  অবধি প্রিন্সলি স্টেট বা করদ রাজ্যের মর্যাদায়  ছিল। অসংখ্য করদ রাজ্যের সমাহার ভারত। এক সময়ে তোপ রাষ্ট্র ( Gun State) বা স্যালুট (Salute State) রাজ্যের দেখা পাওয়া যেত উপমহাদেশে। শুধুমাত্র তোপধ্বনি বা স্যালুট প্রদানের মধ্যদিয়ে রাজ্যের সম্মান দেয়া হতো।

এইরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া  রাষ্ট্র  ভারত। তাই বিগড্যাডি সুলভ আচরণ তার কাছে কাম্য নয়।
পাকিস্তান তার চেয়ে ৭ গুন বড় দেশ ভারতের সাথে নিউক্লিয়ার ভারসাম্য তৈরি  করেছে। এর অর্থ হলো লড়াইটা  আর অসম থাকে না।পরমাণু সক্ষমতা উভয়ের মধ্যে সমতা এনে দিয়েছে।

কোন নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দুর্বল অনির্বাচিত সরকার গঠন করা ও করতে দেয়াও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। এই কাজ যদি আজ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, নেপাল বা চায়না করে  তবে সেই দেশগুলিও হবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের শত্রু। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে যে কোন পরিসরে চ্যালেঞ্জ করলে সেটা নামে যে দেশই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে কথা বলা একটা দলের জন্য দায়িত্ব হয়ে পড়ে।

বিএন পি ও দেশনেত্রী  বেগম খালেদা জিয়া তাই বলেছিলেন বাংলাদেশকে পাকিস্তানী কায়দায় চালাচ্ছে আওয়ামীলীগ। বিএনপি একটি বাংলাদেশপন্থী রাজনৈতিক দল। আজ তাই একটি বৃহৎ  ঐক্যের ওপর জোর দেয়া দরকার। ভবিষ্যতের এই ঐক্যের ভিত্তি  হবে বাংলাদেশপন্থীতা। এই ঐক্য  তাদের সাথেই হবেঃ

 ১.যারা বাংলাদেশের পক্ষে  ও তার জনগণের ভোটাধিকারের পক্ষে
২.যারা আওয়ামীলীগের  আদালত বুভুক্ষার (Court Hungriness) বিপক্ষে 
৩.যারা বিনাবিচার-অবিচার-অতিবিচারের নামে বিচারহীনতার বিপক্ষে
৪.যারা বিচার বহির্ভূত ও গুম খুনের বিরুদ্ধে
৫.যারা বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক জলবায়ু, জমি, জলাশয়,পরিবেশ রক্ষার পক্ষে
৬. সর্বোপরি যারা অন্যায়ভাবে বানোয়াট মামলা দিয়ে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার ও  মিথ্যা মামলায় কারাবন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে
অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলির সাথে সার্বভৌমত্ব মানে জীবনের ওপর অধিকার। ভোটাধিকার, নিজের নেতা নির্বাচিত করার অধিকার, সম্পদের ওপর অধিকার নিয়েই এই ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

সরকার বলতে আওয়ামীলীগের  হাতে এখন কিছু নেই যেটা আছে সেটা সরকারের মমি। যার সব আছে শুধু প্রাণ নেই।

বাংলাদেশ  ও জনগণ সার্বভৌম না হলে এদেশের, রাষ্ট্রের  উন্নয়নের গল্প ফানুসে পরিণত হবে।পাশের বড় ‘বন্ধু প্রতিম’ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে একটা অসফল ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ ফেইল্ড  বা অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে দেখানো। এর মধ্য দিয়ে সে তার  নিজ দেশের অখণ্ডতা বজায় রাখতে চায়। তাই যে কোন দেশপ্রেমিক নাগরিকের  দায়িত্ব বাংলাদেশকে গনতন্ত্রের বহুত্বের পরিমাপে অনেক বেশি স্বাধীন ও সার্বভৌম  রাখা। বিএনপি এই লক্ষ্যে কাজ করে তার নেত্রী চরম প্রতিংসার মুখেও ভেঙ্গে পড়েন না, অবিচল থাকেন। এটাই বিএনপির শক্তির জায়গা। এইসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ  যে কোন সময় গণবিক্ষোভে ফেটে পড়বে তার আলামত স্পষ্ট  হচ্ছে।
  • লেখক কেমিস্ট এবং রাজনীতিবিদ 

No comments:

Post a Comment