Search

Sunday, November 22, 2020

তারেক রহমান — নেতা, নেতৃত্ব ও বাংলাদেশ

—  আহাদ আহমেদ 




নভেম্বর ২০, ২০২০ — বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান’র  শুভ ৫৫তম জন্মবার্ষিকী। দেশবাসী শুভেচ্ছা জানায়, ভালবাসা জানায় তাদের প্রিয় এই নেতাকে!বাংলাদেশের সব চাইতে জনপ্রিয় রাজনৈতিক   ব্যক্তিত্ব  শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় সন্তান ও মাটি মানুষের  নেতা তারেক রহমান। 

সংবিধানে বা আইনের কোথাও ফ্যানের সাথে, সিলিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে হাত পা বেঁধে ওপর থেকে ফেলে দেয়ার বিধান কী আছে? ইতোপূর্বে কোন জাতীয় নেতাকে এমন শাস্তিভোগ করতে হয়েছে? মেরুদণ্ডের ক্ষতি করে নাগরিককে পঙ্গু করার বিধান কি আছে সংবিধানে? শাসকের ইচ্ছাই কি মামলার ভিত্তি হতে পারে? একদম অবাক শোনালেও এর সব হয়েছে বাংলাদেশে। আর এই ভয়ঙ্কর অন্যায়, জুলুমের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি  জিয়াউর রহমান ও চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিএনপির ৩৫ লক্ষ নেতাকর্মীও এই জুলুমের শিকার মামলায়-হামলায়। যদি জুলুমের পরিমাপ করা হয় তবে আধুনিক রাজনীতির ইতিহাসে তারেক রহমানের চেয়ে বড় কোন রাজনৈতিক নেতা পাওয়া যাবেনা। তারেক রহমান নিজে ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মানবাধিকারহরণের শিকার তালিকায় সবার ওপরে আছেন।

নেতৃত্বের বয়স  বিতর্ক 

বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বয়স নিয়ে এক কিম্ভূতকিমাকার ধারণা বিদ্যমান। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক তাঁর কথোপকথনে (প্রফেসর সরদার ফজলুল করিম এর সাথে) বলেছিলেন,যে লোকের বয়স ৭০ বছর তাকে আগামীর স্বপ্নের কথা বললে সে তার বয়সের সীমাবদ্ধতার কারণেই বেশী দূরে দেখতে পাবেনা। তাই এই দেখার বিষয়টা ৩০ বছরের হাতে ছেড়ে দিতে হবে যে সামনের ৭০ বছরকে দেখতে পাবে। এটা তাঁর একটা বক্তব্য, যেখানে দেখার চোখের চেয়ে কল্পনা শক্তির গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার বিরুদ্ধে যখন কোন যুক্তিসঙ্গত  সমালোচনা দাড় করানো যায় নি। কোন অভিযোগ যখন ভিত্তি পাচ্ছিল না,তখন তার চরিত্রহণন হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র ক্ষেত্র। পরিশেষে, অভিযোগটা এখানে এসে দাঁড়ায় যে-  তারেক রহমান রাজনীতিতে ‘শিশু’!! ‘তিনি যথেষ্ঠ  সাবালক নন’ — এসব খেলো যুক্তি। এই আলোচনার কি জবাব হতে পারে। এটার জবাব ইতিহাসের কিছু তথ্য হতে পারে।

তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর।এখন তার বয়স ৫৫ বছর। ২০০২ সালে তিনি যখন  দায়িত্ব নেন দলের একটি পদে তখন তার বয়স ৩৭ বছর। তিনি ২৯ বছর বয়সেই আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান চালান। তার দক্ষতার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন ২০০১ এর অক্টোবরের  জাতীয় সংসদ নির্বাচন সাফল্য এনে দিয়ে। তিনি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০০২ সালেই। তার মানে দাঁড়ায় রাজনৈতিক পরিবারের আবহে থেকে তারেক রহমানের নিজস্ব রাজনৈতিক জীবনের দৈর্ঘ প্রায় ৩০ বছর তথা তিন দশক।

যারা তার বয়স ও ‘সাবালকত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন তাদের জন্য বলা যায় একটু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনাসহ রাজনৈতিক নেতাদের দিকে দৃষ্টিপাত করুন।

রাজনীতিকদের বয়স

শেখ মুজিবুর রহমান জন্ম নেন ১৭ মার্চ ১৯২০ সালে। ১৯৪৭ সালে বিএ পাশের বছর তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে একজন মুসলিম রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হন।  তখন তার বয়স মাত্র ২৭। মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৯৪৯ সালে তিনি ভাসানীর নেতৃতাধীন  আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক হন। তিনি মাত্র ৩৬ বছর বয়সে পাকিস্তানে মন্ত্রীত্ব লাভ করেন।

শহীদ প্রেসিডেন্ট  জিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি ১৯৩৬ সালে ১৯ জানুয়ারী জন্ম গ্রহন করেন।তিনি ৩৫ বছর ৩ মাস বয়সে পাকিস্তানের  সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের  মেজর হিসেবে বিদ্রোহ করেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। তার এই ঘোষণার বিবরণ ভারতের প্রথম বাংলাদেশ মিশন প্রধান  জে.এন দীক্ষিত এর লিবারেশন এন্ড বিয়ন্ডঃ ইন্দো- বাংলাদেশ রিলেশন্স এ বিস্তারিত এসেছে। এর অনেক স্বাক্ষী আছে মইদুল হাসান তার উপধারা একাত্তরঃ মার্চ-এপ্রিল এ লিখেছেন। জাতীয় সংসদের ২০০৯ এর এক অধিবেশনে জাসদ নেতা মঈনুদ্দীন খান বাদল শহীদ জিয়ার ঘোষণার কথা বলেছেন। সিপিবির সভাপতি মঞ্জুরুল 

আহসান খান সাক্ষাৎকার  দিয়েছেন এই ব্যপারে। আর এর সাথে নিজের কানে শোনা সেই লক্ষ লক্ষ জনতা। ৪০ বছর বয়সে সেনাপ্রধান হন। মাত্র  ৪১ বছর বয়সে ১৯৭৭ সালে ২১ এপ্রিল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট  হন। ৪৫ বছর বয়সেই প্রেসিডেন্ট  জিয়া একটি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রধান নেতায় পরিনত হন। তিনি অপরিনত বয়সে এক হত্যাকাণ্ডের  শিকার হন।

বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহন করেন। তিনি ১৯৮২ সালের  ৩ জানুয়ারি  বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ২৮ নভেম্বর ১৯৮৩, ৩ মে ১৯৮৪, ১১ নভেম্বর ১৯৮৭, ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ (তারেক রহমানসহ) ও ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ এই ৫ বার বেগম খালেদা জিয়া  কারাবরণ করেন।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তার মত এত কারাবরণের শিকার কেউ হয় নি। এরশাদ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগের   প্রতিহিংসার শিকার এই রাজনৈতিক  পরিবার। বেগম খালেদা জিয়া ৩৯ বছর বয়সে ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিএনপির মত একটি বিশাল রাজনৈতিক  দলের চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব নেন। তিনি রাজপথে লড়াকু দল হিসেবে গড়ে তোলেন বিএনপি। তিনি ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর  থেকে ৭ দলীয়  জোটের মাধ্যমে স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলন  গড়ে তোলেন। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তিনিই মধ্যপন্থী মুসলিম প্রধান দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাসের স্বচ্ছ ভোটে নির্বাচিত হন । নিউজউইক সম্পাদক ফরিদ জাকারিয়া তার এক নিবন্ধ - ‘Why do they hate us’ এ  এই বিষয়ের প্রতি তাবৎ বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ  করেন। 

শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালে- শেখ মুজিবুর রহমান যে বছর ডিগ্রী পাশ করেন সেই বছর ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহন করেন। তিনি তার বয়স ৩৪ হবার আগেই ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামীলীগের সভানেত্রীর  দায়িত্ব নেন। শেখ হাসিনা ৪৮ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহন করেন।

আমাদের বুদ্ধিজীবি মহলে আরেক সাংস্কৃতিক বৈকল্য কাজ করে। এরা  এমনভাবে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন, যেন সবাই তাদের বয়সে ছোট একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রেসিডেন্ট জিয়ার চেয়ে বয়সে এক বছরের ছোট ছিলেন। জিয়ার একুশে পদক প্রবর্তন এনাদের মহিমান্বিত  করেছে। কবির চৌধুরী  জিয়ার চেয়ে বয়সে প্রায় ১২ বছরের বড় ছিলেন। শামসুর রাহমান ছিলেন ৭ বছরের বড়। আহমদ ছফা ছিলে বছর সাতেকের ছোট। আর হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন জিয়ার ১২ বছরের ছোট। এই সব ব্যক্তিদের মধ্যে হুমায়ুন আহমেদ অনেক নিরপেক্ষ মুল্যায়ন করেছেন জিয়ার।

রাষ্ট্রনায়ক জিয়া থেকে তারেক রহমান

জেমস স্মিথ একজন ব্রিটিশ ফ্রীল্যান্সার সাংবাদিক। তিনি তারেক রহমানকে যেভাবে মুল্যায়ন করেন সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার ভাষায়, তারেক রহমান বাংলাদেশের প্রথাগত নেতাদের থেকে ভিন্ন কিন্তু তার প্রয়াত পিতার অনেক কাছাকাছি। আর সেটা হলো মাত্র সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশের গ্রাম, নদী, মানুষকে  চাক্ষুষ করেছিল প্রেসিডেন্ট জিয়া। মাইলের পর মাইল হেটে মানুষকে বোঝার চেষ্টা ছিল তাঁর নিরন্তর। মানুষের  দুঃখ বেদনা ও চাওয়া পাওয়ার সাথে সম্পর্ক  গড়া। বাংলাদেশের মানুষের কষ্ট, তার ওপর হামলায় প্রথম যে তৎকালীন তার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে যুদ্ধ ঘোষণা  করেছিলেন। তিনিই জিয়া,শহীদ জিয়া। ঠিক পিতার দেখানো পথেই হেটেছেন তিনি। একদম মুলে, তৃনমূলে ছুটে গেছেন তিনি। নেতাদের বাসায় বসে ‘সাক্ষাৎ’ দেবার রাজনীতিকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন ৬৪ জেলায় ২০ টি রাজনৈতিক  অঞ্চলে। নেতারা মঞ্চে বসে মাটির সাড়া ও শব্দ  শুনেছেন।

জেমস স্মিথ এও বলেছেন যে, যদি জনগনকে তার অধিকার ও ক্ষমতা সম্পর্কে  সচেতন করা যায় তবে তার প্রতিফলন  ঘটে রাজনৈতিক  প্রক্রিয়া ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে। তারেক রহমান জনতার ক্ষমতায়ন  করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন জিয়ার এই মানুষের কাছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাবার কারণেই তাকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছিল। কিন্তু তার অসময়ে প্রস্থানের পর তার জানাজায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ  জমায়েত হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া যখন ২০১০ সালে সারাদেশব্যাপী  রোডমার্চ করেছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ  রাত জেগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে। সরকারের বিরুদ্ধে জনগনের এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ  দেখে  ভারত দাওয়াত দিয়ে নিয়েছিল তাকে। কিন্তু জামাত ও কিছু দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ায় সেই কূটনৈতিক তৎপরতা  বাধাগ্রস্থ  হয়। ভারত প্রত্যক্ষ অবস্থান নেয় বিএনপির বিরুদ্ধে। আন্দোলনকে সরকারের গোয়েন্দা তৎপরতায় নিশ্চিহ্ন  করা হয়। অর্থাৎ  বিএনপি যখনই তৃনমুল রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে তখনই তার ওপর হামলে পড়া হয়েছে।

উন্নয়ন ধারণা ও তারেক রহমান

স্মিথ উল্লেখ করেছেন, তারেক রহমান  ১৯৯৬- ২০০১ এর আওয়ামীলীগ সরকারের ভয়াবহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যুক্তিসংগত রাজনৈতিক প্রচার  চালিয়েছেন। তিনি তার পিতার মতই  দেশব্যাপী ব্যপক পরামর্শ সভা করেছেন। তিনি তার সফরের সময়ে জনতার  জীবনমান উন্নয়নের  জন্য কৃষকের জন্য বীজ,সার, হাস-মুরগী- ছাগল বিতরণ  করেছেন।সর্বোপরি তিনি তার হাসি দিয়ে কৃষককে উজ্জীবিত  করেছেন।এই পরামর্শ সভার সরাসরি ফলাফল হলো ২০০১ এর বিএনপির ভূমিধসবিজয় ও সরকার গঠন।সবাই চেয়েছে তিনি নেতৃত্ব দিক।কিন্তু তারেক রহমান সলাজ দুরত্ব রেখে জনতার কাতারে তাদের কাধে কাধ রেখে চলেছেন।

তারেক রহমান আদর্শ  হিসেবে ইতো  মধ্যেই  ঠিক করেছিলেন তিনি পিছিয়ে পড়া কৃষি  ও কৃষককে আর্থিকভাবে নিরাপদ করবেন। দারিদ্র্যের অভিশাপ বিমোচন করবেন। এই কাজের অংশ হিসেবে পশুপালন ও সম্পদ  সাহায্য নিয়ে তিনি গ্রামীন জনগোষ্ঠীর পাশে দাড়িয়েছেন। ছোট বড় পোল্ট্রি , মাছ চাষ, পশুখাদ্যের আমদানীবিকল্প শিল্প গড়তে সহযোগিতা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন।২০০১-২০০৬ মেয়াদে পোল্ট্রি শিল্পে এক নিরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এর সব  ছিল তারেক রহমানের মাটিমুখীনতার রাজনীতি। এখনকার সরকার কোন অসামান্য কাজ সাধন করেনি। এরা শুধুমাত্র উপভোগ করেছে। যেমন  বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের গোড়াপত্তন  জিয়ার হাত ধরে। রেমিট্যান্সের গোড়াপত্তন শহীদ জিয়ার হাত ধরে। কিন্তু এই বিকাশের পতপত উড়ানো পতাকার ভিত্তির কথা কেউ বলে না। ঠিক তেমনি আজকে সারাদেশে এই যে সহজলভ্য ডিম, মুরগীর মাংশ তার কৃতিত্ব খালেদা জিয়ার-তারেক রহমানের নীতির। পেটে খেলে পিঠে সয় এই নীতির কারণেই ২০০৭-২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী যখন মন্দা, বাংলাদেশে তার হাওয়া লাগেনি-সেটার কারণও জিয়ার শাসনামলে নেয়া কৃষিনীতি আর ১৯৯১ সাল থেকে খালেদা জিয়ার নেয়া কৃষিবান্ধব নীতি। এই নীতির স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে ২০০১- ২০০৬ সালের মৎস, পোল্ট্রি ও শষ্যবহুমুখীকরণ প্রকল্প।

শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রসারে তারেক রহমান

তারেক রহমান ছাত্রদের শিক্ষা সহায়তা প্রকল্প নিয়ে শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ গ্রহন করেন। এক্ষেত্রে তিনি কোন দলীয়করণ  প্রশয় দেন নাই। তৃনমুল  সম্মেলন আয়োজন  করে তিনি যৌতুকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, জন্মনিয়ন্ত্রণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। পরে এর ভিত্তিতেই নীতিমালা গৃহীত হতো। ফলে এই গৃহীত  নীতিমালার ভিত্তিও ছিল তৃনমুল ধারনা। যেমন জেমস স্মিথ উল্লেখ করেছেন, উদাহরণ দিয়েছেন যে বাংলাদেশের ৫ শতাংশ মানুষ এজমারোগে ভুগতো যে তথ্য তারেক রহমান তৃনমুল সম্মেলন থেকে গ্রহন করেন। তখন সারাদেশে মাত্র একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল ছিল।তিনি এক বছরের মধ্যে দুইটি কেন্দ্র গঠন করেন।

স্মিথ বলেন তারেক রহমান শুধু বর্তমানকেই নিয়েই  থাকেন না। তিনি শিক্ষা ও যুবসমাজের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ দেখেন। এইসব  গুনাবলী কিন্তু আওয়ামীলীগের চোখে অপরাধ। তারেক রহমান তার প্রাগ্রসর চিন্তা দিয়ে ধ্বসিয়ে দিয়ে ছিল আওয়ামীলীগের সাজানো পরিকল্পনা। তাই তারা তারেক রহমানের প্রতি ক্ষমাহীন।

স্বৈরাচার বিরোধী তারেক রহমান

তারেক রহমানকে পঙ্গু করে ফেলা, রাজনীতিতে অপাঙতেয় করে তোলা ছিল দেশী ও বিদেশী চক্রান্তের অংশ। চক্রান্তে অস্বীকৃতি জানানোর পরিনামে ৩১ ডিসেম্বর ২০০৭ এ অবৈধ সেনাসমর্থিত উদ্ভট সরকার তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে। এরপর তার ওপর চালানো হয় মধ্যযুগীয় বর্বর নির্যাতন। তিনি গুরুতর স্পাইনাল ড্যামেজের শিকার হন।তাকে প্রয়োজনীয়  চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয় যাতে তিনি পঙ্গু হয়ে যান। আধুনিক রাজনীতির ইতিহাসে এই ধরণের প্রতিহিংসামূলক নির্মমতার শিকার কোন রাজনৈতিক নেতা হন নাই। তাই তারেক রহমান হলেন এক নির্যাতিত নেতার প্রতিকৃতি।

জেমস স্মিথ আরো বলেন-তারেক রহমান সব সময় বিশ্বাস করেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তার  মাটির কাছাকাছি জনতার হাতে,তৃনমুলের হাতে। তিনি তাদের নেতা একদম নিচ থেকে উঠে আসা এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনায়ক। 

তৃনমূল ও বিএনপির অখন্ডতায় তারেক রহমান

রাজনীতিকে তারেক রহমান যে তৃনমুলে নিয়ে গেলেন তার ফলাফল কি? এই ফলাফলের জন্য বাংলাদেশকে ১৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর উত্তর হলো ২০০৬ এর ২৮ অক্টোবর লগি লাঠি বৈঠা  থেকে অদ্যাবধি সেনাসমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার ও এরই ধাবাহিকতার আওয়ামী মহাজোট সরকার’র রাজনীতি। এই জবরদস্তির সরকারের ধারাবাহিকতায় গত ১৪ বছরে (২০০৭-২০২০) আওয়ামী লীগ  তার সাথের, জোটের, ভোটের সব দলকে টুকরায় পরিনত করেছে। আওয়ামী লীগ এদের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, দিলীপ বড়ুয়া, ইমরান এইচ সরকার, মওলানা শফি হুজুর, ভিপি নুরুল হক নুর কেউ বাদ যায় নি এই ভাঙ্গন থেকে। শুধু তাদের সাফল্য আসেনি বিএনপির ক্ষেত্রে। বিএনপিকে রাজনৈতিক ক্লিঞ্জিংয়ের শিকার হতে হয়েছে,৩৫ লক্ষ নেতাকর্মী ও মামলায় আক্রান্ত দলটি। রুটি রুজিতে হামলার শিকার হয়েছে নেতাকর্মীরা। কিন্তু দল ভাঙ্গতে পারে নি। এটাই তারেক রহমানের তৃনমুল রাজনীতির সাফল্য। এটা ঠিক দল ক্ষমতায় থাকলে সুযোগ-সন্ধানী ও ব্যাপারীর দল ঘিরে ফেলে। কিন্তু অনেক অত্যাচার করেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমান করা সম্ভব হয় নাই।

তারেক রহমান ও মাটিমুখীনতা

চীনা দার্শনিক ও পন্ডিত কনফুসিয়াসকে ৫০০০ বছর আগে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এত যে বিপুল জনগোষ্ঠী  এ নিয়ে কি করা যায়? উত্তরে তিনি বলেছিলেন - এদের ধনী বানাও আগে। তারপর? এরপর এদের শিক্ষিত করো, জ্ঞানী বানাও। কনফুসিয়াস  বলেছিল, " Don't want to do things quickly and don't seek petty gains.You cannot reach your goals if you want to be quick and you you cannot accomplish great things if you seek petty gains."

এছাড়াও সরকার নিয়ে কনফুসিয়াসের বেশ কিছু ধারণা চীনের বুদ্ধিমান নেতারা কাজে লাগিয়ে চীনকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক (Meritocratic) রাষ্ট্রে পরিনত করেছে। কনফুসিয়াস অতি ঘনত্বের দেশে জনগণকে প্রথমে ধনী করার কথা বলেছেন, এরপর বলেছেন শিক্ষিত করার কথা।  ‘What a dense population! Make them rich." ধনী বানিয়ে এই জনতাকে দিয়ে কি করবেন?  এই প্রশ্নের উত্তরে কনফুসিয়াস  বলেন,  ‘Educate them’।  

রাজনৈতিক নেতৃত্বের  ধারাবাহিকতা 

বিবিসি সাংবাদিক এলেস্টেয়ার লসন  লিখেছিলেন - তারেক রহমানের বাবা ও মা দুজনেই বাংলাদেশের নেতৃত্ব  দিয়েছেন। "বাংলাদেশের মানুষ  বলে, জিয়াউর রহমান আমাদের নেতা ছিলেন,খালেদা জিয়া আমাদের নেতা এবং তারেক রহমান  আমাদের ভবিষ্যৎ নেতা"। এখানে অত্যুক্তি কিছু নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভিত্তি কি শেখ মুজিব নয়? এই যে জনতার প্রচার-লক্ষ কোটি মানুষের  আকাঙ্খা - তারেক রহমান তাদের নেতা এটা অসত্য নয়। এটাই সত্য। তারেক রহমান বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই  দলের নেতা হবার লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠেছেন। যে সব কারণে অন্যান্য রাজনৈতিক পরিবারে নেতৃত্বের  সংস্কৃতি গড়ে উঠে তার ব্যতিক্রম তার ক্ষেত্রে কেন হবে?  মতিলাল, জওহরলাল নেহেরু পরিবারে ইন্দিরা-রাজীব-রাহুল যেভাবে বিকশিত হয়েছে সেই একই পথ ধরে মুজিবের রাজনৈতিক  উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা। আর একই নিয়মে  তারেক রহমানও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, তিনি কোন ব্যতিক্রম নন। এখানে নেপোটিজমের প্রশ্ন অবান্তর।

উপমহাদেশে রাজনৈতিক দলের ঐক্যের  কেন্দ্র ( Center of Unity) এখনো পরিবারগুলো ধরে আছে।এটা ভাল বা মন্দ এই বিবেচনার ভিত্তি পশ্চিমের মতামত হতে পারে না। পশ্চিমের কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য সংখ্যা উপমহাদেশের একটি দলের রাজনৈতিক জেলার সদস্যের সমানও নয়। তাই ভিন্ন সাংস্কৃতিক মানের কোটি সদস্যের দলের ঐক্য  "লিবারেল" ধারণা দিয়ে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। যে কারণে উপমহাদেশে কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রীরা জড়ো হবার আগেই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র ধারায়  বিভক্ত হয়ে পড়ে।

অসম বিচারের শিকার নেতা

২০০৪ সালে দি ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এক সম্পাদকীয় লেখেন। সেখানে তিনি তারেক রহমানের অনেক সমালোচনা করেন। এই সমালোচনা ছিল এরকম যে, বেগম খালেদা জিয়া তার ছেলেকে  রাজনীতিতে এনে ঔদ্ধত্যের (Audacity) পরিচয় দিয়েছেন। কারণ তার যুক্তিতে তারেক রহমান তখনও তার চোখে ‘নাবালক শিশু’।এই চিন্তার ধরণের একটা ব্যখ্যা হলো এটা একটা রোগ - যার নাম বিচ্ছিন্নতা (Alienation)। এই চিন্তার ফলে মাহফুজ আনাম তার সমবয়সী ছাড়া কাউকে ধর্তব্যের মধ্যে নেবে না। তিনি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন এভাবে- "তিনি নিরলসভাবে পুরানা নেতাদের সরিয়ে তার বলয়ের নেতাদের মাধ্যমে নেতৃত্ব  প্রতিষ্ঠা করতে চান"।এই মাহফুজ আনামরা কি  শেখ হাসিনা বা সজিব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে এমন মন্তব্য করতে পারবেন?  

প্রচারবিমুখ  তারেক রহমান

তবে প্রথিতযশা  অনেক সাংবাদিক তারেক রহমান সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, তিনি পিছনে থেকে অনেক কাজ করতেন। নাম ফুটানোর বাতিক তার ছিলনা। তিনি খুব বিখ্যাত ছিলেন তার স্বল্পভাষিতার জন্য। তার গ্রেপ্তার ও নির্যাতন সমালোচিত হয়েছে। কারণ তার বিরুদ্ধে আনীত দূর্নীতির কোন অভিযোগ প্রমানিত হয় নাই এবং তাকে বলির বকরা (scapegoat) বানানো হয়েছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে  গণমাধ্যমে অতিরঞ্জন  ও ফাপিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হতো। কিন্তু এইসব ভিত্তিহীন অভিযোগের সবগুলিই ছিল সত্য থেকে অনেক দূরবর্তী। প্রফেসর আসিফ নজরুল যেমনটা বলেছিলেন যে,সরকারের উচিৎ তার বিরুদ্ধে কি কি দূর্নীতির অভিযোগ আছে সেটা জানানো।

জবরদস্তির শাসনামল ও তারেক রহমান

একটা গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের ভিত্তি হলো জনতার আকাঙ্খা। তাই এই আইন প্রনয়ন হবার আগে সেটা সংসদে বিল আকারে উত্থাপিত হয়। নিয়ম হলো চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া,বিতর্ক হওয়া এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সেটা গৃহীত হওয়া। এর পরের ধাপ, সেটা প্রেসিডেন্টের  অনুমোদনের জন্য পাঠানো।প্রেসিডেন্ট  অনুমোদন দেক বা না দেক সেটাই পরে আইনে পরিনত হবে। এটাই সংসদীয় পদ্ধতির নিয়ম। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন  হলে এবং সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একক ব্যক্তি হিসেবে প্রেসিডেন্টের হাতে জমা হয়।এখানে সংসদীয় ব্যবস্থা বলে একটা ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু সংসদে গৃহীত বিল আইন হিসেবে অনুমোদন -পুরোই  নির্ভর করে প্রেসিডেন্টের ওপর। ব্যবস্থাটির নাম  প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতি।

বাকশালী শাসনের শিকার বাংলাদেশ

বাকশাল ব্যবস্থার সমালোচনা যারা করেন তারা শুধু এর একদলীয় বিষয় নিয়েই বলেন বা এর নীপিড়নমূলক বিষয় হাইলাইট করেন। কিন্তু বাকশালের গুরুত্ব ও ভয়ংকর দিক হলো এর আইনী কাঠামো। এখনো আকাশ থেকে পড়ার বাকীই আছে! সবাই জানেন যে, ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ  পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট  ইয়াহিয়া খান LFO বা ‘লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক’ ইস্যু করেন যেখানে ৫ দফাকে  ‘মৌল নীতি’ (Fundamental Principles)  হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেখানে রাষ্ট্রের ফেডারেল প্রজাতান্ত্রিক চরিত্র, ইসলামী আদর্শ  ও স্বায়ত্তশাসন নিয়ে অনেক বাগাড়ম্বর ছিল। স্বায়ত্বশাসন নিয়ে যা বলা ছিল, সেটাকে Quid Pro Quo বা  এক হাতে দিয়ে অন্য হাতে ফিরিয়ে নেবার মত! এলএফওতে বলা হয়েছিল - "ফেডারেল  সরকারের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকবে - যার মধ্যে সংসদীয়, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক  ক্ষমতা অন্তর্ভুক্ত থাকবে যা দিয়ে আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা রক্ষা করা যায়"। (Bangladesh: A Struggle for Nationhood by Mohammed Ayoob* Anirudha Gupta*Rahmatullah  Khan* GP Despande* R Narayanan* Sisir Gupta,  1971, Vikas Publication, Delhi,India page - 33-34, This part written by  Mohammed Ayoob at his Article named - Background and Developments)। এই পুস্তকের লেখকেরা জওহেরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক  ছিলেন। এপ্রিল ১৯৭১ সালেই এই বই লিখিত হয় - অনুবাদক)। দুইটি অধ্যায় বিশেষত ২৫ ও ২৭ নিয়ে পুর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। যার মুলে ছিল ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রনয়ন ও এলএফও-এর ব্যখ্যা নিয়ে। ২৫ নম্বর অধ্যায়ে বলা ছিল - সাংবিধানিক বিল সংসদে পাশ হলেও তার চূড়ান্ত অনুমোদন একমাত্র প্রেসিডেন্ট প্রদান করবেন। যদি প্রেসিডেন্টের সেই অনুমোদন/অস্বীকৃতি  সংসদে প্রত্যাখ্যাত হয় তবে প্রেসিডেন্ট  সংসদ ভেঙ্গে দিতে পারবেন!! 

২৭ নম্বর অধ্যায়ে বলা ছিল-"LFO সংক্রান্ত  যে কোন প্রশ্ন বা সন্দেহ পোষন করা হলে  একমাত্র প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে এবং কোন আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যাবেনা"। এখানে এমনও যুক্ত ছিল যে-"প্রেসিডেন্ট বা জাতীয় সংসদ এই আদেশের কোন সংশোধনী  আনতে পারবে না"(ibid, page 34)।

এখন কি বাকশাল ব্যবস্থার সাথে ইয়াহিয়ার এলএফও-এর কোন মিল খুজে পাওয়া যায়? যারা বাকশালকে মহান করে কিংবা বিরোধীতা করে সবাই এই মৌলিক বিষয়  এড়িয়ে যায়। ফলে বাকশালওয়ালাদের কাছে সেটা দেখা দেয় ‘দ্বিতীয়  বিপ্লবের  কর্মসূচী’ হিসেবে।। আর বিরোধীতাকারীদের কাছে শুধুই ‘একদলীয় শাসন’  হিসেবে।আসলে বাকশাল হলো ইয়াহিয়ার এলএফও -এর প্রেতাত্মা শুধু মোড়কটা ভিন্ন।

 

আইন বিচারবুভুক্ষা ও মামলার শিকার তারেক রহমান

আইনের  ভিত্তি নিয়ে কথা হলো। কিন্তু বিচারের ভিত্তি কী হবে? বিচারের ভিত্তি হবে আইন। তাই পরিশেষে, বিচারের ভিত্তি আসলে জনগনের আকাঙ্খাই হয়।

তারেক রহমান আধুনিক রাজনৈতিক  ইতিহাসে সবচাইতে  নির্মম রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও সবচাইতে বেশী মামলার শিকার। প্রায় ৩৪ টি মামলার শিকার হয়েছেন তিনি। এসব মামলায় রাষ্ট্রের সংক্ষুব্ধতা লক্ষনীয়।মামলা সমুহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ — 

  • ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর ক্যান্টনমেন্ট থানায় দায়ের করা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা। ২০১১ সালের ৬ জুলাই এ মামলার বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৩ তারেক রহমানকে খালাস দেন। উচ্চ আদালত ২০১৬ সালের ২১ জুলাই নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন।
  • ২০০৮ সালের ৩ জুলাই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তারেক রহমানকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক আখতারুজ্জামান ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন।
  • দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা (মামলা নং ২৯/১১ ও ৩০/১১) 
  • গুলশান থানার ৩৪(৩)০৭ নম্বর দ্রুত বিচার আইনে দায়ের করা মামলা বিচারাধীন। 
  • ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ১২৩৩/১৪ নম্বরের মামলাটি। 
  • ৯৫৪/১৪, ৮৪১/১৪, ৩৮০/১৫, ৭২০/১৫ এবং ১৯৬/১৫ নম্বর মামলা রয়েছে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে বিচারাধীন।
  • মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ৩৮০/১৪ নম্বর মানহানির মামলা। 
  • ঢাকার অন্যান্য আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ১৯৬/১৫, ৬১৭/১৫, ৯৪১/১৫ ও ৩৯৩/১৪ নম্বরের মামলা। 
  • গুলশান থানার ১০২(৩)৭ ও ১৩(৫)০৭ নম্বর মামলা এবং কাফরুল থানার ৫২(৯)০৭ ও ৬৮(৩)০৭ নম্বর মামলাটি  তদন্তাধীন রয়েছে।
  • কাফরুল থানায় ২০০৭ সালে দায়ের করা (মামলা নং ১৭/২০০৭) চলছে।
  • ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে দায়ের করা (১৫৫৮২/১৭) রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা চলমান রয়েছে। 
  • ঢাকার সিএমএম কোর্টে চারটি মানহানি মামলা (৪৯৯/৫০০ ধারায়) চলমান।

 

জনগণের নেতা তারেক রহমান

দুই দশটি মামলা, বার কয়েক পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদ ও জেল ঘুরে এলেই ভারতীয় উপমহাদেশে ‘কারানির্যাতিত’ নেতার মোহর পড়ে যায়। এর মধ্যে নির্যাতন যে নেই,অবশ্যই  আছে। কিন্তু যে শারিরীক  নির্যাতনের শিকার তারেক রহমান হয়েছেন তার তুলনা হতে পারে না। উপমহাদেশ কেন সারাবিশ্বেই তার তুলনা নেই। এটাকে কোন যুক্তিতে যুক্তিযুক্ত যারা করে, তারা আসলেই ঘাতকের দল। যারা মনে করেন নেতৃত্ব পায়ে হেটে তারেক রহমানের কোলে চড়ে বসেছে তারাও পক্ষান্তরে অন্যায় ও জুলুমেরই সমর্থক। কঠিন অগ্নিপরীক্ষা  দিয়ে তারেক রহমান বাংলাদেশের  জনগনের নেতা।


লেখক রাজনীতিবিদ । 

তথ্যসুত্র —  

Political Thoughts of Tarique Rahman: Empowerment of the grassroots people

2.Sayings of Confucious,Compiled and Translated  Ding Wangdao,13.17)

Sayings of Confucious,Compiled and Translated by Ding Wangdao,13.9)


Friday, November 20, 2020

বাংলাদেশ তাঁর এই জন্মক্ষণে , তাঁরই ফেরার অপেক্ষায়

—  আজিজুল বারী হেলাল 


কিছুই হচ্ছে না। 

বন্ধ্যা সময়।

গণতন্ত্র আইনের শাসন নির্বাসিত। 

থমকে গেছে স্বাধীন মতপ্রকাশ। 

রাজনীতি যেন গাঙের তলায় অচল জল। গুম-খুন-হামলা-মামলার দমকা বাতাস সরকার বিরোধী প্রতিবাদী মানুষের 

পরিবারকে দুমড়ে মুচড়ে  ছারখার করে দিচ্ছে। রাষ্ট্রপ্রেমী মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ, স্বজন হারানো হাহাকার আজ সর্বত্র। আর  এই বন্ধ্যা-উষর  পরিস্থিতিতে ২০শে নভেম্বর   দেশবাসী পালন করবে ‘ভবিষ্যত বাংলাদেশের কারিগর’ দেশনায়ক তারেক রহমানের ৫৫তম জন্মবার্ষিকী।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান


এই দিনে জন্ম নেয়া অনেক অনন্য অসাধারণ  মানুষের মত তিনিও আলোকিত করেছেন এই ধরিত্রী।    রংধনুর সাতরঙ  রাঙিয়ে, পলকা বাতাসে রঙীন 

বেলুন উড়িয়ে  দিনটি সজ্জিত হয়ত হবে না, হয়তো  গরীব-দুস্থ – অসহায়দের সাহায্যার্থে  তেমন কিছুই হবে না। উৎসবের ঘনঘটায়দিনটি পালিত না হলেও দেশবাসী তারেক রহমান কে স্মরণ করে আর  করবেও অগনিত ভালোবাসা নিয়ে। শুধু ২০ নভেম্বরই নয় ,উৎসবের  আমেজেই নয়, তিনি আছেন, থাকবেন   আপামর জনতার নিত্যদিনের আটপৌরে দিনলিপিতেও।

২০০৭ সালে সামরিক-বেসামরিক জান্তার কঠিন আঘাতের ধকল কাটাতে চিকিৎসার জন্য ব্রিটেনে যান। তারপর থেকে  প্রায় এক যুগ যাবত তারেক রহমানের যাপিত জীবন নির্বাসনে, বিদেশ বিভূঁইয়ে জনারণ্যে থেকেও নির্জনে।কিন্তু নির্বাসন দিয়েই কি আর বিস্মৃত করা যায় তারেক রহমান কে !!

তারেক রহমান  তাঁর  দূরদর্শী রাজনৈতিক দক্ষতা-সাংগঠনিক যোগ্যতা- দিয়ে  জীবন প্রত্যাশা ( Life expectation) বৃদ্ধি ও উন্নয়ন ভাবনা - নতুন শতাব্দীর  নতুন নতুন  চ্যালেন্জ মোকাবেলার উপযোগী করে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় জনপ্রিয়তা যার অপরিমেয় ।

বর্তমান দখলদার শাসক গোষ্ঠী ও তার  সৈন্য-সামন্তের  ক্ষমতায় টিকে থাকার লোভেই বাধ্য করছে তারেক রহমানের এই প্রবাস যাপনকে । ‘ভোটের রাজনীতিতে দখলদার গোষ্ঠীর   পরাজয়  নিশ্চিত’  জেনেই, মিথ্যা মামলা সাজিয়ে জনপ্রিয় তারেক রহমানকে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বাধা প্রদান করছে। অথচ দেশের আদালতে তিনি নির্দোষ বলে প্রমাণিত। আর যে বিচারকের রায়ে তা প্রমাণিত, সেই বিচারকও বাধ্য হয়েছেন দেশ ছাড়তে !!!

প্রয়াত জনপ্রিয় নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুন স্বাধীনতা পরবর্তী বাকশালী আমলে মানুষের নৈতিক স্খলন- মুল্যবোধের যে অবক্ষয় হয়েছিল  তার বিরুদ্ধে ‘সুবচন নির্বাসনে’  নামক এক প্রতিবাদী নাটক রচনা করেন ।  

আর আজ নতুন শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই সৎ-কর্মযোগ্য-প্রতিবাদী মানুষ  যেভাবে গুম হচ্ছে,  খুন হচ্ছে , দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তা যদি নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুন বেঁচে থেকে দেখতেন , তাহলে  হয়ত এবার  লিখতেন  ‘সুজন নির্বাসনে’। 

ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ার বলতেন, “তোমার মতের সাথে আমি একমত নাও হতে পারি কিন্তু তোমার মত প্রকাশের জন্য আমি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতেওনপ্রস্তুত আছি।”  আর তারেক রহমান বিশ্বাস করেন, শত ফুল ফুটুক, শত মত প্রকাশ হোক।

মুক্ত চিন্তা-মুক্ত বুদ্ধি আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।আধুনিক প্রযুক্তির কল্যানে  স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ  আজ অবারিত। কিন্তু এদেশে রাজনীতি-ভাবাদর্শ-শিক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞান সবখানেই দখলদার শাসকগোষ্ঠীর  জগদ্দল শাসন সব রকমের অগ্রগতি এবং বিকাশের অন্তরায় হয়ে আছে ।

দখলদার সরকার দেশ ও জনগনের উদ্দেশ্যে  তারেক রহমানের সকল বক্তৃতা  প্রচারে মিডিয়াকে  নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে। ভলতেয়ার এদেশে জন্মালে  এর প্রতিবাদে নির্ঘাত জীবন উৎসর্গ করতেন। 

তারেক রহমান  বহুধা বিভক্ত-বহু ধারার রাজনীতি ও আদর্শকে সম্মান করে নি:শঙ্ক চিত্তে মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা, শেখ মুজিব, শহীদ জিয়াকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্ববান জানান। 

তিনিই প্রথম শেখ হাসিনার প্রবাসী সন্তানকে দেশের রাজনীতিতে অংশ নিতে   চিঠিতে    আহ্বান জানিয়ে লেখেন,  ‘আমার-আপনার পূর্বপুরুষরা স্বাধীনদেশ নির্মানে অবদান রেখেছিলেন। আসুন আমরা দেশের উন্নয়ন-উৎপাদনে একমত হই।’ 

রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও  ঈদ, বাংলা নববর্ষ ইত্যাদি জাতীয় উৎসবে বিরোধী রাজনীতিক নেতৃবৃন্দকে উপহার পাঠিয়ে তিনি  দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন  যা ব্যক্তিগত  ও সামাজিক সম্পর্ককে অম্লান করেছে।

বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি চর্চায় তিনি বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষদের রাজনীতিতে স্বাগত জানিয়েছেন । কারণ, রাজনীতিকে তিনি অন্যসকল পেশার মত জীবিকা নির্ভর  মনে না করে একটি অংশগ্রহনমূলক অবিভাজ্য বিষয় হিসেবেই দেখেন। যেখানে অংশ নিতে পারে ছাত্র-শিক্ষক-নারীপুরুষসহ চিকিৎসক-প্রকৌশলী- শ্রমিক বিভিন্ন স্তরের দেশে-বিদেশে অবস্হানরত বাংলাদেশী জনগণ।

তারেক রহমান বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নয় সাংস্কৃতিক সম্প্রীতিরও দেশ।

তিনি অতীতকে অবগাহন  করে বর্তমানকে স্পর্শ করতে চান। এজন্য চিরায়ত বাংলা নববর্ষে  রমনার বটমূলে পান্তা -ইলিশ, দেশীয় ঐতিহ্যর গান এবং  চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার পাশাপাশি  আধুনিক  ব্যান্ড সংগীতের  সংমিশ্রনে তিনি পালন করেন নববর্ষ। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে বিকালে  আয়োজন করেন দেশের সেরা সেরা ব্যান্ড সংগীতদলের অংশগ্রহনে কনসার্ট । তিনি দেশ ও জনগনের উন্নয়নে রাজনীতি ছাড়াও সামাজিক কর্মসুচীও গ্রহন করেছেন বিশেষ করে সবুজ বৃক্ষের বনায়ণ কর্মসূচী, দারিদ্র বিমোচনে, “একটু চেষ্টা, একটি উদ্যোগ, দেশে আনবে স্বনির্ভরতা” ইত্যাদি কর্মসূচী ব্যাপক সফলতা লাভ করে। 

তারেক রহমানের প্রতিষ্ঠিত  ‘জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন’  দেশের দারিদ্র বিমোচনে  এখনো অবদান রেখে  যাচ্ছে। 

রাজনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারেক রহমানের  বিচরণ বিচ্ছুরিত আলোকচ্ছটার মতনই । যে দ্যুতি আলোকিত করে চারধার। নির্বাসন তাঁর হৃদয় থেকে বাংলাদেশকে নির্বাসিত করতে পারেনি, বরং এদেশ আরও গভীর ভাবে প্রোথিত তাঁর এই একাকী হৃদয়ে । এক হৃদয়েই তিনি ধারন করে আছেন ১৬ কোটি আমাদের। 

আমাদের দেশে একদিন  দেশনায়ক তারেক রহমানের নেতৃত্বে রচিত হবে প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’। বাংলাদেশ তাঁর এই জন্মক্ষণে, তাঁরই ফেরার অপেক্ষায়। শুভজন্মদিন প্রিয় তারেক রহমান। 

লেখক  তথ্য বিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি 
সাবেক সভাপতি, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল

Wednesday, November 11, 2020

জিয়া, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে

— ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা


এই জাতীর জীবনে যদি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর না আসতো, তাহলে কী হতো? কী হতো যদি ৩ নভেম্বরের পর থেকে কার্যত কোনো সরকার না থাকা বাংলাদেশ আরো বেশ কিছুদিন‌ সেভাবে চলতো? কোন‌ও বহিঃশত্রুর আক্রমণের হুমকি তৈরি হলে চেইন অব কমান্ড পুরোপুরি ভেঙে পড়া ‌একটা সেনাবাহিনী কী করত তখন? কিংবা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্ৰুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে সেটা দেশকে কোন পরিস্থিতিতে নিয়ে যেত?

১৯৭৫ এর ৪৫ বছর পর এই ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে এই নভেম্বর মাসে দেখি - ভাগ্যিস একজন জিয়াউর রহমান সেদিন এই জাতির ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল, এবং ধীরে ধীরে সেটা যতটা খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছিল সেটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকেই ভীষণ বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে দিয়েছিল। সেই বিপদ থেকে এই রাষ্ট্র ৭ নভেম্বর বেরিয়ে এসেছিল এত অসাধারণভাবে যার চাইতে ভালো কিছু আর হতে পারত না। 



নভেম্বর মাসের শুরুতে অবিশ্বাস্য যেসব ঘটনা ঘটেছিল এবং সেগুলোর পরম্পরায় একটা পর্যায়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কীভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন সেই ঘটনাপ্রবাহ কমবেশি আমরা সবাই জানি। সেই সব ঘটনার পুনরুল্লেখ করছি না। কিন্তু ৭ ই নভেম্বর শহীদ জিয়া ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসা বিশ্বের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। 

পৃথিবীর নানা দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। হয়েছে এই দেশেও। এমনকি ৭ ই নভেম্বরের আগেই খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর একটা সামরিক অভ্যুত্থান করেছিলেন, যেটা ব্যর্থ হয়। ‌ ৭ ই নভেম্বরে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল সেটা ছিল সিপাহী-জনতার মিলিত অভ্যুত্থান। এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা; এটাই এই অভ্যুত্থানটিকে আলাদা করে আর সবগুলো থেকে। ওই দিনটিতেই সামরিক-বেসামরিক মানুষ ফিরে গেল সেই মানুষটার কাছে যে মানুষটা সাড়ে চার বছর আগে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়া একটি জাতিকে পথ দেখিয়েছিলেন। 

২৫ শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর  কর্যাকডাউন 'অপারেশন সার্চলাইট' এর পর পুরো জাতি হয়ে পড়ে রক্তাক্ত, ভীত, দিকনির্দেশনাহীন। সেই অবস্থায় এই জাতিকে যে মানুষটা স্বাধীনতা ঘোষণা করে মানুষের মনে আস্থা, সাহস এবং অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন, সেই মানুষটাকেই আবার এই দেশের ক্রান্তিলগ্নে মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতার ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। জনগণের মনে একজন মেজর জিয়ার প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস কতটা গভীর ছিল ৭ নভেম্বর আবার সেটা প্রমাণিত হয়েছিল। তাদের এই আস্থা যে কতটা সঠিক ছিল সেটা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিদিন প্রমাণ করে গিয়েছেন শহীদ জিয়া।



৭ নভেম্বরের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটা জিয়ার সামনে ছিল সেটা হচ্ছে সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা। একটা সশস্ত্র বাহিনীতে যখন চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় যেটা দেশকে একেবারে গৃহযুদ্ধের মুখে মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। বাংলাদেশ ছিল সেই পরিস্থিতিতেই। সেই সময় অত্যন্ত শক্ত হাতে তিনি সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সেই সময় তার নেয়া পদক্ষেপ গুলোকে যারা সমালোচনা করেন, তারা হয় সে সময়কার বাস্তবতা জানেন না, কিংবা মতলববাজি করে জেনেশুনে অস্বীকার করেন। 

সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার সফলতা দিয়ে শুরু। এরপর একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে জিয়া ক্রমাগত ছাড়িয়ে যেতে থাকেন নিজেকে। স্বাধীনতার পর পর সমাজতন্ত্রের নামে একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নেয়া হতে থাকে। এর মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল বেসরকারি খাতকে অগ্রাহ্য করে সবকিছু সরকারি মালিকানায় রাখার চেষ্টা। এতে দেশের শিল্প-ব্যবসার বড় অংশ অত্যন্ত অদক্ষ এবং দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। এর সাথেই সমাজতন্ত্রের ধুয়ো তুলে এই রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত ছিল বাকশাল গঠন করা। মুখে সমাজতান্ত্রিক মডেলের কথা বলাটা ছিল আসলে একটা বাহানা, এর মাধ্যমে এক ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত ‌ করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। 



মজার ব্যাপার আওয়ামী লীগ বাকশালের পক্ষে নানা রকম যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলেও ২০০৯ সাল থেকে দুই-তৃতীয়াংশ এবং পরে তার চাইতেও বহু বেশি আসন নিয়ে সংসদে থাকলেও চতুর্থ সংশোধনীর মত আর কোন সংশোধনী আনার সাহস করেনি। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ দলটি আবার নতুন জীবন পেয়েছিল জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই। রাষ্ট্রকে আবার বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকাগুলোর একটা। বিভাজিত জাতিকে এক্যবদ্ধ করতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের যে আদর্শ তিনি স্থাপন করেন সেটি বাংলাদেশ যতদিন থাকবে মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় জিয়াকে অমর করে রাখবে।

শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক সংস্কারের সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল বেসরকারি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে একটি পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করা। বেসরকারি খাত উন্নয়নে নানা রকম নীতি সাহায্য নিশ্চিত করেছিলেন। মজার ব্যাপার বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটি পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানে সমাজতন্ত্র যুক্ত করলেও চালু রেখেছে শহীদ জিয়া প্রবর্তিত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই।



এই রাষ্ট্রের আর্থিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। নিকট অতীতে বাংলাদেশের সবগুলো সরকার যে তিনটি সেক্টরের উপরে ভিত্তি করে অর্থনীতির ক্ষেত্রে উন্নতি নিয়ে গর্ব করেছে তার মধ্যে দু'টির (গার্মেন্ট, প্রবাসী কর্মী) একেবারে গোড়াপত্তন হয়েছে শহীদ জিয়ার হাত ধরে আর অপরটির (কৃষি) ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছে তাঁর নেয়া নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে।

এই দেশে গার্মেন্ট শিল্প আজ দেশের প্রধান রপ্তানি খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয় এই খাতে প্রায় অর্ধকোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয় এই সেক্টরে। এই পরিমাণ মানুষের সামষ্টিক ভোগের পরিমাণ বিপুল, তাদের উপর ভিত্তি করে আরো নতুন নতুন শিল্প-ব্যবসা তৈরি হয়েছে। তাই দেশের জিডিপিতে এর অবদান অনেক বড়।

এই দেশের এক কোটির বেশি মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকে, যার প্রধান অংশটি থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। মূলত এই মানুষগুলোর পাঠানো রেমিট্যান্স‌ই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যুক্ত হওয়া ২২  লক্ষ মানুষ কী করতো, কেউ কি একবারও ভেবে দেখছি? বিদেশে কর্মী এভাবে না যেতে পারলে তার ফলশ্রুতিতে তৈরি হওয়া বেকার সমস্যা এই দেশের সামাজিক অস্থিরতা কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারতো অনুভব করা আমরা? এই দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভর করে আছে রেমিটেন্স এর ওপারে। কতটা ভবিষ্যতদ্রষ্টা হলে একজন মানুষ আজ থেকে চার দশকেরও বেশি সময় আগে এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন এবং কর্মীদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো শুরু করেন। 

এখনকার বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচ দিতে দিতে আমাদের পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নেমে যাচ্ছে। এটা এক ভয়ংকর পরিস্থিতি। তাই বেশ কিছুদিন থেকে সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। ‌শহীদ জিয়া তাঁর সময়ে এই ভূপরিস্থ পানি ব্যবহারের জন্য খাল কাটা কর্মসূচি সারা দেশে চালু করেছিলেন। 

জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই দেশের বিরাট সমস্যা হয়ে উঠতে পারে সেটা জেনেই পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি চালু করেন তিনি। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে খাদ্য মজুদের জন্য বড় বড় গুদাম তৈরি করা হয় তার সময়ে। শিক্ষাকে সব মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, গণশিক্ষা এবং বয়স্ক শিক্ষা চালু করেন তিনি।  রাষ্ট্রের সাথে পল্লীর জনগণের সম্পর্ক তৈরি করার জন্য গ্রাম সরকার, আনসার-ভিডিপি তাঁরই অবদান। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নাগরিকদের উৎসাহ প্রদান করার কথাও ভুলে যাননি তিনি - চালু করেছিলেন একুশে এবং স্বাধীনতা পদক।



দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এর যে মিথ্যে প্রপাগ্যান্ডা চালানো হয়, সেটা আসলেই ছিল তাঁর সময়ে। নিজে ছিলেন যে কোনও রকম দুর্নীতি থেকে একেবারেই মুক্ত শুদ্ধতম মানুষ আর লড়াই করে যাচ্ছিলেন সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করার। সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রম, নিরপেক্ষতা, দূরদর্শীতা, কঠোর পরিশ্রম তাকে একেবারে আলাদা করেছিল আর সব রাজনীতিবিদের থেকে।

একথা বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হয় না বর্তমানে যে বাংলাদেশে আমরা দেখছি তার মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার হাত ধরেই। সেই ভিত্তিটার দিকে তাকালে এটুকু বলতে হয় এই দেশ সার্বিক বিচারে আরো অনেক উন্নত হবার কথা ছিল। কথা ছিল এই দেশে দুর্নীতি থাকবে না, থাকবে সুশাসন। কিন্তু তারপরে ক্ষমতায় আসা এরশাদ সরকার এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারটি বীভৎস লুটপাটের মাধ্যমে দেশটার এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। 

শহীদ জিয়া খুব বেশি সময় বেঁচে থাকবেন না, এটা সম্ভবত অনিবার্য ছিল। ক্ষমতার কেন্দ্রে আসার পর থেকেই তিনি রাষ্ট্রের স্বার্থে জাতির স্বার্থে এমন সব পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিলেন যেগুলো বহু মানুষের কায়েমী স্বার্থে আঘাত হেনেছিল। একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং স্মার্ট মানুষ জিয়াউর রহমানের এই ব্যাপারটি না বোঝার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু যে মানুষটি '৭১ সালে মানুষকে সাথে নিয়ে নিজে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য, যে মানুষটি '৭৫ সালে নিজের জীবন বিপন্ন করে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন, সেই মানুষের অভিধানে 'ভয়' শব্দটি না থাকারই কথা। 

ভয় পাননি, তাই জীবন দিয়েছেন, কিন্তু এই ভয় না পাওয়াটাই এমন এক জিয়াকে তৈরি করেছে যেটি এই মাটির মানুষের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে বহু প্রজন্ম পরেও।


লেখক — রাজনীতিবিদ, আইনজীবী।

Tuesday, November 10, 2020

৭ই নভেম্বরের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র ফেরাতে হবে

— ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম


শীর্ষ জাতীয় পত্রিকা দৈনিক বাংলার ফ্রন্ট পেইজ, নভেম্বর ৮, ১৯৭৫


‘৭ই নভেম্বর — জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস. বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দিন। বিপ্লব শব্দের অর্থ ব্যাপক পরিবর্তন, আর সংহতি শব্দের অর্থ মিলন ও ঐক্য। বিপ্লব হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে একটি মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন, যখন জনগণ চলমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জেগে ওঠে। অধিকাংশ সময় বিপ্লব শব্দটি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে একটি পরিবর্তন সূচিত করা বোঝায়। এরিস্টটল দুই ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লবের বর্ণনা দিয়েছেন —   ১. এক সংবিধান থেকে অন্য সংবিধানে পূর্ণাঙ্গ পরিবর্তন এবং ২. একটি বিরাজমান সংবিধানের সংস্কার। বিপ্লবের ফলে সংস্কৃতি, অর্থনীতি, এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়। ডেভিসের মতে বিপ্লব হচ্ছে, হিংসার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত শাসকশ্রেণিকে উৎখাত করে জনসাধারণের অধিকাংশের সমর্থনপুষ্ট কোনো শ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস সামাজিক সম্পর্কসমূহের গুণগত পরিবর্তনকেই বিপ্লব আখ্যা দিয়েছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সামগ্রিক কাঠামোগত এবং ক্ষমতার আমূল রদবদলকে আমরা বিপ্লব বলে অভিহিত করতে পারি। শব্দটির সহজ সরল অর্থ হলো সম্পূর্ণ ভাবে ঘুরে দাড়ানো। অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করাই শুধমাত্র বিপ্লবের একমাত্র লক্ষ্য নয়। সামাজিক সৃজনশীলতা এবং রাজনৈতিক মুক্তিও বিপ্লবের অংশ। গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানকেও বিপ্লব বলা হয়। বিপ্লব সভ্যতার অগ্রগতির ধারক। এসব লক্ষ্যকে সামনে রেখেই মার্কিন স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৭৭৬), ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯), রুশ বিপ্লব (১৯০৫-১৯১৭) এবং ইরানের ইসলামী বিপ্লব (১৯৭৯) সংগঠিত হয়েছিল। আর ১৬৮৮ সালে ব্রিটেনে একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গৌরবময় বিপ্লব হয়েছিল। এসব বিপ্লবের মাধ্যমে অসম্ভব সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হয়। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশেও ব্রিটেনের মত এমন একটি বিপ্লব আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের পর থেকে জাতি এই দিবসটি পালন করে আসছে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শপথ গ্রহণ এবং সামরিক বাহিনী ও জনগণের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে। এই দিনটা অস্বীকার করা মানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা। জনগণ ও সাধারণ সৈনিক দেশের সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য ৭ই নভেম্বর বিপ্লব করেছিলেন। এজন্যই এ দিনটিকে আমরা বিপ্লব ও সংহতি দিবস বলে থাকি।

১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লব দিবস নিয়ে জানতে বা লিখতে হলে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে কি ঘটেছিল সেখান থেকে শুরু করতে হবে। জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ ১৯৭৫ সাল বাংলাদেশে মুজিব সরকার আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল চালু করেছিল। এটা অত্যন্ত বিতর্কিত ও গণতন্ত্র হত্যাকারী কাজ ছিল। মানুষের বাক স্বাধীনতা ও মিডিয়ার স্বাধীনতা না থাকার কারনে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের আগ পর্যন্ত আপাতদৃষ্টিতে বা দৃশ্যমান ওপরের অংশ শান্ত বা সরকারের অনুকূলে বহমান ছিল বলে মুজিব সরকারের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল। বাস্তবে তা ছিল না। অদৃশ্যমান পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভাবে সরকারের বিপরীতে। এই রকম পরিস্থিতিতে ১৫ই আগস্টের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল। ১৫ই আগস্টের ঘটনার সাথে সামরিক ও রাজনৈতিক দুই ধারার লোক জড়িত ছিল —  এই ঘটনাবলিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তৎকালীন কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রমের ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের অধীনে থাকা দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি। আর্টিলারি রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের অগোচরে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন এবং বিদ্রোহে সক্রিয় অংশগ্রহন করেন। সেনাবাহিনী সদর দফতরের চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের অগোচরে বা গোপনে গোপনে তার অধীনস্থ একটি সাঁজোয়া ইউনিট প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সার বিদ্রোহের প্রস্তুতি ও বিদ্রোহে অংশগ্রহন করেন। অর্থাৎ বেঙ্গল ল্যান্সারের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং গোয়েন্দাদের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন। তাদের সাথে যুক্ত ছিলেন চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত অন্যান্য অফিসার। এটা গেল এক ধারার লোকদের কথা। অন্য ধারায় ছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে শেখ মুজিবের বিশ্বস্ত মোশতাকসহ তার দলে নেতারা। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবের নামের উপর প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভারও অন্যতম সদস্য ছিলেন মোশতাক। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রী সভার অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। এই খন্দকার মোশতাকের সঙ্গী ছিলেন দুই শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাকের নেতৃত্বে মুজিব সরকারের মন্ত্রীদের নিয়েই (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদসহ হাতেগোনা কয়জন বাদে) নতুন সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি ছিল অভ্যুত্থানকারী ফারুক-রশিদের নেতৃত্বাধীন ‘মেজর’ গ্রুপের হাতে। ক্ষমতার এই পটপরিবর্তনকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ মেনে না নিয়ে, সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার নামে ৩রা নভেম্বর কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় এক পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায়। মোশতাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে বিচারপতি সায়েমকে বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি করেন। তারপর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেই সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে নিজেকে চীফ-অফ-আর্মি স্টাফ হিসেবে ঘোষনা করেন এবং জিয়াউর রহমানকে চীফ-অফ-আর্মি স্টাফ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তাকে তাঁর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। নভেম্বর ৪ (নভেম্বর ৩ শেষ রাতে) ঢাকা জেলখানায় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই অবস্থায় খালেদ মোশাররফের সমর্থনে ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বরের একটি মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে। মিছিলে নেতৃত্ব দেন খালেদ মোশাররফের মা, তার ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ। এর মধ্যে ক্ষমতা সংহত করার লক্ষ্যে বঙ্গভবনে নানা দেন-দরবারে ব্যস্ত থাকেন খালেদ মোশাররফ এবং তার সঙ্গীরা। ফারুক-রশিদ গ্রুপের সঙ্গে খালেদ মোশাররফ একটা আপসরফা করে তাদেরকে দেশের বাইরে লিবিয়ায় পাঠিয়ে দেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক হিসেবে সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। তাই জিয়াকে অন্তরীণ রাখাকে সাধারণ সৈনিকেরা পছন্দ করেননি এবং এই ঘটনা সেনাবাহিনীর মধ্যে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। পাশাপাশি দেশের জনসাধারনের মধ্যে সৃষ্টি হয় চরম হতাশা ও আতঙ্ক। জনগন ভাবতে শুরু করে দেশে আবারও একদলীয় বাকশাল ও দুর্ভিক্ষের দিনগুলো বুঝি ফিরে আসছে এবং সেনানিবাসের ভিতরে-বাইরে ছড়িয়ে পড়ে যে খালেদ ভারতের পক্ষে ও ইন্ধনে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এসময় কর্নেল তাহের, জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জেনারেল জিয়ার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে, তাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনা আগাম জানতে পেরে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সেনাসদস্যরা লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ৬ই নভেম্বর রাত ১২টার দিকে জিয়াউর রহমানকে তাঁর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির হেড কোয়ার্টারে আনা হয়। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান এইজন্য মাত্র ৩দিন স্থায়ী হয়। এর পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।

বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতারা যখন জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে কর্নেল তাহেরের কাছে নিয়ে যাবার জন্য সেনানিবাসে আসে তখন তারা খুব হতাশ হয়। কর্নেল তাহের নিজেও হতাশ হয়ে পড়েন। তারপর শেষ কৌশল হিসেবে জেনারেল জিয়াকে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির হেডকোয়ার্টার থেকে বের করে আনার জন্য সেখানে কর্নেল তাহের নিজেই উপস্থিত হন। কিন্তু পরিস্থিতি ততক্ষণে পাল্টে গেছে। সাধারণ সিপাহীদের সাথে জনতাও স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে যোগ দিয়েছে এক অভূতপূর্ব বিপ্লবে। বিনা রক্তপাতে স্বতঃস্ফুর্ত বিপ্লবের মাধ্যমে পালা বদলের পরও, এমনকি বঙ্গভবন থেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদা মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল পালিয়ে গেছেন এটা জানার পরও হাসানুল হক ইনু এবং কর্নেল তাহেরর নির্দেশে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা মরিয়া হয়ে উঠে এবং সেনানিবাসের ভিতরে ৩০ জন সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ২য় ফিল্ড আর্টিলারিতে কর্নেল তাহের সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে জেনারেল জিয়াকে বের করে আনার জন্য চেষ্টা করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবার জন্য রেডিও স্টেশনে নেবার প্রস্তাব করেন। সেখানে উপস্থিত অন্যান্যরা ২য় ফিল্ড আর্টিলারিতেই রেডিও কর্মকর্তাদের ডেকে এনে জেনারেল জিয়ার ভাষণ রেকডিং করানোর পাল্টা প্রস্তাব দেন। এতে কর্নেল তাহের একাধারে আরো ক্ষিপ্ত ও হতাশ হন। এমতাস্থায় কর্নেল তাহের তার অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদেরকে যে কোন মূল্যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিলকে হত্যার নির্দেশ দেন। কর্নেল শাফায়াত জামিল এই নির্দেশের কথা তার ব্রিগেড মেজর হাফিজের কাছ থেকে জেনে তা বঙ্গভবনে অবস্থানরত খালেদ মোশাররফকে অবহিত করেন। সেনানিবাসে ফোন করে খালেদ মোশাররফ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হন এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলকে বঙ্গভবনে অবস্থান করত বলে কর্নেল হায়দার ও কর্নেল হুদাকে নিয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। তারা প্রথমে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর প্রধান কর্নেল নুরুজ্জামানের বাসায় গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করেন। সেখান থেকে তারা খালেদা মোশাররফের এক আত্মীয়ের বাসায় যান এবং কয়েক জায়গায় ফোন করার পর শেরে বাংলা নগর অবস্থানরত ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্নেল নওয়াজেশের সাথে কথা বলে নিরাপত্তার আশ্বাস পান এবং সেখানে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। পথিমধ্যে এক দুর্ঘটনায় তাদের গাড়িটি নষ্ট হয়ে গেলে প্রথমে তারা মোহাম্মদপুরের ফাতেমা নার্সিংহোমে যান। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাম্পে পৌছান। কর্নেল নওয়াজেশ আহমেদ টেলিফোনে জেনারেল জিয়াকে তার ক্যাম্পে খালেদ মোশাররফের উপস্থিতির কথা জানান। জেনারেল জিয়া ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নিরাপত্তার সকল ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্নেল নওয়াজেশকে নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি কর্নেল নওয়াজেশের ক্যাম্পে অবস্থানরত রেজিমেন্টের আরেকজন সেনা কর্মকর্তা মেজর জলিলের সাথে কথা বলে তাকে নির্দেশ দেন যেন তিন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছাড়াও বাকি আরো দুজন সেনা কর্মকর্তাকে যথাযত নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষেত্রে কর্নেল নওয়াজেশকে সাহায্য করেন।

কর্নেল হুদার স্ত্রী নিলুফার হুদার বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঐই সময় ঢাকা সেনানিবাসের ২য় ফিল্ড আর্টিলারিতে অবস্থানরতদের কাছ থেকে জানা যায়, যথন জেনারেল জিয়া কর্নেল নওয়াজেশ ও মেজর জলিলের সাথে কথা বলছিলেন তখন কর্নেল তাহের কিছুক্ষনের জন্য বাহিরে যান। সেখান থেকে ফিরে তিনি জেনারেল জিয়ার কাছে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঠিক অবস্থান জানতে চান এবং আবারও কিছুক্ষনের জন্য বাহিরে চলে যান। সেনাপ্রধানর আদেশ ও নিশ্চয়তা পেয়ে কর্নেল নওয়াজেশ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও তার দুই সঙ্গীর জন্য নাস্তার আয়োজন করেন। তাদেরকে নাস্তার পরিবেশনের কিছুক্ষণের মধ্যে সামরিক বাহিনীর খাকি পোশাক পরিহিত কর্নেল তাহেরের অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বেশ কিছু সদস্য গান পয়েন্টে সেই রুমে প্রবেশ করে এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফসহ তিন সেনাকর্মকর্তাকে অস্ত্রের মুখে কক্ষের বাহিরে এনে গুলি করে হত্যা করে (‘বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায়: ১৯৭৫-৮১’)। সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে জানা যায় যে, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কিছু সদস্য কর্নেল আসাদুজ্জামানের নিকট ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও তার দুই সঙ্গীকে হত্যার জন্য কর্নেল তাহেরের নির্দেশ পৌছে দেয় এবং কর্নেল আসাদুজ্জামান নিজে এই হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দেন।

তাহের-ইনুর নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর আসলে একটি রক্তাক্ত ব্যর্থ অভ্যুথ্যান হয়েছিল, আর তারই সমন্তরালে সিপাহী-জনতার সম্মিলিত প্রয়াসে আরেকটি রক্তপাতহীন বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, যার নেতৃত্ব দিয়েছিল সেনাবাহিনীর ২য় ফিল্ড আর্টিলারি। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী কয়েকটি অভ্যুথ্যান ও পাল্টা অভ্যুথ্যানের মাঝে সবার অলক্ষ্যে জন্ম নিয়েছিল ইতিহাসের মোড় ফেরানো এক অনন্য সাধারণ বিপ্লব যা আমুল পাল্টে দিয়েছিল বাংলাদেশের রাজনীতির ও সমাজের গতিপথ। 

দেশ আজ আর  গণতন্ত্র নেই। ভোটাধিকার পদদলিত।  তাই, গণবিরোধী ও আগ্রাসনবাদী শক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে দেশকে এক ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই চত্রুান্ত হাসিল করার জন্য বর্তমান সরকার সামরিক বাহিনী, আইনশৃঙ্খল বাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও জনতাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল লক্ষ্য ছিল —   সুশাসন, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ, এক উদারচেতা, পরমতসহিষ্ণু, সংস্কৃতিমনা সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সুখী-সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশ গড়তে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বর্তমান নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, তানা হলে এসব থেকে কারও পরিত্রাণ নেই। এটা শুধু বিরোধী দলের একার কাজ নয়। ১৯৭৫ সালে ৭ই নভেম্বর সফল হয়েছিল সিপাহী জনতার ঐক্যের কারণে। তাই সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকে ৭ই নভেম্বরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সব ধরনের জাতিঘাতী এবং রাষ্ট্রঘাতী অপকৌশলের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে।‪








—  লেখক সিনিয়র সাইন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র। 


Wednesday, November 4, 2020

গণতন্ত্রহীনতা ও চরমপন্থা — আপন দুই ভাই


—  সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া 

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মূলত সরকারি-নীতি নিয়ে বিতর্কই মূল কেন্দ্রবিন্দু। উন্নত দেশগুলোতে জনগণ দেখে কোন দল আমার আয়-রোজগার, ব্যবসার জন্য ভালো, আমার ট্যাক্স কম নিবে বা এফিশিয়েন্টলি খরচ করবে, দুর্নীতি কম করবে। আবার অনুন্নত দেশের জনগণ দেখে কারা আমার রাস্তা-ঘাট, সেতু-কালভার্ট বানায়, স্কুল ভবন করে দেয়, টিআর-কাবিখা দেয়, দুর্নীতি কম করে। অর্থাৎ এসবই জাগতিক বিষয়-আশয়। উন্নত বা অনুন্নত যেকোনো দেশেই গণতন্ত্রে দলগুলোকে ডেলিভার করতে হয়, পারফরমেন্স দেখাতে হয়। সুতরাং সরকারি-নীতি-নির্ভর মধ্যপন্থী দলগুলো তুলনামূলক বাস্তববাদী সমাধান হাজির করে এবং দিনশেষে র‌্যাডিক্যাল দলগুলোর চেয়ে এগিয়ে থাকে। অর্থনীতি খুব খারাপ করলে বা প্রতিষ্ঠিত মূলধারার দলগুলো সবাই ব্যর্থ হলে র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থীরা ফাঁকতলে ক্ষমতায় চলে আসতে পারে, কিন্তু ডেলিভার করতে না পারলে মানুষই আবার তাদের খেদিয়ে দেয়।

অগণতান্ত্রিক দেশে বা স্বৈরতান্ত্রিক দেশে (পড়ুন বাংলাদেশের মতো) সরকারকে লেজিটিমেসি ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য মূলত দুইটা কাজ করতে হয়: ১) উন্নয়ন/ভয় বিক্রি করতে হয়, ২) চরম দমন-পীড়ন চালাতে হয় যেহেতু জোর-জবরদস্তি করে ক্ষমতায় টিকে থাকা লাগে। [চীনকে যেকোনো উদাহরণের বাইরে রাখবেন – কারণ চীনে এমন একটি ব্যবস্থা চালু আছে যা পৃথিবীতে চূড়ান্ত ব্যতিক্রম – লম্বা আলাপ, পরে সময়-সুযোগে বলবো]

যেহেতু স্বৈরশাসক ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে দমন-পীড়ন করতে হয়, তো এর প্রথম ধাক্কাটা লাগে প্রতিষ্ঠিত মধ্যপন্থী দলগুলোতে। কারণ স্বৈরশাসনের প্রথম শর্ত হলো বিদ্যমান অর্থোডক্স রাজনৈতিক বিকল্প শক্তিটিকে নির্মূল করা। একাজটি তারা সহজেই করে। কারণ এই মধ্যপন্থী দলগুলো যেহেতু সরকারি নীতি, উন্নয়ন এসব স্লোগান নিয়ে রাজনীতি করে, এবং রেন্ট-সিকিং-এর উপর ভিত্তি করে একটা পেট্রন-ক্লায়েন্ট রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে এদের রাজনৈতিক র‌্যাঙ্ক-এন্ড-ফাইল পরিচালিত হয়, সেহেতু এদের কর্মীদের আনুগত্য ও রেজিমেন্টেশন র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থী (আইডিওলজি বা আইডেন্টিটি-নির্ভর) দলগুলোর চেয়ে কম। এবং যেকোনো চরম নিপীড়ন, নির্যাতনের ‍মুখে মধ্যপন্থী, অর্থোডক্স এসব দল হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। এই ফাঁকা স্পেসটিই র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থী প্রান্তিক দলগুলোর বিকাশের উত্তম সময়। এদের কর্মীদের আনুগত্য ও রেজিমেন্টেশন যেহেতু শক্ত, এবং এমনকি নির্যাতনের মুখেও তারা দলত্যাগ করে না বা সহজে হাল ছেড়ে দেয় না, তখন স্বৈরশাসনের প্রচণ্ড দমন-পীড়নের মুখে দীর্ঘমেয়াদে এরাই প্রধান, প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে আবির্ভূত হয়। স্বৈরশাসন ম্যাচিউর হওয়ার কিংবা এই র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থী ফ্রিঞ্জদের মূলধারায় অধিষ্ঠিত হওয়ার এই টাইমফ্রেম কতদিন? নানা ফ্যাক্টর বিবেচনায় এটি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে আমার বিবেচনায় ১০-১৫ বছর একটি আদর্শ সময়।

অর্থাৎ আপনি গণতন্ত্রের মুখ বন্ধ করে দিলে এর স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থী রাজনীতিরই উত্থান ঘটবে। সেটি আপনি ঠেকাতে পারবেন না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দীর্ঘ স্বৈরশাসনে এটিই ঘটেছে। সেখানে মধ্যপন্থী দলগুলো স্বৈরশাসকদের দমন-পীড়নের মুখে হাওয়া মিলিয়ে গিয়েছে। কেবল মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো ধর্মীয় আদর্শ-ভিত্তিক সংগঠন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থেকেছে। এবং যার ফলে স্বৈরশাসন-উত্তর রাজনীতিতে ইসলামপন্থী দলগুলোই চালকের আসনে আসীন। যেমনটি আগে বলেছি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও মধ্যপন্থী দলগুলোর সীমাহীন ব্যর্থতা র‌্যাডিক্যাল দল বা গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে পারে, তবে সেটি ব্যতিক্রম, সাধারণ নিয়ম নয়। অন্যদিকে স্বৈরশাসনের ফল আউট র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা, সেটিই স্বাভাবিক পরিণতি, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও।

বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র আরো কয়েক বছর টিকে থাকলে এমনটিই ঘটবে বাজী ধরতে পারেন। শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের পরিণতিতে প্রথাগত মধ্যপন্থী দল বিএনপি মামলা-হামলা-নিপীড়নে ইতোমধ্যেই প্রায় নিষ্ক্রিয়, নির্জীব একটি শক্তি হয়ে পড়েছে (এর কারণটি উপরে বলেছি যে এই ধরনের দমনপীড়নের মুখে সরকারি-নীতি/উন্নয়ন-সর্বস্ব রাজনৈতিক শক্তি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে)। যেহেতু সৃষ্ট এই শূন্যতা স্বাভাবিক নিয়মেই শূন্য থাকবে না, সে স্থানটি তারাই পূরণ করবে যারা এই পরাক্রমশালী স্বৈরশাসনের বেঁধে দেওয়া সীমারেখা ডিঙিয়ে রাজনীতির স্পেসটি রিক্লেইম করতে পারবে। সে কাজটির জন্য প্রয়োজন প্রচণ্ড অনুগত, ও রেজিমেন্টেড কর্মীবাহিনী। এর পাশাপাশি সমাজের মূলধারার সেন্টিমেন্ট যোগ হলে তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলাম একটি সুপ্ত কিন্তু ডমিনেন্ট শক্তি। একে আগ্রাহ্য, উপেক্ষা করে এমনকি মধ্যপন্থী দলগুলোও রাজনীতি করতে পারেনি বা করতে চায় না। বাংলাদেশে এই স্বৈরতন্ত্রের যাঁতাকলে প্রাকৃতিক নিয়মেই ইসলামীক রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে উল্লিখিত তিনটি কারণে: ১) নিপীড়নের মুখে টিকে থাকা অনুগত রাজনৈতিক কর্মী, ২) নিপীড়নের মুখে ভেঙে না যাওয়া দলীয় শৃঙ্খলা (রেজিমেন্টেড ফোর্স), এবং ৩) সামাজিক লেজিটিমেসি (ইসলাম)।

বাংলাদেশ নিয়ে আমি মাঝে-মাঝে পাশ্চাত্যের কিছু পণ্ডিত ও নীতি-নির্ধারকের সাথে কথা বলি। প্রায়শই দেখেছি বাংলাদেশ নিয়ে তাদের মধ্যে সাধারণ কিছু উদ্বেগ রয়েছে এবং সেটি র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থী রাজনীতি নিয়ে। তাদের কাছে বর্তমান সরকার একটি জিনিস সফলভাবে বিক্রি করেছে: সেটি হলো ইসলাম ও চরমপন্থা। সরকার পশ্চিমাদের ভয় দেখায় যে, গণতন্ত্র দিলে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় আসবে এবং বিএনপি’র সাথে জামায়াত এবং অন্য ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনী জোট দেখিয়ে তারা এ কাজটি করে।

আমার সামনে যতবারই সুযোগ এসেছে আমি তাদের উদ্বেগটি জানার চেষ্টা করেছি এবং সুযোগ পেলে তাদের বুঝাপড়ার ফাঁক নিয়ে আলোচনা করেছি। তাদেরকে বলতে চেষ্টা করেছি যে বাংলাদেশে ইসলাম একটা ডমিনেন্ট ডিসকোর্স হলেও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলো বরাবরই ছিলো ফ্রিঞ্জ বা প্রান্তিক শক্তি। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলাম প্রশ্নে সংরক্ষণবাদী এটি সত্য হলেও ইসলামী দলগুলোকে ভোট দিয়ে তারা ক্ষমতায় আনে না। তাদেরকে জানাতে হয় যে বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের ভোটের পরিসংখ্যানে ইসলামী দলগুলোর সম্মিলিত ভোটের পরিমাণ কখনো ১০ শতাংশ অতিক্রম করেনি। বহু পশ্চিমা বিশ্লেষক এ কথা শুনে আশ্চর্য হয়েছে যখন আমি বলেছি যে বাংলাদেশে বর্তমানে ইসলামী চরমপন্থার নামে যা বিক্রি হচ্ছে তার উর্বর ক্ষেত্র হচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। এটিই চরমপন্থী রাজনীতির সবচেয়ে বড় এনেবলারের কাজ করছে ও ভবিষ্যতেও করবে। তাদের সামনে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর উদাহরণ দিতে হয়েছে, আবার পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক, বাংলাদেশের সামরিক শাসকদের আমলকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হয়েছে। অনেকে উত্তরণ কী জানতে চায়। আমার উত্তর হচ্ছে: বাংলাদেশে চরমপন্থা মোকাবেলার অন্যতম প্রধান উপায় (একমাত্র উপায় নয়) হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া।

গণতন্ত্র নিজেই চরমপন্থার ফিল্টার। কিছু লোকের কুযুক্তির প্রতি সতর্ক থাকুন যারা মোদি, ট্রাম্পের মতো ব্যতিক্রমী উদাহরণগুলোকে দেখিয়ে বলে এটাই গণতন্ত্র – তাদের যুক্তি আংশিক সত্য, কারণ কিছু বাজে লোক গণতন্ত্রের ফাঁক গলে ঠিকই ক্ষমতায় চলে আসে, কিন্তু কুযুক্তি দেওয়া ওই দুষ্টু লোকগুলো যেটা আপনাকে কখনোই বলে না সেটি হলো: এই গণতন্ত্রই আবার মোদি ও ট্রাম্পের মতো ব্যক্তিদের ছুড়ে ফেলে দিয়ে তার কোর্স কারেকশন করে। আর এই কোর্স কারেকশনের সক্ষমতাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি।

সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া 
গবেষক









কার্টসি — https://rb.gy/seohq8

Tuesday, November 3, 2020

আপসহীন জননেতা তরিকুল ইসলাম

— মোঃ তাইফুল ইসলাম টিপু




তরিকুল ইসলাম ছিলেন শতভাগ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, সৎ ও সাচ্চা দেশপ্রেমিক জননেতা। শত নির্যাতনের মাঝেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন থেকেছেন তরিকুল ইসলাম। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস এবং নেতাকর্মীদের প্রতি কমিটমেন্ট তাঁর নেতৃত্বকে উদ্ভাসিত করেছে। তিনি দলমত নির্বশেষে সর্বমহলে ছিলেন জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন স্বাধীন মতপ্রকাশে বিশ্বাসী একজন সৃষ্টিশীল গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বও। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির হাতেখড়ি, দীর্ঘ অবিজ্ঞতা সম্পন্ন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন,

‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব সৃষ্টি যখন বিলীন হবে দেশের স্বাধীনতা-গণতন্ত্র ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাসহ শোষিত মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের পথও ততোটাই রুদ্ধ হবে।’

একজন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ হওয়া যে কতো কঠিন তা তরিকুল ইসলাম এর রাজনৈতিক জীবনাদর্শ বিশ্লেষণ করলে তা পরতে পরতে অনুধাবন করা যায়। একজন রাজনীতিবিদের যে সংজ্ঞা ও গুণাবলী থাকা দরকার ছিল তরিকুল ইসলামের মাঝে কোনটারই কমতি ছিল না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশিই ছিল।



১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর তরিকুল ইসলাম যশোর শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ব্যবসায়ী আলহাজ্জ্ব আব্দুল আজিজ ও মাতা গৃহিনী মোসাম্মৎ নূরজাহান বেগম দম্পতির সুযোগ্যপুত্র তরিকুল। স্ত্রী নার্গিস ইসলাম তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও যশোর সরকারি সিটি কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ। ছাত্রজীবনে নার্গিস ইসলাম রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। কিন্তু বাঙ্গালী বধূদের মতো স্বামী, সংসার আগলে রাখতে উচ্চশিক্ষিত নার্গিস ইসলাম বিয়ের পর আর সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেননি। কিন্তু স্বামী তরিকুলের মৃত্যুরপর নেতাকর্মীদের চাপে তাকেও শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে আসতে হয়েছে। তিনি বর্তমানে যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।

১৯৬১ সালে তরিকুল ইসলাম, যশোর জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা, ১৯৬৩ সালে যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় থেকে আইএ এবং ১৯৬৮ সালে একই কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে তার রাজনীতি শুরু। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন তিনি। তিনি ১৯৬৩ সালে সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দেলনের যুগ্ম-আহবায়ক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি তৎকালীন মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিপরীতে ফাতেমা জিন্নাহ-এর অনুকূলে জনমত সৃষ্টির জন্য অধ্যাপক শরীফ হোসেনের সহযোদ্ধা হিসেবে গ্রামে গ্রামে গমন এবং মানুষকে সংগঠিত করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই শোষিত ছাত্র জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে সর্বোচ্চ বিলিয়ে দিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। শোষিত মানুষের পক্ষে সংগ্রাম করতে গিয়ে কখনও ইটের ভাটায়, কখনও গরিব মানুষের কুঁড়ে ঘরে এবং কখনও কলার ভেলায় রাত্রি যাপন করেছেন। তিনি মাইলের পর মাইল ক্লান্তিহীনভাবে কর্দমাক্ত পথ পায়ে হেঁটেছেন।



বিচিত্রময় রাজনৈতিক জীবনে তরিকুল ইসলাম বহুবার কারাবরণ করেন ও নির্যাতনের শিকার হন। যশোর এমএম কলেজে শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগ নিতে গিয়েও তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন স্থানীয় এমএনএ কর্তৃক দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় তরিকুল ইসলামকে বেশ কিছুদিন কারাবরণ করতে হয়। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের জন্য তাঁকে রাজবন্দী হিসাবে দীর্ঘ নয় মাস যশোর ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকতে হয়েছে। সাবেক পাকিস্তান আমল ও পরবর্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনসহ ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র গণআন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য পুলিশ কর্তৃক নির্যাতিত হন এবং বেশ কিছুদিন হাজতবাস করেন। জাতীয় রাজনীতিতে তরিকুল ইসলাম ছিলেন একজন প্রথম সারির নেতা। ১৯৭০ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগদান করেন তিনি। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আহুত ফারাক্কা লং মার্চে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বীরত্বের সহিত দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করেন। 

১৯৭৩ সালে তরিকুল ইসলাম যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে তিনি তিন মাস কারাভোগ করেন। ১৯৭৮ সালে তরিকুল ইসলাম যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে তিনি ফ্রন্টের হ্যাঁ/না নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। মরহুম মশিউর যাদু মিয়ার নেতৃত্বে ন্যাপ (ভাসানী) বিলুপ্ত হলে তিনি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির বৃহত্তর যশোর জেলা শাখার আহবায়ক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যশোর সদর নির্বাচনী এলাকা (যশোর-৩) থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান বীরউত্তম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটিতে বিশেষ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। 

তিনি যে সারাজীবনই রাজনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন তার প্রমাণ-সেই সময় একটি দলীয় মিটিংয়ে দলের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেছিলেন সবাই মন্ত্রী হতে চায়, দল করবে কে ? তখন তরিকুল ইসলাম দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমি দল করতে চাই।’ ১৯৮২ সালের ৫ মার্চ বিচারপতি সাত্তার সাহেব এর মন্ত্রী পরিষদে জনাব তরিকুল ইসলাম সড়ক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। নির্বাচিত একটি সরকারকে বন্দুকের নলের জোরে ১৯৮২ সালে স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর তরিকুল ইসলাম কারারুদ্ধ হন। দীর্ঘ তিন মাস তাঁকে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে প্রতিদিন তাঁর হাত পা বেঁধে ঝুলিয়ে তাঁর শরীরে প্রহার করা হতো। তাঁর চোখ মুখে গরম পানি ঢেলে দেয়াসহ তাঁর সকল দাঁত উপড়িয়ে ফেলা হয়। শুধুমাত্র তরিকুল ইসলামকে এরাশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগাদানে রাজি করাতেই এসব ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়। এই নির্যাতনের ভয়াবহতা এমনই ছিল যে, সেই সময় কারাগারে তাঁর স্বজনেরা প্রথম দর্শণে তাকে চিনতে পর্যন্ত পারেননি। তাঁর মুখমণ্ড সহ সারা শরীর ছিল ক্ষত-বিক্ষত। কিন্তু তিনি এতো নির্যাতনের পরেও তাঁর রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। অতঃপর তথাকথিত এরশাদ হত্যা প্রচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি হিসেবে দীর্ঘ নয় মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ থাকেন। সেখানেও তাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন যে কয়জন নেতা দেশনেত্রী ও গণতন্ত্রের মাতা বেগম খালেদা জিয়াকে দল এবং দেশের প্রয়োজনে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে উৎসাহিত করেছেন তার মধ্যে তরিকুল ইসলাম অন্যতম। স্বৈরাচার এরশাদের সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেকেই লোভ-লালসায় পড়ে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করলেও ব্যতিক্রম ছিলেন তরিকুল ইসলাম।

তিনি সকল ধরণের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পাশে থেকে বিএনপি’র পতাকাকে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথরিয়া অর্থাৎ দেশের সর্বত্র উড্ডীন রেখেছেন। ১৯৮৬ সালে তরিকুল ইসলামকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯০'র গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরিকুল ইসলাম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্তরণের পর ১৯৯১ এর সংসদ নির্বাচনে তাকে ১০৩ ভোটে পরাজিত দেখানো হলেও পরবর্তীতে পুনর্গণনায় তিনি বিজয়ী হন। কিন্তু ওই নির্বাচনে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। সেসময় অনেকেই মন্ত্রী হওয়ার জন্য তদবিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এখানেও তরিকুল ইসলাম ছিলেন ব্যতিক্রম। কিন্তু তার অবদান দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভুলে যাননি। তরিকুল ইসলামের প্রতি শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা থেকে তাঁকে ১৯৯১ সালে সরকারের সমাজকল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং ১৯৯২ সালে ওই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেন। এ সময়ে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসাবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি ঐ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালের উপ-নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি যশোর-৩ আসনের এমপি নির্বাচিত হন। বিএনপি’র মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হলে তিনি বাংলাদেশ সরকারের খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয় এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। 

২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত দলের ৫ম কাউন্সিলে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ পান। তিনি কখনোই পদের জন্য রাজনীতি করেনি। তার প্রমাণ- ১৯৮৮ সালে দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁকে বিএনপি’র মহাসচিব হওয়ার জন্য প্রস্তাব করেছিলেন। ওই সময়ে তাঁর ঢাকাতে থাকা ও যাতায়াতের জন্য নিজের কোনো বাড়ী-গাড়ী না থাকায় তিনি সেই প্রস্তাব বিনয়ের সহিত প্রত্যাখান করেন। তরিকুল ইসলামের জন্য সেই ব্যবস্থাও করতে চেয়েছিলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। শীর্ষ নেতৃত্বকে ওয়াদা করে তিনি বলেছিলেন,‘আমি যেখানেই থাকি আমার উপর অর্পিত সকল দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবো।’

২০০৯ সালে জাতীয় কাউন্সিলের সময় তাঁকে আবারও মহাসচিব করার বিষয়ে আলোচনা শুরু হলে তিনি এ্যাড.  খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দলের চেয়ারপারসনকে বলেছিলেন যে, ‘দলের দু:সময়ে  খোন্দকার সাহেব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন বিধায় তাঁকেই পুনরায় মহাসচিব রাখা হোক।’

তরিকুল ইসলাম অনেক আগেই দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। রাজনীতিতে অনেক জুনিয়র তাঁর চাইতে বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি তাতে দলের প্রতি রাগ-অভিমান করেননি। সকল সময়ে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা ছিল বিধায় যখনই দলের সংঙ্কট দেখা দিয়েছে ঠিক তখনই সংঙ্কট মোকাবেলায় তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি যথাযথভাবে সংঙ্কট মোকাবেলা করে স্ব-স্থানে ফিরে গিয়েছেন। দলের প্রায় সকল সম্মেলনে তাঁকে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধনের চেয়ারম্যান মনোনিত করা হতো। তরিকুল ইসলাম সদালাপি ও জনবান্ধব নেতা ছিলেন। তিনি সারাজীবনই জনতার মাঝে থাকতে পছন্দ করতেন। সারাদেশসহ খুলনা বিভাগের এমন কোন ইউনিয়ন ও থানা নেই যেখানে তাঁর পদার্পণ ঘটেনি। তিনি শেষ বয়সে অসুস্থ অবস্থাতেও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি অধিকাংশ সময় যশোরে থাকতেন, দলের প্রয়োজনে ঢাকায় আসলেও কাজ শেষে আবার ফিরে যেতেন গ্রামজনপদের মানুষের কাছে। তাঁকে কখনোই কোন ব্যক্তি বা বলয় প্রভাবিত করতে পারতেন না। তিনি নিজে যা ভাল মনে করতেন তা নেতাকর্মীদের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। এমনকি তাঁর পরিবারের সদস্যরাও দলীয় সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না। 

কর্মীদের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অগাধ। কাউকে কখনো কোন দায়িত্ব দিলে তার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সার্বক্ষণিক খবর রাখতেন। দলের কোন নেতাকর্মীই তাঁর কাছে দূরের কেউ ছিলনা, কারণ যিনি ভাল কাজ করতেন তাকেই তিনি সেই কাজের বিষয়ে যথাযথ মূল্যায়ন করতেন। তিনি সদা স্পষ্টবাদী নেতা ছিলেন। তিনি অকপটে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরের নেতাকর্মীদেরকে সত্য কথা বলতেন। দলের যেকোন নেতাকর্মীই বিপদে পড়লেই তাঁর কাছে ছুটে যেতেন, তিনি যথাযথ সমাধান দেয়ার চেষ্টা করতেন। এই কারণেই তিনি বিএনপি’র সকল নেতাকর্মীর কাছে সম্মানের পাত্র ছিলেন। তিনি অনেক সময় প্রচণ্ড রেগে যেতেন, নেতাকর্মীদেরকে শাসন করতেন আবার কিছুক্ষণ পরেই মনের গভীর থেকে মায়া মমতা দিয়ে আদর করতেন। 

তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অপরিসীম। তিনি সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরকে বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ রাখার কাজে ছিলেন দক্ষ সংগঠনের ন্যায় পারদর্শী। তিনি একজন নির্লোভ সাদামাটা প্রকৃতির নেতা ছিলেন। তিনি ৪ বার মন্ত্রী থাকার পরেও ঢাকা শহরে ১টি সীমিত আকারের ফ্ল্যাট ছাড়া তাঁর আর কিছুই নেই। পারিবারিক ব্যবসা থাকার পরেও রাজনৈতিক কারণে সেই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ততার মুখে পড়েছে। তিনি একজন দূরদর্শী নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন, ১/১১’র তথাকথিত সরকার অনেককেই যখন কারাগারে নিয়েছিলেন তখন জিয়া পরিবারকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করার প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের এই প্রক্রিয়ার বিরোধীতা করার কারণে তাকে কারাগারে নেয়া হয়েছিলো। কারাগারে সকলেই যখন উদ্বিগ্ন তখন তিনি সকলকে বলতেন সর্বোচ্চ ২ বছরের বেশি এই সরকার টিকে থাকতে পারবে না, ঠিক তেমনটাই হয়েছে। 

তিনি স্বৈরাচারের নির্যাতনে শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ হওয়ার পরও তাঁর মেধা ছিল অপরিসীম। কারণ একবার কোন কথা শুনলে সেটি আর ভুলতেন না এবং কোন কর্মীকে একবার দেখলে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মনে রাখতে পারতেন। তিনি কখনোই স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় দিতেন না। সেটির উদাহরণ মিলে তার ছেলেকে গত ২০১৬ সালের কাউন্সিলে পদ দেয়ার বিষয়ে তাঁর সম্মতি নিতে অনেক নেতাই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি সম্মতি দেননি। এমনকি তিনি তাদের বলেছেন আমি এ বিষয়ে কাউকে বলতে পারবো না। তিনি মিতব্যয়ী ছিলেন, কারণ তাঁকে কোন দায়িত্ব দিলে যে পরিমান খরচ হতো অন্যদের দায়িত্ব দিলে তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হতো। তিনি কখনোই অর্থের জন্য কারো কাছে মাথানত করেননি। অনেক সময় অর্থের অভাবে তাঁর চিকিৎসা বিলম্বিত হয়েছে, দলের চেয়ারপারসন অনেক সময় তাঁর চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন সেটিও তিনি বিনয়ের সহিত গ্রহণ করেননি। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের আন্দোলন পর্যন্ত বিভিন্ন কৌশলে যে কয়জন নেতা আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছিলেন তরিকুল ইসলাম ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম। তিনি যখনই কোন গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে যাওয়ার আগে তৃণমূল থেকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সহিত আলাপ করে তাদের মনোভাব জানার চেষ্টা করতেন এবং মিটিংয়ে সে সকল নেতাদের মতামতকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করতেন। তাঁর বাসা বাড়ীতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সদালাপ ও চা পান ব্যতিত কেউ ফিরতেন না। 

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তথা জিয়া পরিবারের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল অপরিসীম। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখনও তিনি বিছানায় শুয়ে নেতাকর্মীদেরকে নেত্রীর জন্য কিছু করার পরামর্শ দিতেন। দেশনেত্রীর যেদিন মামলার তারিখ থাকতো সেদিন শুয়ে শুয়ে টেলিভিশনের দিকে লক্ষ্য রাখতেন, মাঝে মাঝে নেতাকর্মী এবং আইনজীবীদের ফোন করে খবর নিতেন। যখনই শুনতেন নেত্রীর জামিন হয়নি তখনই তিনি নীরব-নিথর হয়ে যেতেন। অবশেষে নেত্রীকে শেষ বারের মতো মুক্ত না দেখার যন্ত্রণা নিয়েই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন তিনি।

আজ দেশে বিভিন্নভাবে অনেকেই নেতা হচ্ছেন কিন্ত তরিকুল ইসলামের মতো ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজপথে সংগ্রাম করে নেতৃত্ব সৃষ্টি এখন প্রায় বিলীনের পথে বিধায় রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের মধ্যে মমত্ববোধ এবং ভ্রাতৃত্ব নি:শেষের পথে। আগামি দিনে তরিকুল ইসলামের মতো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব সৃষ্টি যতো বিলীন হবে দেশের স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাসহ শোষিত মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের পথ ততো বেশি বিলীন হবে। তাই দেশ ও দলকে এগিয়ে নিতে তাঁর মতো একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ তৈরি করতে হবে বার বার।


  • লেখক                                                 
    তাইফুল ইসলাম টিপু

মোঃ তাইফুল ইসলাম টিপু
সহদপ্তর সম্পাক
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি

Saturday, October 24, 2020

একজন এম কে আনোয়ার

— মহিউদ্দিন খান মোহন

এম কে আনোয়ার



গণচীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং-এর একটি অমর বাণী আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো কোনো মৃত্যু পাহাড়ের চেয়ে ভারী, কোনো কোনো মৃত্যু হাঁসের পালকের চেয়েও হালকা।’ কথাটি যে কী বিরাট তাৎপর্যময় এবং এর মর্মার্থ কতটা গভীর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাস্তবিকই কোনো কোনো মৃত্যু মানুষকে ভীষণভাবে শোকে মুহ্যমান করে, বেদনায় নীল করে দেয়। তখন সে মৃত্যু নিছক একজন মানুষের এ নশ্বর পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য চলে যাওয়ায় সীমাবদ্ধ থাকে না, তা তৈরি করে এক বিশাল শূন্যতা ।

এক সময়ের দাপুটে আমলা এবং মন্ত্রী এম কে আনোয়ারের চলে যাওয়াটা ঠিক এ রকমই। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি ইন্তেকাল করেছেন। পেছনে ফেলে গেছেন তার বিশাল কর্মময় জীবন, শোকের সাগরে ভাসিয়ে গেছেন অগনিত ভক্ত, সুহৃদ, আর সহকর্মীকে। ১৯৩৩ সালের ১ জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার ওপারচর গ্রামে জন্ম মোহাম্মদ খোরশেদ আনোয়ারের, যিনি এম কে অনোয়ার নামেই সমধিক পরিচিত। ১৯৫৪ সালে বিএসসি অনার্স এবং ১৯৫৬ সালে পরিসংখ্যানে মাস্টার্স করার পর একই বছর যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দক্ষতা ও বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখে একের পর এক ডিঙ্গিয়েছেন সাফল্যের সিঁড়ি। জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার, অর্থ সচিব এবং কেবিনেট সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। চাকরি জীবন শেষে যোগ দিয়েছিলেন রাজনীতিতে। আর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েই নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য, হয়েছিলেন মন্ত্রী।

এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন এম কে আনোয়ার। সরকারি প্রশাসনের যে পর্যায়েই ছিলেন, নিজের এলাকার সাথে ছিল তার নিবিড় যোগাযোগ। আমাদের দেশে বেশিরভাগ আমলাকে দেখা যায় জনসম্পৃৃক্তি এড়িয়ে চলতে। নিজের এলাকার সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ রাখেন না। কিন্তু এম কে আনোয়ার ছিলেন এর ব্যতিক্রম। আমলা হিসেবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। এলাকার সাথে তার এ নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ তাকে করে তুলেছিল বিপুল জনপ্রিয়। এলাকাবাসীর কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন একজন জনদরদী ও উন্নয়ন পাগল মানুষ হিসেবে। আমাদের দেশে সাধারণত দেখা যায়, ক্ষমতা হাতে পেলে বেশিরভাগ মানুষ নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রেও এম কে অনোয়ার ছিলেন ভিন্ন চরিত্রের। ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনি তার এলাকাবসীর কল্যাণে কাজ করেছেন, উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। এটা শীর্ষ আমলা হিসেবে যেমন, ক্ষমতাশালী মন্ত্রী হিসেবেও তেমন।

অসাধারণ মেধাবী ছিলেন এম কে আনোয়ার। শিক্ষাজীবনে যেমন তার স্বাক্ষর রেখেছেন, তেমনি কর্মজীবনেও তার ছাপ ছিল স্পষ্ট। এমন কি রাজনীতিতেও তিনি তার সে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। রাজনীতিতে তার আগমনটা ছিল তিনি ‘এলেন, দেখলেন, জয় করলেন’ ধরনের। রাজনীতিতে যোগ দিয়েই তিনি নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। বিএনপি’র মনোনয়নে ১৯৯১ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন এবং সে বছরই বিএনপি সরকারের মন্ত্রী হন। সেই যে শুরু আর পেছনে তাকাতে হয়নি এম কে আনোয়ারকে। তার এলাকায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিদন্ধি  জনপ্রিয় নেতা। তার জনপ্রিয়তার কাছে অন্যরা হয়ে পড়েছিলেন ম্লান। মোট পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু তার জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাটা পড়েনি।

এম কে আনোয়ারে চরিত্রের আরেকটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তাহলো সুদীর্ঘ কর্মজীবনে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকা। সরকারি আমলা হিসেবে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের কর্মজীবন এবং সাতাশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন প্রচন্ড ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার মওকা খোঁজেননি কখনোই। যেখানে সামান্য ক্ষমতার বাতাস গায়ে লাগলে কোনো কোনো মানুষকে দুর্নীতির সাগরে হাবুডুবু খেতে দেখা যায়, সেখানে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের। আর তাই, সারাজীবন তাকে দেখা গেছে অতি সাধারণ জীবন যাপন করতে। সুযোগ পেয়েও দুর্নীতির অগ্রাসন থেকে নিজেকে রক্ষা করার এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন এম কে আনোয়ার।

দেশ ও জাতির সেবায় অত্মনিবেদিত ছিলেন এম কে আনোয়ার। এ জন্যই একজন নিষ্ঠাবান সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণের পর রাজনীতির জটিলক্ষেত্রে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। একজন রাজনীতিক হিসেবে তিনি তার দল এবং দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে। রাজনৈতিক অবস্থান এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি বিত্ত বৈভব গড়ে তোলার মতো অনৈতিক কাজে লিপ্ত হননি।

এম কে আনোয়ার ছিলেন একজন ভালো মানুষ। কোনো অনৈতিক কাজে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার কথা কখনো শোনা যায়নি। অথচ, দুঃখজনক হলো বাসে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যার হুকুমদাতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে হয়েছে তাকে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে। ৮২ বছর বয়সে এসে এমন উদ্ভট অভিযোগ এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে জেলখাটার ঘটনা তাকে খুবই মর্মাহত করেছিল। সারাজীবন পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করেছেন তিনি। কিন্তু জীবন শায়াহ্নে এসে মানুষ খুনের হুকুমদাতা হিসেবে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনা সহজভাবে নিতে পারেননি তিনি। মন ভেঙ্গে গিয়েছিল তার। পরিচিতজনদের বলেছেনও সে কথা। তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি, কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে একজন নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন কাল্পনিক অভিযোগ আনা যেতে পারে! সারাজীবন নিয়ম-নিষ্ঠার অনুশীলনকারী এম কে আনোয়ার বোধকরি রাজনীতির এ অন্ধকার দিকটি সম্পর্কে একরকম অজ্ঞই ছিলেন। তিনি বোধহয় ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এমন অভিযোগের শিকার তাকে হতে হবে। সে মনোবেদনার বোঝা বুকে নিয়েই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

এম কে অনোয়ার চলে গেলেন। পেছনে রেখে গেলেন সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, কর্তব্যপরায়ণতা ও মানবসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা তাকে জাতির হৃদয়ে চির অমর করে রাখবে।


  • কার্টসি — ইনকিলাব/ ২৮ অক্টোবর ২০১৭ 

Wednesday, October 21, 2020

সারমেয় প্রবৃত্তি

—  আহাদ আহমেদ


সারমেয় সমাজে একটা রীতি আছে, নিয়ম আছে তার প্রজননের। যেটাকে প্রজনন মৌসুম  বলে। পশু সমাজে এটা নিয়ম মেনেই হয়। এরকম মৌসুমে রাস্তার সারমেয়রা যত্রতত্র সঙ্গীর গায়ের ওপর লাফিয়ে ওঠে।কেউ কখনো বলে নাই যে এই সারমেয়টি ধর্ষকামী বা ধর্ষক।কিংবা কেউ এমনও মুন্ডুপাত বিশেষ করে না যে, -"ছ্যা ছ্যা সারমেয় সমাজটা একদম  রসাতলে গেল গো!!"
বাংলা প্রবচন আছে- কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে পায়।তাই বলে কি কুকুরের পায়ে কামড় দেয়া মানুষের শোভা পায়?
আজ দেশে মেগা-দুর্নীতি আর হত্যা-গুমের যে সংস্কৃতি চলছে, দেশের মালিক জনগনকে যে ভাবে পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ায় অবজ্ঞার ব্যাবস্থা করা হয়েছে তা সারমেয় মনোজগতেরই লক্ষন। যেটা সারমেয় সমাজে রীতি সেটা মানুষের সমাজের নীতি হতে পারে না। গরুর হাটে বাজারে দেখা যায় কিছু  বেয়াড়া ষাড় ত্রাস তৈরি করে। দড়িটি যে কৃষক বা গরুর মালিকের  হাতে বা খুটিতে বাঁধা সে জানে দুই ঘা বসিয়ে দিতে হবে দমন করতে। নাকি দড়ি ছেড়ে দিতে হবে?
এই যে দুই ঘা বসাতে আলাদা করে আইন করার দরকার নেই। এটাই পশু পালনের নিয়ম।
কোন দেশে মানুষের  মধ্যে সারমেয় প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটে জবাবদিহিতার অনপুস্থিতিত্তে। সাধারণতঃ বাধাহীন জনরায়  প্রকাশের মাধ্যম  নির্বাচন ব্যবস্থা চালু থাকলে  ন্যুনতম  জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।তাই ভোটাধিকার  প্রয়োগের একটা নিরপেক্ষ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সাথে সারমেয় প্রবৃত্তি দমন অঙ্গাঅঙ্গি জড়িত।


  • লেখক - রাজনৈতিক বিশ্লেষক