Search

Friday, June 25, 2021

প্রথম আলো — প্রোপাগান্ডা নয়, সাংবাদিকতার সাথে থাকো

-----------------------------

মুহম্মদ ইসমাইল 

-----------------------------

তারেক রহমান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, বিএনপি
বাংলাদেশ আজ দুই ভয়াবহ কঠিন সমস্যায় জর্জরিত-মুমূর্ষু-স্তব্দ, শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতিতে নাগরিকেরা — প্রথম সমস্যা, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও মানুষের ভোটাধিকার না থাকায় জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন শাসকগোষ্ঠী স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি আর গণতন্ত্রপন্থী মানুষদেরকে নিষ্ঠুর নির্যাতনের মাধ্যমে অবলীলায় টার্মের পর টার্ম ক্ষমতায় বসে আছে। জনগণের অধিকার নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়ছে না এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে করোনাভাইরাস বিশ্বমহামারির ফলে সারাদেশে মানুষ অকাতরে কোভিড নাইনটিনে আক্রান্ত হচ্ছেন, বেঘোরে মারা যাচ্ছেন, মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ আছেন, অর্থনৈতিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। জীবন-জীবিকা বাঁচাতে শূন্যহাতে লড়াই করছেন তারা । দিশেহারা উদ্বিগ্ন সমগ্র জাতি। ভিন্ন এক সময় পার হচ্ছে জাতি।     

অথচ দেশের প্রধান একটি দৈনিক পত্রিকা হিসেবে ‘প্রথম আলো’ দেশের এই দুই চ্যালেঞ্জ নিয়ে রুটিন মাফিক কিছু ডেস্ক রিপোর্টিং ছাড়া কিছুই করছে না। মানুষের যে ভোটাধিকার নেই,  গণতন্ত্র নেই, মানুষের কথা বলার অধিকার নেই, বিচার পাচ্ছে না, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে অন্ধকারাচ্ছন্ন যে গোটা দেশ — এসবের কোন প্রতিফলন এই পত্রিকায় দেখা যায় না।  সংবাদপত্র জনগণের দর্পণ। মিডিয়াকে বলা হয় রাষ্ট্রের ‘ফোর্থ স্টেট’। রাষ্ট্রকে সঠিক পথে রাখতে মিডিয়ার রয়েছে পবিত্র দায়িত্ব। মানুষের অধিকার আর মানুষের সামগ্রিক বিষয়কে কেন্দ্র করেই একটি গণমাধ্যম বেড়ে গড়ে ওঠে। এটিই একটি জাতীয় মিডিয়া আউটলেটের কাজ এবং এই পবিত্র দায়িত্ব পালনের প্রধান শর্ত পূরণের শপথ নিয়েই এই অর্গানাইজেশন অনুমতি লাভ করে। সংবাদপত্র, রেডিয়ো, টিভি, ইন্টারনেট নিউজপেপার যে মাধ্যমেই হউক না কেনো একটি গণমাধ্যমের কাজ হচ্ছে সত্য উৎঘাটন করা, মানুষের অধিকারের পক্ষে থাকা, এর ব্যত্যয় হওয়া মানে পবিত্র দায়িত্বের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা।   দেশে দেশে যুগে যুগে গণতন্ত্র আর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে গণমাধ্যম সাহসী ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ ও নব্বই দশকের স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সংবাদমাধ্যম সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। অথচ দেশে আজ এক যুগ ধরে গণতন্ত্র নেই, মানুষের কথা বলার অধিকারও নেই। সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। কিন্তু প্রথম আলো যেনো উট পাখির মতো বালির ভিতর মুখ লুকিয়ে পালিয়ে থেকে টিকে থাকার নীতির সাথেই চলছে!  


করোনাভাইরাস বিশ্বমহামারিতে সরকারের ব্যর্থতা, মানুষের ভোগান্তী, সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরার কাজটি করতেও প্রথম আলো যেনো নিত্য ভয় পাচ্ছে। ভয়াবহ করোনাভাইরাস বিষয়ে সরকার ও জনগনকে আগাম সতর্ক করতে  আট কলাম ব্যানার হেডলাইন পাঠক হিসেবে আমাদের চোখে পড়েনি! এটি একটি বড়ো কাজ ছিল। সরকার ও দেশবাসীকে একটা ম্যাসেজ দেয়া জরুরি ছিল যে এক ভয়াবহ বিপর্যয় আসছে দেশে। কিন্তু রুটিন, কপিপেস্ট ডেস্ক রিপোর্টিং এর বাইরে কিছু করেনি প্রথম আলো! কর্তৃপক্ষ যা বলছে তা-ই   প্রথম আলো ছাপছে, প্রকাশ করছে। এবং সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় এবং নানা উপায়ে প্রকাশ করছে করোনাভাইরাস তেমন কিছু না, একে জয় করবে সরকার। অথচ নিজের জগতটাকে বিস্তৃত করে চোখ মেলে একটু বিশ্ব মিডিয়াগুলোর দিকে তাকালে প্রথম আলো দেখতে পারত কোভিড নাইনটিকে তারা কিভাবে কাভার করছে। দেশে দেশে সরকারসমূহ তাদের জনগণের জীবন ও জীবিকার দায়িত্ব নিয়েছে। নাগরিকেরা পাচ্ছেন অর্থনৈতিক সহযোগিতা, নিখরচায় চিকিৎসা। অনেক দেশে  ব্যর্থ সরকারদেরকে সরে যেতে হয়েছে।  অথচ জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে জনগণের প্রাপ্য অধিকারের বিষয়ে কোন প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় না প্রথম আলোকে।  অথচ এটি গণমাধ্যমের নিত্য কাজ। এই জন্য একটি সম্পাদকীয় বিভাগই থাকে, যেখানে প্রতিদিন জনগণের কণ্ঠ শুনতে পাওয়া যাওয়ার কথা ছিল। 

পাঠক হিসেবে দেখি প্রথম আলো খেলাধুলা ও ইন্ডিয়ান সিনেমার নায়ক নায়িকাদের খবরাখবর প্রকাশ করতেই ব্যস্ত থাকছে সারাক্ষণ যখন করোনাভাইরাস সারা বিশ্বকে থমকে রেখেছে! পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। খেলার খবরই বড়ো বড়ো করে থাকে প্রথম পাতায়। আপনি আজকেই তাদের বিনোদন সেকশন একটি চেক করে আসেন। যেন এটি ইন্ডিয়ান পত্রিকা। প্রথম আলোকে প্রশ্ন, ভারতের কোন পত্রিকায় কি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের কোন সংবাদ এতো বড়ো করে প্রতিদিন প্রকাশ করে? আপনাদের কি আত্নসম্মানবোধে লাগে না। আপনারা ভিন্ন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতির নিত্য প্রচার ও প্রশার করে যাচ্ছেন! কিন্তু বাংলাদেশী সাংস্কৃতিকে অন্য দেশতো প্রমোট করছে না। 

সারা বিশ্বে এবং আমাদের দেশে করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিকজনিত এমন ভয়াবহ শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতিতেও জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সরকার প্রযোজিত ঘূর্ণমান ‘তারেক রহমান’ গিবতের সাথে তাল মেলাতে যেন প্রথম আলো পণ ধরেছে। নির্লজ্জভাবে প্রোপাগান্ডা মেশিন হিসেবে নিজেকে ব্যবহার করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপক্ষেই অবস্থান সুস্পষ্ট করছে। আস্থা হারাচ্ছে প্রথম আলো। পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে পত্রিকাটি। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থেকে সুপরিকল্পিতভাবে অপ্রাসঙ্গিক ও অদরকারি বিষয়ে অসত্য রিপোর্ট তৈরি করে 'কৃত্রিমইস্যু' সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্তকরে জাতির চলমান চ্যালেঞ্জসমূহ থেকে তাদের চিন্তাজগতকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করছে।  

প্রতিটি সংবাদপত্রের রিপোর্ট প্রস্তুতকরণ, বাছাই ও সম্পাদনার নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকে। রিপোর্টারকে আস্যাইনমেন্ট দেয়া হয় অথবা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রিপোর্টার সংবাদ লেখেন।  অথচ  সংবাদ তৈরি ও প্রকাশের ন্যূনতম মানদণ্ডও বজায় না রেখে বৃহসস্পতিবার, জুন ২৪, ২০২১, সকালে একটা অসত্য রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। প্রথম আলো এখন যেনো মিথ্যাচার, গল্পগুজব, ইন্ডিয়ান নাচ, গানের কারখানা! রিপোর্টারকে প্রশ্ন দেশের চলমান রাজনৈতিক মঞ্চে এমন কী হয়েছে যে এমন একটি মনগড়া ফরমায়েশি রিপোর্ট লিখতে হলো! এ যেন মানুষের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার দীর্ঘ সংগ্রামের পিঠে ছুরিকাঘাত! 

নগর পুড়লে দেবালয় কি এড়ায়

রিপোর্টের হেডলাইন ‘তারেকের নেতৃত্বে বিএনপি দাঁড়াতে পারছে না’। বাস্তবতা হচ্ছে চক্রান্তমূলক একএগারো থেকেই বাংলাদেশ দাঁড়াতে পারছে না। সে কালো দিনে আশির দশকের আন্দোলন সংগ্রাম আর ত্যাগ, রক্ত, জীবন এর বিনিমিয়ে অর্জিত দেড় দশকের গৌরবময় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে পদদলিত করে বাংলাদেশকে ধ্বংস করা হয়েছে।  এই চক্রান্তের অন্যতম ক্রীড়নক হিসেবে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী প্রথম আলোকে বার বার চিহ্নিত করেছে। জেলায় জেলায় মামলা করেছে। এরপর একএগারোর বিশেষ প্রকিয়াজাত সরকার  জানুয়ারি ৫, ২০১৪ এর  বিনাভোটের নির্বাচনের এবং ডিসেম্বর ৩০, ২০১৮ এর মধ্যরাতের নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যত জনগনের ম্যান্ডেটবিহীনভাবে ক্ষমতা দখলে রেখেছে। মানুষ হারিয়েছে ভোটাধিকার, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য। বাংলাদেশ বিপদে, জনগনের শ্বাসরূদ্ধ। ‘গুম-খুন-গ্রেপ্তার-মামলা-হামলা’ এর মাধ্যমে দেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে এর কুফল প্রথম আলোকেও ভোগ করতে হচ্ছে। মামলা, নির্যাতন ভোগ করতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির সাংবাদিকদের। বড় কর্পোরেটদের বিজ্ঞাপনও পাচ্ছে না। এই নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবাদ বা এক্টিভিজম জাতি লক্ষ করছে না। কিন্তু মুখে কুলুপ এটে বসে আছেন তারা।  

তৃণমূল থেকেই উঠে এসেছেন তারেক রহমান। 


কিন্তু প্রথম আলো নিশ্চয়ই জানে যে তারেক রহমান আজকে নেতা হননি। আশির দশকেই তিনি একজন সাধারণ প্রাথমিক সদস্য হিসেবে বিএনপিতে যোগ দিয়ে নেতাকর্মী-সমর্থকদের মাঝে থেকে অবিরাম সংগঠনকে গণতান্ত্রিক উপায়ে শক্তিশালী করার কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই তিনি গণতান্ত্রীক ও শান্তপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে পাল্টে দিতে দিনরাত একাকার করে কাজ করে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে সুদীর্ঘ  কাল ধরে তিনি বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বে দায়িত্বপালন করেই আজকের এই অবস্থানে এসেছেন। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে কৌশল প্রণয়ন ও প্রচারণায় নিউক্লিয়াসের মতো কাজ করেছেন। তারেক রহমান কিন্তু দলে একজন প্রাথমিক সদস্য থেকে শুরু করে চার দশক ধরে মাঠে ময়দানে অক্লান্ত পরিশ্রম করেই সময়ের প্রয়োজনে দলের শীর্ষে এসে পৌঁছেছেন। তিনি পেশায় রাজনীতিবিদ। এর মাঝে বিএনপি তিনবার জনগনের ভোটে সরকার গঠন করেছিল। তারেক রহমান কিন্তু এমপি, মন্ত্রী হননি। তিনি দলের একজন হয়েই জনগণ ও কর্মীর মাঝে থাকতেই পছন্দ করেছিলেন। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দেশ ও দলের জন্য নিরলস কাজ করে গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন। তারেক রহমান আর বিএনপি এক ও অভিন্ন। বিএনপির সবস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ভালোবাসা ও প্রেরণার অসীম উৎস। দলে তারেক রহমানের বিস্তার বিএনপির মূলকাঠামোর সাথে একাকার। এটাই বাস্তব। এইখানে অন্য কোন সমীকরণ সম্ভব নয়, ফল মিলবে না।   


তাঁর ক্রিয়েটিভ  নেতৃত্বে সারাদেশে তৃণমূল বিএনপির যে সাংগঠনিক সভাগুলো তিনি সেই দেড় যুগ আগেই করেছেন, সেই রকম কর্মসূচি অন্যকোন দল এখনো করতে পারেনি। একই সময়ে তারেক রহমানের পরিকল্পনায় দেশে বগুড়াসহ কয়েকটি জেলায় ভোটের মাধ্যমে দলীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বিএনপি বিএনপির সাথে লড়েছিল। সেই সময়ে তাঁর এসব গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড সারাদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। প্রথম আলো চক্র কিন্তু সেগুলো দেখেও দেখিনি।  উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে এইভাবেই দলের কমিটি গঠন ও প্রার্থী নির্বাচন করা হয়। নিজেদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দলে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে অন্যকোন দল কিন্তু এমনটি করতে পারেনি। তারেক রহমান সফল্ভাবেই করে দেখিয়েছেন। দলে গণতন্ত্র চর্চা প্রতিষ্ঠিত করতে তারেক রহমান অবিচল। সর্বশেষ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি তিনি সুদূর লন্ডন থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত থেকে গাইডলাইন দিয়ে ভোটের মাধ্যমে গঠন করেছিলেন। প্রথম আলোকে অনুরোধ করব তারেক রহমান যেভাবে তৃণমূল প্রতিনিধি সভা করেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের আর কোন রাজনৈতিক দল সেটি করতে পেরেছে কীনা তা একটু খতিয়ে দেখে একটা রিপোর্ট প্রকাশ করতে। 

বিএনপি চেয়ারপার্সন, মাদার অব ডেমোক্রেসি, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি গণতান্ত্রিকভাবেই কর্মসূচি পালন করছে। দলের জাতীয় স্থায়ীকমিটি, চেয়ারপার্সন এর উপদেষ্টা কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, অঙ্গ ও সহযোগী কমিটির নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকরা এবং সমমনা পেশাজীবী সংগঠনগুলো দলের পরিকল্পনা মতো কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। 

বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক শান্তিময় দল। এই পথেই অবিরাম ছুটছে বিএনপি।  আর তারেক রহমান আজীবন দলের সেই ম্যারাথন দৌড়ের সাথেই আছেন বিএনপির রাজনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে। হঠাৎ করে এখনি তিনি নেতা হননি। হঠাৎ করেই বিএনপি দাঁড়াতে পারছে না, ব্যাপারটি মোটেও তেমন নয়। কাজেই ‘তারেকের নেতৃত্বে বিএনপি দাঁড়াতে পারছে না’ গিবত তথা অসত্য ছাড়া কিছুই নয়। তারেক রহমানের চার দশকের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে পুরো ভুলে গিয়েই এমন অসত্য ভাবনা সম্ভব। 

রিপোর্টের সাবহেড —  দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ মহলে তারেক রহমানের ব্যাপারে অগ্রহণযোগ্যতা কাটেনি। ফলে ক্ষমতার রাজনীতিতে বিএনপি আগের জায়গাতেই রয়ে গেছে।

কিন্তু রিপোর্টে কোন কোন বিদেশীমহলের কাছে তারেক রহমান এর অগ্রহণযোগ্যতা কাটেনি, সেসব মহলের কারো নাম ও বক্তব্য নেই। রিপোর্টার যেন আষাঢ়ে গল্প বলছেন। পত্রিকা আছে, লেখা প্রকাশের ক্ষমতা আছে বলেই কি একটি সংবাদপত্র এইভাবে অসত্য ও সূত্রবিহীন রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারে? এমন গল্পকাহিনী যে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়, সেটি কি আদৌ কোন সংবাদপত্র? প্রশ্ন রইল প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এর কাছে। প্রথম আলো কি উন্মুক্ত সোশ্যাল মিডিয়া যে যেকেউ তাঁর ইচ্ছামতো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই কিছু পাব্লিশ করে দিতে পারে। 

এবং প্রথম আলো কী স্বৈরতন্ত্র ও বিদেশী প্রভুর দাসত্বে বিশ্বাস করে। চক্রান্তে বিশ্বাস করে?  সরকার গঠন তো হবে জনগণের ভোটের মাধ্যমে। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। এখন প্রশ্নজাগে প্রথম আলো কী মনে করে জনগণ নয় বরং দেশিবিদেশি গুরুত্বপূর্ণ মহল লাখো মানুষের আত্নত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনকে নিয়ন্ত্রণ করছে? গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের পক্ষে থাকলে সেইসব চক্রান্তকারীদের মুখোশ উন্মোচন কিন্তু করছে না প্রথম আলো! প্রথম আলোর সুশীল মুখোশ কিন্তু উন্মোচিত হয়ে গেলো। এমন এক অগণতান্ত্রিক ও চক্রান্তমূলক বিষয়ের অবতারণার মাধ্যমে। প্রথম আলোকে দেশের মানুষে পক্ষেই থাকতে হবে। প্রথম আলোকে সম্পাদকীয় লিখতে হবে যে বিদেশী শক্তি নয়, দেশের জনগণই হতে হবে ক্ষমতার উৎস।   

রিপোর্টের ইন্ট্রোতে লেখা আছে বিএনপির বড় একটি অংশের কাছে নাকি তারেক রহমান এর কর্তৃত্ব ও অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি আছে। এই ‘বড় অংশটির’ কারো নাম বা সূত্রও এখানে উল্লেখ করা হয়নি।  উচ্ছিষ্টভোগী এইসব প্রোপাগান্ডা মেশিনারিজের সবচেয় সহজ রাস্তা ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ এই কথাটিও ব্যবহার করা হয়নি। হায়রে হলুদ সাংবাদিকতা!  

বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি বিএনপি ঐক্যবদ্ধ। জনগণ কিন্তু এই বিষয়ের প্রশংসা করছে। জনগণ বলছে এমন দুর্দিনেও বিএনপি ইস্পাত কঠিন গণঐক্য বন্ধন তৈরি করে দাঁড়িয়ে আছ। আমরা দেখছি যে তারেক রহমান কর্তৃত্ববাদী নন, গণতন্ত্রবাদী। বিএনপির জাতীয় স্থায়ীকমিটির প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত বৈঠক হয়। সেখানে পলিসি নিয়ে  বিস্তারিত আলোচনা শেষে গণতান্ত্রিকভাবেই সিদ্ধান্ত হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই বিষয়ে অনেকবার কথা বলেছেন। কর্তৃত্ববাদী হলে তো এসব মিটিং না করলেও চলতো। প্রথম আলোকে প্রশ্ন, বিনাভোটের যে দলটি ক্ষমতা নির্লজ্জভাবে দখল করে আছে সেই দলের নীতিনির্ধারণী বৈঠক কয় মাস পরপর হয়?   

ইন্ট্রোতে আরো লেখা আছে তারেক রহমান এর নেতৃত্ব দৃঢ় হয়নি। আবার নিচেই লেখা আছে তারেক রহমান দলে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন! একই রিপোর্টে বিপরীতমুখী অবস্থান। এখন প্রশ্ন জাগে প্রথম আলোর সাংবাদিকরা কি সুস্থা আছেন নাকি বেঘোরে কাজ করছেন?   

রিপোর্টার লিখেছেন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। নেতাকর্মীদের ভোটাধিকার নেই, কথা বলার অধিকার নেই। গুম-খুন-গ্রেপ্তার-মামলা-হামলার শিকার হচ্ছেন। দেশে কর্মসংস্থান নেই। এসব কারণে সারাদেশের মানুষই এখন হতাশার অতলে ডুবে আছে। বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থকেরা এই দেশেরই অংশ। দেশের সমগ্র সাংবাদিক সমাজও হতাশায় আছেন। 

দলের সদ্য প্রয়াত জাতীয় নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের এলাকায় কমিটি গঠনের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। প্রোপাগান্ডা মেশিনারিজ বাস্তবে প্রয়াত মানুষদের উদাহরণ ব্যবহার করতে ভালোবাসে। কারণ সেগুলো ভেরিফাই করা কঠিন।  কমিটি গঠন বিষয়ে দুই তিনটি এলাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তবে সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ দলে অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন।   

২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ প্রার্থীদের মধ্যে চার জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে নাকি ক্ষোভ তৈরি হয়েছে! বাস্তবে যারা নমিনেশন পাবেন না তারা কম বেশি ক্ষুব্ধ হতে পারেন। সব দলেই হয়। আর যে চার জনের নাম উল্লেখ করা আছে তারা কিন্তু বিএনপির পরীক্ষিত নেতা। নির্বাচনী এলাকায় তাদের জনপ্রিয়তা সুস্পষ্টভাবে দেখা গেছে। তাদের কারো মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে, কারো বাড়ীতে ভাংচুর করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে দেশের অন্যদল যেটি ভোট ছাড়াই ক্ষমতায়, তাদের এক পরিবারের অনেক প্রার্থী এখন অবৈধ এমপি!  প্রথম আলো সেই ব্যাপারে উদাসীন। কারণ তারা ব্যস্ত ভারতীয় সিনেমার খবর প্রকাশে আর বিএনপি গিবতে, সাংবাদিকতা ছেড়ে প্রোপাগান্ডা মেশিনে পরিণত হয়েছে। 

রিপোর্টে জাতীয় স্থায়ীকমিটি গঠন বিষয়ে বলা হয়েছে। জাতীয় স্থায়ীকমিটিতে দলের এবং দেশের শ্রদ্ধেয়া সিনিয়র নেত্রী সেলিমা রহমান ও সিনিয়র নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এর অন্তর্ভুক্তি বিএনপির সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি ছিল চমৎকার এবং এর মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তের সুস্পষ্ট প্রাজ্ঞতা প্রমাণিত হয়েছে।  

প্রথম কথাটিই দ্বিতীয়বার বলছি, জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সরকার ফ্যাসিজমের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। বিপদে বিপথে আজ বাংলাদেশ। এই থেকে কেউই রক্ষা পাচ্ছে না। প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম এর সর্বশেষ উদাহরণ মাত্র। রোজিনা ইসলামসহ গণমাধ্যমের সকল ন্যায্য দাবির প্রতি বিএনপি সর্বদা সোচ্চার রয়েছে। ভারতীয় সিনেমার নায়ক নায়িকাদের নিয়ে প্রতিদিন বড় বড় রিপোর্ট প্রকাশ করা হলেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর হত্যাকাণ্ডের রহস্যভেদ করতে কোন ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট করতে প্রথম আলোকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদেরকেই এমন হতাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে দেখা যায়। প্রথম আলো এই বিষয়ে একটু কাজ করুন।  

আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি সর্বদা 'মুক্ত গণমাধ্যম' এ বিশ্বাস করে। বিএনপি গণমাধ্যমবান্ধব দল। এটাই দলটির অবিচল নীতি। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার অমর ঘোষক, মহাবীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের এক ও এগারো নাম্বার সেক্টর এবং জেডফোর্সের কমান্ডার, সাতই নভেম্বরের সিপাহীজনতার বিপ্লবের মহানায়ক, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের প্রবর্তক, আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমত্রী, মাদার অব ডেমোক্রেসি বেগম খালেদা জিয়া গণমাধ্যমে শত ফুল ফোটার পরিবেশ নিশ্চিত করেছিলেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও গণমাধ্যমে বান্ধব। সাংবাদিকদের সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের সিনিয়র অনেক সাংবাদিক বিভিন্ন সময় সেটি উল্লেখ করেছেন।  

এবার আসা যাক শেষ কথায়। আসলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলেকে ক্রমাগত শক্তিশালী করছেন। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছেন। জাতীয় স্থায়ীকমিটির সভা নিয়মিত করছেন। প্রধান কর্মসূচিগুলোতে ভার্চুয়ালি উপস্থিত থাকছেন। বিভিন্ন ইউনিট এর কমিটি হচ্ছে। অথচ তারেক রহমানের গিবত প্রকাশে প্রথম আলো এগিয়ে থাকলেও তাঁর বক্তব্য প্রচারে কিন্তু হাতঘুটিয়েই থাকে! দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতার বক্তব্য তারা প্রচার করেনা। এ কেমন সাংবাদিকতা যে গিবত প্রকাশ করা যাবে, প্রশংসা করা যাবেনা। আর তারেক রহমানের আধুনিক নেতৃত্বের সম্ভাব্য প্রভাব ও ফল সম্পর্কে প্রোপাগান্ডা মেশিনারিজ বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তারা উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের ব্যাপক গাত্রদাহ চলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পেইজ খুলে টাকা খরচ করে অপপ্রচার করে চলছে।  প্রথম আলোর এমন ভিত্তিহীন অসত্য রিপোর্টিং তারই অংশ। প্রথম আলো তুমি মানুষের ভোটাধিকারের পক্ষে দাঁড়াও। গণতন্ত্রের পক্ষে থাকো। প্রোপাগান্ডা ছেড়ে সাংবাদিকতা করো। আমরা দেখেছি বিএনপি তোমাদের সাথেই আছে। বিএনপি তোমাদের জেলেও নেয়নি এবং বিজ্ঞাপনও বন্ধ করেনি। করবেও না।  

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হৃদয়ে আছেন তারেক রহমান, এই সত্যকে অসত্যের সাথে গুলিয়ে প্রোপাগান্ডা প্রচার থামাও। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিরুদ্ধে চলমান চক্রান্ত থেকে বেরিয়ে আসুন। অন্যথায় ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করবে না।   


  • লেখক একজন প্রথম আলোর পাঠক ও সাধারণ নাগরিক।  

Tuesday, June 22, 2021

প্রসঙ্গ : বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ

--------------------------------------

সৈয়দ আবদাল আহমদ

--------------------------------------




নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসনের অবসানের পর বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নিরপেক্ষ নির্বিচনে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। ‘দেশনেত্রী’ ও ‘আপসহীন’ নেত্রী বিশেষণে দেশে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। সেই তিনি দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের ইতিহাসের এটি অবিচ্ছেদ্দ অংশ, যা মুছে ফেলা যাবে না।

১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের কথা। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি নিয়ম চালু ছিল, মাসে একটি বা দু’টি ‘মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত বিশেষ সভা’ হতো। মন্ত্রণালয়ের নানা প্রকল্পের ও কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেয়াই ছিল সভার লক্ষ্য। এতে সিনিয়র মন্ত্রী ও সচিবরা উপস্থিত থাকতেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস শাখায় দায়িত্ব থাকায় ওই সভায় প্রায়ই উপস্থিত থাকতাম। কোনো সভায় প্রেস সচিবও থাকতেন।

একদিন এমনই একটি সভা চলছিল ত্রাণ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত। মন্ত্রী-সচিব ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সভায় উপস্থিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে তৎকালীন একান্ত সচিব সাবিহ উদ্দিন আহমেদ এবং আমারও উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়। সভা শুরু হলো। বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন, কাবিখা, খাল খনন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। মানুষের কল্যাণের সাথে জড়িত প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই অনুমোদন করে দেয়া হলো। অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকেও দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়ে দ্রুত টাকা ছাড় করার কথা বলছেন। আলোচনার একপর্যায়ে তৎকালীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান খান আজাদ একটি বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বললেন, “ম্যাডাম এ সময় তো ‘কামলা’ পাওয়া যায় না”। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তৎক্ষণাৎ মাইক্রোফোন অন করে বললেন, “আজাদ আপনি এটা কী শব্দ বললেন? তারা ঘাম ঝরিয়ে কাজ করেন। তাদের ‘শ্রমজীবী মানুষ’ বলতে অসুবিধাটা কোথায়? ‘কামলা’ তো গালাগাল অর্থে ব্যবহার করা হয়। প্রতিমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে প্রতিশ্রুতি দিলেন এর পর থেকে শব্দটি আর তিনি ব্যবহার করবেন না। এই হলেন খালেদা জিয়া।


প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে যোগ দেয়ার পর প্রেস সচিব হিসেবে তৎকালীন পিআইও আবদুস সোবহান ভাইকে পাই। তার আগে প্রেস সচিবের কক্ষে বসতেন সাংবাদিক সম্পাদক তোয়াব খান। তিনি প্রেসিডেন্ট এরশাদের প্রেস সচিব ছিলেন। সোবহান ভাই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব হিসেবে এ কক্ষে বসার পর আমরা তার টেবিলের ড্রয়ারে আগের আমলের কিছু আছে কি না দেখছিলাম। একটি ড্রয়ারে পেলাম অনেকগুলো লেখা প্যাডের কাগজ। রাষ্ট্রপতির অফিসের প্যাডের কাগজ। এতে প্রাপ্তি স্বীকার স্বাক্ষর করা। এরশাদের কাছ যারা অর্থ নিয়েছিলেন তার প্রাপ্তি স্বীকার। আমরা বেশ মজা পেলাম।

 

এদের মধ্যে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক এবং অন্যান্য পেশার ব্যক্তি রয়েছেন। টাকার পরিমাণ খুব একটা বেশি না। পঁচিশ, পঞ্চাশ হাজার, এক লাখের মতো। অবশ্য ১৯৯১ সালের আগে এ পরিমাণ টাকা একেবারে কমও না। যাই হোক, আমরা কাগজগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাই। বেগম খালেদা জিয়ার কক্ষে তাকে প্রাপ্তি স্বীকারপত্রগুলো দেয়ার পর তিনি এক এক করে সেগুলো দেখলেন। আমরা তার সামনে চেয়ারে বসা। দেখা শেষ হয়ে গেলে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বললেন, ‘সোবহান সাহেব, এগুলো পুড়িয়ে ফেলুন। এখনি পুড়িয়ে ফেলুন।’ আমি বললাম, ম্যাডাম প্রেসে দিলে তো মানুষ জানতে পারতেন। তিনি আমাকে অনেকটা ধমকের সুরেই বললেন, ‘এরশাদ সাহেব যে টাকা বিলাতেন সেটি তো সবাই জানেন। তা ছাড়া তার তো পতন হয়েছে, জনগণ তাকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দিয়ে শাস্তি দিয়েছেন। আর প্রাপ্তি স্বীকারপত্রে যাদের নাম দেখছি তারা তো আমাদের দেশের সৃজনশীল ও গুণী মানুষ। হয়তো একান্ত প্রয়োজনেই টাকা নিয়েছেন। প্রেসে গেলে তাদের সুনাম ও মর্যাদা নষ্ট হবে না? কেন আমরা তা করব? এই হলেন খালেদা জিয়া।

১৯৯৬ সালের ৩১ মার্চের ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার শেষ কার্য দিবস। কিছুক্ষণ পরই তিনি বঙ্গভবনে যাবেন রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দিতে। প্রধানমন্ত্রীর কক্ষ থেকে বের হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তার মনে হলো ‘রাজারবাগ-শহিদবাগ মোড়ে’ নিহত একজন পুলিশ কর্মকর্তার পরিবারকে প্রতিশ্রুত অর্থ সহযোগিতা করা হয়নি। তিনি তৎকালীন সচিব ড. কামাল সিদ্দিকীকে ডাকলেন। ফাইল আনিয়ে সেই অর্থ সহযোগিতার নোটে স্বাক্ষর করে বললেন, ‘আমি বঙ্গভবনে যাওয়ার আগেই যেন নিহতের পরিবার টাকার চেক পায়।’ এই হলেন খালেদা জিয়া।

বেগম খালেদা জিয়া আজ ভীষণ অসুস্থ। তিনি ৭৫ বছর পার করে এখন বার্ধক্যে উপনীত। দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দু’বার। নির্বাচনে দাঁড়িয়ে কখনো হারেননি। সব সময়ই রেকর্ডসংখ্যক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। দেশের মানুষ এখনো তাকে অসম্ভব ভালোবাসেন। প্রতিটি দুর্যোগে তিনি ছুটে গেছেন দুর্গত মানুষের পাশে। দুই হাতে সহযোগিতা করেছেন। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট তৈরিতে, শিক্ষার বিস্তারে, মানুষকে আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করেত হাঁস-মুরগির খামার, গরু-ছাগলের খামার, বৃক্ষরোপণ প্রভৃতিতে নিয়োজিত করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প নিয়ে তা অনুমোদন করে দিয়েছেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় অসামান্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি। স্বামী জিয়াউর রহমান যখন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে একাত্তরে বন্দিশিবিরে তিনি। স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর জনগণের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়েই গৃহবধূ থেকে রাজনীতি আসেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করেন। নব্বইয়ের স্বৈরশাসনের পতনের পর দেশে আবার গণতন্ত্র ফিরে আসে। তিনিই সংসদে বিল এনে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেন। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দফতর চট্টগ্রামে সরিয়ে নিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজ একটানা তদারকি করে মানুষকে আবার উঠে দাঁড়াতে সহযোগিতা করেন। সফলভাবে এ ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন- তৎকালীন বাংলাদেশে আসা মার্কিন টাস্কফোর্সের প্রধান জেনারেল স্ট্যাকপল। ভয়েস অব আমেরিকাকে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আবেদনে সাড়া দিয়ে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের (সিনিয়র) নির্দেশে আমরা ত্রাণ কাজ চালাতে গিয়েছিলাম। আমাদের এক মাসের অভিজ্ঞতা চমৎকার। ত্রাণসামগ্রী যাদের জন্য এসেছে, তারাই পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দৃঢ় মনোভাব ও কঠোরতার প্রশংসা করি। তিনি কোনো ত্রাণসামগ্রী অপচয় হতে দেননি। দুর্নীতি হয়নি, লুটপাটের প্রশ্নই ওঠে না। তার সাথে কাজ করতে পেরে খুব ভালো লেগেছে।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিরোধী দলের দাবি মেনে নিয়ে সংসদে তিনিই বিল পাস করে দিয়েছিলেন। এর আগে স্যার নিনিয়ান যে ফর্মুলা দিয়েছিলেন, সেটিও মেনে নিয়েছিলেন। যদিও যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন করে এনেছিলেন, তারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এখন ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন।

রাজনীতিতে বিনয় আর উদারতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ তিনি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার জনসভায় গুলি হয়েছিল। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে দুই নেত্রীর নেতৃত্বে শোক মিছিল বের হওয়ার কথা ছিল। মিছিলে সেই দিন শেখ হাসিনা আসতে পারেননি। খালেদা জিয়া এসেছিলেন। মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তেমনি ১৯৮৬ সালে বায়তুল মোকাররম থেকে দুই নেত্রীর নেতৃত্বে গণমিছিলের কর্মসূচি ছিল। সেই মিছিলেও শেখ হাসিনা আসতে আসেননি, খালেদা জিয়াই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

১৯৮৬ সালের পাতানো নির্বাচনের পর ৭ দল ও ১৫ দলের ঐক্য ভেঙে যায়। ১৯৮৮ সালে খালেদা জিয়ার কারণেই সেই ঐক্য আবার হয়। আন্দোলন ঐক্যবদ্ধভাবে চলে।

 

মেয়েদের শিক্ষায় বেগম খালেদা জিয়া্র সরকার যুগান্তরী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন
খালেদা জিয়াই শেখ হাসিনাকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে গিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিয়েতে যোগ দিতে বেগম জিয়া এমপি হোস্টেলে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা ব্যস্ততার কারণেই হয়তো তাকে রিসিভ করতে পারেননি। কিন্তু তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের বিয়েতে শেখ হাসিনা এলে বেগম জিয়া তাকে রিসিভ করেন। একসাথে খাবার খান। ছেলের বউ দেখাতে নিয়ে যান। জরুরি সরকারের সময় সাব-জেলে শেখ হাসিনার চোখের অসুখ বেড়ে গেলে খালেদা জিয়া কোর্টে এসে তাকে চিকিৎসা করানোর আহ্বান জানান। শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া শেখ হাসিনাকে সমবেদনা জানাতে সুধা সদনে ছুটে গিয়েছিলেন। একটিমাত্র ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ছিল। আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলশান অফিসে গেলে তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। অবশ্য খালেদা জিয়া তখন অচেতন ছিলেন। এ ভুলের জন্য তার কর্মকর্তারা দায়ী। এই একটিমাত্র ঘটনা ছাড়া খালেদা জিয়ার বিনয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি লক্ষ করা যায়নি। নারী জাগরণের নেত্রী মহীয়সী বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের রূপকার ছিলেন বেগম জিয়া। নারী উন্নয়নে এবং মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারে তিনি অনন্য অবদান রেখেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন।

এমন একজন অসাধারণ গুণের মানুষ আজ জটিল রোগে জর্জরিত হয়ে প্রবীণ বয়সে নিদারুণ কষ্টের জীবনযাপন করছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ১৭ জুন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, করোনা-পরবর্তী জটিলতা ও পুরনো রোগে খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ। দীর্ঘ চার বছর তার কোনো চিকিৎসা হয়নি। কারাগারে অমানবিক পরিবেশে তিনি অনেক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। হার্টের সমস্যা, কিডনি সমস্যা, লিভারের সমস্যা, পুরনো আর্থ্রাইটিস- সব মিলে তিনি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন। সরকার তাকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেয়নি।

৫৩ দিন পর রাজধানীর এভারকেয়ার হসপিটাল থেকে গুলশানে নিজ বাসভবনে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া 

১৯ জুন রাতে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হয়েছে। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দলের প্রধান অধ্যাপক ডা: এফ এম সিদ্দিকী সাংবাদিকদের জানান, ৫৩ দিন তিনি হাসপাতালে ছিলেন। এ সময় কতটা জটিলতার মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ধারণা ছিল না, কনফিউশন ছিল অনেক। তিনি জানান, তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর সিটি স্ক্যানসহ সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। প্রথম দেখা যায় তার বুকে পানি এসেছে, হার্ট ফেইলিওর-সংক্রান্ত। করোনায় হার্ট ফেইলিওর হতে পারে। প্রথন তিন দিন চিকিৎসার পর কিছুটা উন্নতি হলেও জ্বরে আক্রান্ত হন আবার। বুকে আবার পানি আসে। এক দিনের মধ্যে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যায়। এ অবস্থায় সিসিইউতে নিয়ে গিয়ে দেখা যায় অর্ধেক বুক পানিতে ভরে গেছে। চেস্ট টিউব দিয়ে পনি বের করি। দেখা যায় পানি নয়, রক্ত। প্রায় ১৮দিন চেস্ট টিউবে পানি নিঃসরণ করা হয়। ভেন্টিলেটরে দিতে পরিবারের মতও ছিল। তার বুক থেকে ৭ লিটারের মতো পানি ও রক্ত বের করা হয়েছে। পরীক্ষার সময় দেখেছি হার্ট ফেইলিওর, কিডনি ও লিভার সমস্যা প্রকট।

ব্লাড কালচার করে দেখেছি, হাসপাতালে যেসব জীবাণু থাকে সেগুলো আক্রমণ করছে। দুই তিন ধরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টায় কিছু নার্স, মেডিক্যাল স্টাফ, ডাক্তার আক্রান্ত হয়েছেন। মেডিক্যাল বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ অবস্থায় খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে রাখাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে তাকে পাঁচ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। অথচ খালেদা জিয়ার সারা জীবনে তাকে রক্ত দেয়ার কোনো নজির নেই।

খালেদা জিয়া এমন অসুস্থতায় বর্তমানে এক দুঃসহ, মর্মান্তিক ও অসহায় জীবন অতিবাহিত করছেন। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, তিন যুগেরও বেশি সময়ের দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন, মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালনকারী এবং যার স্বামী একজন সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের প্রধান ছিলেন, সর্বোপরি একজন নারী এবং বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ হিসেবে উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার তার রয়েছে। এটি তার মানবাধিকার। আশা করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন নারী হয়ে বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসায় তাকে সুযোগ করে দেবেন।

 

  • লেখক সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব 


Saturday, June 19, 2021

আবু আদনানের অলৌকিক ফিরে আসা এবং গুগল ম্যাপের রহস্য!

------------------------

ডা: আলী জাহান

------------------------


১০ জুন অপহরণের শিকার ইসলামী বক্তা আবু আদনান শুক্রবার (১৮.০৬.২১) ফিরে এসেছেন। অথবা শুক্রবার তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। উনি কোথায় ছিলেন, কীভাবে ছিলেন, কেন ছিলেন? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আপাতত অন্ধকারে। এর আগে যারা ফিরে এসেছেন তারা আর কখনো মুখ খোলেননি। আবু আদনানও হয়তো এ বিষয়ে আর কথা বলবেন না। আবার কথা বলতেও পারেন। তবে নিকট অতীতে গুম থেকে ফিরে আসা মানুষদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে অপহরণ বিষয়ে তার কথা না বলার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা তা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাফেরা করেন তাদের কাছে আবু আদনানের ফিরে আসাটা কোন আশ্চর্যজনক ব্যাপার বলে মনে হবে না। গতকাল ফেসবুকে গুগল লোকেশনে ( Google location) আবু আদনানের মোবাইলের সর্বশেষ যে অবস্থান দেখানো হয় তা অপহরণকারীদের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না। গুগল ম্যাপের লোকেশন ফেসবুকের কল্যাণে বিদ্যুতের বেগে শেয়ার হতে থাকে। সে কারণেই অনেকেই ভাবছিলেন আবু আদনানের ফিরে আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। ঠিক তাই ঘটেছে। আবু আদনানকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। 

কিন্তু বাংলাদেশে গুম হয়ে যাওয়া সবার ভাগ্য কি আবু আদনানের মতো? অবশ্যই না। হারিয়ে যাওয়া সিংহভাগ মানুষের ভাগ্য আবু আদনানের মতো নয়। সাবিকুন্নাহারের মতো সবাই সৌভাগ্যবতী নন। সবার স্বামীরা ঘরে ফিরে আসে না। সব মা-বাবারা তাদের সন্তানকে ফিরে পান না। সব সন্তানেরা তাদের বাবাকে ফিরে পায় না। কেউ কেউ লাশ ফিরে পায়। কারো কারো কপালে লাশ দেখারও সুযোগ হয় না। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও এক সময় শুকিয়ে যায়। তারপর মানুষ ভুলে যেতে থাকে। কারো কারো মনে থাকেনা যে বাসা থেকে, রাস্তা থেকে, গাড়ি থেকে, বাজার থেকে, অফিস থেকে কাউকে কাউকে ধরে নেয়া হয়েছিল যারা আর কখনো ফিরে আসেনি। ওরা কিন্তু মানুষ ছিল। একই দেশের নাগরিক ছিল!

মনে আছে গত ১৩ বছরে গুমের শিকার হওয়া ৬০৪ জন মনুষ্য সন্তানের কথা? এ সংখ্যার ভেতরে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১১ জন মানব সন্তানও আছেন। এ মানুষগুলো ব-দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় জন্মগ্রহণ করলেও বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কেউ কেউ সরকারকে বড় অঙ্কের ট্যাক্স দিচ্ছিলেন, মানুষের কর্মসংস্থান করছিলেন। বিভিন্ন নামে উনাদের আলাদা পরিচিতি থাকলেও একটি পরিচয় অনেকটা প্রকট। এবং সে পরিচয়টি হচ্ছে বর্তমান সরকারের সাথে তাদের আদর্শিক বা রাজনৈতিক একটা মতপার্থক্য ছিল। ৬০৪ জন গুমের শিকার হওয়া এ মানব সন্তানদের ৭৮ জন পরিবারকে নিজেদের লাশ উপহার দিয়ে জাতিকে বলে গেছেন যে আমরাও মানুষ ছিলাম, আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার ছিল। কিন্তু আপনাদের নীরবতা আমাদের বাঁচতে দেয়নি। গুমের শিকার হওয়া ৫৭ জন অলৌকিকভাবে বা বিশেষ ব্যবস্থায় ফিরে এসেছেন। ফিরে আসার পর কেউই আর মুখ খোলেননি। সৌভাগ্যবান কেউ কেউ দেশান্তরিত হয়েছেন। এরপরেও তারা স্তব্ধ হয়ে আছেন। কেউ কথা বলছেন না। অথবা তাদেরকে বলা হয়েছে যে, তারা যেন কথা না বলেন। ৮৯ জনকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। বাকি লোকগুলো কোথায়? উনারা কি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি। কারণ অন্যকে এ প্রশ্ন করলে উত্তর পাবো না। অতীতে পাওয়া যায়নি। এখনো পাওয়া যাবে না। 

 যেমনটা উত্তর পাওয়া যায়নি গুম হয়ে যাওয়া ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেমের (আরমান) উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আরমানকে মিরপুর ডিওএইচএসের নিজ বাসা থেকে সাদা পোশাকধারী কিছু লোক ( যারা নিজেদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দিচ্ছিল) ০৯ আগস্ট ২০১৬ সালের রাতের বেলা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। তাকে প্রস্তুত হবার জন্য মাত্র পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হয়েছিল। কোন ওয়ারেন্ট ছিল না। কোন অভিযোগ ছিল না। তরুণ এ ব্যারিস্টারকে রাতের আঁধারে বাসা থেকে যখন ধরে নেয়া হয় তখন চিৎকার করে তার দুই মেয়ে আয়েশা তাকওয়া (চার বছর) এবং মারিয়াম বুশরা (আড়াই বছর) আব্বু আব্বু বলে পেছন থেকে ডাকছিল। ব্যারিস্টার আরমানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার অসহায়ের মতো তার স্বামীর চলে যাওয়া দেখছিলেন। উনিও কাঁদছিলেন। তবে আশা ছিল যে, যেহেতু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে দেবে। তাহমিনা আক্তার এবং তার দুই সন্তানের চোখের পানি মুছিয়ে দেয়ার জন্য রাষ্ট্র কি এগিয়ে এসেছিল?

ব্যারিস্টার আরমানের স্ত্রী তানিয়া আক্তারের সে আশা পূরণ হয়নি। তিনি তার স্বামীকে ফিরে পাননি। আয়েশা এবং মারিয়াম তাদের বাবাকে ফিরে পায়নি। বরাবরের মত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যারিস্টার আরমানকে গ্রেপ্তারের খবর অস্বীকার করেছে। 

তবে তাদেরকে ধরে নিয়ে গেল কারা? 

ইসলামী বক্তা আবু আদনান ফিরে আসলেন নাকি কেউ ফিরিয়ে দিয়ে গেল তা হয়তো কখনোই জানা যাবে না। তবে তিনি জীবিত ফিরে এসেছেন, পরিবারের জন্য এটি সবচেয়ে বড় পাওয়া। শুধু তিনি ফিরে আসেননি, তার তিন সঙ্গীও ফিরে এসেছেন। রংপুরের পুলিশ বলছে, ব্যক্তিগত কারণে তারা সকলেই একসঙ্গে গত ৮ দিন থেকে আদনানের এক বন্ধুর বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন। অবিশ্বাস্য এ কাহিনীর রহস্য ভেদ করার জন্য স্বয়ং শার্লক হোমসকে আবার কবর থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। 

আবু আদনান এবং তার সফরসঙ্গীদের ফিরে আসাকে অথবা ফিরিয়ে দেয়াকে অভিনন্দন জানাই। 

হারিয়ে যাওয়া এ চারজনের পরিবারের সদস্যদের কান্না এবং অসহায়ত্ব হয়তো কিছুটা এখন কমেছে। কিন্তু বাকিদের কী হবে? 

গুগল ম্যাপ দিয়ে ঢাকার সূত্রাপুরের সেলিম রেজা পিন্টু, ধানমন্ডি থেকে হারিয়ে যাওয়া কানাডার ম্যাগগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইশরাক আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম আরমান, সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলী, সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমদের অবস্থানটি নির্ণয় করা যায় না?

পৃথিবীর কিছু ভাষা সার্বজনীন। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে এর কোন পরিবর্তন হয়না। চোখের পানির একই ভাষা। বাবা ফিরে আসবে সেই আশায় সন্তানদের পথ চেয়ে বসে থাকা, প্রিয় সন্তান ফিরে আসবে সে জন্য মা-বাবার অন্তরের হাহাকার, প্রিয় স্বামী ফিরে এসে দরজায় কড়া নাড়বে সেই আশায় প্রিয়তমার চোখ মোছা, একই রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ প্রিয় ভাই ফিরে আসবে সেই আশায় আশাহত বোনের অসীমের পানে চেয়ে থাকা- সবই একই ভাষা, একই অভিব্যক্তি। 

সেই সার্বজনীন ভাষাকে বুঝার ক্ষমতাও আমরা হারিয়ে ফেলেছি? আমরা মানুষ তো? 

ব্যারিস্টার আরমানের ছোট দুই মেয়ের বয়স এখন নয় (আয়েশা) এবং সাড়ে সাত বছর (মারিয়াম)। ওরা একসময় বড় হবে এবং রাষ্ট্রকে কঠিন একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে। আমার বাবাকে গুম করলো কারা? কেন তাকে গুম করা হলো? দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব যাদের হাতে তারা সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন তো?


---

লেখক সাবেক পুলিশ সার্জন, যুক্তরাজ্য পুলিশ। 

ইমেইল একাউন্ট alijahanbd@gmail.com

তথ্যসূত্র —   আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন

Tuesday, June 15, 2021

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড: একটি অপ্রাসঙ্গিক অভিধা

---------------------------------------------------------

পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য ও আসিফুর রহমান

---------------------------------------------------------



দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি আসলেই ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’?

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ একবার বলেছিলেন, ‘এটা শুধুই কথার কথা।’ আরও কয়েকজন উনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছিলেন।

শিক্ষাবিদদের মতে, ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ কথাটি এই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম দিকের সাফল্যকে মহিমান্বিত করার জন্যে ব্যবহার করা হতো।

গত সপ্তাহে প্রকাশিত দ্য কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস (কিউএস) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং ২০২২-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অবস্থান ৮০১-১০০০ এর মধ্যে এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১ হাজার ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয়।

দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পর্বত-সমান ফারাক এবং ঢাবির অভিধাটির কথা মাথায় রেখে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে অনেক তথ্য উন্মোচিত হয়।

করোনা মহামারি চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় দুটি কী করছে, প্রথমে সেটা নিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক।

গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকলে ঢাবি কর্তৃপক্ষ গত বছরের ৯ এপ্রিল অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়। তখন থেকে হলগুলো বন্ধ আছে।

এখনো বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধই আছে। মাঝে কিছু পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া বাকি সব ধরনের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের উদ্যোগে নির্মিত নীলক্ষেতের প্রবেশমুখে সুবিশাল একটি তোরণ রয়েছে। সেদিকে তাকালে বিশ্ববিদ্যালয়টি যে লকডাউনে আছে, তা খুব সহজেই দর্শনার্থীরা বুঝতে পারেন।

যখন দেশে লকডাউন শুরু হলো, তখন ঢাবি কর্তৃপক্ষ যানবাহনের প্রবেশ আটকানোর জন্য এই তোরণে বাঁশের বেড়া দিয়ে দিলো।

কিছুদিন পর সরকার লকডাউন প্রত্যাহার করে নিলেও বিশ্ববিদ্যালয় আর বেড়া সরায়নি। কয়েক মাস আগে যখন হল না খুলে পরীক্ষা নেওয়া হলো, তখন একবারের জন্য বেড়াগুলো সরেছিল। পরে আবারও যখন করোনাভাইরাসের দৈনিক শনাক্তের হার অনেক বেড়ে যায়, তখন বাঁশের বেড়াগুলোকে ফিরিয়ে আনা হয়।

স্বভাবতই, কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে অস্থায়ী কাঁচাবাজার গজিয়ে উঠে এবং এতে বিস্মিত হওয়ারও কিছু নেই।

ফুলার রোডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বাসভবনের চারপাশেও ঢাবি কর্তৃপক্ষ বেড়া দেয়। অনেকে এটা দেখে ঠাট্টা করে বলছিলেন যে, বাঁশের বেড়া দিয়ে ঢাবি কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাস ঠেকানোর চেষ্টা করছে।

বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ আরেকটি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ উদ্যোগ নিয়েছে। তারা ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) সাধারণ মানুষের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম সমগ্র টিএসসি এলাকাজুড়ে টহল দিয়ে বেড়াত আর বারবার ‘বহিরাগতদের’ লাউড স্পিকারের মাধ্যমে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে বলত। চায়ের স্টল ও অন্যান্য অস্থায়ী দোকানগুলোও অপসারণ করা হয়েছে।

এর এক পর্যায়ে ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী করোনায় আক্রান্ত হন।

এ যাবৎ প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নেওয়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া, বাঁশের বেড়া দেওয়া এবং চায়ের দোকান উচ্ছেদ কার্যক্রম।

ঢাবি কর্তৃপক্ষ তাদের গবেষণাগারে গত বছরের ৫ মে থেকে কোভিড-১৯ পরীক্ষা শুরু করেছিল। কিন্তু, অল্প কিছুদিন পরেই পরীক্ষা থেমে যায়। কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রাতিষ্ঠানিক ও গবেষণার কাজেই কেবল গবেষণাগার ব্যবহার হওয়া উচিত।

ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান গত বছরের ১ জুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, ‘এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়; হাসপাতাল নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের তিনটি বিভাগ থেকে যেসব গবেষণাগারে ব্যবহারযোগ্য সরঞ্জাম নিয়ে এসেছিলাম, সেগুলোকে গবেষণার প্রয়োজনে ফিরিয়ে দিতে হবে। সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করে তাদের আগের জায়গায় স্থাপন করতে হবে। এ কারণে করোনাভাইরাসের আর কোনো নমুনা পরীক্ষা করা হবে না।’

টেস্ট কিট ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামগুলো (পিপিই) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়ার কথা ছিল আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব ছিল পরীক্ষার অন্যান্য খরচ বহন করা। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, মাসে তাদের অন্তত ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা প্রয়োজন হবে পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। এই বাড়তি অর্থ জোগানো বেশ কঠিন এবং তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড কর্তৃপক্ষ তহবিলের অভাবকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে জনসাধারণের জন্য করোনাভাইরাস পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার পর ঘোষণা দিলো যে, তারা শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নমুনা পরীক্ষা করবে এবং এর জন্য জনপ্রতি খরচ দিতে হবে দেড় হাজার টাকা।

শিক্ষকেরা এই সুবিধাটি নিলেও শিক্ষার্থীদের জন্য তা কঠিন হয়ে যায়।

এবার আমরা যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে আসি।

বাংলাদেশের প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার প্রায় তিন মাস আগে গত বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়।

যেদিন বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেই ১৭ মার্চ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্ট্যান্ট কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্য একটি মোবাইল অ্যাপ বের করে।

একদিন পর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, তারা দ্রুত গতিতে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন। দুই দিন পর তারা সহজে স্থাপনযোগ্য ভেন্টিলেটর তৈরি করার পরিকল্পনা ও সময়সীমা প্রকাশ করেন।

পরবর্তীতে বিভিন্ন পর্যায়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কোভিড-১৯ নিয়ে একাধিক গবেষণা চালায়। এর মধ্যে রয়েছে কোন ধরনের মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তা চিহ্নিত করা, আইসোলেশনে থাকা শিশুদের মা-বাবারা কী ধরনের উদ্যোগ নিতে পারেন, কীভাবে লকডাউন চালু করা উচিত, কীভাবে ভাইরাসটি অন্তঃসত্ত্বা নারীদেরকে আক্রান্ত করতে পারে এবং আক্রান্তদের মানসিক স্বাস্থ্য, ইত্যাদি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে একটি ভ্যাকসিন তৈরিতে চুক্তিবদ্ধ হয়, যেটি গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুমোদন পেয়েছে।

যখন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গবেষণাগুলো চলছিল, তখন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ব্যস্ত ছিল তার রাস্তাগুলোতে বহিরাগতদের চলাফেরা সীমিত করার জন্যে চতুর্দিকে বেড়া দেওয়ার কাজে।

এই সময়ের মধ্যে (২০২০ সালের এপ্রিলে) ঢাবি নয়টি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।

একটি ছিল উপাচার্যের কাছ থেকে আসা একটি শোকবার্তা, দুটি ছিল ছুটি বাড়ানো সংক্রান্ত এবং একটি ছিল জুম অ্যাপের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য।

আরও দুটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর করোনাভাইরাস তহবিলে অনুদান (এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা) দেওয়ার বিষয়ে। ফেস মাস্কের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য, টেলিমেডিসিন প্রকল্প ও ফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সহায়তা সেবা দেওয়া নিয়ে ছিল আরও তিনটি বিজ্ঞপ্তি।

এখন আসুন আমরা এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ও নিজস্ব পরিমণ্ডলের ওপর তাদের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করি।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ হাজার গবেষক রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, এ প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করার ছয় মাসের মধ্যে চাকরি পেয়ে যান।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড প্রসঙ্গে আমরা উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের একটি মন্তব্যকে স্মরণ করতে পারি।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গর্বের বিষয় রয়েছে। পৃথিবীর কোথাও ১০ টাকায় এক কাপ চা, সঙ্গে একটি সিঙ্গারা, একটি চপ ও একটি সমুচা পাওয়া যাবে না৷ কিন্তু, বাংলাদেশে এটি পাওয়া যায়৷ এটি যদি কোনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানতে পারে, তাহলে এটা গিনেস বুক অব রেকর্ডসে স্থান পাবে।’

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড প্রায় ১০০ বছর আগে চালু হওয়ার পর থেকে দুটি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হেঁটেছে এবং বর্তমানে তাদের মাঝের পর্বতপ্রমাণ দূরত্বটি আট হাজার কিলোমিটারের ভৌগলিক দূরত্বের চেয়েও অনেক বেশি।

একটি বিখ্যাত গানের সুরে বলা যায় ‘আজ দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে।’


— দি ডেইলি স্টার 


রাজাকার পুনর্বাসনের আদি কথা

—   ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম

 


সোশ্যাল , ইলেকট্রিনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে এই প্রশ্নটা সামনে আসে যে কে বা কারা বা কার নির্দেশে এবং কার আমলে প্রথম স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ও দালালদেরকে পুনর্বাসন শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও তাদের সুশীল সমাজসহ চেতনাজীবীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ও দালালদেরকে পুনর্বাসিত করার জন্য অভিযুক্ত করে থাকে। এই অভিযোগ কতটা সত্য, জানুন। 

‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ বইয়ের লেখক আওয়ামী বুদ্ধিজীবী আহমদ শরীফ, কাজী নূর-উজ-জামান ও শাহরিয়ার কবির। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী বাঙালিদের তালিকা ও কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত এই বইটি একটি দালিলিক প্রমাণ গ্রন্থ। এই বইতে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা আছে যে শেখ মুজিবের আমলেই রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধী দালালদের পুনর্বাসন শুরু হয়। এই রাজাকার ও দালাল পুনর্বাসন ব্যাপক ছিলো এবং রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধীরা এমন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থান পায় যে শেখ মুজিবর রহমানের আমলেই প্রায় সব চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধী ও রাজাকারের পুনর্বাসনের কাজ শেষ হয়ে যায়। 

লেঃ কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিনের কথা আপনেদের সবার জানা আছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর উপপ্রধান এবং রাজকার বাহীনি প্রধান রিক্রুটিং অফিসার ছিলেন। এই লেঃ কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিন পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতা বিরোধী সব থেকে বড় রাজাকার ও দালাল ছিল। ৭২ সালের জানুয়ারিতেই পাকিস্তানের প্রতি অনুগত এই ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের পদে নিযুক্তি দেন শেখ মুজিবুর রহমান। লেঃ কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিনকে এই পদে দেখে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাফায়েত জামিল তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। সাফায়েত জামিল এই পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ও দালালকে স্যালুট করেন নাই। সেই অপরাধে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাফায়েত জামিলের কোর্ট মার্শাল হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

এই খানেই শেষ নয়। 

বীরমুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন কোম্পানি কমান্ডার, ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তিনি সোমবার,  ডিসেম্বর, ১৬, ২০১৩, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ ‘আমি বিজয় দেখিনি’ শীর্ষক লেখায় আরো অনেক রাজাকারদের কথা তুলে ধরেছিলেন যাদের স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার পুনর্বাসিত করেছিল। 

তিনি লেখেন — 

স্বাধীনতা লাভের মাত্র কয়েক দিনের মাথায় অদৃশ্য শক্তির আশীর্বাদে অলৌকিক সব ঘটনা ঘটতে লাগল। বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে শত্রু আর মিত্রে কোনো বিভক্তিই থাকল না। ক্যাপ্টেন হাকিম একজন গোলন্দাজ অফিসার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২৭ ব্রিগেডের ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্টে কর্মরত থেকে যুদ্ধের ন'মাস হবিগঞ্জের নোয়াপাড়া অবস্থানে গোলন্দাজ অফিসার হিসেবে যুদ্ধরত থেকেছেন মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে। শত শত মানুষ হত্যা করেছেন তিনি তার নিক্ষিপ্ত গোলায়। স্বাধীনতার পর তিনি শুধু চাকরিই ফেরত পেলেন না, তিনি দায়িত্ব পেলেন মিলিটারি পুলিশ বিভাগের প্রধান হিসেবে। একইভাবে চাকরি ফেরত পেলেন লেফটেন্যান্ট মোদাব্বের ও লেফটেন্যান্ট আল ফরিদ। এরা দুজনই পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ জায়গাটি দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন পরবর্তীতে।

সেনাবাহিনীর সদর দফতরে চাকরি পেলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম রহমান। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ১ নং সামরিক আদালতের প্রধান কর্মকর্তা, মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়। আরও চাকরি পেলেন কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব হিসেবে। আরও যারা চাকরি পেলেন তারা হলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন আমিনুল ইসলাম, বেসামরিক গোয়েন্দা দফতরের প্রধান সাফদার, রাজাকার বাহিনী প্রধান রহিম এবং আরও অনেকে। এরা সবাই শুধু চাকরিই ফেরত পেলেন না, পেলেন রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ দফতর। 

— শেষ। 

সূত্র —  https://bit.ly/2TXzbSG 

কাজেই মহান স্বাধীনতার অমর ঘোষক, স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও জেডফোর্সের কমান্ডার শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে এসব হীন প্রোপাগান্ডা বন্ধ করুন। আয়নায় নিজের চেহারা দেখুন। সত্যকে মেনে নিন। 



  • লেখক সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাস্ট্র।  

রাজনীতিতে উত্তর-আধুনিকতার প্রভাব

------------------------------------

মোহাম্মদ আবুল হাসান

------------------------------------


১৯৪৪ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ফ্রাংকফ্রুর্ট স্কুল চিন্তক অ্যাডর্নো এবং হকহেইমার ‘ডায়ালেক্টিক অব এনলাইটেনমেন্ট’ নামক পুস্তকে আধুনিকতাকে গণপ্রতারণা হিসাবে চিহ্নিত করার পর চিন্তারাজ্যে সীমাহীন নৈরাজ্য দেখা দেয়। ধর্মীয় মহা-আখ্যানগুলোর পাশাপাশি পুঁজিবাদ, মার্কসবাদ, উদারনৈতিকতাবাদ, উপযোগবাদসহ চিরায়ত প্রতিষ্ঠিত কাঠামোগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেই ক্ষান্ত থাকেনি উত্তর-কাঠামোবাদীরা, খোদ ইউরোপীয় সাদা সভ্যতাসহ পুরো আধুনিকতাকে বিতর্কিত করে তুলেছে আধুনিকতার এ অধিপাঠ। শিল্পবিপ্লব যদি আধুনিকতার ভিত্তিভূমি হয়, তবে তথ্যপ্রযুক্তি হলো উত্তর-আধুনিকতার উর্বর জমিন। সিগমন্ড ফ্রয়েডের আনকনশাসে চিন্তাজগতের সীমাহীন স্বাধীনতার কারণে মনের কথার সন্ধানে লিপ্ত হয়েছে মানুষ। সন্দেহের বাতাবর্তে পরাবাস্তববাদী প্রভাব শিল্প, সাহিত্যের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সত্যের সুলুক সন্ধানে ব্যাপৃত হয়। অধুনা তথ্যপ্রযুক্তি এ আগুনে ঘি ঢেলে দিয়ে রাজনীতিকে নিয়ত বিচলিত ও বিভ্রান্ত করে চলেছে।

জাঁক দেরিদা তার ডিকনস্ট্রাকশনে কোনো কিছুর সুনির্দিষ্ট অর্থবোধকতাকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘কোনো টেক্সট লেখা হলে তা নিজে একটা মিনিং ধারণ করার পাশাপাশি একটা বিপরীত মিনিংও ধারণ করে।’ কোনো লেখক লেখার মাধ্যমে কোনো কিছু প্রকাশ করতে চাইলে তার মনে হয়, আমি যা কিছুই বুঝাতে চাই না কেন; পাঠক তার নিজের মতো করেই বুঝে নেবে। তাই লিখে কোনো কিছু প্রকাশের চেষ্টা নিরর্থক। লেখক ও পাঠকের রক্তপাতহীন বোঝাপড়ার সংঘাতে সীমাহীন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের ঔদ্ধত্য পাঠককে নিরীহ থাকতে দেয় না। লেখককে তার অধিপতি মানতে নারাজ সে। প্রযুক্তির ব্যবহারে ফেসবুক ও টুইটারে লাইক, কমেন্টস ও শেয়ার স্বল্প পরিশ্রমে রাতারাতি তাকে তারকাখ্যাতির আত্মঅহমিকায় ভোগাচ্ছে। এমন আত্মঅহমিকায় সিক্ত রাজনীতিবিদ বুঝে না বুঝে, নিজ পরিধির বাইরে গিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের নীতিগত সিদ্ধান্তসহ নানাবিধ কর্মের চ্যালেঞ্জ করছেন। এহেন সাহসী কর্মে স্বদলীয় বৈরি শক্তির প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির এমন প্রকাশ্য বচসা নিজদলীয় ঐক্যে ভয়াবহ ফাটল ধরাচ্ছে।

জার্মান তাত্ত্বিক ওয়াল্টার বেনিয়ামিন তার ‘The work of art in the age of mechanical reproduction-1936’ নামক প্রবন্ধে বলেন, ‘যথাযথ শিল্প নিজেকে শুধু প্রকাশই করে না, গোপনও করে।’ বিপরীত লিঙ্গের কৌতূহল হেতু ইসলামের পর্দা প্রথা নারীর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বগুলোর ঐশ্বরিক ইলিউশন ও শৈল্পিক সৌন্দর্য প্রযুক্তির অতিব্যবহারে হাতে হাতে পৌঁছে যাওয়ায় নেতাদের প্রতি কর্মীদের আগ্রহে ভাটা পড়ছে। উপরন্তু নেতাদের বিশেষ গুণগুলোর দোষ-ত্রুটি বিশ্লেষণ করে পরিকল্পিত অপপ্রচার তাকে বিতর্কিত করে তুলছে। প্রযুক্তির সহায়তায় নিজদলীয় এমন অপরাজনীতি দলের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে বিনষ্ট করছে। উত্তর-আধুনিকতা High art I Low art-এর ধারণাকে খারিজ করে দেয়। তর্কের খাতিরে রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমকে high art এবং কায়িক শ্রমকে low art ধরে নিলে কায়িক শ্রম নিয়ত দেখা গেলেও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম দেওয়া হয় পর্দার অন্তরালে। রাজনীতিতে যাদের কম দেখা যায় বা আদৌ দেখা যায় না, দলীয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হয়তো সেই বেশি করছে। দলীয় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামকে জানিয়েই কাজগুলো করছে সে, যা টেকনিক্যাল কারণে সর্বসাধারণে জানানো হয়তো সম্ভবপর নয়। পক্ষান্তরে নিয়মিত সদম্ভে বিচরণ করা কোনো কর্মী হয়তো স্বল্প লোভে বিপক্ষ শক্তির এজেন্ট হিসাবে কাজ করছেন। নানা শ্রম ও উপাদানের সুসন্বিত রূপে নেতৃত্ব নির্বাচিত হলেও নেতাকর্মীদের প্রায় অসন্তুষ্ট হয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্কের ঝড় তুলতে দেখা যায়। একদল অপর দলকে গাধাভিত্তিক শ্রমিক ও এসি রুমের বাসিন্দা বা আয়েশি নেতা হিসাবে কটাক্ষ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে টিপ্পনি কাটতেও কসুর করেন না। দলের পক্ষ থেকে গোপনীয়তার স্বার্থে যথোপযুক্ত প্রমাণসহ নেতৃত্ব নির্বাচনের যৌক্তিক কারণগুলো তুলে ধরাও হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে না। কথা-কর্ম ও প্রকাশে সরাসরি এমন বৈরিতা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সাধিত হয়েছে, আগের দিনে তা ছিল কল্পনাতীত।

ফরাসি পণ্ডিত মিশেল ফুকোর বায়োপলিটিক্সের ধারণায় জ্ঞান ও ক্ষমতার সম্পর্ক বিচারে ক্ষমতা জ্ঞানকে স্বীকৃতি দেয় আর জ্ঞান ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখে। রাজনৈতিক ক্ষমতা, পুঁজিবাদী করপোরেট সংস্থা ও নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ফরমাইশি বুদ্ধিজীবি তৈরি করে থাকে। এমন বুদ্ধিজীবীদের বয়ান ও কর্মপরিকল্পনার সন্দেহ মিশ্রিত অনুপরীক্ষণ দলের অভ্যন্তরে অবিরত চলতে থাকে। গৃহীত সিদ্ধান্তের সফলতা-ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণে বুদ্ধিভিত্তিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। উত্তর-আধুনিক টেক্সট যেমন ব্যাখ্যা তৈরির কারখানা, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক কোনো দৃশ্যপটও অসীম ব্যাখ্যা তৈরি করছে। কেউ কারাগারে গেলে ইচ্ছা করেই কারাগারে গিয়েছেন, আবার মুক্তি পেলে সরকারের যোগসাজশে মুক্তি পেয়েছেন। মামলা হলে ইচ্ছা করেই মামলা নিয়েছেন, আর মামলায় নাম না থাকলে তাকে সরকারের এজেন্ট বলছেন খোদ নিজদলের লোকজন। বিরোধীদলীয় মিটিং-মিছিলকে সরকারি দলের ছত্রছায়ায় ও পুলিশকে উৎকোচ প্রদান করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছে স্বদলীয় বিপক্ষশক্তি। মিটিং-মিছিলকারীরা আবার নিজেদের সুসংহত শক্তি হিসাবে দলীয় ফোরামে জানান দিচ্ছেন। একই ঘটনাকে সরকার দলীয় বিপক্ষ শক্তি হাইকমান্ডকে অবহিত করছেন স্থানীয় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা নেতাদের বিতর্কিত করার লক্ষ্য নিয়ে। পাড়া-মহল্লায় সামাজিক অনুষ্ঠানে দু’দলের দু’জন নেতার মিলিত ছবি স্ব-স্ব দলীয় বিপক্ষশক্তি ফেসবুক-টুইটারে ভাইরাল করছেন অভিযোগের সুরে। এমন নানা তৎপরতা ও অপতৎপরতায় রাজনীতির প্রকৃত অবস্থা প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে দেয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্ল স্মিট তার ‘The concept of political-1926’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘Sense of enmity’ থেকে রাজনীতির উৎপত্তি, যা দুটো বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি নিজ দলেও আছড়ে পড়ছে। রাজনৈতিক উঁচু মহলের গাণিতিক সমীকরণ ও যোগ-বিয়োগের খেলায় বড় নেতার অবস্থানচ্যুতির কারণে তার অনুসারী নির্দোষ ও কঠোর পরিশ্রমীদের প্রায়ই অন্যায়ের শিকার হতে দেখা যায়। ঐতিহাসিক বা পদ্ধতিগত প্রেক্ষাপটে স্ব-ইচ্ছায় বা মনের অজান্তেই উপদলে নাম লেখানো কর্মীটি নিয়তিকে মেনে না নিয়ে উত্তেজনায় ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপক্ষ বড় কোনো শক্তির অপপ্রচারে লিপ্ত হয়ে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলছেন। অধিকন্তু রনজিত গুহের নেতৃত্বে গড়ে উঠা সাবলটার্ন স্টাডিজের নিুবর্গের ইতিহাস চর্চায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনুসংগ্রামের নায়করা নিজেদের কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখতে চান। নেতৃত্ব নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড না থাকায় সবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আকাশ স্পর্শ করছে। উপরন্তু দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে দলে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বগুলোর শৈল্পিক ‘অঁরা’ ১/১১ সরকার অনেকটাই ভেঙে দিয়েছে। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকা সরকারি নির্যাতনে পিষ্ট প্রত্যেক নেতাকর্মী নিজেকে অনুসংগ্রামের নায়ক ভাবছেন; কিন্তু পুরোনো প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব তা মানতে নারাজ। পক্ষান্তরে প্রায় এক যুগ ক্ষমতায় থাকা সরকারি দলে কালো টাকার দৌরাত্ম্যে গড়ে উঠেছে এক নতুন শ্রেণি। এ জায়মান শ্রেণি সরকারি দলের অপেক্ষাকৃত সৎ ও প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বকে চ্যলেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে। এ যেন অহিংস, সহিংস ও রক্তপাতহীন যুদ্ধে সবাই সবার টার্গেট। তথ্যপ্রযুক্তির অবারিত দ্বার যেমন নেতাকর্মীদের মাঝে অফুরান যোগসূত্র স্থাপন করেছে, ঠিক তেমনি শুধু লবিংয়ের জোরে নেতা বানানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক লেনদেনে নেতৃত্ব নির্বাচনের অভিযোগ আসছে প্রকটভাবে। সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দোলাচলে রাজনীতিকে আর সুতায় বাঁধা যাচ্ছে না।

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদের কোণঠাসা করে রাখার কারণে প্রকৃত রাজনৈতিক চর্চার পাশাপাশি বিরোধীরা পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। পক্ষান্তরে পুলিশ ও প্রশাসননির্ভর সরকারি দলের নেতাকর্মীরাও শুধু অর্থনৈতিক চাহিদা ও ক্ষমতা চর্চায় ব্যাপৃত হয়েছেন। ফলে নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ ও রাজনৈতিক চর্চার অভাব হেতু বোঝাপড়া দিনকে দিন কমছে। ঐক্যের পরিবর্তে রাজনীতি হয়ে উঠছে পার্থক্যনির্ভর। চিন্তার নৈরাজ্য, প্রযুক্তির অপব্যবহার, সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণে রাজনীতিতে উত্তর-আধুনিকতার ভয়াবহ প্রভাব চিরায়ত রাজনীতির শৈল্পিক সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। নোয়াম চমস্কি যেমন করে বলেন, ‘সব মানুষই দার্শনিক, কারণ মানুষ এমন বাক্য বলতে পারে; যেটা আগে কখনো সে শোনেনি। আবার আগে অকথিত বাক্যের অর্থ যথাযথভাবে উদ্ধার করতে পারে সে।’ রাজনীতিবিদরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। অধিকন্তু উচ্চাভিলাষ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার স্বভাবজাত। এহেন রাজনীতিবিদদের জন্য নিজেকে লাগামহীন করতে চমস্কির ভাষামালার চেয়ে জুতসই বয়ান আর কিই বা হতে পারে! তবে উত্তর-আধুনিকতার ভয়াবহ আবিষ্টতা তরুণ রাজনীতিকদের সবচেয়ে বেশি বেচাইন করে তুলছে। এর কারণ, যার কেবল দাঁত গজিয়েছে; সে সবকিছুই কামড়াতে চায়।



  • লেখক সাবেক যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ।
         লেখাটি প্রথম দৈনিক যুগান্তরে সম্পাদকীয় পাতায়  প্রকাশিত              হয়েছে। লিঙ্ক https://bit.ly/3glfj4O

Sunday, June 13, 2021

‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ উপাচার্যগণ

 ---------------------------------------

—    গোলাম মোর্তোজা

----------------------------------------

লেখার বিষয় বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং নিয়ে। শুরুতে একটু অন্য প্রসঙ্গ। কিংবদন্তি সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’র একটি ঘটনা।

বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করা কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু মিলে ফয়েজ আহমেদ মেস করে থাকেন নারিন্দার ভুতের গলিতে।

পত্রিকা অফিসের কাজ শেষ হয় রাত দুইটা তিনটায়। কেউ টেবিলে নিউজ পেপার বিছিয়ে বাকি রাতটুকু পার করে দেন, কেউ বাসায় ফেরেন। ফয়েজ আহমদরা মেসে ফিরতেন। সে বছর বড় বন্যা হলো।

দিনের বেলা কিছু অংশ ছোট নৌকায় পার হয়ে অফিসে আসা যায়। কিন্তু অত রাতে নৌকা থাকে না। সবাই মেসে ফেরেন কোমর পর্যন্ত ভিজে। একমাত্র ব্যতিক্রম ফয়েজ আহমদ, তিনি ফেরেন না ভিজে। ভিজে ফিরতে ফিরতে ইত্তেফাকের সহ-সম্পাদক মোহাম্মদউল্লাহর ঠান্ডা লেগে গেছে। সবার আলোচনার বিষয় ফয়েজ আহমেদের না ভেজার ‘রহস্য’। একদিন রাত দুইটায় মোহাম্মদউল্লাহ বন্ধু ফয়েজ আহম্মদকে বললেন, আজ তোর সঙ্গে ফিরব। দেখব না ভিজে তুই কি করে ফিরিস। ফয়েজ আহমদের কাজ শেষ হলো তিনটায়। দুই বন্ধু বের হলেন ইত্তেফাক অফিস থেকে। হাটখোলার ইত্তেফাক অফিসের কাছের হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির পাশের রেললাইন পার হলেই খ্রিষ্টানদের কবরস্থান। উল্টো দিকে বলধা গার্ডেন। পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে নারিন্দার দিকে। রাতে কবরস্থানে অনেকগুলো ঘোড়াকে ঘাস খেতে দেখা যায়। সারাদিন ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে রাতে ঘোড়াগুলোকে ঘাস খাওয়ার জন্যে কবরস্থানে ছেড়ে দিয়ে যান কোচোয়ানরা। এমন একটি ঘোড়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিয়েছেন ফয়েজ আহমেদ, যেটায় চড়ে তিনি বন্যার পানি পার হয়ে মেসে পৌঁছান। সেরাতে এক ঘোড়া দুইজনকে নিতে গিয়ে বিদ্রোহ করে বসে। পেছন থেকে পড়ে যান মোহাম্মদউল্লাহ। ফয়েজ আহমেদ ঠিকই না ভিজে শেষরাতে মেসে ফেরেন।

সংবাদপত্র অফিসের রাত জেগে কাজ করার সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। রিপোর্টারদের মধ্যরাতে বাসায় ফিরতে হয় না।

তাতে কী, ইদানীং উপাচার্যদের মধ্যরাতে কাজের বিষয়টি দৃশ্যমান হচ্ছে। মধ্যরাত বা শেষ রাতে কাজ করে সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।

কিছুদিন আগে বলেছিলেন তিনি দিনে ২০-২২ ঘণ্টা কাজ করেন। তার মানে ঘুমান মাত্র দুই ঘণ্টা। ১৪৪৭ দিনের মধ্যে ২৪০ দিন ক্যাম্পাসে উপস্থিত অর্থাৎ ১২০৭ দিন অনুপস্থিত উপাচার্য সম্ভবত ধরেই নিয়েছিলেন যে তার কথা কেউ বিশ্বাস করেননি। ফলে বিদায় বেলা তিনি রাত সাড়ে তিনটায় শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিয়েছেন। তার অভিনব কর্মকাণ্ডের কথা বলে শেষ করা মুশকিল। তিনি হঠাৎ হঠাৎ সকালের ফ্লাইটে গিয়ে বিকেলের ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরে আসেন। এমন এক দিন হঠাৎ করে ক্যাম্পাসের বাংলোতে গেছেন। শিক্ষক কর্মচারীরা এসেছেন দাবি নিয়ে। বাংলোর সামনে তারা অবস্থান নিয়েছেন। পরের দিনের পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে ‘পেছন দরজা দিয়ে পালিয়ে ঢাকায় ফিরলেন উপাচার্য কলিমউল্লাহ’।

তিনি ইতিমধ্যে একটি বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেছেন। প্রস্তাব পেলে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করবেন বলেও জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে। শিক্ষক নিয়োগসহ আরও কিছু গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। নিজের মাকে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য করেছেন। ইউজিসি তদন্তে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। মন্ত্রণালয় নির্বিকার। তিনি নির্বিঘ্নে দায়িত্ব শেষ করছেন।

র‍্যাঙ্কিং বিষয়ক আলোচনায় আসার আগে আরও কয়েকজন উপাচার্যের সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া যাক।

মধ্যরাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক সোবহানের বাসভবনের সামনে চাকরির দাবিতে অবস্থান নিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তিনি তাদের চাকরি দেবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। মেয়াদ শেষের একদিন আগে তিনি শুধু তাদেরকেই নয়, আরও শতাধিকজনকে চাকরি দিলেন। এখানেও মধ্যরাত মানে সারারাত জেগে চাকরির কাগজপত্র ঠিক করলেন। সুনির্দিষ্ট করে অভিযোগ উঠল অর্থ মানে টাকা মানে ঘুষ নিয়ে চাকরি দিয়েছেন।

উপাচার্য এমন কর্ম করতে পারেন তা অনুধাবন করে প্রতিবাদকারী শিক্ষকরা রেজিস্ট্রার ভবনে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। উপাচার্যের মেয়ের জামাই তালা ভেঙে কাগজপত্র বের করে আনলেন। উপাচার্যের এই মেয়ের জামাই ও মেয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা ছিল না। উপাচার্য নিয়ম পরিবর্তন করে তাদের শিক্ষক বানিয়েছেন। মজার বিষয়, উপাচার্যের মেয়ের জামাই তালা ভেঙে কাগজপত্রও সরিয়েছেন মধ্যরাতে। এখন জানা যাচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণি ও এক বিষয়ে ফেল করা ছাত্রকেও তিনি শিক্ষক বানিয়ে গেছেন।

আরেকজন উপাচার্য  চাকরির যোগ্যতা কমিয়ে নিজের ছেলেকে শিক্ষক বানিয়েছেন। এক উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাশাপাশি নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। আরেক উপাচার্য নিজে একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। ছেলের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ড থেকে কোটি টাকা দিয়ে আরও একটি গাড়ি কিনে দিয়েছেন। আরেকজন উপাচার্য স্বামী-সন্তানকে দিয়ে নির্মাণ কাজের কমিশন ভাগ বাটোয়ারা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গণমাধ্যমের সংবাদ ও ছাত্রনেতাদের টেলিফোন সংলাপ অনুযায়ী তিনি সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের এক-দেড় কোটি টাকা চাঁদার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। উপাচার্য অভিযোগ করেছেন, ছাত্র নেতারা তার কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন। উপাচার্যের বাসভবনে ছাত্র নেতাদের সঙ্গে তার মিটিংটিও হয়েছিল বেশ রাতে। গণমাধ্যমে তেমন সংবাদই প্রকাশিত হয়েছিল।

উপাচার্যের অভিযোগের ভিত্তিতে ছাত্র নেতাদের পদ বাতিল হয়েছে। উপাচার্য টিকে আছেন দাপটের সঙ্গে। বিদায় বেলায় তিনিও রাবি উপাচার্যকে অনুসরণ করে শিক্ষক, কর্মচারী নিয়োগে তৎপর হয়ে উঠেছেন। দরকার নেই, তারপরও অনলাইনে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে ব্যস্ত সময় পার করছেন উপাচার্য।

আরেক উপাচার্যের কাছে শিক্ষার্থীরা দাবি নিয়ে গেলে তিনি সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতা-ক্যাডারদের ডেকে পেটানোর ব্যবস্থা করেন। নিজ শিক্ষার্থীদের জঙ্গি বলে বিষোদগার করেন। ১০ টাকার চা-সিঙ্গারা-সমুচা তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য।

সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রসঙ্গে ফিরি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিউএস বিশ্বের সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করে। এবছরের তালিকায় সেরা ৮০০’র মধ্যে নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। ৮০০-১০০০ এর মধ্যে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট। ২০১২ ও ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০১ ও ৭০১ নম্বরে। অর্থাৎ ২০২১ সালে এসে মানের অবনতি হয়েছে। অথচ ২০২১ সালের সেরা ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকার ৩৫৫,৩৭৩ ও ৪৫৪ নম্বরে স্থান করে নিয়েছে পাকিস্তানের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়।

এমনিতেই বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বাজেট কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবছরের বাজেট ৮৬৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। গবেষণা বাজেট ৪০ কোটি ৯১ লাখ টাকা। শতকরা হিসাবে যা গত বছরের চেয়ে কম। এর মধ্যে আবার বড় অংশ ব্যয় হবে ঢাবির ৫৬টি গবেষণাগারের উন্নয়ন ও সরঞ্জাম কেনায়। প্রকৃত গবেষণার বাজেট নিতান্তই কম। ঢাবির মোট বাজেটের ৭০ শতাংশের উপরে ব্যয় হবে বেতন-ভাতা খাতে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র এর চেয়ে করুণ। এর বাইরে শিক্ষকরা পাঠদান বা গবেষণার চেয়ে অতিমাত্রায় সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্রমাবনতি ও সেরা তালিকায় না থাকার ক্ষেত্রে এগুলো নিশ্চয় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু প্রধানতম কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকনিক চরিত্র উপাচার্য। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন। বর্তমানে বা বিগত কিছু বছর ধরে উপাচার্য হিসেবে যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের কয়েকজনের কিছু কর্মকাণ্ড উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ করার বাইরে থেকে গেছে আরও এমন অনেক ঘটনা। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, উপাচার্য হয়ে যারা অনৈতিকতা ও আর্থিক দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন, সেইসব উপাচার্যরা পরিচালনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়। নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে দু’একজনের বিরুদ্ধে। তাদের অপসারণ করা হয়নি। শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের আন্দোলনকেও ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া হয়নি। ইউজিসি তদন্ত করে দুর্নীতি, অনৈতিকতার প্রমাণ পেয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এমন সব উপাচার্যদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে আমরা হা-হুতাশ করছি, কেন পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আমাদের নাম নেই! দুর্নীতির অভিযুক্তদের দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলে, দুর্নীতির তালিকায় স্থান পাওয়া যেতে পারে, সেরা বা শ্রেষ্ঠের তালিকায় নয়।

আমরা অনেক সূচকে আশপাশের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলি। যা অসত্যও নয়। কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়নে আমরা যে ক্রমাগতভাবে পিছিয়ে পড়ছি, তা আড়াল করা সুযোগ নেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক,উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবন নির্মাণ করেছি। শিক্ষকের মান উন্নয়ন করিনি।

ভবন-রাস্তা-সেতু-ফ্লাইওভার-মেট্রোরেল-টানেল উন্নয়নের জন্যে অপরিহার্য। কিন্তু এগুলো মূল উন্নয়ন নয়, উন্নয়নের সহায়ক। মূল উন্নয়ন মানবসম্পদ উন্নয়ন। সেদিকে আমাদের মনোযোগ নেই, তাই শুধু নয়—মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছি। ঢাকা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে দেখব, যেখানে যে খালি জায়গা ছিল সেখানে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। শিক্ষার মান উন্নয়নে, শিক্ষার্থীদের বাসস্থান,খাদ্য-জীবনমান তথা শিক্ষা উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেই। করোনাকালেও নেই। আমরা মূল উন্নয়ন বাদ দিয়ে যা উন্নয়নের সহায়ক তার পেছনে সময় ব্যয় করছি। ফলশ্রুতিতে আইকনিক চরিত্র উপাচার্যরা এখন অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেন, অনৈতিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ক্রমশ দৃশ্যমান আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবনতি।

লেখক সাংবাদিক।   



 — দি ডেইলি স্টার

Sunday, June 6, 2021

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও একজন জিয়াউর রহমান

 -------------------------------------------------------------------------

— ড. খন্দকার মারুফ হোসেন

--------------------------------------------------------------------------



মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক ও আধুনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপকার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়- তাঁর ৪০তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে। অপারেশন সার্চলাইটের পরে ২৫ মার্চ গভীর রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান মুক্তিকামী বাঙালি জাতির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হন। মেজর জিয়াউর রহমানই প্রথম ব্যক্তি যিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি একটি ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘We Revolt’, ‘আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করছি’। তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরীসহ বাঙালি সেনা অফিসার ও সৈন্যদের নিয়ে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানি কর্নেল জানজুয়াকে গ্রেফতার করেন এবং নিজ হাতে তাকে পরাজিত করে বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। জিয়াউর রহমানের নির্দেশে অস্ত্রাগার বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের জন্য খুলে দেয়া হয়। পরে তার নেতৃত্বে বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজ নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণা সারা দেশে এবং বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। পরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ আবারো স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১৯৭২ সালে ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত তৎকালীন কর্নেল জিয়াউর রহমানের লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি তার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের বহির্নোঙরে থাকা একটি জাপানি জাহাজের রেডিওতে শোনায় যা পরবর্তীতে রেডিও অস্ট্রেলিয়া কর্তৃক সংগৃহীত হয় এবং সারা বিশ্ব তা শুনতে পায়। এ ছাড়া আগরতলা থেকে মনিটরকৃত এ ঘোষণা ইন্ডিয়া নিউজ এজেন্সির মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত কিছু রেফারেন্স নিম্নে তুলে ধরা হলো —

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে দিল্লিতে দেয়া এক রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় বলেছিলেন, ‘জনাব রাষ্ট্রপতি, আপনার অবস্থান ইতোমধ্যে দেশের ইতিহাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

মেজর (অব:) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম তার ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক বইয়ের ৭৯ ও ৮০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘এভাবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সাড়ে ৭-৮টা বাজে। এমন সময় ইথারে ভেসে এলো মেজর জিয়ার জলদগম্ভীর কণ্ঠ। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলছেন।’

তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক সচিব হোসেন তরফদার তার ‘মূলধারা ৭১’ শীর্ষক বইয়ের ৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ৮-ইবির বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া তার প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তিনি শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন।’

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি নিউজ লেটারে প্রকাশিত খবর। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রদত্ত বক্তব্যের একাংশে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার পরই স্বাধীনতার দামামা শুরু হয়েছিল, তার আগে নয়। তিনি নিজেও, যতদূর আমি জানি, এখনো স্বাধীনতার দাবি করেননি’।

ড. ওয়াজেদ মিয়া ২০০২ সালের ১৩ মার্চ তারিখে ‘দি নিউ ন্যাশন’ পত্রিকায় প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণাও করেননি বা কারো হাতে কোনো লিখিত দলিল হস্তান্তর করেননি।’

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম তার ‘স্বাধীনতা-৭১’ শীর্ষক বইয়ের ৪১৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘তার ঘোষণার শুরুটা ছিল এই রকম ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।’

মেজর জেনারেল (অব:) সুবিদ আলী ভূঁইয়া ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তার ‘মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস’ শীর্ষক বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘বেতার কেন্দ্র থেকে যারা মেজর জিয়ার ভাষণ শুনেছিলেন তাদের নিশ্চয় মনে আছে, মেজর জিয়া তার প্রথম দিনের ভাষণে নিজেকে ‘হেড অব দি স্টেট’ অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান রূপেই ঘোষণা করেছিলেন।’

ভাষাসৈনিক অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭-৭৫’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন ‘রেডিও সেটে ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে ‘স্বাধীন বাংলা রেডিও’র ঘোষণা শুনিতে পাই। এই স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র হতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলার ডাক ধ্বনিত হয়েছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিন দিশেহারা, হতভম্ব ও মুক্তিপ্রাণ বাঙালি জনতা শুনিতে পায় এক অভয়বাণী, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িবার আহ্বান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ের সংবাদ।’

ভারতের সাংবাদিক জ্যোতি সেনগুপ্ত তার ‘হিস্টরি অব ফ্রিডম মুভমেন্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন ‘মেজর জিয়া ও তার বাহিনী ২৬ মার্চ ভোর রাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ওই দিন সন্ধ্যায় বেতারের মাধ্যমে সর্বপ্রথম নিজের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন।’


বিখ্যাত লেখক ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছিলেন ‘২৭ মার্চ শনিবার রাত ৮টায় রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে এই দেশের বেশ কিছু মানুষ অদ্ভুত একটা ঘোষণা শুনতে পায় মেজর জিয়া নামের কেউ একজন নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা দিয়ে বলেন- ‘আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’ বলে তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধের ডাক দেন। দেশের মানুষের ভেতর দিয়ে তীব্র ভোল্টেজের বিদ্যুতের শক প্রবাহিত হয়।’

এ ছাড়া এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) এ কে খন্দকার বীর উত্তমসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বইয়েও পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে কেবলমাত্র জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথের সময় ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বীকৃতি দান করেন।

মেজর জিয়াউর রহমান শুধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে ক্ষান্ত হননি, তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে ১ নম্বর ও পরবর্তীতে ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।

১৯৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের পরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়। ৩ থেকে ৭ নভেম্বর দৃশ্যত বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিল না। বাংলাদেশের জনগণ হয়ে পড়ে দিশেহারা। ঠিক সে সময়ে সিপাহি-জনতা বিপ্লব ঘটিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে সামরিক আইন জারি বা ক্ষমতা দখল করেননি। ১৯৭৮ সালে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে ৭২-৭৫ এর দুঃশাসনের কালিমা থেকে দেশকে মুক্ত করেন।

আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি স্বাধীনতার প্রধান চেতনা গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে। মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা বন্ধ করে বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা ও অব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ শুনতে হয়। জোরপূর্বক বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয় ৭২-৭৫ এ।

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন এবং আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। তিনিই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সন্নিবেশিত করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার স্থানে মহান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস এবং সব ধর্মের সমান অধিকার প্রবর্তন করেন। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তিনি নারী উন্নয়নের জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও মহান স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশে ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রবর্তন শিশুদের মেধা বিকাশের জন্য শিশুপার্ক, শিশু একাডেমি, নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেন। ১৯ দফা কর্মসূচি প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর রাষ্ট্রে রূপান্তর করেন। আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার তিনিই। দেশ যখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে উন্নতির শিখরে যাচ্ছে, ঠিক তখনই জিয়াউর রহমানকে দেশী বিদেশী চক্রান্তে শাহাদত বরণ করতে হয়।



শহীদ জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে শহীদ জিয়ার আদর্শ ও দর্শনকে বুকে ধারণ করে বিএনপির নেতাকর্মীরা দলকে সুসংগঠিত করেছে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি সফল হয়েছে। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত করেছে। সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে শহীদ জিয়ার গড়া দল বিএনপি। যতবার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে, ততবারই বিএনপি জনগণের ভোটে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছরে মুক্তিযুদ্ধের মূল আকাক্সক্ষা গণতন্ত্র বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। দেশ আজ স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট ও নব্য বাকশালীদের দখলে। আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার শূন্যের কোঠায়। দেশ আজ দুর্নীতি, দুঃশাসন, অপশাসন, গুম-খুন, অপহরণ ও মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বর্তমান করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন সেক্টরে যে অরাজকতা হয়েছে তা নজিরবিহীন। বিরোধী মতের মুখ বন্ধ করতে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ হাজার হাজার বিএনপির নেতাকর্মী মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় জর্জরিত।

বর্তমান পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হলে বর্তমান বাকশালী, স্বৈরাচারী সরকারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। তবেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর লক্ষ্য পূরণ হবে।

  • লেখক বিএনপি নেতা ও অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা