Search

Tuesday, August 30, 2022

জাতিসংঘের তালিকায় গুমের শিকার হওয়া ৭৬ জন

গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে তাঁদের স্বজনেরা ‘মায়ের ডাক’-এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন। এ সময় নিখোঁজ বাবা পারভেজ হোসেনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে আদিবা ইসলাম। ২০ আগস্ট বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে


জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বিভিন্ন সময় গুমের শিকার হওয়া ৭৬ জনের একটি তালিকা গত বছর বাংলাদেশ সরকারকে দেয়। এ বিষয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপে আলোচনা হয়। সর্বশেষ ১৪ আগস্ট জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত ঢাকা সফরের সময় এ তালিকা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন।


মিশেল ব্যাশেলেতের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওয়ার্কিং গ্রুপ ৭৬ জনের যে তালিকা দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১০ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। বাকিদের মধ্যে ১০ জনকে খুঁজে পেতে পুলিশ সহযোগিতা করতে চাইলেও তাঁদের স্বজনদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। বাকি ৫৬ জন ‘পলাতক’ বা নিখোঁজ। অবশ্য সরকার শুরু থেকেই গুমের ঘটনাগুলো অস্বীকার করে আসছে।


মিশেল ব্যাশেলেত ১৭ আগস্ট ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো সুরাহার স্বার্থে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানান।


জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ সরকারের কাছে গুমের শিকার হওয়া যে ৭৬ জনের তালিকা দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:


১. মোহাম্মদ শফিক উল্লাহ মোনায়েম। তাঁকে ২০০৭ সালের ১ ডিসেম্বর বরিশাল থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২. মো. হাসান খান। গাজীপুর থেকে ২০০৮ সালের ২৫ মে তাঁকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩. মোহাম্মদ চৌধুরী আলম। তাঁকে ঢাকা থেকে ২০১০ সালের ২৫ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে কিছু লোক তুলে নিয়ে যায়।


৪. সানায়াইমা রাজকুমার ওরফে মেঘেন। জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক। তাঁকে ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সাদাপোশাকের কিছু ব্যক্তি ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় পোশাকধারী পুলিশও ছিল।


৫. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। র‌্যাব পরিচয়ে ২০১১ সালে তাঁকে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যায়।


৬. তপন দাস। ২০১১ সালের ৩ আগস্ট তাঁকে কিছু ব্যক্তি ডিবির সদস্য পরিচয় দিয়ে ঢাকা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৭. হাবিবুর রহমান হাওলাদার। তাঁকে ২০১২ সালের বাগেরহাট থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৮. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। সিরাজগঞ্জ থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৯. আল মোকাদ্দাস হোসেন। ঢাকার সাভার থেকে ২০১২ সালে ডিবি ও র‌্যাব পরিচয়ে দিয়ে তুলে নিয়ে যায় কয়েকজন ব্যক্তি।


১০. মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ। ঢাকার সাভার থেকে ২০১২ সালে তাঁকে ডিবি ও র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১১. কে এম শামীম আখতার। ২০১২ সালে তাঁকে ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


১২. মোহাম্মদ ইমাম হাসান। ২০১২ সালে ঢাকা থেকে অপহৃত হন।


১৩. পারভেজ হুমায়ুন কবির ও ১৪. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম (হিরো)। দুজনকে ২০১৩ সালে কুমিল্লা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১৫. মোহাম্মদ তৈয়ব প্রামাণিক। নাটোর থেকে ২০১৪ সালে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১৬. মোহাম্মদ কামাল হোসেন পাটোয়ারী। নাটোর থেকে ২০১৪ সালে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১৭. মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল। নাটোর থেকে তাঁকে ২০১৪ সালে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১৮. কেইথেল্লাকপাম নবচন্দ্র (শিলহেইবা)। জন্মসূত্রে ভারতীয়। তাঁকে ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ ও গোয়েন্দারা তুলে নিয়ে যায়।


১৯. মো. সেলিম রেজা (পিন্টু)। তাঁকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়।


২০. মো. আসাদুজ্জামান রানা (বাবু)। ২০১৫ সালে ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২১. করিম জাহিদুল ওরফে তানভীর, ২২. মো. মাজহারুল ইসলাম ওরফে রাসেল, ২৩. আল–আমিন, ২৪. ইসলাম সাজেদুল ওরফে সুমন ও ২৫. মোহাম্মদ আবদুল কাদের ভূঁইয়া ওরফে মাসুম। এই পাঁচজনকে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে ঘটনা বেশি

গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের তালিকা অনুযায়ী ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে গুমের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। তালিকায় থাকা নামগুলোর মধ্যে আরও রয়েছেন:


২৬. মো. কাওসার হোসেন। তাঁকে ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২৭. এ এম আদনান চৌধুরী। র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২৮. মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম। ২০১৩ সালের ১১ মে ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২৯. নুরুল আমিন। লক্ষ্মীপুর থেকে তাঁকে ২০১৫ সালের ২৯ মার্চ পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩০. শামীম উদ্দিন প্রধান। বগুড়া থেকে তাঁকে ২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩১. নুর আলম। গাজীপুর থেকে তাঁকে ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩২. সোহেল রানা। ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩৩. সাজ্জাদ হোসেন শেখ। গাজীপুর থেকে ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩৪. মো. হোসেন চঞ্চল। ঢাকা থেকে তাঁকে ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩৫. পারভেজ হোসেন। ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩৬. মাহফুজুর রহমান সোহেল। ২০১৩ সালে ২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩৭. জহিরুল ইসলাম। ২০১৩ সালে ২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩৮. মো. নিজাম উদ্দিন। র‌্যাব ও ডিবি পরিচয়ে তাঁকে ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর তুলে নিয়ে যায়।


৩৯. মীর আহমদ বিন কাশেম। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট ঢাকা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৪০. মাহাবুব হাসান। ২০১৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৪১. কাজী ফরহাদ। ২০১৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৪২. সম্রাট মোল্লা। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ঢাকা থেকে তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৪৩. খালেদ হাসান। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ঢাকা তাঁকে তুলে নেওয়া হয়।


৪৪. মোহাম্মদ তারিকুল আলম। ২০১৩ সালের ৭ মার্চ তাঁকে যশোর থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৪৫. আবদুল্লাহিল আযমী। ডিবি পরিচয়ে ঢাকা থেকে ২০১৬ সালের ২ আগস্ট তাঁকে তুলে নেওয়া হয়।


৪৬. মোহাম্মদ আখতার হোসেন। ডিবি পরিচয়ে রংপুর থেকে তাঁকে তুলে নেওয়া হয় ২০১৬ সালের ৩ মে।


৪৭. এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন। ঢাকা থেকে তাঁকে ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনজন অস্ত্রধারী তুলে নিয়ে যায়।


৪৮. মো. আবদুল কুদ্দুস প্রামাণিক। রাজশাহী থেকে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে চার ব্যক্তি তুলে নিয়ে যায়।


৪৯. মোহাম্মদ জাকির হোসেন। ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৫০. মো. মাহাবুবুর রহমান ওরফে রিপন। ২০১৪ সালের ২১ মার্চ ঢাকা থেকে তাঁকে র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়।


ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায়ও ঘটনা অনেক

বিভিন্ন জেলায় ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বেশ কিছু গুমের ঘটনা ঘটেছে। গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের তালিকায় থাকা নামগুলোর মধ্যে আরও রয়েছেন:


৫১. মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান (নাহিদ)। নরসিংদী থেকে তাঁকে ২০১৭ সালের ৯ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ৮ থেকে ১০ জন তুলে নিয়ে যায়।


৫২. মো. রেজাউন হোসেন। যশোর থেকে ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট পুলিশ পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৫৩. শেখ মোকলেসুর রহমান। সাতক্ষীরা থেকে ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট সাতক্ষীরা থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৫৪. মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল ফারুখ (রশিদ)। রাজশাহী থেকে ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই র‌্যাব পরিচয়ে পাঁচ ব্যক্তি তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৫৫. মো. হাসিনুর রহমান। ঢাকা থেকে ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট ১০ থেকে ১৫ জন সশস্ত্র ব্যক্তি তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৫৬. মোহাম্মদ আলতাফ হাওলাদার। যশোর থেকে ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৫৭. রাজু ইসলাম। ২০১৫ সালের ২০ মার্চ ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৫৮. মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সরকার। নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৫৯. মোহাম্মদ জায়েদুর রহমান। নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৬০. মাইকেল চাকমা। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে তিনি নিখোঁজ হন।


৬১. ইসমাইল হোসেন। ২০১৯ সালের ১৯ জুন তিনি ঢাকায় নিখোঁজ হন।


৬২. মো. তারা মিয়া। ঢাকার মিরপুর থেকে ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে কয়েকজন তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৬৩. মনির হোসেন। ঢাকার গুলিস্তান থেকে ২০১০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর র‌্যাব পরিচয়ে কিছু ব্যক্তি তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৬৪. মোহাম্মদ নুর হোসেন (হিরু)। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে ২০১১ সালের ২০ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৬৫. মোহন মিয়া। ২০১৮ সালের ১০ জুন ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৬৬. জাকির হোসেন। ২০১৫ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকার গুলশান থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৬৭. ইফতেখার আহমেদ দিনার। ২০১২ সালের ২ এপ্রিল ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৬৮. জুনায়েদ আহমেদ। ২০১২ সালের ২ এপ্রিল ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়।


৬৯. এম ইলিয়াস আলী। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সদস্য পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৭০. আনসার আলী। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


তালিকায় কল্পনা চাকমার নাম

২৬ বছর আগে রাঙামাটির বাঘাইছড়ির নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে। গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের তালিকায় কল্পনা চাকমাসহ আরও যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁরা হলেন:


৭১. সাইদুর রহমান কাজী। ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল যশোর থেকে তাঁকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৭২. মোহাম্মদ মোরশিদুল ইসলাম। ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল রাজশাহীর তাহেরপুর থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৭৩. আবদুল কুদ্দুস মোহাম্মদ। ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে রাজশাহী থেকে তুলে নিয়ে যায়।


৭৪. ফরিদ আহমদ সৈয়দ। কুমিল্লা থেকে তাঁকে ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৭৫. আলমগীর হোসেন। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি কুমিল্লা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়।


৭৬. কল্পনা চাকমা। রাঙামাটি থেকে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অস্ত্রধারীরা তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


  • সূত্র - প্রথম আলো/ আগস্ট ৩০, ২০২২ 

Thursday, August 25, 2022

ভোট কারচুপি করতেই ইভিএম

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যানসহ তীব্র বিরোধিতা করছে দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জাসদ ছাড়া কোন রাজনৈতিক দলই ইভিএম-এর পক্ষে নয়।  আগামী জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে সর্বাধিক ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। মঙ্গলবার, আগস্ট ২৩, ২০২২, দুপুরে ইসির এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর থেকেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শুরু থেকেই এ কমিশনের প্রতি আমাদের আস্থা নেই। কারণ, এরা সবাই সরকারের আজ্ঞাবহ। এদের বসানোই হয়েছে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। অনেকেই আমাদের বলেছিল ইসির সঙ্গে একটু কথা বলে দেখেন না। ওদের আচরণ ইতিবাচক মনে হচ্ছে। কিন্তু আমরা কেন কথা বলছি না সেটা আজ প্রমাণিত। ওদের চাকরিটাই হলো আওয়ামী লীগকে পুনরায় পাশ করানো।

আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এতদিন ইসি বলেছিল বেশিরভাগ দল ইভিএম চায় না। এখন উনারা নিজেরাই ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। আসলে তাদের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। কারণ আগামী নির্বাচনে সরকারের নীল নকশা বাস্তবায়নেই এ সিদ্ধান্ত। ইভিএম দিয়ে চুরি করবে, বাকিটা অন্যভাবে নেবে। আমরা তো শুরু থেকেই বলছি-সরকার ভোট চুরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ইভিএম হচ্ছে সেটার অংশ। কারণ, ভোটারদের প্রতি ক্ষমতাসীনদের কোনো আস্থা নেই। সুষ্ঠু ভোট হলে পরিস্থিতি কি হবে তা তারা অনুমান করতে পারছে। তাই ভোট ডাকাতির মাধ্যমেই আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।


আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারে ইসির সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব বলেন, এ সিদ্ধান্ত নির্বাচনকে প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে ফেলবে। অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনাকে সুদূর পরাহত করবে?। এটা গণতন্ত্র, নির্বাচন ও ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। ইসির সিদ্ধান্ত আগামী সংসদ নির্বাচনে সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর নীল নকশার অংশ।


বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, আমি মনে করি, এটা বর্তমান রাজনৈতিক সরকার কর্তৃক ইসির ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটা সিদ্ধান্ত। সরকারের চাপিয়ে দেওয়া এ সিদ্ধান্ত নাকচ করার সুযোগ এমনকি আইনি সাহস ইসির নেই। এসব কারণে ইসির ওপর আমাদের আস্থা নেই।


জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের বলেন, দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনের ওপর সাধারণ মানুষের কোনো আস্থা নেই। দেশের সাধারণ মানুষ মনে করছে কারচুপি করতেই ইভিএমে ভোটগ্রহণ করতে চাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা।


বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও ১৪ দলের শরিক সংসদ-সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার পূর্বসূরিদের পথেই হাঁটছে, যা শুভ লক্ষণ নয়। এতে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কিসের ভিত্তিতে ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট হবে-তা স্পস্ট করেনি ইসি। এটা পরিষ্কার বা খোলাসা করে বলা উচিত। তা না হলে নির্বাচনে কারসাজি করার যে বিতর্ক, তা থেকেই যাবে। নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।


লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বলেন, সরকারের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার লক্ষ্যেই এই কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা জনগণের জন্য কিছু করবে সেটা আমরা মনে করি না। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এমনকি সাধারণ মানুষেরও এ কমিশনের প্রতি আস্থা নেই। তারা সরকারের এজেন্ট হিসাবে কাজ করছে। তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।


ইভিএমে ভোট নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার আবারও ডাকাতি করে ক্ষমতায় যেতে চায়। এবার তারা ভোট চুরির বাক্স ইভিএমকে বেছে নিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের এ চাওয়াকেই বাস্তবায়ন করছে ইসি। তারা এখন পর্যন্ত যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কোনোটাই জনগণের পক্ষে নেয়নি। সবশেষ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মতকে উপেক্ষা করে তারা ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইসির কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে, তারা আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন হিসাবে কাজ করছে।


নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। তারা সরকারের দেখানো পথেই হাঁটবে। ইসিকে নিরপেক্ষভাবে হাঁটার সুযোগ তো সরকার দেয়নি। ইভিএম বাতিল করা হলো এটা বলার সাহস ইসির নেই। তাদের এটাই বলতে হবে। তারা করতে থাকুক তাদের কাজ আমরা করব আমাদের কাজ। সরকারের পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে ইসির কিছু করার ক্ষমতা নেই। তারা সেটা করতেও পারবে না। সরকার যা চাইবে তারা সেটাই করবে।


  • সূত্র - দিনকাল/ আগস্ট ২৫, ২০২২

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সরকারের চরম ব্যর্থতা বাংলাদেশকে মহাসংকটে ফেলেছে

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে 

বাংলাদেশ সরকারের চরম ব্যর্থতা দেশের জন্য মহা-সংকটের সৃষ্টি করেছে



আগস্ট ২৫, ২০২২

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি’র সংবাদ সম্মেলন


প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা, 

আসসালামু আলাইকুম।

পাঁচ পাঁচটি বছর পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশের অবৈধ, অনির্বাচিত গণবিচ্ছিন্ন সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মূলত শুরু থেকেই এ সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। 

 

২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বোঝা বহন করে চলেছে। ২২ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু যুক্ত হচ্ছে। সে হিসেবে গত ৪ বছরে রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে ১২ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে এবং এ সংখ্যা দিন-দিন বাড়তেই থাকবে। 

 

রোহিঙ্গা সমস্যা একদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং সামাজিকভাবে জীবন-জীবিকায় চরম অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মাদক ব্যবসা, নারী পাচার ও নানাবিধ অসামাজিক ও আইন বিরোধী কার্যকলাপে সৃষ্ট অশান্ত ও অস্থির পরিস্থিতি, মাদক চোরাচালান ও মাদক পাচারে রোহিঙ্গাদের জড়িয়ে পড়া, রোহিঙ্গাদের অন্তদ্বন্দ্বে রোহিঙ্গা নেতা হত্যা- ইত্যাদি বিষয় চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে ভালো ভবিষ্যতের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ পথে যেমন সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছে।  

 

অপরদিকে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগণের আবাসন ও খাদ্যের যোগান দেয়া, স্যানিটারি ব্যবস্থাসহ পরিচ্ছন্নতা বিধান, স্বাস্থ্য পরিসেবা প্রদান, ক্যাম্পে বেড়ে ওঠা রোহিঙ্গা সন্তানদের শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষা ব্যবস্থা, বিনোদন, জীবনাচার ইত্যাকার বিষয় অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা নির্ভর এক মহাকর্মযজ্ঞ। বিশেষ করে কোভিড পরবর্তী সংকটকালে ইতোমধ্যে ১৭ কোটি মানুষের ভারে ভারক্রান্ত বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের এ অতিরিক্ত বোঝা বহন করা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এদিকে UNHR এর মুখপাত্র রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কক্সবাজারে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির এর জন্য আরও আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। এদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য দরকার পুষ্টি, আশ্রয় সামগ্রী, পয়ঃনিস্কাশন ও জীবিকায়ন সুবিধা। 

 

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, 

রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের একা’র সংকট নয়। এটি একটি বৈশ্বিক সংকট। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সংকট যে একটি বৈশ্বিক সংকট, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সে বিষয়ে যথাযথভাবে উদ্ভুদ্ধ কিংবা convince করতে পারেনি।  

 

বিশ্বের অন্যান্য মানবিক সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে সাড়া দেয় বা তৎপর হয়, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তারা সেভাবে এগিয়ে আসেনি। এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সরকারের চরম কূটনৈতিক ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই না। যদিও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা চলবে বলে রায় দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র রাখাইনের হত্যাকা-কে জেনোসাইড আখ্যায়িত করেছে, এবং ICC রোহিঙ্গাপীড়নের হোতা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান করছে, তথাপি রোহিঙ্গা সমস্যার মূল চ্যালেঞ্জ তথা নিরাপদ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটকে এখন আর গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না বিশ্ব। অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সংকটকে বিশ্ব দরবারে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। 

 

প্রিয় সাংবাদিক ভাই বোনেরা, 

এই সরকার ব্যার্থ হয়েছে বন্ধু রাষ্ট্রদের এবিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের জাতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য রাখাইনে মুসলিম জনপদের ওপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৮ লক্ষ রোহিঙ্গা যখন কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়, তখন মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির পরিবর্তে সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করে এবং মিয়ানমার সরকারের সাথে এক ধরনের সহমর্মিতা  প্রকাশ করে, এবং অন্যদিকে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানবিক সাহায্য প্রদানের আশ্বাস প্রদান করে। এদিকে চীন সরকার একদিকে বরাবরের মতো মিয়ানমারের সাথে তাদের বন্ধুত্বের ঘোষণা অব্যাহত রাখে, এবং অপরদিকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে ত্বরাণ্বিত করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে অদ্যাবধি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় কোনো ফলপ্রসূ অগ্রগতি সাধিত হয়নি। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীন ত্রিপক্ষীয় পদক্ষেপ চলমান রয়েছে বলে বলা হয়। বাস্তবতা হলো গত ৫ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও সেদেশে ফেরত পাঠান সম্ভব হয়নি। এদিকে গত ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সুচিকে ক্ষমতাচ্যুত করা সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের হত্যা করা হয়েছে। সেদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েই চলছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি বরং আরো জটিল আকার ধারণ করেছে।  

 

এই পটভূমিকায় বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা শরনার্থীদের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি এখন আগের চেয়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ভারত, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোসহ আন্তর্জাতিক মহল আরও কার্যকরী ও ফলপ্রসূ চাপ না দিলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠান সম্ভব নয়। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আরও জোরালো রাজনৈতিক তৎপরতার চালাতে হবে। 

 

মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের ওপর প্রচণ্ড জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। দুঃখজনক হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার প্রতিবাদ করলেও আবার তাদের অনেকের সাথেই মিয়ানমারের বড় ধরনের ব্যবসায়ীক সম্পর্কও রয়েছে। 

 

এই দ্বৈত অবস্থান চিহ্নিত করে বাংলাদেশ সরকারের উচিত focused কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে তা বন্ধ করা। কিন্তু সংকীর্ণ রাজনৈতিক কারণে বর্তমান সরকার এসব বিষয়ে স্পষ্ট, কার্যকরী ও সুনির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। 

 

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, 

২০২০ সালে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় না করে সরকারের একক সিদ্ধান্তে বঙ্গোপসাগরের মুখে দ্বীপ ভাসানচরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর কিয়দংশ স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে নাখোশ করেছিল। ঐ সময় জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংগি লি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, ''--এই স্থানান্তরে মিয়ানমার এমন বার্তা পেতে পারে যে বাংলাদেশেই রোহিঙ্গাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তাদের ফেরত না নিলেও চলবে''। সাংবাদিক সম্মেলন করে তখন বিএনপিও ভাসানচরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থানান্তরের বিরোধিতা করেছিল এ জন্য যে এতে মিয়ানমারের স্বার্থই রক্ষিত হবে, প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ কমবে এবং প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়বে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। মিয়ানমার সরকার সম্প্রতি ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে সেদেশে বাস্তুচ্যুত করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বন্দি করে রেখেছে এবং নানা অজুহাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে virtually কোল্ড স্টোরেজে পাঠিয়ে দিয়েছে। ফলে ১২ লক্ষ রোহিঙ্গার বোঝা এখন জগদ্দল পাথরের মতো এ দেশের মানুষের ঘাড়ে চেপে আছে।  

 

প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার শুরু থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বিতর্কিত কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয় আসছে। শুরুতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ, মিয়ানমার বাহিনীর সাথে যৌথ সেনা মহড়ার প্রস্তাব এবং সবশেষে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর এসবই সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার প্রমাণ বহন করে। সে সময় প্রাথমিকভাবে হাসিনা সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা দেয়। 

 

এমনকি মিয়ানমারের ভাষায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যৌথ তদন্তে সহযোগিতার ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে তুরস্কের ফার্স্ট লেডী এবং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয় মন্ত্রীদের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ও আভ্যন্তরীণ চাপে সরকার সে বাধা উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়। ২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ে জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেনঃ ''এই ঘটনার সূত্রপাতটা আমরা যেটা দেখি– ওখানে কোনো একটা গোষ্ঠী আছে, তারা মিলিটারির উপর হামলা করেছে। মিয়ানমারের যে বর্ডার ফোর্স– তাদের উপর হামলা করে বেশ কয়েকজন সদস্যকে হত্যা করে। ২০১২ সালে একবার এই ঘটনা ঘটায়। তখনই সাধারণ নাগরিকের উপর অত্যাচার শুরু হয়। আবার ২০১৬ সালে এবং ২০১৭ সালে ঠিক একই ঘটনা ঘটানো হল। সেখানে অনেকগুলি বর্ডার ফোর্সের সদস্যদের, বর্ডার পুলিশকে হত্যা করেছে। আর্মির উপরে তারা আক্রমণ করেছে। যার ফলাফলটা হল যে, সাধারণ নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার, নির্যাতন শুরু হল...''।

 

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, 

অপরদিকে ২০১৭ সালে আগস্টে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা আরম্ভ হলে শুরুতেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি চেয়ারপার্সন মানবতার নেত্রী, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ সরকারকে অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে উদাত্ত আহবান জানান। রোহিঙ্গাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য তিনি নিজে কক্সবাজারে স্থাপিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এরপরে লাগাতারভাবে আমাদের দলের পক্ষ থেকে দেশে-বিদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, লেখালেখি, প্রকাশনা, প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া হয়। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান ইস্যুতে গোলটেবিল আয়োজন করে এবং রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জাতীয় ঐক্যের আহবান জানায়। কিন্ত এ সরকার তাদের স্বভাবসুলভ স্টাইলে সে ডাকে সাড়া দেয়নি।  

এ প্রসঙ্গে ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান এবং ১৯৯২ সালে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সময় লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা এদেশে আশ্রয় নিলে তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও স্টেটসম্যানসুলভ ধীশক্তি গুণে সে সময় মিয়ানমার সরকারকে প্রায় সকল রোহিঙ্গা শরনার্থীদের দেশে ফেরত নিতে বাধ্য করেছিলেন। সে সময় স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তিতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের আইনানুগ অধিবাসী (legal residents) এবং মিয়ানমার সমাজের সদস্য (member of Myanmar society) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।  

 

২০১৭ সনের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় সংসদে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এই সমঝোতা চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে স্বীকার করেন যে উক্ত সমঝোতা চুক্তিবলে ১৯৭৮ সাল, ১৯৮১-৮২ সাল এমনকি ১৯৯১-৯১ সালে যে সকল রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছিল তাদের ফেরত নেয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো সে সময় সম্ভব হলে এখন কেন সম্ভব হচ্ছে না ?

আমরা বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে কেবলমাত্র স্বল্প সময়ের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করছেন। তারা অতিশীঘ্র তাদের নিজ নিজ বাড়ি ঘরে নিরাপদে ফিরে যাবেন। আমরা চাই, প্রত্যাবাসন হোক স্বেচ্ছাপ্রণোদিত, নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই। রোহিঙ্গারা তাদের প্রিয় মাতৃভূমি মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ফিরে পাক। নিশ্চিত করা হোক বাড়ীঘর, কর্মস্থলে তাদের সার্বিক নিরাপত্তা। বিশ্ব জনমত এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও তা'ই চায়।

 

উপস্থিত সাংবাদিকবৃন্দ, 

রোহিঙ্গা ইস্যুতে শুরু থেকেই জনবিচ্ছিন্ন এই অনির্বাচিত সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। বারো লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি রাখাইনে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকেও সরকার রাখাইনে ফেরত পাঠাতে পারেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছাও তারা প্রমাণ করতে পারেনি। দীর্ঘদিনের এই সমস্যাকে কার্যকরভাবে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে না পারা নিঃসন্দেহে সরকারের চরম ব্যর্থতা। 

 

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, 

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই উপায়ে মিয়ানমারের নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে চান। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনার কক্সবাজার ক্যাম্প পরিদর্শনে গেলে তাঁকেও তারা একই দাবী জানায়। রোহিঙ্গা সংকটের একটি টেকসই সমাধানের জন্য ‘নিরাপদ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন’ নিশ্চিত করতে হবে। আর এই প্রত্যাবর্তনকে শুধুমাত্র কাগুজে চুক্তিতে বন্দি না রেখে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তির কার্যকর প্রয়োগের পথে এগুতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘ, আঞ্চলিক সংস্থা এবং বিশ্বশক্তিগুলোর স্ব স্ব ভূমিকা সুনিশ্চিত করতে হবে। কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলকে বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতার কথা উপলদ্ধি করাতে হবে। 

 

কিন্তু তার আগে মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া হতে হবে স্বেচ্ছায়, মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিয়ে নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই। কোন ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের পাতানো খেলার অপকৌশল হিসেবে নয়। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে হবে।  

 

প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,

দেশবাসীকে আমরা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়া যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন সে সময় উদ্ভুত রোহিঙ্গা সমস্যার সুষ্ঠু ও সম্মানজনক সমাধান করা সম্ভব হয়েছিল তাদের রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্ব¡ এবং দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতাসীন থাকার কারণে। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে দুর্বল এবং স্বৈর সরকার হিসেবে পরিচিত একটি জনমেন্ডেটহীন সরকারের পক্ষে রোহিঙ্গা সমস্যার মতো একটি জটিল ও আন্তর্জাতিক সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। কেবলমাত্র একটি জনবান্ধব গণতান্ত্রিক সরকারের দ্বারাই এটা সম্ভব। যা বাংলাদেশে এই মুহূর্তে অনুপস্থিত। তাই বাংলাদেশের জনগণ, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান ও বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে আলাদাভাবে দেখলে চলবে না। একটি অগণতান্ত্রিক ও গণবিচ্ছিন্ন সরকারের সার্বিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্বৃত্তায়নের ধারাবাহিক পরিণতিই হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও স্থবিরতার প্রধান কারণ। এই মুহূর্তে সর্বাগ্রে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার দিকেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি সরকারের পক্ষেই সম্ভব রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিকভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে তাদের স্বদেশ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা। 

সবাইকে ধন্যবাদ। আল্লাহ্ হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। 

 

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

মহাসচিব 

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি

Monday, August 22, 2022

ধন্যবাদ নিজেকে ‘দালাল’ বলা বিদেশমন্ত্রী!

— রুমিন ফারহানা



মানুষের কখনো কখনো সময় খারাপ যায়। আমরা বলি ‘চোরাবালিতে’ পড়া। এই চোরাবালিতে পড়লে নাকি দাপাদাপি করতে হয়না, চুপ থাকতে হয়। বিদেশমন্ত্রী যেদিন বললেন আমরা বেহেশতে আছি সেদিনই নিজের জন্য যথেষ্ট বিপদ ডেকে এনেছিলেন তিনি। ‘চোরাবালি’ না হলেও বিপদ খুব ছোট ছিল না। শেষমেশ সাংবাদিকদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে কিছুটা হলেও রক্ষার চেষ্টা করেন।


বলেন, ‘আমি তো ট্রু সেন্সে বেহেশত বলিনি। কথার কথা। কিন্তু আপনারা সবাই আমারে খায়া ফেললেন।’ কে কাকে খায়া ফেলছে সেই আলোচনায় না গিয়েই বলি করোনার ধাক্কায় মানুষ যখন বিপর্যস্ত, টিসিবি’র ট্রাকের পেছনে মানুষের সারি প্রতিদিনই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, কাজ হারিয়ে, বেতন কমে মানুষ যখন হিসাব কষছে সন্তানের জন্য দুধ নাকি মায়ের জন্য ওষুধ কিনবে, ঠিক তখনই হঠাৎ করে জ্বালানির দাম বাড়া যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। আর সেই ঘায়ের ক্ষততে লবনের ছিটার মতো আসলো বেহেশত প্রসঙ্গ। সেটাও এক রকম সামলে ফেলেছিলেন মন্ত্রী। কিন্তু শেষ রক্ষা  হলো না। এইবার আর বিপদ না, হাত পা মেলে চোরাবালিতে ঝাঁপ দিলেন তিনি। এখন দেখার বিষয় একা ডোবেন নাকি দলবলসহ।    

গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম শহরের জেএম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দারুণ এক আবদার কিংবা কারও কারও মতে মিনতি করেন ভারত সরকারের কাছে। সেই আবদার মেটানোর জন্য যা যা করা দরকার তাও করতে হবে ভারতকেই। তিনি খোলাখুলি বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্র্রদায়িক একটা দেশ হবে। শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।’  এই সেদিন পর্যন্ত সরকারি দলের মুখে আমরা শুনেছি তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ দলটি নাকি কথায় কথায় বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়, তাদের কাছে নালিশ জানায়, সরকারের সমালোচনা করে তাদের কাছে সমাধান চায়। আর সরকারি দল নাকি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে দেশের মানুষই তাদের একমাত্র শক্তি, ক্ষমতার উৎস। অথচ ২০০৩-২০০৪ সালে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিদেশে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের কথা যদি ছেড়েও দেই ২০১৪ সালের পর থেকে এই সরকারের বিদেশ নির্ভরতার কথা একটা শিশুও জানে। এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন  কথাও প্রচলিত আছে যে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল ১/১১ সরকারের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তারা নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মধ্যদিয়েই ক্ষমতায় যেতে পেরেছিল। 


ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’ বইয়ে লিখেছেন, ২০০৮ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের ডি-ফ্যাক্টো শাসক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ভারত সফরে যান এবং তিনি নির্বাচনের পর নতুন সরকারের অধীনে চাকরি হারানোর ভয়ের কথা জানান প্রণব মুখার্জীকে। জনাব প্রণব মইন ইউ আহমেদকে আশ্বস্ত করেন যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তার কোনো সমস্যা হবে না।   বাংলাদেশে নির্বাচনহীনভাবে ক্ষমতায় থাকা না থাকা নিয়ে কোন কোন দেশের কেমন নেপথ্য ভূমিকা আছে, সেসব নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা অনুমান, ফিসফাঁস, আলোচনা আছে। কিন্তু এটা একেবারে প্রকাশ্যে চলে আসে ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচনের আগে। ভারতে তখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার। তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং দেশে আসেন নির্বাচনের আগে। বিএনপিসহ প্রায় সকল দল নির্বাচনে না থাকায় জাতীয় পার্টিকে যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে এনে সেটাকে কিছুটা হলেও জায়েজ করার চেষ্টা করা হয়। মিস সুজাতা এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাকে শক্ত চাপ দেন নির্বাচনে অংশ নিতে, যা বৈঠকের পর এরশাদ মিডিয়ার কাছে ফাঁস করে দেন। এটা যে তৎকালীন ভারতীয় কংগ্রেস সরকারের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার অংশ ছিল, সেটা প্রমাণিত হয়েছে আরও পরে।      বাংলদেশের ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সালমান খুরশীদ। ২০১৫ সালে প্রকাশিত তার ‘দ্য আদার সাইড অব দ্য মাউন্টেইন’ বইয়ে তিনি যা বলেছিলেন, সেটা খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে তার দল কংগ্রেসের সরকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতটা হস্তক্ষেপ করেছিল। 


সে বইয়ে তার একটা উদ্ধৃতি এ রকম- “বাংলাদেশে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে রাজপথে একদিকে সরকার সমর্থক ও তরুণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী জাতীয়তাবাদী (গণজাগরণ মঞ্চ) এবং অন্যদিকে কট্টর জামায়াতে ইসলামীর কদর্য সংঘাতের ঘটনায় প্রাথমিক সেসব ইতিবাচক লক্ষণগুলো গুলিয়ে যায়। আর সে সময় আমাদেরকে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ শিবিরের দিকে ঝুঁকতে হয়। ভারতের এটি বেছে নিতেই হয়েছে। এক্ষেত্রে অবস্থান নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া এবং সেজন্য সুযোগ হারানোটা সত্যিই বিপজ্জনক ছিল।” ভারতের সঙ্গে বর্তমান সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলটি কী করছে সেটার চমৎকার এক প্রদর্শনী ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই বক্তব্য। তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, আমার দেশে কিছু দুষ্ট লোক আছে, কিছু উগ্রবাদী আছে। আমার দেশ সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন না, আপনার দেশেও যেমন দুষ্ট লোক আছে, আমাদের দেশেও আছে। কিছুদিন আগে আপনাদের দেশেও এক ভদ্রমহিলা কিছু কথা বলেছিলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে একটি কথাও বলিনি। বিভিন্ন দেশ কথা বলেছে, আমরা বলিনি। এ ধরনের প্রটেকশন আমরা আপনাদের দিয়ে যাচ্ছি। সেটা আপনাদের মঙ্গলের জন্য, আমাদের মঙ্গলের জন্য। আমরা যদি একটু বলি, তখন উগ্রবাদীরা আরও সোচ্চার হয়ে আরও বেশি বেশি কথা বলবে। তাতে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন হবে। 


আমাদের স্থিতিশীলতা বিঘ্ন হবে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা এমন কাজ করবো না, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমন কোনো উস্কানি দেবো না, যাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশে কিছু মসজিদ পুড়েছে। আমরা কোনোভাবে সেটা প্রচার করতে দেইনি। এর কারণ হচ্ছে কিছু দুষ্ট লোক আছে, কিছু জঙ্গি আছে যারা এটার বাহানায় আরও অপকর্ম করবে। আমরা এটা নিয়ন্ত্রণ করেছি। অনেকে আমাকে ভারতের দালাল বলে, কারণ অনেক কিছুই হয়, আমি স্ট্রং কোনো স্টেটমেন্ট দেই না।’ চারিদিকে যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে ভীষণ তোলপাড় তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেটার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, ‘ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতকে অনুরোধ আওয়ামী লীগ করে না, করেনি। শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকেও কাউকে এমন দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। যিনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) এ কথা বলেছেন, সেটা তার ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। সেটা আমাদের সরকারের বক্তব্য না, দলেরও না।’  বোঝাই যাচ্ছে, জনাব কাদের ড্যামেজ কন্ট্রোল করার চেষ্টায় নেমেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে এটা তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর গতকাল রাতে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বসে অনেক আলোচনা-পরামর্শ করে ঠিক করেছে, এই ইস্যুতে কী বক্তব্য দেয়া হবে। কিন্তু শেষমেশ জনাব কাদের যে বক্তব্য দিলেন, এতে ড্যামেজ কন্ট্রোল তো হয়ইনি তিনি ড্যামেজ আরও বাড়ালেন, এটা বলছি কারণ, বিদেশ মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তিনি নতুন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিলেন।  


আমরা কি এটা বিশ্বাস করি, সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়াই একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা মনে আসে, সেটাই বলে আসবেন? যেকোনো মূল্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যা যা করার দরকার সেটা করতে ভারতকে অনুরোধ জানাতে কী তিনি পারেন একেবারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে? আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি সত্যিই সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়াই এমন অনুরোধ ভারতকে করে থাকেন, তাহলে সেটা কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে তার ভয়ঙ্করতম অপরাধ নয়? তার এই ‘ব্যক্তিগত’ বক্তব্য কি তার দলের গত কয়েক বছরের কার্যক্রম ও চিন্তাধারা থেকে ভিন্ন কিছু? যদি ভিন্ন কিছুই হয়ে থাকে (যা আমি মনে করিনা) প্রতিক্রিয়ায় কি তাকে বক্তব্যের পর মুহূর্তেই পদচ্যুত করা উচিত ছিল না কিংবা অন্তত পক্ষে একটা ব্যাখ্যা তলব?    একটা সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য কোনো না কোনো ভিত্তি লাগবেই। একটা অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যে সরকারটি ক্ষমতায় আসে, তার ভিত্তি হয় জনগণ। কিন্তু এদেশের মানুষ তাদের সকল ধরনের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়েছে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই।  ২০১৪ সাল থেকে জনগণের ম্যান্ডেটহীন এই সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে এবং টিকিয়ে রেখেছে তাদের আন্তর্জাতিক কিছু মিত্র এবং দেশের ভেতর আমলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিরোধী দলকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যা, নির্বিচারে মামলা দেয়া থেকে শুরু করে হেন কোনো নির্যাতন নাই যা এই সরকারের সময় করা হয়নি। শুধু নিজের দেশের মানুষকে চাপে রাখা নয় সেই সঙ্গে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে নানা ক্ষেত্রে কী ধরনের আচরণ এই সরকার করেছে সেটাও খুব স্পষ্ট বিদেশ মন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই। 


তবে যে যাই বলুক আমি মনে প্রাণে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই বিদেশ মন্ত্রীর সততাকে। দেশের মানুষ যেমন জানে তেমনি জানে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এমপি থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মীরা কি করে তারা ১৪ সালের পর থেকে ক্ষমতায় এসেছে এবং এখনো টিকে আছে। কিন্তু বিদেশ মন্ত্রীর মতো এত খোলামেলা প্রাঞ্জল ভাষায় কেউ একথা স্বীকার করেনি। সামনে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে জনগণের ভোটে বিজয়ী হওয়া দূরেই থাকুক, মোটামুটি সুষ্ঠু ভোট হলেও অল্প কয়েকটি আসন ছাড়া অন্যগুলোতে জেতা সরকারি দলের জন্য অসম্ভব। বিদেশ মন্ত্রীর কথায় এটি স্পষ্ট যে দেশের পুলিশ, প্রশাসন বা নির্বাচন কমিশনের অকুণ্ঠ আনুগত্যও যে তাদের আবার ক্ষমতায় আনতে বা রাখতে পারবে সেটি তারাও এখন আর বিশ্বাস করে না। সুতরাং তারই ভাষায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যে দেশের সঙ্গে আছে তাদের সরাসরি সহযোগিতা ছাড়া উপায় কি? বিদেশ মন্ত্রীকে আমি আরও ধন্যবাদ জানাই নানা আলোচনা সমালোচনা সত্ত্বেও নিজ বক্তব্যে অটল থাকার জন্য। তার এ বক্তব্য সরল মনে বা মুখ ফস্কে দেয়া হয়েছে নাকি তিনি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন-এমন প্রশ্নে আব্দুল মোমেন ঢাকা টাইমসকে বলেন “আমি জেনে বুঝেই বলেছি। আমি আমার বক্তব্য থেকে সরছি না। আমি ভুল কিছু বলিনি।” সঙ্গে তিনি আরও যুক্ত করেন “আমি আরও বলবো। 


তাদের সহযোগিতা আমাদের দরকার।” আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কোনো চ্যারিটি নয়। এখানে প্রতিটি দেশ যার যার স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করবে, যার যার লাভ ক্ষতি হিসাব করবে সেটাই স্বাভাবিক। নিজ নিজ লাভ ক্ষতির সেই চুলচেরা হিসাবে সে কারণেই দেখা যায় আজ যারা পরম মিত্র কালই হয়তো তারা চরম শত্রুতে পরিণত হয়। ভারতের কাছ থেকে অন্যায্য সুবিধা নেবার বদলে এদেশের সরকারকে যদি ভারতকে বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষে গিয়ে কিছু দিতে হয় তার দায় ভারতের নয় বরং রাষ্ট্র বিরোধী, দেশ বিরোধী, জনস্বার্থ বিরোধী সেই সরকারের। বেশ কয়েকটি অতি আলোচিত কিন্তু অনিষ্পন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতের চোখে চোখ রেখে কেন কথা বলতে বা নিজের স্বার্থ বুঝে নিতে পারে না, সেটি বোঝা গেলতো এবার? ধন্যবাদ জনাব মোমেন; সবার জানা কিন্তু লুকিয়ে রাখা বিষয়টি খোলাসা করে স্পষ্টভাবে বলার জন্য, স্বীকার করার জন্য। সবার নিজেকে উন্মোচিত করার এই সৎ সাহস থাকে না।


কার্টসি - মানবজমিন/ আগস্ট ২২,২০২২ 

দুর্নীতি জ্বালানি সঙ্কট-এর উৎস

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

সেমিনার পেপার - “দুর্নীতি জ্বালানি সঙ্কট-এর উৎস”

 


তারিখঃ ২২ আগস্ট, ২০২২। স্থানঃ আব্দুস সালাম হল, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা।

প্রবন্ধ উপস্থাপন  ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিএনপি এবং সাবেক মন্ত্রী।


আসসালামু আলাইকুম। 

ভূমিকাঃ

বাংলাদেশের মানুষ গত এক দশক ধরে ভয়ংকর এক সময় অতিক্রম করছে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা থেকে শুরু করে, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এমনকি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখীন। সমগ্র বাংলাদেশ আজ এক ভয়ংকর শকুনের ছোবলে বাকরুদ্ধ। জনগণের মাঝে ভয়ানক এক ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার একে একে গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ০৫ আগস্ট মধ্যরাতে ডিজেল, অকটেন, পেট্রল ও কেরোসিনের দাম দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানোর নজিরবিহীন গণবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। ২০১৮ সনের মধ্যরাতের ভোট ডাকাত সরকার ৫ আগস্ট মধ্যরাতে সংশ্লিষ্ট সকলকে পাশ কাটিয়ে, এমনকি BERC এর অনুমোদন গ্রহণের আইনগত বাধ্যবাধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৮০ থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, অকটেনের দাম ৮৯ থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা ও পেট্রলের দাম লিটারপ্রতি ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করেছে। তেলের মূল্য ৪২.৫% থেকে ৫১.৬% বৃদ্ধি করা হয়েছে। এক লাফে এত বেশি মূল্যবৃদ্ধি নজিরবিহীন এবং অভূতপুর্ব। 


গত নভেম্বর ২০২১ সালেও সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল। ২০২১ সনের নভেম্বরে ২৩ শতাংশ, এখন আরও ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে কৃষিসেচ, গণপরিবহন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে সাড়ে ৬৫ শতাংশ। অথচ এই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে গড় বৃদ্ধি সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ, যা এখন দ্রুতই কমে আসছে। অতএব এ পর্যায়ে তেলের  মূল্য  মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি ভয়াবহ, অযৌক্তিক ও গণবিরোধী সিদ্ধান্ত।  


প্রভাবঃ 

দুই অঙ্কের অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রভাব, আর দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে জ্বালানি তেলের এহেন অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি  বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে গণশাস্তি দেয়ার শামিল। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গণপরিবহন, দৈনন্দিন দ্রব্যের মূল্য, শিল্প ও কৃষিসহ সব খাতেই ভয়াবহ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।  রাজধানীর কাঁচাবাজারে প্রায় সব ধরনের সবজি, চালসহ বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে এসব প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের কৃষি, গণপরিবহন ও প্রান্তিক অর্থনীতির প্রধান তিন স্তম্ভ হচ্ছে সার, ডিজেল ও কেরোসিন তেল ।  এই তিন খাতেই  মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে কর্মহীনতা, চাকরিচ্যুতি, অর্থকষ্ট ও ক্ষুধার বিভীষিকা শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে নতুন ধারার “জ্বালানি দারিদ্র্যের” আতংকগ্রস্ততা।


জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে গণপরিবহন খাতে যেমন, বাস, ট্রাক, কভার্ড ভ্যান, লঞ্চ- সব ক্ষেত্রেই ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। রেলওয়েও ভাড়া বৃদ্ধির ইংগিত দিয়েছে। তাছাড়া কৃষি উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সামগ্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য- চাল, ডাল, শাকসব্জি, মাছ, ডিম, তেল, ভোজ্যতেলসহ সব পণ্যে। নিম্নবিত্ত ও গরিব জনসাধারণ বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস উঠেছে। বাজারে মূল্যস্ফীতি দুই ডিজিটের ওপর চলে গেছে এবং তা দিনে দিনে আরো খারাপ হচ্ছে। 


যে সকল যুক্তি দেখিয়ে তেলের মূল্যবৃদ্ধি করেছে সরকারঃ 

বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ভারতসহ অনেক দেশই নিজ দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধি করেছে। 

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিপিসির লোকসান কাটিয়ে উঠা। 

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে জ্বালানি তেল চোরাচালান প্রতিরোধ করা।


বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ভারতসহ অনেক দেশই নিজ দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধি করেছেঃ  

বিশ্ববাজারের মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে এ মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে বলা হলেও গত ০৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বরং কমে প্রতি ব্যারেল ৯৪.১২ ডলারে নেমে এসেছে। আগস্ট মাসের ৩ তারিখ থেকেই বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম আগের তুলনায় কমতে থাকে। ৩ আগস্ট ছিল ৯৬.৮ ডলার, ৪ আগস্ট ছিল ৯৪.১ ডলার, ৫ আগস্ট ছিল ৯৪.৯ ডলার এবং ৮ আগস্ট তা নেমে আসে ৯৩.৯ ডলারে। বর্তমানে এ দাম ক্রমান্বয়ে কমছে। প্রজেকশন হচ্ছে বছরের শেষ নাগাদ ব্যারেল প্রতি দাম ৮০ ডলারের নিচে নেমে আসবে। 

বিপিসি’র লোকসান কাটিয়ে উঠাঃ 

সরকার বলছে, গত কয়েক মাসে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান করেছে। গত ৮ বছর ধরে সরকারের একমাত্র লাভজনক সংস্থা হিসেবে গ্রাহকদের কাছে বিশ্ববাজারের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। অতএব বিপিসির লোকসান দেখিয়ে মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। এক নজরে বিপিসি’র বছরওয়ারি লাভের হিসাবঃ 

২০১৫ সালে ৪ হাজার ১২৬ কোটি টাকা, 

২০১৬ সালে ৯ হাজার ৪০ কোটি টাকা টাকা , 

২০১৭ সালে ৮ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা টাকা ,

২০১৮ সালে ৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা

২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা, 

২০২০ সালে ৫ হাজার ৬৭ কোটি টাকা এবং ২০২১ সালে ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা।  


বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ ২০২২’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার তেল আমদানিতে কোনোরকম ভর্তুকি দেয়নি, বরং শুল্ক থেকে আয় ছাড়াও বিপুল পরিমাণ মুনাফা করেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২৩ মে, ২০২২ পর্যন্ত সরকারের এ মুনাফার পরিমাণ মোট ৪৮ হাজার ১২২ কোটি ১১ পয়সা।  


এমনকি চলতি বছরে তেল বিক্রি করে ১ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা লাভ করলেও ৮ হাজার ১৫ কোটি টাকা লোকসানের কথা বলছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনে (বিপিসি)। যা জনগণের সাথে প্রতারণার শামিল। 


আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় বিপিসি এই বিপুল পরিমান মুনাফা করেছে। এসময়কালে বিশ্ববাজারে মূল্য অস্থিতিশীল হলে সরকার দেশেও মূল্য বাড়িয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাসের সুবিধা থেকে সাধারণ ভোক্তাদের বঞ্চিত করেছে সরকার। 


২০১৮ অর্থবছর থেকে বিপিসি শুল্ক, কর ও লভ্যাংশ বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে প্রায় ৫৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। নিয়মিত পরিচালন খরচ এবং অন্যান্য কর দেওয়ার পরও বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট হিসাবে বিপিসির রয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। তিনটি তেল বিতরণকারী কোম্পানির ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাংক আমানত রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের তথ্য। আগামী অর্থবছরে বিপিসি সরকারকে ট্যারিফ, ট্যাক্স এবং মুনাফা (dividend) হিসেবে ৯,২৫১ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। উল্লেখযোগ্য যে ২০১৭ থেকে আর্থিক বছর ২০২২ পর্যন্ত বিপিসি সরকারকে ৬৫,৬৫৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। তন্মধ্যে ২০২০ ও ২০২১ সালে দুই কিস্তিতে বিপিসি সরকারকে তথাকথিত উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি টাকা করে মোট ১০ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ডিজেল এবং কেরোসিনে শুল্ক, ভ্যাট, এআইটি এবং অগ্রিম কর বাবত প্রায় ৩৪% বিপিসি সরকারকে পরিশোধ করে থাকে। জ্বালানি সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিপিসি’র আমানতে থাকা এই বিপুল পরিমান অর্থ দিয়ে সরকার চাইলেই দাম না বাড়িয়েও মুনাফার টাকায় আরও প্রায় ২১ মাস জ্বালানি সরবরাহ করতে পারত।


সরকার দাবী করছে যে, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় দেশেও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। কিন্তু ৪ আগস্ট থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য ৯৫ ডলারে নেমে এসেছে এবং প্রতিদিনই কমে আসছে। বর্তমানে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমতে শুরু করেছে তখন দেশের বাজারে সে অনুসারে কমিয়ে সমন্বয় করা হয়নি। বরঞ্চ অযৌক্তিকভাবে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। অতএব বিশ্ববাজারের মূল্যের সাথে দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে বলে সরকারের বক্তব্য সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং জনগণের সাথে এক ভয়াবহ প্রতারণা মাত্র।


মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে কথা বলতে গিয়ে সরকারের মন্ত্রী-সাংসদরা বিশ্বের অন্যান্য দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া কোথাও তেলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে বেশী নেই। সরকারের তরফে মূল্যবৃদ্ধির এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনামে ডিজেলের প্রতি লিটার দাম ৯৭.৯ টাকা। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে,  হংকংয়ের  জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশের চেয়ে বেশী। কিন্তু  হংকংয়ের  মাথাপিছু আয়  ৪৯ হাজার ৬৬০ ডলার। আর আমাদের মাথাপিছু আয় বিবিএস এর ভুল তথ্যের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েও মাত্র  ২ হাজার ৫০৩ মার্কিন ডলার। যা ইতোমধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান হারানোর ফলে আরও কমে গেছে। কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের  মাথাপিছু আয়ের সাথে মিলিয়ে দেখাটাও জরুরি। 


চোরাচালান প্রতিরোধকল্পে মূল্যবৃদ্ধিঃ

সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তেলের দামের ব্যবধান থাকায় দেশ থেকে জ্বালানি তেল পাচার হয়। তাই ভারতের সঙ্গে সমন্বয় করতে দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু গত নভেম্বর ২০২১ এর আগে পর্যন্ত প্রায় পাঁচ-ছয় বছর যাবৎ বাংলাদেশে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা ছিল। অন্যদিকে আমাদের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তখন ডিজেলের মূল্য আরো বেশি ছিল। কিন্তু পাচারের কোনো তথ্য শোনা যায়নি। এদিকে বিজিবি বলছে, দেশের কোনো সীমান্ত দিয়ে জ্বালানি তেল পাচার হয় না। ২০২১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মাত্র ৭১১ লিটার তেল পাচারের চেষ্টা করা হয়েছে এবং সবগুলো আটক করা হয়েছে। ৭১১ লিটার পাচার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে এদেশে জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে, এটাও অগ্রহণযোগ্য। আর সত্যি যদি পাচার হয় (আমার মনে হয় সেটা dismiss করা যায় না) তাহলে তা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিয়ে দেশে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে দায় জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া গ্রহণযোগ্য নয়।


অতিরিক্ত লাভ করছে বিপিসিঃ 

তেলের মূল আমদানি ব্যয় ও শোধনকৃত মূল্যের চেয়ে এবার জ্বালানির মূল্য অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের বাজারে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম সর্বোচ্চ ৯২ ডলার। অর্থাৎ লিটারপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম টাকার অংকে মাত্র ৫৬ থেকে ৫৭ টাকা। তেল শোধনে লিটারে খরচ পড়ে দেড় টাকা। শোধন, পরিবহন ও কিছু সিস্টেম-লস মিলে লিটারে খরচ সর্বোচ্চ ৬২ টাকা। কিন্তু সরকার লভ্যাংশ, সরকারের কর, শুল্ক, ভ্যাট এই চার স্তরের মুনাফার পরে লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিন ১১৪ টাকা, পেট্রোল ১৩০ এবং অকটেন ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ ১ ব্যারেল অপরিশোধিত তেলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা খরচ করে সেটা বিক্রি করা হচ্ছে ২৫ হাজার টাকার কাছাকাছি(সূত্রঃ প্রথম আলো, ১২ আগস্ট, ২০২২)।এর অর্থ হচ্ছে, বিপিসি প্রতি ০১ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল বিক্রি করে প্রায় ১৫ হাজার টাকা লাভ করে। সরকার এক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিতে কাজ করেছে, জনকল্যাণে নয়। 


BERC কে পাশ কাটিয়ে মূল্যবৃদ্ধি আইনের ব্যত্যয়ঃ 

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন অ্যাক্টের ২২ ধারা অনুযায়ী সব ধরনের জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব কমিশনের (বিইআরসি)। গত ৫ আগস্ট  জারিকৃত  প্রজ্ঞাপনে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এটি আইনের সুস্পষ্ট  লঙ্ঘন এবং বিইআরসি আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপরাধী কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সরকার যেভাবে মূল্যবৃদ্ধি করল, এটা লুণ্ঠনমূলক (প্রিডিয়েটরি) বৃদ্ধি। প্রতিযোগিতা আইনের আওতায় এই মূল্যবৃদ্ধিটাকে লুণ্ঠনমূলক বৃদ্ধি বলা হয়। BERC কে পাশ কাটিয়ে এভাবে মূল্যবৃদ্ধি একটি ফৌজদারি অপরাধ। মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে এ দায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রীর। প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার অনুমোদন ব্যতিত এধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ অসম্ভব। অতএব,আইনের এ ব্যত্যয়-এর দায় সুস্পষ্টভাবে প্রধানমন্ত্রীর উপর বর্তায়।  


জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণসমূহঃ

কিছু বিশ্লেষক মনে করে সম্প্রতি সরকার আইএমএফ’র কাছ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। ঋণ প্রদানের শর্ত হিসেবে আইএমএফ ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। তাই আইএমএফ প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসার আগেই ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি হ্রাসের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকার আইএমএফকে দেখাতে চায় শর্ত পালনে ঢাকা কতটা আন্তরিক। 


কিন্তু আবার অনেকে মনে করেন বৈশ্বিক সংকট, আই এমএফ’র শর্তপূরণ কিংবা বিপিসি’র লোকসান মেইক-আপ, কিংবা ভারতে পাচার রোধ- এসবই অজুহাত মাত্র। গণমাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে জ্বালানি তেল বা খাদ্য আমদানির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে চাপ পড়েনি। ২০২১-২২ অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানি ব্যয় কমেছে ১১ শতাংশ আর খাদ্যে কমেছে ৪ শতাংশ। কিন্তু এ সময় আমদানি ব্যয় বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ ৮৯ বিলিয়ন ডলার। ৫ আগস্ট পূর্ব পর্যন্ত আমদানি ব্যয় আরো অনেক গুন বেড়ে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট একাউন্টে চাপ পড়েছে। মূলত অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি বাণিজ্যের ভারসাম্যকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে। এদিকে যে পরিমাণ আমদানির কথা বলা হচ্ছে, দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানসহ সার্বিক অর্থনীতির সূচকে তার প্রতিফলন নেই। এ সকল ঋণপত্রের বিপরীতে আমদানিকৃত পণ্য বাস্তবেই দেশে এসেছে কিনা তাতেও সন্দেহ রয়েছে। তাছাড়া মেগা প্রজেক্টসহ নানা খাতে দুর্নীতি ও অপখরচ করা হয়েছে। এক বিদ্যুৎ খাতেই ৯০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে লুট করা হয়েছে। বেসরকারি অনেক ব্যাংক পথে বসে যাচ্ছে অর্থনৈতিক অনিয়মের কারণে। কয়েক লক্ষ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আসলে কোথায়?  দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার, আমদানির নামে অর্থ পাচার, বিনা উৎপাদনে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অর্থ লোপাট, খেলাপি ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও লুটপাটের দায় এখন জ্বালানি তেল, পরিবহন সেবা ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হ’ল সরকারের এই হরিলুট সাগরচুরির খেসারত জনগণকে দিতে হবে কেন?


আবার কিছু অর্থনীতিবিদদের মতে সরকার অর্থনীতিকে কন্ট্রাক্ট বা সংকোচন করার উদ্দেশ্যে তেলের দাম এক লাফে ৪২% থেক ৫১% করেছে যাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা স্থবির হয়ে আসবে এবং এর ফলে এগ্রেগেট ডিমান্ড হ্রাস পাবে। এগ্রেগেট ডিমান্ড কমলে চাহিদাও কমবে এবং আমদানি ও রিজার্ভের ওপর চাপও কমবে। পত্রিকা রিপোর্ট করবে অর্থনীতিতে সুবাতাস ফিরে এসেছে। এলসি ওপেনিং ৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অনেকে মনে করেন তেলের দাম এক লাফে ৫১% বৃদ্ধির এটাই কারণ। 


অনেকে মনে করেন- সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আমদানির জন্য ডলারে টান পড়েছে। সরকার সেই টান থেকে বাঁচতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর টেকনিক অবলম্বন করছে। তাছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অর্থ প্রয়োজন। জ্বালানি খাত থেকে রাজস্ব বাড়ানোও সরকারের একটি টার্গেট। এতে বিপিসি যে বাড়তি মুনাফা করবে সেখান থেকে সরকারেরও বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে। জ্বালানি থেকে সরকার ৩৫% কর পেয়ে থাকে। এখন পেট্রল ও অকটেনের দাম যে আরও বাড়ান হয়েছে তাতে বিপিসি’র ৪৫ টাকার বেশি মুনাফা থাকবে। 


জ্বালানি তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণে বহির্বিশ্বের উদাহরণঃ  

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে  স্থানীয় বাজারে বৃদ্ধি করা, আবার আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমলে স্থানীয় বাজারেও কমানো- এই পদ্ধতি অনুসরণ করে ভারত গত মার্চে জ্বালানি মূল্য  ১১বার  সমন্বয় করেছে। ভারত প্রতি লিটারে ৫ টাকা আবগারি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। তারপর আরও ৬ টাকা কমিয়ে দিয়েছে, যাতে জনগণের  ওপর চাপ কম পড়ে। উল্লেখ্য, ভারত এখন আর তেলে ভর্তুকি দিচ্ছে না, একই সাথে তারা জ্বালানি তেলে উচ্চ মুনাফাও করছে না। ভারত এই পদ্ধতি অনুসরণ করে  বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমুল্যের মাঝেও জ্বালানির মূল্য মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত  মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে  আমাদের সামগ্রিক জীবনকেই  চরম বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। সমগ্রদেশে লোডশেডিংয়ের তীব্র প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবন এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। শিল্প উৎপাদন খাত ও রপ্তানি খাতে সুনামির সতর্ক সংকেতে  জনজীবনে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। এখন ১১৪ টাকার প্রতিলিটার ডিজেল থেকে ৩৪ টাকা কর আদায় করছে সরকার। সরকার যদি এই মুহূর্তে থেকে সব রকমের কর প্রত্যাহার করে, তাহলে এই মুহূর্ত থেকে প্রতিলিটার ডিজেলের মূল্য ৩৪ টাকা কমবে। প্রতিবেশী  ভারত অনেকটাই এই পদ্ধতি অনুসরণ  করেছে। 


প্রতিবেশী ভারতে জ্বালানি তেলের দাম ডাইনামিক ডেইলি প্রাইসিং মেথডে (DDPM) প্রতিনিয়ত বাজারমূল্যের সাথে সমন্বয় করা হয়। আফগানিস্তানও এ পদ্ধতি অনুসরণ করে। 


বাংলাদেশে তেলের দাম নির্ধারণ হয় সরকারি নির্বাহী আদেশে ফিক্সড প্রাইস মেথডে (FPM)। এর ফলে বিশ্ববাজারে আচমকা দাম বেড়ে গেলে ভর্তুকি দিতে হয়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক কমে গেলেও দেশের বাজারে কমানো হয় না। ফলে তেলের মূল্য কম থাকার যে সুবিধা সেটি থেকে ভোক্তারা বঞ্চিত হয়।  বর্তমানে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে বা কমলে দেশের বাজারে খুব বেশি সমন্বয় করা হয় না। গত ২০ বছরে দেশে ১৭ বার ডিজেলের দাম সমন্বয় করা হয়। এর মধ্যে ১৩ বার বেড়েছে এবং কমেছে মাত্র ৪ বার। 


গ্যাসভিত্তিক জ্বালানির চিত্র ও দেশীয় সম্পদ আহরণে মধ্যসত্ত্বভোগী সরকারের অনীহাঃ  

বাংলাদেশের শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন পরিকল্পনার অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে প্রাকৃতিক গ্যাসকে কেন্দ্র করে। প্রতি বছরই দেশের আবাসিক, শিল্পোৎপাদন ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাড়ে ৭ বছরের আগেই মজুদ ফুরিয়ে আসবে। এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে নতুন গ্যাস ফিল্ড আবিস্কার এবং জ্বালানির বিকল্প উৎসের সংস্থান করা না গেলে সামনের দিনগুলোয় জ্বালানি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।


গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম কার্যত বন্ধঃ 

বঙ্গোপসাগরের গভীর-অগভীর অংশে ব্লকগুলোয় দুই দশক ধরে কোনো ধরনের অনুসন্ধান কার্যক্রম নেই বললেই চলে। দেশে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বঙ্গোপসাগরের অফশোর ও অনশোরে (গভীর ও অগভীর) অংশকে মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে গভীর সমুদ্রে ১৫টি ও অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক। দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। আন্তর্জাতিক আদালতে জয়ী হয়ে মিয়ানমার ও ভারত এরিমধ্যে বঙ্গোপসাগরে নিজ নিজ এলাকায় অনেক খনিজ পদার্থ আবিষ্কারে সমর্থ হলেও বর্তমান সরকার এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মূলত নিজস্ব ব্যবসায়ীদের স্বার্থে জ্বালানিতে আমদানিনির্ভরতার কারণে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অকার্যকর রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্সও দীর্ঘদিন অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যদিও দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনার বৃহদংশ ঘুরপাক খেয়েছে পুরনো গ্যাসক্ষেত্রের উত্তোলনকে কেন্দ্র করে। নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধান চালানো হয়নি। 


অতএব ভবিষ্যতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে বঙ্গোপসাগরসহ সারাদেশে বাপেক্স ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন এবং নতুন করে গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কারের কার্যক্রম/মহা অভিযান পরিচালনা করতে হবে। 


এক নজরে গ্যাস ভিত্তিক জ্বালানিব্যবস্থাপনার চিত্র (Annexure-1) এবং পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী কিছু তথ্য (Annexure-2) আকারে সংযোজিত। 


গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ)-এর অর্থ এলএনজি আমদানিতে হস্তান্তরঃ 

নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান, উন্নয়ন, উত্তোলন ও সংস্কার কার্যক্রমের জন্য ২০০৯ সালে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) গঠিত হয় । গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতি ঘনমিটারে ৪৬ পয়সা করে কেটে রেখে দেশের জ্বালানি সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যয়ই এ তহবিল গঠনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। অথচ, গত ০৮ মে ২০২২ এলএনজি আমদানির জন্য পেট্রোবাংলাকে এ তহবিলের ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দিয়েছে অর্থ বিভাগ। এর আগেও ২০২১ সালে পেট্রোবাংলা গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের তিন হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত আয় দেখিয়ে অর্থ বিভাগকে দিয়েছিল।  জনগণের অর্থে গঠিত “গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের টাকা” এলএনজি কেনার কাজে ব্যবহারের কোনো ন্যূনতম সুযোগ নেই। এটি কার্যত বেআইনি।  কারণ, এ অর্থ জনগণের।  যা কেবল দেশের খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়নকাজে ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। জিডিএফ তহবিলের টাকা দিয়ে এলএনজি আমদানি করার কোন প্রভিশন নেই। 


জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে অর্থনৈতিক সাপ্লাই  চেইনে বিপর্যয়: 

এককালীন জ্বালানি তেল (পেট্রল, ডিজেল, অকটেন, কেরোসিনের) মূল্য গড়ে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি “মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা” বললেও কম বলা হবে।  এমনিতেই  প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে সমগ্র দেশজুড়ে, নিত্যপণ্যের মূল্য আকাশছোঁয়া। বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছে দেশজুড়ে। এরই মাঝে বিশাল মাত্রায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে বিশাল বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ মন্ত্রী গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিরও ইঙ্গিত দিয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে পিষ্ট নিম্নবিত্তের জীবনে এ মূল্যবৃদ্ধি অভিশাপ হয়ে এসেছে। একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারবে সামনে এর প্রতিঘাত কী হবে। মানুষের জীবনযাত্রায় এর নেতিবাচক প্রভাব সহজেই অনুমেয়। মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে সে তুলনায় মানুষের আয় কিংবা বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে না।  কোনো কোনো পন্যের মূল্যস্ফীতি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। জ্বালানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরই মধ্যে ডমিনো ইফেক্ট হিসাবে যানবাহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম আরেক দফা। কৃষি, শিল্প সব ক্ষেত্রেই চতুর্মুখী সংকট সৃষ্টি করবে। এমনিতেই সারের দাম বেড়েছে, এর মধ্যে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি সেচ মৌসুমে কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করবে। লোডশেডিংয়ের সময় অজস্র ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহার প্রকৃতপক্ষে ডিজেলের চাহিদা বাড়িয়েছে। পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রথম আলোর ১৪ আগস্টের বিশেষ প্রতিবেদনের হেডলাইনের দিকে চোখ বোলালেই যে কেউ আঁতকে উঠবে। শিরোনামটি ছিল ‘বাংলাদেশে জ্বালানির দাম: আমি হয়তো রাস্তায় ভিক্ষা করতে শুরু করব’। এতে মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নামে একজন পরিবহন শ্রমিকের বয়ান তুলে ধরা হয়েছে। এতে তিনি বলেন,  ‘ভয় পাচ্ছেন যে, তাঁকে শিগগিরই ভিক্ষা করতে হয় কি না’।  নুরুল আরও বলেন, ‘আমি যদি আমার চাকরি হারাই, তাহলে আমাকে রাস্তায় ভিক্ষা করা শুরু করতে হতে পারে’। নুরুলের মতো কোটি কোটি নুরুল আজকে বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে এক অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে। যার জন্য গণবিচ্ছিন্ন এই সরকারের লুটেরা নীতিই দায়ী।   


সংকট সমাধানে করণীয়ঃ

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সমগ্র রাষ্ট্রীয়  অর্থনীতিতে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে এথেকে মুক্তি পেতে হলে অতিসত্ত্বর কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন: 

স্বল্প-মেয়াদী

জ্বালানি আমদানিতে বর্তমানে শুল্ক, কর বাবত যে ৩৪% ব্যয় করা হয় তা অনতিবিলম্বে মওকুফ করে আমদানি ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে আনা। 

জ্বালানি তেলের মূল্য ৫ আগস্টের পূর্বাবস্থায় পুনঃনির্ধারণ। 

বিশ্ববাজার থেকে কম দামে তেল ক্রয় করে জনগণের কাছে উচ্চমূল্যে তা বিক্রির মাধ্যমে এত দিন বিপিসি যে মুনাফা করেছে, তার সঙ্গে গত কয় মাসের বা সম্ভাব্য লোকসানকে সমন্বয় করা। 

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গ্যাস উত্তোলনের সময় by-product হিসেবে উৎপাদন হয় বলে দেশেই অকটেন ও পেট্রলের মজুদ রয়েছে এবং তা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আছে। সেক্ষেত্রে বৈশ্বিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি দিয়ে এগুলোর দাম বাড়ান কোনোভাবেই সমীচীন হয়নি।  তাছাড়া উপজাত হিসেবে উৎপাদিত বিধায় এই পণ্যের উৎপাদন খরচ প্রায় শূন্য, সেক্ষেত্রে এগুলোর দাম অবশ্যই কমানো সম্ভব। 

দিন আনে দিন খায়- এই শ্রেণির হতদরিদ্র নিম্ন আয় ও নির্ধারিত আয়ের গরিব মানুষের জন্য cash incentive দেয়া। 

ওএমএস’র আওতায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আইটেম ও পরিমাণ বৃদ্ধি। 

বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে রেশন-কার্ডের বিপরীতে খাদ্য সরবরাহ। 

এসব বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ। 

ছোটো ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা প্রদান। 

জ্বালানি ক্ষেত্রে  সরকার দুভাবে মুনাফা করছে। একদিকে বিপিসি যেন কোনোভাবেই লোকসান না করে, সে জন্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয়ের নামে জ্বালানির মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে, জ্বালানির ওপর কর আরোপ করে সরকার বর্ধিত রাজস্ব আদায় করছে। এই দ্বৈত নীতি পরিহার করা।  


মধ্য-মেয়াদী

মূল্য চাপিয়ে দেয়ার পরিবর্তে Stakeholder সাথে আলোচনাক্রমে নির্ধারণ পদ্ধতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। 

জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের  ক্ষেত্রে একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা।  সেই প্রক্রিয়ায় বৈশ্বিক  বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে  স্বচ্ছ  প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় মূল্য সমন্বয় করার দাম বৃদ্ধি, এবং বৈশ্বিক  বাজারে মূল কমার সাথে সাথে দ্রুততার সাথে মূল্য সমন্বয় করে দাম হ্রাস করা।  যেমনটা ভারত সহ  দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। 

আমদানি নির্ভরতা পরিহার করে প্রাইমারী এনার্জি পলিসি রিভিউকরন। 

নতুন গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা। 

নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন পলিসি গ্রহণ করা। 

বিপিসিকে সুশাসন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহির আওতায় এনে একটি দক্ষ সংস্থায় রূপান্তর। 

শেষ কথাঃ

সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকলে জনকল্যাণের প্রতি তাদের একটা দায়িত্ববোধ থাকতো। সরকার এক লাফে জ্বালানির মূল্য ৫১% বৃদ্ধি না করে বিকল্প পথে বিষয়টির সমাধান করতে চেষ্টা করতো। সরকারের ভেতরে অসাধু এক ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি কাজ করেছে যা আতংকের কারণ।


সরকারের নিশিরাতের সিদ্ধান্তে জ্বালানি তেলের আস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা এই সরকারের পক্ষে দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয় কেননা এদের জনগণের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা নেই। সরকার জনকল্যাণের চেয়ে তাদের নিজস্ব দলীয় ব্যবসায়ি ও সিন্ডিকেটের স্বার্থকে অতিমাত্রায় প্রাধান্য দেয়ায় সাধারণ জনগণের কাঁধে সমস্ত আর্থিক বোঝা চেপে বসেছে। এমতাবস্থায় অবিলম্বে প্রবল গণ আন্দোলন গড়ে তুলে এই অবৈধ লুটেরা সরকারকে বিতাড়িত করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যার অধীনে রাতে নয়, নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে, সকলের অংশগ্রহণে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে সত্যিকারের অর্থে একটি জনগণের সরকার। তাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণের অধিকার আদায়ে সর্বাত্মকভাবে গণ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোন বিকল্প নেই।


সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আল্লাহ্ হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। 


Annexure- 1 

এক নজরে গ্যাস ভিত্তিক জ্বালানিব্যবস্থাপনার চিত্রঃ 

দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। 

এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হতো। 

দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে আসে ২২০-২৩০ কোটি ঘনফুট।  

৭০ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট আমদানি করা হয় এলএনজি হিসেবে। 

কিন্তু বর্তমানে ২৭০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুটের বেশি সরকার দিতে পারছে না। এই গ্যাস আবার শিল্প খাত ও বিদ্যুৎ খাতে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়।

বিশ্ববাজারে এখন প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৪১ ডলারের কাছাকাছি। যা কোভিড-১৯ এর পূর্বে ছিল ৪ ডলার।

২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ, যা কিনা ২০২২ সালে কমে প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। 

এদিকে গত ১০ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৯০ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। 

দেশে নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনের হার কমে গেছে। আর এর ফলে দেশীয় জ্বালানি তথা গ্যাসের পরিবর্তে ব্যবহার বাড়ছে আমদানি করা অতি উচ্চমূল্যের এলএনজির ব্যবহার। 

প্রতি ইউনিট দেশীয় গ্যাসের মূল্য যেখানে ২ থেকে ৩ ডলার, সেখানে প্রতি ইউনিট আমদানি করা গ্যাসের (এলএনজি) জন্য ব্যয় হয় ১২ ডলার (দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি) থেকে ৩৫ ডলার (স্পট মার্কেট) পর্যন্ত। 

দেশে বর্তমানে মোট গ্যাস সরবরাহের কেবল ২৫ শতাংশ আমদানি করা এলএনজি দ্বারা মেটানো হয়। এর বেশী এলএনজি আমদানি করার জন্য দেশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশকে কেন নিয়ে যাওয়া হ’ল! জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিকভাবে একটি ওঠা বদ্বীপ অঞ্চল এবং বাংলাদেশ গ্যাসসম্পদে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত গ্যাস জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়নেও একই মত প্রকাশিত হয়েছে। 

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএস পেট্রোবাংলার সঙ্গে যৌথ জরিপে দেখায় যে বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের গড় পরিমাণ ৩২ টিসিএফ। 

একই সময় নরওয়ের জাতীয় তেল–গ্যাস কোম্পানি এনডিপি বাংলাদেশ সরকারি এজেন্সির সঙ্গে সম্পাদিত জরিপে দেখায় যে দেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের গড় পরিমাণ ৪২ টিসিএফ। 

২০১৮ সালে ডেনমার্কের গ্যাস পরামর্শক র্যামবোল তাদের জরিপে দেখায় যে এর পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ। 

সবাই যে বিষয়ে একমত তা হলো, বাংলাদেশে যথেষ্ট মাত্রায় গ্যাস অনুসন্ধান না হওয়ার কারণে গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গ্যাসসম্পদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা কম অনুসন্ধানকৃত দেশগুলোর একটি। যথেষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভূগর্ভে লুক্কায়িত গ্যাস উত্তোলন করলে বর্তমানে যে দেশে গ্যাস সংকট তা তৈরি হতো না ।


Annexure- 2 

পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী কিছু তথ্যঃ 

দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের বার্ষিক চাহিদা ১ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)।

দেশের ২৭টি গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ ৯ হাজার ৯০১ বিলিয়ন ঘনফুট বা ৯ দশমিক ৯ টিসিএফের কিছু বেশি। 

এর মধ্যে উৎপাদনে থাকা ২০ গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ রয়েছে ৮ দশমিক ৭৫ টিসিএফ গ্যাস। 

বাকি গ্যাসের মজুদ রয়েছে উৎপাদনে না থাকা সাত গ্যাসক্ষেত্রে, যার পরিমাণ এক টিসিএফের কিছু বেশি।

ভূতাত্ত্বিক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি গ্যাসকূপ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা যায়। 

বাংলাদেশের গ্যাসকূপগুলো অনেক পুরনো হবার ফলে অঞ্চলভেদে এসব কূপ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। 

সে হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে সাড়ে ৭ টিসিএফের বেশি গ্যাস উত্তোলন করা প্রায় অসম্ভব।

সে অনুযায়ী দেশে এখন উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ টিসিএফ। বার্ষিক চাহিদা বিবেচনায় এ মজুদ দিয়ে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করা যাবে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত বছর পর্যন্ত।

পাঁচ বছর আগেও দেশে গ্যাসের দৈনিক উত্তোলন ছিল ২৮০ কোটি ঘনফুট। 

পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, দেশীয় কূপগুলো থেকে বর্তমানে প্রতিদিন ২৩০ কোটি ঘনফুট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। 

এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে আরো ৭৮ কোটি ঘনফুট ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, 

দেশীয় কোম্পানিগুলোর আওতায় থাকা গ্যাসক্ষেত্রগুলোর বেশির ভাগই ষাট দশকের। উৎপাদনে থাকা এসব গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন কমে গেলেও সঠিক সময়ে কম্প্রেসার বসানো হয়নি। যে কারণে উৎপাদন ঠিক রাখা যায়নি। 

অন্যদিকে বিদেশী কোম্পানিগুলোর (আইওসি) আওতাধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় কম্প্রেসার বসিয়ে উত্তোলন ঠিক রাখা হয়েছে। 

বর্তমানে দেশে মোট উত্তোলনের ৬৯ শতাংশই এসেছে আইওসিগুলো থেকে। এসব কোম্পানির অধীন গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে চারটি। গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে প্রতিদিন ১৬১ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। 


প্রবন্ধটি রচনায় যেসকল তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়েছে: 

1. বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ ২০২২ (জুন ২০২২-এ প্রকাশিত)

2. সেন্টার পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) প্রতিবেদন।

3. Bangladesh Energy Sector | PDF | Asian Development Bank

4. A Review of Energy Sector of Bangladesh

5. Energy Sector in Bangladesh: An agenda for reforms

6. পলিসি রিসার্চ ইন্সটিউট অব বাংলাদেশ। 

7. যুগান্তর, ০৬ আগস্ট ২০২২।

8. দৈনিক সমকাল ০৬ আগস্ট ২০২২,

9. বণিক বার্তা, ০৬ আগস্ট ২০২২।

10. টিবিএস, ০৭ আগস্ট,২০২২।

11. বণিক বার্তা, ০৭ আগস্ট, ২০২২। 

12. দি ডেইলি স্টার, ০৮ আগস্ট ২০২২।

13. দৈনিক নয়া দিগন্ত, ০৮ আগস্ট ২০২২।

14. মানব জমিন, ০৮ আগস্ট ২০২২।

15. প্রথম আলো, ১২ আগস্ট ২০২২।

16. দি ডেইলি স্টার, ১২ আগস্ট ২০২২।

17. প্রথম আলো, ১৪ আগস্ট ২০২২।

18. বণিক বার্তা,  নভেম্বর ২৭, ২০২১

19. বিবিসি বাংলা, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ 

20. বণিক বার্তা, ০৫ মার্চ ২০২২। 

21. বণিক বার্তা ১৬ অক্টোবর ২০২২। 

22. প্রথম আলো, ১০ আগস্ট ২০২১

23. বণিক বার্তা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১। 

Sunday, August 14, 2022

জ্বালানির ‘জ্বালা’ জনভোগান্তির রেকর্ড

— শুভ কিবরিয়া

 

জ্বালানি তেলের অভাবনীয় মূল্যবৃদ্ধি করে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে ফেলেছে সরকার। বাংলাদেশে অতীতে একবারে এতবেশি পরিমাণে জ্বালানির মূল্য কখনই বাড়ে নাই। হালে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেও এই হারে জ্বালানির মূল্য বেড়েছে কিনা সন্দেহ আছে। দেউলিয়া হতে বসা শ্রীলঙ্কার মতো দেশেও জ্বালানির মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নাই। ৫ই আগস্ট ২০২২ শুক্রবার মধ্যরাতে সরকারের ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা (৪২.৫% দাম বৃদ্ধি), কেরোসিন ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা (৪২.৫% দাম বৃদ্ধি), পেট্রোল ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা (৫১.১% দাম বৃদ্ধি), অকটেন ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা (৫১.৭% দাম বৃদ্ধি) করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ছিল এতটাই আচানক যে এটা বুঝে উঠতেও মানুষের কিছুটা সময় লেগেছে। অবশ্য পরেরদিন রাস্তায় বেরিয়েই গণপরিবহনের তুঘলকি কাণ্ড দেখে মানুষ টের পেয়েছে দেশে কিছু একটা ঘটে গেছে! মাত্র একদিনের মধ্যেই খুব দ্রুত সরকার পরিবহন সংগঠনের সঙ্গে বসে জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে পরিবহন ভাড়ার সমন্বয়ও করে ফেলেছে।

এই কাজে অবশ্য সরকার সব সময়ই খুব পারঙ্গমতা দেখিয়েছে। সরকারের তৎপরতায় বিআরটিএ দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটার প্রতি ৪০ পয়সা (২২.২%) ভাড়া বাড়িয়েছে। নগর পরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে কিলোমিটার প্রতি ৩৫ পয়সা (১৬.২৭%)। এখন বাজারেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দ্রুতই সব গণ্য ও সেবার দাম হু হু করে অনিয়ন্ত্রিত বেগেই বেড়ে যাবে। 

সরকারের নীতি অনুযায়ী জ্বালানির ক্ষেত্রে যতো রকম ঘাটতি আছে, তার দায় ভোক্তার ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছে সরকার। সরকারের সকল উন্নয়নের যে চাপ, যে দায়, পরিকল্পনার যে খেসারত তার ব্যয় উচ্চমূল্যেই এখন আমজনতাকে বইতে হবে নিদারুণ কষ্টে, অসহ্য যন্ত্রণায়।

এর কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই ইউরিয়া সারের দাম সরকার বাড়িয়েছে কেজি প্রতি ৬ টাকা। এর কারণ হিসাবে প্রকাশ্যে সরকার যা বলেছে তা হলো, কৃষকরা না বুঝে কৃষিজমিতে প্রয়োজনের চাইতে বেশি বেশি ইউরিয়া সার ব্যবহার করে। ইউরিয়া সারের এই অতি ব্যবহার জমি, প্রকৃতি, পরিবেশ কারও জন্যই ভালো নয়। সে কারণেই সরকার চায় কৃষক জমিতে পরিমাণ মতো ইউরিয়া ব্যবহার করুক। তাহলে সেটার উপায় কি? সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মনে হয়েছে, দাম বাড়ালেই কৃষক কম কম ইউরিয়া কিনবে। কম কম ব্যবহার করবে। সরকারের এই উদ্দেশ্য ফলপ্রসু হবে কিনা কে জানে? তবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

 প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, গত ৫০ বছর ধরে কৃষি বিভাগ কি কাজ করলো যে কৃষককে এখনো বোঝাতেই পারলো না, ইউরিয়া কতটুকু ব্যবহার করা দরকার। এই ব্যর্থতার দায় কার? কৃষকের না কৃষি বিভাগের? যদি কৃষি বিভাগের হয়, তাহলে সেই দায়ভারের শাস্তি কি? দ্বিতীয়ত, দেশে যখন জ্বালানির সংকট তৈরি হলো, গ্যাস রেশনিং শুরু হলো, তখন প্রথমেই সরকারি মালিকানাধীন ইউরিয়া সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে পুরো ফ্যাক্টরিকেই বসিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারের নিজস্ব ইউরিয়া সার উৎপাদন পুরো বন্ধ করে তার পর পরই বাড়ানো হলো ইউরিয়ার দাম। এর মধ্যে মতলবটাই বা কী! অনেকে বলছেন, আইএমএফ’র লোন পাবার তাড়নায় সার খাতে সরকারি ভর্তুকি কমাবার তাগিদে সরকার এই কাজটা করেছে। কৃষকের ঘাড়ে এবার ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ স্বরূপ হাজির হয়েছে মধ্যরাতে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি। শুধু তাই নয় এবার অচিরেই বাড়তে চলেছে বিদ্যুতের দামও।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার জ্বালানির মূল্য এভাবে বাড়ালো কেন? প্রথমত, সরকার নিশ্চিত যে, সরকার যাই করুক না কেন তার কোনো বড় জনপ্রতিক্রিয়ার মুখে পড়বে না। দু-চারদিন ছোটখাট দু’একটা মিছিল, কিছু বিবৃতি, কিছু টকশো’র আলোচনা ছাড়া এর বড় কোনো রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া  নেই। জনগণের বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষদের কষ্ট বাড়বে, তবে তার সামষ্টিক এমন কোনো চাপ তৈরি হবে না যে সেটা সরকারকে ঘাবড়ে দিতে পারে। আর যদি কোনো ধরনের চাপ তৈরি হয়ও, তা শক্ত হাতে মোকাবিলা করার মত প্রাতিষ্ঠানিক-আর্থিক-প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ক্ষমতা সরকারের আছে। ফলে, এক ধরনের ডোন্ট কেয়ার অবস্থা সরকারকে এ রকম জনবিরুপ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে সরকারের অর্থিক খাতে বিশেষ করে ডলারের টানাটানি বেড়েছে। ফলে আইএমএফ’র সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছুতে হলে তাকে বিভিন্ন খাতে দেয়া ভর্তুকি তুলে নেবার শর্ত পূরণ করেই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আইএমএফ কোনো কারণে বিরাগ হলে সেই চাপ সরকারের মোকাবিলা করার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ আছে। 

ফলে, আইএমএফকে তুষ্ট করার বড় বিপদ এড়ানোর অভিপ্রায়ে জনঅসন্তুষ্টির ছোট ঝামেলা, যা মোকাবিলাযোগ্য, সেটাকেই সরকার অগ্রাধিকার দিয়েছে। অন্যদিকে সরকারের রাজনীতি ও উন্নয়ন ম্যানেজ করতে আমলাতান্ত্রিক যে কাঠামোর ওপর নির্ভর করতে হয়েছে এবং হচ্ছে, তার বাইরে যাবার রাজনৈতিক পথ সরকারের সামনে খোলা নাই। ফলে, শক্তিমান আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় যে অস্বচ্ছতা, অদক্ষতা, দুর্নীতি চলমান আছে, বহু জায়গায় যে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় অব্যাহত আছে, তাকে মেনে নিয়েই সরকারকে এগুতে হচ্ছে। সে জায়গায় সংস্কার করার কোনো সুযোগও সরকারের হাতে নাই। ফলে তুলনামূলক দুর্বল এবং প্রতিরোধ করার ক্ষমতাহীন অংশ ‘আমজনতা’ কিংবা ‘সাধারণ জনগণ’কে চাপ দিয়ে সরকার পরিস্থিতি সামলাতে চাইছে।

এখন দেখা দরকার এই পরিস্থিতির সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কী প্রভাব পড়তে পারে। মানুষের কষ্ট বাড়বে ভীষণভাবে। গ্যাস, বিদ্যুত, পানির বর্ধিত দামে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর যে চাপ পড়বে, তাতে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য ও সেবার দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আমাদের পুরো রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামো যেহেতু জনবান্ধব না, ফলে সকল পণ্য ও সেবা বেশি দাম দিয়ে কিনেও মানুষ আশানরুপ সার্ভিস পাবে না।

 জ্বালানির এই ভয়াবহ দাম মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। সেটা জনজীবনকে আরও ভোগাবে। লুটপাটের বাইরে যারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ব্যবসা করে আমাদের অর্থনীতি সচল রাখে তারাও ভীষণ চাপে পড়বে। তাদের সকল পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ করে রপ্তানিকারকরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে। এমনও হতে পারে উৎপাদনের চাইতে আমদানি লাভজনক বলে বিবেচিত হবে। ফলে, স্থানীয় ব্যবসা, উৎপাদন, বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়তে পারে। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সুবিধাও মানুষকে শেষাবধি চড়া দামে ক্রয় করতে হবে। ফলে সামাজিক বৈষম্য প্রকট হবে। সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। জননিরাপত্তা কমতে থাকবে। জনঅসন্তুষ্টির প্রভাব পড়বে সামাজিক পুঁজির ওপরে। সেটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও আরও প্রতিহিংসাপ্রবণ ও সহিংস করে তুলতে পারে।

জ্বালানির এই বর্ধিত চাপ মেটাতে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার। কেন না জনগণের এই অংশকে একটা ন্যূনতম আর্থিক সন্তুষ্টির মধ্যে রাখাকে কৌশলগতভাবে সরকারের জন্য লাভজনক বলেই ইতিপূর্বে বিবেচিত হয়েছে। সেই বিবেচনা থেকে পেছন ফেরার মতো কোনো কারণ  যেহেতু ঘটে নাই, ফলে সরকার এ রকম সিদ্ধান্ত নিলে অবাক হবার মতো কিছু থাকবে না। 

কৃষিতে একটা বড় বিপদ ঘটবে। সারের দাম, ডিজেলের দাম, বিদ্যুতের দাম প্রান্তিক ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদনকে হুমকির মধ্যে ফেলতে পারে। ছোট কৃষক বিনিয়োগের অভাবে কৃষি পেশা থেকে অব্যাহতি নিতে পারে। এ জায়গায় করপোরেট কৃষি ক্ষুদ্র-প্রান্তিক কৃষকের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হবে। বড় বিনিয়োগে, বড় বিপণন ব্যবস্থায় করপোরেট কৃষি কৃষি বাজারকে নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারে। ভোজ্য তেলের সরবরাহ ও নিয়ন্ত্রণ যেমন কতিপয় বড় ব্যবসায়ীর  হাতে থাকে, জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি তেমনি পুরো কৃষিকে কতিপয় করপোরেটের তালুবন্দি করার ব্যবস্থা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখবে।

আমজনতা তার সকল রকম ব্যয় কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করবে। তার সকল রকমের ইনটেক কমবে। সে খাবে কম, পরবে কম, ঘুরবে কম। ফলে তার জীবনমান, পুষ্টিমান, বিনোদনমান, জীবনের স্বপ্নমান সব কমতে থাকবে। বাসাভাড়া ব্যয়, চিকিৎসা ব্যয়, গ্যাস-বিদ্যুত-পানি খাতে ব্যয়, পরিবহন ব্যয়, সন্তানদের শিক্ষা ব্যয় মিটিয়ে তার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের যে ফারাক ঘটবে তা জীবন নিয়ে তাকে এক দুঃখী মানুষে পরিণত করবে। তার ধর্মপ্রীতি বাড়বে, রাষ্ট্রপ্রীতি কমবে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা-মমতাও সে হারিয়ে ফেলবে। এক বিষণ্নতর জীবন তাকে হতাশার দিকে ঠেলে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা বড় বড় প্রকল্প, অবকাঠামো তৈরি করে সরকার বা রাষ্ট্র তাকে যে সুখী করতে চেয়েছিল সেগুলোকেই সে তার দুর্ভোগের কারণ বলে বিবেচনা করতে থাকবে। সরকারের রাজনৈতিক দলকে সে অবিশ্বাস করতে শুরু করবে। এটাই আমাদের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় দুঃখদিন আনার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। কেন না, জনগণ যদি রাজনৈতিক দলকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে, নিজের জীবনের দুঃখ-কষ্টের জন্য রাজনৈতিক দলের কাজকেই দোষারোপ করতে থাকে, তবে সে রাষ্ট্র বা জাতির জন্য এর চাইতে দুর্ভাগ্যের আর কিছু নেই। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক 

বিশ্লেষক, kibria34@gmail.com

সূত্র — মানবজমিন/ আগস্ট ৮, ২০২২