একাদশ জাতীয় সংসদের চলতি ২১তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমপক্ষে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বার উচ্চারণ করেছেন ‘অনির্বাচিত সরকার’ শব্দ দুইটি। তিনি বলেছেন,অনির্বাচিত সরকারের স্বপ্ন যাঁরা দেখছেন, তাঁদের সেই ‘দুঃস্বপ্ন’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেছেন, ‘অনির্বাচিত সরকার আর জীবনে হবে না।' আরকেটি কথা তিনি বলেছেন। তাঁর আমলেই নাকি জনগণ ভোট দিতে পারে। এই দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথম ধরা যাক অনির্বাচিত সরকার কী এবং সেই সরকার আনার ক্ষেত্রে কার অবদান কতটুকু।
এক। তিনি দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে ফিরে আসেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসাবে। এর ১৩ দিনের মাথায় চট্টগ্রামে চক্রান্তকারীদের হাতে শহিদ হন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এর এক বছর পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনা প্রধান লেঃজেঃ এরশাদ এক সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে গঠন করেন অনির্বাচিত সরকার। আওয়ামী লীগের মুখপত্র বাংলার বাণী এরশাদের সমরিক অভ্যূত্থানকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এই প্রসঙ্গে লেঃজেঃ এরশাদ লিখেছেন, 'আমি যে কোনো সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে দেশের শাসনভার গ্রহণ করিনি, এটা তিনি (শেখ হাসিনা) ও তার দল (আওয়ামী লীগ) পরিষ্কার করেই জানতেন। তা না হলে ১৯৮২ সালে সামরিক আইন জারির পর তার দলের মুখপত্র বাংলার বাণীতে সামরিক শাসনকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদকীয় লেখা হতো না।' — আমার কর্ম আমার জীবন, পৃষ্ঠা ৩৭৫।
দুই। তবে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মধ্যেই প্রথম রক্তক্ষয়ী আন্দেলন হয় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে সেদিনের শিক্ষাভবন ঘেরাও আন্দোলনে জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, কাঞ্চন, দিপালী সাহাসহ বহু শিক্ষার্থী শহিদ হয়। শুরু হয় স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল এবং বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোটের যুগপৎ আন্দোলন। সিদ্ধান্ত হয় এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না কোনো জোট। নির্বাচনে গেলে তারা জাতীয় বেঈমান হিসাবে চিহ্নিত হবে। কিন্তু ৮৬ সালে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যেতে আওয়ামী লীগ একতরফা সিদ্ধান্ত নেয়। ভেঙে যায় ১৫ দলীয় জোট,গঠিত হয় ৮ দল ও ৫ দলীয় বাম জোট। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে ৮দল, বিএনপির নেতৃত্বে ৭দল এবং বাম দলগুলোর নেতৃত্বে ৫দলীয় জোট নতুন মাত্রায় আন্দোলন করে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ঘটায়। এরপর তিনজোটের রূপরেখা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয় দ্বিতীয় অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। স্মরণকালের সর্বাধিক ভোটারের অংশগ্রহণে সেই নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু আওয়ামীলীগের সভানেত্রী হিসেবে তিনি বহুল প্রশংসিত সেই নির্বাচনে সুক্ষ্ম কারচুপি আবিষ্কার করলেন।
দৈনিক খবর, ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৯৬ |
তিন। তিনি ঘোষণা দিলেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সরকারকে একদিনও শান্তিতে থাকতে দেবেন না। শুরু হয় তাঁর আন্দোলন। মাগুরা উপনির্বাচন সেই আন্দোলনে ঘি ঢেলে দেয়। সামনে হাজির হয় জামায়াত আমীর গোলাম আযমের কেয়ারটেকার সরকার ফর্মুলা। সেটাকে লুফে নিয়ে তিনি বেগবান করলেন অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আন্দোলন। ১৭৩ দিন হরতাল অবরোধ দিয়ে অবশেষে ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ রাতে বিএনপি সরকারের সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হন। গঠিত হলো বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
চার। .বহুল আলোচিত ঘৃণিত মঈন উদ্দীন-ফখরুদ্দিন গং-এর এক -এগারোর অনির্বাচিত সরকার গঠনের শতভাগ দাবিদার তিনি নিজেই। সেটা তিনি সেসময় তাদের প্রেসক্রিপশনে বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন এক-এগারোর সরকার তাঁর আন্দোলনের ফসল। তাদের সকল কর্মকাণ্ড তিনি ক্ষমতায় গেলে অনুমোদন দেবেন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় গিয়ে তিনি কথা রেখেছেন।
অর্থাৎ দেখা যায় যতগুলো অনির্বাচিত সরকার গঠিত হয়েছে সবগুলোর পেছনে তাঁর রক্তক্ষয়ী অবদান আছে। এখন তিনি বিনা ভোটে এবং মধ্যরাতের ভোটে নির্বাচিত হয়ে মহান সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন আর কোনোদিন অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে না। তিনি কোনো জ্যোতিষী নন যে ভাগ্য গণনা করে কিছু বলতে পারেন। অনির্বাচিত সরকার কখনও বলে কয়ে আসে না পরিস্থিতিই অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসায়। শুধু সময় ও সুযোগের অপেক্ষা মাত্র।
সংসদের ২১তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে আরেকটি কথা বলেছেন, তাঁর আমলেই জনগণ কেবল ভোট দিতে পারে। তাঁর আমলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিনা ভোটে ১৫৪ জন এমপি হয়েছেন। আর বাকি আসনে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর ২০১৮ সালের নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে নিশি রাতের ভোট হিসাবে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে,চট্টগ্রামে এক কেন্দ্রে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছে। স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা বলেছেন,দিনের ভোট যাতে রাতে না হয় সেজন্য ভোট কেন্দ্রে ইভিএম চালু করা হবে।
আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিকরাও বলেছেন, ২০১৮ সালে দিনের ভোট আগের রাতেই সম্পন্ন করা হয়েছে। সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে দেখে তারা বিষয়টি চেপে যান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভরার অভিযোগের বিষয়টি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘রাতে কিন্তু কাজটা (ভোট দেওয়া) হয়। হয় মানে কী, আমরাই করাইছি। কী বলব এটা হয়। এটা হয় না, ঠিক না।’ — ডেইলি স্টার, জুলাই ৩১, ২০২২।
আর জাপানের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি তো হাটে হাড়ি ভেঙে দিয়েছেন। তিনি বিদায় বেলা বলে গেছেন, ‘দিনের ভোট রাতে হয় এমন কথা তিনি আগে কখনও শোনেননি’। ২০১৮ সালের নির্বাচন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে নাওকি বলেন, ‘আমি শুনেছি, (গত নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি। — প্রথম আলো।
এমন সব জলজ্যান্ত সত্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি বলছেন কেবল আওয়ামীলীগ সরকার আমলে মানুষ ভোট দিতে পারে।