Search

Monday, February 26, 2024

ভারত আর ক্ষমতাসীনদের মদদে পিলখানা হত্যাকাণ্ড

বিজিবির সাবেক ডিজি লে. জে.(অব.) মইনুল ইসলাম



পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছর। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এ দিনে নির্মম হত্যাযজ্ঞে প্রাণ হারান অনেক সেনা কর্মকর্তা ও তাদের স্বজনরা। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের পর ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সাল থেকে ৯ মে ২০১০ সাল পর্যন্ত বালাদেশ রাইফেলস্-বিডিআরর মহাপরিচালক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন লেফটেন্যন্ট জেনারেল (অব.) মো. মইনুল ইসলাম। পিলখানার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে তদন্তও করেছেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।


তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের ২০ থেকে ২১ দিন আগেই বিশৃঙ্খলার পরিকল্পনা হয়েছিল। ঘটনার কয়েক দিন আগে থেকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকজন বিডিআর সদস্যদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বেশ সরব হয়ে ওঠেন। তাদের সাথে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত বিডিআরের বেশ কিছু সদস্যও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল বলে তদন্তে উঠে আসে-এমনটাই জানান।


বিডিআর বিদ্রোহ ও পিলখানায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এর ৪৮ ঘণ্টার মাথায় বিধ্বস্ত বাহিনীটির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মইনুল ইসলাম।


তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাইফেলসের নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি করা হয়। জুলাই ২০১৫ সালে তিনি সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার হন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম এ ঘটনার তদন্ত এবং নানা দিক নিয়ে বাংলা আউটলুকের সঙ্গে কথা বলেন লেফটেন্যন্ট জেনারেল (অব.) মো. মইনুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলা আউটলুকের ঢাকা প্রতিনিধি।


বাংলা আউটলুক: বিদ্রোহের ৪৮ ঘন্টার মাথায় ২৮ ফেব্রুয়ারি আপনাকে তৎকালীন বিডিআর’র দ্বায়িত্ব দেয়া হলো; পিলখানায় গিয়ে কী দেখলেন?


লেফটেন্যন্ট জেনারেল (অব.) মো. মইনুল ইসলাম: চারদিকে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও গ্রেনেড ছড়ান-ছিটান। সেখানে যে ধরনের হত্যাযজ্ঞ হয়েছে, তার তেমন কোনো আলামত ছিল না। কোনো রক্তের চিহ্ন নেই। খুব যত্নে ধুয়ে-মুছে পরিপাটি করে রাখা হয়েছে। ওই দিনই সন্ধ্যায় পিলখানা থেকে যারা বাইরে চলে গিয়েছিল, তাদের ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয় টেলিভিশনে। আমি তখন মহাপরিচালক, আমিই জানি না। সবখানে অস্ত্রশস্ত্র, গ্রেনেড ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমি জানালাম, এখনই ঢোকানো যাবে না।


বাংলা আউটলুক:  আপনি পরবর্তীতে যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, সেই কমিটিতে ছিলেন; পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে কী মনে হয়েছিল? এটি কী হঠাৎই ঘটেছিল?


মইনুল ইসলাম: হ্যাঁ। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল তখন সচিব ছিলেন। তিনিও ওই কমিটিতে ছিলেন। আমি সিভিলদের নিয়ে তদন্ত করার অনুরোধ করেছিলাম। সরকারকে চিঠিও দিয়েছিলাম। ঘটনার আগে-পরে চাইনিজদের বিষয়গুলোও আমলে নিতে বলেছিলাম। সেই সময়ের কন্ট্যাক্টগুলোর ব্যপারেও খোঁজ নিতে বলা হয়েছিল। ইন্ডিয়ার বিষয়েও খোঁজ নেয়া জরুরি ছিল।


বাংলা আউটলুক: চাইনিজরা ওই দিন কী করছিল?


মইনুল ইসলাম: তখন বিডিআর’র সাধারণ আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয়ের কার্যক্রম চলমান ছিল। এগুলো ছিলো স্নাইপার রাইফেল। সেগুলো চীন ডেলিভারি দেওয়ার পর সে সম্পর্কে বিডিআর সদস্যদের ধারণা দিতে একটি টিম পিলখানায় অবস্থান করছিল। ঘটনার দিন গোলাগুলি কিছুটা বন্ধ হলে তারা নিরাপদেই বের হয়ে গিয়েছিল। তদন্তে তাদের বিষয়েও খোঁজ নেয়া প্রয়োজন ছিল।


বাংলা আউটলুক:  ইন্ডিয়ানদের প্রসঙ্গ আসলো কেন?

 

মইনুল ইসলাম: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ইন্ডিয়ান বিএসএফ পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বর্ডারের খুব কাছে অবস্থান নিয়েছিল। যুদ্ধের পর ইন্ডিয়ান বিএসএফ কয়েকটি ঘাঁটি ছেড়েছিল। আবার কোথাও কোথাও ছাড়েনি। বিডিআরের তুলনায় ইন্ডিয়ান বিএসএফ দুর্বল ছিল। কারণ বিএসএফের কমান্ডিংয়ে আর্মি ছিল না। কিন্তু বিডিআরের কমান্ডে ছিল আর্মি। ইন্ডিয়ান বিএসএফ তাদের ক্যাম্পের সীমা পেরিয়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বিওপিতে অবস্থান করছিল সেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। ১৯৭৫ সালের পর ১৯৮১ সালের আগে ইন্ডিয়ান বিএসএফকে বাংলাদেশের বিওপি ছাড়তে বাধ্য করার জন্য বেশ কয়েকটি অপারেশন শুরু হয়েছিল। অপারেশনে ইন্ডিয়ান বিএসএফ পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। ইন্ডিয়া এটার কাউন্টার কখনো করেনি বা করতে পারেনি। সেই সক্ষমতা বিএসএফের ছিলও না। সেই সুযোগও বিএসএফ পায়নি। ইন্ডিয়া সবসময়ই চেয়েছিল, কীভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা যায়। পিলখানা হত্যাকাণ্ড ছিল মোক্ষম সময়। সেনাবাহিনীর সবগুলো মোধাবী কর্মকর্তাকে দু’দিনের মধ্যে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। এটা সবাই সেভাবেই দেখে। এই বিষয়টিও তখন আমলে নেয়া জরুরী ছিলো, বিভিন্ন পক্ষ থেকে কথাও এসেছিল। এর ওপর পিলখানার পরিস্থিতি বিশেষ করে অস্ত্রাগারের পরিবেশ দেখে পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছিল এটি পরিকল্পিত ভাবেই ঘটানো হয়েছিল এবং সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘটনার পেছনের লোকজন ২০-২১ দিন আগেই এখানে ঢুকেছিল।


বাংলা আউটলুক: ইন্ডিয়ার সম্পৃক্ততা কি আপনাদের অনুমান ছিলো? না কোনো আলামত পেয়েছিলেন?


মইনুল ইসলাম: আমাদের কাছে মনে হয়েছে। সিম্পটমগুলো (লক্ষণ) ফুটে উঠেছিল, বিভিন্ন সময় ইন্ডিয়ান পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিল। তারা বিরোধিতা করেছিল কেন বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড আর্মি দ্বারা পরিচালিত হয়। ইন্ডিয়া সবসময়ই বিডিআরের কমান্ডিংয়ে আর্মি এবং ১৯৮১ সালের আগের বেশ কয়েকটি অপারেশন এবং পরবর্তিতেও বেশ কয়েকটি অপারেশন নিয়ে প্রতিশোধপরায়ন ছিল। তারা চেষ্টাও করেছিল। এখানেই পরিষ্কার, এখানে ইন্ডিয়ার ইন্ধন ছিল। আমরা যখন বিডিআর (বিজিবি) রিফর্ম করি তখনও ইন্ডিয়ানদের অনেক বাধার মুখে পড়েছি। আর্মি কেন বিডিআরকে কমান্ড করে এটাও ইন্ডিয়া সহ্য করতে পারত না। সঠিক তদন্ত করলে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসত। আরো অনেকের সম্পৃক্ততা ছিল। তা-ও বেরিয়ে আসত। 


বাংলা আউটলুক:  আর কাদের সম্পৃক্ততা ছিল বলে মনে হয়েছে?


মইনুল ইসলাম: স্থানীয় রাজনৈতিক একটি পক্ষের সম্পৃক্ততা ছিল। বিদ্রোহের আগে বেশ কয়েকবার স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সদর দপ্তরে বিভিন্ন ক্যম্পে দ্বায়িত্ব পালনকালে অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বিডিআরের অভিযুক্ত জওয়ানদের পক্ষে দাবি নিয়ে যেতে দেখা গেছে। বিদ্রোহের দিন বিডিআরের কিছু লোক রিভেঞ্জ (প্রতিশোধপরায়ন) ছিল। তাদের সাথে আশপাশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন ছিল। কেন বিডিআর আর্মি অফিসার দ্বারা পরিচালিত হবে- এসব নিয়ে কথাও বলেছেন তারা। ঘটনার দিন পিলখানায় গোলাগুলি চলছে, আশপাশের সাধারণ মানুষ জীবন নিয়ে নিরাপদে সরে যাচ্ছিলেন। আর পাশেই বিদ্রোহীদের পক্ষে আজিমপুরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ রাস্তায় মিছিলও করেছে। নিশ্চয়ই তাদেরও সমর্থন ছিল এই ঘটনায়। আর তারাও নিশ্চিত ছিল তাদের ওপর কেউ গুলি করবে না। সেগুলোও তদন্ত করা হয়নি। সবকটি পক্ষ মিলেই আর্মিকে শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল। 


বাংলা আউটলুক:  আর কী কী দুর্বলতা বা অসামঞ্জস্যতা দেখেছিলেন সেই দিন?

 

মইনুল ইসলাম: প্রতি বছরই একই প্রোগ্রাম হয়, একই আয়োজন থাকে। গতানুগতিকই কিছু কমিটি থাকে। কমিটিগুলোতে বিডিআরের অফিসারদেরই (ডিএডি) ইনচার্জ করা হতো। কিন্তু ওই বছরই (২০০৯ সালে) সকল কমিটির হেড করা হয়েছিল আর্মি থেকে আসা অফিসারদের। কেন আর্মি অফিসারদের প্রধান করা হলো? আর আর্মি অফিসরাদের সাথে আগ্নেয়াস্ত্র দেয়া হলো না। আগ্নেয়াস্ত্রের কমান্ডিং ক্ষমতা রাখা হলো বিডিআর অফিসারদের (ডিএডি) নিয়ন্ত্রণে। তার মানে আর্মি অফিসারদের হাতে কোনো অস্ত্র দেয়া হলো না। অস্ত্র থাকল বিডিআরদের হাতেই। এ বিষয়টিরই তো হিসেব মেলেনি। এর কারণটা কী? আগে-পরে করা হলো না; কিন্তু ওই বছর কেন করা হলো? এটা তো দরকার ছিল না। করা হলো, কিন্তু আগে যখন বিডিআর’র ডিএডিরা এই দ্বায়িত্বে ছিল, তখন আগ্নেয়াস্ত্র বহন করার অনুমোদন ছিল, কিন্তু যখন আর্মি অফিসারদের ওইসব কমিটির প্রধান করা হলো, অস্ত্র দেয়া হলো, কিন্তু বিডিআর’র নিয়ন্ত্রণে রাখা হলো কমান্ডিং পাওয়ার। 


বাংলা আউটলুক:  অস্ত্রাগার, গোলাবারুদের দ্বায়িত্বে কারা ছিল?


মইনুল ইসলাম: অর্মির অফিসারদের দায়িত্বে ছিল। গার্ড কমান্ডাররা তাদের গ্রেফতার করেছিল। গোলাবারুদ এবং অস্ত্রাগার সবই লুট হয়েছিল। সব তো নিয়ে বের হয়ে যায়নি। যার যখন যা লেগেছে, তারা নিয়ে বেরিয়ে গেছে। যখন হিসেব শুরু হলো, কতগুলো ছিল, কতগুলো আমরা পেলাম, তা না হলে তো স্টক (মজুত) মিলবে না। গোলাবারুদ এবং অস্ত্র সব গণনা করা হলো। সমস্ত গোলাবারুদের বক্স থাকে সিল করা। যেগুলো সিলড সেগুলো চেক করিনি। বক্সের ওপর ওজন লেখা থাকে, মেপেছি। স্যম্পল চেক করেছি, ঠিক ছিল। যেগুলো ঠিক ছিল না, সেগুলো চেক করে দেখেছি। গ্রেনেডের ভেতরে ফিউজ দেওয়া। মানে রেডি টু ইউজ (ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা)। এটা কী করে সম্ভব! গ্রেনেড এবং ফিউজ আলাদা বক্সে থাকে। এটি ছিলো অস্বাভাবিক ঘটনা। এরকম অনেকগুলো বক্স ছিল। এটি আগে থেকেই রেডি করা ছিল। তার মানে আগে থেকেই ভেতর থেকে কেউ এ কাজ করেছে। পূর্বপরিকল্পিত ভাবে করা হয়েছে। এ বিষয়টিও তদন্ত করা হয়নি। আমাদের খতিয়ে দেখতেও দেয়া হয়নি।


বাংলা আউটলুক:  আপনি কী বলতে চাইছেন, এই বিদ্রোহে প্রত্যক্ষ মদদ ছিলো?


মইনুল ইসলাম: অবশ্যই ইন্ডিয়ার মদদ ছিলো। কারণ আমাদের তো আর কোনো শত্রু ছিলো না। মিয়ানমারের কিছুই করার ছিল না।


বাংলা আউটলুক: আপনাদের তদন্ত প্রক্রিয়ায় কোন প্রতিবন্ধকতা ছিলো?


মইনুল ইসলাম: আমরা ডিজিএফআই, এনএসআই, এনটিএমসি এদের যুক্ত করে তদন্ত করার কথা বলেছিলাম। কে কার কাছে কল করছে, কী বলছে। এসব বিষয় বের করার জন্য কল রেকর্ড বের করতে বলেছিলাম। এ রকম একটি অস্বাভাবিক ঘটনায় অনেক ধরনের আলামত থাকে, সেগুলো বের করা জরুরী ছিলো। কিন্তু তা করতে দেয়া হয়নি। তথ্য চেয়েও আমরা পাইনি। বলা হয়েছিল, এগুলো সিক্রেট। তাহলে আমরা তদন্ত করব কীভাবে? এ বিষয়ে সরকারকে এটা চিঠিও দিয়েছিলাম। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল আমাদর কমিটির প্রধান ছিলেন।  


বাংলা আউটলুক: তদন্তে আর কী কী অস্বাভাবিক ঘটনা পেয়েছিলেন?


মইনুল ইসলাম: আরেকটি বিষয়, আমাদের কাছে খটকা লেগেছিল। সেটি হচ্ছে পিলখানার ভেতরে দু’দিন ব্যাপী অফিসারদের হত্যা করা হচ্ছিল। ভেতর থেকে বাঁচার আকুতি শোনা যাচ্ছিল। বাইরে র‌্যাব ঘিরে রেখে ছিল। আর্মি ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন আর্মিকে বলা হয়েছিল, ভেতরে ঢুকলে দেশে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবে। তাদের ঢুকতে দেয়া হলো না কেন? এখানে অবশ্যই কোনো একটা অদৃশ্য শক্তি ইশারা করেছে। তাদের নির্দেশেই আর্মিকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এটা পরিষ্কার।


বাংলা আউটলুক: আপনারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন?


মইনুল ইসলাম: আমরা একটা প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলাম। আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়া, তথ্য চেয়ে না পাওয়ায় আমাদের সেই প্রতিবেদন আমলে নেয়া হয়নি। আমাদের ৭-৮ জনের ওই তদন্ত কমিটি একসাথে মিটিংও করতে পারিনি। 


বাংলা আউটলুক: পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হয়েছে, আপনার মন্তব্য কি?


মইনুল ইসলাম: এখানে দুই ধরনের অপরাধের বিচার হয়েছে। কিন্তু বিদ্রোহের কারণ এবং পরিকল্পনা বেরই করা হলো না।


  • বাংলা আউটলুক/ ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪

Tuesday, January 16, 2024

সংবিধান লঙ্ঘনের মহাযজ্ঞ — ''সদস্যদের কার্যভারগ্রহণ বিতর্ক''

সালাহউদ্দিন আহমেদ



বাংলাদেশে এখন দু’টি সংসদ চলমান। একাদশ সংসদ এবং দ্বাদশ সংসদ। যেহেতু রাষ্ট্রপতি এখন পর্যন্ত ভেঙে দেননি তাই একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২৯শে জানুয়ারি ২০২৪। রাষ্ট্রপতি ভেঙে না দিলে এবং মেয়াদের শেষ না হলে সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং একাদশ সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় দ্বাদশ সংসদের সদস্যগণ শপথ নিয়েছেন।

এটি সংবিধানের সঙ্গে চরমভাবে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ন্যূনতম নির্দেশনা অনুসরণ করলেও এই ধরনের অসাংবিধানিক কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে না।

দশম এবং একাদশ সংসদ রাষ্ট্রপতি ভাঙ্গিয়া দেন নাই এবং মেয়াদের অবসানও ঘটেনি। এতে বিনা কারণে এবং সহজে সংবিধান লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। সংবিধান লঙ্ঘনে প্রজাতন্ত্রের সকল প্রতিষ্ঠান নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে গেলে সংবিধান মান্য করার নৈতিক শক্তি হারিয়ে যাবে। ধারাবাহিকভাবে সংবিধানের লঙ্ঘন কোনো ক্রমেই অনুসরণীয় হতে পারে না।

২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আ'লীগের সংবিধান লঙ্ঘনের বিষয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ীকমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ একটি উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন। যা ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয়েছে। 

👇

———

সৌভাগ্যই বলিতে হইবে। মহাজোটের মহামন্ত্রী এবং মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের কল্যাণে আমরা দেশের প্রায় সকল আমজনতাই সংবিধান বিশেষজ্ঞ হইয়া উঠিয়াছি। উপায় ছিল না, বিগত কয়েক বৎসরে সংবিধানে কত রকমের অপারেশন করা হইয়াছে কেবল মুজিবকন্যার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পোক্ত করিবার মানসে। গতবারে গণভবন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লইয়াছিলেন, কিন্তু কপালমন্দ; এইবারে অন্তত আজীবন থাকা যায় কি না, তাহারই আইনি কসরত চলিতেছে।

জনাব গওহর রিজভী সাহেবের একটি লেখা গত ১২ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-‘শপথগ্রহণ নিয়ে সংশয়ের সুযোগ নেই’ শিরোনামে ছাপানো হইয়াছে। জনাবের জন্ম ও লালনপালন, শিক্ষা-দীক্ষা, কর্মজীবন সকল কিছুই বিদেশে বলিয়া দুষ্ট লোকেরা বলিয়া থাকেন। সুতরাং তাহাকে বিদেশ মন্ত্রক বিষয়ের উপদেষ্টা করা হইয়াছে। অতিশয় ভাগ্যবান বলিতে হইবে। তিনি বিদেশ বিষয়ের সহিত যে সংবিধান বিশারদও হইয়া উঠিয়াছেন ইহা আমাদের জানিবার সুযোগ করিয়া দিয়াছেন উপরোক্ত লেখনীর মারফত। তাহার প্রসঙ্গে আলোচনা করিয়া অন্যান্য বিষয়ে যাইব মনস্থ করিয়াছি।

সংবিধানের ১৪৮(৩) অনুচ্ছেদ উদ্ধৃৃত করিয়া তিনি ব্যাখ্যা দিলেন যে, শপথ গ্রহণযোগ্য পদের ক্ষেত্রে শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর শপথ গ্রহণকারী ব্যক্তি কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইলেও সংসদ সদস্যদের‌ ক্ষেত্রে তাহা প্রযোজ্য হইবে না।

তিনি যুক্তি হিসাবে উপস্থাপন করিয়াছেন সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যের শপথ গ্রহণের জন্য তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত শপথ ও ঘোষণা পত্রের (ফরমে) ঘোষণা (শপথ) ও স্বাক্ষরের কথা। ফরম (৫)-‘আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইয়া... আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি তাহা আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব’। তাহার যুক্তি হইল সংসদ সদস্যগণ শপথগ্রহণ করিলেও কর্তব্যভার এখনও গ্রহণ করেন নাই, তবে আরও পরে নিকট ভবিষ্যতে কোনো তারিখে কার্যভার গ্রহণ করিবেন।

জনাব গওহর রিজভী সাহেব চশমা দিয়া ভালোমতো দেখিলে বুঝিতেন যে, শপথের ফরমে ‘কর্তব্যভারের (Discharge the duties) কথা বলা হইয়াছে কার্যভারের (Enters upon an office) কথা বলা হয় নাই।’ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীগণ গোপনীয়তার শপথ নেন এবং সংবিধান রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের জন্যও শপথ নেন যাহা সংসদ সদস্যদের নিতে হয় না।

এইবার মূল আলোচনায় আসিব

সংবিধানের ১২৩(৩) (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ তবে শর্ত থাকে যে, এই দফায় (ক) উপদফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ উক্ত উপদফায় উল্লেখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না। কার্যভারগ্রহণ সংক্রান্ত ইংরেজি পাঠ হইল (a) “Shall not assume office as members of parliament except after the expiration of the term referred to therein.” অর্থাৎ উক্ত ৯০ দিন সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কার্যভার গ্রহণ (office assume) করিবেন না, যাহা আগামী ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ ইং শেষ হইবার কথা। উল্লেখ্য, অনুচ্ছেদ ৭২(১) অনুযায়ী উক্ত ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের অধিবেশন না থাকিবার বিধানটি ইতোমধ্যে লঙ্ঘিত হইয়াছে পূর্ববর্তী অধিবেশন টানিয়া লম্বা করিবার কারণে।

অনুচ্ছেদ ১৪৮(১)-এর ভাষ্যমতে শপথ গ্রহণের বিধান অনুযায়ী-কার্যভার গ্রহণের পূর্বে তৃতীয় তফসিলের ফরম মতে, শপথগ্রহণ ও স্বাক্ষর করিতে হইবে। ১৪৮ (১) এর ইংরেজি পাঠে কার্যভার গ্রহণকে “Entering upon the office”  বলা হইয়াছে। ১৪৮(৩) এই সংবিধানের অধীন যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির পক্ষে কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথের আবশ্যক সেই ক্ষেত্রে শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর তিনি কার্যভারগ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে। ইংরেজি পাঠ Where under this constitution a person is required to make an oath before he enters upon an office he shall be deemed to have entered upon office immediately after he makes the oath’ অর্থাৎ সংসদ সদস্যগণ শপথের সাথে সাথে কার্যভারগ্রহণ করিয়াছেন (deemed to have entered upon office) বলিয়া গণ্য হইবে। একজন সাবেক সংসদ সদস্য হিসাবে সবিনয়ে এই তথ্য দিতে পারি যে, শপথের তারিখ হইতে বেতন ভাতা, অন্যান্য সুবিধাদি ও কার্যাবলি কার্যকর হয়। office assume (কার্যভারগ্রহণ) করা বা Enters upon an office (কার্যভারগ্রহণ) কে duties (কর্তব্যভার) বলিবার সুযোগ নাই। বাংলা ও ইংরেজি উভয় পাঠই পরিষ্কার এবং পাশাপাশি বর্ণিত আছে সংবিধানে। এখন প্রশ্ন হইলো নবম সংসদ ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ ইং তারিখ পর্যন্ত বহাল থাকা অবস্থায় দশম সংসদ গঠিত হইল কিভাবে? 

গওহর রিজভী সাহেবের বক্তব্য আরো একটি আছে তাহা হইল সংসদ সদস্যদের শপথের ফরমে (তৃতীয় তফসিল ফরম ৫) লেখা আছে ‘আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইয়া...... শপথ করিতেছি যে, আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি তাহা আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব, যাহার ইংরেজি পাঠ “I will faithfully discharge the duties upon which I am about to enter according to law”  

গওহর রিজভী সাহেবের মূল ভাষ্য হইল; সংসদ সদস্যগণ এখনও কার্যভার গ্রহণ করেন নাই, কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে সম্ভাব্য কোনো তারিখে কার্যভার গ্রহণ করিবেন। অথচ তিনি জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার দুর্বল প্রয়াস নিয়াছেন। তিনি কার্যভার এবং কর্তব্যভার এক বিষয় মনে করিয়াছেন। শপথের ফরমের ভাষ্য অনুযায়ী সংসদ সদস্যগণ “কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছেন” (Duties upon which I am about to enter) সংসদ সদস্যগণ বাড়িতে, হাটে, মাঠে, ঘাটে কত রকমের কর্তব্যপালন করিয়া থাকেন। তাহাদের ৯টা-৫টা অফিস নাই। আবার সব সময় সংসদের অধিবেশনও বসে না। 

এইবারে আলোচনা সমাপ্ত করিতে চাই

অনুচ্ছেদ ১২৩(৩) (ক) অনুযায়ী নবম সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগেই শপথগ্রহণপূর্বক সংসদ সদস্যরা কার্যভারগ্রহণ করিয়া (Assumed office) সংবিধান লঙ্ঘন করিয়াছেন। মাননীয় স্পিকার তাহাদের শপথ পাঠ করাইয়া সংবিধান লঙ্ঘন করিয়াছেন। অনুচ্ছেদ ১৪৮(৩) অনুযায়ী শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর সংসদ সদস্যগণ কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন (Deemed to have been entered upon the office) 

গওহর রিজভী সাহেবের কথাই যদি মানিয়া লই তাহা হইলে দশম সংসদের সদস্যগণ এখনও কার্যভারগ্রহণ করেন নাই, তবে কি মন্ত্রিসভা নবম সংসদের সদস্যগণ লইয়া গঠিত হইল? তাহা হইলে কি রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের শপথ পাঠ করাইয়া সংবিধান লঙ্ঘন করেন নাই? পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখিয়া যে অনুচ্ছেদ আনা হইয়াছে তাহা ভবিষ্যতে এইখানেও কার্যকর হইবে কি না বলা যাইতেছে না। 

বিনাভোট, বিনাভোটার, বিনাবিরোধী দল এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের নামে যে প্রহসনের নির্বাচন নাটক মঞ্চস্থ হইল তাহাদের কেবল শপথগ্রহণই যে একমাত্র ভরসা। শপথ সর্বস্ব এমপিদের লইয়া মুজিবকন্যা কত দূর যাইবার শপথ করিয়াছেন তাহাই এখন দেখিবার বিষয়।

অনেক সুশীলকে বলিতে শুনিলাম; নির্বাচন কমিশন দ্রুত গেজেট প্রকাশ করিবার কারণেই যত গণ্ডগোল। এক্সরে করিয়া দেখিলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ডের অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। অতএব কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।

মহাজোট সরকারের সংবিধান লঙ্ঘনের কাহিনী বর্ণনা করিতে হইলে আরেকটি মহাভারত লিখিতে হইবে; সুতরাং ইচ্ছা থাকিলেও সীমিত রাখিতে হইবে। তবে সাম্প্রতিককালের কয়েকটি বর্ণনা দিতে চাই।

নির্বাচনী সরকার গঠনের নামে সব মন্ত্রীর পদত্যাগ নাটক দেশ-বিদেশে সবাইকে দেখিতে হইল ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে। কয়েকজন মন্ত্রীকে দেখিলাম মুজিবকন্যার পদতলে পদত্যাগপত্র সমর্পণ করিয়া পদস্পর্শ করিয়া প্রণাম করিতে। জাতিকে দেখিতে হইল, আন্তর্জাতিকও দেখিল। ভবিষ্যতে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম দেখিবার ভাগ্য হইলেও অবাক হইব না।

সংবিধানের ৫৮(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করিলেই মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে। অথচ পদত্যাগী মন্ত্রীরা অফিস করিলেন; ক্যাবিনেট মিটিংয়ে অংশ নিলেন; পরবর্তীতে নির্বাচনী সরকারের সদস্য হইলেন। যদিও সংবিধানে ‘নির্বাচনকালীন’ সরকার বলিতে কিছুই নাই তারপরেও তিনি তাহা জাতিকে উপহার দিলেন। পদত্যাগী মন্ত্রীদের উক্ত সময়ের কার্যাবলি অসাংবিধানিক বিবেচনায় ভবিষ্যতে আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতারও সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা হইবার সম্ভাবনা অবশ্যই রহিয়াছে।

মুজিবকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবিধান লঙ্ঘনের প্রবণতা পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত। তাহার পিতা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ১৯৭৪ ইং সনের ১৬ মে তারিখে চুক্তি সম্পাদন করিয়া বাংলাদেশের দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়নের ২.৬৪ বর্গমাইল এলাকা ভারতের কাছে হস্তান্তর করেন, বিনিময়ে তিন বিঘা করিডোর (১৮৭ × ৮৫ মিটার) অদ্যাবধি আমরা স্থায়ীভাবে পাই নাই (এই চুক্তি লইয়া অন্য দিন লিখিবার ইচ্ছা রইল)। সংবিধান অনুযায়ী এই চুক্তি করিবার কোনো এখতিয়ার তাহার ছিল না। চুক্তি কার্যকর করিবার জন্য অতঃপর ২৯ নভেম্বর ১৯৭৪ ইং তারিখে সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী আইন প্রণয়ন করিতে হইয়াছে। বাংলাদেশকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী পৈতৃক সম্পত্তি মনে করিবার ইহাও একটি কারণ হইতে পারে।

আমাদের সকলেরই মনে থাকিবার কথা যে, মুজিবকন্যা দিল্লি সফর করিয়া বাংলাদেশে ফেরত আসিয়া বলিলেন ‘আমি জয়ী আজ, দিল্লি জয় করিয়াছি’। ৫০ দফার যৌথ ইশতেহার ও পাঁচটি চুক্তি সম্পাদন করিয়া দিল্লির কাছে আপদমস্তক ইজারা দিয়া আসিয়া পরবর্তীতে বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যাহা তিনি করিয়াছেন তাহা দেশের জনগণ দেখিয়াছে এবং বলিয়াছে ‘দিল্লি তাহাকে জয় করিয়াছে’। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মাঝে মধ্যে গান, কবিতা ইত্যাদি আওড়ানোর শখ আছে। তিনি না বুঝিয়াই কি মহাভারতের খলনায়ক দুর্যোধনের বাক্য বলিয়াছেন? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে ‘গান্ধারীর আবেদন’ রচনা করিয়াছেন। 


সম্রাট ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্ন পুত্র দুর্যোধনের কাছে —

অখণ্ড রাজত্ব জিনি সুখ তোর কই রে দুর্মতি?

দুর্যোধন বলিলেন, সুখ চাহিনাই মহারাজ

জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।


সত্যই কলিযুগের দুর্যোধন মুজিবকন্যা দিল্লি জয় করিয়াছেন কি না জানি না; তবে দিল্লি অবশ্যই (দশম সংসদ নির্বাচনে) তাহাকে বিজয়ী দেখিতে চাহিয়াছেন ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই। ঢাকা-দিল্লির যে মহড়া চলিতেছে তাহা দেখিয়া কোন প্রাতঃকালে গাহিতে হইবে ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্য বিধাতা’ এখন আপাতত ইহাই চিন্তার বিষয়। 

লেখক : সালাহউদ্দিন আহমেদ

সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিএনপি।

(এই কলামটি দৈনিক নয়াদিগন্তে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে।)

Thursday, December 28, 2023

অবৈধ আওয়ামী মন্ত্রী-এমপিরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ

ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীর দুর্নীতির খন্ডচিত্র বেরিয়ে আসছে




আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ২০ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আয় গত পাঁচ বছরে নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। সর্বোচ্চ আয় বেড়েছে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির– ২ হাজার ১৩১ শতাংশেরও বেশি। আর যার আয় সবচেয়ে কম বেড়েছে, তিনি হলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর, তাও ১৩২ শতাংশেরও বেশি। গত ১৫ বছরে আটজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সম্পদও সীমাহীনভাবে বেড়েছে। এতে শীর্ষে আছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। 

প্রার্থীদের মধ্যে শতকোটি টাকার চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক আছেন ১৮ জন। তাদের সবাই আওয়ামী লীগের কিংবা দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থী। এদিক থেকে শীর্ষে আছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৩৪৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকার। 

ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩ রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত ‘নির্বাচনী হলফনামার তথ্যচিত্র: জনগণকে কী বার্তা দিচ্ছে?’ শিরোনামে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের দেওয়া হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে অনেক মন্ত্রী-এমপির সম্পদ বৃদ্ধির চিত্র রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। 

তবে টিআইবি বলছে, হলফনামায় দেওয়া সম্পদ বিবরণী কতটা সঠিক এবং আয় ও সম্পদ বৈধ কিনা, তা যাচাই করে না নির্বাচন কমিশন, রাজস্ব বিভাগ কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন। আবার সম্পদের অর্জনকালীন যে মূল্য দেখানো হয়েছে, তা নিয়েও বড় রকমের প্রশ্ন রয়েছে। প্রার্থীরা তাদের অর্জিত সম্পদের কতটা দেখিয়েছেন অথবা বিদেশে সম্পদ থাকার তথ্য গোপন করেছেন কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে।

টিআইবির প্রতিবেদনে মন্ত্রী-এমপি প্রার্থীর সম্পদের যে চিত্র  তুলে ধরা হয়েছে, তা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। অবশ্য অনেক মন্ত্রী-এমপি-প্রার্থীর ঋণও রয়েছে। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এসএকে একরামুজ্জামানের ৪২১ কোটি টাকার সম্পদ থাকলেও তাঁর ঋণ ও দায় রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার।  চারজন প্রার্থী রয়েছেন যাদের শত শত বিঘা জমি রয়েছে। অথচ বাংলাদেশের ভূমি আইন অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ ৬০ বিঘা কৃষিজমি থাকার বিধান রয়েছে। 

প্রতিটি সংসদে পর্যায়ক্রমে রাজনীতিবিদের সংখ্যা কমছে। এবার প্রার্থীদের মধ্যে রাজনীতিবিদ আছেন ৩ শতাংশেরও কম। ব্যবসায়ী আছেন ৫৭ শতাংশেরও বেশি। 

সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রার্থীদের নিজের দেওয়া হলফনামায় সম্পদের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, বাস্তবে তাদের সম্পত্তির পরিমাণ আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। 

টিআইবির ট্রাস্টি মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘বৈধ উপায়ে এত সম্পদ মানুষের বাড়ে কিনা, আমি জানি না। আমরা দেখছি কিছু মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়ে যাচ্ছে। আর কিছু মানুষ পেট ভরে খাওয়ার জন্য প্রতিদিন যুদ্ধ করছে। আমরা একটা অসম সমাজ তৈরি করছি। আমরা দ্রুত ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় চলে যাচ্ছি। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি।’ 


গত পাঁচ বছরে আয় বৃদ্ধিতে শীর্ষে ১০ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী 

  1. বাণিজ্যমন্ত্রী — টিপু মুনশির — ২,১৩১ % 
  2. স্বাস্থ্যমন্ত্রী — ডা. জাহিদ মালেক  — ২৭৬ %
  3. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী — নসরুল হামিদ — ২২৮ % 
  4. ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী — ডা. এনামুর রহমান — ২২৭ %
  5. শিক্ষামন্ত্রী — ডা. দীপু মনি — ২০৪ %
  6. শিল্প মন্ত্রী — নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন — ১৬৪ %
  7. প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী — মোঃ জাকির হোসেন — ১৪৯ %
  8. বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী — গোলাম দস্তগীর গাজী  — ১২২ %
  9. প্রধানমন্ত্রী — শেখ হাসিনা — ১১৯ %
  10. খাদ্য মন্ত্রী — সাধন চন্দ্র মজুমদার — ৯১ %

 


পাঁচ বছরে সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে যারা


গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি সম্পদ বেড়েছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের– ১ হাজার ৬৩ শতাংশ। এরপর নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বেড়েছে ২৮৬ শতাংশ,  স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ২৪২ শতাংশ, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর ২৪২ শতাংশ, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ২৩৯ শতাংশ, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খানের ১৯৬ শতাংশ, দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের ১৯৬ শতাংশ, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ১৭৩ শতাংশ, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদের ১৪০ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ১৩২ শতাংশ সম্পদ বেড়েছে।





৫ বছরে যেসব এমপির আয় বেড়েছে

এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন ঢাকা-২০ আসনের এমপি বেনজীর আহমদ (২২৩৮.১০%)। আজ মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির সমন্বয়ক (আউট রিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) মোহাম্মদ তাওহিদুল ইসলাম। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া ২,০০০ এর বেশি হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য তুলে ধরেছে সংস্থাটি। 

একাদশ সংসদের এমপিদের ৫ বছরে আয় বৃদ্ধির হারে শীর্ষ ১০- এ যারা:

১. ঢাকা-২০ আসনের বেনজীর আহমদ (২২৩৮.১০%)
২. কুষ্টিয়া-১ আসনের আ. ক. ম. সরওয়ার জাহান (২২০০.৫৮%)
৩. রংপুর-৪ আসনের টিপু মুনশি (২১৩১.১২%)
৪. বগুড়া-২ আসনের শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ (২০৭৪.৮৩%)
৫. নাটোর-১ আসনের মো. শহিদুল ইসলাম (বকুল) (১৯৭২.১৬%)
৬. যশোর-১ আসনের শেখ আফিল উদ্দিন (১৬০৮.৬৩%)
৭. নওগাঁ-৩ আসনের মো. ছলিম উদ্দীন তরফদার (১৪৯৪.১২%)
৮. দিনাজপুর-৪ আসনের আবুল হাসান মাহমুদ আলী (১১৮৭.৫২%)
৯. পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির (১০৬০.৪৪%)
১০. যশোর-৩ আসনের কাজী নাবিল আহমেদ (১০৩৯.৭৮%)






১৫ বছরে সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে যারা
গত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি সম্পদ বেড়েছে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের– ৬ হাজার ৩৫০ শতাংশ। গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের বেড়েছে ২ হাজার ৮৫৮ শতাংশ, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ২ হাজার ৭০৩ শতাংশ, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের ২ হাজার ১৭৯ শতাংশ, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ৯৮২ শতাংশ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ৭৮৩ শতাংশ,  শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের ৪৯৩ শতাংশ এবং ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের বেড়েছে ১২৯ শতাংশ। 


১৫ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে যারা

  1. রাজশাহী-৪ — এনামুল হক —  ২,৪৩,৫১৩ শতাংশ
  2. নাটোর-৩  জুনায়েদ আহমেদ পলক  ১৬,৭৪২ শতাংশ   
  3. মাদারীপুর-১ — নূর আলম চৌধুরী  — ৮,৩২৪ শতাংশ 
  4. গাজীপুর-৫ — মেহের আফরোজ — ৭,৬৯২ শতাংশ
  5. নওগাঁ-১ — সাধন চন্দ্র মজুমদার — ৬,৩৫০ শতাংশ
  6. দিনাজপুর-৪ — আবুল হাসান মাহমুদ আলী — ৬,১৩৮ শতাংশ
  7. ঢাকা-২ — কামরুল ইসলাম — ৫,৩৯০ শতাংশ
  8. কুষ্টিয়া-২ — হাসানুল হক ইনু — ৪,৭২৩ শতাংশ
  9. চট্টগ্রাম-৭ — মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ — ৪,৬৮৩ শতাংশ
  10. চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ — জিয়াউর রহমান — ৪, ৬৮২ শতাংশ




বছরে কোটি টাকা আয়ের প্রার্থী বাড়ছে
গত চারটি জাতীয় সংসদের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশি আয়ের প্রার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বছরে কোটি টাকা আয় করেন এ রকম প্রার্থী ২০০৮ সালে ছিল ৪৩ জন, ২০১৩ সালে ৬২ জন এবং ২০১৮ সালে ১৪৩ জন। এবার তা বেড়ে হয়েছে ১৬৪ জন। 

১৮ প্রার্থী শতকোটি টাকার মালিক
এবার ১৮ জন প্রার্থী রয়েছেন, যারা শতকোটি টাকারও বেশি সম্পদের মালিক। এর মধ্যে ১০ জনই আওয়ামী লীগের। অন্য আটজনও আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাদের মধ্যে শীর্ষ ১০ জন হলেন পর্যায়ক্রমে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের গোলাম দস্তগীর গাজী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের স্বতন্ত্র একরামুজ্জামান, ঢাকা-১ আসনের আওয়ামী লীগের সালমান এফ রহমান, কুমিল্লা-৮ আসনের আওয়ামী লীগের আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন, কুমিল্লা-৩ আসনের আওয়ামী লীগের ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন, চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের  স্বতন্ত্র দিলীপ কুমার আগরওয়ালা, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের আওয়ামী লীগের আব্দুল মমিন মণ্ডল, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের স্বতন্ত্র গাজী গোলাম মর্তুজা, নরসিংদী-৩ আসনের স্বতন্ত্র সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, ঢাকা-৬ আসনে আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। 

কৃষিজমির মালিকানায় শীর্ষ ১০

কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের গোলাম কবির ভূঞার জমির পরিমাণ ৬৪৭ একর। বগুড়া-২ আসনের বিউটী বেগমের ৫৪৮ একর, ময়মনসিংহ-৪ আসনের মোহাম্মদ মোহিত উর রহমানের ১৯৫ একর, বাগেরহাট-৪ আসনের জামিল হোসাইনের ১১০ একর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের ফিরোজুর রহমানের ৮৩ একর, যশোর-১ আসনের শেখ আফিল উদ্দিনের ৬৮ একর, চট্টগ্রাম-২ আসনের হোসাইন মো. আবু তৈয়বের প্রায় ৭০ একর, ঢাকা-১৫ আসনের কামাল আহমেদ মুজদারের ৬১ একর, ভোলা-১ আসনের ছিদ্দিকুর রহমানের ৬০ একর ও সুনামগঞ্জ-২ আসনের চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের ৫১ একর। এর মধ্যে শেষের দু’জন জাসদ থেকে এবং অন্যরা আওয়ামী লীগ বা একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী।



অকৃষি জমিতে শীর্ষে যারা

জামালপুর-৫ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী জাকির হোসেনের আছে ৮১৩ একর, নাটোর-৪ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির আলাউদ্দিন মৃধার ৫৮২ একর, পিরোজপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দীন মহারাজের ৩৮১ একর, রাজবাড়ী-১ আসনে আওয়ামী লীগের কাজী কেরামত আলীর ১৮১ একর, সুমানগঞ্জ-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়া সেনগুপ্তার ৯৫ একর, ঢাকা-১৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী খসরু চৌধুরীর ৬১ একর, ভোলা-২ আসনে জেপির মো. গজনবীর ৫৩ একর, নারায়ণণগঞ্জ-২ আসনে তৃণমূল বিএনপির আবু হানিফ হৃদয়ের ৪৩ একর, বরিশাল-১ আসনে আওয়ামী লীগের আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ৫৮ একর, দিনাজপুর-৯ আসনের স্বতন্ত্র তরিকুল ইসলাম তারিকের সাড়ে ৩৬ একর অকৃষি জমি রয়েছে।     

দেশে বিদ্যমান ভূমি আইন অনুযায়ী, কৃষি ও অকৃষি মিলিয়ে কারও ১০০ বিঘার বেশি জমির মালিক হওয়ার  সুযোগ নেই। এর বেশি থাকলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। অতিরিক্ত জমি বাজেয়াপ্ত বা অধিগ্রহণ করতেও পারে সরকার। এই নিয়ম অনুযায়ী, তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগদানও অনৈতিক বলে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়। 

১০ জনের আয় বেড়েছে অবিশ্বাস্য গতিতে
গত পাঁচ বছরে ১০ জন এমপির আয় অসম্ভব গতিতে বেড়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-২০ আসনের বেনজীর আহমদের আয় বেড়েছে ২ হাজার ২৩৮ শতাংশ, কুষ্টিয়া-১ আসনের সরওয়ার জাহানের ২ হাজার ২০০ শতাংশ, রংপুর-৪ আসনের টিপু মুনশির ২ হাজার ১৩১ শতাংশ, বগুড়া-২ আসনের শরিফুল ইসলাম জিন্নার ২ হাজার ৭৪ শতাংশ, নাটোর-১ আসনের শহিদুল ইললাম বকুলের ১ হাজার ৯৭২ শতাংশ, যশোর-১ আসনের শেখ আফিল উদ্দিনের ১ হাজার ৬০৮ শতাংশ, নওগাঁ-৩ আসনের ছলিম উদ্দীন তরফদারের ১ হাজার ৪৯৪ শতাংশ,  দিনাজপুর-৪ আসনের আবুল হাসান মাহমুদ আলীর ১ হাজার ১৮৭ শতাংশ, পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবিরের ১ হাজার ৬০ শতাংশ এবং যশোর-৩ আসনের কাজী নাবিল আহমেদের আয় ১ হাজার ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। 

১০ জনের স্ত্রী ও পরিবারও তাক লাগিয়েছে 
চট্টগ্রাম-১৫ আসনের আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিনের স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের আয় বেড়েছে ২ হাজার ৪০৯ শতাংশ, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির পরিবারের ২ হাজার ১৩১ শতাংশ, ফেনী-২ আসনের নিজাম উদ্দিন হাজারীর ১ হাজার ২৩০ শতাংশ, পটুয়াখালী-৪ আসনের মহিবুর রহমানের ৬৬৯ শতাংশ, ঢাকা-৩ আসনের নসরুল হামিদ বিপুর ৬২৭ শতাংশ, শরীয়তপুর-৩ আসনে নাহিম রাজ্জাকের ৫১১ শতাংশ, রাজশাহী-১ আসনের ওমর ফারুক চৌধুরীর ৪৯৯ শতাংশ, ঢাকা-২০ আসনের বেনজীর আহমদের ৩৪৪ শতাংশ, যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্য্যের ২৭১ শতাংশ এবং নাটোর-১ আসনের শহিদুল ইসলাম বকুলের স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের আয় বেড়েছে ২৩৬ শতাংশ।
 
৫ বছরে কয়েক এমপির অস্থাবর সম্পত্তি বৃদ্ধির চিত্র
রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হকের অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে ৫ হাজার ৪৭০ শতাংশ, নোয়াখালী-৩ আসনের মামুনুর রশীদ কিরনের ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, নাটোর-১ আসনের শহিদুল ইসলাম বকুলের ১ হাজার ৯১৩ শতাংশ, খাগড়াছড়ির কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ১ হাজার ৫৪ শতাংশ, পটুয়াখালী-৪ আসনের মহিববুর রহমানের ১ হাজার ২৪ শতাংশ, গাজীপুর-৫ আসনের মেহের আফরোজ চুমকির ৮২৭ শতাংশ, কুষ্টিয়া-১ আসনের আ ক ম সরওয়ার জাহানের ৫৭৪ শতাংশ,  ময়মনসিংহ-১১ আসনের কাজিম উদ্দিন আহম্মদের ৫৪৩ শতাংশ এবং যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্য্যের ৪৮৬ শতাংশ। 

যেসব এমপির স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ ব্যাপকহারে বেড়েছে
পাঁচ বছরের ব্যবধানে রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হকের স্ত্রী ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের আয় বেড়েছে ৩৮ হাজার ৪৭৩ শতাংশ, বগুড়া-২ আসনের শরিফুল ইসলাম জিন্নার ৯ হাজার ৪৫১ শতাংশ,  সুনামগঞ্জ-৫ আসনের মহিবুর রহমান মানিকের ২ হাজার ৫৭৯ শতাংশ, পটুয়াখালী-৪ আসনের মহিববুর রহমানের ২ হাজার ৯৩ শতাংশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেনের ১ হাজার ৬২৪ শতাংশ,  কুষ্টিয়া-১ আসনের আ কা ম সরওয়ার জাহানের ১ হাজার ১৬২ শতাংশ, নওগাঁ-৩ আসনের ছলিম উদ্দীন তরফদারের ১ হাজার ১৯ শতাংশ, ফেনী-২ আসনের নিজাম উদ্দিন হাজারীর ৯২০ শতাংশ, সাতক্ষীরা-১ আসনের মুস্তফা লুৎফুল্লাহর ৮৯৩ শতাংশ এবং রাজবাড়ী-১ আসনের কাজী কেরামত আলীর বেড়েছে ৮৭১ শতাংশ।
 
আয় বৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০ এমপি 
গত ১৫ বছরে সর্বোচ্চ আয় বেড়েছে পিরোজপুর-২ আসনের এমপি আনোয়ার হোসেনের– ৭ হাজার ১১৬ শতাংশ। এ সময়ে মাদারীপুর-১ আসনের নূর-ই আলম চৌধুরীর বেড়েছে ৫ হাজার ৬৯৬ শতাংশ, মাদারীপুর-২ আসনের শাজাহান খানের ৪ হাজার ৬৯৭ শতাংশ, নোয়াখালী-১ আসনের এইচ এম ইব্রাহিমের ৪ হাজার ২৯৬ শতাংশ, শেরপুর-২ আসনের মতিয়া চৌধুরীর বেড়েছে ৪ হাজার ১৩৫ শতাংশ,  নওগাঁ-১ আসনের সাধন চন্দ্র মজুমদারের ৪ হাজার ১৩২ শতাংশ, জয়পুরহাট-২ আসনের আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের ২ হাজার ৮৯৫ শতাংশ, বাগেরহাট-১ আসনের শেখ হেলাল উদ্দীনের ২ হাজার ৭৬৭ শতাংশ,  রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হকের ২ হাজার ৭৫৬ শতাংশ ও গাজীপুর-২ আসনের জাহিদ আহসান রাসেলের বেড়েছে ২ হাজার ৫৪৫ শতাংশ।
 
১৫ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে যারা
গত ১৫ বছরের ব্যবধানে অস্থাবর সম্পত্তি বৃদ্ধিতে শীর্ষে আছেন রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হক। তাঁর অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৩ শতাংশ। এরপর পর্যায়ক্রমে মাদারীপুর-১ আসনের নূর আলম চৌধুরীর ৮ হাজার ৩২৪ শতাংশ, গাজীপুর-৫ আসনের মেহের আফরোজের ৭ হাজার ৬৯২ শতাংশ, নওগাঁ-১ আসনের সাধন চন্দ্র মজুমদারের ৬ হাজার ৩৫০ শতাংশ, দিনাজপুর-৪ আসনের আবুল হাসান মাহমুদ আলীর ৬ হাজার ১৩৮ শতাংশ, ঢাকা-২ আসনের কামরুল ইসলামের ৫ হাজার ৩৯০ শতাংশ, কুষ্টিয়া-২ আসনের হাসানুল হক ইনুর ৪ হাজার ৭২৩ শতাংশ, চট্টগ্রাম-৭ আসনের মোহাম্মদ হাছান মাহমুদের ৪ হাজার ৬৮৩ শতাংশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের জিয়াউর রহমানের ৪ হাজার ৬৮২ শতাংশ ও ঢাকা-২০ আসনের বেনজীর আহমদের অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৪ হাজার ১৯৭ শতাংশ।




ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে সংসদ
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে মূল পেশা বিবেচনায় ব্যবসায়ী আছেন ৫৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এ ছাড়া আইনজীবী আছেন ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, কৃষিজীবী ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ, চাকরিজীবী ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ, শিক্ষক ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ, রাজনীতিবিদ আছেন ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ২ দশমিক ৭১ শতাংশ, চিকিৎসক ২ দশমিক ১৯ শতাংশ, সাংবাদিক দশমিক ৮৩ শতাংশ, গৃহস্থালি দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং অন্যান্য ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। প্রার্থীদের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম– মাত্র ৫ দশমিক ১০ শতাংশ। পুরুষ ৯৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। 

যুক্তরাজ্যে এক মন্ত্রীর ছয় কোম্পানি
‘নির্ভরযোগ্য’ তথ্যের বরাতে টিআইবি জানায়, বর্তমান মন্ত্রিসভায় এমন একজন সদস্য রয়েছেন, যাঁর যুক্তরাজ্যে ছয়টি কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানিতে তাঁর বিনিয়োগ ১৭ দশমিক ২০ কোটি পাউন্ড, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। তবে টিআইবির হিসাবে, ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার সম্পদ তাঁর। তিনি সেখানে প্রথম কোম্পানি স্থাপন করেন ২০১০ সালে আর পঞ্চম ও ষষ্ঠ কোম্পানি ২০২১ সালে। ওই মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করেনি টিআইবি।



তিনি হলেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। সমকালের নিজস্ব অনুসন্ধানে সাইফুজ্জামান নিজে পরিচালক এমন আটটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নিশ্চিত হওয়া গেছে, টিআইবির কাছে ভূমিমন্ত্রীর বিষয়েই তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। সমকাল জানতে পেরেছে, লন্ডনে মন্ত্রী জাবেদের কোম্পানি ছয়টি না; আটটি। কোম্পানিগুলোর সম্পদমূল্য ২০ কোটি ৩১ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। স্ত্রী রুখমিলা জামান এবং মেয়ে জেবা জামানের নামেও কোম্পানি খুলেছেন তিনি। এ ছাড়া পারিবারিক মালিকানায় থাকা ব্যবসায়িক গ্রুপ আরামিটের নামেও একটি কোম্পানি খুলেছেন।

জনগণের টাকা লুটপাট করে অর্থ পাচারের মাধ্যমে গত ১৫ বছর যাবত মাফিয়া হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা দেশে ও দেশের বাইরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে।

Tuesday, December 19, 2023

আবারও আমরা একটি মুক্ত-স্বাধীন দেশে বাস করবো

দ্য ডিপ্লোম্যাটকে সাক্ষাৎকারে 
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান




আগামী ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। দেশটির প্রধান বিরোধী দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই নির্বাচন বর্জন করেছে। দলটির অভিযোগ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নিবার্চন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। এই নিয়ে গত এক বছর ধরে তারা দেশজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছে। বহু সভা-সমাবেশ হয়েছে এর বিরুদ্ধে। 

দ্য ডিপ্লোম্যাটের সিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ব্যাখ্যা করেন, কেন তার দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। 
তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনে শুধু যে রাজনৈতিক দলগুলোই অংশগ্রহণ করবে না তা নয়, ভোটাররাও এতে অংশ নিতে পারবে না। এর সবই পূর্বনির্ধারিত। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান ২০০৬-২০০৭ সালে ১৮ মাস জেলে ছিলেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন। 

এই সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান কথা বলেছেন বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল, অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের সম্ভাবনা এবং বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে। ডিপ্লোটম্যাটকে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে ভারতের উদ্বেগ অযথাই। অতীতে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগও বহুবার জোট গঠন করেছে। 

তারেক রহমানের পুরো সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য ভাষান্তরিত করেছে বাংলা আউটলুকের অনুবাদ ডেস্ক।

প্রশ্ন : ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করার ব্যাপারে বিএনপি একেবারেই অনড় কেন? 

তারেক রহমান : বিএনপি একাই নয়, আরো ৬২টি গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক দল ৭ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের জনগণের মুখের দিকে তাকিয়ে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করতে। একটি অর্থবহ নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে। যাতে তারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন। তাদের ভোট যথাযথভাবে গণনা করা হয়। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে আগের নির্বাচনগুলো হয়েছে প্রহসনমূলক। কারচুপি আর অনিয়মের কলঙ্কিত ইতিহাস হিসেবে সেগুলো চিহ্নিত। সারা দুনিয়া সেসব জানে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কোনো বিরোধী দল ছাড়াই নির্বাচন করেছিল, এবং ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪ টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল বলে দাবি করেছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা রাতের বেলা ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছিল। 

২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ আরেকটা জালিয়াতির নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগেই তাদের সাথে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর আলোচনা-সাপেক্ষে ফলাফল পূর্বনির্ধারিত হয়ে গেছে। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো মূলত আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক মিত্র, তাদের ওপর জনগণের কোনো আস্থা ও বিশ্বাস নেই। এদের মধ্যে জাতীয় পার্টি একমাত্র দল, যার কিছু জনভিত্তি রয়েছে। জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতারা এক বৈঠকে নির্বাচন বর্জন ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বিলুপ্ত করার পক্ষে তীব্র ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। পরে গোয়েন্দারা তাদের সাথে দেখা করেন এবং তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেন। 

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়াতে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ডামি প্রার্থী দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ডামি প্রার্থীদের জয়-পরাজয় মূখ্য  বিষয় নয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করাই এর মূল উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় করে তিনি বিএনপিকে বিভক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। তথাকথিত কিংস পার্টি (বিরোধী দল থেকে টেনে নেওয়া লোক নিয়ে রাষ্ট্রীয় সমর্থনে গঠিত দল) গঠনে পৃষ্ঠপোষকতা জুগিয়েছেন তিনি। এর উদ্দেশ্য ছিল মিথ্যা অন্তর্ভুক্তির ধারণা তৈরি করা, যেন হাজার হাজার প্রার্থীর সাথে বিরোধী দলও এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে বলে মনে হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের আসন ভাগাভাগিতে গোলযোগ লেগে গেছে। জাকের পার্টি ২০০ টি আসন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অন্যান্য ছোট দলগুলোর অনেক প্রার্থীও প্রত্যাহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের বাধা দিয়েছে বলে জানা গেছে। 

আমরা যদি শেখ হাসিনার অধীনে উপ-নির্বাচনগুলো দেখি, যেগুলোর তেমন গুরুত্বও ছিল না, সেখানেও আওয়ামী লীগের কমীর্রা ভোটচুরির মচ্ছব বসিয়ে দিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় সম্পদের সাহায্যে নির্বাচন কারচুপির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ও অভ্যাস তারা অব্যাহত রেখেছে। তাদের আয়োজিত প্রতিটি নির্বাচনেই দেখা গেছে বিরোধী প্রার্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ভোটার তালিকায় ভোটদাতার নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। জাল ভোট হয় ব্যাপক হারে। ব্যালট বাক্স ভরে যায় তাদের ভোটে। গত মাসেই নির্বাচনী জালিয়াতির এক সুউচ্চ শিখরে পৌঁছুতে দেখেছি আমরা,  আওয়ামী লীগের এক পোলিং এজেন্ট ৫৭ সেকেন্ডে ৪৩টি ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে। এটা স্পষ্ট যে যতদিন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকবেন, বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনে ততদিন অনিময়ম হবে। বহুল প্রত্যাশিত লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড ততদিন থাকবে অকল্পনীয় স্বপ্নে।

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, বিরোধী নেতা-কমীর্দের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী শাসন ততই জোরদার হচ্ছে। দেশব্যাপী তাদের ওপর সমানে দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এমন পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে যেন কোনোভাবেই অন্তভুর্ক্তিমূলক নির্বাচন না হয়। জেলখানা উপচে পড়ছে আমাদের নেতাকমীতে, তবুও বানোয়াট মামলায় নির্বিচারে আটক চলছেই। সাথে জোরপূর্বক গুম, বিচারবহিভূর্ত হত্যা, নৃশংস নির্যাতনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধ তো আছেই। এটা স্পষ্ট যে শুধুমাত্র একটি অ-রাজনৈতিক, নিরপেক্ষ, নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে পরিচালিত নির্বাচনের মাধ্যমেই কেবল একটি অন্তুভুর্ক্তিমূলক, বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বচ্ছ নির্বাচন হতে পারে, যাতে বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার হতে পারে এবং একটি সরকার পূর্ণ জনসমর্থন পেতে পারে। 

প্রশ্ন : বিএনপির রাজপথের আন্দোলনের গতি আর কতদিন? কয়েক সপ্তাহর মধ্যেই তো নতুন সরকার আসছে।

তারেক রহমান :
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২ হাজার ৬৮৭জন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এই হত্যাগুলো সংঘটিত হয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্বারাই। এর সঙ্গে জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে ৬৭৫ জনকে। বিএনপি ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের ৫০ লাখ সদস্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত মামলা দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০-এরও বেশি। ২৮ অক্টোবর আমাদের মহাসমাবেশের পর  ২২ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারাগারে কয়েদির সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার প্রায় আড়াই গুন বেশি। তবু গ্রেফতার চলছেই। 

ক্ষমতাসীনদের হাতে বিএনপির নেতাকমীর্রা নজিরবিহীন দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন। অসহ্য অত্যাচার আর অবিচার সহ্য করেছেন। দেশের গণতান্ত্রিক নীতি সমুন্নত রাখতে এটি আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রমাণ। জনগণের যে-অধিকার অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আমাদের কর্তব্য তাদের অধিকার ন্যায্যভাবে আদায় করা। নির্বাচন যেমনই হোক, শেখ হাসিনা যতই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকুন, বিএনপির প্রতি দৃঢ় জনসমর্থনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এখন যদিও কিছু কৌশলগত সমন্বয় আসতে পারে, বড় আকারে দেখলে আমাদের আন্দোলনের গতিবেগ এখান থেকে কেবল সামনেই দিকেই যাবে, আরো ওপরের দিকেই উঠবে। 

বিএনপির সর্বশেষ সমাবেশ ও শোভাযাত্রা হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। সে-সমাবেশে গণজোয়ারই আমাদের শক্তির প্রমাণ। রাষ্ট্রীয় সহিংসতা উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা সারা বাংলাদেশে বিশাল বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেছি। লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাদের সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। আমাদের প্রতি এই বিপুল জনসমর্থন জাতির ইতিহাসের একটি অভূতপূর্ব অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
 
প্রশ্ন : অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর তীব্র চাপ রয়েছে। বিএনপির কি মনে হয় এই চাপ কাজ করবে না?

তারেক রহমান : আপনার প্রশ্নের মধ্যেই এর উত্তর রয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য একটি প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজমান, এটা প্রমাণ করার জন্যই আমাদের আন্দোলন চলমান। এতে আমাদের নৈতিক ভিত্তি আরো শক্তিশালী হচ্ছে। কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক তার সর্বশেষ বক্তব্যে বলেছেন যে, রাতারাতি মুক্তি পাওয়ার শর্তেও বিএনপি নির্বাচনে যোগদানের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। তিনি বস্তুত দাবি করেছেন যে একটি পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তারা বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক করেছেন। এতে এটাও স্পষ্ট হয় যে কীভাবে তারা নির্বাচনের ছক করেন। রাজনৈতিক গ্রেফতার এবং বিচারিক হয়রানি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিকল্পনার অংশ। এতে নির্বাচন প্রক্রিয়া ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। 

শেখ হাসিনা রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাজনীতিকরণ করেছেন। এর মধ্যে আছে বিচারবিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন বেসামরিক এবং সামরিক আমলাতন্ত্র। ক্ষমতাসীনদের প্রতি তারা অনুগত, অবৈধ নির্দেশ মানতেও তারা পিছপা হন না। ভিন্নমত দমন করতে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চালানোর জন্য শেখ হাসিনা এই প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যবহার করেন। 
জন নীপিড়নের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন একেবারেই উদাসীন। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ হিসেবে এটি ভুয়া সংস্থাগুলোর অনুমোদন দিয়েছে। এটিও প্রমাণ করে যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া হবে আসলে আপোষে। নিবার্চন কমিশন সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচনী প্রচারণা ব্যতীত সব রাজনৈতিক অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করার জন্য, এটিও তো উদ্বেগজনক। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন বস্তুত আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করেছে। এই পদক্ষেপ শুধু অনৈতিক, বেআইনি ও অসাংবিধানিকই নয়, এতে এও বোঝা যায় যে, নির্বাচন কমিশনের ওপর হাসিনার কী রকম প্রভাব রয়েছে। 

প্রশ্ন  : বিএনপির ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকে হাসিনার সরকারকে খুব বেশি প্রভাবিত করেনি। এই অবস্থায় কীসের ভিত্তিতে হাসিনা-সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে দুর্বল করার জন্য বিএনপি আগামী নির্বাচন বর্জনের আশা করছে? 

তারেক রহমান : যেহেতু গণতন্ত্র ও মানবাধিকার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে সংযোগ-সেতু তৈরি করে, তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সহাবস্থান তৈরি করা। বাংলাদেশের সঙ্গে যারা ব্যবসা করেন এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের সহযোগীরা, যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে তাদের নৈতিক সমর্থনের জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের জনগণ তাদের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলোর প্রশংসা করেছেন। যেমন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসা বিধিনিষেধ ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য এগুলো ছিল সাধারণ আহবান। এর সবই গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রশ্ন : শেখ হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় এলে দলের জন্য বিএনপির কর্মপরিকল্পনা কী? নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে ভোটাররা দলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে না?

তারেক রহমান : একেবারেই না। কারণ ভোটাররা এর মধ্যেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণেরই আবেগের বহিঃপ্রকাশ। এই অর্থবহ নির্বাচনের জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষা একইরকম। বস্তুত আমি বিশ্বাস করি, ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ একেবারেই ধ্বংস গেছে। একেবারে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তার অনেক নজিরও আছে। গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে নোবেল বিজয়ী, সাংবাদিক থেকে সুশীল সমাজ, ছাত্র থেকে পেশাজীবী- সমাজের সবাই মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা-বঞ্চিত। বিএনপির দাবির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা মিলে গেছে। সবাই শেখ হাসিনার পদত্যাগ চায়। আমাদের দল জনস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই জনসমর্থনের ভিত্তিতেই আমরা রাষ্ট্রের ৩১-দফা কাঠামোগত সংস্কার এবং ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নীতি প্রণয়ন করেছি। 

আসন্ন নির্বাচনে শুধু যে রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিতে পারবে না তা নয়, ভোটাররাও এতে অংশ নিতে পারবেন না। আমি বুঝতে পারি এটা কতটা বঞ্চনার। জনগণ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। হাসিনার অধীনে গত দুটি নির্বাচনে প্রায় ১২০ মিলিয়ন ভোটার ভোট দিতে পারেননি। যাদের মধ্যে আছেন ৩০ মিলিয়ন তরুণ ভোটার, যারা ২০০৯ সালের পর ভোটার হয়েছেন। এই অধিকার-বঞ্চিত ব্যক্তিরা ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করছেন। বিএনপির দাবিও এই একই। লিঙ্গ, ধর্ম, জাতি বা রাজনীতি নির্বিশেষে সব বাংলাদেশীর স্বাধীনতা, সমতা এবং সমৃদ্ধির ক্ষমতায়নের সর্বোচ্চ লক্ষ্যের জন্য বিএনপি ও জনগণ একে অপরের পরিপূরক।

প্রশ্ন : আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপি নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই নির্বাচন বর্জন করছে। দলের অনেক নেতা কারাগারে বা পলাতক। এ বিষয়টি কি বিএনপির নির্বাচন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তে কোনো ভূমিকা রেখেছে?

তারেক রহমান : কর্মী, সমর্থক এবং অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যার দিক থেকে যদি বিবেচনা করি তাহলে বিএনপি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। সাংগঠনিক শক্তিতে আমাদের মোকাবিলা করতে না পেরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রযন্ত্রকে লেলিয়ে দিয়েছে আমাদের পেছনে। ক্ষমতার অপব্যহার করছে। নৃশংসতা চালাচ্ছে। তৃণমূল থেকে আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাকমীর্দের ফাঁদে ফেলেছে। বিএনপির জনবান্ধব শক্তিকে এবং নিজের জনবিচ্ছিন্ন দুর্বলতাকে ভয় পেয়ে আওয়ামী লীগ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে যেন বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে। 

বিএনপির সিনিয়র নেতারা দুই বছর ধরে রায়ের মুখোমুখি। দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না, আওয়ামী লীগ এমন একটি আইনি বিধানকেও কাজে লাগিয়েছে বিএনপির নেতাদের প্রতিহত করতে। বিএনপির নেতাকর্মীরা নাশকতামূলক অগ্নিসংযোগ করেছে এমনই কাল্পনিক ঘটনার সাথে জড়িয়ে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, পক্ষপাতদুষ্ট রায় দেওয়া হয়েছে। আটক ব্যক্তিদের ঠিকমতো চিকিৎসাও হচ্ছে না। পুলিশ-হেফাজতেই তাদের অনেকের মৃত্যু হচ্ছে। আওয়ামী লীগের গুন্ডারা এবং পুলিশ একই সাথে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িতে আক্রমণ করে। তাদের গুলি করে মারার হুমিক দেখায়, নানা উপায়ে জব্দ করে, বাড়িতে বোমা মারে। যার ফলে আমাদের লক্ষ লক্ষ কর্মী বাড়িছাড়া হয়েছে। এমন অনেক ঘটনা আছে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে না পেয়ে তার আত্মীয়-স্বজনকে ধরে এনেছে, তাদের ওপর অত্যাচার করেছে। 

প্রশ্ন : আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের সপক্ষে যুক্তি দেখান যে, ২০০৬-০৮ সময়কালে বিএনপিই নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসম্মানিত করেছিল। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

তারেক রহমান : ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় প্রশাসন প্রবর্তন করে বিএনপি সরকার। বাংলাদেশের সংবধিানে এটি অন্তর্ভুক্ত করে। যা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নামে পরিচিত। সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অবাধ, সুষ্ঠু এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন পরিচালনার লক্ষ্যে জনগণের ম্যান্ডেট দ্বারা এটি সমর্থিত হয়েছিল। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ এই বিধানটি বাতিল করে। এতে দেশের মানুষ হতবাক হয়, ক্ষুণ্ণ হয়। কোনো বৈধতা ছাড়াই ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ এই পথ বেছে নেয়। 

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক নিযুক্ত “অ্যামিকাস কিউরি” তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রাখতে ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক দল, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, আইনবিদ, সুশীল সমাজের সদস্য এবং জাতীয় দৈনিক সম্পাদকদের সাথে পরামর্শ করে একটি সংসদীয় কমিটি সর্বসম্মতভাবে এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করেছেন। সবার দাবি অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনা তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার জন্য সংসদীয় কমিটিকে নির্দেশ দেন। 

প্রশ্ন : বিএনপিকে নিয়ে ভারতের চিন্তার একটি দিক হলো ইসলামপন্থী দলগুলোর সাথে বিএনপির ঐক্য। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর সাথে সম্পর্ক। বিএনপি শাসনামলে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো ছিল এবং ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ নিয়ে বিএনপি সরকারের তেমন চিন্তা ছিল না। আপনার মন্তব্য কী?

তারেক রহমান : একটি বড় দল হিসেবে বিএনপি সবার বিশ্বাসকে মর্যাদা দেয়। বিএনপি বিশ্বাস করে ধর্ম ব্যক্তির। কিন্তু রাষ্ট্র সবার জন্য। বাংলাদেশ সব ধর্মের দেশ। যার যার ধর্মের প্রতি এখানে সবার সমান অধিকার। আমাদের দল ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায় না। তবে বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সংবিধান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে, তাই এই তিনটি দেশেই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে।

ধরুন ভারতের চিন্তা শুধু জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে বিশেষভাবে। সেক্ষেত্রে জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্কের ইতিহাস রয়েছে। ১৯৬৬ সাল থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলাম একসঙ্গেই কাজ করেছে। একযোগে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছে। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য দুটি দল একযোগে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। ১৯৯৪-১৯৯৬ সালেও তারা একসাথে ছিল, এবং বিএনপির বিরুদ্ধে ছিল। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তারা একযোগে আন্দোলন চালিয়েছ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ যদি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করে তাহলে সমস্যা নেই? বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর জোট হলেই সমস্যা? 

অন্যদিকে, ভারতের উদ্বেগ যদি হয় ইসলাম নিয়ে, তাহলে উল্লেখ করতে হয় যে, একটি শরিয়াভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের জন্য ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ একটি লিখিত চুক্তি স্বাক্ষর করছিল। হাসিনাই কট্টরপন্থী ইসলামপন্থীদের আওয়ামী লীগের তাঁবুর নিচে টেনে নিয়ে এসেছেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা, এ. কে. এম বাহাউদ্দিন পূজা নিয়ে কটূ মন্তব্য করেন এবং কীভাবে দূর্গা পূজা করতে হবে তা হিন্দুদের শেখাতে গিয়েছিলেন। অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি নিজের দাবি প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করেন। তার মন্তব্যের সমালোচনা করায় তার সমর্থকরা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করতে যায়। হিন্দু নেতাদের সতর্কবার্তার পরেও তিনি আসন্ন ডামি নির্বাচনে আবারো মনোনয়ন পেয়েছেন। 

আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল হলো সন্ত্রাসবা
দ, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং চরমপন্থা মোকাবেলার জন্য একটি শক্ত সমর্থ যৌথ-প্রচেষ্টার ওপর জোর দেওয়া। বাংলাদেশের ভূখণ্ড কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর নয়, এ ব্যাপারে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

প্রশ্ন  :  ১৫ বছর ধরে আপনি বাংলাদেশ থেকে দূরে, আপনার দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন বিরোধীদলীয় নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রসহ একাধিক মামলায় দেশে জেল খেটেছেন। আপনাকে আসামী হিসেবে বিদেশী রাষ্ট্রের কাছেও প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। আপনার বক্তৃতা এবং মন্তব্যও বাংলাদেশে প্রচার নিষিদ্ধ। এমন কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। এর বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থাও রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি সমর্থকদের কী করে নেতৃত্ব দেবেন বলেন ভাবছেন? 

তারেক রহমান : শেখ হাসিনার সাথে আকস্মিক সম্পর্ক অবনতির পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে জোরপূর্বক বিচার বিভাগ থেকে অপসারণ করা হয়, এতেই বাংলাদেশের বিচার বিভাগেগর স্বাধীনতা বোঝা যায়। বাইরের সিদ্ধান্ত কীভাবে আদালতের রায়কে প্রভাবিত করে তাও স্পষ্ট করে। আরেকটি ঘটনার কথা বলি, হাসিনার চাপ সত্ত্বেও বানোয়াট মামলা থেকে আমাকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলন বিচারক মো. মোতাহার হোসেন। অবিশ্বাস্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জীবন বাঁচানোর জন্য তাকে পালিয়ে বিদেশে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এতেই বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা স্পষ্ট। চাকরি বাঁচানোর জন্য বিচারকদেরও পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হয়। 

বিচারিক অবিচারের প্ররোচনাকারী একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন আবদুল কাহহার আকন্দ, যিনি শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুসারে বেশ কযে়কটি সাজানো মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসাবে দাযি়ত্ব পালন করেছিলেন। আপনি যে মামলাটি হাইলাইট করেছেন তাতে তিনি আমার বিরুদ্ধে বানোয়াট দোষী সাব্যস্ত করেছেন, ঘটনার সাত বছর পরে অভিযোগপত্রে আমার নাম যুক্ত করেছেন এবং জাল প্রমাণ তৈরি করেছেন যার কোনও উপাদান নেই। অবসর গ্রহণের পর তিনি আসন্ন ডামি নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এই সম্পৃক্ততা, পা চাটলে পুরষ্কার পাবে, ভাবলেই আমার গা জ্বলে। 

হাসিনা সরকার শুধু আমাকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসায়নি, আমার স্ত্রীরও বিরুদ্ধেও কাল্পনিক অভিযোগ এনে মামলা সাজিয়েছে। অথচ রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আমাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছেন। আমার মা, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে জোরপূর্বক বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছেন। ওই বাড়িটি ছিল তিন দশকেরও অধিক সময়ের আমাদের পারিবারিক বসতি। তার বয়স হয়েছে। স্বাস্থ্যও খারাপ। তার উন্নত চিকিৎসা দরকার। পারিবারিক সান্নিধ্য প্রয়োজন। তিনি এই সব কিছু থেকে বঞ্চিত। আমি এবং আমার পরিবার গণতন্ত্রের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা থেকে আমরা অনুপ্রেরণা পাই। 

পরবাসে থাকলেও আমি গভীরভাবে বাংলাদেশের সত্তা ও মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত। সারাক্ষণই আমি সারা দেশের মানুষের সঙ্গে ফোনে ও অনলাইন মিটিংয়ে থাকি। প্রতিদিনই আমি দেখি আমাদের নেতাকমীর্রা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আরো নিভীর্ক ও দৃঢ়-সংল্পপের অধিকারী হয়ে উঠছেন। পরদিনই তারা পথসভা বা জনসভায় যোগ দিচ্ছেন। গণতান্ত্রিক আদর্শের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে পিছপা হন না। এই সাহস ও উদ্দীপনা দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই। জনগণের আপসহীন অবস্থানের প্রশংসা করি। ব্যবসায়ীদের, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের একত্রিত করতে আমার দিক থেকেও সর্বাত্মক চেষ্টা চলতে থাকে। শত দুর্ভোগ আর প্রতিকূলতার মুখেও এই বিশ্বাস থেকেই আমাদের আবেগ কাজ করে যে, আবারও আমরা একটি মুক্ত-স্বাধীন দেশে বাস করবো। 



স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য্য, 
ভারতের আলট্রা লেফট এবং হিন্দু রাইট বিষয়ক দুটি নন-ফিকশন বইয়ের লেখক। ভারতের রাজনীতি, পরিবেশ, মানবাধিকার এবং সংস্কৃতি নিয়ে লেখালেখি করেন।

মাহবুব মানিক ও বিএনপির হাজারো সাধারণ কর্মীর ত্যাগের স্মরণেঃ "সব মরণ নয় সমান"

— ড. সাইমুম পারভেজ





শেষ যখন মানিকের সাথে কথা হয়েছিলো তখন সে জেল থেকে কেবল বের হয়েছে। হঠাৎ করেই ফোন দিয়ে স্বভাবসুলভ জোরালো গলায় কিছুটা হাসি নিয়েই জেলজীবনের কথা বলছিলো। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, জেল এ কি খুব কষ্ট হয়েছিলো মানিক ভাই?
আমার প্রশ্নে মানিক কিছুটা থমকে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, "ভাই, খুব খারাপ অবস্থায় ছিলাম। জেলে যতজন থাকার কথা তার চেয়েও অনেক মানুষ গাদাগাদি করে রাখা। ঘুমাতে তো দূরের কথা, শুতেও পারি নাই ঠিকমতো। বেশীর ভাগই আমাদের মত বিএনপির নেতা-কর্মী। চোর-ডাকাতদের সাথেই ছিলাম। এ সরকার তো আমাদের চোর-ডাকাত বানিয়ে দিলো ভাই। বিএনপি করা কি এখন অপরাধ?"

মানিকের এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আলোচনা করার আগে জেনে নেই মানিক কে। মাহবুব মানিক চল্লিশোর্ধ এক যুবক। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপির মিডিয়া সেলের ডিজিটাল মিডিয়ার কাজগুলোর দেখভালের দায়িত্ব ছিলো মানিকের। বড় কোন রাজনৈতিক নেতা না, নিতান্তই নিরলস নিভৃতে কাজ করে যাওয়া এক কর্মী। 

গত ২৮ অক্টোবর ২০২৩ থেকে বিরোধী দল ও মতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের পেটোয়া বাহিনী যে নিপীড়ন চালাচ্ছে তারই অংশ হিসেবে মাহবুব মানিককে গ্রেফতার করা হয় বিএনপি চেয়ারপার্সনের অফিসের সামনে থেকে। কারাবাস শেষে মানিক বের হয় ১৯ নভেম্বর। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ সকালে মানিক মারা যায়।

সুস্থ-সবল যুবক মানিকের মৃত্যু কি স্বাভাবিক? আরো হাজারো বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের মত মানিক কি কারা হেফাজতে অথবা রিমান্ডে নির্যাতিত হয়েছিল? শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের চাপের কারণেই কি মানিকের মৃত্যু হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো একসময় জানা যাবে, বা কিছু প্রশ্ন অজানাই থেকে যাবে। 

কিন্তু যেসব প্রশ্নের উত্তর আমরা পাচ্ছি তা খুবই আশঙ্কাজনক ও হৃদয়বিদারক। গত জুলাই ২৮, ২০২৩ থেকে ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ পর্যন্ত মানিকের মত ২৪,৭৩৬ জন বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে শুধু বর্তমান সরকার বিরোধী হবার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে, ১০২৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে, ৯১,৬৩৭ জনকে এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে, ৯০৫৯ জন আহত হয়েছেন, আর হত্যা করা হয়েছে কমপক্ষে ২২ জনকে।

কিন্তু এই তালিকা কেবল সংবাদপত্রে ও বিএনপির দলীয় সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরো অসংখ্য মানুষকে গ্রেফতার, নির্যাতন, ও হয়রানি করা হয়েছে, যার সব তথ্য পাওয়া যায়নি। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ও মতের সমর্থক ও নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের সংখ্যাটি এত বেশী যে তা বাংলাদেশের কারাগারের ধারণক্ষমতার অনেক বাইরে চলে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে মানবেতর পরিস্থিতি।

আমাদের দেশের বিক্রি হয়ে যাওয়া সুশীল সমাজ, সবকিছু এড়িয়ে চলে নিজের লাইফস্টাইল ঠিক রাখতে চাওয়া মধ্যবিত্ত, আর সরকারী দলের অনুগত বুদ্ধিজীবিরা বলার চেষ্টা করেন যে গণতন্ত্র পুণরুদ্ধারের এই চলমান আন্দোলন কেবল বিএনপি বনাম আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দখলের লড়াই। 

তারা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারকে ত্যাগ করে দৃশ্যমান কিন্তু সারবত্তাহীন উন্নয়নকে বেছে নেন। আওয়ামী লীগ সরকার ও এর সুবিধাভোগী কিছু মানুষ ছাড়া এই "উন্নয়ন" বাকি সবাইকে দিনের পর দিন গরীব করে তুলেছে।  সাধারণ মানুষ, যাদের দৈনন্দিন জীবনে লুটপাট ও অর্থনৈতিক সংকটের ছাপ পড়েছে, তারা এই কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের জন্য সবচেয়ে বেশী জোরালো আওয়াজ তুলেছে।

ধরা যাক শাওন আহমদের কথা। পেশায় একজন শ্রমিক শাওন সেপ্টেম্বর ২০২২ এ বিএনপির প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেয়ার কারণে পুলিশের গুলিতে মারা যান। জুলাই ২০২২ এর হত্যা করা হয় আবদুর রহিম নামে এক কৃষককে। একই বছরের সেপ্টেম্বর এ শহিদুল আলম নামের একজন রিকশাচালক ও নভেম্বরে নয়ন মিয়া নামে একজন শ্রমিককে হত্যা করা হয়। ২৮ অক্টোবর ২০২৩ এর পর থেকে পুলিশ ও সরকারী দলের পেটোয়া বাহিনীর হাতে যারা মারা যান, যেমন শামিম মোল্লা, আব্দুর রশীদ, জাকির হোসেন, তারাও সাধারণ নেতা-কর্মী।

ফিরে যাই মৃত্যুর আগে মাহবুব মানিক আমাকে শেষ যে প্রশ্ন করেছিলো সে প্রসঙ্গে। বিরোধী দলের রাজনীতি করা কি অপরাধ? মানিক, শাওন, রহিম, শামিমের মত হাজারো নেতা-কর্মী নির্যাতিত হয়ে, প্রাণ দিয়ে, বারবার কারাগারে গিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই দিয়ে গেছেন। দিয়ে যাচ্ছেন। 

তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা আমাদের বারবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে যে, আমরা এমন একটি দেশ তৈরি করেছি, এমন একটি সরকারকে বৈধতা দিচ্ছি, এমন একটি নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক দলকে শাসনক্ষমতায় অবৈধভাবে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া থাকতে দিচ্ছি, যারা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে, রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডে জড়িত থাকার সার্বজনীন অধিকারকে 'ক্রিমিনালাইজড' করে ফেলেছে।

যে প্রশ্নের উত্তর এই দেশের সাধারণ জনগণ জানে, বুঝতে পারে, এবং নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে সংগ্রাম করে, তা কি বিক্রি হয়ে যাওয়া "শিক্ষিত শ্রেণী" বুঝে? এই প্রশ্নই এখন প্রাসঙ্গিক। 

বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকার আরেকটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের আয়োজন করেছে ৭ জানুয়ারি ২০২৪। এই প্রহসনের নির্বাচনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী জনগণের আন্দোলন চলছে। নির্বাচনের আগে ও পরে এই আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি কেমন হবে তা ভবিষ্যতই ঠিক করবে। 

কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, ইতিহাসের কোন বাঁকে, কোন দেশেই ফ্যাসিস্ট সরকারকে কে সরিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সহজ হয়নি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও অনেক প্রাণ, রক্ত, আর সংগ্রামের বিনিময়ে একদিন ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, জীবন ও জবানের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। 

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই শ্বাপদ-সংকুল যাত্রা যাদের প্রাণের বিনিময়ে, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাড়ি দিবো তাদের আমরা যেন ভুলে না যাই। পুলিশের গুলিতে মারা যাবার আগে শাওন তার ফেসবুকে লিখেছিলেন, "কর্মীর চেয়ে বড় কোন পদ নাই।"

ইতিহাস সবসময় রাজা-রাজড়াদের আরো মহান করে তুলে। শাওন ও মানিকের মত হাজারো সাধারণ মানুষের জীবন হারিয়ে যায়, থাকলেও চলে যায় ইতিহাসের ফুটনোটে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এসব "সাধারণ" কে আমরা যেন অসাধারণ করে তুলতে পারি।
মাহবুব মানিক মজা করে বলতো, "বিয়ে করবো গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে, হাসিনা সরকারের পতন হলে।"

মানিকের সে স্বপ্ন পূরণ হয় নি। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই আকুতি মানিক রেখে গেছে হাজারো প্রাণের মাঝে। 

মাহবুব মানিক এখন বাংলাদেশের হাজারো মায়ের "সোনা-মানিক"দের কাতারে শামিল, যাদের ত্যাগ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে অটুট রেখেছে।  

লেখক: ড. সাইমুম পারভেজ 
ব্রাসেলসভিত্তিক রাজনীতিবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষক

Monday, December 18, 2023

কৃষিমন্ত্রীকে অভিনন্দন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

পর্যালোচনাঃ 
শহীদুল্লাহ ফরায়জী



আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিএনপিকে ভোটে আনতে সব চেষ্টাই করেছে আওয়ামী লীগ। এমনকি একরাতে সব নেতাকে জেল থেকে মুক্তির প্রস্তাবেও বিএনপি রাজি হয়নি। বারবার নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি নির্বাচনে আসলে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া হবে। শুধু পিছিয়ে দেয়া নয়, বলা হয়েছে, সবাইকে জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হবে। বিএনপির ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার না করলে বাংলাদেশে আজকে হরতালের দিন গাড়ি চলতো না। এছাড়া আমাদের অন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না। বিকল্পও ছিল না। যেটা করেছি আমরা চিন্তাভাবনা করেই করেছি। তাদের জেলে না রাখলে দেশ অচল হয়ে যেতো।

মাননীয় কৃষি মন্ত্রীর কথায় যা স্পষ্ট হয়েছে তা হল, ২০ হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে বন্দি করে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সব চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে কোন সংলাপ বা কোন উদ্যোগ না নিয়ে তাদের ২০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে।

আমাদের সবার মনে থাকবার কথা, তফসিল ঘোষণার পূর্বে বিরোধী দলের সাথে সংলাপের জন্য অভ্যন্তরীণ এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও তা সরকারের পক্ষ থেকে  সরাসরি নাকচ করা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে কী কারণে নেতাকর্মীদের জেলে রেখে গোপন আঁতাতের প্রয়োজন পড়লো তা মাননীয় মন্ত্রীর কথায় বোধগম্য নয়।

নাশকতা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত ২০ হাজার নেতাকর্মীকে এক রাতে ছেড়ে দেওয়া যায়- এতে স্পষ্ট প্রমাণ হয়, ২০ হাজার নির্দোষ নেতাকর্মীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। একমাত্র শাহজাহান ওমর ছাড়া সরকারের সাথে গোপন সমঝোতার প্রশ্নে আর কেউ রাজি না হওয়ায় কারো মুক্তি মিলেনি। মাননীয় মন্ত্রীর কথায় সরকারের সাথে সমঝোতা হলে তাদের বিরুদ্ধে আনীত সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে এক রাতে সবাইকে মুক্ত দেয়া সম্ভব হতো। ২০ হাজার মানুষকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা এবং সমঝোতার ভিত্তিতে এক রাতে মুক্তি দেয়া এটি কোন গণতান্ত্রিক দেশে, কোন আইনের শাসনের দেশে, কোন রাজতান্ত্রিক দেশে, কোন কমিউনিস্ট শাসিত দেশে, কোন একদলীয় শাসিত স্বৈরাচারী সরকারের দেশেও সম্ভব নয়। এতে এটা প্রমাণ হয় বর্তমান বাংলাদেশ সরকার উপরোক্ত দেশসমূহের সরকারের চেয়ে একেবারে ভিন্ন। এটাকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হবে।


মাননীয় কৃষি মন্ত্রী আরো বলেছেন, বিশ হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার না করলে আজকে হরতালের দিনে গাড়ি চলতো না। এ ছাড়া আমাদের বিকল্প ছিল না। যেটা করেছি চিন্তা ভাবনা করেই করেছি। তাদের জেলে না রাখলে দেশে অচল হয়ে যেত।

১৯৭১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার যদি এই সরকারের অনুরূপ বিবেচনায় রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে পদক্ষেপ নিতো হয়ত ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের ঐতিহাসিক 
ভাষণ পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হতে পারত না, ২রা মার্চের পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চের ইশতেহার পাঠ সম্ভব হতো না। এমনকি  জাতি রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের স্বপ্ন অধরাই থেকে যেত।


নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারি ইস্যুতে অতীতে আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল করেছে, কিন্তু তখন তৎকালীন সরকার আওয়ামী লীগের ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের কথা বিবেচনা করেনি। অথচ বর্তমান সরকার রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা বা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে গ্রেফতার বা বল প্রয়োগের একমাত্র পথ অনুসরণ করছে, যা দেশকে গভীর রাজনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।  

প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী বিভাগ নাগরিককে ইচ্ছা বা সুবিধা অনুযায়ী অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করবে ও উদ্দেশ্য পূরণ হলে নির্বাহী বিভাগই কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে দিবে, তাহলে রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে এবং আইনের শাসন তথা রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তাই শেষ হয়ে যাবে।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা ও অবমাননার ফলে বাংলাদেশের জনগণ অত্যাচার ও উৎপীড়নের  বিরুদ্ধে সর্বশেষ উপায় হিসেবে ১৯৭১ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। সেই দেশে আবার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্যকে নিশ্চিত করে না।

সত্যের দুর্ভিক্ষে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী যে বয়ান উপস্থাপন করেছেন তার জন্য অভিনন্দন প্রাপ্য।

লেখক:
গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক

কার্টসি - মানবজমিন/ ডিসেম্বর ১৭, ২০২৩

Sunday, December 17, 2023

মাহবুব মানিক আর নেই



ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সদস্য, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) কাউন্সিলর এবং বিএনপির মিডিয়া সেলের ডিজিটাল বিভাগের প্রধান মাহবুব মানিক ইন্তেকাল করেছেন। শুক্রবার (১৫ ডিসেম্বর ২০২৩) সকাল ১১টায় রাজধানীর বসুন্ধরার বাসায় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে এভার কেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তিনি অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী ও আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন।

মরহুম মাহবুব মানিকের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করেছেন বিএনপির মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর। শুক্রবার (১৫ ডিসেম্বর ২০২৩) এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, মরহুম মাহবুব মানিক অত্যন্ত মেধাবী ও বিনয়ী সাংবাদিক ছিলেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ন। বিএনপির মিডিয়া সেল কর্তৃক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পালন করতেন।

শোকবার্তায় বলা হয়- গত ২৮ অক্টোবর তাকে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। গত ২০ নভেম্বর মুক্তি পান। এর কিছুদিন পরই মানিকের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত ও মর্মাহত। চলমান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন অগ্রসৈনিক। গণতন্ত্রের একজন যোদ্ধা হিসেবে তার নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার মৃত্যুতে মিডিয়া সেলের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। জাতি হারালো একজন দেশপ্রেমিক মেধাবী সাংবাদিক ও ভোটাধিকার এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অগ্রপথিককে। 

বিএনপির মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক বলেন, মহান আল্লাহর দরবারে মরহুম মাহবুব মানিকের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকাহত পরিবার, আত্মীয়-স্বজনসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন যেন মরহুম মাহবুব মানিককে বেহেস্ত নসিব করেন এবং শোকাহত পরিবারকে ধৈর্য ধারণের তৌফিক দেন, এই দোয়া করি।

Friday, September 8, 2023

আপনার জনগণ আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন ——— ইসরাফিল খসরু

আমরা যারা আশির দশকের গোড়ার দিকে জন্মেছি অথবা যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্মেছেন,  তাদের উভয়েই একটা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী।  আর তা হচ্ছে ১৯৯০’র স্বৈরশাসনের পতনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পালা পরিবর্তনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যা আমাদের মনন ও মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে গ্রোথিত হয়ে আছে। 

দশ বছর বয়সী এক কিশোরের চোখে আমি সেই সময়টি দেখেছিলাম, দেখেছিলাম চট্টগ্রামের রাস্তায় প্রতিবাদমুখর জনতার মিছিল, অনুভব করেছিলাম আসন্ন সামগ্রিক সম্ভাবনার সোনালি ভোর। মনে হচ্ছিল আমরা আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি নতুন ভোরের সাক্ষী হতে যাচ্ছি। তখন আমি অভ্যাসগতভাবে যে কাজগুলো করতাম তার মধ্যে একটি হলো আমার বাংলা শব্দভান্ডার উন্নত করার জন্য  সংবাদপত্র  পড়া,  সেই সংবাদপত্রের পাতায়ই প্রথমবারের মতো বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে আমার প্রথম জানা। সেই পত্রিকার পাতায়ই আমার চোখ নিবদ্ধ হয়েছিল সাধারণ সাদা শাড়ি পরা একজন নারীর ছবির প্রতি, যার মুখাবয়ব ছিল দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ, যিনি হ্যান্ডমাইকে উৎসুক জনতার প্রতি বক্তব্য রাখছিলেন। সেই প্রতিচ্ছবি এখনো আমার মনে খোদাই করা আছে। 

পরিবারের সিনিয়র সদস্যরা আমাকে ছবিটির ব্যক্তি সম্পর্কে জানিয়েছিলেন যে  তিনি কোন সাধারণ মহিলা নন, তিনি শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম-এর পত্নী এবং চলমান  স্বৈরাচার এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রধান নেত্রী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির চেয়ারপার্সন । এই বিষয়ে দুটি মৌলিক তথ্য আমাকে কৌতূহলী করেছিল এবং ছোটবেলায় আমার উপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। 

প্রথম বিষয়টি ছিল যে একজন নারী এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন এবং দ্বিতীয়ত, তাঁর পূর্ব কোন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না যা তাঁকে এমন একটি বিশাল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে সহায়তা করতে পারে। পুরুষ শাসিত এমন একটি সমাজে সহস্র বাধা ডিঙ্গিয়ে যিনি এক দশক ধরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম করেছিলেন, বাংলাদেশের ভাগ্যকে সুনিশ্চিত করেছিলেন ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করেছিলেন, তিনি কোন সাধারণ নারী নন।  তিনি অবশ্যই কোন সাধারণ নারী ছিলেন না, তিনি আমাদের ত্রাণকর্তা ছিলেন। আমি সবসময় তাকে এভাবেই দেখেছি এবং এখনও সেইভাবেই জানি।

আমার উৎসুক কিশোর মন তাঁর সম্পর্কে আরো জানতে আগ্রহী হয়ে উঠে। অনুসন্ধানে আমি জেনেছিলাম কীভাবে তিনি একটি রাজনৈতিক দল যেটি ছিল একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে, তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি সেই দলটিকে এক বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত করেছিলেন যা আশির দশকে দীর্ঘ নয় বছর রাজপথে জনপদে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করেছিল। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর তিনি তৃণমূল থেকে বিএনপিকে গড়ে তোলার কাজে হাত দেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিনি জনসমর্থন তৈরি করতে এবং উপযুক্ত প্রার্থীদের খুঁজে বের করার জন্য সারা দেশে সফর করেছিলেন। তাঁর একক জনপ্রিয়তাই বিএনপিকে ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী করে এবং দলটিকে বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিতে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তিনি একজন আপসহীন নেত্রী হিসাবে ক্রমাগ্রত নিজেকে নিজে অতিক্রম করেছিলেন।  শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যদি বিএনপির আদর্শিক মেরুদণ্ড হন তাহলে বেগম খালেদা জিয়াই তৈরি করে ছিলেন দলের সাংগঠনিক ভিত্তি। 

১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউজে দূর থেকে তাকে প্রথম দেখার স্মৃতি আমার মনে আছে। তার সেই মুখ তখনও সেই পত্রিকার পাতায় আমার দেখা সেই দৃঢ় সংকল্পকে উদ্ভাসিত করছিল যিনি সকল প্রতিকূলতাকে পরাজিত করে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, এই কৃতিত্ব, এই অর্জন কেউ তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেন না। 

আমার বাবা ১৯৯১ সালে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হন, এরপর রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে দীর্ঘ সময় বেগম খালেদা জিয়াকে পর্যবেক্ষণ করলেও,  আমার উপর ছোটবেলায় ব্যক্তি বেগম জিয়ার সেই প্রভাবই স্থায়ীভাবে রয়ে গেছে। বেগম খালেদা জিয়া নিজে উদাহরণ তৈরি করেছেন যে আমাদের সমাজের মহিলারা দৃঢ়সংকল্প এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। এটি আমাকে আমাদের সমাজে মহিলাদের কাজের সম্ভাবনা ও গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন ইতিবাচক ভাবনায় উপনিত করেছিল।

এখন তিন দশক পরে এসে আমরা ১৯৯০-এর মতো একই দুর্দশার মুখোমুখি হয়েছি। আমরা এখন এমন একটি শাসনব্যবস্থায়  রয়েছি যেখানে বিরোধীমত ও মানুষ কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছেন, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা অনুপস্থিত এবং ক্ষমতায় তাদের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার জন্য তারা বিচার বিভাগকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৯৯০ এর এর বিপরীতে, এখন অসুস্থ খালেদা জিয়া তাঁর জীবনের জন্য লড়াই করছেন যখন সরকার তাঁর সর্বোত্তম চিকিৎসায় বাধা দিয়ে চলেছে। কিন্তু এটা লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে গত কয়েক বছরে তার প্রতি  ঘটা সরকারি হিংসাত্নক আচরণ ও কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও, তিনি এখনও সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অসীম ধৈর্য এবং আপসহীনতার প্রতীক হয়ে সারা জাতিকে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন । একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে বিগত এক দশক ধরে নিশ্চিহ্ন করার যে অপচেষ্টা চলেছে তার বিপরীতে দলটি যে টিকে আছে, তা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব এবং ধৈর্যেরই প্রমাণ। এইভাবে, একজন অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার জন আশা-আকাঙ্ক্ষার সম্মিলিত প্রতীক হয়ে আছেন এখনো।   

আমার জন্য, আমার মধ্যে থাকা কিশোরটি এখনও বিশ্বাস করে যে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানুষের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে আমাদের পরিত্রাতা হিসেবে,  পথপ্রদর্শক হিসাবে আমাদের কাছে ফিরে আসবেন। তাঁর অদম্য জীবন ও পথচলা আমাদের জন্য আদর্শ  এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও আদর্শ হয়ে থাকবে। সুস্থ হয়ে উঠুন বেগম খালেদা জিয়া, আপনার জনগণ আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন এবং লড়াই কিন্তু শেষ হয়নি।

— লেখক একজন উদ্যোক্তা।