তখন ১৯৬৯-এর প্রান্ত ছুঁই ছুঁই। দেশের রাজনীতির ঈশান কোণে প্রলয়ের ইশারা। মজলুম জননেতা আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ঝড়ো নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আসসালামু আলায়কুম জানিয়েছেন। টলেছে পাকিস্তানি হুকুমাত। আবির্ভাব হয়েছে ক্ষমতার মঞ্চে ব্ল্যাক ডগব্র্যন্ড ইয়াহিয়া খানের। তিনি দিলেন পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচন এলএফও’র আওতায়।পুর্বাঞ্চলের রাজনীতিতেএলো সাজসাজ রব। বঞ্চিত এদেশবাসীর দাবি আদায়ের মোক্ষম সুযোগ। আর ঠিক সেই সময়ে নেমে এলো দেশের স্মরণকালেরইতিহাসের ভয়াল করাল প্রকৃতির রুদ্ররোষ। মহাবিপর্যয়, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন, বেজে উঠলো ধ্বংসের প্রলয় বিষাণ। ভীমবেগে আছড়ে পড়লো উপকূল এলাকায় দানবিক জলোচ্ছাস। নিয়ে গেলো ১৫ লক্ষাধিক প্রাণ। জননেতা মওলানা ভাসানী আহবান জানালেন, ভোট স্থগিত করে জীবিত-মৃত মানুষের দাফন-কাফন ও ত্রাণে নামতে। সাড়া মিললো না কারও কোথাও। এ নিয়ে দেখাদিল তুমুল বিতর্ক। মানুষ আগে না রাজনীতি আগে? ঠিক এই পর্যায়ে ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’ -এর অসাধারণ ও অবিস্মরণীয় সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ গাইলেন ভাসানীর ভূমিকার সমর্থনে জাতির জন্য অসাধারণ তাৎপর্যময় এক প্যারোডি -- ‘ভাতের আগে ভোট দিয়া , স্বর্গেতে যামুগা, ইলেকশন কইরা স্বর্গেতে যামু গা!’
আগস্ট ২০১৭, যমুনায় নামা কুলপ্লাবী বন্যায় গোটা প্রায় উত্তরবঙ্গের ৩৩ জেলা তলিয়ে গেছে যখন কথাটা বন্যার্ত প্রায় কোটির বেশি মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বা এখনও পাচ্ছে --- ভাতটা ভোটের আগে না ভোটের পরে। তখন যদি কেউ এসে বলে ‘তয় ভাত খাওয়ামু, শুধু কথা একখান ভোট দিতে হইব!’ কেমন লাগবে আপনার!’
এ হলো রাজনীতির । বলাবাহল্য ক্ষমতার রাজনীতির। এখানে রাজনীতি আর আবেগের নয় কাঠখোট্টা নির্মম বুদ্ধির। অঙ্কের মতো হিসেবের। সেই ৭০ শতকের উন্মাদ পাকিস্তানীদের মোকাবেলায প্রধান বিরোধী দল সেদিন ভাসানীর বিরোধিতা করেছিল। যা বলেছিল তার মর্মার্থ ছিল : রাজনীতি আগে, ভাত পরে। সেদিন উপকূলের বিভীষিকাময় বিধ্বস্ত জনপদে কারা মরে পড়ে আছে, কারা খায়নিতার জন্য রাজনীতি অপেক্ষা করেনি। প্রধান বিরোধী দল তাই সেখানে কার্যত ত্রাণে যায়নি। নির্মম, নিষ্ঠুর হলেও সত্য --- পাকিস্তানী শাসকরা কেন উপদ্রুত এলাকায় আসলেন না তানিয়ে অভিযোগের রাজনীতির দায়সারা কাজ করে নির্বাচনের রাজনীতির পাশা খেলায়মত্ত হলেন। লাশের ওপর দিয়েই বলতে গেলে নির্বাচন হলো। জলোচ্ছ্বাসের বিভীষিকা দেখতে ইয়াহিয়া খান আসেননি। তবু নিষ্ঠুর পরিহাস হলো পাকিস্তানী সেনারাই প্রধানত লাশ দাফনের কাজটি করলো। আর ওমরাও খানের মতো স্বৈর শাসকও অমর হয়ে রইলেন বিশেষত কক্সবাজারের মানুষের কাছে।
কথায় আসি বন্যা নিয়ে রাজনীতির। বন্যা নিয়েও রাজনীতি যে হতে যে পারে না তা নয়। তবু শরমের কিছু বালাই অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। মানূষ যখন নিছক প্রাণের দায়ে ভিক্ষার হাত পাতছে, না পেয়ে আকাশ পানে চোখ তুলে অশ্রু সজল চোখ ফিরে যাচ্ছে আপাত ঠিকানাবিহীন কোনো ডেরায় তখন ভাতের লোভ দেখিয়ে ভোট শিকারের এ কোন অমানুষিক বর্বরতা!
তবে রাজনীতি, রণক্ষেত্রে ও দেহজ প্রেমের নাকি কোনো নীতিই নেই। অথচ চীনের হাজার বছর আগের রণবিদ যে কথা বলে গেছেন, তাতে দেখা যায় আসলে তা থাকা উচিত। রণনির্মমতায় রীতি ও নীতি দুই-ই অছে। শত্রুর ফসল, পরিবেশের ক্ষতি করার,অপপ্রয়োজনে প্রাণনাশের কোনো বিধানই নেই। আমাদের রাজনীতির বাস্তবতা হলো ছল-বল-কৌশল।
আসা যাক, কৌশল প্রসঙ্গে। বলাবাহুল্য কৌশল জনগণের সাথে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। সকল রাজনৈতিক দলই এটা করে থাকেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রই তা শালীনতার সীমা লঙ্খন করে। যেমন, কেউ বললো বারোটা ‘বাজাদল’ কেউ বললো ‘বা-- দল’। পপুলিশ্ট রাজনীতিতে এ্সব একটু আধটু হয়েই থাকে। কিন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর তাৎপর্য় অসাধারণ! দৃষ্টান্তে আসা যাক।যেমন ধানের শীষ কাটো, নৌকা ভরো। আমরা নৌকা , ধানের শীষ আর লাঙল আমাদর জীবনে কী তাৎপর্যের দাবিদার সে আমরাজানি। এ নিয়ে মামলা মোকর্দমাও হয়েছে। যেমন, ‘আগে জানলে, ... আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’ এই বিখ্যাত লোকগানটির গাওয়াও বন্ধ হযে গেছে।
বানভাসি মানুষের চলতি আবেগের কাছে ভোট ভিক্ষা মনোবিজ্ঞানী পাভলভের সেই বিখ্যাত ‘স্টিমুলাস অ্যান্ড রেসপন্স’-এর কথাই মনে পড়ে যায়। সেটি হলো কুকুরের সামনে ঘণ্টা বাজানো। কুত্তা বুঝবে খাবার আসছে, সেটা প্রকৃতপক্ষে আসুক বা নাই আসুক। বন্যার্তর অহায়তা নিয়ে এই পরীক্ষাটা আর যাই হোক শালীনতা হতে পারে না, এটা এক বর্বর রসিকতা। তবে এ নিয়ে আর নয়।
একটা ছোট্র টেলপিস দিয়ে শেষ করি। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘সোনার তরী’র কয়েকটি চরণ। এতে একটি শব্দ মাত্র বদলানো হয়েছে ---
রাশি রাশি ভারা ভারা
শীষ কাটা হল সারা,
--------------
--------------
আর আছে?--- আর নাই, দিয়েছি ভরে।
---------------
---------------
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে---
এখন আমারে লহ করুণা করে।
----------------------
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই--- ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শীষ কাটা হল সারা,
--------------
--------------
আর আছে?--- আর নাই, দিয়েছি ভরে।
---------------
---------------
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে---
এখন আমারে লহ করুণা করে।
----------------------
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই--- ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।