Search

Saturday, October 19, 2019

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত বলেই নৃশংস ঘটনা ঘটছে


রোকেয়া হায়দার

‘আমি হতে চেয়েছিলাম ব্যারিস্টার। সাংবাদিক হবো- এমন স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষাই ছিল না। তবে যখন যা করেছি নিষ্ঠার সঙ্গেই করেছি। নিজেকে একজন নারী সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিতে কখনই স্বস্তিবোধ করি না’- বলছিলেন রোকেয়া হায়দার। যিনি বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। সাংবাদিকতায় দৌড়ঝাঁপে পোশাক বিন্যাস বড় বিষয়। কিন্তু তিনি একাট্টা। শাড়িতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

বাঙালিয়ানাকে সঙ্গী করে দুনিয়া ঘুরেন। পশ্চিমা দুনিয়ায় বড় বড় সেমিনার আর খেলার মাঠে খবর খুঁজে ফেরেন এ পোশাকেই। কাজের ক্ষেত্রে এ পোশাক নেতিবাচক না হয়ে বরং ইতিবাচক- এমনটাই মনে করেন তিনি। বলেন, এর জন্য বাড়তি সুবিধাও পেয়েছি। দুনিয়ার তাবৎ মিডিয়াকে ফিরিয়ে দিলেও মাদার তেরেসাঁ তাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন শাড়ি পরা দেখেই।

রোকেয়া হায়দারের সাংবাদিকতা শুরু বিটিভি দিয়ে। খবর পড়তে ভালোবাসতেন। ১৯৮১ সালে পাড়ি জমান ওয়াশিংটনে। ভয়েস অব আমেরিকাতে। একমাত্র নারী প্রতিনিধি হিসেবে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। কালে তিনিই ২০১১ সালে বাংলা বিভাগের প্রধান হন। পরে একই বিভাগের ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দায়িত্বও লাভ করেন। কোনো আন্তর্জাতিক মাল্টিমিডিয়া প্রতিষ্ঠানে বাংলা বিভাগের প্রধান হওয়ার কৃতিত্ব তারই। নিজ কর্মদক্ষতার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ১৯৯০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। স্পষ্ট উচ্চারণ, বলিষ্ঠ কণ্ঠ আর দৃঢ়চেতা মনোভাব এই মানুষটিকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। যিনি বিশ্বাস করেন সততা, সাহস আর ইচ্ছা থাকলে নির্ভয়ে যেকোনো খবর প্রকাশ সম্ভব। জোর দিয়ে বলেন, কাউকে তুষ্ট করার জন্য সাংবাদিকতা করবো এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মুক্ত গণমাধ্যম, মিডিয়ায় সেল্‌ফ সেন্সরশিপ, কনফ্লিক্ট  রিস্যলুশান নিয়ে মানবজমিনের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।

দীর্ঘ পথপরিক্রমায় কোনো প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েছেন কিনা?

কোথাও কোনো প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়িনি। বিরাট কোনো দুর্ঘটনাও ঘটেনি। তবে পেশাগত অভিজ্ঞতায় কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছি। তা হচ্ছে প্রেস ফ্রিডম বা যেটাকে আমরা বলি মুক্ত গণমাধ্যম তা নিয়ে। একজন সাংবাদিকের পুরোপুরি প্রেস ফ্রিডম এখনো নেই। আমার কাজের শুরুতেও তা ছিল না। বর্তমানেও তা সীমিত। আর তা কেবল বাংলাদেশেই নয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেই এ অবস্থা বিদ্যমান। এখানকার মিডিয়ায় এখনো কথা বলার অধিকার সীমিত।

আমি দেখেছি, এখানে সকলেই চিন্তাভাবনা করে কথা বলে। বর্তমানে মিডিয়া বেড়েছে, পত্র-পত্রিকা, রেডিও বেড়েছে বলে হয়তো অনেককেই সোচ্চার হতে দেখা যায়। কিন্তু আমি জানি না, কতজন নির্ভয়ে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারছেন। কারা নির্ভয়ে কথা বলতে পারছেন? বুয়েটে সাম্প্রতিক সময়ে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড থেকে কিছুটা হলেও কি প্রমাণিত হয় না যে, নির্ভয়ে কথা বলার অধিকার এদেশে এখনো সীমিত। বুয়েটের মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যেখানে মেধাবী ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করতে যায় সেখানে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি, সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত বলেই এ ধরনের নৃশংস, বর্বরোচিত ঘটনা ঘটছে। এটা খুবই দুঃখজনক।

ভয়েস অব আমেরিকাতে দীর্ঘদিন কাজ করছেন, দু’ একটি অভিজ্ঞতার কথা বলবেন?

আমাদের টার্গেট এরিয়া বাংলাদেশ এবং দুনিয়ায় যেখানে বাংলাদেশিরা আছেন। আর সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করি। একটু লক্ষ্য করে দেখবেন, ভয়েস অব আমেরিকাতে আমরা নির্দ্বিধায় লিখছি, পড়ছি। দেশের সর্বোচ্চ পদে যিনি আছেন তার বিরুদ্ধেও বা তার পক্ষে যা কিছু বলার প্রয়োজন হলে তা অত্যন্ত সোচ্চারভাবেই আমরা বলছি। সেখানে সরকারি কোনো চাপ নেই, আমরা নির্দ্বিধায় যা বলার তা বলতে পারছি। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রে যে ধরনের সমালোচনা তা প্রচার করছি। বহু গণতান্ত্রিক দেশেই তা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে কীভাবে দেখেন যুক্তরাষ্ট্রে বসে?

বাংলাদেশের গণমাধ্যম কর্মীদের বলবো, তোষামোদের রাজনীতি না করে কিছুটা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ঝুঁকি নিতে। আমি কাউকে তুষ্ট করার জন্য সাংবাদিকতা করবো এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যদি কোনো সুবিধা লাভের আশায় সাংবাদিকতা করি তাহলে বিষয়টি অন্যরকম হবে। বহু দেশেই আমরা দেখি অনেকে থাকেন যারা সাংবাদিকতার তকমা লাগিয়ে বাড়তি সুবিধা আদায়ের চেষ্টায় লিপ্ত থাকেন, যার মাধ্যমে বিশেষ সুযোগ পাওয়া যায়। বাংলাদেশেও এ ধরনের ঘটনা কমবেশি ঘটে থাকে। এটা কীভাবে ঘটে? যেমন আমি একজনের বিষয়ে কিছু তথ্য জানি। এখন আমি যদি তাকে গিয়ে বলি, তার বিষয়ে আমার কাছে তথ্য আছে তা আমি প্রকাশ করবো। সাংবাদিক শুনে অনেকেই শঙ্কিত হন। অনেকেই আছেন এমন একটা অবস্থানে থাকেন তারা চান না তাদের বিষয়ে কিছু প্রকাশ হোক। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে অসৎ সাংবাদিকরা সুযোগ নিয়ে থাকে।

সরকার বলছে, মিডিয়ায় সেন্সরশিপ নেই, কিন্তু একটি সেল্‌ফ সেন্সরশিপ আলোচনায় আছে?

দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়া ছাড়াও অনেক বড় দেশেও সেল্‌ফ সেন্সরশিপ রয়েছে। অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশেও এটা লক্ষ্য করা যায়। আর স্বৈরশাসন যেসব দেশে সেখানে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এটা পারসন টু পারসন ভেরি করে। কথা হচ্ছে,  আমি সাংবাদিক হিসেবে সেই সুবিধা নিতে চাই কিনা। আমি সত্য প্রকাশ করলাম তার প্রতিক্রিয়া কি হলো, কে কি ভাবলো, কতটা ভীত সেটা ভেবে আমি কতটা সন্ত্রস্ত বা আমি চাই না এ ধরনের কোনো পরিস্থিতিতে পড়ি।

খবর প্রচারের ক্ষেত্রে হয়তো এ বিষয়গুলো কাজ করে। ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই ভাবেন যে, আচ্ছা এই খবরটি আমি প্রকাশ করবো এর প্রতিক্রিয়া কি হবে? আমি একটু যাচাই করে, চিন্তাভাবনা করে দেখি। এই খবরটি প্রকাশ করে আমারই বা কি লাভ হচ্ছে আর তার প্রতিক্রিয়ায় আমি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। এই যে আমি ভাবি, এটা করে আমার কি লাভ হবে, এটা ভেবে অনেকেই চুপ করে যান। আবার অনেকেই মনে করেন যে, না এটা আমাদের বলা উচিত। এরকম কিছু মানুষ মিডিয়ায় আছেন যেটা আমরা আশা করি। কথায় আছে, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে। অর্থাৎ উভয়েই সমান অপরাধী। হয়তো এসবের মধ্য থেকেই সত্যিকার সাহসী সাংবাদিক বেরিয়ে আসবে এবং যার পদাঙ্ক অনুসরণ করবে অনেকেই।

বাংলাদেশে সৎ, সাহসী সাংবাদিকতা নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

ধারা একদিন না একদিন পাল্টে যাবেই। পাল্টাতে বাধ্য। আমি যদি সারাজীবন মনে করি, না একইভাবে চলবে তা হবে না। আপনি নিজেই দেখুন, এতকিছু আড়াল করার পরও এখন অনেক কিছু বেরিয়ে আসছে। এখন অবাধ সংবাদ সরবরাহের দিন। আপনি মোবাইলে একটি চিত্র ধারণ করলেন বা সিসিটিভির একটি ফুটেজ সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে দিলেন তা তো আমি অস্বীকার করতে পারি না। আপনার মুঠোফোন এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। যেটাকে আমরা সিটিজেন জার্নালিজম বলছি। আপনি যদি অন্যায় কিছু চিন্তা করেন যে, আমি একটি ছবি তুলে আটকে দেবো, সেই মনোবৃত্তি ছাড়া আমি সঠিক তথ্যটি তুলে ধরবো এমন চিন্তা করলে, সততা নিয়ে কাজ করলে, আপনি সমাজের অনেক চিত্রই তুলে ধরতে পারবেন।

কি চেয়েছিলেন আর কি হলেন?

ব্যারিস্টার হতে চেয়েছিলাম। সাংবাদিক হওয়ার চিন্তা ছিল না। বাবা-মা চেয়েছিলেন ডাক্তার হই। আমার খবর পড়তে ভালো লাগতো। সেই ভালোলাগা থেকেই এতদূর। অমি নিজেকে এখনো পুরোপুরি সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি বলে মনে করি না। এ পেশায় এসেও অনেক কিছু করতে চেয়েছি কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। চার ছেলেমেয়েকে দেখাশুনা করার জন্য অনেক সময় দিতে হয়েছে। তবে যেটাই করতে চেয়েছি, সেটা একেবারে সর্বোচ্চ মানে গিয়ে করবো তা ভেবেছি সবসময়। যাই করি খুব ভালোভাবে করবো এবং নিষ্ঠার সঙ্গে করবো এবং সেটাই লক্ষ্য ছিল। বিখ্যাত হবো বা নাম করবো এমন কোনো লক্ষ্য ছিল না। চার দশকের সাংবাদিকতায় মনে হয়েছে, টেলিভিশনে যখন খবর পড়েছি সে সময়ই আমার কাছে স্বর্ণযুগ। কেউ দূর দেখে দেখলে এখনো বলে, আপনি বাংলাদেশের খবর পাঠিকা। এই যে খবর পড়ে এতটা জনপ্রিয় হওয়া যায়- এটা ভাবতেই ভালো লাগে।

নিজেকে নারী সাংবাদিক বলতে নারাজ?

এটা আমার একদম ভালো লাগে না। নারী সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে স্বস্তিবোধ করি না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমি একজন মানুষ। আমি যদি ডাক্তার হতাম আর খুব ভালো কাজ করতাম তাহলে আমাকে কেউ মহিলা ডাক্তার হিসেবে দেখলে আমি এটাও পছন্দ করতাম না। তেমনি আমার খুবই অপছন্দ নারী সাংবাদিক বলাটা। আমি যে পেশায় আছি সে হিসেবে পরিচিত হতে চাই। সেই কাজের স্বীকৃতি চাই। আমি কতটা ভালো কাজ করতে পারছি তার স্বীকৃতি চাই নারী বা পুরুষ হিসেবে নয়। তবে হ্যাঁ কথা থাকে হয়তো নারীদের জন্য সাংবাদিকতা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন। সেটা তো অন্য পেশার সময়ও আছে। একটি পরিবারে বাবা যদি একদিন রান্না করেন তাহলে তাকে বাহবা দেয়া হয়, কিন্তু মা তো প্রতিদিন রান্না করেন তার কাজের স্বীকৃতিটা কে দেয়? ঠিক তেমনি নারীদের যেকোনো কাজে সফলতা আনতে হলে দ্বিগুণ না দশগুণ কাজ করতে হয়। এখন নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে এসেছে। তারা সর্বস্তরে কাজ করছে। রাস্তার ইট ভাঙা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা পর্যন্ত নারীরা। পোশাক শিল্পে কাজ করে নারীরাই আশি শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন দেশের জন্য। যেমন খেলাধুলার মাঠেই বলুন, আগে মেয়েদের খুব একটা দেখা যেত না। এখন অনেক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসছে মেয়েদের থেকে। একইভাবে মেয়েরা আগের চেয়ে অনেক বেশি হারে সাংবাদিকতায়ও এসেছে। আমি যখন শুরু করি ১৯৮১ সালে, তখন ভয়েজ অব আমেরিকাতে একজন মাত্র নারী কাজ করতেন। আজ দিন বদলেছে সেখানেও।

সাংবাদিকতায় স্পোর্টস বাছাই করলেন কেন?

আমার বাইরে বেড়াতে খুব ভালো লাগতো। আর খেলার মাঠে যাওয়া মানেই বাইরে যাবার সুযোগ। অন্যদিকে খেলার মাঠে প্রাণের জোয়ার, তারুণ্যের জোয়ার দেখা যায় তা অন্য কোনো কিছুতে সম্ভব নয়। তারুণ্যের জোয়ার দেখতে মাঠে যেতে আমার খুব ভালো লাগে। খেলার মাঠে অবাধে চলাফেরা করতে পারতাম, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতাম- এটাও একটা কারণ। সেখানে কোনো রাজনৈতিক চাপ ছিল না। ফলে খুব সহজেই স্পোর্টস নিয়ে কাজে মেতেছি। খেলার মাঠে বড় বড় তারকাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। কিংবদন্তির ফুটবল তারকা পেলের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, সেফ ব্লাটারের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। বিশ্বকাপ ফুটবলের ট্রফি ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।

মাদার তেরেসাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন?

এটি একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। আমেরিকাতেই মাদার তেরেসাঁ এসেছিলেন তার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখতে। সেখানেই ওনার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। আমি যখন মাইক্রোফোন নিয়ে ওনার সাক্ষাৎকার চাইলাম প্রথমদিকে তিনি মাইক্রোফোন সরিয়ে দিয়েছিলেন। তখন আমি বললাম, আমি আপনারই দেশ থেকে এসেছি। আমি বাঙালি। আমার পোশাক দেখেই বুঝতে পারছেন, আমি আপনাদেরই লোক। তারপর তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। এটা আমার জীবনে অসাধারণ পাওয়া।

তরুণ প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্য আপনার কি পরামর্শ?

একটাই কথা বলবো, প্রেস ফ্রিডমে বিশ্বাস করেন। সততার সঙ্গে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করেন। আমি অন্তত এটি বলতে পারি, যতদিন সাংবাদিকতা করছি নির্ভয়ে এবং সততার সঙ্গে করছি। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভয়েস অব আমেরিকা শুরু হয়েছিল দুটি লাইনের ওপর ভিত্তি করে- খবর ভালো হোক মন্দ হোক, আমরা প্রকৃত তথ্য তুলে ধরবো। এতদিন পরও এর ভিত্তিতেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি প্রেস ফ্রিডম নিয়ে।

কখনও সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সমস্যা হয়েছে?

কনফ্লিক্ট রিস্যলুশান বলে একটি বিষয় আছে। আমি এই প্রশিক্ষণও নিয়েছিলাম। যেখানে বলা হয়েছে দু’পক্ষেরই কথা শুনতে হবে। অন্যের মতকে গুরুত্ব দিতে হবে। সবসময় নিজের মত ঠিক নাও হতে পারে। এটা তো আমার কাজের জায়গা। সুতরাং অনেক কিছু মেনে নিতে হয়।

কার্টসি — মানবজমিন/ অক্টোবর ১৯, ২০১৯।


Thursday, October 17, 2019

বিচার কত দূরে





সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা  তাদের নিয়ন্ত্রিত টর্চার  সেলে নিয়ে ঘণ্টার পর  ঘণ্টা ধরে নির্মমভাবে পেটাতে পেটাতে মেরেই ফেলল বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে। তার অপরাধ তিনি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করেছেন। বুয়েটসহ সারা দেশে যখন আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে তখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে দেখা করেন নিহত আবরারের পরিবারের সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত করা হবে। তারা যে দলেরই হোক

এর আগে ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড, লক্ষীপুরে এডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড সহ প্রায় সব আলোচিত হত্যাকাণ্ডের পরই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা একই রকম আশ্বাস দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারের উদাহরণ টেনে সরকারদলীয়রা বলে থাকেন, দেশ বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হয়েছে। সরকারের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত এগারো বছরের ব্যাপক আলোচিত ও নৃশংস কয়েকটি ঘটনায় বিচারের সর্বশেষ অবস্থা জেনে নেওয়া যাক।



এক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর ছিদ্দিক হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতাকর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পেয়েছেন। আট মাস আগে এই মামলার রায় হয়েছে। কিন্তু আবু বকরের বাবা-মা, এমনকি বাদীকে রায় সম্পর্কে জানানো হয়নি। হত্যাকারী চিহ্নিত করার মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতে আপিল করার যে সুযোগ ছিল, তা-ও রাষ্ট্রপক্ষ নেয়নি। এর মধ্যে আপিলের স্বাভাবিক সময়ও পার হয়ে গেছে। ফলে নিহত ব্যক্তির পরিবার বিচার পাওয়ার অধিকার থেকেই বঞ্চিত রয়ে গেল (আবু বকরকে কেউ খুন করেনি! প্রথম আলো, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮)

দুই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলের অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে অনেকগুলো ক্যামেরার সামনেই দিনেদুপুরে নির্মমভাবে কুপিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা খুন করে দর্জি দোকানের কর্মী বিশ্বজিৎ দাসকে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে নিম্ন আদালতে ছাত্রলীগের আটজন নেতাকর্মীর ফাঁসির রায় ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হলেও হাইকোর্ট তার মধ্যে ছয়জন নেতাকর্মীকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দিয়েছে। এই রায়ের পর বিশ্বজিৎ দাসের ভাই উত্তম দাস বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘পাঁচ বছর পরে আজ আরেকটা দুঃসংবাদ এটা। আজকের দিনটাতে যে এরকম কিছু শুনতে হবে আমরা আশাই করিনি। এটাই ঠিক যে সরকার যা চাইবে তা-ই হবে। সরকার যদি চাইত যে অন্তত বিশ্বজিতের ঘটনাটা সুষ্ঠু বিচার হোক তাহলে হতো’(বিবিসি বাংলা, ৬ আগস্ট ২০১৭)

তিন। ‘আমি পাখির মতো মুক্ত... এখন আমি উড়তে পারি...’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক খান মোহাম্মদ রইস ওরফে সোহান ফেইসবুকে এরকম একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। জুবায়ের হত্যায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত ইশতিয়াক মাহবুব ওরফে অরূপও ইন্সটাগ্রামে একটি ছবি পোস্ট করেন। ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কুয়ালালামপুরের একটি স্টারবাকস স্টোরে বসা। এই দুজনসহ সাজাপ্রাপ্ত পাঁচজনই ধরাছোঁয়ার বাইরে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ২০১২ সালে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের প্রতিদ্ববী গগ্রুপের হাতে ছুরিকাহত হয়ে জাবির ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহত হওয়ার পর হাসপাতালে মারা যান (হত্যার পাঁচ বছর, ‘পাখির মতো মুক্ত’ জুবায়েরের খুনিরা, ডেইলি স্টার, ০৯ জানুয়ারি ২০১৭)।

চার। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের কলেজ শাখার নেতা তাওহীদুল ইসলাম (২৫) হত্যা মামলায় মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি সৌমেন দে, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হাইসহ সব আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত। খালাস পাওয়া সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। ২০১৪ সালের ৪ জুন ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবু সিনা ছাত্রাবাসের ১০০৩ নম্বর কক্ষে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাওহীদুল ইসলামকে। তাওহীদ এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কলেজ শাখার আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন (ছাত্রদল নেতা তাওহীদুল হত্যা মামলা, সব আসামি খালাস, প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০১৮)।

পাঁচ। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মারধরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর সাধারণ ছাত্রসমাজ খুনিদের বিচার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এমনই আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল আট বছর আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ছাত্রাবাসে। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল চমেকের ৫১তম ব্যাচের বিডিএস তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবিদুর রহমান আবিদকে। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামি ছাত্রলীগের ভিপিসহ ১২ নেতাকর্মীর সবাই দুই মাস আগে আদালতের রায়ে বেকসুর খালাস পেয়ে গেছেন। আবিদকে ছাত্রদল কর্মী বলে সন্দেহ করতেন চমেক ছাত্রলীগের নেতারা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবিদের জনপ্রিয়তা ছিল। এ কারণে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর দুপুর ২টা, সন্ধ্যা ৭টা ও রাত ১০টায় তিন দফা পিটুনির পর চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে আবিদকে তার বোনের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি বোনের বাসা থেকে চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতালে আনা হলে সেখানেও বাধা দেন ছাত্রলীগে নেতাকর্মীরা। অবশেষে ২১ অক্টোবর মারা যান আবিদ। (চমেক হোস্টেলে দফায় দফায় পেটানো হয় আবিদকে) আবরার হত্যার বিচারে সবাই যখন সোচ্চার, তখন আবিদের খুনি ছাত্রলীগের ১২ নেতাকর্মী খালাস। (কালের কণ্ঠ, ১০ অক্টোবর, ২০১৯)

শুধু এই পাঁচটিই নয়, এমন বহু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে ছাত্রলীগ গত এগারো বছরে। ০৮ অক্টোবর ২০১৯ দৈনিক যুগান্তরের এক রিপোর্টে লেখা হয়, গত ১০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চবি) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে লাশ হয়েছেন ২৪ জন শিক্ষার্থী। এই ২৪ জনের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন, রাজশাহীতে ৫ জন, ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ৩ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের ১৭টি ঘটেছে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে!

এই হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে বিচার যে কতদূরে সে বিষয়ে ০৯ অক্টোবর ২০১৯ দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে ৮ শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দশকে খুন হয়েছেন চার শিক্ষার্থী। সিলেট শাহজালাল, লিডিং এবং সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে তিন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। বিচার হয়নি একটি হত্যাকাণ্ডের। এই হলো আওয়ামী লীগ সরকারের গত এগারো বছরে শুধু ছাত্রলীগের হাতে খুন হওয়াদের বিচারের খতিয়ান। ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালত সাজা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা যে টিকে থাকে না, এমন নজিরও অনেক।

লক্ষীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহের ও তার ছেলে বিপ্লবের নৃশংসতার বলি হয়েছিলেন বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম। বাসা থেকে অপহরণ করে তাকে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রথম আমলের শেষ দিকে ২০০০ সালে। আলোচিত নুরুল ইসলাম হত্যাসহ অপর একটি হত্যা মামলায় বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডর রায় দেওয়া হয়। আপিল বিভাগ পর্যন্ত রায়ে বলেছিল, সমস্ত তথ্য প্রমাণ করে বিপ্লব হত্যাকারী। তাই তার সাজা হ্রাস করার কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় খুনি বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড রহিত হয়। বহু মামলার আসামি সাজাপ্রাপ্ত বিপ্লব এখন মুক্ত।

এই বিচারহীনতা ও খুনিদের ক্ষমার সংস্কৃতি এই দেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশাকে যে কতদূরে ঠেলে দিয়েছে তা উঠে এসেছে দুর্বৃত্তদের হাতে হত্যাকাণ্ড্ররে শিকার ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের কথায়। দৈনিক মানবজমিনকে তিনি বলেছেন, চারদিকে সবাই বিচার দাবি করে। পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। কিন্তু বিচার আর হয় না। বাংলাদেশের যে বিচারব্যবস্থা এখানে ন্যায়বিচার পাওয়া খুব কঠিন। তাই আমি একজন সন্তানহারা বাবা হয়ে আবরারের বাবাকে বলব, বিচার হলো কী হলো না সেটা নিয়ে যেন তিনি না ভাবেন। আসলে রাষ্ট্রের পরিচালনা ঠিক নেই। রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত। এই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির মধ্যে সরকার কোনো কিছু ঠিকমতো চালাতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ভ‚মিকা সঠিকভাবে পালন করছে না। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারের ছাত্র সংগঠনগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে ওঠে।

আদালতে যখন চাক্ষুষ অপরাধী পার পেয়ে যায় এবং সেটা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয় তখন জানা যায় পুলিশি তদন্ত ও চার্জশিটের দুর্বলতার কথা। তার মানে হলো, বিষয়টি আদালতে আসার আগেই অপরাধীদের বাঁচানোর পথ তৈরি করে রাখা হয়। কারা করে এটা? তদন্ত কর্মকর্তা তো? তিনি কেন করেন? উত্তর সোজা। এর পেছনের কারণ দুর্নীতি ও রাজনীতি। কখনো অর্থের বিনিময়ে, কখনো রাজনৈতিক প্রভাবে আবার কখনো উভয় কারণে চার্জশিট এমনভাবে দেওয়া হয় যে আদালতে গিয়ে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় প্রকৃত অপরাধী।

ক্ষমতাসীন দলের যে সব অপরাধী এভাবে পার পেয়ে যান তাদের সঙ্গে ক্ষমতা ও টাকার সম্পর্ক যে গভীর সেটা সবারই জানা। তার দায় তো অবশ্যই সরকার ও দলকেই নিতে হবে। এভাবে খুন করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি দলীয় অপরাধীদের সাহস জোগায় আরও ভয়াবহ অপরাধ করতে। তারা বুঝে যায়, তাদের মাথার ওপরে ‘বড় ভাইয়ের’ ছায়া আছে। কোনো না কোনো পথে তাদের বাঁচানো হবে। আর সরকারি দলের দাপুটে সন্ত্রাসীদের কাছে তো টাকা কোনো সমস্যাই নয়।

এত কিছুর পরেও যদি কারও শাস্তি হয়েই যায় তবে শেষ ভরসা হিসেবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ তো আছেই। তার ক্ষমাও হয়তো মিলতে পারে, এই ভরসাও কারও মনে কাজ করতেই পারে। তাই তারা খুন করে, বেঁচে যায়, আবারও খুন করে। এভাবে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য অপরাধী। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তাদের এই বেঁচে যাওয়ার প্রক্রিয়া দেখে উৎসাহিত হয়ে ছিঁচকে সন্ত্রাসীও এক সময় হয়ে ওঠে ভয়াবহ খুনি। এভাবে রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে যে খুনি শ্রেণির উদ্ভব ঘটে ও বিস্তৃত হয় তার দায় কোনো ভাবেই এড়াতে পারেন না রাজনীতিবিদরা। সুশাসন ও সুবিচার নিশ্চিত করতে হলে আগে চাই সৎ ও স্বচ্ছ রাজনীতি।

—  লেখক চিকিৎসক ও কলামিস্ট 
  • কার্টসি — দেশরুপান্তর / অক্টোবর ১৭, ২০১৯

Wednesday, October 16, 2019

মানসিক বিকাশ হচ্ছে না গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্তানের

শাহেদ মতিউর রহমান


আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে বাবাকে ফিরে পেতে এক শিশুর কান্না




বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্তানের মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। অনেকে দীর্ঘ সময় বাবাকে কাছে না পেয়ে রীতিমতো অস্বাভাবিক আচরণও করছে। যশোরের এক শিশুপুত্র বাবার আদর না পেয়ে অভিমানে আত্মহত্যা করেছে। বাবা গুম হওয়ার পর ঢাকার তেজগাঁওয়ের এক শিশুকন্যার অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করে এক বছর ধরে তার মা মোহাম্মদপুরের একটি মানসিক বিকাশ কেন্দ্রে মেয়ের কাউন্সেলিং করাচ্ছেন। নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে গুম হওয়া ব্যক্তির অবর্তমানে তাদের এমন অনেক শিশুসন্তানের খোঁজ মিলেছে যারা মানসিকভাবে অসুস্থ। এসব শিশুসন্তানদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাও করাচ্ছেন তাদের স্বজনেরা।


২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকার তোপখানা রোডের নিউ ইয়র্ক হোটেলের নিচ থেকে নিখোঁজ বা গুম হয় নড়াইলের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম লিটন। লোহাগড়ার লুটিয়া গ্রামের মৃত শেখ তারামিয়ার ছয় ছেলের মধ্যে লিটন ছিল দ্বিতীয়। নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে গুম হওয়া লিটনের পরিবারের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে। লিটনের ভাই শেখ ফিরোজ আলম জানিয়েছেন, লিটনের ফিরে আসার দীর্ঘ অপেক্ষার পরেও বাবার আদর আর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেছিল ছোট্ট ছেলে আকাশ। চাওয়ার আগেই বাবার কাছে সবই পেত সে। কিন্তু দীর্ঘ দিন বাবার আদর না পেয়ে ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর মায়ের সাথে অভিমান করে গলায় দড়ি দেয় বাবার স্নেহবঞ্চিত আকাশ। ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করে সে।


২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গুম হন রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার শাহিনবাগের সাজেদুল ইসলাম সুমন। দীর্ঘ দিন ধরে বাবার আদর না পেয়ে সুমনের দুই মেয়ের জীবনও যেন অনেকটা ছন্নছাড়া। বাবা গুম হওয়ার পর বড় মেয়ে হাফসা ইসলাম রায়তার পড়াশোনা এক বছর সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। শাহীন স্কুলের মেধাবী ছাত্রী রায়তার পরীক্ষার ফলাফলে আসে চরম বিপর্যয়। পরিবার তার মানসিক অবস্থাটি বুঝতে পেরে ইংলিশ মিডিয়াম পরিবর্তন করে বাংলা মাধ্যমে আবার ভর্তি করিয়েছে তাকে। রায়তার ছোট বোন আরোয়া ইসলামের মানসিক অবস্থা আরো করুণ। স্থানীয় উত্তরণ প্রিপারেটরি স্কুলে পড়াশোনা করছে সে। কিন্তু বাবার আদর না পেয়ে মানসিক বিকাশ হচ্ছে না তার। আরোয়ার মা মোহাম্মদপুরের কিডস্ ক্লাবে নিয়মিত কাউন্সেলিং করাচ্ছেন তাকে।


২০১৩ সালে ২ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও থেকে গুম হন কায়সার নামে একজন প্রাইভেটকার চালক। ঘরে তখন তার তিন বছর বয়সের মেয়ে মীম। মীম এখন ক্লাস টুতে পড়ছে। কিন্তু প্রতিক্ষণেই মীম যেন তার বাবার অভাব অনুভব করছে। মানসিকভাবেও বিষন্ন থাকে সব সময়। মীমের মা মিনু বেগম জানান, মেয়ে আমার ঠিকমতো খাওয়া দাওয়াও করে না। ডাক্তারের কাছে বেশ কয়েকবার নিয়ে গেছি। ডাক্তার বলেছেন কোনো রোগ নেই। তারপরও মেয়ে আমার সুস্থভাবে বেড়ে উঠছে না।


ছয় বছর আগে শাহবাগ থেকে গুম হন বংশালের চঞ্চল। চঞ্চলের একমাত্র ছেলে আহাদ। আহাদের বয়স এখন ৯ বছর। বাবা গুম হওয়ার পর আহাদ বড় ধরনের একটি মানসিক আঘাত পায়। তার মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ করছে তার পরিবার। আহাদের মা জানান, ছেলের বয়স ৯ বছর হলেও শারীরিক কিংবা মানসিক কোনোভাবেই সে বেড়ে উঠছে না। তার ওজন এখনো মাত্র ১৫ থেকে ১৬ কেজি। যদিও স্বাভাবিকভাবে এই বয়সে ওজন থাকার কথা ২৮ থেকে ৩০ কেজি।

আহাদের মা আরো জানান, ওর বড় সমস্যা হলো পড়াশোনা কিছুই মনে রাখতে পারে না। সকালের কথা দুপুরেই ভুলে যায়। স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়ে কয়েকবার দেখিয়েছি। সবাই বলেছে বাবার কথা বেশি চিন্তা করছে সে। এই বয়সে বাবাকে কাছে না পাওয়া ওর জন্য বড় আঘাত।


২০১৩ সালে নিখোঁজ হওয়া বংশালের ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেনের সাত বছরের মেয়ে হৃদির মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। হৃদির মা জানান, আমার মেয়ে সাত বছর ধরেই রাতে ঘুমাতে পারে না। মেয়ের একটাই দাবি, পাপার বুকে আমি ঘুমাতে চাই। পাপা তো আসে না। প্রতিদিন আমি পাপার জন্য অপেক্ষায় থাকি। কোথায় গিয়েছে পাপা?

পরিবারের প্রধান তথা বাবার অবর্তমানে এসব শিশুর মানসিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতা কিভাবে দূর করা যায় সেই বিষয়ে নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেছেন রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ও অধ্যাপক ডা: এম এ মোহিত (মোহিত কামাল)। তিনি বলেন, গুমের বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। কাজেই এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্যও নেই। তবে পরিবারের বাবা অথবা মায়ের আদরবঞ্চিত হলে যেকোনো শিশুর মনেই একটা বিরূপ বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। ওই শিশু অন্যের দ্বারা সহজে প্রভাবিত হবে। বিশেষ করে বাবার আদর না পেলে শিশুরা জীবনে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে না। তাদের মধ্যে সহনশীলতাও কমে যায়।

তবে পরিবারের অন্য সদস্যরা যদি এই শিশুদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন তাহলে তাদের মধ্যে কোনো হতাশা থাকবে না বলেও জানান এই মনোবিজ্ঞানী।

  • কার্টসি  — নয়াদিগন্ত/ অক্টোবর ১৬, ২০১৯

Monday, October 14, 2019

ভারত বাংলাদেশকে ময়লার ভাগাড় বানাতে চাইছে কি-না?

সায়েম সাবু, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

সুলতানা কামাল

সুলতানা কামাল।  মানবাধিকার নেত্রী। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের চেয়ারম্যান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। মানবাধিকার ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।

দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ আলোচনায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ড, উন্নয়ন ও রাজনীতির বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে আসে। অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নে মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হতে পারে বলে মত দেন। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও চুক্তির প্রসঙ্গ নিয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় আপনি বলেছেন, আগে পাকিস্তান শোষণ করেছে, এখন ভারত শোষণ করছে। কেন এমন উপলব্ধি?


সুলতানা কামাল : আমি ঠিক এ ভাষায় বলিনি। আমি বলেছি, পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে কাঁচামাল সরবরাহের যেমন ক্ষেত্র বানিয়েছিল, এখন ভারতও তেমন একটি ক্ষেত্র বানাতে চাইছে বাংলাদেশকে। ভারতকে তিনটি ইকোনমিক জোন করার অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে দেয়া হলো ভারতকে। এ ধরনের প্রকল্প তৈরিতে আমরা ভারতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ দেখতে পাচ্ছি।

ভারতের এমন আচরণ দেখে আমরা দুটি ভাষা ব্যবহার করছি। একটি হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশকে ময়লার ভাগাড় বানাতে চাইছে কি-না? আরেকটি হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশকে কলকারখানার ক্ষেত্র বানিয়ে ফেলল কি-না? উদাহরণস্বরূপ আমরা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা উল্লেখ করেছি।

জাগো নিউজ : কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশ সরকারও করছে। বিদেশি বিনিয়োগ হতেই পারে…

সুলতানা কামাল : কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি এখন সারা বিশ্বেই। ভারতের যে কোম্পানি রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে, সে কোম্পানির বেশ কয়েকটি প্রকল্প ভারত বন্ধ করে দিয়েছে, পরিবেশ দূষণের কথা বলে। আবার একই কোম্পানির আরও কয়েকটি প্রকল্প অর্ধেক দিন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখছে, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার জন্য।

এমন একটি কোম্পানিকেই বাংলাদেশে প্রকল্প করার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। আমি বলেছি, একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে বড় কষ্ট হয়, যখন দেখি আমাদের শাসকরা বিদেশে গিয়ে বলেন, তোমরা বাংলাদেশে এসে বিনিয়োগ কর। আমার দেশের শ্রম সস্তা। সস্তা শ্রমের কথা বলে বাইরের দেশের বিনিয়োগকারীদের এভাবে আহ্বান করা সত্যিই দুঃখজনক। আমরা সস্তা শ্রমিক দিচ্ছি, বন উজাড় করে দিচ্ছি। উপকূল ধ্বংস করে দিচ্ছি।

এভাবে সব উজাড় করে দিতে থাকলে বিদেশিরা তাদের জন্য বাংলাদেশকে শুধু উৎপাদনের ক্ষেত্রই মনে করবে। অথচ, উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে ভারত বা অন্য দেশের নামে।

জাগো নিউজ : আপনার যুক্তির বিপরীতেও কথা আছে, অন্তত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান প্রশ্নে…


সুলতানা কামাল : এমন প্রশ্ন তুলেই বিদেশিদের ডেকে আনা হচ্ছে। তাই বলে দেশের সবকিছু ধ্বংস করে এভাবে বিনিয়োগ হতে পারে না।

আমার দেশের প্রচুর মানুষ বাস্তুহারা। প্রতি বছর নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে হাজার হাজার মানুষ ভিটেহারা হচ্ছে। নিজস্ব শিল্পায়নের জন্যও মানুষকে উৎখাত করা হচ্ছে। আমরা এমনই একটি অর্থনীতিতে বাস করছি যে, যাদের শহরে বাড়ি আছে, তারা গ্রামেও বাগানবাড়ি করে রেখেছে। আবাসন প্রকল্পগুলো মানুষকে উৎখাত করছে। উন্নয়নের নামে ঘরহারা মানুষকে আমরা জায়গা দিতে পারছি না।

ঘরহারা এসব মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে বস্তিতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। আবার নানা কায়দায় সেই বস্তিবাসীকেও উৎখাত করা হচ্ছে। সেটা বস্তিতে আগুন দিয়ে হলেও! শহরে ভাসমান মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কেন? এত উন্নয়ন, তাহলে মানুষ রাস্তায় ঘুমাচ্ছে কেন? এ প্রশ্ন তোলা খুবই ন্যায্য। 

মানুষকে পুনর্বাসন না করে বিনিয়োগ হতে পারে না। জীবন বিপন্ন করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জায়গা দিচ্ছি না তো? এমন প্রশ্ন তো সবারই তোলা উচিত। জমি বণ্টনের যে ন্যায্যতা, তা কি আমরা রক্ষা করছি?

জাগো নিউজ : উন্নয়ন করতে হলে তো ক্ষতি কিছুটা মানতে হয়…


সুলতানা কামাল : কতটুকু উন্নয়ন আর কতটুকু ক্ষতি সেটা নিয়ে আলোচনা করা হোক। পরিবেশ ধ্বংস করে, মানুষের জীবন বিপন্ন করে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না। কারণ মানুষের জন্যই তো উন্নয়ন। পরিবেশ না থাকলে মানুষ বাঁচবে কী করে?

আমাদের দেশের বিদ্যুতের চাহিদা যতটুকু তার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। এ পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ রফতানির কথা বলা হচ্ছে। নিজের প্রয়োজনে পরিবেশ খানিক নষ্ট হতে পারে। কিন্তু বন উজাড় করে, পানি-বায়ুদূষণ করে, মাটি নষ্ট করে রফতানির জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের তো কোনো মানে হয় না। অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল কিন্তু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধ্বংসের মধ্যে থেকে এমন উন্নয়ন সাধারণ মানুষের কোনো প্রয়োজনে আসেনি।

জাগো নিউজ : তার মানে আপনি এমন উন্নয়নে বিশ্বাস রাখছেন না?


সুলতানা কামাল : উন্নয়ন অবশ্যই দরকার। আমরা উন্নয়নের জন্য এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ অঙ্গীকারে স্পষ্ট করে বলা আছে, এমন উন্নয়ন যেন না হয়, যাতে পরিবেশ নষ্ট হয়। সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য, বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য উন্নয়ন হোক।

কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনের বিনিময়ে উন্নয়ন, জীবিকার বিনিময়ে উন্নয়ন, তাদের সম্পদের বিনিময়ে উন্নয়ন কতটুকু ন্যায্য, সেই প্রশ্ন তোলা সময়ের দাবি।

জাগো নিউজ : সরকার তো উন্নয়ন নিয়ে উচ্ছ্বাসিত। জিডিপি, মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে...


সুলতানা কামাল : জিডিপি, মাথাপিছু আয় বাড়ছে- এটি সরকারের হিসাব। কার কত বাড়ল, সে হিসাব থাকাও জরুরি। গড় হিসাব দিয়ে আপনি সার্বিক চিত্র তুলে আনতে পারবেন না।

১৭ কোটি মানুষ। ধরলাম, সেখানে পাঁচ কোটি মানুষ প্রচণ্ডভাবে ধনী হলেন। বাকি ১২ কোটি মানুষের ভাগ্যে কী ঘটল, তার খবরও নিতে হয়। যদি জিডিপি বাড়েই সত্যিকার অর্থে, তাহলে রাজস্ব বাড়ে না কেন? সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়ে না কেন?

জাগো নিউজ : সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ তো এ সরকারই বাড়িয়েছে…


সুলতানা কামাল : কেউ কি হলফ করে বলতে পারবেন, একটি গ্রামের প্রত্যেক বিধবা বা দরিদ্র ব্যক্তি ভাতা পাচ্ছেন?

এসব ভাতা নিয়ে আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ আছে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত একটি থোক বরাদ্দ দেয়া হয়। একটি গ্রামে পাঁচজন বিধবা আছেন। থোক বরাদ্দ থেকে তিনজনকে দেয়া হলো। বাকি দুজনের কী হবে?

ওই তিনজনকে বাছাই করতেই দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়। বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়, স্বজনপ্রীতি করা হয়, রাজনৈতিক বিবেচনা গুরুত্ব পায়। এ চিত্র সর্বত্রই।

তার মানে এসব পরিকল্পনার মধ্যেই তো অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। চলমান পরিস্থিতি সত্যিকার উন্নয়নের চিহ্ন বহন করে না।

মাত্র প্রতিবন্ধীদের একটি সংবাদ সম্মেলন থেকে আসলাম। ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা অধিকার আইন করা হয়েছে। অথচ, ২০১৯ সালে এসেও সে আইনের কোনো বাস্তবায়ন নেই। আজ তারা সংবাদ সম্মেলন করতে বাধ্য হলো। কমিটি করতে বলা হয়েছে। কমিটি করে না। করলেও তারা কোনো মিটিং করে না।

একজন প্রতিবন্ধী মাসে পাচ্ছেন মাত্র ৭০০ টাকা। সেই টাকা পাচ্ছেন আবার তিন মাস অন্তর। আবার যিনি টাকা দিচ্ছেন, তিনি এক মাসের টাকা কেটে রাখছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই মাসের টাকাও কেটে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

উন্নয়ন আলোচনা থেকে এ প্রসঙ্গগুলো আসছে। আলোচনা করার প্রেক্ষাপটও আছে। সরকার যখন জিডিপি, মাথাপিছু আয়, উন্নয়ন নিয়ে নানা সূচকের গল্প শোনায়, তখন কিন্তু তালিকাগুলো যোগ করে। আন্তর্জাতিক মহল এ সূচকগুলোর খবর রাখেন না।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য ভাতা দিচ্ছে জেনে অমর্ত্য সেন আনন্দিত হতেই পারেন। কিন্তু তিনি তো জানছেন না, ২১০০ টাকা থেকে ৭০০ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪০০ টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে কেটে নেয়া হচ্ছে। তিনি সরকারের দেয়া তথ্য থেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেন। বাস্তব চিত্র কিন্তু ভয়াবহ!

সরকারের দেয়া তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের এ ঘাটতি তো অস্বীকার করতে পারবেন না। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছি বলেই মানুষের এ কষ্ট, অভিযোগ জানতে পারছি। সাধারণ মানুষ কোনো সরকারি লোকের কাছে যেতে পারে না। এমনকি জনপ্রতিনিধিদের কাছেও না। আমলা আর জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশেই দুর্নীতি হচ্ছে।

  • কার্টসিঃ জাগোনিউজ/ অক্টোবর ১৩, ২০১৯। 

Thursday, October 10, 2019

আবরারের স্ট্যাটাস ও ফেনী নদীর পানি

আসিফ নজরুল
ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়ার পর ছাত্রলীগের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ। ফেসবুক পোস্টে তিনি বাংলাদেশ-ভারতের সর্বশেষ চুক্তিগুলোর সমালোচনা করেছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ফেনী নদী প্রসঙ্গ। আবরারের আপত্তি বুঝতে হলে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু ফেনী চুক্তি না, অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিত দেখতে হবে। আবরার তাঁর পোস্টে সেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং এরপর অকালে হারিয়েছেন তাঁর অসীম সম্ভাবনাময় জীবন।

২.
ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি দেওয়া হবে সেকেন্ডে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক, অর্থাৎ প্রায় ৫০ লিটার। প্রতিদিনের হিসাবে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ লিটার পানি। শুকনা মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল) ফেনী নদীতে যে পানি পাওয়া যায়, তা বিবেচনায় নিলে এই পরিমাণ পানিকে অনুল্লেখ্য বিবেচনা করার সুযোগ নেই।





বর্তমানে অনেক বাড়িয়ে বলা হলেও ২০০৫ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকাশিত বাংলাদেশের নদ-নদী গ্রন্থের ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠার তথ্য অনুসারে, শুকনা মৌসুমে এই পানির পরিমাণ সর্বনিম্ন মাত্র ৪৭ কিউসেক। মুহুরী সেচ প্রকল্প বাদেও অন্যান্য কারণে ফেনী নদীর পানি তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য। এই পানির একটা অংশ তবু দেওয়া হয়েছে ত্রিপুরার মাত্র হাজার আটেক অধিবাসীর একটি শহরের খাওয়ার পানির চাহিদা মেটানোর জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটা দেওয়া হচ্ছে মানবিক কারণে।

ফেনী নদীর সামান্য অংশ সীমান্তে, বাংলাদেশের বিভিন্ন ছড়ার পানি মিলে এটি বেগবান হয়েছে সীমান্ত পার হওয়ার পর। বাংলাদেশ নিম্ন অববাহিকার দেশ বলে এই পানি ভারতকে দেওয়ার কোনো রকম আইনগত বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের নেই। মানবিক কারণ ছাড়া এ পানি দেওয়ার তাই কোনো কারণ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, মানবিকতা কি শুধু একতরফা একটি বিষয়? মানবিকতা দূরের কথা, এমনকি আইনগত অধিকারগুলো কি আমরা ভারত থেকে পেয়েছি অভিন্ন নদীর পানির ক্ষেত্রে? কিংবা অন্য অনেক ক্ষেত্রে?

আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিতে ‘ভাইটাল হিউম্যান নিডস’ বলে একটি কথা আছে। খাওয়ার পানি ও জীবন-জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় শস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত পানিকে ভাইটাল হিউম্যান নিডস বলা হয়। এসব কারণে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদী থেকে পানি পাওয়া খুব জরুরি বাংলাদেশের জন্য। সেই আলোকে ১৯৮৬ সালে গঙ্গা বাদে আরও আটটি বড় অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি করা হবে—বলেছিল দুই দেশের জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্ট। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তিতে সব অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে চুক্তি করার কথা বলা আছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে এই ভাগাভাগির চুক্তি আর হয়নি।

ভারতের যুক্তি, এসব নদীর পানিপ্রবাহের পরিমাণ নিয়ে দুই দেশের তথ্যে গরমিল আছে। গত মাসেও ভারত বলেছে, এ বিষয়ে আগে স্বীকৃত তথ্য মিলুক, ভাগাভাগি চূড়ান্ত হবে তারপর। ভারতের পানিসচিব বাংলাদেশে এসে বললেন, আটটি নদীর (মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, ফেনী, তিস্তা ও দুধকুমার) পানি ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ ভাগাভাগির বিষয়ে তাঁরা ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অগ্রগতি আশা করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সমঝোতা হলো শুধু ফেনীর বিষয়ে। এমনকি ২০১১ সাল থেকে ঝুলে থাকা তিস্তার বিষয়ে কোনো নতুন কথা শোনা গেল না।

এসব চুক্তি কবে হবে, তা নিয়ে আবরারের মতো বাংলাদেশের যেকোনো মানুষের হতাশা স্বাভাবিক। কারণ, অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে ভারতের অনীহার তথ্য আমরা বহু সময় পেয়েছি। দুই দেশের সচিব পর্যায়ের মিটিংটি গত মাসে হয়েছে প্রায় আট বছর পর। যৌথ নদী কমিশনে মন্ত্রী পর্যায়ে মিটিং শেষবার হয়েছে ২০১০ সালে। এরপর বহুবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিটিং করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও সাড়া মেলেনি। আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্প নিয়ে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে ভারত, তাতে বাংলাদেশের পানির চাহিদা কীভাবে সমন্বয় করা হবে, তা নিয়ে এবারও কিছু বলেনি তারা।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ফেনী নদীর পানি ভারতকে দিতে রাজি হওয়ার বিষয়টি বহু মানুষকে ক্ষুব্ধ করতেই পারে।

৩.
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি। প্রশ্ন উঠেছে সেসব নিয়েও। বাংলাদেশ ভারতে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস রপ্তানি করতে রাজি হয়েছে। বিদ্যমান সড়কব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব, পরিবহনঝুঁকি আর বাংলাদেশের জ্বালানিনিরাপত্তা স্পষ্ট করা হয়নি দুই দেশের প্রকাশিত তথ্যে।

নতুন একটি চুক্তি অনুসারে ভারত বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে নজরদারি করার জন্য রাডার সিস্টেম বসাবে। এমন রাডার সিস্টেম ভারত বসাতে পেরেছে মালদ্বীপ, মরিশাস আর সেশেলসের মতো ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোয়। সেই কাতারে আমরা নামলাম কিসের বিনিময়ে? এই সার্ভিল্যান্সের নিয়ন্ত্রণ থাকবে কার হাতে?

প্রশ্ন আছে অন্য বিষয়গুলো নিয়েও। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম আর মোংলা বন্দর ব্যবহারের বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, কিন্তু ভারতের কোনো বন্দর বাংলাদেশের ব্যবহারের কথা নেই কেন? বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটান আর নেপালের সরাসরি সংযোগের জন্য ভারতের স্থল করিডর ব্যবহার প্রসঙ্গে কোনো অগ্রগতি নেই কেন এবারও? বহু আশ্বাসের পরও সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষ হত্যা অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই কেন কোথাও?

ভারত থেকে আমরা পেয়েছি সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিনিময়ের কিছু সহায়তা, যার গুরুত্ব অনুল্লেখ্য। যেমন রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রাবাস নির্মাণ বা খুলনায় একটি পেশাজীবী প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা। ভারত বাংলাদেশকে ঋণসহায়তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। এই ঋণের শর্ত নিয়েও প্রশ্ন আছে দেশে।

৪.
ভারত সফরে যাওয়ার আগে দুটো বিষয় নিয়ে উদ্বেগের কথা বলেছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। এসবের কোনো সদুত্তরও আসেনি দুই দেশের চুক্তি, সমঝোতা বা যৌথ বিবৃতিতে। গণহত্যা করে মিয়ানমার থেকে অমানবিকভাবে ঠেলে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে। এমন একটা ইস্যুতে সর্বশেষ হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত থেকেছে ভারত। এ বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ ও প্রত্যাশা কতটা গুরুত্বহীন, তা আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি পর্যন্ত উল্লেখ না করে সেখানে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষদের সহায়তার অঙ্গীকার করেছে ভারত। কিন্তু আমরা তো খাবার, কম্বল বা তাঁবুর মতো পুনর্বাসন সহায়তা চাইনি ভারতের কাছে, আমাদের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ভারতের সমর্থন ও সহায়তা। দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে তার প্রতিফলন নেই।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উত্কণ্ঠা জানিয়েছিলেন ভারতের জাতীয় নাগরিক তালিকা (এনআরসি) নিয়ে। আসামের পর এমন এনআরসি করার তোড়জোড় হচ্ছে ভারতের আরও কিছু রাজ্যে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা প্রকাশ্যেই বলছেন, এনআরসি থেকে বাদ পড়া লোকজনকে ফেরত পাঠানো হবে বাংলাদেশে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগের জবাবে মৌখিকভাবে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে এ নিয়ে বাংলাদেশের চিন্তার কিছু নেই, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সত্যি চিন্তার কিছু না থাকলে তার উল্লেখ বা আশ্বাস যৌথ বিবৃতিতে নেই কেন?

‘চিন্তার কিছু নেই’ বা ‘বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না’—এসব আশ্বাস রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথেষ্টও নয়। এর আগে বাংলাদেশের জন্য চরম ক্ষতিকর ফারাক্কা ব্যারাজ চালুর আগে এক দশক ধরে ভারত তা-ই বলে এসেছিল। মাত্র কয়েক বছর আগে পরিত্যক্ত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের ক্ষেত্রে একই কথা বলেছিল ভারত। কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া আশ্চর্যজনকভাবে একই কথা বলেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের কিছু মন্ত্রীও।

এনআরসি নিয়ে একই ধরনের আভাস পাই ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার কাছে দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার ৬ অক্টোবরের সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছেন, ভারতে সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর নিজেদের যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত আছে বাংলাদেশ। এই বক্তব্য কী বার্তা দেবে ভারতকে?

৫.
দুই দেশের সম্পর্ক শুধু নীতিনির্ধারকদের সম্পর্ক নয়; এটি দুই দেশের জনগণের সম্পর্কও হতে হয়। প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ, দুর্বল আমলাতন্ত্র, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অতিকেন্দ্রিকতা এবং জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিতে অনীহার কারণে ভারতের সঙ্গে আমরা দর-কষাকষি শক্তি অনেকটুকু হারিয়েছি।

এ সুযোগে বাংলাদেশ থেকে বহু একতরফা সুবিধা নিচ্ছে ভারত। ফেনী চুক্তিসহ এবার স্বাক্ষরিত অন্য সমঝোতাগুলো এর নতুন উদাহরণ মাত্র। এসব অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারত নিয়ে অস্বস্তি আরও বাড়বে।

দীর্ঘ মেয়াদে দুই দেশের সম্পর্কে এর নেতিবাচক প্রভাব হতে পারে মারাত্মক। আবরারের হত্যাকাণ্ডের পর মানুষের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় সেই ইঙ্গিত রয়েছে।

  • আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ অক্টোবর ১০, ২০১৯

টর্চার সেল ও আবরারদের জীবন-মরণ

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেছে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। দেশজুড়ে চলছে প্রতিবাদ। হত্যায় অভিযুক্ত কয়েকজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে অপরাধে আবরারকে হত্যা করা হলো তা যে এই দেশে এখন আর অসম্ভব কোনো বিষয় নয় তা সবারই জানা। সেই জানা বিষয়টি বিলোপ করতে যারা এতদিন কার্যকর কোনো প্রতিবাদ করেননি তারাও আজ আবরার হত্যায় আহা উহু করছেন। নিজের ছেলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন আবরারকে। কিন্তু আবরারকে কেন হত্যা করা হলো? কী অভিযোগে হত্যা করা হলো? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ফেসবুকে বর্তমান সরকার ও প্রতিবেশী দেশ নিয়ে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দিয়েছেন। 

আবরার লিখেছে :
১. ৪৭-এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ  করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে  উদ্বোধনের আগেই  মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।

২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি  কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড়লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।

৩. কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব। হয়তো এ সুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন “পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/এ জীবন মন সকলি দাও,/তার মত সুখ কোথাও কি আছে/আপনার কথা ভুলিয়া যাও”

আবরারের এই কথাগুলো কি এদেশের অনেকেরই মনের কথা নয়? অনেকেই এভাবে সাহস, সততা ও দেশপ্রেম নিয়ে বলেন না হয়তো। আবরার বলেছে। তাতেই তাকে মেরে ফেলতে হবে! বলতে দ্বিধা নেই, আবরারের এই কথাগুলো আমারও মনের কথা। তাই বলে এখন কি আমাকেও কোনো টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হবে? পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে আমাকেও, ঠিক যেভাবে মেরে ফেলা হলো বুয়েটের ছাত্র আবরারকে! আসলে আবরারের অপরাধ অনেক। প্রথম অপরাধ সে এমন একটা দেশে, এমন একটা সমাজে জন্ম নিয়েছে যে দেশটা, যে সমাজটা সবার নয়। দেশটা শুধুই ক্ষমতাবান ও তাদের অনুসারীদের। তার দ্বিতীয় অপরাধ, এ দেশে স্রোতের বিপরীতে সাহস দেখালে তার পরিণতি কী হতে পারে তা মাথায় না রাখা। তার তৃতীয় অপরাধ, এ দেশে থাকতে হলে মূক, বধির ও অন্ধ হয়ে থাকতে হবে। এখানে ক্ষমতাবানদের অপকর্ম দেখতে নেই, শুনতে নেই, বলতে নেই। এই সত্যটাকে অস্বীকার করে আবরার  লিখেছে। এত সব অপরাধ যার, এমন ঔদ্ধত্য যে ছেলে দেখায় তার বেঁচে থাকার অধিকার কি এই দেশে থাকতে পারে! তাই সেই অপরাধ ও ঔদ্ধত্যের সমাপ্তি টানতে এগিয়ে এসেছে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতারা। আসলে মরে গিয়ে এক রকম বেঁচে গেছে আবরার।

এই ‘অক্সিজেন’ শূন্য  মৃত্যুপুরীতে হাঁটাচলা, খাওয়া-দাওয়া, দৈনন্দিন কাজ করা মানেই কি বেঁচে থাকা! এখানে ক্ষমতাবানদের সঙ্গে দ্বিমত করা মানেই এক আতঙ্কের জীবন। এখানে ঘরে আতঙ্ক, বাইরেও আতঙ্ক। এই আতঙ্কময় অনিশ্চিত জীবনযাপন করাকে কি বেঁচে থাকা বলে? এই প্রতিবাদহীন সব সয়ে যাওয়াকে কি বেঁচে থাকা বলে? আমার যারা প্রতিবাদহীন সব সয়ে যাওয়া বেঁচে থাকার দলে নাম লিখিয়েছি তাদের গালে যে চড় কষিয়ে দিয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে গেল আবরার, সে চড়ের দাগ কি আমাদের মনে একটুও লেগেছে? এই ঘটনায় অনেকেই ছাত্রলীগকে নিন্দা করছেন। কিন্তু ছাত্রলীগ কি এবারই প্রথম এমন নৃশংস ঘটনার জন্ম দিল? এর আগে তারা কি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হল থেকে বিরুদ্ধ মতের শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগের তৈরি টর্চার সেলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেনি? তাদের হল থেকে বের করে দেয়নি? যাকেই নির্যাতন করার দরকার পড়ত তাকেই ‘ছাত্রশিবির’ ট্যাগ লাগিয়ে দিলেই যেন নির্যাতন করা বৈধ হয়ে গেল। টর্চার সেলে নিয়ে এতদিন ভিন্ন মতের শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করাকে যারা অপরাধ মনে করেননি বরং ছাত্রশিবির পিটিয়েছে বলে আত্মসন্তুষ্টি লাভ করেছেন তারাই কি আবরার হত্যার প্লট তৈরি করেননি? আজ আবরার হত্যার পরে তাদের এই আহা উহু ভÐামি ছাড়া আর কী হতে পারে! ছাত্রলীগের নৃশংসতার বহু নজির আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে। যাদের একটু ‘ভুলো মন’ তারা চাইলে গুগলে সার্চ দিয়ে আকাশ থেকে নামিয়ে কিছু নমুনা দেখে নিতে পারেন। এই ছাত্রলীগই ধার দেওয়া ক্যালকুলেটর ফেরত চাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এহসান রফিককে নিজের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে আটকে রেখে নির্যাতন করে। তার একটি চোখের কর্নিয়ায় গুরুতর জখম হয়েছিল। পরের দিকে তিনি চোখের দৃষ্টি প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন।

দর্জিকর্মী বিশ্বজিৎ দাসের কথাও এতদিনে নিশ্চয়ই অনেকে ভুলে গেছেন। সেই রক্তাক্ত শার্ট হয়তো এখন আর কারও মনে পড়ে না। জামায়াতের ডাকা হরতালের দিন ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে দিনেদুপুরে অসংখ্য টিভি ক্যামেরার সামনে ছাত্রশিবির সন্দেহে ছাত্রলীগ যাকে উপর্যুপরি কোপানোর সময় যে চিৎকার করে বলেছিল, আমি ছাত্রশিবির না, আমি হিন্দু। আমাকে মারবেন না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী জুবায়ের হত্যার কথাও হয়তো আমরা ভুলে গেছি। সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের সেই দাউদাউ আগুন আর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের অসহায় কান্নাও হয়তো ভুলে গেছি আমরা

গত এগারো বছরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন কতজন শিক্ষক তার আন্দাজ করাও কঠিন। কোন অপকর্মটি করেনি ছাত্রলীগ? চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, হাটের-মাঠের-ঘাটের ইজারা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এমন কোনো অভিযোগ নেই যা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ওঠেনি গত এগারো বছরে। এই সময়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগও শতাধিক। টর্চার সেলে নিয়ে ছাত্রলীগ নির্যাতন করে আবরারকে হত্যা করেছে বলে আজ এই সেলও আলোচনায়। যুবলীগ নেতাকে ধরলে আবিষ্কৃত হয় টর্চার সেল। আওয়ামী লীগ ধরলেও বেরিয়ে আসে তার টর্চার সেলের খবর। স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা বা অন্য কোনো অঙ্গসংগঠন হোক যাকেই ধরা হচ্ছে বের হচ্ছে টর্চার সেলের খবর। সাম্প্রতিককালে যুবলীগের একটা ইউনিটের ( ঢাকা দক্ষিণ) মধ্যম সারির নেতা খালেদ মাহমুদ ভ‚ইয়ার টর্চার সেলেও পাওয়া যায় টর্চারের হরেক রকম ভয়াবহ সব উপাদান। আর ছাত্রলীগ যে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে আবাসিক হলগুলোতে টর্চার সেল বানিয়ে রেখেছে তাতো বহুল আলোচিত। ছাত্রলীগের নেতাদের এমন টর্চার সেলের অসংখ্য সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে বিভিন্ন সময়। ভিন্ন মতের ছাত্র তো বটেই, এমনকি সাধারণ নির্দলীয় ছাত্ররা পর্যন্ত রেহাই পায় না এ নির্যাতন থেকে। নেতাদের আদবের সঙ্গে সালাম না দেওয়ার অপরাধেও টর্চার করার বহু ঘটনা এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। আর তাদের ডাক অগ্রাহ্য করে মিছিলে যাওয়া থেকে বিরত

থাকলে টর্চার সেল থেরাপি অবধারিত। এ কথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী জানে, ছাত্রনেতারা জানেন। সকলেই জানেন। কিন্তু এই টর্চার সেল বন্ধ করতে কেউ উদ্যোগী হয়নি।

আজ শুধু ‘বুয়েটের তিন হলে ৭ টর্চার সেল’ এর বিশদ বিবরণ দেওয়া হচ্ছে (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৯ অক্টোবর ২০১৯) সেখানে আবরার ফাহাদ নামে একজন ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে বলে। একই কারণে এখন ডেইলি স্টার (৮ অক্টোবর ২০১৯) লিখছে, ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীরা জানান, আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মিলনস্থল হিসেবে কক্ষটি ব্যবহার করা হতো। তারা জানান, প্রায় প্রতি রাতেই সে কক্ষে পার্টি চলত। মাতাল শিক্ষার্থীদের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যেত। এতে আশপাশের কক্ষের শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা হলেও, ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের এক নেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, কক্ষটি ছাত্রলীগের ‘পলিটিক্যাল রুম’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষার্থীদের ধরে সেখানে আনা হতো এবং নির্যাতন করা হতো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বুয়েটের অপর এক হলের সহকারী প্রাধ্যক্ষ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে ছাত্রলীগের এমন কক্ষ রয়েছে, যেগুলো ‘টর্চার সেল’ হিসেবে পরিচিত। এটি দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিতে ছিল না, কিন্তু গত পাঁচ বছরে ফিরে এসেছে। প্রতিটি হলেই নির্দিষ্ট কিছু কক্ষ থাকে, যেখানে ছাত্রলীগ সদস্যরা থাকেন। সেখানে তারাই সর্বেসর্বা, অন্য কাউকে সেখানে থাকতে দেওয়া হয় না।’

যে ছাত্রনেতা আজ বলছেন টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করার কথা, যে শিক্ষক আজ জানাচ্ছেন টর্চার সেলে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের মদ্যপ মিলনমেলার খবর তারা নিশ্চয়ই আজই জানেননি এ খবর। আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু বলেননি কিছু। কেন বলেননি তাও কারও অজানা নয়। আমরা সবাই একটা ভয়ের রাজত্বে বসবাস করছি। সে একই কারণে এরা সংবাদ মাধ্যমে নিজের নামটা পর্যন্ত প্রকাশ করতে রাজি হননি। যেই ছেলেগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা পিটিয়ে, অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে ভেতর-বাহির থেঁতলে দিয়ে মেরেই ফেলল একটা তরতাজা প্রাণ তারাও তো বুয়েটেরই ছাত্র। তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাপকাঠিতে মেধাবী এ ব্যাপারে তো কারও সন্দেহ নেই। একজন দুজন নয়, অন্তত বিশ-বাইশজন বা তারও বেশি ছাত্র মিলে একই প্রতিষ্ঠানের আরেকজন ছাত্রকে নিজেদের বানানো টর্চার সেলে নিয়ে পেটাতে পেটাতে মেরেই ফেলল! কারও মায়া লাগল না? কারও হাত কাঁপল না? কারও দয়া হলো না? কেউ বলল না, থাক আর নয়। ছেলেটি মরে যাচ্ছে! হঠাৎ রাগের মাথায় নয়, হঠাৎ দেওয়া দুচারটি পিটুনিতে নয়। দীর্ঘ পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলল আবরারকে। এই প্রাতিষ্ঠানিক তথাকথিত মেধাবী কী কাজে আসবে দেশের? এরা যে শুধুই মেধাবী হয়েছে, মানুষ হয়নি তার দায় কে নেবে? পরিবার, সমাজ, সরকার, রাষ্ট্র, কারও কোনো দায় নেই?

  • লেখকঃচিকিৎসক ও কলামনিস্ট
  • কার্টসিঃ দেশরুপান্তর / বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০১৯

রাষ্ট্র কান্নায় নির্মিত হয় না

রফিকুজজামান রুমান

অফুরান চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে সব। ফেনী নদী থেকে যত কিউসেক পানি নিয়ে যাবে ভারত, হয়তো তার চেয়েও বেশি অশ্রু ঝরেছে আবরারের মা-বাবার চোখ থেকে; অসহায়ত্বের শিকল পরা এদেশের অগণন মানুষের চোখ থেকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন প্রিয় পাঠক, চোখের পানিতে এর সমাধান নেই। চোখের পানিতে পৃথিবীতে কখনো কোনো বিপ্লব হয়নি; পরিবর্তন ঘটেনি।

চুক্তি না-হওয়া তিস্তা নদীতে ভরা বর্ষায় জল এসে বন্যা হয় যত পানিতে, এদেশের মায়েদের কান্নার কাছে হার মানে সেই প্রবাহ। আবু বকরের মা কাঁদে, শরীফুজ্জামান নোমানীর মা কাঁদে, ফারুক হোসেনের মা কাঁদে; কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় দিন, মাস, বছর; বিচারের বাণীও নিভৃতে কাঁদে! নয় বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুবকর সিদ্দিককে হত্যা করা হয়। সাত বছরের মধ্যে খালাস পেয়ে যায় ১০ আসামির সবাই! আবুবকর কি তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে? মা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলে আবুবকর হয়তো আসে। এসে বলে, ‘আমি ছিলাম তোমাদের আশার আলো।

কুৎসিত রাজনীতির ভয়াল থাবা নৃশংস কালিমা হয়ে সে আশায় চিরস্থায়ী আঁধার-প্রলেপ বসিয়ে দিয়েছে। তিল তিল করে তোমরা আমাকে বড় করে তুলেছিলে। আর তার চেয়েও বড় করেছিলে আমাকে নিয়ে তোমাদের নির্মিত স্বপ্নের পরিধি। আমি সেই স্বপ্নের নাগালও পেয়েছিলাম মা! কিন্তু পরাজিত মানবতার শূন্য পীঠে আজ সেই স্বপ্ন শুধুই হাহাকার করে ফিরে আসে। আমার নির্দোষ নিষপ্রাণ রক্তাক্ত দেহেই তোমার সমস্ত স্বপ্নের যবনিকাপাতের উদ্বোধনী ঘোষণা হয়ে গেল মা!’ আবুবকরের বাবা দিনমজুর। টেনেটুনে সংসার চালাতে হতো বলে মা রাবেয়া খাতুন তিন বছর মাথায় তেল না দিয়ে সেই টাকা আবুবকরের পড়াশুনার খরচের জন্য জমাচ্ছিলেন। ছেলের পড়াশুনার জন্য মা মাথায় তেল দিচ্ছেন না এমন এক রাষ্ট্রে, যেখানে নরপশুরা গড়ে তুলছে সম্পদের পাহাড়, ক্যাসিনো সাম্রাজ্য।

এমন রাষ্ট্রে কান্নাই শেষ কথা নয়। ২০০৯ সাল থেকে কেঁদে চলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হওয়া শরীফুজ্জামান নোমানীর মা। কান্না থামলেই প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা বলো, কী অপরাধ ছিল আমার নোমানীর? আজ আমার নোমানী যদি থাকতো, আমার বুকের সমস্ত শূন্যতা পূরণ হয়ে যেত।’ কার কাছে এই প্রশ্ন? রাষ্ট্রের কাছে? এই রাষ্ট্র কি জীবিত?

আবরারের লাশ যখন পৌঁছালো মায়ের কাছে, বুকফাটা কান্নায় মায়ের প্রশ্ন, ‘আমার বাবা, ওরা তোমার কোথায় মেরেছে? তুমি কেন আমায় ছেড়ে চলে গেলে?’ মায়ের আদরে, ভালোবাসায়, নিখাঁদ ছোঁয়ায় গড়ে উঠেছিল আবরারের যে শরীর, তাতে হায়েনার লাঠির আঘাতের তামাটে চিহ্ন- পৃথিবীর কোন মা পারেন এমন দৃশ্য মেনে নিতে? ‘ওরা তোমার কোথায় মেরেছে’- ফুলের টোকাও লাগতে দেইনি তোমার যে শরীরে, যে শরীরে আমার নির্ঘুম রাত জাগার ছাপ, যে শরীরে আমার ভালোবাসার অসংখ্য চুমু, তিলে তিলে যে শরীরে নির্মিত হচ্ছিল স্বপ্ন আর সম্ভাবনারা, যে শরীর প্রতিদিন জায়নামাজে লুটিয়ে পড়তো প্রভুর ডাকে; সেই শরীরের কোন জায়গাটায় ওরা মেরেছে? মা রোকেয়া খাতুন জবাব খুঁজে পান না।

কোথাও আজ কোনো জবাব নেই। নেই জবাবদিহিতা। গত দশ বছরে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই কমপক্ষে ২৪ শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। বিচার হয়নি কোনোটিরই। এ এক অদ্ভুত আঁধারে ঢেকে থাকা সময়। ইচ্ছে হলেই পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা যায়। গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যা করা যায়। ভিন্নমত ধারণ করলে তাকে পিটিয়ে মারা যায়। ব্যর্থতার নির্লজ্জ হাসিতে সবকিছু জায়েজ করা হয় ‘শিবির সন্দেহে’ আর ‘অনুপ্রবেশকারী’ ট্যাগ লাগিয়ে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী তার মতামত প্রকাশ করতে পারবে না যেই রাষ্ট্রে, সেই রাষ্ট্র কি ছাত্রলীগের কাছে বর্গা দেয়া হয়েছে? তিস্তার কোনো সমাধান না করেই ফেনী নদীর পানি ভারতকে দিয়ে দেয়ার চুক্তির মধ্যে যে অসহায়ত্ব রয়েছে, তার বিরোধিতা করা অন্যায়? তাহলে দেশপ্রেম কী? ক্যাসিনো সাম্রাজ্য গড়ে তোলা?
হায়েনাদের এমন উল্লাসে কান্না হলো সবচেয়ে বড় পাপ। নিয়মিত বিরতিতে এক একটি ঘটনা ঘটছে। আমরা কোরাস করে কেঁদে উঠছি। এই কান্না পরাজয়ের কান্না। রাষ্ট্র নির্মিত হয় বিপ্লবে; কান্নায় নয়।
  • লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক
  • কার্টসিঃ মানবজমিন/  ১০ অক্টোবর ২০১৯, বৃহস্পতিবার

Monday, October 7, 2019

অসামান্য বালিশ ও ক্যাসিনো কেস

কাজী জেসিন


কাজী জেসিন
পুরোটাই লুটপাটের টাকায় জুয়াখেলা। ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো চলে আসছে বছর বছর ধরে। সাধারণ মানুষ কেউ কিছুই জানে না। কিন্তু, কিছু মানুষ না জানলে তো ক্যাসিনো ক্লাবগুলো তার গ্রাহক পেতো না, কোটি কোটি টাকা আয় হতো না, মজুদ হতো না ভরি ভরি সোনা। ক্যাসিনো থেকে সর্বস্ব হারিয়ে কেঁদে বের হয়ে যাওয়া মানুষের চোখের জল আশেপাশের মানুষ দেখেছে। তবু রাষ্ট্রের নজরে আসেনি। রাষ্ট্রতো অন্ধ না। রাষ্ট্রের চোখ আছে।

যে রাষ্ট্র ডিজিটাল তার তো চোখ, নাক, কান আরও সুতীক্ষ্ণ। যখন তখন সে রাষ্ট্র নামের কারিগর যার-তার ফোনে আড়ি পাততে পারে,  যখন খুশি যে কারো সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়তে পারে। ডিজিটাল রাষ্ট্র বলে কথা। কিন্তু এই রাষ্ট্র গত দশ-বারো বছরে কোথায় কিভাবে ক্যাসিনো চলেছে তা দেখতে পায়নি। তাহলে এখন দেখতে পেলো যে! কী অদ্ভুত!

সাধারণ মানুষ বিগত বছরগুলোতে দেখে এসেছে কিভাবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার বাণিজ্য নিজেদের আয়ত্তে নিতে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে কখনও কখনও হানাহানি, মারামারি এমন কি খুন পর্যন্ত করেছে। যুবলীগ, ছাত্রলীগের টেন্ডার নিয়ে একের পর এক সংঘর্ষ, হত্যা বাংলাদেশের মানুষের সামনে একটা অতি পরিচিত চিত্র। সরকারি দল ও তার অঙ্গ সংগঠন সংবিধান লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতির মহাউল্লাস চালিয়ে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশ জাতিসংঘের ইউনাইটেড নেশানস কনভেনশান এগেইন্সট করাপশান (টঘঈঅঈ) এর অনুসমর্থনকারী দেশ। দূর্নীতি নির্মূলের জন্য ’ফৌজদারী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে দুর্নীতির প্রতিকার ছাড়া ও দুর্নীতির ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণকে’ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এই কনভেনশানে। শুধু তাই নয় আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ও জনগনের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতিতে বার বার উল্লেখ করেছে দুর্নীতি নির্মূলের কথা, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে এক অস্বাভাবিক দুর্নীতির খেলা, যেখানে সরকারি কাজের টেন্ডারে বালিশের মূল্য ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার নয় শত সাতান্ন টাকা, তিরিশটি বিছানার চাদর আনতে ট্রাক ভাড়া তিরিশ হাজার টাকা। 

কী অসামান্য বালিশ! কী অসামান্য চাদর! শুধু বালিশের মূল্যই নয়, আমরা দেখেছি সড়ক নির্মাণেও অনান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ব্যয় কয়েকগুণ। উন্নত দেশগুলোতে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে গড় ব্যয় হচ্ছে ৩১ কোটি টাকা। বাংলাদেশে ঢাকা-পায়রা বন্দর রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭৩ কিলোমিটার রেলপথের ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৩ কোটি টাকা। চট্রগ্রামের দোহাজারি থেকে বান্দরবনের ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় ১৩৯ কোটি টাকারও বেশি। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সিঙ্গেল লাইনের রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে গড় ব্যয় ১২ কোটি টাকা। চীনে সিঙ্গেল রেলপথ নির্মাণে গড় কিলোমিটার ব্যয় ১২ কোটি ৫০ লাখ ও ২০০ কিলোমিটার গতিবেগের রেলপথ নির্মাণে গড় ব্যয়৭৫ কোটি টাকা। 

বিশ্বব্যাংকের গবেষণাপত্রের তথ্যমতে, উন্নয়নশীল দেশে সড়ক নির্মাণের খরচ বাড়ার কারণের মধ্যে রয়েছে বাজার থেকে সড়কের দূরত্ব, দরপত্রের প্রতিযোগিতা না হওয়া, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব, সংঘাত ও উচ্চমাত্রার দুর্নীতি। দুর্নীতির মহোৎসব বাংলাদেশে নতুন কিছু না। বর্তমান সরকার দুর্নীতি রোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মূলত উলটা, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিয়েছে।

যে দেশে ৪৭.১% মানুষ দারিদ্রসীমা এবং ২৪.৬% মানুষ চরম দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে, যে দেশে এখনও মানুষ খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগে সেই দেশে সরকারদলের একজন মাঝারি সারির নেতার ঘরে পাওয়া যায় প্রায় দুই কোটি টাকা, পৌনে দুইশত কোটি টাকার এফডিআর। তিনি শুধু ক্ষমতা দেখিয়ে টেন্ডার সন্ত্রাসের মধ্য দিয়েই অর্থ উপার্জন করেন নি, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় চালিয়ে এসেছেন ক্যাসিনো বাণিজ্য। এর আগে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে যুবলীগের আরেক নেতা খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াকে আটক করা হয়। নানান তালবাহানার পর অবশেষে গত রোববার ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে গ্রেফতার করেছে বলে বলা হচ্ছে ক্যাসিনো সম্রাটখ্যাত সদ্য বহিষ্কৃত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও সহসভাপতি আরমানকে। প্রশাসন কি হঠাৎ করেই ক্যাসিনো আবিষ্কার করেছে? নিশ্চয়ই তা নয়। 

বছরের পর বছর ধরে যেখানে ক্লাবগুলোতে চলছে ক্যাসিনো, যেখানে মানুষ খেলতে যাচ্ছে, বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরছে, যেখানে এই দৃশ্য আশপাশের সাধারণ মানুষ সকলেই দেখছে, প্রশাসনের চোখে পড়েনি একথা একেবারেই ভিত্তিহীন। ক্যাসিনো খেলতে যে সরঞ্জাম লাগে তা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে। কাস্টমস এর নাকের ডগা দিয়ে এই সব অবৈধ খেলার সরঞ্জাম কি করে দেশে ঢুকলো এর জবাব কে দেবে? আজ বা্‌ংলাদেশ যে দুর্নীতির দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়েছে সেখান থেকে দেশকে, দেশের মানুষকে উদ্ধার করতে হলে এর মূলে যেতে হবে।

বিভিন্ন সময় সরকারদলের ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নানাবিধ ফৌজদারী অপরাধে জড়ালে ও সরকার শুধু ক্ষোভ প্রকাশ আর বিব্রতই বোধ করেছে। দু্‌’একটা ঘটনা ছাড়া মানুষ চাঁদাবাজ, টেন্ডারসন্ত্রাস, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বিচার হতে দেখেনি। দরপত্র ছিনিয়ে নিয়ে ঠিকাদারকে মারধরের ঘটনায় সাধারণ মানুষ হয়ত হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয় কিন্তু আর অবাক হয় না। ছাত্রলীগ, যুবলীগের টেন্ডারসন্ত্রাস থেকে রক্ষা পায়নি এমন কি সাধারণ মানুষও। মনে পড়ে রাব্বির কথা। ২০১৩সালের ১৯ জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তার, নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি নিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দুই গ্রপের গোলাগুলিতে পাশের গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের ১০ বছরের শিশু রাব্বি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এমনকি নিজদলের নেতাকর্মীদের হীন স্বার্থে খুনের ঘটনা বারবার জাতীয় দৈনিকগুলোর খবর হয়েছে। আইনের শাসন জারি থাকলে,  প্রশাসন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে,  বলাবাহুল্য সরকারি দলের কোনো নেতাকর্মী, ছাত্রলীগ, যুবলীগের গায়ে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজের তকমা লাগতো না।

কিন্তু প্রশাসনকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হলে সাধারণ মানুষের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হয়। বর্তমান সরকার পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, সাধারণ মানুষকে তাদের সাংবিধানিক ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ক্ষমতায় আছে। কোনো দল যখন মানুষের ভোটের উপর আস্থা রাখতে না পারে, তখন ক্ষমতায় আসার জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় প্রশাসনের অনৈতিক, অসাংবিধানিক সহযোগিতা, পেশীশক্তি এবং জাল ভোটের উপর। জালভোটের মধ্য দিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সরকার সাধরণত: আটকে যায় অনাকাঙ্খিত সব নির্ভরতার জালে। তখন সেই সরকার জনগনকে তুষ্ট না করে তুষ্ট করতে বাধ্য হয় নানারকম পেশীশক্তিকে। আইনের শাসনহীনতার এক অশুভ দুষ্টজালে আটকে যায় সরকার। বাংলাদেশ সরকার এমন উদাহরণ থেকে ব্যতিক্রম নয়। সুষ্টু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগনের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই রুল অব ল প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না তবু একটি নির্বাচিত সরকারই নিয়মতান্ত্রিক শাসনের প্রথম শর্ত। সুতরাং দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে, জনগনের কাছেই সরকারকে ফিরতেই হবে। জনগনের ভোটে নির্বাচিত একটি শক্তিমান স্বনির্ভর সরকারই পারবে দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করতে।

একের পর এক দুর্নীতির কালিমা সরকারকে এমনভাবে কালিমাময় করেছে, প্রশাসন যখন ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো অভিযান চালাচ্ছে তখন, সারাদেশে গুঞ্জন চলছে কেন হঠাৎ এই অভিযান। প্রশাসন দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজ শাসক দলের ভিতরেই অভিযান চালাবে এটা যেন অবিশ্বাস্য, অথচ অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, এটাই জনমানুষের সবসময় কাম্য। সরকার সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সজাগ থাকবে, একটি শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করবে এটাইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ। অথচ সোশ্যাল নেটওর্য়াক খুললেই দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নানান জল্পনা-কল্পনা। 

এই নিয়ে বিবিসি রিপোর্ট করেছে,’শেখ হাসিনা কেন হঠাৎ ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’ সজাগ হলেন। উল্লেখ্য ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’ শব্দযুগলকে এই রিপোর্টে কোড করা হয়েছে অর্থাৎ এই অভিযানকে বিবিসি হয়তো এখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান বলতে নারাজ। কারণ কী হতে পারে এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিবিসি আমাদের জানাচ্ছে এই অভিযানের পেছনে দল এবং সরকারকে রক্ষার কোন চেষ্টা থাকতে পারে। ‘অপরাধে জড়িতদের সতর্ক করা হয়েছিলো ’উল্লেখ করে বিবিসি জানাচ্ছে, ”শেখ হাসিনা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে পরিস্থিতি যাচাই করে অভিযান চালানোসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছেন।’’

অর্থাৎ সরকার একরকম বাধ্য হয়ে একটানা তৃতীয় মেয়াদে এসে কতিপয় দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাও আবার ব্যাবস্থা গ্রহনের আগে অপরাধীদের সর্তক করা হয়েছিলো। সরকার যে এই অভিযানেও কতোটা ইতস্তত তা অনুমান করা যায় ক্যাসিনো সম্রাটখ্যাত সম্রাটকে গ্রেফতারে টালবাহানা দেখে। শুধুমাত্র এই ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান নয়, সরকারকে তার ভাবমূতি উজ্জ্বল করতে চাইলে রাষ্ট্রের বিভিন্নস্তরে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি, অপকর্ম রোধ করতে হবে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে ফিরে গিয়ে মানুষকে তার হারিয়ে যাওয়া ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। জনমানুষের অধিকার সমুন্নত রাখার মধ্য দিয়েই শুধুমাত্র একটি সরকার জনপ্রিয় থাকতে পারে। কোনো চাপের মুখে নয় সরকার সংবিধান মেনে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করুক, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুক, বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করুক, এটাই সাধারণ মানুষের কাম্য। ক্লাবে ক্যাসিনো চলেছে, বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে যেন কোন ক্যাসিনো না চলে, তা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসন যখন এতদিন পর দেখতে পেলো অসাংবিধানিকভাবে চলে আসা এই ক্যাসিনো বাণিজ্য, তখন এই চোখ খোলা থাকুক, সকল অপরাধই রাষ্ট্রের চোখে ধরা পড়ুক। কারণ, অন্ধ হলেই বন্ধ হবে না প্রলয়।

  • — লেখক সাংবাাদিক ও উপস্থাপক
  • কার্টসি — মানবজমিন/ অক্টোবর ৭, ২০১৯

Sunday, October 6, 2019

আমরা আইনহীন সমাজের দিকে যাচ্ছি — ড. শাহদীন মালিক

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, আমরা ক্রমে একটি আইনহীন সমাজের দিকে এগোচ্ছি। যেখানে কোনো আইন নেই, আমাদের নিরাপত্তাবোধ থাকবে না, অন্যায়-অপরাধ হলে আইন অনুযায়ী বিচার হবে না। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত ‘জোরপূর্বক গুম বিষয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতা ও জাতিসংঘের সুপারিশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। শাহদীন মালিক বলেন, ক্যাসিনো ব্যবসা পুলিশের নাকের ডগায় হচ্ছে অথচ পুলিশ বলছে তারা জানে না! চারদিকে দুর্নীতি হচ্ছে।

এসব পচন শুরু হয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম দিয়ে। এক্ষেত্রে বড় উদ্বেগ হচ্ছে এর আগে যেসব দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম হয়েছে তাদের থেকে আমরাও আমাদের ভবিষ্যতের চিত্র দেখতে পাই। সে সমাজ আমাদের কারো কাম্য নয়। তিনি বলেন, সমাজে অবশ্যই অপরাধ আছে, অনিয়ম আছে, বিশৃঙ্খলা রয়েছে। তবে কোনো সমাজই আইনের বাইরে গিয়ে এসব সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।

অনেক দেশই মূর্খের মতো এটা ভেবেছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। আমাদের দেশেও একটা ভাবনা এসেছে যে, দু’চারশ মানুষকে গুলি করে হত্যা করলেই মাদক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এটা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ এর আগে কোনো দেশ এ পথে অপরাধ দমন করতে পারেনি। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া হয় ভয়াবহ। তিনি আরও বলেন, আমাদের উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে আমরা টোটালি ল’ লেস সোসাইটির দিকে এগোচ্ছি। প্রতিফলন কি সেটা যারা সরকার চালাচ্ছে তারা দেখে কি-না জানি না, তবে আমি তো দেখি। যারা সরকার চালান তারা কি সব চোখ বুজে থাকেন এমন প্রশ্ন রেখে শাহদীন মালিক বলেন, যেসব দেশে আশির দশকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুম শুরু হয়েছিল সেসব দেশে কী হয়েছিলে সেগুলো তারা দেখেন না কেন? ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হচ্ছে সেন্ট্রাল আমেরিকা থেকে জনগণ আমেরিকায় চলে আসা।

হন্ডুরাস, গুয়েতেমালা, নিকারাগুয়ে এসব দেশ থেকে হাজার হাজার, লাখ লাখ লোক আমেরিকায় আসতে চাইছে, আর ট্রাম্প তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করছে। আশির দশকে এসব দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল এরই ফল হচ্ছে এগুলো। তিনি বলেন, এ লোকগুলো আমেরিকায় আসছে কেন? তাদের সবারই এক কথা অনেকটা আমাদের রোহিঙ্গাদের মতো। তাদের দেশে তাদের কোনো নিরাপত্তা নেই, তারা সম্পূর্ণ অসহায়, সাংঘাতিক ধরণের অপরাধ হচ্ছে, তারপরও সরকার তাদের কোনো সাহায্য করে না। জানে বাঁচতে তারা আমেরিকায় যাচ্ছে। এ সমস্যাটা সত্তর দশকে চিলিতে দেখা দিয়েছিল। কোনো দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুম শুরু হয় এর পরিণতি যে কি হয়, তার বড় উদাহরণ হচ্ছে সেন্ট্রাল আমেরিকার দেশগুলো। তিনি বলেন, আশির দশকে সেন্ট্রাল আমেরিকার দেশগুলোর লোকজনও বলেছিল, সেসব দেশের বিচারব্যবস্থা কিছু হয় না, কিছু ত্বরিত বিচার হলে তথা অপরাধীকে সরিয়ে দিলে অপরাধ দূর হয়ে যাবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে কোনো সমাজ এ পথে গিয়ে অপরাধ দূর করতে পারেনি। বরং সেক্ষেত্রে পুরো সমাজটাই অপরাধপ্রবণ হয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, গুমের অপরাধের দায় সরকারের। বেশির ভাগ গুম যদি সরকার না করে থাকে তাহলে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা র?্যাব-পুলিশের নাম বলে কেন? কেন গুমের ঘটনায় মামলা নেয়া হয় না? মামলা নিলেও গড়িমসি কেন, অগ্রগতি হয় না কেন? যাঁরা ফিরে আসেন তারা মুখে তালা দেন কেন? তিনি বলেন, দেশে আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, ভোটাধিকার, গণতন্ত্র অনেক কিছুই গুম হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যত আলোচনা সব অরণ্যে রোদন। যাদের এসব ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া দেখানোর কথা সেই সরকার কোনো সাড়া দিচ্ছে না। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীপক্ষের আহ্বায়ক শিরিন হক।

  • কার্টসিঃ মানবজমিন/৬ অক্টোবর ২০১৯

আড়ালে তিস্তা, উল্টো ভারত পেল ফেনী নদীর পানি

পানি শূন্য তিস্তা নদী

নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে বহুল আলোচিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে আশাব্যঞ্জক কোনো আলোচনা হয়নি। দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষিত তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ২০১১ সালের একটি অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামোর কথা শেখ হাসিনা স্মরণ করিয়ে দিলেও অতীতের অজুহাত দেখিয়ে দায় সেরেছেন নরেন্দ্র মোদি। বরং উল্টো এখন ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাবরুম শহরে পানীয় হিসেবে সরবরাহে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ।

শনিবার নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই ও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনটি প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।

২০১৭ সালের পর এই প্রথম নয়াদিল্লি সফরে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটিই প্রথম ভারত সফর।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাধার মুখে অতীতে বেশ কয়েকবার তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত তা চূড়ান্ত পরিণতি পায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরেও তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে কোনো সমঝোতা কিংবা চুক্তি সই হয়নি।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ২০১১ সালে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের সরকার একটি অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামোয় একমত হয়েছিল। এই চুক্তির বাস্তবায়ন জানার জন্য বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।


জবাবে নরেন্দ্র মোদি বলেন, তিস্তা চুক্তি যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পাদন করা যায়; সে লক্ষ্যে বিজেপি সরকার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে নিরন্তর কাজ করে চলছে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের কর্তৃপক্ষের মধ্যে দরকষাকষি হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি কেউই। বরং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা তিস্তার বিকল্প হিসেবে অন্য নদীর পানি নিয়ে আলোচনা কিংবা সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদিও সেসব প্রস্তাবও আলোর মুখ দেখেনি।

দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে তিস্তা ছাড়াও আরো ছয়টি অভিন্ন নদী মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, দুধকুমারের পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে শিগগিরই একটি খসড়া কাঠামো প্রস্তুত হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। এই খসড়া কাঠামো প্রস্তুত করতে যৌথ নদী কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়াই কয়েক বছর ধরে ফেনী নদী থেকে ভারত পানি উত্তোলন করছে। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে সীমান্তের জিরো লাইনে পাম্প বসিয়ে নদীটি থেকে পানি উত্তোলন করছে নয়াদিল্লি। পানি উত্তোলন না করতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাতে সাড়া দেয়নি।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সেই ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামো তৈরি করতে যৌথ কমিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। এখন এই ফেনী নদী থেকেই ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি নিয়ে ভারতের ত্রিপুরার সাবরুম শহরের জনগণের জন্য সরবরাহে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ।

তিস্তা চুক্তির বিষয়টি আড়ালে থাকলেও দুই দেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, সাতটি অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক একটি কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে তিস্তার পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে এ কাঠামো অনুস্মরণ করা হতে পারে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অভিন্ন নদী রয়েছে ৫৪টি। এর মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তি আছে শুধু গঙ্গা নিয়ে। সেই গঙ্গা চুক্তিতে ন্যায্যতা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানিচুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেয়ার কথা ভারতের অথচ কোনো কোনো বছর মাত্র দেড় হাজার কিউসেক পানি পেয়েছে বাংলাদেশ। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ঝুলে আছে পাঁচ দশক ধরে। সর্বশেষ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চুক্তিতে রাজি হলেও তিস্তার পথে এখন বাধা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে এসেছে। রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নির্মূল অভিযানে এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও এখনো প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ভারতের শক্তিশালী সমর্থনের ব্যাপারে অনেকে আশাপ্রকাশ করলেও আপাতত তাতেও হতাশ হতে হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির দেয়া যৌথ বিবৃতিতে এবার রোহিঙ্গা শব্দটিও উচ্চারণ করা হয়নি। বিবৃতিতে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের দ্রুত ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পথ প্রশস্ত করতে আরো প্রচেষ্টা দরকার বলে উভয় দেশ ঐকমত্যে পৌঁছেছে। তবে ভারত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কাজে সহায়তা করার লক্ষ্যে রাখাইনে ইতোমধ্যে আড়াইশ ঘর তৈরি করেছে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

সম্প্রতি ভারতের আসাম প্রদেশে জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকা (এনআরসি) করায় সেখানকার ১৯ লাখ মানুষ নাগরিকত্ব হারিয়েছেন; যাদের অনেকেই বাংলাদেশি বলে ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির শীর্ষ স্থানীয় নেতারা বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছেন। এমনকি এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোরও হুমকি এসেছে প্রায়ই।

দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রায় এক সপ্তাহ আগে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনের ফাঁকে একটি বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সেই বৈঠকে এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে নরেন্দ্র মোদি আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু শনিবার নয়াদিল্লিতে বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়েছে তাতে এনআরসি শব্দটিরও উল্লেখ নেই।

  • কার্টসিঃ জাগোনিউজ/ রোববার, ০৬ অক্টোবর ২০১৯