— সৈয়দ ইজাজ কবির
সৈয়দ ইজাজ কবির |
১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি’ গঠনের ঘোষণা দেন এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদেরকে এ দলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে দলকে শক্তিশালী সংঠন হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এর প্রায় চার সপ্তাহ আগে বিভিন্ন শ্রেণীর নাগরিকদের জন্য বঙ্গভবনে এক নৈশভোজে তিনি জাতীয় ঐক্য, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিষয়ে তাঁর ধ্যানধারণা তুলে ধরে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ইঙ্গিত দেন। তারই ধারাবাহিকতায় বিএনপি গঠিত হয়। ভিন্ন মতাদর্শের হলেও, যারাই দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, তাদের কে নিয়ে দল গড়াই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য।
ফলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদেও আদর্শিক ভিত্তি রচিত হয় ও বিস্তার লাভ করে এবং এ দেশের জনগন তা খুব সহজেই আপন করে নেয়। জনগন বুঝতে পারে, বাঙালী জাতীয়তাবাদ এ দেশের মানুষের খণ্ডিত পরিচয় তুলে ধরে, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি রক্ষা করে না এবং সার্বিকভাবে বিশ্বের কাছে দেশ হিসেবে নিজের স্বকীয়তা উপস্থাপন করে না। সেই আদর্শকে সম্পূর্ন রূপ দিতেই রচিত হয় উন্নয়নের ম্যাগনাকার্টা ১৯ দফার। ১৯ দফার ১৬ নম্বর দফায় বলা আছে — “সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা।”
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন।”
১৯৭৮ সালে শহীদ জিয়া স্বচ্ছতার স্বার্থে এই অনুচ্ছেদটি সংবিধানে যোগ করেন। আমাদের সংবিধানে আরো একটি শর্ত যোগ করা আছে, আর তা হলো “জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোন চুক্তি কেবলমাত্র সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।” সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে, যা হোক, যেভাবেই হোক, আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে পেশ করতেই হবে। আর তা না হয়ে থাকলে বাংলাদেশের আইনের চোখে বলবৎ যোগ্য চুক্তি বলে গণ্য করা সম্ভব নয়। সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের সাথে আন্তর্জাতিক অঙ্গন ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক চুক্তি ভূরাজনীতিতে সামগ্রিকভাবে গুরুত্ব রাখে। বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার চুক্তিগুলো আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন দেশের সম্পর্কের ধরণ ও গতিপ্রকৃতি, বিশেষ করে প্রতিবেশি বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের সাথে আমাদের অম্লমধুর সম্পর্কটা বুঝতে হলে একটু ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে।
শেখ মুজিবের শাসনামলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘেঁষা। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ-সোভিয়েত সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি হয়। সোভিয়েতরা বাংলাদেশে ব্যবহৃত তাদের সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। জিয়ার সরকার সে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে, আর সম্ভবত সে কারণেই মুজিব আমলে মস্কোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হকের নিয়োগ বাতিল করেননি।
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি, জাতিসংঘ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা এবং কমনওয়েলথ-এর সদস্যপদ লাভের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীন ভূমিকা পালন করা সহজ হয়ে ওঠে।
পররাষ্ট্রনীতির বিষয়েও শহীদ জিয়ার নিজস্ব ধ্যান ধারণা ছিল। তা হলো বাংলাদেশ যেন নিজের পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন বলেই তার এমন আকাঙ্খা ছিল। জিয়া পররাষ্ট্রনীতিকে খুব সরলীকরণ করে দেখতে পারতেন। তাঁর কাছে পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় জিনিস ছিল জাতীয় সত্ত্বা অক্ষুন্ন রেখে জাতীয় স্বার্থরক্ষা ও তা হাসিল করতে পারা।
জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির তিনটি মূল লক্ষ্য ছিল — ১. স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত এবং নিরাপদকরণ ২. দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা এবং ৩. আন্তর্জাতিকভাবে শান্তি, স্বাধীনতা এবং প্রগতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে উন্নত করা। কোন এক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব রাখা জিয়ার নীতিতে ছিল না। জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন মাত্রা ও গতি যুক্ত হয় এবং তা সারা বিশ্বে ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। চীন, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। যার ফলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে দরকষাকষি করা বাংলাদেশের জন্য অনেকটা সহজ হয়ে যায়। পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে উন্নত সম্পর্কের ফলে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ উন্মোচিত হয়। জিয়া বিশ্বাস করতেন, পররাষ্ট্রনীতি সকল সময়ে একটি গতিশীল প্রক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও জাতীয় স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল। তিনি এক বিদেশি সাংবাদিককে একবার বলেছিলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বহুমুখী, যার অর্থ বন্ধুত্বের মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। তিনি আরো বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জাতীয় উন্নয়নের জন্য এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা খুবই জরুরি।
কোন ক্ষমতার ব্লকে যোগদান না করে এ অঞ্চলের সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমেই এটা সম্ভব। এতে বুঝা যায় জিয়া বাংলাদেশের জন্য সকলের সঙ্গে সম্পর্কের পররাষ্ট্রনীতিতে (Inclusive foreign policy) বিশ্বাস করতেন। আর তাঁর প্রমাণ, জিয়ার উদ্যোগে পরবর্তীতে সার্ক (SAARC) প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
জিয়ার স্বাধীন অবস্থান ভারতকে বিচলিত করে রাখতো, সেই প্রমাণ দেখা যায় জিয়ার দিল্লি সফরের সময়। ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লি সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জিয়ার কাছে জানতে চান, কেন বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে বস্ত্র শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, দিল্লী সফর শেষে জিয়া ঢাকা ফেরার এক মাসের মধ্যেই এখানে ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের যন্ত্রপাতির একটা প্রদর্শনী করা হয়। হাস্যকর হলেও সত্য যে এই ২০১৮ সালেও ভারত বস্ত্রশিল্পের যন্ত্রপাতি রপ্তানী করতে কতটুকু সফল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত, তা এখনও নিশ্চিত নয়। অথচ ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ইন্দিরা গান্ধীর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় এই বস্ত্রশিল্প যন্ত্রপাতি অন্য দেশ থেকে আমদানি করার জন্য। জিয়া আন্তর্জাতিক মহলে কোন দেশের সাথে বৈরিতা চাননি যার ফলে ভারত সফরের এক মাসের মধ্যেই তিনি ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের যন্ত্রপাতির একটি প্রদর্শনী করার বন্দোবস্ত করেন বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে জিয়া তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ১৯৭৬ সালে ইসলামিক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সপ্তম সম্মেলনে (আইসিএফএম) যোগ দিয়েছিলেন এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক সংহত করতে সফল হয়েছিলেন। তিনি ফারাক্কা বাঁধ প্রশ্নে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সমর্থন আইসিএফএম-এর যৌথ ইশতেহারেও প্রতিফলিত হয়েছে। ৫ম জোটনিরপক্ষ আন্দোলন (ন্যাম)-এ ১২ সদস্যের এক প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে ১৯৭৬ সালে কলম্বো যান তিনি। সে সময় তিনি অনেক বিশ্বনেতাদের সঙ্গে একক বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু বহু কূটনৈতিক চেষ্টা সত্ত্বেও সেই সময় কলম্বোয় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে জিয়ার আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি। জিয়া যখন প্রথম ভারত সফরে যান তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মোরারজী দেশাই। কিন্তু ১৯৮০ সালের আগে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে জিয়ার কোন আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি।
ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে জিয়া পানি বণ্টনের বিষয়টি উত্থাপন করেন, যা ভারতের কাছে অগ্রহনযোগ্য ছিল। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে ভারত যে সিকিম দখল করে নেয়, সেটাও ন্যাম নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করেননি।
জিয়ার শাসনামলে চীনের সাথে সম্পর্ক ছিল অতি উষ্ণ ও শক্তিশালী। জানুয়ারি ২, ১৯৭৭, জিয়া চীনের রাজধানী বেইজিং পৌঁছলে তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধার এক অসাধারণ প্রকাশ হিসেবে রাষ্ট্রাচারের আনুষ্ঠানিকতা উপেক্ষা করে জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে চায়না কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান হুয়া গুয়ো ফেং বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। যখনি বাংলাদেশে কোন সংকট উপস্থিত হয়েছে, বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছে। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি জিয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিচালনা করতেন। বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশি ভারত। আর চীনের সাথে রয়েছে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত। আর এ কারনেই জিয়ার বুঝতে দেরি হয়নি যে এই উপমহাদেশে চীনের ভূমিকা কতোটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানও চীনের জন্য কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের সাথে জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকাকালেই, দুদেশের সহযোগিতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো সংস্কৃতি, অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা ও বিশ্ব রাজনীতি। সেই সময় গংগার পানি ভাগাভাগি ও সীমান্তের ওপার থেকে চালানো সশস্ত্র হামলার ইস্যু দুটি জিয়ার জন্য অতিশয় গুরত্বপূর্ণ ছিলো। বেইজিং বৈঠকগুলোতে তিনি সীমান্ত এলাকায় সশস্ত্র হামলার কথা উত্থাপন করেন এবং দুষ্কৃতকারীদেও দমনে চায়নার নেতারা তাঁকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। ইরানের সাথেও বাংলাদেশের ছিল একটি শক্তিশালী সম্পর্ক। ১৯৭৭ সাল থেকে জিয়ার ধারাবাহিকভাবে চালানো বিভিন্ন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশের সাথে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সাথেই গড়ে উঠে সুসম্পর্ক।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেন জানি সব সময় টক, ঝাল আর মিষ্টি মিশ্রিত। জিয়া নিহত হওয়ার প্রায় তিন সপ্তাহ আগে ভারত কে নিয়ে এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ৯ মে ১৯৮১ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ তালপট্টিতে সেনা অবতরণ ঘটানো হয়। বাংলাদেশ এতে বিস্ময় প্রকাশ করে নয়া দিল্লিকে অনুরোধ জানায় যাতে তারা ঐ দ্বীপ থেকে অবিলম্বে পতাকাসহ সৈনিক ও মালামাল সরিয়ে নেয়। এই ঘটনায় সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে অকুন্ঠ সমর্থন পেলেও তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামীলীগ ঘটনাটির ব্যপারে অতি সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করে।
এই ঘটনার আগে, সেপ্টেম্বর ৩, ১৯৮০, সাউথ ব্লকে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে জিয়ার আধাঘন্টারও বেশী সময় ধরে একান্ত আলাপ হয়। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচ্যসূচিতে ছিল মূলত গঙ্গার পানি বন্টন, ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি এবং বাংলাদেশে সফরে আসার জন্য ইন্দিরাকে আমন্ত্রণ জানানোর মতো দ্বিপাক্ষিক বিষয়াবলি এবং ছয় জাতি শীর্ষ সম্মেলনের জন্য জিয়ার প্রস্তাব। বৈঠকের আগে ভারতীয় পক্ষ জানিয়েছিল, ইন্দিরা গান্ধী দক্ষিণ তালপট্টি ইস্যু নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নন।
বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী |
জানুয়ারি ২১, ১৯৮০, বেগম খালেদা জিয়াসহ প্রতিনিধিদল নিয়ে জিয়া ভারতে এক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। জিয়া বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনি বিভিন্ন ইস্যু ও সমস্যা নিয়ে বন্ধুত্বপুর্ণ পরিবেশে বৈঠক করেছেন। কিন্তু ড. আর এ গনির কথায় একটু ভিন্ন সুর পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “দিল্লি থেকে ফেরার পর জিয়া মিসেস গান্ধীর সঙ্গে তাঁর আলোচনা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। জিয়া তাঁদের জানান যে মিসেস গান্ধী তাঁকে বলেছেন, ‘আমারা অখণ্ড ভারতের ধারণা বাদ দেইনি, কাজেই আপনারা ওভাবেই চলুন’। একথা মন্ত্রিসভার কার্যবিবরণীতে তোলা হয় নি। কিন্তু তাঁর মন্ত্রীরা এখনো একথা স্মরণ করতে পারবেন।
সার্বিকভাবে যদি জিয়ার রাজনীতি পর্যালোচনা করা যায় তাহলে সন্দেহাতীত ভাবে বলা যাবে, জিয়া ছিলেন একজন খাঁটি বাংলাদেশপন্থি। এরকম উস্কানিমূলক কথা বলার পরেও তিনি ভারত কে চটান নি। আবার তাদের কাছে নিজেকে বিকিয়েও দেননি।
জিয়া মনে করতেন, দেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা নিশ্চিত করাই বিএনপি‘র পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য। জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশ পঞ্চাশটিরও অধিক মুসলিম দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। ইউরোপও বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জিয়া যে অবদান রেখে গেছেন সে ব্যাপারে হেনরি কিসিঞ্জরের সেই কথাটি প্রযোজ্য — ‘যে কোন দেশেই, যে সব পররাষ্ট্রনীতিকে ইতিহাস উচ্চ মর্যাদা দিয়েছে তাদের বেশির ভাগ এসেছে সেই সব নেতার কাছ থেকে, বিশেষজ্ঞরা যাঁদের বিরোধিতা করেছিলেন।” জিয়া আমদের দুই প্রতিবেশির সাথেই সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেছেন এবং সফল ও হয়েছেন। ভারতের বাঁকা কথাতেও জিয়া বৈরী সম্পর্ক হতে দেননি এবং ন্যায্য দাবী আদায়ও করেছেন।
আবার চীনের সাথেও শক্তিশালী বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়েছেন। সূত্র একটি, স্বাধীনভাবে চলা এবং সবাইকে বন্ধুসুলভ সম্মান দেওয়া। বুদ্ধিমত্তার সাথে সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। বর্তমান পরিস্থতিতে আমাদের আবার সময় এসেছে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একটু ভেবে দেখবার। দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, আর কোন দিকে
যাওয়া উচিৎ, এটা না হয় পাঠকেরাই ভেবে দেখবেন। এটাকেই বলা হচ্ছে, ‘পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি’ যা পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে একটি নতুন ধ্যানধারণা।
- লেখক আইনজীবি ও রাজনৈতিক কর্মী