Search

Saturday, August 8, 2020

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করুন

ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম 

ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম

উনপঞ্চাশ বছর পরও স্বাধীনতাত্তোর সরকারের মত বর্তমান শাসকগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক নতুন সংস্করণের চর্চা শুরু করেছে। যেখানে অপশাসন-দুঃশাসন, বন্ধুকযুদ্ধ-ক্রসফায়ার, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ব্যাংক ডাকাতিসহ জনগণের নাগরিক স্বাধীনতা, ভোটাধিকার, মৌলিক ও মানবাধিকার খর্ব হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি, সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে কক্সবাজারের টেকনাফ থানা পুলিশ কর্তৃক হত্যার পর কথিত বন্ধুকযুদ্ধ-ক্রসফায়ারের কল্পকাহিনী তৈরি করা হয়েছে। গত ২২ মাসে কক্সবাজারে পুলিশের সঙ্গে তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ১৭৪ জন। পুরো সময়টাতেই টেকনাফ থানার অফিসার্স ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন প্রদীপ কুমার দাশ। 










এখন টেকনাফ থানা ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ জন্য দেশে আলোচিত। ক্রসফায়ারের বেশির ভাগই ঘটেছে মেরিন ড্রাইভ এলাকায়। স্থানীয়দের কাছে জায়গাটি ‘ডেথজোন’ হিসেবে পরিচিত। ইয়াবা চোরাচালান বন্ধের নামে এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করা হয়েছে। আর এসব ক্রসফায়ারে নিহতদের ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে প্রচার করে ওসি প্রদীপ নিজে কৃতিত্ব নিতেন। কিন্তু ইয়াবা চোরাচালান থেমে নেই। তবে টেকনাফের মানুষ বলছেন, তিনি মূলত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষার জন্য এসব ক্রসফায়ার দিতেন। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠতা। ইয়াবা ব্যবসায়ী সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদির সঙ্গেও ছিল তার দারুণ সখ্য। বদির সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের বিভিন্ন ছবি ঘুরছে সামাজিক মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, এসব ক্রসফায়ার দিয়ে একাধিকবার অর্জন করেছেন পুলিশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদক। কথিত এই ক্রসফায়ারের জন্য ২০১৯ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক’ বা বিপিএম পেয়েছিলেন প্রদীপ। পদক পাওয়ার জন্য তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ছয়টি কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ করেন। সব ক’টিতেই ক্রসফায়ারের ঘটনা ছিল। মানবাধিকার সংস্থা ও পুলিশের তথ্য মতে, ২০১৮ সালের মে থেকে গত ৩০শে জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজারে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি’র সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২৮৭ জন নিহত হয়। এর মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ১৭৪, র‍্যাবের সঙ্গে ৫১, বিজিবি’র সঙ্গে ৬২ জন নিহত হয়। শুধু টেকনাফেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে ১৬১ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য মতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে ১৬৭৭ জন। ২০১৯ ছয় (জানুয়ারি থেকে জুন) মাসে দেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ২০৪ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। বন্ধুকযুদ্ধ-ক্রসফায়ার, মিডনাইট নির্বাচন, করোনাভাইরাস, ক্যাসিনো, দুর্নীতিবাজ, প্রতারক, লুটেরা, বাটপার, দেহব্যবসায়ী, সিন্ডিকেট, গডফাদার, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সন্ত্রাস ও গুম-খুনের কারনে রাষ্ট্র ব্যবস্থা একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের কোন প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এখন আর নাই। এরপরও যদি বলা হয় দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাহলে বর্তমানে যে তথাকথিত সুশাসন ও আইনের শাসন চলছে, এটা কতটা নিম্নমুখী হলে মানুষ জাগ্রত হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল লক্ষ্য ছিল —  সুশাসন, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ, এক উদারচেতা, পরমতসহিষ্ণু, সংস্কৃতিমনা সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সুখী-সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশ গড়তে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বর্তমান নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, তানাহলে এসব থেকে কারও পরিত্রাণ নেই। এটা শুধু বিরোধী দলের একার কাজ নয়। 

  •  লেখক সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র । 


No comments:

Post a Comment