Search

Tuesday, August 11, 2020

সিঙ্গারার (লীগের) ভেতরে আলু (শাহেদ) ঢুকলো কিভাবে?

—  মিনার রশীদ 

মিনার রশীদ 


অজ পাড়াগাঁওয়ের   জনৈক আব্দুল আলী শহর দেখতে এসেছে। শহরে পা ফেলে যা দেখে তাতেই অবাক  হয়। বাস থেকে নেমে কিছু  খাওয়ার জন্যে একটি  খাবারের হোটেলে ঢুকে। সেখানে প্রথমবারের মত আজব  পিঠার মত দেখতে একটি জিনিস খায়। জিনিসটির  নাম নাকি ‘সিঙ্গারা’!   অবাক করা ব্যাপার!  ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আজব জিনিসটি দেখে। কোনওভাবেই   মাথায় ঢুকছে  না, এই পিঠার  (সিঙ্গারার) ভেতরে আলু  কিভাবে  ঢুকলো?  

এই আব্দুল আলীর মত কিছু আব্দুল আলী আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনীতি জগতেও অবস্থান করছেন। একই সরলতায় এরা প্রশ্ন করছে, আওয়ামী লীগের এত ভেতরে বা গহীনে   শাহেদ, সাবরিনা, পাপিয়া, জিকে শামীম এরা কীভাবে ঢুকলো? ৭১ টিভিসহ আরো কিছু টিভি চ্যানেল ও পত্রিকা নিজ নিজ জায়গা থেকে যথারীতি ড্যামেজ কন্ট্রোলের মিশনে নেমে পড়েছে। এব্যাপারে  কারো কারো পেরেশানি বা বুদ্ধিবৃত্তিক কসরত উপভোগ করার  মত। ইনিয়ে বিনিয়ে এরা সরল এই প্রশ্নটি রাখছেন। কিছুটা দোষ কিভাবে বিএনপি-জামায়াতের ঘাড়ে চাপানো যায়, সেই  চেষ্টাও জারি রেখেছেন। 

দেশবাসীর এখন দায় পড়েছে তাদের এই প্রশ্নটি খোলাসা করার।  এই আব্দুল আলীদের কাছে এখন ব্যাখ্যা করতে হবে, সিঙ্গারার ভেতরে এই আলুটি কিভাবে ঢুকলো? 

এদের সর্বোচ্চ গবেষণা এখন — এই  শাহেদরা  কিভাবে রাষ্ট্রের এত এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের এত কাছাকাছি চলে গেলেন? তাদের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ অতি পবিত্র দল!  এই দলের নেত্রীকে বিশ্বের দ্বিতীয় সৎ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখানোর এই জোকারদের  হাস্যকর প্রচেষ্টাটি আরেকটু হাস্যকর হয়ে পড়ছে। এই অতি চালাকেরা দেশের মানুষকে সত্যি সত্যি ‘গরু-ছাগল’  ভেবেছে । এক মন্ত্রীতো এজন্যে দেশবাসীকে কচুরিপানা খাওয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন!


এদের দাবি, এই দলে কোনো খারাপ মানুষ থাকতে পারে না।  কাজেই  বিএনপি জামায়াতের ষড়যন্ত্র আবিস্কারের নিমিত্তে  আগে থেকে প্রস্তুত (well equipped)  ডুবুরির দল নেমে পড়ল। এই ডুবুরির দল ভক্তদের  নিরাশ করে নাই। শাহেদের সাথে হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততাও ইতোমধ্যে আবিস্কার করে ফেলেছে!  হাছান মাহমুদ  তার কাছ থেকে কাঙ্খিত  বোমাটি ঠিক সময়েই ফাটিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন,   তারেক রহমানের সাথে স্কাইপিতে যোগাযোগ করেছে শাহেদ।  এখন শাহেদের যেখানে, ‘ভাই আপনি আমার বাপ লাগেন’ বলে কোনো এক শামীম ওসমানের সঙ্গে যোগাযোগ করার  কথা, সেখানে নাকি  তিনি কথা বলেছেন বিএনপির টপ নেতার সঙ্গে!! 

মৃত্যুর পর এই ভদ্রলোকের মগজটি  সত্যিই জাদুঘরে সংরক্ষণ করে রাখা  দরকার। এই আজব চীজ শতাব্দিতে দুয়েকটির বেশি জন্ম নেয় না। 

এই ধরণের কোনো মন্তব্য বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোনো মন্ত্রী বা এই মাপের নেতা করলে এদেশের সাংবাদিকগণ  সত্যি সেই নেতা বা মন্ত্রীকে ফানা ফানা করে ফেলতেন। 

আজকের এই আব্দুল আলীরাই আমাদের মিডিয়া ও বুদ্ধিজগতের একেক দিকপাল সেজে বসেছেন। কেউ কেউ নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীর তকমাও লাগিয়েছিলেন!  নিরপেক্ষভাবেই এই সুশীলদের এক বড় অংশ এখন চুপ মেরে রয়েছেন। সময় হলে ইনারা জাগবেন। 

২০০৪ থেকে ২০০৬ সালে এদের বিলাপে সারা দেশ ও বিশ্ববাসীর অন্তরাত্মা কেঁপে   ওঠেছিল । কেউ কেউ প্রায় প্রতিদিন নিজ নিজ   পত্রিকার প্রথম পাতায় গুরু গম্ভীর  ‘মন্তব্য কলাম’ প্রকাশ করতেন। তাদের  এক কথা —  রাষ্ট্রটি অকার্যকর বা নন ফাংশনিং হয়ে পড়ছে। ‘বাঘ আসছে’   বলে এরা  বিকট চিৎকার  করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলতেন। অথচ আজ সেই  জ্যান্ত   বাঘ চোখের সামনে  দেখেও ভাবজগতের এই আব্দুল আলীরা  মুখে কুঁলুপ এঁটে বসেছেন! 

এদের সর্বোচ্চ গবেষণা এখন —    রিজেন্ট হাসপাতালের এই  শাহেদরা  কিভাবে শাসক দলের এত  অন্দরে  ঢুকলো? 

দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি এদেশে নতুন কিছু নয় । বলতে গেলে এটি আমাদের সম্মিলিত অপরাধ । 

কিন্তু  দুর্নীতিকে এভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার নমুনা এর আগে আর কখনোই দেখা যায় নি। সন্দেহ নাই  এরশাদ এই দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন। আর তারই ঘোষিত বোনের সময় এটি বর্তমান চূড়ায় পৌছেছে  । 

গত বছর জুলাই মাসে দুদক চেয়ারম্যান বলেছিলেন, সরকারী কর্মকর্তারা সরল বিশ্বাসে দুর্নীতিতে জড়ালে তা অপরাধ হবে না। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সরকারী কর্মকর্তাদের প্রতি উপদেশ রেখেছিলেন, ‘আপনারা ঘুষ খান, একটু রয়ে সয়ে’। রাবিশ নামে পরিচিত অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ক্ষমতায় থাকলে সম্পদ একটু আধটু বাড়বেই’। তিনি আরো স্বীকার করেছিলেন, ‘এখন শুধু পুকুর চুরি না, রীতিমত সাগর চুরি হচ্ছে’। হলমার্কের চার হাজার কোটি টাকার লুটপাটকে তিনি  বলেছিলেন  ‘পিনাট’।  নিশিথরাতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি ইন্ডিয়াকে যা দিয়েছি তা কোনোদিন ভুলতে পারবে না। 

এতকিছুর পরেও এক শ্রেণীর জ্ঞানপাপীরা বুঝতে পারছেন না, শাহেদ সাবরিনার মত বাটপার আওয়ামীলীগে  কিভাবে ঢুকলো ?

আশার কথা, নঈম নিজাম, পীর হাবিব, প্রমুখ সাংবাদিকদেরও বিবেক এখন জাগ্রত হচ্ছে। দুর্নীতির কান ধরে  ইনারাও ইদানিং টানাটানি করছেন তবে টানটি এমন রয়ে সয়ে  দিচ্ছেন যাতে আবার পুরো মাথাটি বের না হয়ে পড়ে। 

জেকেজির টেস্ট নিয়ে যখন সরকার বেকায়দায় পড়ে তখন সরকারকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন বুয়েটের প্রাক্তন  ছাত্রলীগ নেতা ও প্রথম আলোর আনিসুল হক । তিনি তার গদ্য কার্টুনে এক চমৎকার গল্প ফাঁদেন। তাতে মনে হবে সরকার ধোয়া তুলসী পাতা। চরিত্র খারাপ এই জাতির! 

এই আনিসুল হক গং দুরবিন দিয়ে আমেরিকা, ইউরোপ, চায়নাতে মানবতার বিপর্যয় দেখেন এবং কয়েকজন মিষ্টিমুখের তারকাদের নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করেন। এমনকি নিকট প্রতিবেশী ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের বিপর্যয়ও এই মানবতাবাদি দেখতে পেয়েছেন। শুধু দেখতে পান নি  ঘরের ভেতরে কী ঘটেছে বা এখনও ঘটছে তা!  

জানি না ডাক্তারি  পরিভাষায়  আনিসুল হক এবং পীর হাবিবদের এই বিশেষ রোগের কোনো বিশেষ নাম রয়েছে কি না। এজন্যেই যে কথাটি বার বার বলতে চেয়েছি তাহলো আমাদের পচন ধরেছে মগজে। সেই মগজের চিকিৎসা না করলে এই জাতির ব্যারাম দূর হবে না। আনিসুল হকদের যুক্তি মেনে নিলে সরকারের আর কোনো দায় থাকে না। সব দায় প্রতারক জাতির। সরকার সরল বিশ্বাসেই কোভিড টেস্টের দায়িত্ব জেকেজি নামক প্রতারক কোম্পানিকে দিয়েছে। দোষ সরকারের না। দোষ এই জাতির খাসলতের। 

এরা অনেক কিছু খুঁজে পেলেও ধরা পড়ার আগে শাহেদদের খুঁজে পান  না। চলুন, একটা সহজ হিসাব কষি। ধরুন,  এই শাহেদ  ৫০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এই শাহেদকে যদি  এখন দুর্নীতি পরিমাপের একটা ইউনিট ধরি  তবে   দেশ থেকে গত এগারো বারো বছরে যে ৭ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে সেখানে কমপক্ষে (৭ লাখ কোটি ভাগ ৫০০ কোটি) ১৪০০ জন শাহেদের সাইজের  দানব সৃষ্টি হয়েছে। শেয়ার বাজার থেকে যে ১ লাখ কোটি টাকা লুট করা হয়েছে সেখানে ২০০ জন শাহেদের মত দানব রয়েছে। কুইক রেন্টাল থেকে যে ৫১ হাজার কোটি টাকা লুট করা হয়েছে সেখানেও ১০০ জনের   মত শাহেদ সাইজের দৈত্য    রয়েছে। এগুলো তো জানার মধ্যে। এই হিসাবের বাইরে রয়েছে আরো অসংখ্য দানব। এই অসংখ্য দানবদের  কখনোই ধরা যাবে না  বা ধরা হবে না। সোনালী ব্যাংক ভক্ষণ করেও এই দানবদের কেউ  টকশোর মূখ্য আলোচক থাকবেন  এবং  জাতিকে অবলীলায় এরিস্টটল, সক্রেটিসের জ্ঞান বিতরণ করবেন। শাহেদের সাথে এই সব জ্ঞানীগুণীদের পার্থক্য শুধুমাত্র এই জায়গায় যে  ভাগ্যের ফেরে  শাহেদ ভুল জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছিল। 

মিডিয়ার এই সব আব্দুল আলীরা ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছু বললেও পালের গোদাকে চিহ্নিত করবে না। কখনোই প্রশ্ন করবে না, এই  সব শত শত বা হাজার হাজার দানব তৈরির মূল দায়টি কার বা কাদের?  পৃথিবীর যে সব সভ্য দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে সব দেশে কোনো অন্যায় বা দুর্নীতি সংঘটিত হলে সর্বোচ্চ মহলকে পাকড়াও করা হয় বা দায়ী করা হয় কিন্তু আমাদের এখানে যত নিচ দিয়ে কাজটি সারা যায় সেই চেষ্টা করা হয়। তাই অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে  শুদ্ধি অভিযান চালানো হয় কিন্তু জিকে শামীম বা শাহেদদের জন্ম কখনোই বন্ধ হয় না । 

প্রধানমন্ত্রী ঠিকই  বলেছেন, শাহেদদের বিএনপি ধরে নাই, তারাই ধরেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কখন ধরেছেন? ধরেছেন তখনই যখন ইতোমধ্যে সাত মাসের ফোলা  পেটটি দৃষ্টিগোচর হয়ে গেছে। শাহেদ সাবরিনাদের ধরেছেন তখনই  যখন  পৃথিবীর না না দেশে ফেইক কোভিড-১৯ টেস্ট নিয়ে স্বদেশীরা  ধরা খেয়েছেন। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলে  মোড়লের মত বলেন, ‘নেমে পড়েছি । সামনেই কুটুমের বাড়ি’ 

জানি না , এই টেকনিক আর কতদিন কাজে দেবে ?


  • লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। 


No comments:

Post a Comment