Search

Saturday, August 15, 2020

এতিমের প্রকারভেদ এবং ভিভিআইপি এতিম

—  মিনার রশীদ

কিছুদিন  আগে একটি  পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ভিসির একটি কাহিনী  ভাইরাল হয়ে পড়েছিল । সেই ভিসি  সাহেব এসএসসি পাশ এক এতিম মেয়েকে  মাস্টার রুলে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন।  দয়া এবং জ্ঞানের সাগর সেই ভিসি মহাশয়  নিজের  ব্যাচেলর বাংলোতে (অফিসিয়াল  স্ত্রী অন্য জায়গায়)   সেই অনাথ মেয়েটির  আশ্রয়েরও ব্যবস্থা করেন। কিছুদিন পর এতিম মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং যথারীতি সাহসিকতার সাথে (এবরশনের চাপ থাকা সত্ত্বেও) একটি সন্তান প্রসব করেন।  এমতাবস্থায় নীতিনিষ্ঠ বিশেষ চেতনাধারী সেই ভিসি সাহেব মেয়েটিকে  কলঙ্কিনী আখ্যা  দিয়ে  সন্তানসহ বের করে দেন। তখন এতিম মেয়েটি স্থানীয় সাংবাদিকদের শরণাপন্ন হন। ঘটনার  চৌম্বক অংশ ছিল মেয়েটিকে বলা  ভিসি সাহেবের মন ছুয়ে যাওয়া   নিবেদনটি , ‘তুমি এতিম, আমিও এতিম ....’।  এই ভাবে দুই এতিম কাছাকাছি  আসায় তৃতীয় এতিমটির  জন্ম হয়। এই কিছিমে ভিআইপি এতিমগণ   পিতৃ পরিচয়হীন সাধারণ এতিমের জন্ম দেন। 

একটি উদাহরণে তিন কিছিমের তিনটি  এতিম রয়েছে বলে ঘটনাটি উল্লেখের লোভ সংবরণ করতে  পারলাম না । দেশে এই কিছিমের  প্রচুর ভিআইপি এতিম থাকলেও ভিভিআইপি এতিম রয়েছে মনে হয় মাত্র  দুজন। এতিমের প্রতি সমাজের এই সহজাত সহানুভূতি শুধু  অর্থ  কিংবা প্রেম ভিক্ষার কাজেই  লাগছে  না — রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহণ বা টিকে থাকার জন্যেও খুবই  কাজে  দিচ্ছে । 

প্রিয় পাঠক, কারো আবেগকে আহত করার জন্যে নয় — মনের একটা বেদনা থেকেই লেখাটি লিখছি। আমরা সবাই নিজ নিজ এতিমের কান্না নিয়েই ব্যস্ত। সকল এতিমের কান্না কখন আমাদের সকলকে স্পর্শ করবে, জানি না ।  শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার কান্নার রঙ থেকে লক্ষ্মীপুরের ডাক্তার ফয়েজের  মেয়ের কান্না বা বেদনার  রঙ কি আসলেই আলাদা? কিংবা ইলিয়াস আলীর কন্যার কান্নার রঙ থেকে  কমিশনার একরামুলের  কন্যার সেই কান্না, আব্বু তুমি কান্না করতেছো  যে? 

সাধারণ এতিমের কান্না আমাদের কানে ঢুকানো হয় না। ভিভিআইপি এতিমের কান্না বা আহাজারি বার বার আমাদের কানে ঢুকানো হয়। তবে ‘ভিভিআইপি এতিম’ শব্দটি  কেন ব্যবহার করলাম, সেই জবাবের আগে গতকাল বাসস পরিবেশিত সংবাদটির উপর একটু চোখ বুলিয়ে নেন । 

’৭৫ এর ১৫ আগস্ট তাঁর পিতা-মাতাসহ পরিবারের সদস্যদের নিহত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই আমরা এতিমদের বেদনা খুব ভালোভাবে অনুভব করতে পারি। কারণ আমরা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এতিম হয়েছি। তোমরা একেবারে একা না। আমরা আছি তোমাদের পাশে। আমি এবং আমার ছোট বোন (শেখ রেহানা) সব সময় তোমাদের কথা চিন্তা করি, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি যখন বলেন, ‘আমি আমার মা বাবা ভাই সব হারিয়েছি’, তখন মনে হয় পাথরের হৃদয়ও বিদীর্ণ হয়ে যায় । 

এতিমদের কথা যিনি এত  ভাবেন, তাদের বেদনা এতটুকু  উপলব্ধি করেন  সেই  তাঁর  সরকারী এবং বেসরকারী বাহিনীর হাতে কতগুলি হত্যা ও গুম হয়েছে তা দেখে  অঙ্ক মিলে না । গত দশ বছরে কয়েক হাজার বিচার বহির্ভূতহত্যা, গুম, হেফাজত কিলিং, সাঈদী ইস্যুতে জামায়াত কিলিং সব কিছু মিলিয়ে কমপক্ষে ৫ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা বা গায়েব করা হয়েছে । এর মাধ্যমে কমপক্ষে পনের থেকে বিশ হাজার বনি আদমের সন্তানকে এতিমের স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন। নির্মম পরিহাসের বিষয় হলো,   এই ভিক্টিমদের  কারো সাথেই নিজের এতিম হওয়ার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। মজার ব্যাপার হলো, এতকিছুর পরেও উনার ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’  হতে অসুবিধা হয় নাই। 



হায়রে সেলুকাস! কী আজব এই দেশ! এ এক আজব খেলা। সাপ হয়ে দংশন করে, ওঝা হয়ে ঝাড়ে। এই সব ঘটনার  মধ্যে দুয়েকটি  ভাইরাল হলে  ক্ষণেক  ভাগ্যবান সেই  এতিম বা স্বজন হারারা ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’র  তাৎক্ষণিক উষ্ণ হাগ বা  সান্ত্বনা উপভোগ করেন।  এরকম হাগ বা সান্ত্বনার গ্যারান্টি থাকলেও বিচারের গ্যারান্টি নেই । এসব কেরামতি দেখে   এটিকে আর কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলে মনে  হয় না — মনে  হয় ব্যান্ডিট কুইন বা ডাকু রাণীর  প্রভাবিত এলাকা।  

বিষয়টি বুঝানোর জন্যে আমি একটি প্লেইনের উদাহরণ টানি । মনে করুন, একজন পাইলট প্লেইন ক্র্যাশে  স্ত্রীপুত্রসহ  নিহত  হয়েছেন। দয়ার্দ্র  পাসেন্জারবর্গ সেই পাইলটের জীবিত কন্যাকেই আবার প্লেইন চালানোর দায়িত্ব অর্পণ করে নিজেরা সেই প্লেইনের যাত্রী হয়েছেন । এই গল্পটি শুনলে সেই প্লেইনের প্যাসেন্জারদেরকে দয়াবান বললেও চরম বেকুব হিসাবে আখ্যায়িত করবেন। বলবেন, এই কাজটি করার আগে ওদের উচিত ছিল সেই কন্যার সাইকোলজিকেল টেsT করা, তার মানসিক বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া। কারণ এমন একটি পারিবারিক ট্রাজেডির পর সেই কন্যার পক্ষে  প্লেইন চালানো তো দূরের কথা, তার পক্ষে মানসিকভাবে স্বাভাবিক  থাকাটাই  অস্বাভাবিক ব্যাপার । মানুষ হিসাবে দয়া দেখানো যেতে পারে, সহানুভূতি দেখানো যেতে পারে কিন্তু কোনওভাবেই দেশরুপী প্লেইনটির চালকের আসনে বসিয়ে নিজ ও জাতির জীবনকে বিপন্ন করা সমুচিন হচ্ছে  না ।  

আমাদের উচ্চ আদালত  যখন  নির্ভয়ে সত্য কথা বলতে পারতো তখন এই কন্যাকে রং হেডেড ঘোষণা দিয়েছিল ।  কারণ সেই ধরণের সিম্পটম দেখিয়ে চলছেন । তা না হলে একজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে একটি রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ যেমন নির্বাচন কমিশন, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন,  বিচার ব্যবস্থা, গণমাধ্যম,  শিক্ষা ব্যবস্থা এবং অর্থনীতিকে এমনভাবে ধ্বংস করা সম্ভব হতো  না । দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী হিসাবে একজন  প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেশের সকল মানুষের 

(ভিন্ন মতাবলম্বীসহ) জান ও মালের নিরাপত্তা বিধান করা। সেখানে হাজার হাজার ভিন্ন মতাবলম্বী কিংবা বিরোধীদলের নেতাকর্মীকে খুন গুম করে তাদের মধ্যে দুয়েকজন ভাইরাল এতিম-বিধবা-সন্তানহারাকে ডেকে হাগ করা বা সান্ত্বনার নাটক প্রধানমন্ত্রীর কাজ নয় ।

জীবনটা হয়ে গেছে অনেকটা বাংলা সিনেমা কিংবা হুমায়ূন আহমেদের হাসির নাটকের  মত । এক পাগলী দাও হাতে নিয়ে গ্রামবাসীকে তাড়া করছে। জীবন বাঁচাতে সবাই ছুটছে। কেউ পেছনে ফেরে তাকাচ্ছে না।   পাগলীর হাত থেকে এই দা কেড়ে নেওয়া বা তাকে নিবৃত্ত করার জন্যে কেউ এগিয়ে আসছে না । 

যে গণমাধ্যমের নৈতিক দায়িত্ব ছিল এই সব বিষয় তুলে ধরা — তাদের কেউ কেউ এই কাজের জন্যে তৈল দিয়ে আকাশে তুলছে । মোজা বাবু, গোলাম সারওয়ারের মত কেউ  কেউ পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে বাহ্বা দিচ্ছে । জিকে শামীম , শাহেদ , সাবরীনা , পাপলু , ওসি প্রদীপ নিজ নিজ মতলব হাসিল করছে । 

সত্যি মহা বিপদে ও আপদে পড়েছে এই জাতি ।


  • লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক 


No comments:

Post a Comment