Search

Wednesday, August 12, 2020

তাঁদের মামা

—  ওয়াসিম ইফতেখার

ওয়াসিম ইফতেখার
ব্লগার 

হিস্ট্রি ইঞ্জিনিয়ারিং এর দশকে বলতে অস্বস্তি ই লাগে, তবুও বলি। এসব বলার মানুষ বেশী আর নেই। ইতিহাস বিকৃতি'র উৎসবে কিছু সত্য প্রকাশ মন্দ তো না।

...মামী এখনো বেঁচে আছেন। বেশ অসুস্থ। উনার জন্য দোয়া রাখবেন। যে ছবিটা দিলাম, চার জনের সামনে যিনি, এই মামী'র স্বামী। মানে মামা হন। হুম মামা বেঁটে ছিলেন, বেশ ভালোই খাঁটো। যে সময়ের কথা বলছি, মামা তখন ডাক্তার। মেজর ডাঃ নাইমুল ইসলাম, ডাক নাম বাচ্চু।  

কমলের ইচ্ছা ছিল মেডিকেলে পড়বে, বড় ডাক্তার হবে। কিন্তু বাচ্চু মামা'র পরামর্শে কমল শেষ অবধি আর্মিতে চলে আসে।

মার্চ মাসে ভাগ্নে কমল চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে। সে এক হুলস্থুলকাণ্ড বৈকি।

ভাগ্নে যখন চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করে যুদ্ধ শুরু করেছে তখন মামা বাচ্চু অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্ট্রিতে বিদ্রোহ করে বাঙালী অফিসারদের ফ্যামিলি গুলো রেস্কিউ করে ঢাকা'র দিকে কোথাও নিয়ে আসছেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য।

তার স্ত্রী'র ভাষ্য ৩ এপ্রিল সকালের দিকে উনি বললেন — 

‘একটা সুটকেসে তোমাদের কিছু কাপড় নিয়ে নাও।’ 

জানতে চাইলাম, ‘তোমার-টা নেবে না?’ 

বললেন, ‘দরকার নেই।’ 

কথাটা তখন ঠিক বুঝতে পারি নি, আজ উপলব্ধি করি। তিনি হয়তো সবকিছুই বুঝেছিলেন, সব জানতেন। যা হোক ঐদিন তিনি বললেন যে আমাদের ঢাকা শহরের ফার্মগেটে নামিয়ে দেবে।


উল্লেখ্য ২৫ মার্চের পর থেকে চেনাজানা কাছের মানুষরা সবাই জড়ো হয়েছিল ডাক্তার নাইমুলের বাড়িতে। 

একটা বাস ভর্তি হলো আর নাইমুলের একটা ফিয়েট গাড়ি। ফিয়েট টা নাইমুল নিজেই চালাচ্ছিল। 

আজ যেটা উত্তরা এই উত্তরা হয়ে নিকুঞ্জ পার হবার পথে ডাঃ নাইমুল ইসলাম বাচ্চু চালিত ফিয়েট ও অন্যান্য ফ্যামিলি গুলোকে বহন করা বাসকে ব্যারিকেড দিয়ে আঁটকে দেয় এক পাকিস্তানী কর্নেল। অন্যরা স্কেপ করতে পারলেও আঁটকে যান নাইমুল। তাঁকে ধরে নিয়ে আসা হয় সংসদ ভবন এলাকার আর্মি ক্যাম্পে। এরপর নাইমুলের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি, বহু যুগ। 



যে দিন যারা নাইমুলের বাড়িতে অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের একজন মাহাবুবুর রহমান। দেশ স্বাধীন হবার পর ২৬ মার্চ উপলক্ষে 'হাতিয়ারে' নামে একটা স্মরণিকা প্রকাশ হয়। ৩ এপ্রিলের বাস ছাড়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত সব কিছুর বিস্তারিত বর্ণনা মাহাবুবুর রহমান লিপিবদ্ধ করেছেন ঐ স্মরণিকাতে।

এতগুলো জীবন বাঁচাতে শহীদ হওয়া নাইমুল হয়তো এই দেশে মুক্তির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ কেউকেটা কেউ নন। 

শুধু ধরা পরা না, দেশের জন্য কিভাবে মরতে হয়, তার একটা ভালো উদাহরণ হয়ে থাকবেন নাইমুল। জানতে চান কিভাবে হত্যা করা হয় কমলের মামা ডাক্তার নাইমুল কে?

করাচী আর্মি হাসপাতালে বাঙ্গালী রুগী আসতো রক্ত শূন্যতা আর জখমজনিত ক্ষরণ নিয়ে। তখন, রক্ত প্রয়োজন হলে মেজর ডাঃ নাইমুল পাঞ্জাবী সৈন্যদের কাছে রক্ত চাইতেন রোগী বাঁচাতে। 

মামা তখন বুঝেন নি পাঞ্জাবীরা রক্তদানকে ভালো চোখে দেখছে না। যখন বুঝলেন তখন ৭১' সালের এপ্রিল মাস। 

গ্রুপ মিলে গেলেই মামার শরীরের রক্ত নিয়ে নিয়ে পাক সেনাদের শক্ত শূন্যতা পূরণ করা হতো! অনবরত নেয়া হতে শুরু হল রক্ত… বুঝতেই পারছেন।

এর বেশী কিছু বলতে চাই না। সত্য বলতে বলার ক্ষমতা আমার নেই। বিভৎসতার বর্ণনা নাই বা জানালাম! যতদূর জানা গিয়েছে, মামার প্রায় রক্তশূণ্য দেহটি সংসদ ভবনের পিছনে কোথাও পুঁতে দেয়া হয়। এখন যেটা লেক হয়েছে আর কি। এই ঘটনা জানতে অপেক্ষা করতে হয়েছে কয়েক যুগ। স্বাধীন দেশের অজস্র বেওয়ারিস লাশের মত হারিয়ে গিয়েছেন মামা।

বাংলাদেশের ডাকটিকিটে প্রথমবারের মতো আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পাই ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯১-এ প্রকাশিত তিনটি শিটলেটে, বেগম জিয়ার প্রধানমন্ত্রী হবার পর। সেই সুবাদে প্রথমবারের মত হ্যাঁ, ৯৩'এ ডাক্তার নাইমুলের ছবি সম্বলিত সম্মান সূচক ডাক টিকিট প্রকাশ করেছিল বেগম জিয়ার সরকার। শহীদ ডাক্তার হিসাবে মামা নাইমুলের নাম তখন স্মরণ হয়েছে PG ও CMH- এর শ্বেতপাথরে। 

অনেক চেষ্টার পর Bangladesh Ordnance Factory থেকে যে রাস্তা বামে সালনার দিকে বাঁক নিয়েছে, সেই রাস্তার নাম রাখা হয়েছে এই শহীদ ডাক্তারের নামে। তার আগে ঐ প্রধান সড়কের নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার নাইমুলের নামে করার দাবী উঠলে বাঁধা দেয় এলাকার লীগ নেতারা।

আর হ্যাঁ, ঐ মামী কিন্তু কমলের একার মামী না। পুতুলেরও মামী। না, স্বামী কমলের সূত্রে না। নিজ মায়ের সূত্রে।

অনুগ্রহ করে কোন প্রশ্ন করবেন না। স্রেফ জেনে রাখেন, এই দেশের জন্য এমন অনেক মানুষ ও পরিবার প্রাণ দিয়েছে, যাদের কথা জাতিকে জানতে দিতে প্রবল আপত্তি একটা গোষ্ঠীর।।


তথ্য সুত্র —  

  • ইত্তেফাক 
  • নবিউল করিম 
  • শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট
  • মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা


No comments:

Post a Comment