— সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া
সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া গবেষক |
গাড়ির মালিক-চালকদের স্বার্থহানি হলে মালিক-চালক-শ্রমিকদের সংগঠন সরকারের সাথে দরকষাকষি করে — সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করে।
আইনজীবিদের স্বার্থহানি হলে আইনজীবী সমিতি আদালত অচল করে দেয় — সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করে।
পুলিশের স্বার্থহানি হলে পুলিশ এসোসিয়েশন সরকারকে ধমক দেয়, পরের বার রাতে ভোট নিয়ে দিবে না বলে হুমকি দেয় — সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়।
সামরিক বাহিনীর স্বার্থহানি হলে সামরিক বাহিনী গদি নড়বড়ে করে দিবে বলে হুমকি দেয় — সরকার ভয়ে সব দাবি মেনে নেয়।
সরকারি কর্মকর্তাদের স্বার্থহানি হলে (যেমন — ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা চলে গেলে) সরকারি কর্মকর্তাদের এসোসিয়েশন অবৈধ নির্বাচনে অবৈধ সুবিধা দিবে না বলে হুমকি দেয় — সরকার তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।
এই যে সংগঠিত গোষ্ঠীগুলো, এর বাইরেও বিপুল সংখ্যক মানুষ রয়েছে যাদের কোন সংগঠন নেই, কোন ছায়া নেই, কোন দল নেই, বল নেই। এরা ‘সাধারণ’ মানুষ, ;আমজনতা’, ‘ম্যাংগো পিপল’। আপনি ও আমি। তো এই আমজনতার কোন স্বার্থহানি হলে তার প্রতিকার কী? তাদের পক্ষে কে দরকষাকষি করবে?
কিছুদিন আগে সরকার পরিবহন ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়িয়েছে। কেন জানেন? কারণ পরিবহন মালিকদের সংগঠন ও তাদের নেতা শাহাজাহান খান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে, তারা নাকি করোনাকালীন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সুতরাং ভাড়া বাড়িয়ে দিয়ে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে হবে। খুবই যৌক্তিক কথা। তাদের ক্ষতি হয়েছে সুতরাং ক্ষতি পোষাতে হবে। কিন্তু কার কাছ থেকে পোষাবে? কার পকেট কেটে? কাটো জনগণের পকেটই কাটো! কোন প্রতিবাদ হবে না। যদিও করোনায় আমজনতা, যারা গণপরিবহণে চড়ে, তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারো চাকুরি গেছে, কারো বেতন কমেছে। তো জোর করে তাদের পকেট কাটার বন্দোবস্ত করা হলো, তারা বাড়তি ভাড়া দিতে হবে — কিন্তু তাদের যে আয়-রোজগার কমলো, তাদের ক্ষতিপূরণ কে দিবে? তাদের ক্ষতি কে পোষাবে? আর আম-জনগণই যেহেতু ক্ষতিগ্রস্ত তারাই কেন অন্যের ক্ষতি পোষাতে নিজেদের পকেট থেকে ৬০ শতাংশ বেশি বাস ভাড়া দিবে? দেখুন, আপনাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করা সরকার এখানে জনগণের পক্ষ না নিয়ে পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ নিয়েছে। কেন? কারণ মালিকদের সংগঠন আছে। জনগণের কোন সংগঠন নেই। জনগণের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। সেজন্য জনগণের পকেট কাটা জায়েজ। জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে রাজনীতি করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?
আরেকটা উদাহরণ দেখুন, গত কয়েক মাস সরকার যাচ্ছেতাইভাবে জনগণের ঘাড়ে দ্বিগুণ, তিনগুণ বিদ্যুতের বিল চাপিয়ে দিয়েছে। কেন? কারণ তাদের পকেট কাটা সহজ। কোন আওয়াজ হবে না, প্রতিবাদ হবে না। প্রতিবাদ করলে মামলা, হামলা, গুম! জনগণের স্বার্থ দেখার কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই জনগণের পক্ষে দাড়াবার। জনগণেরও করার কিছু নেই এই অন্যায় সিদ্ধান্ত মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া।
...হ্যাঁ থাকতো, যদি পাঁচ বছর পরপর হলেও তাদের হাতে ভোট দেওয়ার ক্ষমতাটা থাকতো। প্রতি পাঁচ বছর পরপর ওই নাঙাভূখা, গরিব, মেহনতী, গণপরিবহনে চড়া মানুষগুলো হাতের টিপসই দিয়ে অত্যাচারি শাসককে শায়েস্তা করতে পারতো। ওই একদিন তাদের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতাটা ফিরে যেতো। আর তাদের কাছে পাঁচ বছর পর হলেও ফিরে যেতে হবে এ চিন্তা থাকলে যত অত্যাচারি শাসকই হোক-না-কেন, তারা জনগণকে শাস্তি দেওয়ার আগে দু’বার চিন্তা করতো।
আমজনতার, ম্যাংগো পিপলের, স্বার্থহানি হলে তারা এই যে প্রতি পাঁচ বছর পরপর হলেও ভোট দিয়ে সরকারকে শায়েস্তা করতে পারে, রাষ্ট্রের মালিক বনে যায়, এর ফলেই অত্যাচারি শাসক বা সরকারও তাদের অন্যায় কার্যকলাপের, বেপরোয়াভাবে মানুষকে হয়রানি করার কিছু লাগাম টেনে ধরে। এটিই গণতন্ত্রের সর্বনিম্ন সুবিধা।
আর ভোট, গণতন্ত্র না থাকলে? জনগণের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন বাড়বে, কমবে না। কারণ ১৬ কোটি জনগণের তো কোন এজেন্সি নেই, সংগঠন নেই। থাকা সম্ভবও না, থাকবেও না। তাদের একমাত্র সংগঠিত শক্তি তাদের ভোটাধিকার। সেই জনগণের ভোটকে ভয় পেয়ে সরকারগুলো কিছুটা সোজা থাকতো। কিন্তু জনগণের সেই অধিকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই ডাকাত, দুর্বৃত্তরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে ছিনিয়ে নিয়েছে। মানুষকে জোরজবরদস্তি করে শাসন করছে। তাহলে এখন জনগণের স্বার্থ রক্ষা হবে কিভাবে? হবে না যদিনা জনগণ অবৈধ শাসকদের গদি পুড়িয়ে দেয়। ততদিন পর্যন্ত ওসি প্রদীপরা প্রতিবছর শয়ে শয়ে সাধারণ মানুষ মারবে এবং পার পেয়ে যাবে। কারণ জনগণের, মানুষের স্বার্থ রক্ষা করার আর কোনো সংগঠন নেই, ব্যবস্থা নেই, তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই, তাদের রাগ-ক্ষোভ-ক্রোধ এসবের কোনো মূল্য নেই কারণ এগুলো প্রকাশের, উদ্গিরণের কোন ব্যবস্থা অবশিষ্ট নেই। প্রিয় জনগণ, এই গণতন্ত্রহীনতা মানে আপনাদের নিজেদেরই অধিকারহীনতা, দস্যু, দুর্বৃত্তদের হাতে আপনাদের জীবন-সম্পদ সবকিছু বন্দী থাকা।
যারা জনগণের সংগঠিত শক্তি প্রয়োগের অধিকার, অর্থাৎ ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে তারা জনশত্রু। মুক্তিযুদ্ধ, চেতনা এসব বলে পার পাওয়া যাবে না। এসব জনশত্রুদের রুখে দাঁড়ান। আপনার অধিকার ছিনিয়ে নিন। ভোটের অধিকার সংরক্ষণ করুন। আপনার ভোটে যেই ক্ষমতায় আসুক — তারা ওসি প্রদীপদের রামরাজ্য কায়েমে কিছুটা হলেও লাগাম টেনে ধরবে। আপনার ভোটই পাঁচ বছর পরপর হলেও আপনার একমাত্র রক্ষাকবচ কারণ এটি ছাড়া সরকারের কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করার আপনার হাতে আর কোনো ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই। এই সুরক্ষা না থাকলে আপনি ওসি প্রদীপ ও তার আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা শেখদের নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হওয়াই আপনার গন্তব্য।
No comments:
Post a Comment