Search

Thursday, September 30, 2021

দেশে ‘পঞ্জি স্কিম’ প্রতারণা

রুমিন ফারহানা

বাংলাদেশের একটি সুবিখ্যাত গাড়ির ব্যাটারি কোম্পানি ভারতে রপ্তানি করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে। ২০০৪ সালে ভারত অভিযোগ করে সেই ব্যাটারি কোম্পানি নিজেদের উৎপাদন মূল্যের চেয়েও কমমূল্যে পণ্যটি ভারতে রপ্তানি করছে (বাণিজ্যের ভাষায় ডাম্পিং)। এতে ভারতের ব্যাটারি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা রোধকল্পে তারা অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে। ডাম্পিংয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের পণ্যকে একচেটিয়া করে ফেলে তারপর সুবিধাজনক সময়ে অনেক চড়া দামে পণ্য বিক্রি করে অনেক বেশি মুনাফা করে সেটা পুষিয়ে ফেলা। এটা বাজারের প্রতিযোগিতা নষ্ট করে শেষ পর্যন্ত জনস্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বলে এটা বন্ধের জন্য অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপের কথা ওঠে।  

বাংলাদেশ এর প্রতিবাদ করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) অভিযোগ জানায়। সেখানে ওই ব্যাটারি কোম্পানিকে উৎপাদনের যাবতীয় তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে যে দামে তারা পণ্যটি বিক্রি করছে তাতে তারা লোকসান দেয়নি, লাভ করছে। এরপর ২০০৬ সালে ওই ব্যাটারি কোম্পানি ডব্লিউটিও থেকে নিজেদের পক্ষে রায় পায়। পাঠক এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ব্যাটারি কোম্পানিটি নিজেদের উৎপাদিত পণ্য অতি কম দামে দিচ্ছে কেবলমাত্র এই কারণেই শুল্কের মুখোমুখি হয়েছিল। এমন নয়, যে তারা মিডিয়া বা মাধ্যম হিসেবে মূল উৎপাদনকারী এবং ক্রেতার মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছিল যেমনটি আমরা দেখেছি ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ এবং এদের মতো আরও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে। যেহেতু বিখ্যাত এই ব্যাটারি কোম্পানি প্রমাণ করতে পেরেছিল যে তুলনামূলকভাবে কম মূল্যে ব্যাটারি বিক্রি করলেও তারা লোকসানে নয়, লাভে আছে, সে কারণেই শেষ পর্যন্ত মামলা জিতে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক থেকে মুক্ত হতে পেরেছিল তারা। 

ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ কিংবা তারও আগে যুবক, ইউনিপে-টু-ইউ, ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর শুরু থেকেই ব্যবসা করার ন্যূনতম কোনো ইচ্ছে ছিল না। প্রতারণার মাধ্যমে লাখো মানুষের হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎই ছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য। মজা হচ্ছে এই প্রতারণা তারা লুকিয়ে চুরিয়ে রাখঢাক করে করেনি। রীতিমতো বিশাল বিশাল ব্যানার-বিলবোর্ড টানিয়ে প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিয়ে, বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের স্পন্সর হয়ে, বিখ্যাত সব তারকাদের খ্যাতির দ্যুতি ছড়িয়ে, র‍্যাবের তৈরি সিনেমায় আর্থিক সহায়তা করে, সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে টাকা ঢেলে, ই-ক্যাবের নানা অনুষ্ঠানেরও পৃষ্ঠপোষক হয়ে মাঠে নেমেছিল তারা। মন্ত্রীদের নিয়েও নানান অনুষ্ঠান করে ই-ভ্যালি। সবার চোখের সামনে ওয়েবসাইট খুলে গ্রাহককে বিশাল ছাড়ে পণ্য দেওয়ার লোভ দেখিয়েছে তারা, বিপুল অংকের টাকা তুলেছে, লেনদেন হয়েছে ব্যাংক ও মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এত বড় পরিসরে নামার পর সাধারণ মানুষের সন্দেহ করার কী কারণই বা থাকতে পারে? আর প্রতারণার জাল তো বিস্তার করা হয়েছে ধীরে ধীরে, শুরুতে ওয়াদা মতো পণ্য মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়ে। মানুষের অবিশ্বাসের কোনো কারণ তো ছিল না। মানুষ দেখেছে তার পরিচিতজনরা টাকা দিয়েছে, পণ্য পেয়েছে এবং সেই পণ্যও পেয়েছে অর্ধেক বা তারও কম দামে। কিন্তু এই বিশ্বাসের মাশুল গুনেছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। অনেকেই শুনলাম বলছেন, মানুষের লোভের রাশ টানা উচিত, বেশি লোভ করলে এমনই ঘটে, ইত্যাদি ইত্যাদি। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, এই প্রশ্ন কেউ তুলছেন না, কী করে সরকারের এতগুলো সংস্থার নাকের ডগা দিয়ে মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর এ ধরনের ব্যবসা চালালেন এই প্রতারকরা। কী করে গত ১৫ বছরে ২৮০টি প্রতিষ্ঠান মিলে মানুষের অন্তত ২১ হাজার ১৭ কোটি টাকা লোপাট করে, কী করে যুবক, ইউনিপে-টু-ইউ, ডেসটিনির তিক্ত অভিজ্ঞতার পর আবারও ই-অরেঞ্জ, ই-ভ্যালি, ধামাকা, এহসান গ্রুপ ধরনের প্রতারক কোম্পানিগুলো সরকারের সব প্রতিষ্ঠানের সামনে দিয়ে দিনের পর দিন এমন সন্দেহজনক ব্যবসা চালিয়ে গেল। এটি পানির মতো পরিষ্কার যে সরকারের পক্ষ থেকে যদি পরিবীক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যেত তাহলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হয় না।

সংসদে এই বিষয়ে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছিলাম আমি। তারপরই দেখলাম সরকারের যেন কিছুটা ঘুম ভাঙল, নড়েচড়ে বসল প্রতিযোগিতা কমিশনও। এই ফাঁকে বলে রাখি, পশ্চিমের ‘অ্যান্টিট্রাস্ট ল’-এর ধারায় বাংলাদেশে প্রতিযোগিতা আইন হয়েছে ২০১২ সালে। সেই আইনে প্রতিযোগিতা কমিশনের কাজের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে (৮.১.ক) বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী অনুশীলনসমূহকে নির্মূল করা, প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা ও বজায় রাখা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এরপর আইনের ১৫ এবং ১৬ ধারায় উল্লেখ আছে বাজারে প্রতিযোগিতা ক্ষুন্ন করতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিতে পারবে না। ২১ সেপ্টেম্বর প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান ই-কমার্স ব্যবসার লোকজনের সঙ্গে বসে বলেন, ‘গ্রাহকদের প্রতারিত করার লক্ষ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক ডিসকাউন্ট দিয়ে পণ্য বিক্রি করেছে। ব্যবসাও করছে গ্রাহকের টাকায়। আগামীতে আর কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন প্রতিযোগিতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পেলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করবে।’ এই আইনের ১৯ ধারা অনুযায়ী কমিশন কোনো ব্যবসা জনগণের বড় ক্ষতি করতে পারে এমন সন্দেহ করলে দুই দফায় ৬০ দিন করে মোট ১২০ দিন অর্থাৎ ৪ মাস ব্যবসাটি বন্ধ করে রাখার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অর্থাৎ এই আইনের অধীনে প্রতিযোগিতা কমিশন এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক আগেই বন্ধ করে দিতে পারত। তাহলে অসংখ্য মানুষ চরম ঝুঁকিতে পড়া থেকে বেঁচে যেত।        

সংসদে এই বিষয় কথা বলতে গিয়ে আমি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলাম এই টাকা জনগণের টাকা এবং এর দায় সরকারকে নিতে হবে। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে জনগণের টাকা ফেরত দিতে হবে সরকারকে, পরে পারলে সরকার এই সব প্রতারক কোম্পানির কাছ থেকে অর্থ আদায় করে নেবে। পরে দেখলাম একই ধরনের কথা বলছেন অর্থমন্ত্রীও। তার  ই-কমার্সের নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণার দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। যেহেতু এখানে ছাড়পত্র দিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তাই প্রাথমিকভাবে তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। আইটির বিষয়ও যেহেতু এখানে জড়িত তাই আইসিটি মন্ত্রণালয়ও দায় এড়াতে পারে না। অর্থাৎ অর্থ, বাণিজ্য, আইসিটি, স্বরাষ্ট্র প্রতিটি মন্ত্রণালয়েরই দায় আছে এই ধরনের ব্যবসা চলতে পারার পেছনে এবং তারা কেউ-ই সে দায় এড়াতে পারে না।

 

বাণিজ্যমন্ত্রী অবশ্য দায় নিতে নারাজ। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণে সরকার কিছুই করবে না। তিনি বরং আরেক কাঠি সরেস হয়ে বিষয়টিকে হালকা করে ফেলার চেষ্টা করছেন। অনলাইনে কোরবানির গরু কিনতে গিয়ে তিনি হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়ে এমনভাবে কথা বলেছেন যেন ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জের মতো ঘটনা বাংলাদেশের সব ই-কমার্সেই হয়। বাংলাদেশের ই-কমার্স ব্যবসায় পণ্য কিনতে গিয়ে অর্ডার দেওয়া পণ্যের সঙ্গে প্রাপ্ত পণ্য নিম্নমানের হওয়া, বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে পণ্য বিক্রি, ডেলিভারি পেতে দেরি হওয়ার মতো অভিযোগ ক্রেতাদের দিক থেকে আছে; দেশের ই-কমার্সের ভবিষ্যতের স্বার্থে সেগুলো নিয়ে কাজ করতেই হবে। কিন্তু সেগুলো কোনোটি কি এই আলোচিত ‘পঞ্জি স্কিম’ প্রতারণাগুলোর সঙ্গে তুলনীয় কোনো দিক থেকে? এটা করে তিনি কি সাধারণভাবে ই-কমার্সের প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা তৈরি করছেন না?

হালের ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ ও এদের মতো কিছু ই-কমার্স সাইট এবং আগের ডেসটিনি, যুবক, ইউনিপে-টু-ইউ এগুলো কোনোভাবেই ব্যবসা নয়, এগুলো আসলে ‘পঞ্জি স্কিম’। বড় স্কেলে এমন প্রতারণা করা ব্যক্তি চার্লস পঞ্জি’র নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। এটা হচ্ছে এক ধরনের প্রতারণামূলক কার্যক্রম, যেখানে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের তুলনায় বিশাল অংকের একটি লভ্যাংশ (ই-কমার্স সাইটগুলোর ক্ষেত্রে অতি অস্বাভাবিক কম মূল্যে পণ্য) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যেটা বাজারের প্রচলিত হারের চাইতে অনেক বেশি। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানটি মানুষের কাছ থেকে নেওয়া টাকা দিয়ে কোনো মূল্য সংযোজন না করে তারা নতুন বিনিয়োগকারীদের থেকে প্রাপ্ত টাকা দ্বারাই পুরনো বিনিয়োগকারীদের কাউকে কাউকে লাভ/পণ্য প্রদান করে। এতে শুরুতে নিজে পেয়ে বা আশপাশের কাউকে লাভ পেতে দেখে অনেক মানুষ আকৃষ্ট হয়ে তাদের টাকা দেয় এবং এক পর্যায়ে অনিবার্যভাবেই দেখা যায় মানুষ প্রতিশ্রুত লাভ/পণ্য আর পাচ্ছে না। তখন এই প্রতারকরা বহু মানুষের টাকা নিয়ে চলে যায়। এই কারণেই সভ্য দেশে ‘পঞ্জি স্কিম’ অল্প সময়ের জন্যও চলতে পারে না, কারণ এটা কোনোভাবেই ব্যবসা নয়, স্রেফ প্রতারণা।

তাহলে টাকা হারানো সাধারণ মানুষের দায় নিয়ে তাদের ক্ষতিপূরণ দেবে না কেন সরকার? জানি সরকারের টাকা মানেই জনগণের টাকা। জনগণের টাকা দিয়ে কারও প্রতারণার মাশুল সরকার দেবে কেন, এই প্রশ্ন আসতে পারে, আসছেও সেটা। কিন্তু আমি মনে করি জনগণকে প্রকাশ্য প্রতারণার জালে আটকে ফেলে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় সরকারকে যেহেতু কোনো আর্থিক দায় নিতে হয় না, তাই এসব ঘটনা বারবার ঘটার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপও থাকে না। সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং দলের ক্ষমতাবান মানুষ এসব প্রতারকের কাছ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হয় বলে এসব প্রতারণা ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নিয়ে বারবার আসে, আসতেই থাকে। এই কারণেই আমি বিশ্বাস করি এসব প্রকাশ্য প্রতারণার ক্ষেত্রে সরকারকে আইনগতভাবেই আর্থিক দায়ে যুক্ত করার মাধ্যমেই এটা রোধ করা সম্ভব হতে পারে।

  • লেখক আইনজীবী, সংসদ সদস্য ও বিএনপিদলীয় হুইপ 

লেখাটি প্রথমে দৈনিক দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। 

Saturday, September 25, 2021

বিএনপি’র তুলনায় আওয়ামী লীগের সময়ে নিত্যপণ্যের দাম ৩-৬ গুণ বেশী

 মোঃ মিজানুর রহমান




মানুষের জীবন-জীবিকা, শারীরিক সুস্থ্যতা, মানসিক প্রশান্তি আর তেজো-বুদ্ধিদীপ্তে খাদ্যপণ্য অপরিহার্য। প্রতিটি পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে নিত্য খাদ্য ব্যবস্থা। নিত্য খাদ্য পণ্যের দাম বেড়ে গেলে মানুষের খাদ্য গ্রহণমাত্রা সঠিক থাকে না বরং কমে যায়। ফলে পুষ্টির অভাব দেখা যায়। আর পুষ্টিহীনতা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ সর্বোপরি রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করে। তাই প্রতিটি দেশে নিত্য খাদ্য পণ্যের দাম মানুষের ক্রয় সীমার মধ্যে রাখতে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায়-আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রতি বছরই নিত্যপণ্যের দাম দফায় দফায় বাড়তে থাকে- যা নিম্নে উল্লেখিত ছক দেখলে অনুমান করা যাবে। 


সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, খিলগাঁও ও শান্তিনগর বাজারে নিত্যপণ্যের দাম সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় প্রতি কেজি সাদা আলু ২৫ টাকা, লাল আলু ৩০ টাকা, বেগুন, করলা ও পটল ৬০-৭০ টাকা, ঢেরস ৬০ টাকা, শিম ৭০-৮০ টাকা, চিচিঙ্গা ও ঝিঙ্গা ৬০ টাকা, বরবটি ৯০-১০০ টাকা, শসা ৬০-৮০ টাকা, গাজর ৮০ টাকা, টমেটো ৯০-১০০ টাকা, লাউ (আকারভেদে) ৬০/৭০/৮০+ টাকা, মিস্টি কুমড়া (আকারভেদে) ৭০/৮০/১০০+ টাকা, আদা ও রসুন ১২০ টাকা, সয়াবিন তেল (প্যাকেটজাত) প্রতি লিটার ১৫৩ টাকা, আটা ৪০ টাকা, ময়দা ৫০ টাকা, মোটা চাল ৫২ টাকা, সরু চাল ৭০ টাকা থেকে বিভিন্ন দামের, হাসের ডিমের হালি ৫৫-৬০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৬০+ টাকা, লাল লেয়ার মুরগি প্রতি কেজি ২৫০+, গরুর গোস্ত ৬০০ টাকা, খাসির গোস্ত ৯০০-৯৫০ টাকা এবং মাছের দাম প্রকারভেদে বিভিন্ন রকম। করোনা মহামারীর কারণে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা সংকুচিত হওয়ায় ও সেই সাথে নিত্য পণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী হওয়ায় জীবন-যাপনে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকেই নিত্য পণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। বর্তমান আওয়ামী সরকারের সময় ও বিগত বিএনপি সরকারের সময় নিত্য পণ্যের দামের তুলনামূলক চিত্র নিম্নে দেয়া হলো।


ক্রমিক নং

পণ্য

২০০৬ সালে 

বাজারদর 

টাকায় 

২০২১ সালে 

বাজারদর 

টাকায় 

২০০৬ এর তুলনায় 

২০২১ এ

দাম বৃদ্ধি 

মোটা চাল 

(প্রতি কেজি)

গড়ে ১৫ টাকা

৫২ টাকা

সাড়ে 

তিনগুণ

 (প্রায়)

সরু চাল 

(প্রতি কেজি)

২৪.৫০ টাকা

৭০ টাকা +

তিনগুণ

(প্রায়)

আটা 

(প্রতি কেজি)

১৭ টাকা

৪০ টাকা

তিনগুণ

সয়াবিন তেল 

(প্রতি লিটার)

    ৫৫ টাকা

১৫৩ টাকা

তিনগুণ

(প্রায়)

শাক 

(প্রতি আটি)

০২-০৩ টাকা

১৫-২৫ টাকা

৫-১০ গুণ 

(প্রায়)


আলু 

(প্রতি কেজি)

২৫-৩০ টাকা

৬০ টাকা 

পাঁচগুণ 

(প্রায়)


পেঁয়াজ 

(প্রতি কেজি)

০৮-১০ টাকা

৫০-৬০ টাকা

৫-৬ 

গুণ+

 (প্রায়)


চিনি 

(প্রতি কেজি)

৩৬ টাকা

৬০ টাকা +

দ্বিগুণ

 (প্রায়)

হাসের ডিম 

(প্রতি হালি)

১২ টাকা

৫৫-৬০ টাকা

চারগুণ 

(প্রায়)

১০

গরুর গোস্ত 

(প্রতি কেজি)

১৮০ টাকা

৬০০ টাকা

তিনগুণ

 প্রায়

১১

খাসির গোস্ত 

(প্রতি কেজি)

২৮০-৩০০ টাকা

৯০০-৯৫০ টাকা

তিনগুণ

 প্রায়

১২

গ্যাস (প্রতি ২ মুখ চুলা)

২০০ টাকা

৯৭৫ টাকা

চারগুণের 

বেশী


দেখা যায় বিএনপি’র তুলনায় আওয়ামী লীগের সময়ে নিত্য পণ্যের দাম ৩-৬ গুণ বেশী।


বছরে বছরে দাম বৃদ্ধি পেতে পেতে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কাট-ছাট করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। নিত্যপণ্য কিনতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সহনীয় পর্যায়ে দাম ধরে রাখতে ব্যর্থ আওয়ামী লীগ সরকার। মানুষ কিছু বলতে পারে না-অজানা আতংকে। অজানা আতংক এই জন্য যে, মানুষ তাদের অধিকার তথা মুক্তমত, মানবাধিকার, ভোটাধিকার বিষয়ে বলতে গেলে বা গণমানুষের পক্ষে কোন সংগঠন বা সংস্থা বলতে গেলে বা লেখতে গেলে হতে হয় নির্যাতিত, নিপীড়িত, হামলা-মামলা, জুলুম, জেল-রিমান্ড; এমনকি গুম বা অপহরণ এর শিকার। অধিকার আদায়ে সোচ্চার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সম্বলিত বহু মানুষ আতংকে বাসায় ঘুমাতে পারে না বা এলাকায় থাকতে পারে না। 

করোনা মহামারীর এ সময়ে অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য, আয়ের উৎস অচলাবস্থা। অনেক মানুষ চাকরি বা কর্ম হারিয়েছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ভাসমান মানুষ তাদের পুজি খুঁয়েছে। আনেকে বাসা-বাড়ী ছেড়ে দিয়ে গ্রামে গেছেন। মোবাইল কোম্পানীর দেয়া তথ্যমতে মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ে  ১ কোাটি ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা শহরে বাসা-বাড়ী ছেড়ে দেশে গেছেন। অনেকে পরিবার দেশে বা গ্রামে রেখে শহরে মেসে সিট ভাড়া করে থাকছেন। অনেকের বেতন শতকরা ৪০ ভাগ কমেছে। অসহায়, দরিদ্র্য মানুষের জন্য সরকারের সহায়তার টাকা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে একই মোবাইল নাম্বার বারবার ব্যবহার করে একই ব্যক্তি একাধিকবার টাকা তুলে নিজেদের পকেটে ভরছে-যা বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানা যায়। ফলে অসহায়, দরিদ্র্য মানুষের ক্ষুধা আর কান্না একাকার হয়ে মিশে যাচ্ছে মানবাধিকারের কৃষ্ণ গহ্বরে। এক অসহনীয় অবস্থায় মানুষ বসবাস করছে। ক্ষমতাসীনদের চাল বা গ্যাসের ক্ষেত্রে ভূর্তুকি বা অন্য কোন পন্থা আবলম্বন করে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সহনীয় পর্যায়ে নিত্য পণ্যের দাম ধরে রাখতে বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণ অনস্বীকার্য ছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু তারা তা করেননি বরং উন্নয়নের জোয়ারের কথা বললেও মানুষের যাপিত জীবনের আর্থ-সামজিক এই প্রেক্ষাপটে বলা যায় যথার্থ উন্নয়ন হয়নি। কেননা, মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সাধ্য অনুযায়ী দামের উর্ধ্বগতির কারণে ক্রয় করতে পারছে না। মাসে মাসে বাসা ভাড়া তো আছেই। আয়-ব্যয় হিসেবের কঠিন যাতাকলে আত্ম-মর্যাদায় বেঁচে থাকা যেনো মানুষের দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। উন্নয়ন গল্পের ছিটে-ফোটা তাদের যাপিত জীবনে দেখা যায় না। সাধরণ মানুষের প্রশ্ন তাহলে উন্নয়ন কি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা শ্রেণীর বাহুডোরে? কেননা, ঘরে ঘরে মানুষের অর্থনীতির বেহাল অবস্থা আর চাপা কান্না। অথচ প্রতিটি মানুষ চায় অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা; যা ক্ষমতাসীনরা দিতে ব্যর্থ।

১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর কথা বলে ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ আজ সে কথা মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। মোটা চালের দাম পঁঞ্চাশের ঊর্ধ্বে, সরু চালের দাম ৭০ টাকা। ক্ষমতাসীনদের যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে করোনাভাইরাস মন্দার মধ্যেও গত এক বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, পাইজাম চালে দাম বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশী, আটার দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৭১ শতাংশ, ময়দার দাম বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। এছাড়াও ডাল, শিশুদের গুড়াদুধসহ অন্যান্য পণ্যেরও দাম বেড়েছে। 

বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর অর্থাৎ ২০০৬ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অব্যাহতভাবে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনে রীতিমতো দুর্যোগ নেমে এসেছে। অথচ মানুষের আয় বাড়ানোর জন্য সেই অর্থে ক্ষমতাসীনদের পদক্ষেপের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার কথা বললেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেকারত্বের হার বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর তথ্য মতে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের শতকরা ৬৬ ভাগ আজও বেকার। মানুষ সন্তানদের বেকারত্ব আর দুর্যোগ থেকে মুক্তি চায়। সময়ান্তে এই মানুষগুলো প্রতীক্ষার প্রহরে, মিশে যাবে তারা সেই সংগঠন বা সংস্থা’র সাথে যে সংগঠন বা সংস্থা মানুষের অধিকার তথা মুক্তমত, মানবাধিকার, ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অবিরাম সংগ্রাম করে যাচ্ছে সফল হওয়ার লক্ষ্যে। 

তথ্য উৎস — জাতীয় সংবাদপত্র ও ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি 

  • লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট। 

Thursday, September 16, 2021

ওবায়দুল কাদেরের উপহার বাংলাদেশের দুর্নীতিরই চিত্র

ফাইজ তাইয়েব আহমেদ


রোলেক্স ডেটজাস্ট, ডায়মন্ড ডায়াল, দাম ৯,৩৩,০০০ টাকা

একজন মন্ত্রী প্রতিদিন অফিস আওয়ারে ফ্যাশনের নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার চেহারা দেখাতে পারেন না। এই সময়টায় তার কাজ দেখানোর কথা। নিয়ম করে প্রতিদিন এই যে ফ্যাশন শো, তার সাজসজ্জ্বার টাকা আসে কোথায় থেকে?

১। কাদের সাহেবের বেতন কত? তার মাসিক বেতনের টাকায় কয়টা স্যুট কেনা যায়?

২। মন্ত্রী ভিনদেশি রাষ্ট্রের সৌজন্য উপহার ছাড়া কোন ধরণের গিফট আইটেম নিতে পারেননা। ভিনদেশি রাষ্ট্রের সৌজন্য উপহারও রাষ্ট্রের তোশাখানায় জমা দেয়া লাগে। গিফট নিলেই অন্যকে অবৈধ সুবিধা দিবার বিষয় চলে আসে, এতে দুর্নীতি বাড়ে। বাড়ে যোগ্যকে ঠকানো এবং ঠেকানোর বিষয়। এখানে বৈষম্যের বিষয়ও জড়িত। নেত্রা নিউজে অভিযোগ ছিল কাদের সাহেব কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা দামের ঘড়ি নিয়েছেন, তা উনি ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। উপহারের কথা বলে এসব দুর্নীতির বিষয় কার্পেটের নিচে চাপা দেয়া যাবে না। দুর্নীতির টাকা দিয়ে দিনের পর দিন ফ্যাশন শো চলছে, তা কি মহামান্য আদালতের নজরে আসছে না?

রোলেক্স ডে ডেট প্রেসিডেন্ট ঘড়ির, দাম ২৮,৮৬,০০০ টাকা
৩। এইযে গরমের দেশে ব্রিটিশের সাজ সাজার মধ্যে গোলামের স্যার হয়ে উঠার বাসনা, এটা বাংলাদেশের হঠাৎ বড় লোক হওয়া লোকেদের আচরণগত বক্রতা। গণ্ডারের চামড়ার উপর চুরির টাকায় কেনা স্যুট পরলেই চুরি চামারি লুকানো যায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকবার দলীয় নেতাদের স্যুট কোট না পরে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে বলেছিলেন!

৪। স্যুট ঠান্ডার দেশের ইউরোপীয়দের পোশাক, সেখানে স্যুট পরতে এসিতে থাকা লাগে না। বাংলাদেশে ভাদ্র মাসের তালপাকা গরমে এগুলা পড়ে থাকতে হলে এসি চালাতে হয়। অতিরিক্ত এসি দেশের শহর গুলোর পরিবেশ নষ্ট করছে, তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। গবেষণা বলছে ঢাকার অভ্যন্তরের তাপমাত্রা ঢাকার বাইরের থেকে অন্তত ৮ ডিগ্রি বেশি। একটা শহরের প্রাণ চক্র এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য এটা এনাফ। মাত্রাতিরিক্ত এসি ঢাকার পরিবেশ বিপর্যয়ে একটা ভূমিকা রাখছে।

৫। কাদের সাহেব একই স্যুটে তার ডজন ডজন ছবি শেয়ার দেয়। এর মানে কি? এক ভঙ্গির ছবি বার বার দেয়ার মধ্যে ছাগলামি আছে, আছে আরেকটা বিষয়। তার তোষামুদে লোকেরা এগুলা দেখে, লাইক শেয়ার দেয়।

প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় ব্রাউজিং যে কার্বন এমিশান করে তার উপর বিবিসি ফিউচার প্লানেট এর একটা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা আছে। সেখেনে দেখানো হয়েছে, প্রতি পৃষ্ঠা ভিউ থেকে যে ডিজিটাল এমিশান (কার্বণ ডাই অক্সাইড নির্গমন) হয় তা আনুমানিক ১.২ থেকে ৩.৬ গ্রাম। আর হ্যাঁ আমাদের বিদ্যুৎ এর ৯৬% ই নবায়ন যোগ্য বিদ্যুৎ নয়।  

লুই ভিতন তাম্বো স্পিন টাইম রিগাতা ঘড়ি, দাম ৩৭,৩১,৫০০ টাকা


৬। কাদের সাহেবের ফ্যাশন শোতে শ্রম ঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। এই সময়ে তার রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার কথা।

জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেলের অতি সাধারণ  পোশাকের বিষয়টা সবাই নিশ্চয়ই জানেন। ১০ বছরের ব্যবধানে এক সাংবাদিক উনাকে একই সুপারমার্কেটে (পড়েন মুদি দোকান) দেখেছেন। সাংবাদিক বলেছেন, মার্কেল ১০ বছর আগেও আপনাকে এক্সাক্টলি সেইম পোশাকে দেখেছি। মার্কেল বলেছেন, আমি মডেল নই, মানুষের সেবক।

৭। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৭ সালের একটি মতামত জরিপমতে, ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩তম ছিল। গ্লোবাল কম্পেটিটিভ ইনডেক্স ২০১৭ বলছে, এশিয়ার মধ্যে নেপালের পরেই সবচেয়ে খারাপ রাস্তা বাংলাদেশের। কাদের সাহেবের কেতাদুরস্ত পোশাক তার মন্ত্রণালয়ের মানহীন  কাজের মানের সাথে যায় না।

কাদের সাহেব যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী। হাজার হাজার সেতুর প্রকল্প বাংলাদেশের দুর্নীতির প্রধানতম এক খাত। শত শত সেতু অপ্রয়োজনে তৈরি করা, নদী-খাল-নালা না থেকেও যত্র তত্র টাকা খাওয়ার জন্য সেতু তুলে ফেলে রাখা হয়েছে। দেশের হাওড় বিলের মাঝে রাস্তা ছাড়াই সেতু উঠানো আছে। বহু জায়গায় সেতু আছে রাস্তা নাই। অনেক জায়গায় সেতুতে উঠতে মই লাগে। বাংলাদেশেরর একটা সেতুও মেয়াদ বাড়ানো আর খরচ বাড়ানো ছাড়া সমাপ্ত হয় না। অতি দুর্নীতি মানহীন নির্মান সামগ্রী, কম পাইলিং, কম সিমেন্ট ও কম রড ব্যবহারের কারণে বহু সেতু নির্মাণ কালের অব্যবহতি পরেই ভেঙে পড়ে কিংবা নষ্ট হয়। এমনকি নির্মাণকালেই ভেঙে পড়ার নজিরও আছে বহু। অন্যদিকে সেতু দৈর্ঘ্যে ছোট হয় যা নদী ও খাল হত্যা করে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সেতু গুলোতে লেইনের প্রস্থ চুরির বিষয়ও আছে। বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেও বাংলাদেশের অধিকাংশ রাস্তা ঘাট চলাচলের অনুপোযোগী, খান খন্দ আর গর্ত ভরা।এই সব দুর্নীতি কাদের সাহেবদের জানার বাইরে হয়ে যাচ্ছে ভাবার কোন কারণ নাই। হলেও এসব প্রতিহত করার দায়িত্ব উনাদের। উপহার এসব দায়িত্বের সাথে সরাসরি  কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করে।

মূল বিষয় হচ্ছে, মন্ত্রীর শো ওফের সাথে দুর্নীতির সাক্ষাৎ সংযোগ আছে। ওবায়দুল কাদেরের উপহার বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্র মাত্র। এইসব দুর্নীতি এবং হীন্মান্যতা সেলিব্রেশনের বিষয় নয়, কিংবা হাসাহাসির বিষয় নয়। বরং কিভাবে সমাজে জবাবদিহি আসবে তা ভাবার বিষয়, প্রতিবাদের বিষয়।


  • লেখক টেকসই উন্নয়নবিষয়ক বিশ্লেষক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর বইয়ের প্রণেতা। তাঁর ইমেইল অ্যাকাউন্ট faiz.taiyeb@gmail.com 


স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও প্রকট বৈষম্য

মোঃ মিজানুর রহমান



১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ২৩ বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শাসন, শোষণ, বঞ্চনা অর্থাৎ বৈষম্যের শিকার হয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য, রাজনৈতিক অসমতা ছিল অন্যতম। বৈষম্যের কিছু উদাহরণ নিম্নরূপঃ ১৯৫৫ সালের হিসেব মতে সামরিক বাহিনীর ২২১১ জন কর্মকর্তাদের মধ্যে বাঙালী ছিল মাত্র ৮২ জন। ১৯৫৬ সালের হিসেব মতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ৪২,০০০ কর্মকর্তাদের মধ্যে বাঙালী ছিল মাত্র ২,৯০০ জন। ১৯৬২ সালের হিসেব মতে পাকিস্তানের মন্ত্রণালয়গুলোতে শীর্ষ কর্মকর্তাদের ৯৫৪ জনের মধ্যে বাঙালী ছিল মাত্র ১১৯ জন। ১৯৬২ সালের হিসেব মতে বিদেশে ৬৯ জন রাষ্ট্রদূতের মধ্যে ৬০ জনই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। ১৯৪৭-১৯৭০ সাল পর্যন্ত মোট রপ্তানী আয়ের শতকরা ৫৪.৭ ভাগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। রাপ্তানী আয় বেশী করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমদানী ব্যয় ছিল মাত্র শতকরা ৩১.১ ভাগ। সকল ক্ষেত্রেই ছিল এ রকম বৈষম্য। 

 

পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী ছিল মোট জনসংখ্যার (প্রায়) ৫৬% এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল হাজার রছরের পুরনো। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে (প্রায়) ৪৫% জনসংখ্যার মধ্যে ছিল বিভিন্ন ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতি বিদ্যমান (দৈনিক ইনকিলাব, ২০১৬)। আবার সে সময় জনসংখ্যার ভিত্তিতে ক্ষমতার বন্টন পূর্ব পাকিস্তানের অনুকুল হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তান এক ইউনিট তত্ত্ব নামে এক অভিনব ধারণার সূত্রপাত করে ক্ষমতা তাদের দখলে রাখার জন্য । শাসন, শোষণ, বঞ্চনা অর্থাৎ বৈষম্যে থেকে মুক্তি পেতেই জনগণ সংগঠিত হয়ে তৎকালীন রাজনৈতিক দলের সাথে মিশে আন্দোলন করেন এবং ১৯৭১ সালে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এবং তার এর কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে কৃষক-শ্রমিক, মজুর, যুবক, আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা এবং যুদ্ধকালীন সময়ে সেক্টরসমূহ, ফোর্সগুলো, গেরিলা বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী যে যার অবস্থান থেকে নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করছেন। শাসন, শোষণ, বঞ্চনা অর্থাৎ বৈষম্যে থেকে মুক্তি পেতেই নয় মাস যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর হয় কাঙ্খিত বিজয়। 

 

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী’র প্রাক্কালে স্বাধীন এই বাংলাদেশে চলমান সময়ে আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের ভাবনা ‘বৈষম্য থেকে কি সম্পূর্ণ মুক্ত’ ? জনগণের ভাবনা এই কারণে যে, জনগণ এখন তার ভোট নিজে পছন্দমতো দিতে পারেন না। ভোট দিতে গেলে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন কেন্দ্রে তাদের দলের লোকজন বা ভোটার ছাড়া অন্য দলের লোকজনদের বা ভোটারদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেন না, বরং ত্রাসের সৃষ্টি করে কেন্দ্র থেকে বিতারিত করে দেন। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেন সে সময় কাঠের চশমা পড়ে থাকেন এবং নির্বাচন কমিশন যেনো অন্ধ হয়ে থাকেন। যা নির্বাচনকালীন সময়ে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণ ওয়াকিবহাল। বর্তমান সময়ে করোনার প্রভাবে আয় কমে যাওয়ায় মানুষের জীবন-যাপন কষ্টার্জিত। তার উপরে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে যাপিত জীবনে মানুষের নাভিঃশ্বাস উঠে গেছে। তার সাথে ধর্ষণ, ভীতিকর পরিবেশ অব্যাহত আর প্রতিবাদ করলেই মামলা, হামলায় জর্জরিত জনজীবন। ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি আইনের ফলে মানুষের কথা বলা ও লেখার স্বাধীনতা সংকুচিত। 

 

এমন পরিস্থিতিতেও জনগণের জীবনের সাথে জড়িত ইস্যুসমূহ, অধিকার, মানবাধিকার, ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়সমূহ রাজপথে ও বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সভা-সমাবেশ, ভার্চুয়াল সংলাপ এর মাধ্যমে তুলে ধরছেন বিরোধী দল বিএনপি। জনগণের বিষয়সমূহ নিয়ে বিএনপি তাদের কর্মকান্ড চলমান রাখায় ক্ষমতাসীনরা তা স্তব্ধ করে দিতেই বিএনপি নেতা-কর্মী-সমর্থকদের নামে মামলা দায়ের করেন বা করান এবং গ্রেফতার, রিমান্ড, জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন অব্যাহত রাখেন।  বিএনপি’র ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর নামে লক্ষাধিক মামলা (দি ডেইলি স্টার-বাংলা, ২০২০)। এসব দেখে জনমন ভীত-ত্রস্ত। তারপরেও বিএনপি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় থেমে নেই এবং জনগণও মিডিয়া বা গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে জ্ঞাত এবং সজাগ। বিএনপিকে দমাতে পারলেই যেনো প্রতিবাদ করার কেউ নেই ভোটারবিহীন ক্ষমতাসীনদের। তাই বিএনপি’কে দমানোর জন্য ক্ষমতাসীনরা তাদের প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন। প্রথমে তারা সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি তুলে দেন এবং ক্ষমতায় থেকেই তারা জোর, জুলুম, ভীত, ত্রাস পরিবেশ সৃষ্টি করে কেন্দ্র দখল করে নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীদের বিজয়ী করে নেন। বিএনপিকে স্তব্ধ করতেই গণতন্ত্রের মা বিএনপি’র চেয়াপার্সনকে ভিত্তিহীন মামলায় সাজা দিয়েছেন ও তারুণ্যের অহংকার বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকেও সাজা দিয়েছেন এবং এখনো মামলা দেওয়া অব্যাহত রেখেছেন। সেই সাথে মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক, স্বনির্ভর ও আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি, উন্নয়নের রূপকার, বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান এর দেশ গঠনে ও উন্নয়নে অবদান নতুন প্রজন্ম যেনো জানতে না পারেন এ জন্যই ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ স্থাপনা, প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে জিয়াউর রহমান এর নাম পরিবর্তন করার কাজে লিপ্ত রয়েছেন। তার কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা হল-২০১০ সালের মার্চ মাসে বরিশালে শহীদ জিয়াউর রহমান বিশ^বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় নামে সংসদে বিল পাস এবং পরে পরিবর্তন করে ক্ষমতাসীনরা। ২০১০ সালের নভেম্বরে নারায়নগঞ্জের চাষাড়ায় শহীদ জিয়া হলের নাম পরিবর্তন করে টাউন হল করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রের প্রায় ১২০০ কোটি টাকা খরচ করে ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ নামফলকে জিয়া নাম খুলে তদ্স্থলে হযরত শাহজালাল (রহ.) নাম তোলেন এবং ইংরেজী ও আরবী ফলকেও নাম পরিবর্তন করেন। ২০১৬ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহার এবং প্রত্যাহারের পাশাপাশি জাতীয় জাদুঘর থেকে ওই পুরস্কারের মেডেল ও সম্মাননাপত্র সরিয়ে ফেলার সুপারিশ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং পরবর্তীতে জাতীয় জাদুঘর থেকে স্বাধীনতা পদক সরিয়ে নেয়া হয়। ২০১৭ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলার নাম পরিবর্তন করে ইন্দুরকানি করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার এবং পরবর্তীতে গেজেট প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে রাজধানী শাহবাগে অবস্থিত ‘শহীদ জিয়া শিশু পার্ক’ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শিশু পার্ক’। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের কাজীর দেউরিতে অবস্থিত ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘর’ এর নামফলকের উপর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘরের নামফলকের স্টীকার লাগানো হয়। ২০২০ সালে জুন মাসে বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার বাগবাড়ী গ্রামে ‘গাবতলী শহীদ জিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’ এর নাম পরিবর্তন করে গাবতলী পূর্বপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় রাখা হয়েছে এবং ‘সুখানপুকুর শহীদ জিয়াউর রহমান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’ এর নাম পরিবর্তন করে সুখানপুকুর বন্দর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২০ সালে অক্টোবরে জয়পুরহাট শহীদ জিয়া ডিগ্রী কলেজের নাম পরিবর্তন করে জয়পুরহাট ডিগ্রী কলেজ করা হয়। ২০২০ সালেই অক্টোবরের শেষে পুরান ঢাকার মোগলটুলিতে ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়’ নাম পরিবর্তন করে পুরান মোগলটুলি উচ্চ বিদ্যালয় রাখা হয়। অথচ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই বিদ্যালয়ের নাম ছিল ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়’ । 

 

নাম পরিবর্তন করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের প্রযোজনায় কতিপয় নামহীন কুশিলব দ্বারা ভিত্তিহীন কাহিনী নির্ভর তথ্যসন্ত্রাস প্রপাগান্ডাস্বরূপ ‘ইনডেমনিটি’ নামক নাটক মঞ্চস্থ ও প্রচার করছেন কতিপয় টিভি চ্যানেল ও মিডিয়ার মাধ্যমে যেখানে জিয়াউর রহমান এর ভূমিকা ভিত্তিহীন, উদ্ভট, মিথ্যাচারিতা করে উপস্থাপন করা হয়েছে। যার সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নায়ক, গায়ক, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাসসহ বিভিন্ন সংগঠন। মহান স্বাধীনতার ঘোষক বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে নিয়ে তথ্যসন্ত্রাস, কটুক্তি ও নাম পরিবর্তনের পাশাপাশি জনদৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার জন্য কৌশলে উন্নয়নের প্রকল্প উপস্থাপন করেন ক্ষমতাসীনরা। 

 


নানা প্রকল্পের বাজেট বছরে বছরে বাড়িয়ে তিনগুন বা চারগুন করে নিজেদের পকেট ভরান ক্ষমতাসীনরা। কেননা, জনগণ মিডিয়া বা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জেনে গেছেন ক্ষমতাসীনদের উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেট বাড়িয়ে দুর্নীতির কার্যকলাপ। আসা যাক প্রকল্পগুলোর বিষয়ে। উন্নয়নের যেসব প্রকল্পের কথা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বলছেন সেগুলো তো বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ে হাতে নেওয়া প্রকল্প। রাজধানীর যানযট নিরসনে মেট্রোরেল প্রকল্পের পরিকল্পনা প্রথম হাতে নেন বিএনপি সরকার। ২০০৫ সালে ঢাকার জন্য ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) অনুমোদন করেন এবং এতে যানজট নিরসনসহ ২০২৪ সালের মধ্যে একাধিক মেট্রোরেলসহ নানাপ্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয়া হয় (প্রথম আলো,২০১৯)। তারই ফলশ্রুতিতে আজকের এই মেট্রোরেল প্রকল্প। ২০০৪ সালে জুলাই মাসে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা এর সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মানের সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন সরকার (বাংলা ট্রিবিউন, ২০১৭) অর্থাৎ তৎকালীন বিএনপি সরকার। পরে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একনেক বৈঠকে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ধরে শুরু হয় পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ। আর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় জেকে বসে দফায় দফায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাজেট বাড়ান এবং ২০২০ সালে এসে এই প্রকল্পের বাজেট দাড়িয়েছে প্রথম বাজেটের চেয়ে তিনগুন বেশী ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা । বিএনপি সরকারের সময় অর্থাৎ ২০০৬ সালে ১৯২.৪৮ কিলোমিটার ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন মহাসড়ক ২ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একনেকে অনুমোদন করেন এবং পরবর্তীতে ব্যয় বৃদ্ধি করে করেন ৩ হাজার ৮১৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা আর ২০১৬ সালে ০২ রা জুলাই ১৯০.৪৮ কিলোমিটার সড়ক উদ্বোধন করেন (৩) আওয়ামী লীগ সরকার । মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পে প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় ধাপে তা বাড়িয়ে নির্ধারণ করেন ৭৭২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সময়মতো তাতেও প্রকল্পটি সম্পন্ন না হওয়ায় পরে ব্যয় বাড়িয়ে নির্ধারণ করেন ১২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা (২)। অর্থাৎ প্রথম বাজেটের চেয়ে চারগুন বেশী করা হয় আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে । রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বাজেট ছিল ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা আর ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাড়িয়ে তা করা হয়েছে ১৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা । দেখা য়ায় প্রকল্পগুলো বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় শুরু ও সে সময়ের বাজেট ছিল এক রকম এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সময় প্রকল্পগুলোর বাজেট; শুরুর সময়ের তুলনায় তিন বা চারগুন বাজেট বাড়ানো হয়। বাজেটের এই অতিরিক্ত টাকাগুলো ক্রয়ে দেখা যায় বাজার দামের তুলনায় বেশ কয়েকগুন বেশী। তেমনি এক সরকারী ক্রয়খাতে মিডিয়া বা গণমাধ্যমের কল্যাণে জনগণ জেনেছেন এক বালিশের দাম (উঠানোর খরচসহ) প্রায় সাত হাজার টাকা, এক পর্দার দাম ৩৭ লাখ টাকা-যা দুর্নীতির নামান্তর। কেউ বা কোন সংগঠন এসব বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করলে বা লেখালেখি করলে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বলা হয় ওরা স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার ইত্যাদি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধারাও হয়ে যান রাজাকার বা স্বাধীনতা বিরোধী। প্রতিবাদ করায় শুধু বিএনপি নেতা-কর্মীরাই নয়; জনসমর্থিত বিএনপি’র চলমান আন্দোলনকে সমর্থন করায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সাহেবরাও ক্ষমতাসীনদের দ্বারা স্বাধীনতাবিরোধী বা রাজাকার হয়ে যান। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সময়েও চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা য়ায় বৈষম্য। যা ২০১৪ সালে নভেম্বর মাসে ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম (বর্তমানে মৃত)  এর বক্তব্য থেকেই অনেকটা স্পষ্ট।

 

কিন্তু জনগণ বৈষম্য চান না। কেননা, বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতেই স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১-এ বিজয় অর্জন করেছিল এদেশের জনগণ। অথচ আজ এতো বছর পর স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে সেই বিজয়ের ফলাফল কি এই যে, চলছে নাম পরিবর্তনের খেলা, তথ্যসন্ত্রাসস্বরূপ ইতিহাস বিকৃত মিথ্যাকাহিনী নির্ভর নাটক প্রচার করা, উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেট বাড়িয়ে বাজার দামের তুলনায় বেশী দাম দেখিয়ে টাকাগুলো নিজেদের পকেটে তোলা, ভোটারদের নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে ক্ষমতাসীনদের কর্তৃক বাধা দেয়া-ভয়ভীতি দেখানো বা কেন্দ্রে প্রবশ করতে না দেয়া, ভোটকেন্দ্র থেকে বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দেয়া, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী বা নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব, মুক্তভাবে লেখার বা কথা বলার অধিকারকে সৃষ্ট তথ্য-প্রযুক্তি আইন দ্বারা দমানো, করোনাকালীন সময়ে গরীব মানুষদের মোবাইলের মাধ্যমে সরকারী সহায়তার টাকা, কাবিখা’র টাকা, বিভিন্ন ভাতা ও উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা ক্ষমতাসীনদের দ্বারা লুটপাট, অনুমতি ছাড়া সভা-সমাবেশ করতে পারবে না বলে প্রশাসনের এমন আদেশ দেয়ার পর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলো ঠিকভাবে সভা-সমাবেশ করতে পারছে না পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীনরা দেদারসে রাজপথে থেকে মিছিল-স্লোগান ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে-অর্থাৎ বৈষম্য চলমান। তাই বিভিন্ন বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতেই যেমন নয় মাস যুদ্ধে করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করেছিল এদেশের জনগণ এবং ঠিক তেমন স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে জনগণের ভাবনা নিপাত যাক আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকসহ সকল বৈষম্য, প্রতিষ্ঠিত হোক সবার সমান অধিকার, ভোটাধিকার,  মানবাধিকার। প্রতিষ্ঠিত হোক সুশাসন, সুআইন, সুবিচার। 

 

  • লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট।