Search

Sunday, August 14, 2022

জ্বালানির ‘জ্বালা’ জনভোগান্তির রেকর্ড

— শুভ কিবরিয়া

 

জ্বালানি তেলের অভাবনীয় মূল্যবৃদ্ধি করে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে ফেলেছে সরকার। বাংলাদেশে অতীতে একবারে এতবেশি পরিমাণে জ্বালানির মূল্য কখনই বাড়ে নাই। হালে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেও এই হারে জ্বালানির মূল্য বেড়েছে কিনা সন্দেহ আছে। দেউলিয়া হতে বসা শ্রীলঙ্কার মতো দেশেও জ্বালানির মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নাই। ৫ই আগস্ট ২০২২ শুক্রবার মধ্যরাতে সরকারের ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা (৪২.৫% দাম বৃদ্ধি), কেরোসিন ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা (৪২.৫% দাম বৃদ্ধি), পেট্রোল ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা (৫১.১% দাম বৃদ্ধি), অকটেন ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা (৫১.৭% দাম বৃদ্ধি) করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ছিল এতটাই আচানক যে এটা বুঝে উঠতেও মানুষের কিছুটা সময় লেগেছে। অবশ্য পরেরদিন রাস্তায় বেরিয়েই গণপরিবহনের তুঘলকি কাণ্ড দেখে মানুষ টের পেয়েছে দেশে কিছু একটা ঘটে গেছে! মাত্র একদিনের মধ্যেই খুব দ্রুত সরকার পরিবহন সংগঠনের সঙ্গে বসে জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে পরিবহন ভাড়ার সমন্বয়ও করে ফেলেছে।

এই কাজে অবশ্য সরকার সব সময়ই খুব পারঙ্গমতা দেখিয়েছে। সরকারের তৎপরতায় বিআরটিএ দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটার প্রতি ৪০ পয়সা (২২.২%) ভাড়া বাড়িয়েছে। নগর পরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে কিলোমিটার প্রতি ৩৫ পয়সা (১৬.২৭%)। এখন বাজারেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দ্রুতই সব গণ্য ও সেবার দাম হু হু করে অনিয়ন্ত্রিত বেগেই বেড়ে যাবে। 

সরকারের নীতি অনুযায়ী জ্বালানির ক্ষেত্রে যতো রকম ঘাটতি আছে, তার দায় ভোক্তার ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছে সরকার। সরকারের সকল উন্নয়নের যে চাপ, যে দায়, পরিকল্পনার যে খেসারত তার ব্যয় উচ্চমূল্যেই এখন আমজনতাকে বইতে হবে নিদারুণ কষ্টে, অসহ্য যন্ত্রণায়।

এর কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই ইউরিয়া সারের দাম সরকার বাড়িয়েছে কেজি প্রতি ৬ টাকা। এর কারণ হিসাবে প্রকাশ্যে সরকার যা বলেছে তা হলো, কৃষকরা না বুঝে কৃষিজমিতে প্রয়োজনের চাইতে বেশি বেশি ইউরিয়া সার ব্যবহার করে। ইউরিয়া সারের এই অতি ব্যবহার জমি, প্রকৃতি, পরিবেশ কারও জন্যই ভালো নয়। সে কারণেই সরকার চায় কৃষক জমিতে পরিমাণ মতো ইউরিয়া ব্যবহার করুক। তাহলে সেটার উপায় কি? সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মনে হয়েছে, দাম বাড়ালেই কৃষক কম কম ইউরিয়া কিনবে। কম কম ব্যবহার করবে। সরকারের এই উদ্দেশ্য ফলপ্রসু হবে কিনা কে জানে? তবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

 প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, গত ৫০ বছর ধরে কৃষি বিভাগ কি কাজ করলো যে কৃষককে এখনো বোঝাতেই পারলো না, ইউরিয়া কতটুকু ব্যবহার করা দরকার। এই ব্যর্থতার দায় কার? কৃষকের না কৃষি বিভাগের? যদি কৃষি বিভাগের হয়, তাহলে সেই দায়ভারের শাস্তি কি? দ্বিতীয়ত, দেশে যখন জ্বালানির সংকট তৈরি হলো, গ্যাস রেশনিং শুরু হলো, তখন প্রথমেই সরকারি মালিকানাধীন ইউরিয়া সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে পুরো ফ্যাক্টরিকেই বসিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারের নিজস্ব ইউরিয়া সার উৎপাদন পুরো বন্ধ করে তার পর পরই বাড়ানো হলো ইউরিয়ার দাম। এর মধ্যে মতলবটাই বা কী! অনেকে বলছেন, আইএমএফ’র লোন পাবার তাড়নায় সার খাতে সরকারি ভর্তুকি কমাবার তাগিদে সরকার এই কাজটা করেছে। কৃষকের ঘাড়ে এবার ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ স্বরূপ হাজির হয়েছে মধ্যরাতে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি। শুধু তাই নয় এবার অচিরেই বাড়তে চলেছে বিদ্যুতের দামও।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার জ্বালানির মূল্য এভাবে বাড়ালো কেন? প্রথমত, সরকার নিশ্চিত যে, সরকার যাই করুক না কেন তার কোনো বড় জনপ্রতিক্রিয়ার মুখে পড়বে না। দু-চারদিন ছোটখাট দু’একটা মিছিল, কিছু বিবৃতি, কিছু টকশো’র আলোচনা ছাড়া এর বড় কোনো রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া  নেই। জনগণের বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষদের কষ্ট বাড়বে, তবে তার সামষ্টিক এমন কোনো চাপ তৈরি হবে না যে সেটা সরকারকে ঘাবড়ে দিতে পারে। আর যদি কোনো ধরনের চাপ তৈরি হয়ও, তা শক্ত হাতে মোকাবিলা করার মত প্রাতিষ্ঠানিক-আর্থিক-প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ক্ষমতা সরকারের আছে। ফলে, এক ধরনের ডোন্ট কেয়ার অবস্থা সরকারকে এ রকম জনবিরুপ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে সরকারের অর্থিক খাতে বিশেষ করে ডলারের টানাটানি বেড়েছে। ফলে আইএমএফ’র সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছুতে হলে তাকে বিভিন্ন খাতে দেয়া ভর্তুকি তুলে নেবার শর্ত পূরণ করেই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আইএমএফ কোনো কারণে বিরাগ হলে সেই চাপ সরকারের মোকাবিলা করার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ আছে। 

ফলে, আইএমএফকে তুষ্ট করার বড় বিপদ এড়ানোর অভিপ্রায়ে জনঅসন্তুষ্টির ছোট ঝামেলা, যা মোকাবিলাযোগ্য, সেটাকেই সরকার অগ্রাধিকার দিয়েছে। অন্যদিকে সরকারের রাজনীতি ও উন্নয়ন ম্যানেজ করতে আমলাতান্ত্রিক যে কাঠামোর ওপর নির্ভর করতে হয়েছে এবং হচ্ছে, তার বাইরে যাবার রাজনৈতিক পথ সরকারের সামনে খোলা নাই। ফলে, শক্তিমান আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় যে অস্বচ্ছতা, অদক্ষতা, দুর্নীতি চলমান আছে, বহু জায়গায় যে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় অব্যাহত আছে, তাকে মেনে নিয়েই সরকারকে এগুতে হচ্ছে। সে জায়গায় সংস্কার করার কোনো সুযোগও সরকারের হাতে নাই। ফলে তুলনামূলক দুর্বল এবং প্রতিরোধ করার ক্ষমতাহীন অংশ ‘আমজনতা’ কিংবা ‘সাধারণ জনগণ’কে চাপ দিয়ে সরকার পরিস্থিতি সামলাতে চাইছে।

এখন দেখা দরকার এই পরিস্থিতির সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কী প্রভাব পড়তে পারে। মানুষের কষ্ট বাড়বে ভীষণভাবে। গ্যাস, বিদ্যুত, পানির বর্ধিত দামে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর যে চাপ পড়বে, তাতে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য ও সেবার দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আমাদের পুরো রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামো যেহেতু জনবান্ধব না, ফলে সকল পণ্য ও সেবা বেশি দাম দিয়ে কিনেও মানুষ আশানরুপ সার্ভিস পাবে না।

 জ্বালানির এই ভয়াবহ দাম মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। সেটা জনজীবনকে আরও ভোগাবে। লুটপাটের বাইরে যারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ব্যবসা করে আমাদের অর্থনীতি সচল রাখে তারাও ভীষণ চাপে পড়বে। তাদের সকল পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ করে রপ্তানিকারকরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে। এমনও হতে পারে উৎপাদনের চাইতে আমদানি লাভজনক বলে বিবেচিত হবে। ফলে, স্থানীয় ব্যবসা, উৎপাদন, বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়তে পারে। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সুবিধাও মানুষকে শেষাবধি চড়া দামে ক্রয় করতে হবে। ফলে সামাজিক বৈষম্য প্রকট হবে। সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। জননিরাপত্তা কমতে থাকবে। জনঅসন্তুষ্টির প্রভাব পড়বে সামাজিক পুঁজির ওপরে। সেটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও আরও প্রতিহিংসাপ্রবণ ও সহিংস করে তুলতে পারে।

জ্বালানির এই বর্ধিত চাপ মেটাতে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার। কেন না জনগণের এই অংশকে একটা ন্যূনতম আর্থিক সন্তুষ্টির মধ্যে রাখাকে কৌশলগতভাবে সরকারের জন্য লাভজনক বলেই ইতিপূর্বে বিবেচিত হয়েছে। সেই বিবেচনা থেকে পেছন ফেরার মতো কোনো কারণ  যেহেতু ঘটে নাই, ফলে সরকার এ রকম সিদ্ধান্ত নিলে অবাক হবার মতো কিছু থাকবে না। 

কৃষিতে একটা বড় বিপদ ঘটবে। সারের দাম, ডিজেলের দাম, বিদ্যুতের দাম প্রান্তিক ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদনকে হুমকির মধ্যে ফেলতে পারে। ছোট কৃষক বিনিয়োগের অভাবে কৃষি পেশা থেকে অব্যাহতি নিতে পারে। এ জায়গায় করপোরেট কৃষি ক্ষুদ্র-প্রান্তিক কৃষকের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হবে। বড় বিনিয়োগে, বড় বিপণন ব্যবস্থায় করপোরেট কৃষি কৃষি বাজারকে নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারে। ভোজ্য তেলের সরবরাহ ও নিয়ন্ত্রণ যেমন কতিপয় বড় ব্যবসায়ীর  হাতে থাকে, জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি তেমনি পুরো কৃষিকে কতিপয় করপোরেটের তালুবন্দি করার ব্যবস্থা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখবে।

আমজনতা তার সকল রকম ব্যয় কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করবে। তার সকল রকমের ইনটেক কমবে। সে খাবে কম, পরবে কম, ঘুরবে কম। ফলে তার জীবনমান, পুষ্টিমান, বিনোদনমান, জীবনের স্বপ্নমান সব কমতে থাকবে। বাসাভাড়া ব্যয়, চিকিৎসা ব্যয়, গ্যাস-বিদ্যুত-পানি খাতে ব্যয়, পরিবহন ব্যয়, সন্তানদের শিক্ষা ব্যয় মিটিয়ে তার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের যে ফারাক ঘটবে তা জীবন নিয়ে তাকে এক দুঃখী মানুষে পরিণত করবে। তার ধর্মপ্রীতি বাড়বে, রাষ্ট্রপ্রীতি কমবে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা-মমতাও সে হারিয়ে ফেলবে। এক বিষণ্নতর জীবন তাকে হতাশার দিকে ঠেলে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা বড় বড় প্রকল্প, অবকাঠামো তৈরি করে সরকার বা রাষ্ট্র তাকে যে সুখী করতে চেয়েছিল সেগুলোকেই সে তার দুর্ভোগের কারণ বলে বিবেচনা করতে থাকবে। সরকারের রাজনৈতিক দলকে সে অবিশ্বাস করতে শুরু করবে। এটাই আমাদের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় দুঃখদিন আনার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। কেন না, জনগণ যদি রাজনৈতিক দলকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে, নিজের জীবনের দুঃখ-কষ্টের জন্য রাজনৈতিক দলের কাজকেই দোষারোপ করতে থাকে, তবে সে রাষ্ট্র বা জাতির জন্য এর চাইতে দুর্ভাগ্যের আর কিছু নেই। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক 

বিশ্লেষক, kibria34@gmail.com

সূত্র — মানবজমিন/ আগস্ট ৮, ২০২২

জনগণকে হাত-পা বেঁধে যেন মাঝনদীতে ফেলে দেওয়া হলো

— শাহানা হুদা রঞ্জনা



বড় ধরনের একটা ঝড় আসবে আসবে বলে আশংকা করছিলাম। ঝড়টা এসেই গেল মনে হচ্ছে। এই ঝড় প্রতিহত করার ক্ষমতা আমাদের নেই সত্যি। কিন্তু ঝড়ের প্রভাব থেকে আমরা কিভাবে বাঁচবো এরও কোন নির্দেশনা নেই, নেই অগ্রিম সতর্কবার্তা ও আপদকালীন পরামর্শ। ফলত যা হওয়ার তাই হবে। অর্থনীতির এই ঝড়ের ধাক্কায় ছিটকে পড়বে সাধারণ মানুষ। বিপর্যস্ত হবে তাদের জীবনব্যবস্থা।

প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী, যারা শক্তিশালী তারা টিকে থাকবে। কিন্তু আর্থিকভাবে এই শক্তিশালী মানুষ আসলে কতজন। একটি দেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে টেনেটুনে হয়তোবা শতকরা ১০ জন। বাকি ৯০ শতাংশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এই অর্থনৈতিক ঝড়টা শুরু হয়েছিল ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর, যেদিন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সর্বনিম্ন হলো, ঠিক সেদিনই জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলে বসলেন, "আামি প্রাইস বাড়াচ্ছি কারণ আমার দেউলিয়াত্ব থেকে আমি বাঁচতে চাই।"

দাম বাড়িয়ে উনি না হয় বাঁচলেন কিন্তু জনগণের কি হবে? সবার মনে এখন একই প্রশ্ন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কমতির দিকে, তখন বাংলাদেশে দাম এতটা বৃদ্ধি করা হলো কেন? জনগণ কি পারবে এই ভার বহন করতে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম এ প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, "মানুষের প্রতি অবজ্ঞা থেকেই জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানো হলো। মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতা থাকলে জ্বালানি তেলের মূল্য এতটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ছিল না।"

তিনি আরো বলেছেন, "বিশ্ববাজারে তেলের দাম এখন নিম্নমুখী। আর এই যে সমন্বয়ের কথা ওনারা বারবার বলেন, কিন্তু তেলের দাম যখন দীর্ঘদিন ধরে অনেক কম ছিল আমরা তো কম দামে তেল কিনিনি। ওই টাকা যদি হিসাব করা হয়, তাহলে লাভের কত টাকা জমা আছে বিপিসির কাছে। এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সেই টাকাটা কি সমন্বয় করা যায় না?"

গত ২৭ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছিলেন, "অকটেন এবং পেট্রল কিন্তু আমাদের কিনতে হয় না। এটা আমরা যে গ্যাস উত্তোলন করি, সেখান থেকে বাই প্রডাক্ট হিসেবে পেট্রল ও অকটেন পাই। বরং আমাদের যতটুকু চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি পেট্রল ও অকটেন আমাদের আছে। আমরা অনেক সময় বাইরে বিক্রিও করি", তখন দারুণ একটা স্বস্তিবোধ করেছিলাম। তাহলে গোলটা বাঁধলো কোথায়? সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা জানতে চাইছি এই কয়দিনে কী এমন ঘটলো যে প্রধানমন্ত্রীর কথাও রাখা গেল না?

সাধারণ মানুষ এত হিসাব-নিকাশ বুঝে না। শুধু দু'বেলা ডাল ভাত খেয়ে, পরিবার নিয়ে নিরাপত্তার মধ্যে বাঁচতে চায়। কিন্তু হঠাৎ করে যখন অস্বাভাবিকহারে বাড়ানো হলো তেলের দাম, তখন মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মূল্যবৃদ্ধির জন্য কোনো প্রস্তুতি নেই, নেই কোন আলোচনা বা আগাম সতর্কতা।

সরকার কি জানেনা নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের অবস্থা আর্থিকভাবে কতটা সংকটপূর্ণ, সেটা তো সরকারের বিবেচনায় থাকা দরকার ছিল। কিন্তু, তেলের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তাতে মনে হয় না যে তাদের এই বিবেচনাটা খুব একটা আছে। বলা যায়, জনগণকে হাত-পা বেঁধে মাঝ নদীতে ফেলে দেয়ার মতো অবস্থা হলো। এটা কোনো বিবেচনাতেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং হঠকারি সিদ্ধান্ত বলা যায়।

এই আপদকালীন সময়ে সরকারের সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি বললেন, "আইএমএফের শর্ত মেনে সরকার বিষ গিললো।" কথা যদি সত্য হয়, তাহলে তো বুঝতে হবে এই বিষ দেশের জনগণ গিললো। আইএমএফ এর লোন কেন দরকার, কোথায় খরচ হবে, কিভাবে খরচ করবে, সুদ কত, সরকার কিভাবে-কতদিনে সুদ মেটাবে, জনগণকে কতটা বহন করতে হবে--- এই বিষয়গুলো স্পষ্ট করা দরকার সরকারকেই, কারণ তা না হলে মেনন সাহেবের বিষ গেলার কথাটাই সত্য বলে ধরে নিতে পারে বিপদগ্রস্ত জনগণ।

এমনিতেই বাংলাদেশ কি শ্রীলংকা হবে, নাকি ইউক্রেন হবে এসব চিন্তাভাবনা, হাস্যরস, আশংকা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিলই। সরকার নানাভাবে জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে। কখনো কখনো প্রকৃত পরিস্থিতি গোপন করে হলেও তারা ভেবেছে জনগণকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। কিন্তু বিশ্বব্যাংক যখন বলে বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে জটিলতা এবং দ্রুত খালি হয়ে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ শ্রীলংকাকে দ্রুত অস্থির করে তুলছে, তখন তো আইএমএফ লোন নিয়ে সাধারণ মানুষ ভয় পাবেই।

মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, শিশুখাদ্যের অস্বাভাবিক দাম সবকিছুকে এড়ানো সম্ভব হলেও ডলারের অনিয়ন্ত্রিত বাজার, গ্যাস সংকট, বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং সর্বশেষ জ্বালানির প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে একেবারে পেরেশান করে তুলেছে। এরমধ্যে সরকারের মন্ত্রী, এমপি মহোদয়রা এতটাই অপ্রাসঙ্গিক বাণী দিয়ে চলেছেন, যা মানুষকে বিরক্ত করছে বহুগুণ।

আমি নিশ্চিত যে শুক্রবার রাতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সংবাদ শোনার পর অনেক মানুষ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে কাটাতে বাধ্য হবেন। যাদের উপর পরিবার পরিচালনার দায়িত্ব, তারা রাত জেগে খামোখাই আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করে গেছেন, যে হিসাব আসলে আর মিলবে না।

তারা জানেন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তেল, নুন, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে বাস-রিকশা, বাড়িভাড়া সব বেড়ে যাবে। বেড়েছে এবং আরো বাড়বে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের বিল। শিক্ষা ব্যয় বাড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা। আমাদের মতো নির্ধারিত আয়ের মানুষের মূল চ্যালেঞ্জটা হলো বাজারে সবকিছুর দাম হু হু করে বাড়বে, আমার আয় বাড়বে না কিন্তু আমাকে খরচ কমাতে হবে।

আমরা অনেকেই ১৯৭৪ সালের পর অর্থনীতির এত বিপর্যয় দেখিনি। এবার যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারের মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধি। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এরকম বড় আরো একটি ধাক্কা দেশের অর্থনীতিকে একেবারে পঙ্গু করে দিতে পারে বলে অনেকেই আশংকা করছেন।

মানুষের চোখের সামনে শ্রীলংকা ও পাকিস্তান মন্দ অর্থনীতির উদাহরণ হিসেবে খাড়া হয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছে ঋণ সহায়তা চেয়েছে। এতবড় একটা ঋণের বোঝা কিভাবে বাংলাদেশ শোধ করবে, সেটা নিয়েও মানুষ চিন্তিত।

একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের সংকোচন ও মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে সরকারের অপরিমিত ব্যয়, দুর্বল ব্যাংকিং নীতি, অর্থনীতিবিদদের কথা অবজ্ঞা করা, কালো টাকা হালালীকরণ, সরকারি কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত বিলাসব্যসন, ভর্তুকি ব্যবস্থা, বিদেশ ভ্রমণ, অ-দরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনা, দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীন আমদানি নীতি, করোনাকালীন ক্ষয়ক্ষতি এবং জনগণের আয়-ব্যয় এর কথা না ভাবা সব বিরূপ প্রভাব ফেলেছে অর্থনীতির উপর।

করোনার পর অর্থনীতিতে এত বড় ঝড় দেখে সবারই একটা আশংকা তৈরি হয়েছে যে আবার কি আমাদের কাজের জায়গা ছেড়ে, বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়ে, শহরের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে হবে আশ্রয়ের জন্য? সংসার খরচ, সন্তানের পড়াশোনা, বাড়িভাড়া, বিল, গাড়িভাড়া, ওষুধ, বাবা-মায়ের খরচ সব নির্ভর করে চাকরির বেতনের উপর বা নির্ধারিত আয়ের উপর। আয়ের পথ রুদ্ধ হলে, স্থানীয় বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হলে, কীভাবে চলবে সংসার?

সাম্প্রতিক গণশুমারি অনুযায়ী ঢাকাতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা সাড়ে চার কোটি। অনেকের ধারণা তা পাঁচ কোটি হবে। সে যাই হোক, এই মানুষগুলোর অর্ধেকও যদি বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে না পেরে আবার গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়, তখন বিপর্যয়টা কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে, তা সহজেই অনুমেয়।

আবার যে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হচ্ছে, এর মধ্যে সাধারণ মানুষ বাঁচবে কেমন করে? শুধু যে দরিদ্র মানুষের গায়ে এই মন্দার তাপ লাগবে, তা নয়। তাপ লাগবে মধ্যবিত্তর জীবনে। শুধু আর্থিক বিপর্যয় নয়, মানসিক বিপর্যয়ও সমাজ ও দেশকে অস্থির করে তুলবে।

কৃষকরা প্রথম ধাক্কা খেয়েছেন সেচের জন্য বিদ্যুৎ না পেয়ে, অনাবৃষ্টিতে ক্ষতি হচ্ছে ফসলের। কিছুদিন আগে কয়েকটি জেলায় হয়ে গেল বন্যা, বেড়েছে সারের দাম। এখন আরো বাড়বে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ। ডিজেলের দামের সাথে অনেককিছুর মূল্যবৃদ্ধি জড়িত। এই মূল্যবৃদ্ধি গ্রাম ও শহরের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছিল সেই করোনাকাল থেকেই, এবার মনে হয় সত্যি গিলে ফেলবে।

আমরা শুধু অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে ভাবছি কিন্তু সমাজের উপর এর প্রভাব হবে আরো অনেক ভয়াবহ। অর্থকষ্ট, শিক্ষার সুযোগ কমে যাওয়া, জীবন চালাতে না পারা, চাকরি হারানো, উপার্জনের সুযোগ না থাকার মতো বিষয়গুলো সমাজে বাড়াবে খুন, জখম, আত্মহত্যা, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, হতাশা, মাদক গ্রহণ এবং শারীরিক অসুস্থতা।

সামাজিক অস্থিরতা ও মানবিক হতাশা এমন বিষয় যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ফিরে এলেও শান্তি ফিরিয়ে আনাটা কঠিন হয়ে পড়ে। সময়ে যে লাগামটা আমাদের টেনে ধরার দরকার ছিল, তা আমরা টেনে ধরতে পারিনি। তাই আন্তর্জাতিক অচলাবস্থা আমাদের যতোটা না ঘায়েল করবে, এর চেয়েও আমরা নিজেদের বেশি ক্ষতি করবো হঠকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে।

লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

Friday, June 3, 2022

জিয়ার অর্থনৈতিক চিন্তা ও অবদানের পথ ধরেই আধুনিক ও স্বনির্ভর বাংলাদেশের শুভযাত্রা

— ফারহান আরিফ




বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর নতুন সংবিধান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলা হয়। কিন্তু এই পদ্ধতি কার্যকরের উপযোগী কোনো ধারণা তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারে কারোও মাথায় ছিল না। এমনকি এ বিষয়ক কোনো প্রস্তুতিও সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটির ছিল না। গণপরিষদে যখন এ বিষয়ক বিতর্ক হয় তখন সমাজতন্ত্রকে ‘মুজিববাদ’ বলে উল্লেখ করা হয়। বস্তুত মুজিব নিজে সমাজতন্ত্রের ঘোষণা দিলেও এর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তিনি স্বাধীনতার পরপরই সকল পাট ও বস্ত্র কলসমূহ জাতীয়করণের ঘোষণা দিলেন। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু কোনোরূপ পূর্বপ্রস্তুতি এবং স্বচ্ছ ধারণা ব্যতিরেকেই তার এই পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। বস্তুতঃ জাতীয়করণ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উত্তরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও এর সফল বাস্তবায়নের জন্য কয়েকটি শর্ত পূরণের প্রয়োজন ছিল। অর্থাৎ একটি সৎ রাজনৈতিক দল, নিষ্ঠাবান ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী এবং বিশ্বস্ত প্রশাসন, এই তিনের সমন্বয় ব্যতিত একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উত্তরণ ছিল অসম্ভব। কিন্তু মুজিবীয় আমলে রাষ্ট্র ও রাজনীতির এই প্রধান নিয়ামকসমূহ গড়ে উঠতে পারেনি। উপরন্তু যারা বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছিলেন তাদের এ সংক্রান্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানও ছিল না। ফলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হল। জাতীয়করণের সুযোগে প্রভাবশালী মহল লুটপাটের সুযোগ পেয়ে গেল এবং অতি দ্রুত বাংলাদেশ একটি ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা লাভ করলো। এসব কারণে স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরেই বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবার উপক্রম হলো। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ ‘বটমলেস বাস্কেট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করলো।

রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির এই দুর্যোগে রাজনীতিতেও সংক্রমিত হলো। একটি ঘটনাবহুল রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যে দিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লব ঘটলো। সাধারণ সৈনিক এবং জনগণই জিয়াকে কাঁধে করে ক্ষমতার দোড়গোড়ায় নিয়ে এলেন। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে জিয়া উপসামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তার সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল, বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা।  

জিয়ার অর্থনৈতিক ভাবনা ও উন্নয়ন নীতি 

জিয়া ব্যক্তিখাতের প্রাধান্যসহ মিশ্র অর্থনীতিতে বিশ্বাস করতেন। তার লক্ষ্য ছিল, জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার উন্নত করা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন। এ দুইটিকে তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব মনে করতেন। উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর লক্ষ্যে তিনি কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেনঃ ১) সরকারি ও বেসরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পদের ভিত্তিতে উন্নয়ন ব্যয় বাড়ানো, ২) বিনিয়োগমূলক ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ানো, ৩) জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি তথা কৃষি ও শিল্প খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পদের বরাদ্দ বাড়ানো।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গ্রামমুখী অর্থনীতির উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ‘বাংলাদেশ অর্থ গ্রাম। বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য আমাদের গ্রাম ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন করতে হবে।’ গ্রামীণ জনজীবনের সার্বিক উন্নতির প্রতি গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘গ্রামের নিরক্ষর ও দরিদ্র মানুষের দ্বারে আমাদের সভ্যতার বাণী নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই বলতে পারবো যে, বাংলাদেশের উন্নতির জন্য আমরা কাজ করেছি।’

১৯৭৬ সালের ৬ ডিসেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যবৃন্দ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে আলাপকালে জিয়া তার উন্নয়ন নীতির রূপরেখা তুলে ধরেনঃ ১) উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, ২) গ্রামকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের চাহিদা পূরণে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে, ৩) গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং ৪) পলিমাটিতে ভরাট হওয়া নদী ও খাল খননের কাজে জনগণকে কাজে লাগাতে হবে। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে তিনি বিভিন্ন স্তরে কমিটি গঠনের রূপরেখাও দিয়ে গিয়েছেন।

দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা 

মুজিব সরকারের ভ্রান্ত নীতি ও সীমাহীন লুটপাট এবং পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সুফল বয়ে আনতে পারেনি। তাই দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের আগে জিয়া একটু দম নিতে চাইলেন। তাই তিনি একটি দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এই পরিকল্পনায় জিয়ার ১৯ দফা রাজনৈতিক কর্মসূচীর প্রতিফলন ঘটানো হয়। পরিকল্পনা প্রণয়নের খসড়া নিয়ে তিনি ১৯৭৮ সালের ১৬ জুন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অর্থনীতি সমিতির একটি তিন দিনের বিশেষ অধিবেশনে যোগ দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘জনগণের জন্য স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে দেশে আর্থ-সামাজিক ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে অব্যহতভাবে অনুসরণ করতে হবে। দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য জনশক্তির কার্যকর ব্যবহার এবং উর্বর জমি, পানি, গ্যাস ইত্যাদির মত অবিকশিত ও অব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগানোর উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।’

দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল, উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং এ কারণে কৃষি উন্নয়ন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার লাভ করে। এ পরিকল্পনায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা এবং বাণীজ্যিক জ্বালানি উন্নয়নের উপর জোর দেয়া হয়। দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রায় ৮৩ শতাংশ পরিকল্পিত ব্যয়ভারসহ বহুসংখ্যক চলমান প্রকল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারণ সে সময় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে ছিল।

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা 

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল কৃষিখাতের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রাম উন্নয়ন। এ লক্ষ্যে কৃষিপদ্ধতির দ্রুত রূপান্তরের জন্যে আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তি প্রসারিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনকে একটি মূলধনভিত্তিক কাজ বিবেচনায় নিয়ে সৌর ও বায়ু শক্তির মতো প্রাকৃতিক শক্তির উৎসসমূহের উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়। দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে নিরাময়মুখী থেকে প্রতিরোধমুখী করার উদ্যোগও এই পরিকল্পনার মেয়াদেই গৃহীত হয়।

১৯৮০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বক্তৃতাকালে জিয়া দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার নয়টি অগ্রাধিকারমূলক উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করেনঃ ১) খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করা, ২) শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করা, ৩) জনশক্তি উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ৪) সর্বজনীন অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু, ৫) গণস্বাক্ষরতা কার্যক্রম প্রবর্তন, ৬) কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণকে উৎসাহিত করা, ৭) গ্রামাঞ্চলে মৌলিক চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারিত করা, ৮) উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করা এবং ৯) সমবায় পদ্ধতীর সম্প্রসারণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন।

ভূমি ও কৃষি সংস্কার প্রস্তাব



খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর গভীর আন্তরিকতা থেকেই জিয়া ভূমি সংস্কারে আগ্রহী হন। তিনি মনে করতেন, উত্তরাধিকার আইনের অধীনে ক্রমাগতভাবে জমি খণ্ড-বিখণ্ড হওয়া, নিরক্ষরতা ও সার ব্যবহারে অনভিজ্ঞতা, যান্ত্রিক চাষাবাদ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব ঋণ প্রদানকারি মহাজনদের শোষণ ইত্যাদির ফলেই কৃষকরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। জিয়া সীমানা হিসেবে ব্যবহৃত আইল প্রথার সমালোচনা করতেন। তৎকালীন এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দেশে জমির যত আইল আছে তা একত্র করলে একটি জেলার সমপরিমাণ জায়গা বের হয়ে আসবে।

১৯৮০ সালে জিয়ার শাসনামলে জাতীয় সংসদে এক বৈঠকে ভূমি ও কৃষি সংস্কার প্রস্তাব পেশ করা হয়। এ প্রস্তাবের প্রথম সুপারিশ ছিল, গ্রামাঞ্চলে পরিবার প্রতি কৃষিজমির ঊর্ধসীমা ১০০ বিঘা রাখা যেতে পারে; কিংবা মাথাপিছু ১০ বিঘা করা যেতে পারে। শহরাঞ্চলে কোনো ব্যক্তি একটির বেশি প্লট বা আধা বিঘার বেশি জমি রাখতে পারবে না। এর বেশি রাখলে তা অধিগ্রহণ করে প্রকৃত শহরবাসীদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া যেতে পারে। প্রস্তাবে একটি বর্গাচাষ আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। এছাড়াও খাস জমির ব্যবস্থাপনা, নদী সিকস্তি ও নদী পয়ন্তি জমির জন্য আইন প্রণয়ন এবং ভূমিকরের জাতীয় হার নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট বিধান সুপারিশ করা হয়।

বেসরকারি বিনিয়োগ 

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক। তিনি ব্যক্তিখাত ও বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করেছেন। ব্যক্তিখাতকে ব্রিজ ফাইন্যান্সিং ও আন্ডাররাইটিং সুবিধা প্রদান এবং দেশীয় বেসরকারি শিল্প ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের মধ্যে সহযোগীতার ওপর থাকা সকল বাঁধা-নিষেধ বিলোপে তিনি ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) প্রতিষ্ঠা করেন। বেসরকারি খাতকে চাঙ্গা করার জন্য তার সরকার ১৯৭৬ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পুনঃসক্রিয় করার ঘোষণা দেয়। ১৯৭৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জিয়া সরকার জাতীয়করণ করা ২৯টি চা বাগান ব্যক্তিখাতে ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়। ১৯৭৮ সালের মধ্যে সরকার ১১৬টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেসরকারি মালিকদের কাছে বিক্রি করে। বেসরকারি নিনিয়োগ নীতিতে জিয়া সরকার দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহারকারি রপ্তানীমুখী শিল্প, গ্রাম ও অনুন্নত এলাকায় শিল্প স্থাপন, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প, দেশীয় কাঁচামাল নির্ভর কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন এবং টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিল্প স্থাপনকে স্বাগত জানায়।

নারী উন্নয়ন



শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে নারী উন্নয়নের বিকল্প নেই। মোট জনসমষ্টির এই বিরাট অংশকে পিছিয়ে রেখে জাতীয় মুক্তি অসম্ভব। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেই জিয়া নারী উন্নয়নের জন্য বিশেষ কিছু পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। এই পরিকল্পনায় নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। নারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের ১১ ডিসেম্বর মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। দেশের নারীদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের মাধ্যমে সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করতে ১৯৭৬ সালের ১৬ এপ্রিল জাতীয় মহিলা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর এক বছরের মধ্যেই ১৯৭৭ সালের ১৫ জানুয়ারি জাতীয় মহিলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। জিয়া পুলিশ বাহিনীতে নারীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেন। ১৯৭৬ সালের ৮ মার্চ সর্বপ্রথম পুলিশে নারীদেরকে নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। তার আমলেই আনসার ও ভিডিপিতেও নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে নারিদের জন্য সংসদীয় আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয় জিয়ার আমলে।

জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে এই ধারা দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও অব্যহত থাকে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নারীদের জন্য পদ সংরক্ষণ সহ ১৯৭৬ সালের ৮ এপ্রিল সরকারি চাকুরিসমূহে নারীদের জন্য কোটা সংরক্ষণের ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়াও চাকুরিতে প্রবেশের জন্য মেয়েদের বয়সসীমা ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয় ১৯৭৮ সালের ৩ নভেম্বর তারিখে।

ব্লু ইকোনমি

উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে ব্লু ইকোনমির ভূমিকা অপরিসীম। ব্লু ইকোনমি হচ্ছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমুদ্রের উপযোগীতা বৃদ্ধি। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে, খনিজ সম্পদ আহরণ, বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে সমুদ্রের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধিশালী হয়েছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে সমুদ্রকেন্দ্রিক এই ব্লু ইকোনমির পথিকৃৎ। তার উদ্যোগে ১৯৮১ সালের ১৯ থেকে ২১ জানুয়ারি দেশ সেরা একদল মেধাবী শিক্ষার্থী এবং বিজ্ঞানীদেরকে নিয়ে ‘সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’ একটি শিক্ষা সফর আয়োজন করে। সমুদ্রগামী যাত্রীবাহী জাহাজ ‘হিজবুল বাহার’-এ চড়ে বঙ্গোপসাগরে এই ব্যতিক্রমধর্মী সফরে জিয়া অংশগ্রহণকারীদের সাথে মত বিনিময় করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্পদ ও সম্ভাবনার সাথে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া।

খালখনন কর্মসূচি 



১৯৭৬ সালের নভেম্বরের এক শীতের সকালে জড়ো হওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের কোলাহলে ঘুমন্ত গ্রাম উলশী জেগে উঠে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেই স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে মিলে সর্বপ্রথম মাটিতে কোদালের কোপ বসান। তাকে অনসরণ করেন গ্রামেরই ৭০ বছর বয়সী আবদুর রহমান বাদ্যকর। এই বৃদ্ধ তার নিজের এক একর জমি খালের জন্য দান করেন। বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বৈপ্লবিক অগ্রগতি সাধনের উপযোগী জিয়ার খালখনন কর্মসূচীর সূচনা এভাবেই। জিয়া উলশী-যদুনাথপুর এলাকাকে ‘সারথী স্বনির্ভর এলাকা’ নাম দিয়েছিলেন।

গ্রাম সরকার 

সরকারের উন্নয়নকে গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা থেকে জিয়াউর রহমান গ্রাম সরকার ব্যবস্তার প্রবর্তন করেন। গ্রাম সরকারের লক্ষ্য কেবল উন্নয়ন ব্যাবস্থানাই ছিল না; বরং নিম্নতম স্তর পর্যন্ত প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের জন্যেও গ্রাম সরকার অপরিহার্য ছিল। গ্রাম সরকার পরিকল্পনার অধীনেই বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) ১৯৭৭ সাল থেকে ভূমিহীন নারী ও পুরুষদের সংগঠিত করতে শুরু করে। ১৯৮০ সালের ৩০ মে সাভারের জিরাবো গ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়া সর্বপ্রথম গ্রাম সরকারের উদ্বোধন করেন। ১৯৮১ সালে ৭ জানুয়ারি ঢাকায় স্বনির্ভর গ্রাম সরকার প্রধানদের নিয়ে তিনি একটি কনভেনশনের আয়োজন করেন। কনভেনশনে তিনি বলেন, ‘গ্রাম সরকারদের দিয়েই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।’ এই কনভেনশনে তিনি গ্রাম সরকারগুলোর জন্য পঞ্চবার্ষিক পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, সরকারি খাস জমিতে ফলের গাছ রোপণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ সহ বিশটি কাজের একটি তালিকা দেন।

তৈরি পোশাক শিল্প খাত 

বাংলাদেশের জিডিপিতে দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে তৈরি পোশাক শিল্প খাত। এ শিল্পের ভীত এবং মূল মানবসম্পদের ভীত গড়ে দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৮ সালের ৪ জুলাই অধুনালুপ্ত দক্ষিণ কোরীয় শিল্প গ্রুপ দেইউ-এর সাথে যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে দেশ গার্মেন্টস স্থাপনের চুক্তি করা হয়। এরপর ১৩০ জন তরুণ-তরুণিকে তৈরি পোশাক প্রস্তুতের উপর হাতেকলমে প্রশিক্ষণের জন্যে দক্ষিণ কোরীয়ার পুসানে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রা সূচিত হয়। তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশের জন্য স্পেশাল বন্ডেড ওয়্যারহাউজের প্রয়োজন ছিল। ১৯৭৮ সালে জিয়ার শাসনামলেই এই স্কিম চালু হয়। এটি চালু করার ফলে রফতানিকারকেরা সরাসরি শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুযোগ পায়।

জনশক্তি রফতানি 

বাংলাদেশের জিডিপিতে অবদান রেখে চলেছে এরকম আরেওটি বড় খাত হচ্ছে রেমিট্যান্স। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাত ধরেই এর শুভ সূচনা ঘটে। দেশের কর্মক্ষম যুবকদের চাহিদা পূরণের জন্য তিনি দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ৬০৭৮ জন বিদেশে চাকরির উদ্দেশ্যে গমন করে। সেই থেকে এই ধারা ক্রমবর্ধমান আকারে অব্যহত রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি এই খাতের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল।

ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে প্রণোদনা 

দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প এখন বাংলাদেশ ছাড়িয়ে সমগ্র বিশ্বেই সমাদৃত। এ প্রকল্পের কারণে ড. ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার অর্জনে করেছেন, যা আন্তর্জাতিক দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার পেছনে চাপা পড়ে আছে জিয়ার অবদান। ১৯৭৬ সালে হাঠাজারির জোবরা গ্রামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক ড. ইউনুস পল্লী ব্যাংকিংয়ের একটি মাঠ পর্যায়ের গবেষণা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, প্রান্তিক জনগণের মাঝে জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা প্রণয়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। পাইলট প্রকল্পটি সফল হবার পর বৃহৎ পরিসরে চালু করার ক্ষেত্রে বড় ফান্ডের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ সমস্যা নিরসনে তখন এগিয়ে আসেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তার নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফান্ডের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। প্রাপ্ত ফান্ড ব্যবহার করে ড. ইউনুস চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইলে সফলভাবে প্রকল্প সম্পন্ন করেন। এরপরে আর তাকে পেছনে তাকাতে হয় নি। সে সময়ে উদ্যোক্তাদেরকে সরকারি ফান্ড থেকে টাকা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেকের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সম্ভাবনা বিচারে জিয়া ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন।

নোবেল পুরষ্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ জন ক্যানেথ গ্যালব্রেইথ (১৯০৮-২০০৬) বলেন, ‘In economics, hope and faith coexist with great scientific pretension and also a desire for responsibility.’ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জিয়াউর রহমানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চিন্তায় এর প্রতিফলন সুস্পষ্ট। জিয়া তার যুগান্তকারি ১৯-দফা কর্মসূচীতে বাংলাদেশ নিয়ে তার যে চিন্তা ও চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, আজ অবধি বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার মূলে তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একটি তলাবিহীন ঝুড়ি উপাধি পাওয়া দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রয়োজন ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়া তা ধারণ করতেন। তারই দেখিয়ে যাওয়া পথ ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতিতে জোর দিয়ে এসেছে এবং আগামীতেও এ ধারা অব্যহত রাখবে বলেই জাতি প্রত্যাশা করে।

 

লেখক —  সদস্য, আহ্বায়ক কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Monday, May 30, 2022

শহিদ জিয়ার অনন্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা

প্রফেসর মোর্শেদ হাসান খান ও খান মো. মনোয়ারুল ইসলাম

 



জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশকটি ছিল অভাবিত ঘটনাবহুল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতার পটভূমিতে ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয় দেশ। রাষ্ট্র পরিচালনায় সামগ্রিক ব্যর্থতা ঢাকতে ১৯৭৫ সালে ২৫শে জানুয়ারি বাকশাল গঠনের মাধ্যমে রাজনীতিতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার পালাবদলের পথ রুদ্ধ করা হয়। এইরকম রুদ্ধশ্বাস পটভূমিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ঘটনার পরম্পরা সিপাহী-জনতা ৭ই নভেম্বর শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রের পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে। পরম্পরার ধারাবাহিকতাতেই ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হন শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে এসে তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বজনগ্রাহ্য দার্শনিক ভিত্তি ‘ জাতীয়তাবাদ’ যেমন প্রবর্তন করেন তেমনি উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির সূচনা করে দেশের সর্বস্তরে অভূতপূর্ব প্রাণের সঞ্চার করেন। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালনকালে দেশের সর্বত্রই শুধু অভূতপূর্ব কর্ম উদ্দীপনার মন্ত্র দিয়ে নয় বরং নিজেই কর্মী হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতার প্রথম দশকের প্রথম সাড়ে তিন বছর যেমন হতাশার তেমনি প্রথম দশকের শেষ চার বছর আশাবাদী হওয়ার পর্ব। এই পর্বে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি যেমন দাঁড় করিয়েছেন তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন দেশের উন্নয়নের রাজনীতির সূচনা করেন।পররাষ্ট্র নীতিতে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান শহিদ জিয়া। দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্ব শক্তিশালী আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ গঠনে বিপুল এ কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে ব্যক্তিগত সততা ও কর্মউদ্যোগকে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এমন অনন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই উচ্চতায় স্বাধীনতার ৫০ বছরে কেউ পৌঁছাতে পারেনি। এজন্যই অনন্য শহিদ জিয়া এখনও প্রাসঙ্গিক।

 

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ: রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৫ কালপর্বে বাংলাদেশের জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মোড়কে পরিচিত করিয়ে দেয়ার প্রয়াস আমাদের জাতীয়তার পরিচয়কে পূর্ণতা দিতে পারেনি। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নবীন রাষ্ট্রের জনগণের জন্য  জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করে রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি দাঁড় করান।  জাতীয়তাবাদ বর্ণ,ভাষা,ধর্ম, ভৌগলিক অঞ্চল,অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা প্রত্যেকটি উপাদানকে প্রতিনিধিত্ব করে। এই জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্য ছিল সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহকে একটি অভিন্ন পরিচয়ে নিয়ে আসা। তাই বর্ণ, ভাষা ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধকে অস্বীকার করার মাধ্যমে ‘ জাতীয়তাবাদ’ রাষ্ট্রের সার্বিক পরিচয়কে প্রতিনিধিত্ব করে।

 

উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির পথপ্রদর্শক

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ‘সমাজতন্ত্র' থাকলেও কুশাসন, শোষণ, নিষ্পেষণে জনজীবনে দারিদ্র্য,অশিক্ষা ও অপুষ্টির অভিশাপের মতো বিরাজমান থাকায় শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সমাজতন্ত্রে’র পরিবর্তে সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্রের মধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির সূচনা করেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি বৈপ্লবিক ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

তিনি কৃষি প্রধান বাংলাদেশকে চিনেছিলেন হৃদয়ের মমতা দিয়ে,তাই গ্রামকে কেন্দ্র করে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবী কর্মসূচিতে পাঁচ বছরে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে দেড় বছরে স্বেচছাশ্রমের ভিত্তিতে ১২০০ খাল খনন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। বিপুল সংখ্যক জনগণকে গনশিক্ষার আওতায় আনা হয়। গ্রামে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনে বিপ্লবের সূচনা হয়। গ্রামে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টিতে ৬৫, ০০০ গ্রাম সরকার সৃষ্টি করা হয়। গ্রামের জনগণকে চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে অতি অল্প সময়ে ২৭, ০০০ পল্লী চিকিৎসক তৈরি করা হয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ সবকিছুই করা হয় শান্তিপূর্ণ বিপ্লবী কর্মসূচির আওতায়। এ কর্মসূচী বাস্তবায়নে প্রয়োজন ছিল বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শান্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা । শহিদ জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পূন: প্রবর্তনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের ধাঁচে দেশ গঠনের লক্ষ্যে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির সূচনা করেন। উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতিতে তিনি কর্মসূচি দিয়ে বসে না থেকে, কারো উপর নির্ভর না করে, নিজ কর্মউদ্যোগকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে নিজে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন। আর স্বল্পকালীন রাজনৈতিক জীবনে ৫, ০০০ জনসভা কর্মীসভা ও সমাজ গঠন মূলক সভা করেছিলেন । এ সময় তিনি দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলের প্রায় সব গ্রামে গিয়েছেন। এধরনের সফরে কোনো সার্কিট হাউসে অবস্থান করলে পকেট থেকে বিধি অনুযায়ী ভাড়া পরিশোধ করে বিস্ময়কর নজির স্থাপন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

 

পররাষ্ট্রনীতিতে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রজ্ঞা

শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পররাষ্ট্রনীতিতে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রাখেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দক্ষিণ, মধ্য ও বামপন্থী সব ধরনের মতাদর্শের অনুসারীদের মধ্য থেকে বন্ধু জুটিয়ে কার্যকর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রকে মজবুত ভিত্তিতে স্থাপন করেন । তিনি বাংলাদেশকে ভারত-সোভিয়েত বলয় থেকে বের করে পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সম্পর্কে বৈরী পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে বন্ধুতে পরিণত করতে সক্ষম হন শহিদ জিয়া ।তিনি মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের নতুন অবস্থান সৃষ্টিতে সফল হন । আরব ও অনারব সব মুসলিম দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হন জিয়া। আল-কুদস কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ। এই ভূমিকায় সফলতার পটভূমিতেই মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানির দুয়ার খুলে যায় দেশের জন্য। এছাড়া পররাষ্ট্রনীতিতে সবচেয়ে সম্মানজনক ও আলোচিত উদ্যোগ ইরাক ও ইরান সংঘর্ষের সমাধানকল্পে ওআইসি গৃহীত উদ্যোগে মধ্যস্থতার দায়িত্ব পালন করেন শহিদ জিয়া ।

 

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করার পাশাপাশি আঞ্চলিক পর্যায়ে সার্ক গঠনের উদ্যোগ নেন শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান । তাঁর জীবদ্দশাতেই সার্ক গঠনের লক্ষ্যে পররাষ্ট্র সচিবদের প্রথম বৈঠকটি হয় কলম্বোয় এপ্রিল, ১৯৮১তে । ১৯৮৫তে ঢাকায় সার্কের যাত্রা শুরু হয়েছিল ।

 

আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বাংলাদেশকে সম্মানজনক পর্যায় উপনীত করার লক্ষ্যে তিনি বহুবার বিদেশ সফর করেন এবং বহু বিদেশি অতিথিদের স্বাগত জানান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ফোরামে-জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ন্যাম,জি-৭৭, ওআইসি-তে তিনি বাংলাদেশের দৃশ্যমান উপস্থিতি নিশ্চিত করেন।

ব্যক্তিগত সততায় অনন্য

ব্যক্তি শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সততা ও কর্মেও অতুলনীয় প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার পারিবারিক অন্তরঙ্গ ঘরোয়া জীবন, আত্মীয়-স্বজন এসব ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন, কৌতুহল পছন্দ করতেন না। আত্মীয়-স্বজন পারতপক্ষে তার বাসায় যেতেন না বিশেষ উপলক্ষে অথবা পার্বণ ছাড়া; কারণ জিয়া বিব্রত বোধ করতেন। এদিকে তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনও তার সঙ্গ এড়িয়ে চলতেন পাশে কেউ মনে করে প্রেসিডেন্টের আত্মীয় হিসেবে তারা কোনো সুযোগ নিচ্ছেন। জিয়াও ব্যক্তিগতভাবে এমনটি চাইতেন।

জিয়া বাইরে খুব টিপটপ থাকতেন।কিন্তু ঘরে একেবারে সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। কাজের ফাঁকে বঙ্গভবনে কখনো বিশ্রাম নিলে পরতেন-অনেকবার রিপু করা, তালি দেওয়া একটি হালকা প্রিন্টের পাজামা, একটি বারবার সেলাই করা ঢিলে শার্ট। ঘরে জিয়ার বসন-ভূষণ সম্পর্কে জানা যায় তারেক রহমান পিনুর লেখায়। ১৯৮১ সালের মাসিক শিশু এর মে-জুন সংখ্যায় ‘আমার আব্বু' শিরোনামে একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন-

“আব্বু সাদাসিধে জীবন কাটাতে ভালোবাসতেন। আমরাও কোনোদিন কোনো দামি জামা কাপড় জুতা ব্যবহার করিনি। কেউ আমাদের কোনো জিনিস দিলে আব্বু তা পছন্দ করতেন না। তিনি নিজেও কারো কাছ থেকে কোন উপহার নিতেন না। সেজন্য আমাদের আত্মীয় স্বজন আমাদের কোনো কিছু উপহার দিতে সাহস করতেন না।.. আব্বু আম্মু আর আমরা দুভাই সাধারণ খাবার খেতাম। খুব সাধারন পোষাক পরতাম। আব্বুর ব্যবহার করা প্যান্ট বা শার্ট আব্বুর ছোট বড় হলে সেগুলো কেটে আমাদের গাঁয়ের মাপে দরজি জামা প্যান্ট তৈরি করে দিত। আমাদের বাড়ির খাবার-দাবার ছিল সাধারণ। অনেক বন্ধুর বাড়িতে দেখেছি তারা কত রকম খাবার খায়। কিন্তু আমরা সেই রকম খাবার খেতাম না। কারণ খাবারে বেশি বিলাসিতা আব্বু পছন্দ করতেন না।...”

পৃথিবীর বহু দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে গেছেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। প্রচলিত রীতি রেওয়াজ অনুযায়ী এসব দেশ থেকে প্রীতি-শুভেচ্ছা-সৌজন্যের নিদর্শন হিসেবে বহু উপহার পেয়েছেন। তিনি উপহারগুলো জমা দিয়েছেন বঙ্গভবনের তোষাখানায়। পাকিস্তান থেকে আগত তাঁর একবন্ধু একটি কুর্তা উপহার দিয়েছিলেন, সেটাও জমা দিয়েছেন তোষাখানায়। ইরানের সাবেক সম্রাজ্ঞি ফারাহ দিবা বেগম খালেদা জিয়াকে ব্যক্তিগত উপহার হিসেবে ফিরোজা পাথর বসানো একটি আংটি উপহার দিয়েছিলেন, সেই আংটিটি জমা রয়েছে তোষাখানায় । জিয়ার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল-এগুলো সব রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ;তাই এগুলো তোষাখানায় জমা দেওয়া হয়েছে ।

শহিদ জিয়ার খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে একজন সাংবাদিক বলছেন ‘সংযমের এবং স্বল্প খরচের এক নিদর্শন’। এক পেয়ালা চা এবং কখনও কখনও সাধারণ কিছু বিস্কিট এগুলো ছিল রুটিন আপ্যায়নের সামগ্রী। বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার খাবারের আমন্ত্রণকে অনেকেই “পানিশমেন্ট ফুড” হিসেবে বিবেচনা করতেন। মোটা চালের ভাতের সঙ্গে সবজি,ডাল, মাছ অথবা মাংস যেকোনো একটি । মাছ এবং মাংস একই সঙ্গে পরিবেশিত হলে তিনি রেগে যেতেন।

অনন্য শহিদ জিয়া এখনও সমান প্রাসঙ্গিক

বাংলাদেশের ইতিহাস শহিদ জিয়াকে কিভাবে স্মরণ করবে? সেই মূল্যায়নের সঠিক সময় সম্ভবত এখনো আসেনি। একটি নবীন রাষ্ট্রের পথচলার শুরু হয় নেতৃত্বে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ ধরে । নেতা পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বের দুর্বলতায় সে স্বপ্ন ফিকে হয়েছিল । সেই ফিকে স্বপ্নকে রঙিন স্বপ্নে পরিণত করেছিলেন শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার নিজস্ব ক্যারিশমায় । একটি নবীন দেশে রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি স্থাপনে, উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির পথপ্রদর্শক হিসেবে অন্তরীণ ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হন শহিদ জিয়া । তাঁর সময়েই পররাষ্ট্রনীতিতে সাফল্যের ধারাবাহিকতাতেই বহির্বিশ্বে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়ায় । তাঁর ব্যক্তিগত সততা ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন বিপুল সংখ্যক মানুষকে মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল নিঃসন্দেহে । আসলে মাত্র সাড়ে চার বছরে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যা করে দেখিয়েছেন সেটা বিগত ৫০ বছরে কেউ পারেনি। তাইতো শহিদ জিয়া আজও সমান প্রাসঙ্গিক।


Tuesday, April 26, 2022

শিশুদের উপর দারিদ্রতার কষাঘাত, অন্ধকার জাতির ভবিষ্যৎ

—  মুহম্মদ মাহাথির


কবি গোলাম মোস্তফার ‘কিশোর’ কবিতার ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’ লাইনটি  বিখ্যাত হয়ে আছে, যা বোঝাচ্ছে, শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। তাই আজকের শিশুর সঠিক ও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার ওপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যত। দুঃখজনক হলেও সত্য দেশে বিদ্যমান দারিদ্রতার কষাঘাতে জীবনের শুরুতেই থেমে যাচ্ছে অনেক শিশুর সঠিক বিকাশ।  

শনিবার,  জানুয়ারি ২২, ২০২২,  ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘শিশুশ্রম নিরসনে ট্রেড ইউনিয়ন ও গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক মতবিনিময়সভায় জানানো হয় দেশে প্রায় অর্ধকোটি শিশু শ্রমিক রয়েছে। প্রতিদিনই এই সংখ্যা বেড়ে চলেছে। 

দেশের খাবারের হোটেলে, পরিবহণে, কৃষিকাজে, কলকারখানায়, হাটবাজারে, রাস্তাঘাটে অগণিত শিশুদের নানা রকম অমানবিক কাজ করতে দেখা যায়। অসংখ্য শিশু ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত। অথচ এই সময়ে তাদের থাকার কথা ছিল বিদ্যালয়ে পড়ালেখায়, পরিবারে আদর স্নেহে। 

সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত দুইটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে বর্তমানে শিশুদের কী করুণ অবস্থা। 

রান্নাঘরের খুঁটির সঙ্গে শিশু সিমন হোসেনের পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সামনে সিমনের ভাই ইবল ও বোন আমবিয়া। বদরগঞ্জ পৌরসভার পকিহানা গ্রামের রেলবস্তির
ছবি: প্রথম আলো


এপ্রিল ২৫, ২০২২, বদরগঞ্জ, রংপুর থেকে আলতাফ হোসেনের লেখা ‘প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে খাবার চায় শিশু দুটি, তাই শিকলে বেঁধে রাখছেন মা–বাবা’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রংপুরের বদরগঞ্জ পৌরসভার পকিহানা গ্রামের রেলবস্তির দুই শিশু সহোদর সুমন হোসেন, ১০ ও সিমন হোসেন, ৮, কে যথাক্রমে ছয়মাস ও ১৫ দিন ধরে পায়ে শিকল লাগিয়ে রেখেছে তাদের মা। 

দরিদ্র ওই পরিবারের সদস্যদের অনাহারে–অর্ধাহারে দিন কাটে। ক্ষুধার জ্বালায় সুমন ও সিমন বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে খাবার চায়, কখনোবা গোপনে গাছের ফল ছিঁড়ে নিয়ে আসে। এসব কারণে প্রতিবেশীদের কথা শুনতে হয় তাঁদের মা–বাবাকে। তাই এই ব্যবস্থা। 

চাল কিনবে বলে শাকের আঁটি বিক্রি করতে বের হয় পাঁচ বছরের আরিয়ান
ছবি: প্রথম আলো


বাগেরহাট থেকে সরদার ইনজামামুল হকের ‘চাল কিনবে বলে শাক বেচতে বের হয়েছে ছোট্ট আরিয়ান’ হেডলাইনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শিশু আরিয়ানের কথা যে অনাহারের থাকা মায়ের জন্য চাল কিনবে বলে রাস্তার ধার থেকে শাক কুড়িয়ে কয়েক মাইল হেঁটে যায় বাগেরহাট শহরে। সে নিজেও ছিল ক্ষুধার্ত।  

শুধু আরিয়ান, সুমন ও সিমনই নয় দেশের প্রতিটি জনপদে অগণিত শিশুর জীবন দারিদ্রতার কঠিন আঘাতে তছনছ। খাবারের অভাবে পুষ্টিহীনভাবে বেড়ে উঠছে তারা। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে থাকছে নিরক্ষর। ফলে তৈরি হচ্ছে এক বিশাল অদক্ষ ও অসুস্থ জনগোষ্ঠী। এদের অনেকেই সমাজে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। দক্ষতার অভাবে ভালো কোন কাজ এরা পায় না। দারিদ্রতার দুষ্টচক্রে বাধা পড়ছে এরা। 

বর্তমান অবৈধ সরকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিশুদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার কোন ব্যবস্থা করেনি। 

জনগণের ভোটে নির্বাচিত দক্ষ সরকার ও ভিশনারি নেতৃত্বই একমাত্র পারবে শিশুদের জন্য একটি সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে। 

টেইক ব্যাক বাংলাদেশ।

Saturday, April 23, 2022

নিরীহ সন্তান হত্যার বিচার চায় না কেন পরিবার?

তারিক চয়ন

 


ঘটনা এক

গত ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় দুর্বৃত্তের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু। ওই সময় টিপুর গাড়ির পাশেই যানজটের কারণে সড়কে আটকা পড়েছিল বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরিন প্রীতি, ১৯ এবং তার বান্ধবী সুমাইয়াদের বহনকারী রিকশা। গুলি এসে লাগে রিকশায় বসে থাকা প্রীতির শরীরেও। টিপুর গাড়িচালক মনির হোসেন মুন্নাও গুলিতে আহত হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, মেয়েকে হারিয়ে প্রীতিদের শান্তিবাগের বাসায় শোকের মাতম চলছিল। শোকার্ত মা হোসনে আরা শুধু বলছিলেন, "বিচার চাই না। শুধু মেয়ের লাশ পৌঁছে দিলেই হবে।" আর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে প্রীতির বাবা জামাল উদ্দিন বলেছিলেন, "একজনকে মারতে গিয়ে আমার মেয়ের শরীরে গুলি লেগেছে।

সন্তানের এমন মৃত্যু কোনো বাবা-মা চান না। আমি তো মেয়ে হারিয়েছি। সম্পদ গেলে সম্পদ ফিরে পাওয়া যায়, কিন্তু কোনো প্রাণ গেলে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না। আমি কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাই না... মেয়ে হত্যার বিচার চাই না। মামলা চালানোর মতো অবস্থাও নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। বিচার চাইলে আল্লাহর কাছে চাই।" এমনকি মেয়ে হত্যার শাস্তি চাইতে গিয়ে 'বিবাদে'ও জড়াতে চান না বলে জানান তিনি, "কার শাস্তি চাইব? আমি তো কাউকে চিনি না, জানি না কে আমার মেয়েকে মেরেছে। কোনো বিবাদে জড়াতে চাই না।"

ঘটনা দুই 

গত পহেলা এপ্রিল রাতে খিলগাঁও তিলপাপাড়া এলাকায় স্বামীর সাথে মোটরসাইকেলে করে বাসায় ফিরছিলেন ২০ বছর বয়সী গৃহবধূ নাসরিন খানম। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি তাদের মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দিলে নাসরিন পড়ে যান এবং তার মৃত্যু হয়।

পরদিন চ্যানেল আইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহত নাসরিনের পরিবারের পক্ষ থেকে জিডি করা হলেও কোন মামলা করা হয়নি। ঘটনার পর গাড়িচালক বকুল মিয়াকে আটক করা হলেও নিহতের পরিবার থেকে কোন মামলা না করায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানায় খিলগাঁও থানা পুলিশ। নাসরিনের স্বামী মোঃ শামীম জানান, বিচার পাবেন না বলে তারা বিচার চান না। শামীম বলেন, "দেশের ভেতর কতো কী ঘটছে! কেউ পেরেছে? কোনকিছুই হয় নাই। আপনারা সংবাদ (প্রচার) করবেন, জনগণকে জানাবেন। পুলিশ কিছুই করবে না। দেশ দেশ নিয়েই থাকবে। এই আইন আমাদেরকে শেখাবেন না।"

ঘটনা তিন

গত ১৯ এপ্রিল সকালে কামরাঙ্গীরচরের বাসা থেকে বের হয়ে নিউমার্কেট হয়ে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নাহিদ হোসেন, ২০। কিন্তু, নুরজাহান মার্কেটের সামনে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও দোকান কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুরুতর আহত হন তিনি। এরপর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ওইদিন রাতেই তার মৃত্যু হয়।

নিজ পরিবারকে নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে বসবাস করতেন এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের একটি কম্পিউটার সরঞ্জামের দোকানে ডেলিভারিম্যান হিসেবে কর্মরত নাহিদ।

নিহত নাহিদের রোজগার দিয়েই চলতো ছয়জনের পরিবারটি।

তার ছেলে বিবাদমান কোন পক্ষের লোক ছিলেন না জানিয়ে নাহিদের বাবা বলেন, "আমরা নিরীহ মানুষ। কারও সঙ্গে ঝামেলার মধ্যে নেই। কে মারল, কেন মারল আমার ছেলেকে। ওর তো কোনো অপরাধ নেই। কারও কাছে বিচার চাই না। বিচার চেয়ে কী হবে? কার কাছে বিচার চাইবো? মামলাও করতে চাই না। এটাই তো কপালে লেখা ছিল... শুনেছি অনেকে মিলে ওকে বেদম পিটিয়েছে। ওতো কোনো পক্ষের লোক না। নিউমার্কেটের হকারও না, কলেজের ছাত্রও না।" বিচার চাইলেও বিচার পাবেন না মন্তব্য করে ছেলেহারা শোকাহত মা নার্গিস বলেন, "আমরা বিচার চাই না। নাহিদকেতো ফেরত পাবো না। বিচার চেয়ে কী হবে? বিচার চাইলেই তো আর বিচার পাব না। আমার ঘর-সংসার কীভাবে চলবে?"

উপরের তিনটি ঘটনার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে প্রত্যেকটি ঘটনার ক্ষেত্রেই দুটি মিল রয়েছে। প্রথমতঃ নিহত নাসরিন, প্রীতি এবং নাহিদ প্রত্যেকেই নিরীহ ছিলেন। যেসব ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে সেসবের সাথে তাদের দূরতমও কোন সম্পর্ক ছিল না। তারা নিতান্তই ভুক্তভোগী। দ্বিতীয়তঃ নাসরিন, প্রীতি এবং নাহিদ প্রত্যেকেই নিজ নিজ পরিবারে ছিলেন আদরের সন্তান। কিন্তু নিহত প্রিয়জন নিরীহ ছিলেন জেনেও তাদের পরিবার তাদের হত্যার কোন বিচার চাইছেন না!

খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, যারা তাদের নিরীহ প্রিয়জনকে হত্যার বিচার চান না, তাদের মনে কি তবে এমন ধারণা জন্মেছে যে, বিচার চেয়ে কোন লাভ নেই? কিংবা বিচার হলেও সেটা ‘ন্যায়বিচার’ হবে না? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই এমন প্রশ্ন রাখছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, "বিচার না পাওয়ার চেয়েও বিচার না চাওয়ার সংস্কৃতি অধিক আশংকাজনক!"

প্রীতি হত্যার পর বিবিসির সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ২৬ মার্চ লিখেছিলেন, "ঢাকার রাস্তায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুজন নিহত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এতে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। এরকম হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর সব শহরে প্রতিদিনই হচ্ছে। কিন্তু আমি উদ্বিগ্ন অন্য একটি কারণে। হত্যাকাণ্ডের পর নিহত মেয়েটির মা বলেছেন তিনি লাশ ফেরত চান, বিচার চান না। পিতা বলেছেন আমি বিচার চাই না, কার কাছে চাইবো। বুঝতে পারছেন গত ৫০ বছরে আমরা কেমন রাষ্ট্র তৈরি করেছি! সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।"

আমিনুল ইসলাম নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছিলেন, "একজন পিতার নিরপরাধ মেয়েকে খুন করা হয়েছে। অসহায় পিতা দুনিয়াতে বিচার না চেয়ে আখেরাতে বিচার চাচ্ছেন। এ যেনো এক নীরব প্রতিবাদ।"

বিঃদ্রঃ এই প্রতিবেদনটি যখন লেখা হচ্ছিল তখনই খবর প্রকাশিত হয় যে, নিউ মার্কেটে ব্যবসায়ী এবং ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় মুরসালিন নামে আরও একজন দোকান কর্মচারীর মৃত্যু হয়েছে।

—  মানবজমিন 

গণতন্ত্র অথবা স্বৈরতন্ত্র কোন পক্ষে জার্মানি? — মুহম্মদ মাহাথির

  — মুহম্মদ মাহাথির




বাংলাদেশে জার্মান অ্যাম্বাসেডর আখিম ট্র্যোস্টার বুধবার, এপ্রিল ২০, ২০২২, ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ-ডিক্যাব আয়োজিত ’ডিক্যাব টকে’ জানিয়েছেন যে বিএনপি তার বক্তব্যের ‘মিস কোট’ করেছে। এতে তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।  

অথচ জার্মান অ্যাম্বাসেডর’র এই বক্তব্যের কোন সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং বলা যায় তিনি বিএনপি নেতাদের ‘মিস কোট’ করেছেন।   

বৃহস্পতিবার, মার্চ ১৭, ২০২২, গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সন’র কার্যালয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের তিন সদস্যের প্রতিনিধি টিমের সাথে বৈঠক করেন অ্যাম্বাসেডর আখিম ট্র্যোস্টার। 

বিএনপির নেতৃবৃন্দ জার্মান রাষ্ট্রদূতের নাম উল্লেখ করে কোন বক্তব্য দেননি। এক মাসের অধিককাল আগে জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎকার পরবর্তী বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। এই সম্পর্কিত ভিডিয়োও ইন্টারনেটে রয়েছে।  সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে বিএনপির নেতৃবৃন্দ পরিষ্কার বলেছেন যে বিশ্বের বিভিন্ন গণতন্ত্রে এবং মানবাধিকারে বিশ্বাসী শক্তিগুলো বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে অবগত আছেন।  

সেই বৈঠক শেষে বিএনপির জাতীয় স্থায়ীকমিটির সদস্য ও ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, তাদের আলোচনায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে জার্মান রাষ্ট্রদূত কী বলেছেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সবাই অবগত আছেন। এখানে নতুন করে বলার কিছু নেই। এগুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনাও হচ্ছে এটা তো আপনারা জানেন। এসব ব্যাপারে ওনারা কনসার্ন। বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আলোচনা হচ্ছে, ওনারা তো তার একটা অংশ। ইউরোপিয় ইউনিয়ন বলেছে, আমেরিকা বলছে, ব্রিটেন বলেছে, সবাই বলছে।

বাংলাদেশের প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাধারণত তথ্যভিত্তিক বক্তব্য প্রদান করেন। একজন অ্যাম্বাসেডরের কাজের চৌহদ্দি সম্পর্কে তিনি ভালোভাবে অবগত। সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে তার সেই অভিজ্ঞানও সুস্পষ্ট। এখানে তিনি জার্মান অ্যাম্বাসেডরকে মোটেও কোট করেননি। দায়িত্বশীলতার সাথে একটি সাধারণ বক্তব্য দিয়েছিলেন। 

বরং এক মাস আগের একটা বৈঠক সম্পর্কে, একটা না বলা কথাকে এখন হঠাৎ করে কেন জার্মান রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে সামনে আনা হল, তা সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে আদৌ পরিষ্কার নয়। এই ব্যাপারে জার্মান রাষ্ট্রদূতের কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়লে বিএনপির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সেটা করা যেত।  ভোটাধিকার ও মানবাধিকার ফিরিয়ে আনার কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত বাংলাদেশিরা জার্মান অ্যাম্বাসেডরের এমন বক্তব্যে হতাশ হয়েছেন।  

বিএনপি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল, যার প্রতিষ্ঠাতা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম শুধু বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষকই নন, তিনি বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁকে বলা হয় আধুনিক বাংলাদেশের আর্কিটেক্ট। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জনগণের কল্যাণে ব্যাপক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। 

এক যুগধরে বিএনপি এই দেশের হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে নিবেদিত,  বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে অনবরত লড়াই করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিএনপির হাজারো সমর্থক-নেতা-কর্মী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। পঁয়ত্রিশ লাখ সমর্থক-নেতা-কর্মী হয়তো কারাবন্দি আছেন নতুবা আদালত প্রাঙণে নিত্য হাজির থাকছেন। জার্মান অ্যাম্বাসেডর নিশ্চয় সেই খবর রাখেন।  

বিএনপি সবসময় গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারে বিশ্বাসী দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে এবং সামনের দিনেও তাই করে যাবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন পক্ষ থেকে যে স্পষ্ট ও কার্যকর সমর্থন দেখা যাচ্ছে, বিএনপি দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মতই সেগুলোকে স্বাগত জানায়।  

জার্মানি বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক শক্তি। বিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামনের কাতারেই থাকছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশিরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছে বাংলাদেশে লুটে নেয়া গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ফিরিয়ে আনার পক্ষে অনুপস্থিত বর্তমান ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাস। বাংলাদেশে অব্যাহত গুম-খুন-গ্রেপ্তার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে নিরব তারা। বাংলাদেশে মানবাধিকার ও ভোটাধিকারের অনুপস্থিতি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশে তারা যেনো কুণ্ঠিত! বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দল বিএনপির সাথে কথা বলতেও যেনো তারা আড়ষ্ট!

ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাসের প্রতি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনার আহ্বান জানাই।  

এক। 

বিশ্বের নতুন পাঁচ 'স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায়' বাংলাদেশ স্থান করে নিয়েছে। আর ২০১৮-এ সেই তালিকা প্রকাশ করেছে জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'বেরটেলসম্যান স্টিফটুং। 

দুই। 

জার্মানির রাজধানী বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল৷ বাংলাদেশের ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনকে এই সংগঠনটি আখ্যা দিয়েছিল ‘প্রশ্নবিদ্ধ, অভূতপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য' হিসেবে৷ ২৯৯ আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটির ৫০টি আসনের নির্বাচনি প্রক্রিয়ার ওপর এক পরিবীক্ষণের ফলাফলে ৪৭টিতেই ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে সংগঠনটি৷

তিন। 

ইউরোপিয় ইউনিয়নের অন্যতম শক্তিশালী সদস্য জার্মানি অতীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছে৷ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের ‘কিছু এলাকা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে' বলেও মন্তব্য করেছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে৷ 

চার। 

জার্মানির পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান ড. নরবার্ট ব়্যোটগ্যান বাংলাদেশের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির ব্যাপকতা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন৷ তিনি বাংলাদেশ ক্রমশ একদলীয় ব্যবস্থায় পরিণত হচ্ছে বলে মন্তব্য করে এই বিষয়ে সোচ্চার হতে ইউরোপিয় সরকারগুলোর প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন৷ 

পাঁচ।

ডিসেম্বর ১০, ২০২১,  মার্কিন রাজস্ব ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় র‍্যাবসহ এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। 

বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে এমন পরিস্থিতিতে এক লাখ বিছানা চাদর ক্রয়ের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদকে জার্মানি যাওয়ার ভিসা দেয় জার্মান দূতাবাস। অথচ এই ধরনের পণ্য বাংলাদেশেই তৈরি হয় এবং এখন অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে৷ জার্মানিতেও এসব পণ্যের বড় বাজার আছে৷ সমালোচনার মুখে পড়ে এই সফর বাতিল হয়।  

সার্বিক দৃশ্যপট দেখে ওয়াকিবহাল মহলের কাছে মনে হতে পারে ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাসকে কোন কোন মহল বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার রক্ষায় ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও এর অন্যতম নেতা জার্মানি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দেশটি বাংলাদেশেও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেব বলে প্রত্যাশা সবার।     

গণতান্ত্রিক বাংলাদেশই পারবে বিশ্বের সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক ও সম্মানজনক অংশীদারিত্ব রক্ষা করতে, স্বৈরতন্ত্র নয়।   

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পক্ষে অথবা গণতন্ত্রের বিপক্ষে, ইতিহাসে কোন পক্ষে থাকবে জার্মান রাষ্ট্রদূত, সেই দায়িত্ব তার নিজস্ব। 

বাংলাদেশের জনগণ ভোটাধিকার ও মানবাধিকার ফিরিয়ে পাওয়ার সংগ্রাম চালিয়ে যাবে এবং বিজয়ী হবেই। 

—  মন্তব্য লেখকের ব্যক্তিগত। 

Friday, March 18, 2022

মিডিয়া কী অভিশপ্ত?

— শওকত মাহমুদ 




স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সম্মুখবর্তী অবদান। ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু। বায়ান্নর একুশেতে সালাম-বরকতের হত্যাকাণ্ডের প্রথম প্রতিবাদ ‘দৈনিক আজাদ’ সম্পাদক প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের। পরদিন অ্যাসেম্বলি থেকে পদত্যাগ এবং শহিদমিনারের উদ্বোধন করলেন। 

সেদিন ‘আজাদ’-এর ব্যানার হেডলাইন ‘মৃত্যুর জানাজা মোরা কিছুতেই করিব না পাঠ, কবরেরও ঘুম ভাঙে জীবনের দাবি আজ এতই বিরাট’। বার্তা সম্পাদক স্বনামধন্য সন্তোষ গুপ্তের দেওয়া শিরোণাম এটি।

আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে আমাদের পূর্বসূরিরা একটি স্বপ্ন লালন করেছেন —  ‘স্বাধিকার ও স্বাধীনতা’। এটা ছিল তাদের  collective dreaming… ওই মধ্যবিত্ত আলোকিত মানুষগুলো আইয়ুব শাহির ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ ও চৌদ্দই ডিসেম্বর পাকবাহিনী ও তাদের ঘৃণ্য দোসর আলবদর, আলশামসদের খতম-মিশনে ছিল পত্রিকা অফিস, প্রেসক্লাব ও শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকরা।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে এখন দ্বন্দ্বে পড়ে যাই কী পেলাম? গণমাধ্যমে সত্য বলার পরিসর নিয়ে উৎকণ্ঠার কথা বাদই দিলাম। গণমাধ্যম-বিশ্লেষণের কাটাছেঁড়ায় ঢোকাটাই এখন বিপজ্জনক। মিডিয়াকে ঘিরে রাষ্ট্রীয় সম্বন্ধ ও সাংবিধানিক অধিকারের তাৎপর্য ঘোরালো হয়ে গেছে। কালাকানুনের জাঁতাকল, নিষেধাজ্ঞার স্বপ্রণোদিত চর্চা, ‘অন্যরকম’ মালিকানার আছর, দূষিত রাজনীতির বিভাজনের কলকারসাজি, মধ্যবিত্ত সাংবাদিকদের নিম্নবর্গীয় হয়ে যাওয়া বনাম কতিপয় উচ্চপদস্থদের চোখ ধাঁধানো বেতন ও সুবিধাদির গল্প — সব মিলিয়ে এখন মিডিয়া ভুবনে অগাধ ঘটনাবৈচিত্র্য। পুঁজির চালচলনে মিডিয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মোহজালের ব্যাপকতা। দেশের একটি বিত্তবান গ্রুপ তাদের একটি ইংরেজি দৈনিক বন্ধ করে দিলেও কোনো হইচই নেই। পেশাগত মূল্যবোধ ও সত্য প্রকাশের লড়াকু প্রচেষ্টায় অতীতের সাংবাদিকতা যে রকমারি দীপ্তি ছড়িয়েছিল আজ তা ধূসর। দুঃসময় পেরোনোর সাঁকো কোথায়? গণমাধ্যম কি অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে? জনগণের তরফে অভিযোগ মিডিয়া সত্য বলতে চায় না, এড়িয়ে যেতে চায়। বিরোধী দলবিরোধী সাংবাদিকতাই একমাত্র স্বাধীন সাংবাদিকতা। মধ্যপ্রাচ্যে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মালিকানায় শপিং মল আছে। এ গুজব প্রচারে সরকারি চাপ আছে। কিন্তু মিডিয়া এটা যাচাইও করে না অথবা আর কারও সম্পদ সেখানে আছে কিনা, জানতেও চায় না। সরকার বন্দনাই যেন আরাধ্য ও নিত্যকর্ম। দুর্নীতি, অনিয়ম বা কুশাসনের কিছু খবর প্রকাশে মিডিয়া পিছপা হচ্ছে না, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সরকার শুভ্র, ধবল, নিরঞ্জন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে টক শো’র উপস্থাপকেরা নিজেরাই উপসংহার টানেন সরকারের দিকে। দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় উল্লম্ফনে বাজারে ক্রেতাদের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়, ক্ষোভ নয়। কী বলা যাবে এই প্রবণতাকে, in exact science of telling truth? ধরেই নিয়েছি যত দুর্বৃত্তপনা শুধু একপক্ষের, willing suspension of disbelief। 

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের মিডিয়ার সামনে চ্যালেঞ্জগুলো হলো —  

এক। আইনগত প্রতিকূলতা

প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অধ্যাদেশ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, সংবাদপত্র বাতিলকরণ আইনের যে আঘাত স্বাধীনতার ঊষালগ্নে শুরু হয়েছিল, তার রেশে নতুন নতুন কালাকানুনে মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের নেতিবাচক শর্তগুলোই সরকারের প্রিয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর ৭খ, আইসিটি অ্যাক্ট, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, প্রকাশমান প্রবিধানমালা ও সাংবাদিক সুরক্ষা আইন, বিদ্যমান নানা কিসিমের নীতিমালা সাংবাদিকদের প্রান্ত থেকে অন্তে নিয়ে থাকার পরিকল্পিত আয়োজন। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি আবদুল মতিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ হজরত মুসা (আ.)-এর লাঠির মতো, সাপ হয়ে ফেরাউনের জাদুকরদের সাপগুলো যে খেয়ে ফেলেছিল। কিন্তু বাস্তবে এখন ফেরাউনের সাপগুলোই শক্তিশালী মনে হচ্ছে।


দুই। নব্য মালিকসমাজ 

মিডিয়াতে এখন যে নব্য মালিকসমাজ তৈরি হয়েছে, তারা রাজনৈতিকভাবে একদেশদর্শী। তারা জোটবদ্ধ। পাশাপাশি সাংবাদিক নেতাদের মিডিয়া মালিকানায় আনা হয়েছে। এদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচার উপকমিটির সদস্য। আশা করি, তারা সাংবাদিকদের ঠকাবেন না। জরিপে প্রকাশ, অধিকাংশ মিডিয়ার মালিক এখন শাসক দলমুখী। পুরনো মালিকেরাও প্রশাসনের নানা নিপীড়নে তটস্থ। সরকার প্রধানের বাড়িতে বিশেষ বিশেষ কাগজ যায় না বা তাদের প্রতিনিধিরা সরকার প্রধানের অফিসে নিষিদ্ধ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই প্রথম এমনটি হলো যে সরকার প্রধানের সঙ্গে ভিন্নমতি সাংবাদিকদের দেখা বা সংবাদ সম্মেলনে যেতে পারার বিষয়টি বন্ধ। এমনকি সব নজির শিকেয় তুলে তথ্য মন্ত্রণালয় যেসব কমিটি করেছে, যেমন ওয়েজবোর্ড, ওয়েজবোর্ড মনিটরিং কমিটি, কোনোটিতে সরকারবিরোধী সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর কাউকে রাখা হয়নি।

তিন। নতুনরূপে সেন্সরশিপ

আগের নির্বাচিত বা সামরিক সরকারগুলো তথ্য মন্ত্রণালয়ের মারফত প্রেস অ্যাডভাইস দিত, এটা ছাপা বা প্রচার করা যাবে, ওটা যাবে না। এখন সে বালাই-ই নেই। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন মৌখিকভাবে এ কাজ করছে। তারা মিডিয়া মনিটরিং মহাশক্তিশালী করেছে। এটা শুরু হয়েছিল ১/১১ থেকে। সাংবাদিকদের জন্য তাদের নৌ-বিহার বা পিকনিক আয়োজন এখন স্বাভাবিক বিষয়।

চার। আদালতের ভূমিকা

আদালতকে সাংবাদিকরা সংবাদপত্রের বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সহায়ক বলে মনে করেন না। এখন পর্যন্ত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে উচ্চ আদালতের কোনো রায় এসেছে, এমন ঘটনা মনে পড়ে না। মত প্রকাশের জন্য প্রধান বিচারপতি যেখানে লাপাত্তা হন, সেখানে বলার কিছু থাকে না। প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম সাহসী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু দেশীয় আদালতের সহানুভূতি পান নি। একই ঘটনা ফটোগ্রাফার কাজল বা আরও অনেক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও। দীর্ঘ সময় পার হওয়া সত্ত্বেও সাগর-রুনীর হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা হয়নি, আদালত সময় দিয়েই চলেছেন তদন্তকারীদের। ‘আমার দেশ’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আদালত অবমাননার মামলায় আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি বলেছেন, ‘Truth is no defense’। 

পাঁচ। সাংবাদিক নির্যাতন ও সংবাদপত্র দলন

গত এক যুগে কয়েক হাজার সাংবাদিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। বিরোধী দল সমর্থিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের তিন চলতি সভাপতিকে সরকার গ্রেফতার করেছে। কোনো কোনো হিসেবে প্রকাশ, বর্তমান সরকারের আমলে একদিনও যায়নি যেখানে কোনো না কোনো সাংবাদিক অথবা ভিন্নমতের কারণে কেউ জেলে বন্দি ছিলেন না। পাশাপাশি অনেক সংবাদপত্রে ডিক্লারেশন নানা অজুহাতে বাতিল করা হয়েছে। চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত, ইসলামিক টিভি, আমার দেশ বন্ধের সিদ্ধান্ত যেন আমরা মেনে নিয়েছি। এ জন্য সাংবাদিকরা ভীত, সন্ত্রস্ত।

ছয়। প্রাতিষ্ঠানিক দলীয়করণ

প্রেস কাউন্সিল, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, তথ্য কমিশন — এসব সরকারি প্রতিষ্ঠান সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা রাখার তো দূরের কথা, শাসক দলের রাজনৈতিক বিষয়াদি দেখভালই যেন তাদের মুখ্যকর্ম। অন্যদিকে সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো রাজনৈতিক বিভাজন ও নতুন মালিক শ্রেণির নেতিময় উত্থানে নীরব হয়ে গেছে। সম্প্রতি এক পত্রিকা মালিকের লাশ জানাজার জন্য ওই পত্রিকার সাংবাদিকদের আপত্তির কারণে প্রেসক্লাবে আনতে দেওয়া হয়নি। বকেয়া শোধ না করায় প্রতিবাদ ওই পর্যন্তই।

সাত। মন ও জীবিকা  

মিডিয়ার চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম হচ্ছে মন ও জীবিকা — এ দুটি ক্ষেত্রেই সাংবাদিকরা পিছিয়ে গেছেন। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার জন্য সাহিত্য, মূল্যবোধের এবং সুষ্ঠু শিক্ষার যে প্রেক্ষাপটটি গুরুতর প্রয়োজন, তার বোধহয় খামতি আছে। রুখে দাঁড়ানোর চেতনা আর সর্বজনীন নয়। করোনার কারণে তারা আরও গরিব। প্রেসক্লাবে টিসিবির ন্যায্যমূল্যের পণ্যবাহী ট্রাকের সামনে দীর্ঘলাইন। অধিকাংশ পত্রিকায় নিয়মিত বেতন নেই। ভিন্নমতের সাংবাদিকদের দক্ষ যোগ্য, অথচ কোথাও চাকরি পান না রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে। ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু গুণী সাংবাদিকদের বেকারত্ব তীব্র। সরকারি কিছু অনুদান আসে। তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অন্যদিকে সরকার সমর্থিত সাংবাদিকদের মধ্যে আয়ের বৈষম্য তীব্র। উচ্চপদস্থরা অবিশ্বাস্য উচ্চ বেতন-সুবিধা পান, বাকিরা নিদারুণ দুর্দশায়। আবার তরুণ প্রজন্মের নিউজ পরিচালকরা সিনিয়রদের চাকরি দিতে চান না।  তাছাড়া এডিটোরিয়াল ইন্সটিটিউশন দুর্বল হয়ে পড়েছে।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের মিডিয়াকে ‘ন্যাশনাল মিডিয়া’য় পরিণত করতে এবং গণমুখী, স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য সুস্থ গণতন্ত্র প্রয়োজন। সর্বাগ্রে আসবে সহনশীল ও মানুষের অধিকারের প্রতি বিশ্বাসী রাষ্ট্রচালকদের কথা। একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক সরকার আমাদের প্রথম স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা । সে জন্য সরকারের উচিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় মিডিয়া কমিশন গঠন করা। ১৯৮৩ সালে প্রবীণ রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে প্রথম মিডিয়া কমিশন হয়েছিল, যার সুপারিশগুলো ছিল প্রকৃত অর্থে সংবাদপত্রের জন্য কল্যাণকর। নতুন যে কমিশন হবে, তারা গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার আইনগত, পরিবেশগত, মালিকানাগত বিষয়গুলো দেখবে। সাংবাদিকদের  মতপ্রকাশের সাংবিধানিক আজ্ঞা যাচাই করা, ন্যায্য অধিকার নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনাপূর্বক সুপারিশমালা দেওয়া তাদের কাজ হবে। মালিক হওয়ার যাবতীয় যোগ্যতা এবং শুধু ব্যবসায়িক দুর্বৃত্তপনার স্বার্থে টিভি পত্রিকা প্রকাশের দুরভিসন্ধি খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। গণমাধ্যমের জন্য রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য প্রয়োজন। কিন্তু তা যেন কোনোমতেই ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিংয়ের আদর্শে না হয়। শক্তিশালী প্রেস কাউন্সিল এবং অপসাংবাদিকতা রোধের ব্যবস্থাও জরুরি। ভূঁইফোড় সরকারি বিজ্ঞাপন খাওয়ার পত্রিকা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। গণমাধ্যমের মালিকানায় লাইসেন্সিং প্রথার অবসান হওয়া উচিত। তবে যারা মালিক প্রকাশক হবেন, তারা যেন সাংবাদিকদের বেতন ভাতা নিয়মিত দেওয়ার সংস্কৃতি চালু করেন এবং প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলে বিপুল জরিমানার মুখে পড়েন তা নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদপত্রের মালিক মানে মননে স্বপনে ব্যতিক্রমী সত্তা। এসবের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংহতি ও গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় মিডিয়া বিশ্বস্ত সঙ্গী হতে পারবে।



  • লেখক সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও রাজনীতিবিদ 


Monday, February 28, 2022

ভাটির দেশে পানি, গ্যাস,বিদ্যুৎ ও নিত্যপণ্যের দামে নৈরাজ্য এবং জনগণের ‘মুক্তি’র স্বপ্ন!

— 

প্রফেসর মোর্শেদ হাসান খান

খান মো.মনোয়ারুল ইসলাম

 

নদীমাতৃক বাংলাদেশ হলো ভাটির দেশ। ঐতিহাসিকভাবে ভাটি অঞ্চল পরিচিতি লাভ করে সপ্তদশ শতকে। ভাটির বারো ভূঁইয়ারা মোগল আধিপত্যের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। ভাটি অঞ্চলে শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করে মোগল আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল ঈসা খাঁ  ও মুসা খানের নেতৃত্বে বারো ভূঁইয়ারা। বারো ভূঁইয়াদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে সুবাদার ইসলাম খানের সুনিপুণ রণ কৌশলে ১৬১০ সালে। ১৬০৯ সালে রাজমহল থেকে সুবাদার ইসলাম খানের মোঘল বাহিনী ভাটির বারো ভূঁইয়াদের দমনের উদ্দেশ্যে উদ্দেশ্যে যে অভিযান পরিচালনা করেন সেটি সমাপ্ত হয় ১৬১০ সালে ঢাকা জয়ের মাধ্যমে। মোঘল বাহিনী ঢাকা জয়ের সঙ্গে সঙ্গে একে রাজধানী ঘোষণা করে। রাজধানী ঢাকার যাত্রা তখনই। ঐতিহাসিক আব্দুল করিম ভাটির সীমানা নির্দেশ করেছেন-পশ্চিমে ইছামতি, দক্ষিণে গঙ্গা নদী, পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য, উত্তরে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, উত্তর-পূর্ব সিলেটের বানিয়াচং, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা এই বৃহৎ নদী ও তাদের শাখা-প্রশাখা এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ সিলেটের নিয়ে গঠিত। বিস্ময়করভাবে সপ্তদশ শতকের ভাটি অঞ্চলের পুরোটা নিয়েই বিংশ শতকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

ভাটি অঞ্চলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর নদীগুলো জালের মত বিস্তার করে আছে সমগ্র ভূখণ্ডকে। পানির সহজলভ্যতাই এ পাললিক ভূখণ্ডকে অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছে। এই একবিংশ শতকে এসেও পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের চাইতেও প্রকৃতির অপার মহিমায় পানির সহজলভ্যতা এখানকার কৃষি অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনকে করেছে অনন্য।

পানির মূল্য বৃদ্ধিতে নৈরাজ্য




পানির সহজলভ্যতা বাংলাদেশে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনে স্বস্তির অনুষঙ্গ থাকা উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো পানি এখন নাগরিক জীবনে আতঙ্কিত অনুষঙ্গ । ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বিগত ১৩ বছরে ১৪বার পানির দাম বাড়িয়েছে । করোণা মহামারীর মধ্যেও ঢাকা ওয়াসা দুই বছরে পানির দাম বাড়িয়েছে ৩১ শতাংশ। ২০১৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ৫ শতাংশ পানির দাম বৃদ্ধির পরে বিস্ময়করভাবে করোণা মহামারীর মধ্যে ১লা এপ্রিল ২০২০ পানির দাম ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন আইন, ১৯৯৬(২২এর২ ধারা) অনুযায়ী প্রতিবছর সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হারে দাম বাড়ানোর বিধান থাকলেও করোণা মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এদিকে আবার আগামী পহেলা জুলাই থেকে আরেক দফা পানির দাম ৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা  হয়েছে।

পানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা প্রায় ই যুক্তি দেখান পানির উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয় মূল্যের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য দাম বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় খুঁজে পান না বলেই দাম বাড়াতে হয়। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা সরবরাহকৃত পানির ৬৫ শতাংশ গভীর নলকূপ ভূগর্ভস্থ বাকি ৩৫ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পরিশোধন করা। অর্থাৎ মোট পানির বেশিরভাগ অংশই পরিশোধন এর প্রয়োজন হয় না । আবার নগরবাসী ওয়াসার কাছ থেকে যে পানি পায় সেটি প্রায় ক্ষেত্রেই পান উপযোগী নয । টিআইবির তথ্য অনুসারে ঢাকা শহরে ৯১ শতাংশ গ্রাহক পানি ফুটিয়ে পান করেন। এতে ৩২২ কোটি টাকার গ্যাস খরচ হয়। এছাড়া খরচ সমন্বয়ের জন্য দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয় সেটিও জনগনকে ধোকা দেওয়া বৈ আর কিছুই নয়। ঢাকা ওয়াসার ২০২০-২১ অর্থবছরের নিরীক্ষা তথ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় ১৫৯২ কোটি টাকা। এতে পানির বিল ১২০১ কোটি টাকা বাকিটা সুয়ারেজ বিল বাবদ আয়। ট্যাক্সসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ওয়াসার লাভ হয়েছে ৪৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বছর শেষে ওয়াসার সঞ্চিত মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯২ কোটি টাকা। সরকারের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান লাভে থাকার পরও পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জনগণের প্রতি চরম অবিচার ।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে উল্লেখ করা হয়েছে বর্তমানে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান এর বেতন ভাতা মাসে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ২০০৯ সালে এমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া তাকসিম এ খান এর বেতন-ভাতা বেড়েছে ৪২১ শতাংশ ! অথচ ঢাকা ওয়াসার এমডি পদটিতে একজন অতিরিক্ত সচিবকে নিয়োগ দেয়া হলে বছরে অন্তত ৭০ লক্ষ টাকার সাশ্রয় হত। ঢাকা ওয়াসার এমডির বিগত বছরগুলোতে অর্জনটা কি? একই পদে ১৩ বছর দায়িত্ব পালনে জনগণ সুফল তো পাইনি বরং চৌদ্দবার পানির বর্ধিত দাম চুকিয়েছে ! অথচ কানাডার মতো দেশে বিগত ২০ বছরে পানির দাম এক টাকাও বৃদ্ধি পায়নি!

 

বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য: যে তুঘলকীকাণ্ডের শেষ নেই!

ভাটির দেশে পানির মূল্যের নৈরাজ্য সম্পর্কে বলা হলো, এবার সেবা খাতের আরও দুটি বড় অনুষঙ্গ -গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিষয়ে আসা যাক। পানির মতই দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে । আরো একদফা দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগামী মার্চ মাসে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির উপরে গণশুনানির ঘোষণা এসেছে, এরপর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বিষয়েও শুনানি হবে। দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্য কাহিনী কি?

সিপিডির মতে বিদ্যুতের চাহিদা প্রাক্কলনে সরকারের ত্রুটি থাকায় বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতার বিপরীতে চাহিদার বিরাট পার্থক্য তৈরী হয়েছে । ফলে চাহিদা না থাকায় সরকার অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পারছে না কিন্তু ভাড়ার টাকা ঠিকই দিতে হচ্ছে গত এক দশকে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ সরকারের খরচ হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা । কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি আরো পরিস্কার হবে। পিডিবির সূত্র থেকে জানা যায়, ১০০ মেগাওয়াট একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শুধুমাত্র ভাড়া বছরে প্রায় ৯০ কোটি টাকা। এই টাকাটা সরকারকে গুনতে হবে কোনো বিদ্যুৎ না কিনেই। আবার, ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিতে না পারায় মাসে সরকারকে ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৩০ কোটি টাকা। এইযে ভাড়াটা পরিশোধ করতে হচ্ছে এটি কিন্তু প্রতিবছর বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অফ এনার্জি ইকোনমিক্স ফাইনান্সিয়াল এনালাইসিস এর প্রতিবেদন অনুযায়ী গত অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ পিডিবির খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি।

বিদ্যুৎ খাতের এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সূচনা হয়েছিল ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ  সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে। বিদ্যুৎ সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য রাতারাতি টেন্ডার বিহীন কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে । কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্রমগুলোকে নজিরবিহীন দায়মুক্তির ব্যবস্থাও করে সরকার। সমালোচকরা বলেন “সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে লুটপাটের ব্যবস্থা করা”হয় বিদ্যুৎ খাতে। এই কুইক রেন্টালের দায় এখনো বিদ্যুৎ খাত বহন করছে। স্বল্প মেয়াদের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এখনো ৯২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এমন ১২টি স্বল্পমেয়াদী বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু আছে। যেগুলোকে বসিয়ে রেখে সরকার শুধু ভাড়া দিয়ে যাচ্ছে, তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ পর্যন্ত কিনছে না। এমন তুঘলকিকাণ্ড আধুনিক বিশ্বে কোথাও দেখা যাবে কি?

বিদ্যুৎ এর মতই গ্যাস খাতে নৈরাজ্য অবর্ণনীয়। দেশে গত এক যুগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের জোর না দিয়ে বিগত কয়েক বছর আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চড়া দামে এলএনজি আমদানিতে সরকারের অতিরিক্ত আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। পেট্রোবাংলার হিসাব মতে এ বছর মোট সরবরাহকৃত গ্যাসের ৭৩ শতাংশ দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে।এর জন্য পেট্রোবাংলার খরচ হবে ৫ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। আর বাকি ২৭ শতাংশ গ্যাস আসবে আমদানি থেকে যার জন্য খরচ হবে ৪৪ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা । চড়া দামে এলএনজি আমদানিতে সরকারের অতি আগ্রহ প্রকট ভাবে লক্ষ্য করা গেছে। দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় ২০১৯ সাল থেকে দেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ লাখ টন করে এলএনজি সরবরাহ করছে ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল। ২০২০ সালে এ সরবরাহ আরো ১০ লাখ টন বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল কোম্পানিটি। ওই সময়ে প্রস্তাবিত দর ছিল প্রতি এমএমবিটিইউ ৭ থেকে ১০ ডলার করে। বিষয়টি নিয়ে পেট্রোবাংলা খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। দীর্ঘমেয়াদে সরবরাহ নিশ্চিতের পরিবর্তে স্পর্ট থেকেই তাৎক্ষণিক মূল্যে এলএনজি সংগ্রহের পথ বেছে নেয় পেট্রোবাংলা। এটির ভয়াবহ ফলাফল প্রত্যক্ষ করছে দেশ। এই ফেব্রুয়ারিতেই সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সিঙ্গাপুরের ভিটল এশিয়া থেকে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি ক্রয় করার অনুমোদন দিয়েছে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে আরো বেশি দামে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি সংগ্রহ করেছিল বাংলাদেশ। ওই সময়ে ভিটল এশিয়া থেকে প্রতি এমএমবিটিইউ ৩৫ ডলার ৮৯ সেন্টে এলএনজি আমদানি করেছিল পেট্রোবাংলা ।

ওমান ট্রেডিং অর্গানাইজেশন (ওটিআই) এর প্রস্তাব যথাসময়ে গ্রহণ করা হলে এলএনজি সংগ্রহে স্পট মার্কেটের উপর নির্ভরতা অনেকটাই কমে যেত। ইতিমধ্যে করোনা এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন সংকট স্পট মার্কেটকে কোথায় নিয়ে যায় সেটা কেউ বলতে পারে না। তবে এটাতে বোধহয় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা খুব বেশি চিন্তিত নন কারণ তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নন তাই স্পট মার্কেট থেকে অতি উচ্চ মূল্যে এলএনজি ক্রয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নন।

পিডিবি ছাড়া বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে সব প্রতিষ্ঠান মুনাফায় আছে।ঘাটতি মোকাবেলায় প্রতিবছর ভর্তুকি পাচ্ছে পিডিবি। এলএনজি আমদানির জন্য পেট্রোবাংলাকেও ভর্তুকি দেয় সরকার। বিদ্যুৎখাতে ডিপিডিসির গত অর্থবছরের নিট মুনাফা ১০৮ কোটি টাকা। ডেসকোর নিট মুনাফা ৭৩ কোটি টাকা। পল্লী বিদ্যুতের নিট মুনাফা ২০ কোটি টাকা। ওজোপাডিকো নিট মুনাফা ২৪ কোটি টাকা। নেসকোর মুনাফা প্রায় ১৮ কোটি টাকা। গ্যাস খাতে পেট্রোবাংলা গত অর্থবছরে মুনাফা করেছে দুই হাজার কোটি টাকা। তিতাস মুনাফা করেছে ৩৪৬ কোটি টাকা। বাখরাবাদ ১২৬ কোটি, জালালাবাদ ২১৮ কোটি, কর্ণফুলী ৩৫১ কোটি, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি ৬ কোটি এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির মুনাফা ৫৯ কোটি টাকা। এরকম মুনাফার রমরমা অবস্থা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয় কার স্বার্থে? জনগণের স্বার্থে নয় নিশ্চয়ই। এটা পরিষ্কার, সরকারি সেবা খাত সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো শোষণের পথ বেছে নিয়েছে।

 

নিত্যপণ্যের দামে বল্গাহীন গতি



পানি,গ্যাস, বিদ্যুতের মতো সেবা খাতে সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের যে পথ বেছে নিয়েছে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারে ।২০০৯ সালে ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি এখন প্রতারণায় রূপ নিয়েছে। সরকারের অদক্ষতা ও অবহেলায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে বল্গাহীন গতিতে। চাল,ডাল,তেল,আটা-ময়দা,মুরগি,ডিম সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অধিকাংশ সময়ে অযৌক্তিকভাবে বেড়ে চলেছে। আরো বেড়েছে রান্নার গ্যাস, সাবান ও টুথ পেস্টের মতো নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর মূল্য ও। সব মিলিয়ে নিত্যব্যবহার্য পণ্য সামগ্রী ক্রয় করতে সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছে এমন একটি সময় যখন বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস, পিপিআরসি ও সানেম) বলছে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪২ শতাংশ এ পরিণত হয়েছে।

সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসেবে ২০১৯ সালে ৫ লিটার সয়াবিন তেলের মূল্য ছিল ৪৬৫-৫১০ যা ২০২২ সালে বেড়ে ৭৪০-৭৮০ টাকা হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে তুলনায় এখন মোটা চালের দাম সাড়ে৩১, চিনি ১৯, মসুর ডাল ৩০, গুড়া দুধের দাম ১৩ শতাংশ বেড়েছে।

এবারের ভরা মৌসুমেও শীতের সবজির দাম কমেনি, সব ধরনের সবজির দাম ছিল বাড়তি। এরকম পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারের ভূমিকা ছিল নির্বিকার। সরকারিভাবে কম দামে চাল, ডাল, তেল, চিনি বিক্রির কার্যক্রমের পরিসর চাহিদার তুলনায় সীমিত রাখা হয়েছে। অথচ সরকারের চালসহ নিত্য ব্যবহার্য পণ্য বিক্রির ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্রের সামনে সীমিত এর মানুষের ভিড় সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমে বলেছেন টিসিবির পণ্য কিনতে ভালো পোশাক পরা লোকের সমাগম বেড়েছে। বিগত এক বছরে সরকার চাল ও তেলের দাম ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। বাজারে জোর গুজব রয়েছে এসব সিন্ডিকেটের পেছনে ক্ষমতাসীন দলের লোক জড়িত বলে এসব সিন্ডিকেটের ব্যাপারে সরকার নির্বিকার।

বিগত এক দশকে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১২৯ শতাংশ। গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম আরও বাড়ানোর জন্য মার্চ মাসে গণশুনানি হবে। বিগত এক দশকে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১১৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে খুচরা দাম ৯০ শতাংশ বেড়েছে। এখন নতুন করে পাইকারি পর্যায়ে আরো ৬৪ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে ৬৬ থেকে ৭৯ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। বিগত এক দশকে জ্বালানি তেল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ডিজেলের দাম বেড়েছে ৪৪ থেকে ৮০ টাকা।

আমরা উপরে তথ্য দিয়ে দেখিয়েছি সেবা খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত সব বিদ্যুৎ, তেল ,গ্যাস কোম্পানি প্রতিবছরই মুনাফা করছে । প্রায় সব গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মতে, করোনা মহামারীতে সাধারণ জনগণের প্রকৃত আয় কমেছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। তারপরও সরকার সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করতে বদ্ধপরিকর। সরকার এখানে নিপীড়কের ভূমিকায়। সরকারের এমন শোষকের ভূমিকা দেখলে খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও লজ্জা পেত!

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল। সেই মুক্তির স্বপ্নতেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে মানুষ এমন এক সময়ে যখন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বিগত এক যুগেরও বেশি সময় মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। ভোটাধিকার নাই বলে অথবা সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেনা বলে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সরকারকে বিচলিত করে না। সেবা খাত সংশ্লিষ্ট সবগুলো সেক্টরে দাম বাড়ানোতে সরকারের ‘দ্বীধাহীনতা’য় জনগণের ‘মুক্তি’র স্বপ্ন প্রলম্বিতই থেকে যাচ্ছে ।