— শুভ কিবরিয়া
জ্বালানি তেলের অভাবনীয় মূল্যবৃদ্ধি করে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে ফেলেছে সরকার। বাংলাদেশে অতীতে একবারে এতবেশি পরিমাণে জ্বালানির মূল্য কখনই বাড়ে নাই। হালে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেও এই হারে জ্বালানির মূল্য বেড়েছে কিনা সন্দেহ আছে। দেউলিয়া হতে বসা শ্রীলঙ্কার মতো দেশেও জ্বালানির মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নাই। ৫ই আগস্ট ২০২২ শুক্রবার মধ্যরাতে সরকারের ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা (৪২.৫% দাম বৃদ্ধি), কেরোসিন ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা (৪২.৫% দাম বৃদ্ধি), পেট্রোল ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা (৫১.১% দাম বৃদ্ধি), অকটেন ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা (৫১.৭% দাম বৃদ্ধি) করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ছিল এতটাই আচানক যে এটা বুঝে উঠতেও মানুষের কিছুটা সময় লেগেছে। অবশ্য পরেরদিন রাস্তায় বেরিয়েই গণপরিবহনের তুঘলকি কাণ্ড দেখে মানুষ টের পেয়েছে দেশে কিছু একটা ঘটে গেছে! মাত্র একদিনের মধ্যেই খুব দ্রুত সরকার পরিবহন সংগঠনের সঙ্গে বসে জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে পরিবহন ভাড়ার সমন্বয়ও করে ফেলেছে।
এই কাজে অবশ্য সরকার সব সময়ই খুব পারঙ্গমতা দেখিয়েছে। সরকারের তৎপরতায় বিআরটিএ দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটার প্রতি ৪০ পয়সা (২২.২%) ভাড়া বাড়িয়েছে। নগর পরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে কিলোমিটার প্রতি ৩৫ পয়সা (১৬.২৭%)। এখন বাজারেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দ্রুতই সব গণ্য ও সেবার দাম হু হু করে অনিয়ন্ত্রিত বেগেই বেড়ে যাবে।
সরকারের নীতি অনুযায়ী জ্বালানির ক্ষেত্রে যতো রকম ঘাটতি আছে, তার দায় ভোক্তার ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছে সরকার। সরকারের সকল উন্নয়নের যে চাপ, যে দায়, পরিকল্পনার যে খেসারত তার ব্যয় উচ্চমূল্যেই এখন আমজনতাকে বইতে হবে নিদারুণ কষ্টে, অসহ্য যন্ত্রণায়।
এর কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই ইউরিয়া সারের দাম সরকার বাড়িয়েছে কেজি প্রতি ৬ টাকা। এর কারণ হিসাবে প্রকাশ্যে সরকার যা বলেছে তা হলো, কৃষকরা না বুঝে কৃষিজমিতে প্রয়োজনের চাইতে বেশি বেশি ইউরিয়া সার ব্যবহার করে। ইউরিয়া সারের এই অতি ব্যবহার জমি, প্রকৃতি, পরিবেশ কারও জন্যই ভালো নয়। সে কারণেই সরকার চায় কৃষক জমিতে পরিমাণ মতো ইউরিয়া ব্যবহার করুক। তাহলে সেটার উপায় কি? সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মনে হয়েছে, দাম বাড়ালেই কৃষক কম কম ইউরিয়া কিনবে। কম কম ব্যবহার করবে। সরকারের এই উদ্দেশ্য ফলপ্রসু হবে কিনা কে জানে? তবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, গত ৫০ বছর ধরে কৃষি বিভাগ কি কাজ করলো যে কৃষককে এখনো বোঝাতেই পারলো না, ইউরিয়া কতটুকু ব্যবহার করা দরকার। এই ব্যর্থতার দায় কার? কৃষকের না কৃষি বিভাগের? যদি কৃষি বিভাগের হয়, তাহলে সেই দায়ভারের শাস্তি কি? দ্বিতীয়ত, দেশে যখন জ্বালানির সংকট তৈরি হলো, গ্যাস রেশনিং শুরু হলো, তখন প্রথমেই সরকারি মালিকানাধীন ইউরিয়া সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে পুরো ফ্যাক্টরিকেই বসিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারের নিজস্ব ইউরিয়া সার উৎপাদন পুরো বন্ধ করে তার পর পরই বাড়ানো হলো ইউরিয়ার দাম। এর মধ্যে মতলবটাই বা কী! অনেকে বলছেন, আইএমএফ’র লোন পাবার তাড়নায় সার খাতে সরকারি ভর্তুকি কমাবার তাগিদে সরকার এই কাজটা করেছে। কৃষকের ঘাড়ে এবার ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ স্বরূপ হাজির হয়েছে মধ্যরাতে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি। শুধু তাই নয় এবার অচিরেই বাড়তে চলেছে বিদ্যুতের দামও।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার জ্বালানির মূল্য এভাবে বাড়ালো কেন? প্রথমত, সরকার নিশ্চিত যে, সরকার যাই করুক না কেন তার কোনো বড় জনপ্রতিক্রিয়ার মুখে পড়বে না। দু-চারদিন ছোটখাট দু’একটা মিছিল, কিছু বিবৃতি, কিছু টকশো’র আলোচনা ছাড়া এর বড় কোনো রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নেই। জনগণের বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষদের কষ্ট বাড়বে, তবে তার সামষ্টিক এমন কোনো চাপ তৈরি হবে না যে সেটা সরকারকে ঘাবড়ে দিতে পারে। আর যদি কোনো ধরনের চাপ তৈরি হয়ও, তা শক্ত হাতে মোকাবিলা করার মত প্রাতিষ্ঠানিক-আর্থিক-প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ক্ষমতা সরকারের আছে। ফলে, এক ধরনের ডোন্ট কেয়ার অবস্থা সরকারকে এ রকম জনবিরুপ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে সরকারের অর্থিক খাতে বিশেষ করে ডলারের টানাটানি বেড়েছে। ফলে আইএমএফ’র সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছুতে হলে তাকে বিভিন্ন খাতে দেয়া ভর্তুকি তুলে নেবার শর্ত পূরণ করেই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আইএমএফ কোনো কারণে বিরাগ হলে সেই চাপ সরকারের মোকাবিলা করার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ আছে।
ফলে, আইএমএফকে তুষ্ট করার বড় বিপদ এড়ানোর অভিপ্রায়ে জনঅসন্তুষ্টির ছোট ঝামেলা, যা মোকাবিলাযোগ্য, সেটাকেই সরকার অগ্রাধিকার দিয়েছে। অন্যদিকে সরকারের রাজনীতি ও উন্নয়ন ম্যানেজ করতে আমলাতান্ত্রিক যে কাঠামোর ওপর নির্ভর করতে হয়েছে এবং হচ্ছে, তার বাইরে যাবার রাজনৈতিক পথ সরকারের সামনে খোলা নাই। ফলে, শক্তিমান আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় যে অস্বচ্ছতা, অদক্ষতা, দুর্নীতি চলমান আছে, বহু জায়গায় যে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় অব্যাহত আছে, তাকে মেনে নিয়েই সরকারকে এগুতে হচ্ছে। সে জায়গায় সংস্কার করার কোনো সুযোগও সরকারের হাতে নাই। ফলে তুলনামূলক দুর্বল এবং প্রতিরোধ করার ক্ষমতাহীন অংশ ‘আমজনতা’ কিংবা ‘সাধারণ জনগণ’কে চাপ দিয়ে সরকার পরিস্থিতি সামলাতে চাইছে।
এখন দেখা দরকার এই পরিস্থিতির সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কী প্রভাব পড়তে পারে। মানুষের কষ্ট বাড়বে ভীষণভাবে। গ্যাস, বিদ্যুত, পানির বর্ধিত দামে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর যে চাপ পড়বে, তাতে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য ও সেবার দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আমাদের পুরো রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামো যেহেতু জনবান্ধব না, ফলে সকল পণ্য ও সেবা বেশি দাম দিয়ে কিনেও মানুষ আশানরুপ সার্ভিস পাবে না।
জ্বালানির এই ভয়াবহ দাম মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। সেটা জনজীবনকে আরও ভোগাবে। লুটপাটের বাইরে যারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ব্যবসা করে আমাদের অর্থনীতি সচল রাখে তারাও ভীষণ চাপে পড়বে। তাদের সকল পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ করে রপ্তানিকারকরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে। এমনও হতে পারে উৎপাদনের চাইতে আমদানি লাভজনক বলে বিবেচিত হবে। ফলে, স্থানীয় ব্যবসা, উৎপাদন, বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়তে পারে। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সুবিধাও মানুষকে শেষাবধি চড়া দামে ক্রয় করতে হবে। ফলে সামাজিক বৈষম্য প্রকট হবে। সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। জননিরাপত্তা কমতে থাকবে। জনঅসন্তুষ্টির প্রভাব পড়বে সামাজিক পুঁজির ওপরে। সেটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও আরও প্রতিহিংসাপ্রবণ ও সহিংস করে তুলতে পারে।
জ্বালানির এই বর্ধিত চাপ মেটাতে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার। কেন না জনগণের এই অংশকে একটা ন্যূনতম আর্থিক সন্তুষ্টির মধ্যে রাখাকে কৌশলগতভাবে সরকারের জন্য লাভজনক বলেই ইতিপূর্বে বিবেচিত হয়েছে। সেই বিবেচনা থেকে পেছন ফেরার মতো কোনো কারণ যেহেতু ঘটে নাই, ফলে সরকার এ রকম সিদ্ধান্ত নিলে অবাক হবার মতো কিছু থাকবে না।
কৃষিতে একটা বড় বিপদ ঘটবে। সারের দাম, ডিজেলের দাম, বিদ্যুতের দাম প্রান্তিক ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদনকে হুমকির মধ্যে ফেলতে পারে। ছোট কৃষক বিনিয়োগের অভাবে কৃষি পেশা থেকে অব্যাহতি নিতে পারে। এ জায়গায় করপোরেট কৃষি ক্ষুদ্র-প্রান্তিক কৃষকের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হবে। বড় বিনিয়োগে, বড় বিপণন ব্যবস্থায় করপোরেট কৃষি কৃষি বাজারকে নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারে। ভোজ্য তেলের সরবরাহ ও নিয়ন্ত্রণ যেমন কতিপয় বড় ব্যবসায়ীর হাতে থাকে, জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি তেমনি পুরো কৃষিকে কতিপয় করপোরেটের তালুবন্দি করার ব্যবস্থা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
আমজনতা তার সকল রকম ব্যয় কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করবে। তার সকল রকমের ইনটেক কমবে। সে খাবে কম, পরবে কম, ঘুরবে কম। ফলে তার জীবনমান, পুষ্টিমান, বিনোদনমান, জীবনের স্বপ্নমান সব কমতে থাকবে। বাসাভাড়া ব্যয়, চিকিৎসা ব্যয়, গ্যাস-বিদ্যুত-পানি খাতে ব্যয়, পরিবহন ব্যয়, সন্তানদের শিক্ষা ব্যয় মিটিয়ে তার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের যে ফারাক ঘটবে তা জীবন নিয়ে তাকে এক দুঃখী মানুষে পরিণত করবে। তার ধর্মপ্রীতি বাড়বে, রাষ্ট্রপ্রীতি কমবে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা-মমতাও সে হারিয়ে ফেলবে। এক বিষণ্নতর জীবন তাকে হতাশার দিকে ঠেলে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা বড় বড় প্রকল্প, অবকাঠামো তৈরি করে সরকার বা রাষ্ট্র তাকে যে সুখী করতে চেয়েছিল সেগুলোকেই সে তার দুর্ভোগের কারণ বলে বিবেচনা করতে থাকবে। সরকারের রাজনৈতিক দলকে সে অবিশ্বাস করতে শুরু করবে। এটাই আমাদের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় দুঃখদিন আনার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। কেন না, জনগণ যদি রাজনৈতিক দলকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে, নিজের জীবনের দুঃখ-কষ্টের জন্য রাজনৈতিক দলের কাজকেই দোষারোপ করতে থাকে, তবে সে রাষ্ট্র বা জাতির জন্য এর চাইতে দুর্ভাগ্যের আর কিছু নেই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক
বিশ্লেষক, kibria34@gmail.com
সূত্র — মানবজমিন/ আগস্ট ৮, ২০২২