Search

Tuesday, December 3, 2019

বাড়ছে শিক্ষিত বেকার

চাহিদামাফিক জনশক্তি গড়ে তুলুন


সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণায় দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার বলে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। এই গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদের নেতৃত্বে একটি দল ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে ফেসবুক ও ই-মেইলের মাধ্যমে এই অনলাইন জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপ অনুযায়ী, শিক্ষা শেষে এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত বেকার ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ, দুই বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে বেকার ১৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত বেকার ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

এর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে দেশে মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেকার বলে জানানো হয়েছিল। বিবিএসের জরিপের তুলনায় বিআইডিএসের অনলাইন জরিপে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। বাংলাদেশে বেকারত্বের ভয়াবহতা জানতে কোনো জরিপের প্রয়োজন হয় না। বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস কিংবা অন্য কোনো খাতে একটি শূন্য পদে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা দেখলেই সেটি অনুমান করা যায়।

বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা এই জরিপ করলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো অসত্য বলে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই জরিপের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কেবল বিআইডিএস বা বিবিএসের জরিপ নয়, দেশি-বিদেশি প্রায় সব জরিপ ও পরিসংখ্যানেই বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে। কয়েক বছর আগে ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের জরিপে বলা হয়েছিল, বিশ্বে বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের হার সর্বোচ্চ।

দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, এটি আনন্দের খবর। কিন্তু সেই আনন্দ মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, যখন আমরা তাদের বড় একটি অংশকে কাজে লাগাতে পারি না। শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা। এই শিক্ষার পেছনে শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও বিপুল বিনিয়োগ থাকে। শিক্ষিত তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ যদি বেকার থাকে, তাহলে আমরা ওই শিক্ষাকে কীভাবে মানসম্মত বা যুগোপযোগী বলব?

জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্ধিত জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। সংস্থাটির মতে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি ৯৮ লাখে পৌঁছাবে, যা হবে জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ। কিন্তু জনমিতির এই সুফল কাজে লাগাতে হলে প্রত্যেক নাগরিককে যেমন দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, তেমনি তাদের উপযুক্ত কাজের সংস্থান করতে হবে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত ও মান শক্ত না করেই একের পর এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে চলেছি, যা সনদ বিতরণ করলেও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেকার থাকা সত্ত্বেও অনেক খাতে উচ্চ বেতন দিয়ে বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তাদের যুক্তি, দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। এর অর্থ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন নতুন বিভাগ ও অনুষদ খুলছে, কিন্তু সেসব বিভাগ ও অনুষদের কোনো উপযোগিতা আছে কি না, সেসব ভেবে দেখার কেউ নেই। উপযুক্ত জনশক্তি তৈরির পাশাপাশি তাঁদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। 

  • কার্টসি — প্রথম আলো/ ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯

Monday, December 2, 2019

Road Safety Uprising - Students’ most demands remain unmet

Shahin Akhter

Most of the major demands of the students placed during the countrywide student protests that erupted after the death of two Shaheed Ramiz Uddin Cantonment College students in an accident because of reckless driving at Kurmitola in Dhaka in 2018 remained unmet.

Following the student protest, the government enacted the Road Transport Act 2018 in September 2018 year and finally enforced it on November 17 this year.

Countrywide work abstention by transport workers forced the government to backtrack from the enforcement of the law on some major areas such as driving licence, overloading, fitness and modification of vehicles.

As the demands on road safety remains elusive, the fatalities on roads are on rise and the government is forming committees one after another to control accidents and bring order on roads.

Road safety experts alleged the situation on roads was deteriorating day by day. Had the demands of the students were met then, safety on roads would be established by now, they said.

Thousands of students took to the streets for more than a week after their two fellows were killed on July 29, 2018 when a reckless driver drove a Jabal-e-Noor company bus off the road and ploughed through a crowd while competing with another bus of the same company.

Amid an utter anarchy in the road sector for long, the students demanded highest punishment for the bus drivers responsible for the killing of the two, not allowing buses without fitness, driving by any unlicensed driver at any place of the country, and ban on carrying passengers by public transports in excess of their capacity.

They also demanded establishing footbridges and taking safety measures for safe movement of students, establishing speed-breakers in accident-prone areas including in front of educational institutions, taking all responsibilities by the government of the families of the deceased and injured, compelling the buses to carry students and ensuring half fare for them.

A Dhaka court on Sunday sentenced two drivers and an assistant of Jabal-e-Noor Paribahan to life-term imprisonment in the case filed over the incident.

On November 21, after a meeting with transport sector leaders following a countrywide strike, home minister Asaduzzaman Khan said the drivers could drive any vehicle with the existing licence and modified vehicles could run till June 30, 2020 and within this time the drivers would receive appropriate licences and the owners would receive update documents from the Bangladesh Road Transport Authority.

Till date the authorities are in a relaxed mood to enforce the law.

According to a data compiled by Bangladesh Police till September this year 3,060 deaths, and 3,292 injuries, and 3,009 traffic accidents were recorded and the death figure is the highest after 2008.

In 2018, 2,635 people were killed and 1,920 were injured in 2,609 traffic accidents.

The percentage of deaths in accident increased this year by around 16 per cent comparing with last year.

Road accidents took 2,513 lives in 2017, the figure was 2,463 in 2016, 2,376 in 2015, 2,067 in 2014, 1,957 in 2013, 2,538 in 2012, 2,546 in 2011, 2,646 in 2010, 2,958 in 2009, and 3,765 in 2008, the data shows.

The High Court on July 24 this year asked the owners of 4.79 lakh unfit vehicles running across the country to get fitness certificates for the vehicles from the Bangladesh Road Transports Authority within two months.

On October 23 the authority submitted a report before the High Court which said only 89,269 vehicles’ owners have collected fitness certificates in August and September following the court directive.

As per the authority, the number of registered motor vehicles in the country was around 41 lakh till July this year against which around 23 lakh driving licences were issued. It proved a huge crisis of drivers especially for driving public transports.

Recently the authorities have taken an initiative to build an underpass in front of Shaheed Ramijuddin College for safe movement of pedestrians.

Professor Mizanur Rahman, director of Accident Research Institute under the Bangladesh University of Engineering and Technology, told New Age that following the student protest, the government passed the new road law which was yet to be enforced fully.

He said the authorities should control the sick competition among the owners of the buses and reduce gap between supply and demand sides for public transports.

‘If all their demands would be met then safety on roads would be assured,’ he added.

Professor Shamsul Hoque, former director of Accident Research Institute, said the situation on roads was deteriorating day by day.

He said the students pointed at the faults in the overall system and strongly hit the base of the society’s morality.

However, the government should go for step by step solutions based on facts and findings to ensure safety on roads, he added. 

Meanwhile prime minister Sheikh Hasina on June 25, 2018 gave directives to ensure drivers’ rest every five hours, to employ alternate drivers for long-distance vehicles, training and resting facilities for drivers and their assistants, use of seatbelts while travelling, and abiding by the traffic signals.

Most of these demands and directives still remain on paper due to crisis of drivers, training facilities and infrastructures like zebra crossings.

  • Courtesy — NewAge/Dec 2, 2019 

খেলাপি ঋণ বাড়ছে না কমছে?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

আমার মনে আছে, নতুন অর্থমন্ত্রী মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার পরপরই বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। কিছুদিন পর তিনি আবারও বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার কোনো সুযোগই নেই। আরও কিছুদিন পর সাংবাদিকরা যখন জানালেন, খেলাপি ঋণ বেড়েছে; অর্থমন্ত্রী তখন বললেন, তিনি বিশ্বাস করেন না। খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান পরিবেশন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মন্ত্রী যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও বিশ্বাস না করেন, তাহলে তার বিশ্বাসের ভিত্তি কোথায়? এখন পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা যাক।

অর্থমন্ত্রীর আত্মবিশ্বাসের মূলে ছিল তার কিছু ধারণা এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রথমেই তিনি খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে এক যুগ আগের সংজ্ঞায় নিয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিন মাস অচল থাকার পরিবর্তে এখন ছয় মাস অচল থাকলে তাহলেই হিসাবটি খেলাপি হবে। এটি আন্তর্জাতিক খেলাপি ঋণ নীতিমালার স্খলন। তবে অর্থমন্ত্রী মনে করেছিলেন, শিথিলকরণের কারণে অনেক খেলাপিই খেলাপমুক্ত হবেন। অতএব, খেলাপি ঋণ কমে যাবে। অর্থমন্ত্রীর দ্বিতীয় ব্যবস্থাটি ছিল, দুই শতাংশ টাকা জমা দিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সব খেলাপি ঋণকে ১০ বছরের জন্য মাত্র ৯ শতাংশ সুদে খেলাপমুক্ত করা যাবে। ভেবেছিলেন, সব খেলাপি যদি খেলাপমুক্ত হয়ে যান, তাহলে তো দেশে আর খেলাপি ঋণ থাকবে না। কিন্তু তার এই ধারণা যে কতটা সরলীকৃত ছিল, তা এখন বোঝা যাচ্ছে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ


বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর প্রতিটি কোয়ার্টারে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এবং বৃদ্ধির পরিমাণ ১৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে এই হিসাবে একমত হয়নি আইএমএফ। বিশ্ব সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে ঋণ অবলোপন করা হয়েছে, তাও খেলাপি। আবার অনেক ঋণ খেলাপির যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সব মিলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ হবে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী অবলোপনের নীতিমালাতেও শিথিলতা এনেছেন। আগে পাঁচ বছর থাকার পর অবলোপন করা যেত। সেটিকে সম্প্রতি তিন বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে। এখন ব্যাংক মালিকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রস্তাব রেখেছেন, সময় ব্যয় না করে সঙ্গে সঙ্গেই অবলোপন করার বিধান করা হোক। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে চাপে আছে বলে মনে করা হচ্ছে।

দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা গোড়া থেকেই বলে এসেছেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে শিথিলতা প্রদর্শন করলে খেলাপিরা উৎসাহিত হবেন। এ প্রক্রিয়ায় আদায় ব্যাহত হবে। যে কাজে উৎসাহ দেওয়া হয়, তা বেড়ে যায়। আর যে কাজে শাস্তি প্রদান করা হয়, সে কাজ কমে যায়। এ কারণে ভালো কাজে উৎসাহ দেওয়া হয় এবং মন্দ কাজে শাস্তি দেওয়া হয়। পৃথিবীর সর্বত্রই ব্যাংকের খেলাপিদের শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। কারণ, ঋণের টাকা ব্যাংক মালিকদের নয়। বরং এ সম্পূর্ণ টাকাই জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত আমানত; যা আইন অনুযায়ী 'চাহিবা মাত্র ফেরত প্রদান' করতে হবে। কাজেই জনগণের টাকা ট্রাস্টি হিসেবে ব্যাংকারদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে; যাতে বিনিয়োগকৃত টাকা মুনাফাসহ সময়মতো ফেরত আসে। এখানে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে সম্প্রতি পূর্বে বর্ণিত বিভিন্ন উপায়ে খেলাপিদের উৎসাহ প্রদান করার ফলে তারা শাস্তি থেকে শুধু মুক্তিই পাচ্ছেন না, বরং পুরস্কৃত হচ্ছেন। এতে দ্বিগুণ উৎসাহে তারা ঋণ ফেরত না দেওয়ার ব্যাপারে মনোযোগী হয়েছেন।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে কমবেশি ১০ লাখ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে; এর মধ্যে এক লাখ কোটি টাকাই নিয়মিত ঋণ। এক লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। এটি অবশ্য বর্তমান অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার আগের চিত্র। এই চিত্র এখন পাল্টে গেছে। ৯ লাখ কোটি টাকা নিয়মিত ঋণের যারা গ্রাহক ছিলেন, তাদের প্রদেয় সুদের হার এখনও ১০ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে। ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে। অথচ খেলাপি ঋণগ্রহীতারা সুযোগ পাচ্ছেন মাত্র ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পরিশোধের। ফলে নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারীরা ৯ শতাংশ সুদের আওতায় আসার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছেন এবং খেলাপি হয়েছেন। ফলে প্রতি প্রান্তিকে নতুন খেলাপিদের কারণে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎসাহ দিলে যে মন্দ কাজের বৃদ্ধি ঘটে, এটি তার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

আমরা এখানে চীনের ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করার পর অনভ্যাসজনিত কারণে চীনের খেলাপি ঋণ অনেক বৃদ্ধি পায়। তখন সরকার খেলাপিদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনের বাইরেও কঠোর শাস্তির বিধান প্রচলন করে। যার মধ্যে ছিল খেলাপি হওয়া মাত্রই কোনো বিলম্ব না করে তার পাসপোর্ট বাতিল। বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা। বিমানের টিকিট ক্রয়ে বাধানিষেধ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কমিটিতে সদস্যপদ লাভে অযোগ্যতা এবং ভিআইপি বা সিআইপি হিসেবে গণ্য হওয়ার অযোগ্যতা। এছাড়া দীর্ঘ সময়ের খেলাপি হলে সরাসরি জেলে নিয়ে যাওয়া হতো। এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ফলাফল দ্রুতই পাওয়া গেল। কমবেশি তিন বছরের মধ্যে খেলাপির হার সর্বনিল্ফেম্ন নেমে গেল।

অর্থমন্ত্রী ও তার সমর্থক মহল থেকে এখন বলতে চেষ্টা করা হচ্ছে যে, দুই শতাংশ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপিমুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটি সম্পন্ন হলে দেশ আর খেলাপি থাকবে না। কিন্তু খেলাপির চেয়ে অখেলাপিরা এখন ৯ গুণ বেশি। এখন ধীরে ধীরে অখেলাপিদের সংখ্যা যদি আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকত, তাহলে মন্ত্রীর ভবিষ্যদ্বাণী যাই হোক না কেন, ব্যাংকগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। সেইসঙ্গে জনগণের সঞ্চিত অর্থ আটকা পড়লে বড় রকমের ভীতির সঞ্চার হতে পারে। এমনকি সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরেও প্রচণ্ড আঘাত আসতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এই সাক্ষ্যই প্রদান করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের খেলাপি ঋণও কমবেশি ১০ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এত বড় দেশ হওয়া সত্ত্বেও দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরে প্রচণ্ড আঘাত এসেছে। সম্প্রতি ভারতের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি পাঁচ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। আমরা অবাক হই, যখন মন্ত্রীর মুখে শুনি, ভারতের খেলাপি ঋণও আমাদের মতোই বেশি। কিন্তু তিনি বলেন না যে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির থেকে প্রতি কোয়ার্টারেই কমে আসছে। অর্থমন্ত্রী কি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বা শ্রীলংকার খেলাপি ঋণ হারের উদাহরণ দিতে পারেন না? এসব দেশে খেলাপির হার ১ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে। চোখ থাকতে অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হবে কি?

কেন এমনটি ঘটছে? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত এ দেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, ড. এআর মল্লিক, সাইফুর রহমান, এসএএমএস কিবরিয়া, এএমএ মুহিত। তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন; কিন্তু কেউই ব্যবসায়ী ছিলেন না। এমনকি তারা কেউ সেই অর্থে ধনাঢ্য ব্যক্তিও ছিলেন না। ব্যবসায়ীরা অর্থমন্ত্রী হলে স্বার্থের সংঘাত দেখা দেয়। তারা চাইবেন নিজের এবং ব্যবসায়ী স্বজনদের আয়-উন্নতির দিকে খেয়াল রাখতে। এতে জনগণ বঞ্চিত হতে পারে। এ কারণেই বর্তমান সমস্যার সৃষ্টি।

আমরা মনে করি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকা উচিত পূর্বসূরিদের মতো অব্যবসায়ীর হাতে। অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ থাকতে হয় প্রকৃত রাজনীতিকদের হাতে। রাজনীতিকরা ব্যবসা করতে পারবেন না- তা নয়। কিন্তু বড় ব্যবসায়ীর দৃষ্টি থাকে আরও বড় হওয়ার দিকে এবং নিজ গোষ্ঠীকেও ওপরে টেনে তুলতে। এই স্বার্থের সংঘাত পরিহারযোগ্য।

ভারতের মতো ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আগেই বিষয়টির প্রতি সত্যিকার রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি বিশ্নেষণ করার অনুরোধ জানাচ্ছি। তিনি এ ব্যাপারে পেশাগত সহায়তা দেওয়ার জন্য দেশের অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ শুনে দেখতে পারেন। উল্লেখ্য, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং নিজে একজন স্বীকৃত অর্থনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও এসব ব্যাপারে পাঁচজন দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদকে নিয়ে একটি পরামর্শক কমিটি করেছিলেন। আমাদের দেশেও এ উদাহরণ অনুসরণ করা যেতে পারে।

  • খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, ব্যাংকার, সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।
  • কার্টসি — সমকাল/ ডিসেম্বর ২, ২০১৯ 

সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস

জিয়াউল হক মিজান

পেঁয়াজের বাজারে নজিরবিহীন অস্থিরতা দীর্ঘ তিন মাস ধরে। আর পুরো জাতি যখন পেঁয়াজ নিয়ে দুশ্চিন্তায় তখন নীরবে বেড়ে গেছে আরো অন্তত এক ডজন পণ্যের দাম। পেঁয়াজের পাশাপাশি বেড়েছে চাল, তেল, ডিম, আদা, রসুন, ময়দা, মরিচ, হলুদ, মসলা, চিনিসহ অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারসাজি করে এ কাজটি করছে। এর মাধ্যমে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী লাভবান হলেও সামগ্রিকভাবে দেশের সব জনগোষ্ঠীই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সীমাহীন বেকারত্ব, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে খরা, শেয়ারবাজারের দুরবস্থা, পরিবহন, বাসা ভাড়া ও শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যয়বৃদ্ধিসহ সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কবলে পড়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ভালো নেই দেশের ব্যবসায়ীরাও।

অভিযোগ উঠেছে, নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা তুলছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। দেশজুড়ে সব মানুষের নজর পেঁয়াজের দিকে। এ সুযোগে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এসব পণ্য কিনতে নিয়মিত বাড়তি ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা।

একই সাথে পেঁয়াজও কিনছেন ১৭০ থেকে ২২০ টাকায়। বর্তমানে বাজারে এসব পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। এর পরও বিভিন্ন অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে অসাধু চক্র। সপ্তাহের ব্যবধানে মসলা পণ্য এলাচের দাম কেজিতে ৬০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। খুচরা বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি এলাচ বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়, যা টিসিবির তথ্যানুযায়ী আগের সপ্তাহে ছিল দুই হাজার ৪০০ টাকা।

খুচরা বাজারে এখন মিনিকেট চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকা, নাজিরশাইল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, আটাশ ৪০ টাকা, ঊনত্রিশ ৩৮ থেকে ৪০ টাকা, স্বর্ণা চাল ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগেও মিনিকেট চাল ৪১ থেকে ৪২ টাকা, নাজির ৫০ থেকে ৫২ টাকা, আটাশ ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা, ঊনত্রিশ ৩২ থেকে ৩৩ টাকা, স্বর্ণা চাল ২৬ থেকে ২৭ টাকা ছিল।

নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলা পণ্য শুকনা মরিচের দাম কেজিতে গড়ে ৫৫ টাকা এবং হলুদের দাম গড়ে ৩৫ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি শুকনা মরিচ মানভেদে ২২০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা দু’সপ্তাহ আগে ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা ছিল। এখন হলুদ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২৫০ টাকায়, যা আগে ১৬০ থেকে ২০০ টাকা ছিল।

গতকাল খুচরায় প্রতি কেজি চীনা রসুন ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা ও দেশি রসুন ১৭০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়। দেশি পুরনো আদা ২০০ থেকে ২২০ টাকা ও নতুন আদা ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা এবং আমদানি করা আদায় ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা গুনতে হচ্ছে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য ঢালাওভাবে সব ব্যবসায়ীদের অভিযুক্ত করার প্রতিবাদ জানিয়ে খিলগাঁও রেলগেইট সংলগ্ন ফার্নিচার ব্যবসায়ী নূরুল আলম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ব্যবসায়ী মানেই মুনাফাখোর নয়। দেশের সব ব্যবসায়ী কারসাজির সাথে জড়িতও নয়। সরকারের আনুকূল্য নিয়ে অপকর্ম করছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। তার দায় নিতে হচ্ছে পুরো ব্যবসায়ী সমাজকে। তা ছাড়া পেঁয়াজের ব্যবসা করে যিনি বাড়তি টাকা আয় করছেন তাকে তো নিজের প্রয়োজনে চাল, ডাল, লবণ, তেল সবই কিনতে হচ্ছে। এমন অরাজকতা কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সংসার চালাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে জানিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সোলায়মান খান গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, যে কোম্পানিতে চাকরি করি তার অবস্থাই ভালো না। গত তিন বছর ইনক্রিমেন্ট নেই। একই বেতনে চাকরি করছি। অথচ এসময়ে সংসার খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ পার্সেন্ট। লেখাপড়ার খরচ, বাসাভাড়া, চিকিৎসা ব্যয়, গ্যাস-বিদুতের বিল সবই বেড়েছে। তার ওপর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম তো আকাশছোঁয়া।

এভাবে চলতে থাকলে সব ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, গ্রামের অবস্থাও তো ভালো না। সেখানে আরো অরাজকতা চলছে। খারাপ মানুষ এবং অসাধূ উপার্জনকারী ছাড়া সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাই এখন দায় হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্যবসায়িক মন্দার অন্যতম প্রধান কারণ জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া। একজন সবজি বিক্রেতা সবজি বিক্রি করে ভালো আয়-রোজগার করলেও অপরাপর সব খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি আয়েও তার পক্ষে সরসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। দোকান ভাড়া বৃদ্ধি, বাসা ভাড়া বৃদ্ধি, কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি বেচাকেনা কমে যাওয়ায় তারা বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করেও আগের মতো লাভ করতে পারছেন না বলে জানান।

এদের অনেকের অবার আয় বেড়েছে ঠিকই; কিন্তু ব্যয় তুলনামূলকভাবে অধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়তি আয়েও সংসার চলছে না বলে জানান বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। টিকে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে অনেকে বড় ব্যবসা ছেড়ে ছোট ব্যবসায় যাচ্ছেন। অনেকে আবার পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে মেসে উঠছেন।

ব্যবসায়ীক মন্দার চিত্র চোখে পড়ে মার্কেটগুলোয় গেলেও। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়তই ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠত মার্কেটের দোকানিরাও। হাতবদলের পর কিছুদিন লোকসান গুনে নতুন দোকানিও গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে। ফলে মার্কেট-মহল্লায় নতুন নতুন ব্যবসায়ীর সংখ্যাই বেশি চোখে পড়ছে।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন কম পুঁজির ব্যবসায়ীরা। তাদেরই একজন জীবনযুদ্ধে হীমসীম খাওয়া রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের ব্যবসায়ী সোলায়মান। ক্রোকারিজ মালামালের ব্যবসায় করেন তিনি।

কথা প্রসঙ্গে জানালেন, কয়েক মাস থেকে ব্যবসায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। বেচা-বিক্রি নেই বললেই চলে। স্কুলে সন্তানদের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা শেষে শুরু হবে নতুন সেশনে ভর্তির চিন্তা। ভর্তি ফি, ড্রেস বানানো, বইপত্র কেনাসহ সম্ভাব্য খরচ কোত্থেকে জোগাড় করবেন সে বিষয়ে চরম দুশ্চিন্তার কথা জানালেন তিনি।

ব্যবসায় মন্দার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, গত রোজার ঈদের আগে থেকে যা বিক্রি হয় তাতে দোকান খরচই আসে না। বাসা ভাড়া, বাজার খরচ, চিকিৎসা ব্যয় এবং সন্তানদের পড়াশোর খরচ চলছে দোকানের পুঁজি ভেঙে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, দু-একটি ছাড়া অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যর দাম বৃদ্ধির যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এ ক্ষেত্রে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা দেখে অতিমুনাফার সুযোগ নিচ্ছে অন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের অসহযোগিতার কারণে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।

এটি দেখে অন্য ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এক কথায় নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এটি কঠোরভাবে সরকারের দমন করা উচিত। এখন কঠোর পদক্ষেপ না নেয়া হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

ক্যাব সভাপতি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের চড়া দামের কারণে ভোক্তারা চাপে আছেন। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট অনেক বেড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার যৌথভাবে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

  • কার্টসি - নয়া দিগন্ত/ ০২ ডিসেম্বর ২০১৯

Sunday, December 1, 2019

People mustn’t pay for wrong power policy of government


THE recommendations for an increase in bulk power prices by 20 per cent and in transmission charges by 7 per cent that the technical evaluation committee of the Bangladesh Energy Regulatory Commission put forth at a public hearing on Thursday come concerning as any such increases are highly likely to leave impact on retail power prices soon. Retail power prices were last increased on November 23, 2017 by an average of 5.3 per cent, or Tk 0.35, a unit and bulk power prices on September 1, 2015 by 2.93 per cent, or Tk 0.23, a unit. The committee in the case at hand has proposed that an increase by 19.5 per cent in bulk power prices should be justified while the Power Development Board has sought a 23.27 per cent increase; and the committee has proposed that the transmission charges for the Power Grid Company of Bangladesh should be increased by 6.92 per cent against 50.27 per cent that the company has sought. With the hearing still going on, other arguments should be forthcoming, but the argument put forth till now that the increase seeks to make up for the projected deficit or to stem a decline in profits of the distributors hardly appears tenable.

Deficit in the power sector is said to have doubled to Tk 80 billion in 2018, in a year, from Tk 36 billion in 2017, which had come down from Tk 40 billion a year before. The Power Development Board in its presentation at the hearing has said that the deficit in the power sector will have increased to more than Tk 85 billion in 2020. While the deficit going down and almost going through the roof and the reasons can well be debated, experts believe that the doubling of the deficit is the outcome of the wrong power policy of the government and people should not pay for the wrongly-premised move. The government is often blamed for a forced continuation of the expensive crisis-time measure of rental and quick rental power, without putting in the required efforts to afford people cheap power from state-owned plants, to advantage certain quarters. The expensive rental power plants, introduced towards the end of the first decade of the century, were meant to be replaced with less expensive power plants by 2014. It did not happen. The government has, rather, increased its power production capacity much beyond the demand, which has forced many plants to sit idle and the government keeps making capacity payment to the plants for the power not yet produced. The government, as the power board says, has paid Tk 590 billion in capacity payment in the past 12 years, which is said to have added to the deficit.

It is, therefore, illogical and unethical for the government to pass the cost of its wrong power policy onto consumers. Increase in power prices at a time when goods prices are much too high could also cause social unrest of a sort. Any decision on power price increase, at the bulk or the retail level, must, therefore, warrant that the government should first set its power policy aright.

  • Courtesy — NewAge/ Nov 30, 2019

ধানের দাম না বাড়লে চালের দাম বাড়বে কেন?

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল

গত ২০ নভেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে চালকল মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। দেশে প্রায় ২ কোটি ৮৪ লাখ ১৬ হাজার ৭১০ টন চালের বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৩ কোটি ৪৪ লাখ টন। এ মুহূর্তে সরকারের বিভিন্ন গুদামে মজুদ রয়েছে প্রায় ১৪ লাখ ৫২ হাজার ৭০৭ টন, যার মধ্যে চালের পরিমাণ ১১ লাখ ১৩ হাজার ৩০৩ টন। তাই পণ্যটির দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তিনি আরো বলেছেন, ধানের দাম বাড়েনি। তাই চালের মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যাবে না। ধানের দাম বাড়লে কৃষক কিছুটা লাভবান হতেন, কিন্তু তা হয়নি। কৃষক লাভ পাবেন না, কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীরা সব লাভ নিয়ে যাবে, সেটা চলতে দেয়া যাবে না। 

উল্লেখ্য, চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শুরুতে হঠাৎ করে মোটা ও চিকন চালের দাম বেড়ে যায়। কেজিতে সব ধরনের মোটা চালের দাম ৬ টাকা পর্যন্ত এবং চিকন চালের দাম ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। আর বস্তাপ্রতি বিভিন্ন জাতের চালের দাম ৫০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। দেশে চালের ‘পর্যাপ্ত মজুদ’ থাকা অবস্থায় আমনের ভরা মৌসুমে চালের দামে ঊর্ধ্বগতির জন্য কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), ধান-চালের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিসহ পাইকারি চালের আড়তদাররা চালকল মালিকদের দায়ী করেন।
মো. আবদুল লতিফ মন্ডল


গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সরকার চলতি আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে ধান-চাল সংগ্রহের নীতিমালা ঘোষণা করে। এতে ১০ লাখ টন ধান ও চাল সংগ্রহ করার ঘোষণা দেয়া হয়; যার মধ্যে ছয় লাখ টন ধান, সাড়ে তিন লাখ টন সিদ্ধ ও ৫০ হাজার টন আতপ চাল। প্রতি কেজি ধানের দাম নির্ধারিত হয় ২৬ টাকা, আর সিদ্ধ ও আতপ চালের কেজিপ্রতি দাম ধরা হয় যথাক্রমে ৩৬ ও ৩৫ টাকা। ২০ নভেম্বর থেকে ধান এবং ১ ডিসেম্বর থেকে চাল কেনা শুরু হয়ে এ কার্যক্রম ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০ নভেম্বর ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে। এবার আমন ধান ও চাল সংগ্রহে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে ব্যতিক্রমধর্মী বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। এর কারণ এক. বেশ কয়েক বছর পর এবার আমন মৌসুমে সরকার ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিল। কৃষকদের কাছ থেকে সংগৃহীত ধান সরকার চুক্তিবদ্ধ মিলারদের দেবে নির্ধারিত দামে খাদ্য অধিদপ্তরকে চাল সরবরাহের জন্য। দুই. সংগ্রহের জন্য নির্ধারিত মোট ১০ লাখ টন চাল তৈরির জন্য যে ধান ক্রয় করা প্রয়োজন হবে, তার বেশির ভাগ কেনা হবে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে। আর সরকার নির্ধারিত দামে খাদ্য অধিদপ্তরকে চাল সরবরাহ করতে যেসব চালকল মালিক দপ্তরটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবেন, তারা বাজার থেকে প্রয়োজনীয় অবশিষ্টাংশ ধান কিনবেন।

অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে সরকারের ধান ও চাল সংগ্রহের মূল উদ্দেশ্য হলো ধান কাটা এবং ঘরে তোলার মৌসুমে বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখা, যাতে ধানচাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন এবং অধিক পরিমাণে ধান উৎপাদনে উৎসাহিত হন। অন্যান্য উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে সরকারি গুদামে চালের নিরাপত্তা মজুদ গড়ে তোলা, বাজারে চালের দাম বাড়লে সরকারি মজুদ থেকে খোলাবাজারে ও ন্যায্যমূল্যের দোকানে চাল বিক্রির মাধ্যমে দাম স্থিতিশীল রাখা এবং সরকারের লক্ষ্যমুখী খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা।

২০ নভেম্বর চালকল মালিকদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠিত বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা পুরোপুরি গণমাধ্যমে আসেনি। বৈঠক শেষে খাদ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের যা বলেছেন, শুধু তা-ই গণমাধ্যমে এসেছে। চালকল মালিকরা বৈঠকে খাদ্যমন্ত্রীর কাছে কী প্রস্তাব রেখেছেন, তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। তবে বৈঠকে চালকল মালিকদের পক্ষ থেকে চালের সংগ্রহ মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ চালকল মালিকদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার দু-একদিন আগে দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চালের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে চালকল মালিকদের পক্ষ থেকে ধানের দাম বৃদ্ধি ও চাহিদা অনুযায়ী হাটবাজারে ধানের সরবরাহ না থাকাকে দায়ী করা হয়েছে। তবে চালের দাম বাড়ার পেছনে তাদের এ  যুক্তি যে সঠিক নয়, তা খাদ্যমন্ত্রীর ‘ধানের দাম বাড়েনি’ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

চলতি শতকের শুরুতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালনকালে আমি লক্ষ করেছি চালকল মালিকরা কীভাবে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। চালকল মালিকরা শুধু সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা লুটেন না, তারা অভ্যন্তরীণ ধান-চাল (আমন ও বোরো) সংগ্রহে সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। তারা অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহে চালের উচ্চমূল্য দাবি করেন এবং ধান কেনায় সরকারকে নিরুৎসাহিত করেন অথবা ধানের দাম কম রাখার জন্য সরকারকে চাপ দেন। কারণ সরকার ধান না কিনলে ধানের দাম কম থাকে এবং তারা কম দামে ধান কিনে বিপুল মজুদ গড়তে পারেন। ধান কাটার মৌসুম শেষে যখন দেশের মোট চাষীর প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীর কাছে ধান মজুদ থাকে না, তখন তারা মজুদ ধান চালে রূপান্তর করে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চমূল্যে পণ্যটি বিক্রি করে প্রচুর লাভ করেন। চলমান আমন মৌসুমে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ৬ লাখ টন ধান কেনার সরকারি সিদ্ধান্তটি চালকল মালিকরা যে ভালোভাবে নেননি, তা বোধ হয় অনেকটা জোর দিয়েই বলা যায়। 

কয়েকদিন আগে একটি দৈনিকে (যুগান্তর) প্রকাশিত আমার এক নিবন্ধে বলেছিলাম, ‘গত বছরের মতো এ বছরও চালকল মালিকদের কাছ থেকে সংগৃহীতব্য আমন চালের কেজিপ্রতি দাম ৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পার্থক্য হলো, এবার চালকল মালিকদের কাছ থেকে সংগৃহীতব্য অধিকাংশ চালের জন্য সরকার ধান কিনে তাদের সরবরাহ করবে। গত কয়েক বছর সরকার আমন ধান না কেনায় এবং ধানের দাম নির্ধারণ করে না দেয়ায় চালকল মালিকরা কম দামে ধান কেনার যে সুযোগ পেয়েছিলেন, এবার তা থেকে তারা কিছুটা হলেও বঞ্চিত হবেন। তাই এবার কেজিপ্রতি ৩৬ টাকা দরে সরকারকে চাল সরবরাহে তারা কতটা সহযোগিতা করবেন, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’ সরকারকে আমন চাল সরবরাহের সময়সূচি এখনো শুরু না হলেও চালের দাম বাড়িয়ে তারা এরই মধ্যে তাদের মনোভাব কিছুটা প্রকাশ করেছেন। ধান কাটা-মাড়ার মৌসুম শেষে যখন চুক্তিবদ্ধ চাল সরবরাহের সময় ঘনিয়ে আসবে, তখন তারা আগের মতো চালের দাম বাড়ানোর দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। চালের মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যাবে না বলে খাদ্যমন্ত্রী যে যুক্তিসংগত অবস্থান নিয়েছেন, তিনি তাতে কতদিন অনড় থাকতে পারেন তা এখন দেখার বিষয়।   

তাছাড়া চলমান অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ নীতিমালায় সরকার চাল সংগ্রহের জন্য চালকল মালিকদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চলমান নীতিমালায় অভ্যন্তরীণভাবে চাল সংগ্রহের জন্য চালকল মালিকরা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উৎস নেই। ২০০৬ সালের জাতীয় খাদ্যনীতিতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্যশস্য কেনার নির্দেশ থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। চালকল মালিকরা এ সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে আসছেন। এ সুযোগের অংশ হিসেবে চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকরা এর আগে একাধিকবার ধানের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে চাল সংগ্রহ মৌসুমে সরকারকে চাল সরবরাহে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং সরকার সংগৃহীতব্য চালের দাম বাড়ানোর পরই তারা চাল সরবরাহ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ২০১০ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ে। ২০১০ সালে বোরো মৌসুমে চালের সংগ্রহমূল্য নির্ধারিত হয় প্রতি কেজি ২৫ টাকা। তদানুযায়ী চাল সরবরাহের জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চালকল মালিকদের চুক্তি হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের অল্পদিনের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকরা বাজারে ধানের দাম বাড়ার অজুহাতে নির্ধারিত দামে চাল সরবরাহে অস্বীকৃতি জানান এবং চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। সরকার তাদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে কেজিতে চালের দাম ৩ টাকা বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ কেজিপ্রতি চালের সংগ্রহ মূল্য পুনর্নির্ধারিত হয় ২৮ টাকা। বিষয়টি নিয়ে তখন বাজারে নানা রকম গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়। আমন চাল সংগ্রহের চলতি মৌসুমেও তারা অনুরূপ একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে পারেন।

যেহেতু ধানের দাম বাড়েনি, সেহেতু সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ও সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকদের মাধ্যমে সংগৃহীতব্য চালের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। মনে রাখতে হবে সরকারের সংগৃহীতব্য চালের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খোলাবাজারে বাড়বে চালের দাম। তাছাড়া ভোক্তার দিকটাও দেখতে হবে। চাল আমাদের প্রধান খাদ্য। দেশের মানুষের প্রয়োজনীয় শক্তির ৭০ শতাংশ জোগান আসে ভাত থেকে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ, গ্রামাঞ্চলে ভূমিহীন শ্রমিক, মজুর, ধান কাটার মৌসুম শেষে চাল-ক্রেতায় পরিণত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীসহ ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ চাল কিনে খায়। চালের মূল্যবৃদ্ধিতে চালকল মালিক, আড়তদার, চাল ব্যবসায়ী এবং বড় কৃষক ছাড়া অন্য সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হন।

  • আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক খাদ্য সচিব
  • কার্টসি — বণিক বার্তা/  ডিসেম্বর ০১, ২০১৯

এই নির্বাচন কমিশন নিয়ে আমরা কী করব!

বদিউল আলম মজুমদার

আমাদের নির্বাচন কমিশনে আবারও নিয়োগ নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি চার কমিশনারের মতামত না নিয়েই সিইসি ও কমিশনের সচিব কর্তৃক ৩৩৯ জন কর্মচারীর নিয়োগ নিয়ে এ দ্বন্দ্ব, যা স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে একজন কমিশনারের দাবি। স্মরণ করা যেতে পারে যে বর্তমান হুদা কমিশন গঠনের পরপরই অন্য কমিশনারদের না জানিয়ে সিইসি ও সচিবের উদ্যোগে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের বদলি নিয়ে ইসি ও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মধ্যে প্রথম বিরোধ দেখা দেয়। অন্য তিন কমিশনার তখন নীরব ছিলেন, যদিও ইসি সে সময় বলেছিলেন যে বদলির বিষয়ে কমিশনারদের জানারও প্রয়োজন নেই (প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০১৭)। আমরা মনে করি, ইসি সচিবের অবস্থান শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বিদ্যমান আইন, এমনকি আমাদের সংবিধানের সঙ্গেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

উল্লেখ্য, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তথা নিজেদের স্বার্থহানির কারণে ইসি সচিব ও অন্যান্য কমিশনারের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হলেও জনস্বার্থ সমুন্নত রাখতে তাঁদের মধ্যে তেমন কোনো উদ্যোগ ও বিরোধ পরিলক্ষিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে জালিয়াতি ঘটেছে, যেখানে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৭৩-৮৯ ধারায় বর্ণিত প্রায় সব নির্বাচনী অপরাধে প্রশাসনিক ও নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত হয়ে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছেন, সেখানে মাহবুব তালুকদারের ক্ষীণ প্রতিবাদ ছাড়া অন্য সবাই ছিলেন নিশ্চুপ। তাঁরা আরও নিশ্চুপ ছিলেন প্রশিক্ষণের নামে জনগণের অর্থ লোপাটের ব্যাপারে। তাই এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের সিইসি এবং অন্তত তিনজন নির্বাচন কমিশনার জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছেন।
বদিউল আলম মজুমদার

জনস্বার্থ জলাঞ্জলি প্রদান ও জনগণের ভোটাধিকার হরণের মাধ্যমে বর্তমান নির্বাচন কমিশন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে ফেলেছে। উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের অনুপস্থিতি তারই প্রমাণ বহন করে। তবে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার সুদূরপ্রসারী পরিণতি রয়েছে। নির্বাচনই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের একমাত্র পন্থা। তাই নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেলে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা রদবদলের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে, যা দীর্ঘমেয়াদিভাবে কারও জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না। এমনি প্রেক্ষাপটে আমরা আশা করেছিলাম যে জনগণের বিশ্বাস ভঙ্গ করার দায় মাথায় নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়েই তাঁদের সাংবিধানিক পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। কিন্তু আত্মমর্যাদাবিবর্জিত এবং নির্বাচনী, এমনকি সম্ভাব্য ফৌজদারি অপরাধে জড়িত এই কমিশন নিয়ে আমরা এখন কী করব! এ ব্যাপারে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এবার নিয়োগ-বদলি নিয়ে কমিশনের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়ে আসা যাক। অনেকেরই স্মরণ আছে যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কমিশনকে সহায়তার জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯-এর মাধ্যমে কমিশনের একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। আইনের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮ (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে উহার জন্য একটি স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন।’

আর এই স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একজন সচিবসহ বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে। অনেকের আরও স্মরণ থাকার কথা যে কমিশন যাতে নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারে, সে লক্ষ্যে ড. হুদা কমিশনের আমলে কমিশনে বেশ কিছু কর্মকর্তা নিয়োগ পান। এসব নিয়োগের উদ্দেশ্য ছিল গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে কমিশনকে দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা। বস্তুত, কমিশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্বই হলো কমিশনকে সহায়তা প্রদান। তাই তাঁদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির এখতিয়ার কমিশনেরই হওয়া আবশ্যক। কারণ, কমিশনেরই সাংবিধানিক দায়িত্ব সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। কমিশনের সচিব বা অন্য কোনো কর্মকর্তার ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি। অর্থাৎ কমিশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ‘বস’ বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন।

তবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনের ৫(১) ধারা অনুযায়ী ‘সচিব নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হইবেন’। আইনের ৪(১৩) (খ) উপধারা অনুযায়ী, সচিবের দায়িত্ব ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণের প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা’। এ ছাড়া আইনের ৪(১৩) (ছ) উপধারায় সচিবকে ‘মাঠপর্যায়ের অফিসারসমূহের প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণে’র দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। আর সচিবের এসব দায়িত্ব পালন করার উদ্দেশ্য হলো সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কমিশনকে সহায়তা প্রদান। আইনের ৪(১) ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় সকল সাচিবিক দায়িত্ব পালন করিবে এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক উহার ওপর অর্পিত অন্যান্য যাবতীয় দায়িত্ব সম্পাদন করিবে।’ অর্থাৎ সচিবেরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তিনি কমিশনের নিকট দায়বদ্ধ।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনে নির্বাচন কমিশনের কাছে এ দায়বদ্ধতার কথা আরও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। আইনের ১৪(১) ধারা অনুযায়ী, ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের যাবতীয় দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য সচিব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের নিকট দায়ী থাকিবেন’। অর্থাৎ আইনে সচিবকে সুস্পষ্টভাবে কমিশনের কাছে দায়বদ্ধ করা হয়েছে, যদিও সিইসির মাধ্যমে। তাই সিইসির অন্য কমিশনারদের পাশ কাটিয়ে সচিবকে নিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই, কারণ, কমিশন একটি যৌথ সত্তাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান (Composite body) [জাতীয় পার্টি বনাম ইলেকশন কমিশন [৫৩ ডিএলআর (এডি) (২০০১)]।

এমনকি অন্য কমিশনারদের বাদ দিয়ে সিইসি এককভাবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিতে পারেন না। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ধারা ৪ অনুযায়ী, ‘কমিশন উহার চেয়ারম্যান বা উহার কোনো কর্মকর্তাকে এই আদেশের অধীন উহার সকল বা যে কোন কর্তব্য বা দায়িত্ব পালন করিবার জন্য ক্ষমতা অর্পণ করিতে পারিবে’। অর্থাৎ পুরো কমিশন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে দায়িত্ব না দিলে তিনি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। জাতীয় পার্টি বনাম ইলেকশন কমিশন মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অধীনে যেকোনো দায়িত্ব পালন বা ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অবশ্যই কমিশন থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হতে হবে, অন্যথায় তাঁর কার্যক্রম এখতিয়ারবহির্ভূত (Coram nonjudice) হবে।’

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি বিখ্যাত রায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ক্ষমতার পরিধি আরও সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছে। পাঠকদের কারও কারও হয়তো জানা আছে যে ভারতের স্বনামধন্য সিইসি টি এন সেশন একসময় সিইসি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র কমিশনার ছিলেন। ভারত সরকার ১৯৯৩ সালে আরও দুজনকে কমিশনে নিয়োগ দেয়, যা জনাব সেশন মেনে নেননি। ফলে কমিশনে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং সিইসি নিজে ও একাধিক নাগরিক উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট রায়ে সুস্পষ্টভাবে বলেন যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, কমিশনের সভাপতি এবং “...সভাপতির দায়িত্ব হবে সভায় সভাপতিত্ব করা, নিয়মকানুন বজায় রাখা, দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করা, সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও লিপিবদ্ধকরণ নিশ্চিত করা এবং এর কার্যক্রম নির্ঝঞ্ঝাটভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে যা কিছু প্রয়োজন তা করা।...তাঁর দায়িত্ব হলো সভায় এমনভাবে আচরণ করা, যাতে তিনি তাঁর সহকর্মীদের আস্থা ও সম্মতি অর্জন করতে পারেন। একজন সভাপতি এটি অর্জন করতে সক্ষম হবেন না, যদি তিনি কমিশনের অন্য সদস্যদের তাঁর অধস্তন মনে করেন...যদি সিইসিকে ঊর্ধ্বতন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, এই অর্থে যে তাঁর কথাই চূড়ান্ত, তাহলে তিনি পুরো কমিশনকেই অকার্যকর ও আলংকারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন।’

প্রসঙ্গত, নির্বাচনসংক্রান্ত ভারতীয় ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিধান—যথাক্রমে অনুচ্ছেদ ৩২৪ এবং ১১৮ ও ১১৯—প্রায় একই রকম এবং আমাদের সংবিধানেও সিইসিকে কমিশনের সভাপতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই কমিশনে চলমান দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে সিইসি এবং সচিবের অবস্থান সম্পূর্ণরূপে আইনের পরিপন্থী।

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক.
  • কার্টসি — প্রথম আলো/  ০১ ডিসেম্বর ২০১৯

রাজধানীতে সীমিত আয়ের মানুষের টিকে থাকা কঠিন

মেহেদী হাসান

জীবনযাত্রার ব্যয় অব্যাহতভাবে বৃদ্ধির ফলে সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে রাজধানীতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাজধানীতে বসবাসকারী সীমিত আয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষ টিকে থাকার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত। নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম বৃদ্ধি অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে আলোচিত বিষয়।

সম্প্রতি অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে এ অবস্থাটা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সেবাপণ্যের দাম। এর সাথে প্রতি বছর রাজধানীতে বাড়ছে বাড়ি ভাড়া। বাড়ছে সন্তানের শিক্ষার খরচ। সব কিছু মিলিয়ে অনেকের অবস্থা করুণ। দীর্ঘ দিন ধরে রাজধানীতে বসবাসের কারণে অনেকে চাইলেও গ্রামে চলে যেতে পারছেন না।

অন্যদিকে রাজধানীতে তাদের পক্ষে টিকে থাকাও ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছে। সীমিত আয় থেকে বাড়িভাড়া, সন্তানের লেখাপড়ার মতো নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের খরচ ঠিক রাখতে গিয়ে মৌলিক চাহিদা খাদ্যের খরচও কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। বড় কোনো অসুখ না হলে ডাক্তার ও ওষুধের কথা ভাবতে পারেন না অনেকে। অনেকেই বছরের পর বছর সন্তান নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন না। পারছেন না প্রিয় সন্তানদের অনেক আবদার ও সখ পূরণ করতে।

রাজধানীতে বসবাস করলেও অনেকের আসলে গ্রামের অনেক গরিব পরিবারের চেয়েও খারাপ অবস্থার মধ্যে আছেন সেকথা কাউকে তারা বোঝাতেও পারেন না বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ। উচ্চশিক্ষিত কিন্তু সীমিত আয়ের অনেকে বলেছেন, গ্রামের অনেক গরিব ও শহরের বস্তির অনেকের চেয়েও তাদের অবস্থা খারাপ।

গ্রামের গরিব লোকজন বর্তমানে অনেক উৎস থেকে অনেক ধরনের সহায়তা পান এবং গ্রামে তেমন আর শোচনীয় গরিব মানুষ নেই। কিন্তু রাধধানীর অনেক শিক্ষিত লোকের অবস্থা বর্তমানে শোচনীয়। আর এর মূলে রয়েছে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।

পেঁয়াজের স্মরণকালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার আড়ালে বেড়ে গেছে চাল, আটা, ময়দা, তেল, আলু, চিনিসহ আরো কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম। ফলে আরেক দফা কঠিন হলো রাজধানীর সীমিত আয়ের মানুষের জীবন। অপর দিকে ঘৃর্ণিঝড়সহ দুই দফা বৃষ্টির কারণে বাজারে চলছে শীতের সবজির আকাল।

রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা ও বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এনায়েত বলেন, এক বছর আগেও মাসে বিুদ্যৎ বিল আসত পাঁচ থেকে ৬০০ টাকা করে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে ১৮ শ’ থেকে ১৯ শ’ টাকা করে। এরই মধ্যে দু’দিন আগে আবার দেখলাম সরকার বিদ্যুৎ বিল বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। গ্যাসের বিল ছিল ৫০০ টাকা। সেটা এখন সাড়ে ৯০০ টাকা। তবে সম্প্রতি মিটার বসানোয় খরচ কেমন হয় তা জানি না।

এনায়েত তার সীমিত আয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি তিন রুমের একটি বাসায় ভাড়া থাকি। প্রতি বছর এক হাজার টাকা করে বাসা ভাড়া বাড়ানো হয়। বাড়িওয়ালা এ মাস থেকে পানির বিল ৫০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা করেছেন। বিদ্যুৎ বিলের বিড়ম্বনার কথা উল্লেখ করে কাতর স্বরে তিনি বলেন, আমাদের পক্ষে মাসে দুই হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল দেয়া কেমন করে সম্ভব?

এনায়েত জানান, তার তিন সন্তান। এর মধ্যে দু’টি প্রাথমিকে এবং একজন মাধ্যমিকে পড়ে। বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর কারণে সন্তানের শিক্ষার ব্যয় তার সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেছে। কিন্তু তিনি চাইলেও এ ব্যয় কমাতে পারছেন না। তাহলে লেখাপড়াই বন্ধ করে দিতে হয় উল্লেখ করে এনায়েক বলেন, রাজধানীতে বেসরকারি স্কুল মানেই খরচ আর খরচ। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে গিয়ে অন্য অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রে খরচ বৃদ্ধির কারণে আমরা দারিদ্র্য হয়ে পড়েছি। ২৮ বছর ধরে রাজধানীতে বাস করছি। চাইলেও এখন আর গ্রামে ফিরে যেতে পারছি না। গ্রামে সে ধরনের কোনো আয়ের ব্যবস্থাও নেই। ফলে বাধ্য হয়ে কোনোমতে টিকে আছি রাজধানীতে।

এনায়েতের মতো অবস্থা রাজধানীর অনেক বাসিন্দারই। সীমিত আয়ের অনেকে জানিয়েছেন, বাড়ি ভাড়া, সন্তানের লেখাপড়াসহ কিছু নির্দিষ্ট ব্যয় ঠিক রাখতে গিয়ে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে পারছেন না তারা।

অনেকে বলেছেন, বাজার থেকে সব সময় কম দামে বেছে বেছে নিম্নমানের পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। মৌলিক কিছু পণ্য ছাড়া কখনো কোনো বাড়তি খাবার যেমন ফল, তৈরি খাবার, একটু বেশি দামের মাছ, গোশত এবং মুখরোচক কোনো কিছু সন্তানদের তারা কিনে দিতে পারেন না। সন্তানদের নিয়ে কোথাও বেড়াতেও যেতে পারেন না।

রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় অতিমাত্রায় বৃদ্ধির কারণে অনেকে যেমন পরিবার নিয়ে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছেন, তেমনি অনেকে আবার রাজধানীতে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরুই করতে পারছেন না। যদিও তারা দীর্ঘ দিন ধরে এখানে কর্মরত। অনেকে বিয়ে করলেও স্ত্রী সন্তান গ্রামে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন দীর্ঘ দিন ধরে।

গত তিন দশকের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সস্তার দিন শেষ হয়ে যায় মূলত ২০০৬ সাল থেকে। ২০০২ সাল থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম চড়া হতে থাকে। অব্যাহতভাবে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনে দুর্যোগ বয়ে আনে। বিপুলসংখ্যক মানুষের তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে পড়ে এর বিরুপ প্রভাব। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিজনিত নানামুখী সঙ্কট ক্রমে তীব্র হয়েছে রাজধানীতে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০১ সালে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে শতকরা মাত্র ১ ভাগ। ২০০২ সালে হঠাৎ করে তা ৪ ভাগে উন্নীত হয়। ২০০৫ সালে এটা বেড়ে শতকরা ৬ ভাগে দাড়ায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তখন এতটাই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পৌঁছে যে, ২০০৬ সালে শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায় জিনিসপত্রের দাম। আর ২০০৭ সালে এটা আরো বেড়ে হয় শতকরা ১৮ ভাগ।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়। ২০০১ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায় শতকরা ৫ ভাগ। আর ২০০৬ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ১৩ ভাগ। ২০০৭ সালে বাড়ে শতকরা ১৬ ভাগ। ক্যাবের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এ হার নির্ণয়ে চাল ডালের সাথে শাড়ি, লুঙ্গি, ফলসহ হরেক রকম জিনিস রয়েছে। এসব বাদ দিলে মূলত অপরিহার্য নিত্যপণের দাম বৃদ্ধির হার এ সময় অনেক বেশি ছিল।

  • কার্টসি — নয়া দিগন্ত/ ০১ ডিসেম্বর ২০১৯

‘অনিরাপদ সড়ক’ কেড়ে নিয়েছিল দুই দ্রুততম মানবকে

দেশের ইতিহাসের সেরা দুই অ্যাথলেট। দুজনেই প্রাণ হারিয়েছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায়।










অনিরাপদ সড়ক এ দেশের দুঃখ। ক্রীড়াঙ্গনেরও হাহাকার। সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছিল দুই ইতিহাস-সেরা স্প্রিন্টার শাহ আলম ও মাহবুব আলমকে। এসএ গেমসের ১৩তম আসরের শুরুর দিনে এই দুই কীর্তিমানকে সামান্য শ্রদ্ধা...

এসএ গেমস এলেই শাহ আলমের কথা খুব মনে হয়। সেটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ সাফল্য বুভুক্ষু বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে একাধিকবার জয়ের আনন্দে আনন্দিত করেছিলেন তিনি। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে পরপর দুবার রেকর্ড গড়ে সোনা জিতে দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হয়েছিলেন আলম। ইতিহাস-সেরা এই অ্যাথলেটকে আমরা হারিয়েছি বড় অবেলায়। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য অনিরাপদ সড়কের বলি হয়েছিলেন এই কীর্তিমান।

মাত্র ২৮ বছর বয়সেই এ দেশের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অথচ, দেশকে অনেক কিছুই দেওয়ার বাকি ছিল তাঁর। ১৯৯০ সালের ২৯ মে নিজের গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী থেকে মোটরসাইকেলে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। কিন্তু পথে পাবনার কাশিনাথপুরে ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারান তিনি। সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। কয়েক দিনের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলেন। গাংনীর সাহেবনগর গ্রামে বাবা-মা আর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ফিরছিলেন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা চিরদিনের জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে কেড়ে নেয় তাঁকে।

শাহ আলম নামটা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রথম উচ্চারিত হয় ১৯৮৪ সালের কাঠমান্ডু সাফ গেমসে। সেবার সাইদুর রহমান ডন, আফতাব মোল্লা, মুজিবুর রহমান মল্লিকের সঙ্গে দল বেঁধে শাহ আলম জিতেছিলেন ১০০ মিটার রিলের সোনার পদক। সেবারই ফটো ফিনিশে ১০০ মিটার স্প্রিন্টের সোনার পদকটি হাতছাড়া হয়। আফতাব মোল্লার দুর্ভাগ্য, তিনি ভারতের স্প্রিন্টার আদিল সুমনওয়ালার কাছে সোনার পদক হারান। সেই অপূর্ণতাকে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন শাহ আলম। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে শাহ আলম আদিল সুমনওয়ালার গড়া ১০.৯০ সেকেন্ডের রেকর্ডটি ভেঙে (১০.৮০) দক্ষিণ এশিয়ার নতুন ‘দ্রুততম মানব’ হয়ে দেশকে গর্বিত করেন। এখানেই তিনি থেমে যাননি। দুই বছর পর ১৯৮৭ সালে কলকাতা সাফ গেমসে নিজের রেকর্ড ভেঙে ১০.৭৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি টানা দ্বিতীয়বারের মতো ১০০ মিটার স্প্রিন্টের মুকুট নিজের করে নেন। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে স্প্রিন্টে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শাহ আলমের মাধ্যমেই।

১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে ওই মুকুটটা ধরে রাখতে পারেননি শাহ আলম। সেবার কোনো মতে ব্রোঞ্জ জেতেন। শাহ আলমের জন্য সেটি ছিল নিদারুণ ব্যর্থতাই। দ্রুততম মানবের খেতাব হারিয়ে বিচলিত আলম নিজেকে ফিরে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৯০ সালের ২৯ মে তিনি ফিরছিলেন সে বছরই বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি শুরু করতে। ইসলামাবাদে সোনার পদক হারানো শাহ আলম এশিয়ান গেমসকেই নিজের ফেরার মঞ্চ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি আর হয়নি। দুর্ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন কিনা, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি কখনোই। তাঁর মৃতদেহ শনাক্তই হয়েছিল অনেক পরে। তবে এটা ঠিক, শাহ আলমের মৃত্যু হতবিহ্বল করে দিয়েছিল গোটা দেশকে।

অনিরাপদ সড়ক শাহ আলমের মতোই কেড়ে নিয়েছিল আরেক দৌড়বিদকে। বাংলাদেশের খেলার ইতিহাস লিখতে গেলে শাহ আলমের মতোই মনে করতে হবে তাঁর কথা—মাহবুব আলম। ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ছিল তাঁর। ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ (এখন চেন্নাই) সাফ গেমসে বলা নেই, কওয়া নেই ঝড়ের বেগে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতে ফেলেছিলেন মাহবুব। শাহ আলমের একজন যোগ্য উত্তরসূরিকেই যেন সেদিন খুঁজে পেয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালে ফটোফিনিশে ২০০ মিটারের সোনা হাতছাড়া হয় মাহবুবের। কিন্তু ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। কুমিল্লা থেকে মাইক্রোবাসে করে ঢাকা ফেরার পথে কাঁচপুরের কাছে ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় মাহবুবের মাইক্রোবাসের।

এস এ গেমসের আরও একটি আসরের শুরু আজ থেকে। এমন দিনগুলোতে শাহ আলম কিংবা মাহবুব আলমরা আসেন বড় দীর্ঘশ্বাস হয়েই। আরও একজন শাহ আলম অথবা মাহবুবকে তৈরি করতে না পারার ব্যর্থতা সেই দীর্ঘশ্বাসকে আরও প্রলম্বিত করে। এস এ গেমসের অ্যাথলেটিকসে ১৪ বছর ধরে সোনা জিততে না পারা বাংলাদেশ একজন শাহ আলম অথবা মাহবুবকে খুঁজে বেড়ায় খুব করেই।

  • কার্টসি — প্রথম আলো/ ০১ ডিসেম্বর ২০১৯ 

বিষের সঙ্গে এইসব দিনরাত

আমিরুল আলম খান

গত কয়েক দিনে ঢাকার আকাশ কুয়াশার চাদরে ঢাকা। হেমন্ত, শীতে কুয়াশা থাকে। তাই তেমন বিচলিত হইনি। কিন্তু নাক-চোখ জ্বলছিল, শ্বাস নিতে কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল। ভাবছিলাম, বয়স বেড়েছে, তাই এসব লক্ষণ। কিন্তু প্রথম আলো (২৫ নভেম্বর, ২০১৯) প্রথম পাতায় একই সঙ্গে দুটি খবর আর ভেতরে সম্পাদকীয় লিখে জানিয়ে দিল আসল সমস্যা অনেক গভীর এবং তা খুবই মারাত্মক। ইফতেখার মাহমুদের রিপোর্ট, ‘ঢাকা কাল ছিল সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর’ এবং রাজীব হাসানের ‘ঢাকার গাছপালাও বড় বিপদে’, সঙ্গে সম্পাদকীয় মন্তব্য ‘কারও কি কোনো দায়িত্ব নেই? বায়ুদূষণের বাড়াবাড়ি’ পড়ে রীতিমতো ভড়কে গেলাম। রিপোর্ট দুটির শিরোনামই উদ্বেগ তৈরির জন্য যথেষ্ট।

এদিনের রিপোর্ট ঢাকার বাতাস কতটা দূষিত তার ওপর। দুনিয়াব্যাপী বাতাসে দূষণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল। নভেম্বর মাসের আট দিনের বেশির ভাগ সময় ঢাকার বাতাস ছিল সবচেয়ে দূষিত। এই তালিকায় আরও আছে কলকাতা, দিল্লি, করাচি, বেইজিং, উলানবাটোর। এসব শহরের দূষণের মাত্রা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যায় প্রায়ই।

কিন্তু দুশ্চিন্তার আরও কারণ আছে। শুধু ঢাকা নয়, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, সাভার, ময়মনসিংহ, রংপুরের বাতাসের মানও খুব খারাপ ছিল এদিন। বোঝা যাচ্ছে, সারা দেশের বাতাস মাত্রাতিরিক্ত দূষিত। কোনো নির্দিষ্ট স্থানের বাতাসের মানের সূচক ২০০-এর বেশি হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। ঢাকায় এদিন বাতাসের গড় মান ছিল ২২০; কিন্তু কারওয়ান বাজারে তা ছিল ভয়াবহ মাত্রায় বেশি, ২৯৮! আন্তর্জাতিক হিসাবে বাতাসে দূষণের মানের এই সূচক ২০০ ছাড়ালে ঘরের জানালা বন্ধ রাখা, সাইকেল না চালানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া মাস্ক ছাড়া বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়। খুব জরুরি না হলে শিশু ও বৃদ্ধদের বাইরে যেতেই নিষেধ করা হয়।

দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০১৯-এর তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে শুধু দূষিত বাতাসের কারণে অন্তত ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ মারা গেছে! অন্য এক তথ্য বলছে, বাতাসের দূষণে মৃত্যুর দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীতে পঞ্চম। ঢাকা শহরে বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি!

ঢাকার বাতাসদূষণের জন্য মূলত শহরের আশপাশের ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের ধুলা দায়ী। কিন্তু এসব নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই বলাই ভালো। বিপর্যয় মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষের যে উদ্যোগ আয়োজন থাকা দরকার, তা তেমনভাবে নেই। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশও তামিল হয় না এ দেশে। প্রথম দরকার শহরে এবং সারা দেশে প্রচুর পরিমাণ বৃক্ষের সমারোহ এবং বিস্তৃত জলাশয়। তাহলে এসব দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে মোট বন এলাকা দেশের ভূ-ভাগের ৬-৭ শতাংশ মাত্র, যা হওয়া উচিত অন্তত ২৫ শতাংশ। আর নদীমাতৃক বাংলাদেশে এখন পানির বড়ই অভাব। ঢাকা শহরে সামান্য কিছু লেক আছে বটে; কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অতি নগণ্য। তা ছাড়া এসব লেকের পানিও এমন দূষিত যে সেদিকে তাকাতেও ভয় হয়।

ধানমন্ডি, গুলশান, এমনকি এত ঢোল পেটানো হাতিরঝিলের পানিও ভীষণ দুর্গন্ধ, চরম দূষিত। দূষিত ঢাকা শহরের চারপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের পানি। এত দূষিত যে কোনো জলজ প্রাণীও এসব নদ-নদীতে বাঁচতে পারে না। আলকাতরার মতো কালো রং সেই পানির। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ভরাট করা হচ্ছে অন্যান্য জলাশয়, নিচু ভূমি, খাল, নদী। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স তথ্য দিচ্ছে, ২০১০ সালের ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) নির্ধারিত জলাভূমির ২২ শতাংশই ২০১৯ সালের মধ্যে ভরাট করা হয়েছে। তথ্য আরও বলছে, ঢাকার বাতাসে ইটভাটা থেকে ৫৮ শতাংশ, রাস্তা ও মাটির ধুলা এবং মোটরগাড়ির কালো ধোঁয়ায় প্রায় ২৬ শতাংশ দূষণ ঘটে। বাকিটা অন্যান্য বর্জ্য সূত্রে দূষিত হয়।

অন্যদিকে সবুজ গাছের বেষ্টনী কমতে কমতে প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে। গত কয়েক বছরে বনানী থেকে উত্তরা পর্যন্ত এলাকায় লাখ লাখ বৃক্ষ সাবাড় করা হয়েছে উন্নয়নের নামে। অন্যত্রও একই চিত্র। কিন্তু এই নির্বিচার বৃক্ষ নিধনযজ্ঞের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক কেবল লুটপাটের। সবকিছুই হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে। কিন্তু বিকল্প কিছুই গড়ে তোলা হয়নি। দূষণের মাত্রা কত ভয়াবহ আকার নিয়েছে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। ঢাকায় এখন সুস্থ সবল কোনো গাছ খুঁজে পাওয়া কঠিন। শুধু ঢাকার কথাই বা বলি কেন, গোটা দেশের অবস্থা কমবেশি একই রকম।

গাছের এমন বিবর্ণ দশা শুরু হয়েছে অনেক বছর আগে থেকেই। এ নিয়ে প্রচুর রিপোর্ট কাগজে ছাপা হয়েছে, টিভিতে দেখানো হয়েছে। কিন্তু টনক নড়েনি কারও। ঢাকা শহরে এবং দেশের জাতীয় সড়কগুলোর পাশের গাছগুলোর মরণদশার শুরু অনেক আগে থেকেই। পাতার ওপর ধুলা জমে প্রথমে তার খাবার তৈরিতে বাধার সৃষ্টি করে। এরপর পানির অভাবে তার খাবারে টান পড়ে আরও বেশি বেশি। এরপর নানা টক্সিক উপাদান গাছের জীবন বিপন্ন করে তোলে।

গাছ কমে গেলে অক্সিজেন তৈরিও কমে যায়। ফলে জীবনদায়িনী অক্সিজেনের অভাবে বিপন্ন হয় অন্য সব প্রাণীও। শিল্পবিপ্লবের পর পৃথিবী এত দূষিত হয়ে উঠেছে যে তার অস্তিত্বই এখন বিপন্ন। ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে এই গ্রহের তাপমাত্রা। মানুষ তাই শঙ্কিত। জীবের জন্য পানি অপরিহার্য। পানির নিয়মিত সরবরাহ বিঘ্নিত হলে প্রাণ বিপন্ন হবেই। নগর পরিকল্পনায় তাই জলাশয় ও সবুজ গাছের বেষ্টনী অতি আবশ্যকীয় শর্ত। গাছের নিয়মিত পরিচর্যাও। বৃষ্টির পানি ছাড়াও তাই জলসিঞ্চন নগরকর্তাদের নিয়মিত দায়িত্ব। উপযুক্ত বৃক্ষ নির্বাচন, পরিকল্পিত বৃক্ষায়ণ এবং পরিচর্যা ছাড়া কোনো নগর টিকে থাকতে পারে না। আমাদের দেশে সুপ্রাচীন কাল থেকে শাসকদের অন্যতম কাজ ছিল জলাশয় সংরক্ষণ ও বৃক্ষ পরিচর্যা। মোগল সম্রাটেরা হিন্দুস্তানে বৃক্ষ রোপণ ও পরিচর্যায় দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিল। বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তুলতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রাউড লককে। তিনি ছিলেন লন্ডনের কিউ গার্ডেন এবং কলকাতা বোটানিক গার্ডেনের কিউরেটর। এখনো রমনা এলাকায় মিন্টো ও হেয়ার রোডে প্রাউড লকের বৃক্ষসজ্জা কিছুটা টিকে আছে।

নিয়মিত জলসিঞ্চনের জন্য মাটির তল দিয়ে পাইপ বসিয়ে ফোয়ারায় গাছের পাতার ওপর পানি দিয়ে ধুয়ে দেওয়া সারা দুনিয়ায় এক সাধারণ দৃশ্য। এর ফলে একই সঙ্গে অনেক কাজ হয়। ধুলো ধুয়ে যায়, গাছপালা দরকারি পানি পায়, শহরের তাপমাত্রাও কমে। কিন্তু আমাদের নগরপিতারা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন বলেই মনে হয়। প্রসঙ্গত আরেকটি কথা, শুধু ঠিকাদার দিয়ে কাজ চলে না। আর ঠিকাদার যদি অসৎ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। নগরবৃক্ষের তালিকা তৈরি করা উচিত বিশেষজ্ঞ দিয়ে। তাঁরাই নকশা করে দেবেন, কোথায় কোন কোন গাছ কেমনভাবে লাগাতে ও পরিচর্যা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নগর বৃক্ষায়ণ ও পরিচর্যা একটি বিজ্ঞান। আমলা, ঠিকাদার দিয়ে এ কাজ হয় না।

  • আমিরুল আলম খান: যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
  • কার্টসি — প্রথম আলো /৩০ নভেম্বর ২০১৯