Search

Sunday, August 9, 2020

চীন-ভারত ও শহীদ জিয়ার পররাষ্ট্রনীতি

— সৈয়দ ইজাজ কবির 

সৈয়দ ইজাজ কবির 

১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি’ গঠনের ঘোষণা দেন এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদেরকে এ দলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে দলকে শক্তিশালী সংঠন হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এর প্রায় চার সপ্তাহ আগে বিভিন্ন শ্রেণীর নাগরিকদের জন্য বঙ্গভবনে এক নৈশভোজে তিনি জাতীয় ঐক্য, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিষয়ে তাঁর ধ্যানধারণা তুলে ধরে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ইঙ্গিত দেন। তারই ধারাবাহিকতায় বিএনপি গঠিত হয়। ভিন্ন মতাদর্শের হলেও, যারাই দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, তাদের কে নিয়ে দল গড়াই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য।

ফলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদেও আদর্শিক ভিত্তি রচিত হয় ও বিস্তার লাভ করে এবং এ দেশের জনগন তা খুব সহজেই আপন করে নেয়। জনগন বুঝতে পারে, বাঙালী জাতীয়তাবাদ এ দেশের মানুষের খণ্ডিত পরিচয় তুলে ধরে, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি রক্ষা করে না এবং সার্বিকভাবে বিশ্বের কাছে দেশ হিসেবে নিজের স্বকীয়তা উপস্থাপন করে না। সেই আদর্শকে সম্পূর্ন রূপ দিতেই রচিত হয় উন্নয়নের ম্যাগনাকার্টা ১৯ দফার। ১৯ দফার ১৬ নম্বর দফায় বলা আছে — “সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা।” 

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন।”

১৯৭৮ সালে শহীদ জিয়া স্বচ্ছতার স্বার্থে এই অনুচ্ছেদটি সংবিধানে যোগ করেন। আমাদের সংবিধানে আরো একটি শর্ত যোগ করা আছে, আর তা হলো “জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোন চুক্তি কেবলমাত্র সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।” সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে, যা হোক, যেভাবেই হোক, আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে পেশ করতেই হবে। আর তা না হয়ে থাকলে বাংলাদেশের আইনের চোখে বলবৎ যোগ্য চুক্তি বলে গণ্য করা সম্ভব নয়। সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের সাথে আন্তর্জাতিক অঙ্গন ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক চুক্তি ভূরাজনীতিতে সামগ্রিকভাবে গুরুত্ব রাখে। বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার চুক্তিগুলো আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন দেশের সম্পর্কের ধরণ ও গতিপ্রকৃতি, বিশেষ করে প্রতিবেশি বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের সাথে আমাদের অম্লমধুর সম্পর্কটা বুঝতে হলে একটু ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে।

শেখ মুজিবের শাসনামলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘেঁষা। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ-সোভিয়েত সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি হয়। সোভিয়েতরা বাংলাদেশে ব্যবহৃত তাদের সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। জিয়ার সরকার সে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে, আর সম্ভবত সে কারণেই মুজিব আমলে মস্কোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হকের নিয়োগ বাতিল করেননি।

স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি, জাতিসংঘ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা এবং কমনওয়েলথ-এর সদস্যপদ লাভের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীন ভূমিকা পালন করা সহজ হয়ে ওঠে।

পররাষ্ট্রনীতির বিষয়েও শহীদ জিয়ার নিজস্ব ধ্যান ধারণা ছিল। তা হলো বাংলাদেশ যেন নিজের পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন বলেই তার এমন আকাঙ্খা ছিল। জিয়া পররাষ্ট্রনীতিকে খুব সরলীকরণ করে দেখতে পারতেন। তাঁর কাছে পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় জিনিস ছিল জাতীয় সত্ত্বা অক্ষুন্ন রেখে জাতীয় স্বার্থরক্ষা ও তা হাসিল করতে পারা। 

জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির তিনটি মূল লক্ষ্য ছিল — ১. স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত এবং নিরাপদকরণ ২. দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা এবং ৩. আন্তর্জাতিকভাবে শান্তি, স্বাধীনতা এবং প্রগতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে উন্নত করা। কোন এক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব রাখা জিয়ার নীতিতে ছিল না। জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন মাত্রা ও গতি যুক্ত হয় এবং তা সারা বিশ্বে ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। চীন, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। যার ফলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে দরকষাকষি করা বাংলাদেশের জন্য অনেকটা সহজ হয়ে যায়। পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে উন্নত সম্পর্কের ফলে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ উন্মোচিত হয়। জিয়া বিশ্বাস করতেন, পররাষ্ট্রনীতি সকল সময়ে একটি গতিশীল প্রক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও জাতীয় স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল। তিনি এক বিদেশি সাংবাদিককে একবার বলেছিলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বহুমুখী, যার অর্থ বন্ধুত্বের মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। তিনি আরো বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জাতীয় উন্নয়নের জন্য এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা খুবই জরুরি।

কোন ক্ষমতার ব্লকে যোগদান না করে এ অঞ্চলের সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমেই এটা সম্ভব। এতে বুঝা যায় জিয়া বাংলাদেশের জন্য সকলের সঙ্গে সম্পর্কের পররাষ্ট্রনীতিতে (Inclusive foreign policy) বিশ্বাস করতেন। আর তাঁর প্রমাণ, জিয়ার উদ্যোগে পরবর্তীতে সার্ক (SAARC) প্রতিষ্ঠিত হওয়া। 

জিয়ার স্বাধীন অবস্থান ভারতকে বিচলিত করে রাখতো, সেই  প্রমাণ দেখা যায় জিয়ার দিল্লি সফরের সময়। ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লি সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জিয়ার কাছে জানতে চান, কেন বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে বস্ত্র শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, দিল্লী সফর শেষে জিয়া ঢাকা ফেরার এক মাসের মধ্যেই এখানে ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের যন্ত্রপাতির একটা প্রদর্শনী করা হয়। হাস্যকর হলেও সত্য যে এই ২০১৮ সালেও ভারত বস্ত্রশিল্পের যন্ত্রপাতি রপ্তানী করতে কতটুকু সফল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত, তা এখনও নিশ্চিত নয়। অথচ ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ইন্দিরা গান্ধীর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় এই বস্ত্রশিল্প যন্ত্রপাতি অন্য দেশ থেকে আমদানি করার জন্য। জিয়া আন্তর্জাতিক মহলে কোন দেশের সাথে বৈরিতা চাননি যার ফলে ভারত সফরের এক মাসের মধ্যেই তিনি ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের যন্ত্রপাতির একটি প্রদর্শনী করার বন্দোবস্ত করেন বাংলাদেশে। 

বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে জিয়া তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ১৯৭৬ সালে ইসলামিক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সপ্তম সম্মেলনে (আইসিএফএম) যোগ দিয়েছিলেন এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক সংহত করতে সফল হয়েছিলেন। তিনি ফারাক্কা বাঁধ প্রশ্নে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সমর্থন আইসিএফএম-এর যৌথ ইশতেহারেও প্রতিফলিত হয়েছে। ৫ম জোটনিরপক্ষ আন্দোলন (ন্যাম)-এ ১২ সদস্যের এক প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে ১৯৭৬ সালে কলম্বো যান তিনি। সে সময় তিনি অনেক বিশ্বনেতাদের সঙ্গে একক বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু বহু কূটনৈতিক চেষ্টা সত্ত্বেও সেই সময় কলম্বোয় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে জিয়ার আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি। জিয়া যখন প্রথম ভারত সফরে যান তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মোরারজী দেশাই। কিন্তু ১৯৮০ সালের আগে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে জিয়ার কোন আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি।

ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে জিয়া পানি বণ্টনের বিষয়টি উত্থাপন করেন, যা ভারতের কাছে অগ্রহনযোগ্য ছিল। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে ভারত যে সিকিম দখল করে নেয়, সেটাও ন্যাম নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করেননি।

জিয়ার শাসনামলে চীনের সাথে সম্পর্ক ছিল অতি উষ্ণ ও শক্তিশালী। জানুয়ারি ২, ১৯৭৭, জিয়া চীনের রাজধানী বেইজিং পৌঁছলে তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধার এক অসাধারণ প্রকাশ হিসেবে রাষ্ট্রাচারের আনুষ্ঠানিকতা উপেক্ষা করে জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে চায়না কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান হুয়া গুয়ো ফেং বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। যখনি বাংলাদেশে কোন সংকট উপস্থিত হয়েছে, বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছে। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি জিয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিচালনা করতেন। বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশি ভারত। আর চীনের সাথে রয়েছে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত। আর এ কারনেই জিয়ার বুঝতে দেরি হয়নি যে এই উপমহাদেশে চীনের ভূমিকা কতোটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানও চীনের জন্য কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের সাথে জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকাকালেই, দুদেশের সহযোগিতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো সংস্কৃতি, অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা ও বিশ্ব রাজনীতি। সেই সময় গংগার পানি ভাগাভাগি ও সীমান্তের ওপার থেকে চালানো সশস্ত্র হামলার ইস্যু দুটি জিয়ার জন্য অতিশয় গুরত্বপূর্ণ ছিলো। বেইজিং বৈঠকগুলোতে তিনি সীমান্ত এলাকায় সশস্ত্র হামলার কথা উত্থাপন করেন এবং দুষ্কৃতকারীদেও দমনে চায়নার নেতারা তাঁকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। ইরানের সাথেও বাংলাদেশের ছিল একটি শক্তিশালী সম্পর্ক। ১৯৭৭ সাল থেকে জিয়ার ধারাবাহিকভাবে চালানো বিভিন্ন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশের সাথে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সাথেই গড়ে উঠে সুসম্পর্ক।

ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেন জানি সব সময় টক, ঝাল আর মিষ্টি মিশ্রিত। জিয়া নিহত হওয়ার প্রায় তিন সপ্তাহ আগে ভারত কে নিয়ে এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ৯ মে ১৯৮১ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ তালপট্টিতে সেনা অবতরণ ঘটানো হয়। বাংলাদেশ এতে বিস্ময় প্রকাশ করে নয়া দিল্লিকে অনুরোধ জানায় যাতে তারা ঐ দ্বীপ থেকে অবিলম্বে পতাকাসহ সৈনিক ও মালামাল সরিয়ে নেয়। এই ঘটনায় সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে অকুন্ঠ সমর্থন পেলেও তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামীলীগ ঘটনাটির ব্যপারে অতি সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করে। 

এই ঘটনার আগে, সেপ্টেম্বর ৩, ১৯৮০, সাউথ ব্লকে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে জিয়ার আধাঘন্টারও বেশী সময় ধরে একান্ত আলাপ হয়। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচ্যসূচিতে ছিল মূলত গঙ্গার পানি বন্টন, ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি এবং বাংলাদেশে সফরে আসার জন্য ইন্দিরাকে আমন্ত্রণ জানানোর মতো দ্বিপাক্ষিক বিষয়াবলি এবং ছয় জাতি শীর্ষ সম্মেলনের জন্য জিয়ার প্রস্তাব। বৈঠকের আগে ভারতীয় পক্ষ জানিয়েছিল, ইন্দিরা গান্ধী দক্ষিণ তালপট্টি ইস্যু নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নন।


বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী 

জানুয়ারি ২১, ১৯৮০, বেগম খালেদা জিয়াসহ প্রতিনিধিদল নিয়ে জিয়া ভারতে এক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। জিয়া বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনি বিভিন্ন ইস্যু ও সমস্যা নিয়ে বন্ধুত্বপুর্ণ পরিবেশে বৈঠক করেছেন। কিন্তু ড. আর এ গনির কথায় একটু ভিন্ন সুর পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “দিল্লি থেকে ফেরার পর জিয়া মিসেস গান্ধীর সঙ্গে তাঁর আলোচনা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। জিয়া তাঁদের জানান যে মিসেস গান্ধী তাঁকে বলেছেন, ‘আমারা অখণ্ড ভারতের ধারণা বাদ দেইনি, কাজেই আপনারা ওভাবেই চলুন’। একথা মন্ত্রিসভার কার্যবিবরণীতে তোলা হয় নি। কিন্তু তাঁর মন্ত্রীরা এখনো একথা স্মরণ করতে পারবেন।

সার্বিকভাবে যদি জিয়ার রাজনীতি পর্যালোচনা করা যায় তাহলে সন্দেহাতীত ভাবে বলা যাবে, জিয়া ছিলেন একজন খাঁটি বাংলাদেশপন্থি। এরকম উস্কানিমূলক কথা বলার পরেও তিনি ভারত কে চটান নি। আবার তাদের কাছে নিজেকে বিকিয়েও দেননি।

জিয়া মনে করতেন, দেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা নিশ্চিত করাই বিএনপি‘র পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য। জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশ পঞ্চাশটিরও অধিক মুসলিম দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। ইউরোপও বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জিয়া যে অবদান রেখে গেছেন সে ব্যাপারে হেনরি কিসিঞ্জরের সেই কথাটি প্রযোজ্য — ‘যে কোন দেশেই, যে সব পররাষ্ট্রনীতিকে ইতিহাস উচ্চ মর্যাদা দিয়েছে তাদের বেশির ভাগ এসেছে সেই সব নেতার কাছ থেকে, বিশেষজ্ঞরা যাঁদের বিরোধিতা করেছিলেন।” জিয়া আমদের দুই প্রতিবেশির সাথেই সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেছেন এবং সফল ও হয়েছেন। ভারতের বাঁকা কথাতেও জিয়া বৈরী সম্পর্ক হতে দেননি এবং ন্যায্য দাবী আদায়ও করেছেন।


আবার চীনের সাথেও শক্তিশালী বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়েছেন। সূত্র একটি, স্বাধীনভাবে চলা এবং সবাইকে বন্ধুসুলভ সম্মান দেওয়া। বুদ্ধিমত্তার সাথে সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। বর্তমান পরিস্থতিতে আমাদের আবার সময় এসেছে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একটু ভেবে দেখবার। দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, আর কোন দিকে

যাওয়া উচিৎ, এটা না হয় পাঠকেরাই ভেবে দেখবেন। এটাকেই বলা হচ্ছে, ‘পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি’ যা পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে একটি নতুন ধ্যানধারণা।


  • লেখক  আইনজীবি ও রাজনৈতিক কর্মী 


জেনারেল জিয়া ও গণতন্ত্রের বন্ধ দুয়ার খোলার রাজনীতি

সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া 

সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া 

একটা বিষয় অনেকদিন ধরে ভাবাচ্ছিলো। সামরিক শাসকদের রাজনীতি তো তাদের মৃত্যুর পর টিকে থাকার কথা না। পৃথিবীর তাবৎ ইতিহাস তাই বলে। কিন্তু বাংলাদেশে জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাজনীতি তার মৃত্যুর পরও এতদিন টিকলো কেন?! 

চলুন দেখা যাক —

১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। বাকশাল এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। চারটি সংবাদপত্র বাদে সবগুলো সংবাদ পত্রের সার্কুলেশন বাতিল করা হয়। অর্থাৎ গণতন্ত্রের বিচারে একটি চরম স্বৈরাচারি ব্যবস্থা! অবিশ্বাস্য সব গণবিরোধী সিদ্ধান্ত! ট্রাজেডি হচ্ছে সারাজীবন গণতন্ত্রের সংগ্রাম করা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩-এর নির্বাচনে নিজ দলের ভোট ডাকাতি বন্ধ করতে পারলেন না, উল্টো ১৯৭৪ সালে গণতন্ত্রেরই কবর রচনা করলেন! যুক্তি দেওয়া হতো যে সেগুলো ‘প্রয়োজনীয়’ ছিলো। হয়তো প্রয়োজনীয়ই ছিলো, কিন্তু গণতন্ত্র হত্যার অভিযোগ তো ঠিকই! মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের অভিযোগটি তো শতভাগ সত্য! বঙ্গবন্ধুর এই চরম হঠকারি সিদ্ধান্তগুলোর মাঝেই জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাজনীতি টিকে থাকার মন্ত্র লুকিয়ে আছে।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম 

জেনারেল জিয়াউর রহমান যে দেশ পেয়েছিলেন, যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন সেটি সম্পূর্ণ গণতন্ত্রহীন, নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারি এক ব্যবস্থা। জনগণের দমবন্ধ করা এক পরিবেশ। সেখানে উর্দি পরা জেনারেল জিয়ার হাত ধরে বাংলাদেশে পুনরায় গণতান্ত্রিক রাজনীতি শুরু করতে হয়েছিলো! সংবাদপত্রগুলো পুনরায় মুক্তভাবে লিখার স্বাধীনতা পেলো। সত্যিকার স্বাধীনতা কতটুকু পেলো সে বিতর্ক করাই যাবে কিন্তু ‘স্বাধীনতা’ তো পেয়েছিলো! জিয়াউর রহমানের গণতন্ত্র কতটুকু নিয়ন্ত্রিত ছিলো সেটিও নিশ্চয়ই বিচার্য বিষয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র বাকশাল থেকে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রও ছিলো মানুষের অধিকারের এক উল্লম্পন, একটুখানি অগ্রগতি। এটি কি অস্বীকার করা যাবে?! দুনিয়া জুড়ে জেনারেলরা ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে, রাজনীতি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে সামরিক জেনারেল জিয়াই কী বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বন্ধ দুয়ার খুলে দেয়নি? হ্যাঁ গণতন্ত্রের ফাঁক গলে মুসলিম লীগ, জামায়াত রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হয়েছিলো, কিন্তু ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যে আওয়ামী লীগ বাকশালে বিলুপ্ত হলো সে আওয়ামী লীগও আবার জিয়াউর রহমানের গণতন্ত্রে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ পায়নি? নিয়তির নির্মম পরিহাস!

জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত সততা কিংবা প্রশাসক হিসেবে অনেক যোগ্যতার কথা বলা হয়, কিন্তু আমার বিবেচনায় জিয়াউর রহমানের রাজনীতি টিকে যাওয়ার মূলমন্ত্র মানুষকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া এবং শেখ হাসিনার রাজনীতির শেষটাও একই কারণে হবে: ‘মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া’।

পুনশ্চ: যে পারিবারিক আবহে বড় হয়েছি তাতে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ভিলেন হিসেবে দেখা হতো। পারিবারিক আলোচনায় জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের সকল অপকর্মের ‘হোতা’। ‍দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাও সে ‘চেতনার’ পক্ষপাত থেকে চিন্তাকে মুক্ত করতে পারেননি। অবশেষে আমেরিকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নিজের বায়াসকে প্রশ্ন করা শিখতে হলো! মানুষের চিন্তার নৈর্বক্তিকতা ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে যে কয়টা বিষয় আদিপাপ হিসেবে কাজ করে তার মধ্যে পরিবার একটা। বাকীগুলো সমাজ, বলয়, বন্ধুত্ব, ধর্ম, সংস্কৃতি উদ্ভূত। একটি আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষের এসব পক্ষপাত (বায়াস) দূর করে তাঁকে একটি নির্মোহ, নৈর্বক্তিক মন গড়ে দেওয়ার কথা যেখানে সে সবকিছুকে প্রশ্ন করতে শিখবে। এভাবেই সে সত্য খুঁজে নিবে। প্রশ্ন করা না শিখলে সত্য মিলবে কী করে?!


Saturday, August 8, 2020

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করুন

ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম 

ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম

উনপঞ্চাশ বছর পরও স্বাধীনতাত্তোর সরকারের মত বর্তমান শাসকগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক নতুন সংস্করণের চর্চা শুরু করেছে। যেখানে অপশাসন-দুঃশাসন, বন্ধুকযুদ্ধ-ক্রসফায়ার, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ব্যাংক ডাকাতিসহ জনগণের নাগরিক স্বাধীনতা, ভোটাধিকার, মৌলিক ও মানবাধিকার খর্ব হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি, সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে কক্সবাজারের টেকনাফ থানা পুলিশ কর্তৃক হত্যার পর কথিত বন্ধুকযুদ্ধ-ক্রসফায়ারের কল্পকাহিনী তৈরি করা হয়েছে। গত ২২ মাসে কক্সবাজারে পুলিশের সঙ্গে তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ১৭৪ জন। পুরো সময়টাতেই টেকনাফ থানার অফিসার্স ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন প্রদীপ কুমার দাশ। 










এখন টেকনাফ থানা ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ জন্য দেশে আলোচিত। ক্রসফায়ারের বেশির ভাগই ঘটেছে মেরিন ড্রাইভ এলাকায়। স্থানীয়দের কাছে জায়গাটি ‘ডেথজোন’ হিসেবে পরিচিত। ইয়াবা চোরাচালান বন্ধের নামে এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করা হয়েছে। আর এসব ক্রসফায়ারে নিহতদের ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে প্রচার করে ওসি প্রদীপ নিজে কৃতিত্ব নিতেন। কিন্তু ইয়াবা চোরাচালান থেমে নেই। তবে টেকনাফের মানুষ বলছেন, তিনি মূলত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষার জন্য এসব ক্রসফায়ার দিতেন। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠতা। ইয়াবা ব্যবসায়ী সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদির সঙ্গেও ছিল তার দারুণ সখ্য। বদির সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের বিভিন্ন ছবি ঘুরছে সামাজিক মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, এসব ক্রসফায়ার দিয়ে একাধিকবার অর্জন করেছেন পুলিশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদক। কথিত এই ক্রসফায়ারের জন্য ২০১৯ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক’ বা বিপিএম পেয়েছিলেন প্রদীপ। পদক পাওয়ার জন্য তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ছয়টি কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ করেন। সব ক’টিতেই ক্রসফায়ারের ঘটনা ছিল। মানবাধিকার সংস্থা ও পুলিশের তথ্য মতে, ২০১৮ সালের মে থেকে গত ৩০শে জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজারে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি’র সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২৮৭ জন নিহত হয়। এর মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ১৭৪, র‍্যাবের সঙ্গে ৫১, বিজিবি’র সঙ্গে ৬২ জন নিহত হয়। শুধু টেকনাফেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে ১৬১ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য মতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে ১৬৭৭ জন। ২০১৯ ছয় (জানুয়ারি থেকে জুন) মাসে দেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ২০৪ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। বন্ধুকযুদ্ধ-ক্রসফায়ার, মিডনাইট নির্বাচন, করোনাভাইরাস, ক্যাসিনো, দুর্নীতিবাজ, প্রতারক, লুটেরা, বাটপার, দেহব্যবসায়ী, সিন্ডিকেট, গডফাদার, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সন্ত্রাস ও গুম-খুনের কারনে রাষ্ট্র ব্যবস্থা একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের কোন প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এখন আর নাই। এরপরও যদি বলা হয় দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাহলে বর্তমানে যে তথাকথিত সুশাসন ও আইনের শাসন চলছে, এটা কতটা নিম্নমুখী হলে মানুষ জাগ্রত হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল লক্ষ্য ছিল —  সুশাসন, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ, এক উদারচেতা, পরমতসহিষ্ণু, সংস্কৃতিমনা সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সুখী-সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশ গড়তে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বর্তমান নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, তানাহলে এসব থেকে কারও পরিত্রাণ নেই। এটা শুধু বিরোধী দলের একার কাজ নয়। 

  •  লেখক সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র । 


Wednesday, August 5, 2020

কর্মিষ্ঠ পুরুষ রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান

আতিকুর রহমান রুমন

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম করমর্দন করছেন রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান'র সাথে


‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাই তুমি করে গেলে দান।’ কর্মিষ্ঠ পুরুষ রিয়ার এডমিরাল এম এ খানের ক্ষেত্রে এ কথা যথার্থভাবেই খাটে। বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যোগাযোগ উপদেষ্টা, কৃষিমন্ত্রী ও নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান কর্মগুণে ও চারিত্রিক মাধুর্যে আমাদের রাজনীতিতে নক্ষত্র সদৃশ। তার অস্তিত্বজুড়ে ছিল যেমন অখ- কর্মপ্রেরণা, তেমনি ছিল সততা ও দেশপ্রেমের বিরলদৃষ্ট চেতনা। তিনি বলতেন, ‘সততা ছাড়া দেশপ্রেম মূল্যহীন, সততা নিয়েই দেশের জন্য কাজ করে যেতে হবে।” বাস্তবিকই স্বল্পপরিসর জীবনের সর্বস্তরে তিনি তার এই চেতনারই বাস্তবায়ন করে গেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। আর এই কর্মগুণেই তিনি দেশের মানুষের অতি প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন জীবনের শেষ দিনগুলোতে। নিজ জীবনে যেমন সততাকে সঙ্গী করেছিলেন, তেমনি অন্যদেরও সৎ থাকার উপদেশ দিতেন। কঠোর শৃঙ্খলাবোধ ও সময়ানুবর্তিতা ছিল তার চরিত্রের বিশেষ ভূষণ। কর্তব্যকর্ম যথাসময়ে সম্পাদনে নিজে যেমন ছিলেন নিষ্ঠাশীল, সহকর্মীদেরও তেমনটি করার প্রেরণাও পরামর্শ দিতেন। এভাবেই তিনি সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে অতি সম্মানিত ও আপন মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আর দেশের উন্নয়নে রেখেছিলেন অমূল্য অবদান।

বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী ও গৌরবময় পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারক রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর সিলেটের বিরাহীমপুরের সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত মুসলিম পরিবারে। তৎকালীন ভারতের (১৯০১ সালে) প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার আহমেদ আলী খান তার পিতা। আহমেদ আলী খান ছিলেন নিখিল ভারতের আইন পরিষদের সদস্য-এমএলএ ও আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আহমেদ আলী খান তিনটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। তিনি ছিলেন হায়দরাবাদ নিজামের প্রধান আইন উপদেষ্টা।

অন্যদিকে অবিভক্ত বিহার, আসাম ও উড়িষ্যার জমিদার পরিবার খান বাহাদুর ওয়াসিউদ্দিন আহমেদের কন্যা যুবাইদা খাতুন ছিলেন মাহবুব আলী খানের মা। আর যুবাইদা খাতুনের দাদা ব্রিটিশদের থেকে অর্ডার অব এমপায়ার খেতাব পান। ১৮৯৭ সালে ভারতে চতুর্থ মুসলিম হিসেবে আইসিএস লাভ করেছিলেন চাচা গজনফর আলী খান। গজনফর আলী খান ১৯৩০ সালে অর্ডার অব এমপায়ার খেতাব পান।

এম এ খানের দাদা ছিলেন ভারতের বিশিষ্ট চিকিৎসক খান বাহাদুর আজদার আলী খান। তিনি বিহার ও আসামের দারভাঙ্গা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও পাটনা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। ১৯২৪ সালে তিনি সিলেটে নাফিজাবানু চ্যারিটেবল হাসপাতাল ও ১৯৩০ সালে ম্যাটার্নিটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।

এম এ খানের পিতা আহমেদ আলীর মামা জাস্টিস আমীর আলী কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। দাদা খান বাহাদুর আজদার আলী ছিলেন সৈয়দ আমীর আলীর জামাতা। স্যার সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন ইংল্যান্ডের রয়্যাল প্রিভিকাউন্সিল সদস্য ও ইন্ডিয়ান ভাইসরয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল সদস্য। স্যার সৈয়দ আমীর আলীর বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব সারাসেন’ ও ‘স্পিরিট অব ইসলাম’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন এম এ খানের চাচাতো ভাই। শের-ই-সিলেট ও অবিভক্ত পাকিস্তানের মন্ত্রী মরহুম আজমল আলী চৌধুরী ছিলেন তার চাচাতো ভাই।

দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে এমএ খান ছোট। বড়বোন সাজেদা বেগম। মেজভাই চিকিৎসক সেকেন্দার আলী খান। সেকেন্দার আলী খানের মেয়ে আইরিন খান অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল।
রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান
 নভেম্বর ৩, ১৯৩৪ – আগস্ট ৬, ১৯৮৪ 

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, সিলেটের বিরাহীমপুর, কলকাতা ও পুরান ঢাকার ৬৭ পুরানা পল্টন লাইনের বাড়িতে এমএ খানের শৈশব ও কৈশোর কাটে। কলকাতা ও ঢাকায় তার প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ হয়। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন শান্ত, ধীর আর চিন্তাশীল। সুদর্শন, উন্নত শারীরিক গঠন ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ অভিব্যক্তির কারণে সবার প্রিয় ছিলেন তিনি। খেলাধুলাও করতেন। ব্যাডমিন্টনে ছিলেন পারদর্শী। প্রতিদিন সকালে নামাজ আদায় করে পবিত্র কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করতেন। যেকোনো কাজের আগে স্মরণ করতেন আল্লাহকে। ছিলেন খাদ্যরসিকও। গলদা চিংড়ি, ইলিশ মাছ পছন্দ করতেন খুব।

১৯৫৫ সালে ২১ বছর বয়সে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন সৈয়দা ইকবালমান্দ বানুর সাথে। তাদের দুই কন্যা শাহিনা খান জামান (বিন্দু) এবং ডা. যুবাইদা রহমান (ঝুনু)। শাহিনা খান জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়াশোনা করেন। ছোট কন্যা যুবাইদা রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। যুক্তরাজ্য থেকে তিনি প্রিভেনটিভ কার্ডিওলজি থেকে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। এতে ৫২টি দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্জন করেন প্রথম স্থান। বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর সৈয়দ শফিউজ্জামান এমএ খানের জ্যেষ্ঠ জামাতা। তিনি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন। আর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড়পুত্র বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার কনিষ্ঠ জামাতা। বাংলাদেশে ১/১১ সরকার আমলে আটক অবস্থায় নির্যাতনের শিকার তারেক রহমান বর্তমানে লন্ডনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের কন্যা জাইমা রহমান এমএ খানের একমাত্র নাতনি।

১৯৫২ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেন এমএ খান। ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ লাভ করেন কোয়েটার সম্মিলিত বাহিনীর স্কুল থেকে। যুক্তরাজ্যের ডার্মউইথ রয়্যাল নেভাল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর রণতরী ট্রাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৫৬ সালের পহেলা মে স্থায়ী কমিশন লাভ করেন। রয়্যাল কলেজ, গ্রিনিচসহ ইংল্যান্ডের রয়্যাল নেভাল ইনস্টিটিউশনে বিভিন্ন কোর্স সমাপ্ত করেন। ১৯৬৩ সালে কৃতী অফিসার হিসেবে যুক্তরাজ্যে রানী এলিজাবেথ কর্তৃক পুরস্কৃত হন। একই বছর যুক্তরাজ্যে ভূমি থেকে টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার অফিসার হিসেবে উত্তীর্ণ হন এবং পাকিস্তান নেভাল স্টাফ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট কোর্স সম্পন্ন করেন। এরআগে ১৯৬০ সালে পিএনএস তুগ্রিলের গানারি অফিসার হন। পরে ১৯৬৪ সালে পিএনএস টিপু সুলতানের টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন অফিসার হন। ১৯৬৭-৬৮ সালে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে জয়েন্ট চিফ অফ সেক্রেটারিয়েট স্টাফ অফিসার (ট্রেনিং এবং মিলিটারি অ্যাসিস্ট্যান্স) হিসেবে দায়িত্ব পালন। ১৯৭০ সালে পিএনএস হিমালয়ে টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন স্কুলের অফিসার ইন চার্জ ও করাচিতে সি-ওয়ার্ড ডিফেন্স অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ এমএ খান পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরিরত ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে পরিবারসহ তিনি গৃহবন্দী হন। তিন বছর বন্দী থাকার পর ১৯৭৩ সালে স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছেন।

এরপর ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম মার্কেন্টাইল একাডেমির প্রথম বাঙালি কমান্ড্যান্ট নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে নৌ-সদর দপ্তরে পারসোনেল বিভাগের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি নৌবাহিনীর সহকারি স্টাফ প্রধান (অপারেশন ও পারসোনেল) নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে রয়্যাল নেভি কর্তৃক হস্তান্তরিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম রণতরী বিএনএস ওমর ফারুক (সাবেক এইচএমএম ন্যাভডক) এর অধিনায়ক হন। রণতরীটি নিয়ে আলজেরিয়া, যুগোস্লোভিয়া, মিসর, সৌদি আরব এবং শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলোতে শুভেচ্ছা সফর করেন। ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর তিনি নৌবাহিনীর স্টাফ প্রধান নিযুক্ত হন এবং ১৯৮০ সালের পহেলা জানুয়ারি রিয়ার এডমিরাল হন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে বিশ্বমানের আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। নৌবাহিনীর আইন প্রণয়ন করেছেন তিনি। দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষা, সমুদ্রে জেগে ওঠা দ্বীপসহ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের দখল রক্ষা, জলদস্যু দমন, সুন্দরবনের নিরাপত্তায় নৌবাহিনীকে সচেষ্ট করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর বেতন ও পেনশন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া দেশের প্রশাসনিক পুনর্গঠনে জাতীয় বাস্তবায়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন। বাংলাদেশে উপজেলা পদ্ধতির প্রবক্তাও তিনি।

১৯৮২ সালে দেশে সামরিক আইন জারি হলে, এডমিরাল এমএ খান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। এ সময় তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয়। ১৯৮২ সালের ১০ জুলাই থেকে ১৯৮৪ সালের ১ জুন পর্যন্ত তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় শাহজালাল সেতু, লামাকারী সেতু, শেওলা সেতুসহ বড় বড় উন্নয়নকাজের সূচনা হয়।

১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে তিনি নৌ, রেল ও সড়ক প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে চীন সফর করেন এবং চীনের নৌঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন। জুন মাসে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে তিনি খান বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন। নভেম্বরে তিনি রাশিয়া যান এবং প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ডিসেম্বরে জ্যামাইকায় অনুষ্ঠিত সমুদ্র আইনবিষয়ক সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন ও কনভেনশন অন অফ-সি কনফারেন্সে স্বাক্ষর দেন। ১৯৮৩ সালের মার্চে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত রেলওয়ে মন্ত্রীদের সভায় তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। জুলাই মাসে তিনি কোরিয়া সফরে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৪ সালের ৩০ মার্চ তিনি গিনির প্রেসিডেন্ট আহমদ সেকুতুরের শেষকৃত্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধি করেন।

জিয়াউর রহমানের বড়ভাই রেজাউর রহমান নৌবাহিনীতে এমএ খানের সহকর্মী ছিলেন। সেই সুবাদে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এমএ খানের স¤পর্ক ছিল নিবিড়। এমএ খানকে বিশেষ সম্মান করতেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের পরে, জিয়াউর রহমান সরকারের সময় নৌবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি তৎকালীন সরকারের যোগাযোগ উপদেষ্টা ছিলেন। সৎ ও অভিজ্ঞ এমএ খানকে এরশাদ সরকার বাংলাদেশের যোগাযোগ ও কৃষিমন্ত্রী করে। তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়ার সবুজ বিপ্লব ও কৃষি আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে যথেষ্ঠ পরিশ্রম করেন। যোগাযোগমন্ত্রী থাকায় তিনি পূর্বাঞ্চলের রাস্তাঘাট-ব্রিজসহ অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করেন।

এমএ খানের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। তার লক্ষ্য ছিল স্থায়ী ও জনকল্যাণমূলক কাজ করা। তিনি সফলও হয়েছিলেন। শুধু সিলেটের নয়, সারাদেশের জন্যই তিনি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষিমন্ত্রী। এমএ খান গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পছন্দ করতেন। কিন্তু নিজে রাজিৈনতক দল করার স্বপ্ন দেখতেন না। তিনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করাসহ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, কৃষিবিপ্লব, অবকাঠামো উন্নয়নে মনোযোগী ছিলেন।

  • লেখক সাংবাদিক। 

স্মরণ — ক্ষণজন্মা একজন মাহবুব আলী খান


মুশফিকুল ফজল আনসারী


মানুষের হৃদয় রাজ্যে বাস করার অভিলাষেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক। কোনো তকমা কিংবা প্রশংসার ফুলঝুরি নয়, সকলের একজন হয়েই বেঁচে থাকতেই হয়তো এমন পণ করেছিলেন রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান। এরকম মানুষ হাতে গুনা। নিরবে নিভৃতে মানুষের তরে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি তাঁকে তাড়া কারলেও তিনি ফিরেও তাকাননি।
 
মাটি-আর মানুষকে আপন করার ইচ্ছে লালন করার তাগিদেই স্বাধীন ভুখন্ড প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বুনেন আপনমনে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সহ্য করেছেন পাকিস্তান সরকারের গৃহবন্দিত্বের খড়গ। ভাতা ভোগ বা আয়েশি জীবনকে তুচ্ছ করে অটল থেকেছেন স্বাধীন স্বদেশে নি:শ্বাস নেয়ার দীপ্ত শপথে। মাহবুব আলী খানের দেশপ্রেম ছিলো প্রশ্নাতীত।

দেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ইঞ্চি পর্যন্ত ছাড় দেননি তিনি। দেশেরসমুদ্রসীমা রক্ষা, সমুদ্রে জেগে ওঠা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপকে বাংলাদেশের সম্পদ হিসেবে আগলে রাখা তার নিখাঁদ দেশপ্রেমের জ্বলন্ত উদাহরণ। মানুষের দোরগড়ায় প্রশাসনকে নিয়ে যেতে তিনিই প্রথম উপজেলা পদ্ধতির প্রবক্তা ছিলেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ গঠনে মাহবুব আলী খানের শ্রম-ঘামের স্বাক্ষী এই জনপদ।
 
রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান
 নভেম্বর ৩, ১৯৩৪ – আগস্ট ৬, ১৯৮৪ 

মাহবুব আলী খানের রয়েছে অবাক করার মতো পারিবারিক ঐতিহ্য। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী রিয়ার এডমিরাল মাহবুবআলী খানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর সিলেটের বিরাহীমপুরের সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত মুসলিম পরিবারে। তৎকালীন ভারতের প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার আহমেদ আলী খান তার পিতা। ১৯০১ সালে বার এ্যাট ‘ল ডিগ্রিধারী আহমেদ আলী খান ছিলেন নিখিল ভারত আইনপরিষদের সদস্য (এম এল এ) ও আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট । মাহবুব আলী খানের মায়ের নাম জোবায়দা খাতুন দু’ভাই ও এক বোনের মধ্যে মাহবুব আলী খান ছিলেন ছোট। সিলেটের বিরাহীমপুর, কলকাতা ও ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকার ৬৭ পুরানা পল্টন লাইনের বাড়িতে মাহবুব আলী খানের শৈশবও কৈশোর অতিবাহিত হয়। তিনি কলকাতা ও ঢাকাতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পড়াশোনায় তিনি ছিলেন কৃতীছাত্র। তার কলেজ জীবনের শিক্ষা ঢাকা কলেজে। মায়ের দিক থেকেও মাহবুব আলী খান ছিলেন বর্ণাঢ্য পারিবারিক ঐতিহ্যের এক গর্বিত উত্তরাধিকার। জোবায়দা খাতুনের দাদা সমাজহীতকর কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ তৎকালীন ব্রিটিশদের রাজকীয় খেতাবে ভূষিত হন । মাহবুব আলী খানের চাচা গজনফর আলী খান ১৮৯৭ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আই.সি.এস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ছিলেন বাংলা ও আসামের প্রথম মুসলিম আই.সি.এস। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৩২ সালে গজনফর আলী খান নাগপুর ডিভিশনের কমিশনার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর কর্মদক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘অফিসার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার’ এবং সি.আই.ই উপাধিতে ভূষিত করে। মাহবুব আলী খানের দাদা ছিলেন ভারতের বিশিষ্ট চিকিৎসক খানবাহাদুর আজদার আলী খান। তিনি বিহার ও আসামের দারভাঙ্গা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও পাটনা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। ১৯২৪ সালে তিনি সিলেটে নাফিজাবানু চ্যারিটেবল হাসপাতাল ও ১৯৩০ আরেকটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। মাহবুব আলী খানের পিতা আহমেদ আলীর মামা বিচারপতি আমীর আলী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। দ্য স্পিরিট অব ইসলাম ও অ্যা শর্ট হিস্ট্রি অব সারাসেন’ এ দু’টি বই রচনা করে আজও তিনি খ্যাতির শীর্ষে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন এম এ খানের চাচাতো ভাই। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে মাহবুব আলী খান ছোট। বড়বোন সাজেদা বেগম। মেজভাই চিকিৎসক সেকেন্দার আলী খান। সেকেন্দার আলী খানের মেয়ে আইরিন খান কাজ করেছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব হিসেবে। সম্প্রতি জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মতামত সংক্রান্ত বিশেষ রেপুটিয়ারের দায়িত্ব লাভ করেছেন আইরিন খান।
 
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, সিলেটের বিরাহীমপুর, কলকাতা ও পুরান ঢাকার ৬৭ পুরানা পল্টন লেনের বাড়িতে মাহবুব আলী খানের শৈশব ও কৈশোর কাটে। কলকাতা ও ঢাকায় তার প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ হয়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত অথচ চৌকস। অজানাকে জানা আর অসাধ্যকে সাধন করার ব্রত তাঁর বাল্যকাল থেকেই।

১৯৫৫ সালে ২১ বছর বয়সে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর সাথে। দুই কন্যা সন্তানের জনক মাহবুব আলী খান । শাহিনা খান জামান (বিন্দু) এবং ডা. জোবায়দা রহমান (ঝুনু)। শাহিনা খান জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেছেন। কনিষ্ঠা কন্যা জোবায়দা রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত সোয়াস থেকে তিনি প্রিভেনটিভ কার্ডিওলজি থেকেএমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। এতে ৫২টি দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্জন করেন প্রথম স্থান। বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর সৈয়দ শফিউজ্জামান এম এ খানের জ্যেষ্ঠ জামাতা। আর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় পুত্র বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মাহবুব আলী খানের কনিষ্ঠ জামাতা। মাহবুব আলী খানের একমাত্র নাতনী ব্যারিস্টার জায়মা রহমান।
 
১৯৫২ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেন মাহবুব আলী খান। ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ লাভ করেন কোয়েটার সম্মিলিতবাহিনীর স্কুল থেকে। যুক্তরাজ্যের ডার্মউইথ রয়্যাল নেভালকলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর রণতরী ট্রাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৫৬ সালের পহেলা মে স্থায়ী কমিশন লাভ করেন। রয়্যাল কলেজ, গ্রিনিচসহ ইংল্যান্ডের রয়্যাল নেভাল ইনস্টিটিউশনে বিভিন্নকোর্স সমাপ্ত করেন। ১৯৬৩ সালে কৃতী অফিসার হিসেবে যুক্তরাজ্যে রানী এলিজাবেথ কর্তৃক পুরস্কৃত হন। একই বছর যুক্তরাজ্যে ভূমি থেকে টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিনওয়ারফেয়ার অফিসার হিসেবে উত্তীর্ণ হন এবং পাকিস্তাননেভাল স্টাফ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে সিনিয়রম্যানেজমেন্ট কোর্স সম্পন্ন করেন। এরআগে ১৯৬০ সালে পিএনএস তুগ্রিলের গানারি অফিসার হন। পরে ১৯৬৪সালে পিএনএস টিপু সুলতানের টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন অফিসার হন। ১৯৬৭-৬৮ সালে তিনি রাওয়াল পিন্ডিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে জয়েন্ট চিফ অফসে ক্রেটারিয়েট স্টাফ অফিসার (ট্রেনিং এবং মিলিটারিঅ্যাসিস্ট্যান্স) হিসেবে দায়িত্ব পালন। ১৯৭০ সালে পিএনএস হিমালয়ে টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন স্কুলের অফিসার ইনচার্জ ও করাচিতে সি-ওয়ার্ড ডিফেন্স অফিসারের দায়িত্বপালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ মাহবুব আলী খান পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরিরত ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে পরিবারসহ তিনি গৃহবন্দী হন। তিন বছর বন্দী থাকার পর ১৯৭৩ সালে স্ত্রী ও কন্যাসহ আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছেন। এরপর ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম মার্কেন্টাইলএকাডেমির প্রথম বাংলাদেশী কমান্ড্যান্ট নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে নৌ-সদর দপ্তরে পারসোনেল বিভাগের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি নৌবাহিনীর সহকারি স্টাফ প্রধান (অপারেশন ওপারসোনেল) নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে রয়্যালনেভি কর্তৃক হস্তান্তরিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম রণতরী বিএনএস ওমর ফারুক (সাবেক এইচএমএম ন্যাভডক) এরঅধিনায়ক হন। রণতরীটি নিয়ে আলজেরিয়া,।। যুগোস্লাভিয়া, মিসর, সৌদি আরব এবং শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলোতে শুভেচ্ছা সফর করেন। ১৯৭৯ সালের ৪ঠা নভেম্বর তিনি নৌ-বাহিনীর স্টাফ প্রধান নিযুক্ত হন এবং১৯৮০ সালের পহেলা জানুয়ারি রিয়ার এডমিরাল হন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে বিশ্বমানের আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। নৌবাহিনীর আইন প্রণয়ন করেছেন তিনি। দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষা, সমুদ্রে জেগে ওঠা দ্বীপসহ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের দখল রক্ষা, জলদস্যু দমন, সুন্দরবনের নিরাপত্তায় নৌবাহিনীকে সচেষ্ট করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি সরকারের তিনিসরকারের সশস্ত্র বাহিনীর বেতন ও পেনশন কমিটিরচেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া দেশের প্রশাসনিক পুনর্গঠনেজাতীয় বাস্তবায়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন। বাংলাদেশে উপজেলা পদ্ধতির প্রবক্তাও তিনি। ১৯৮২ সালে দেশে সামরিক আইন জারি হলে, এডমিরালএমএ খান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। এ সময় তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয়। ১৯৮২ সালের ১০ জুলাই থেকে ১৯৮৪ সালের ১ জুন পর্যন্ততিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় শাহজালাল সেতু, লামাকারী সেতু, শেওলা সেতুসহ বড় বড় উন্নয়নকাজের সূচনা হয়।
 
১৯৮২ সালে দেশে সামরিক আইন জারি হলে, এডমিরাল এমএ খান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। এ সময় তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয়। ১৯৮২ সালের ১০ জুলাই থেকে ১৯৮৪ সালের ১ জুন পর্যন্ততিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় শাহজালাল সেতু, লামাকারী সেতু, শেওলা সেতুসহ বড় বড় উন্নয়নকাজের সূচনা হয়।
 
১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে তিনি নৌ, রেল ও সড়কপ্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে চীন সফর করেন এবং চীনের নৌঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন। জুন মাসে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে তিনি খান বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন। নভেম্বরে তিনি রাশিয়া যান এবং প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ডিসেম্বরে জ্যামাইকায় অনুষ্ঠিত সমুদ্র আইনবিষয়ক সম্মেলনে তিনিবাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন ও কনভেনশন অন অফ-সিকনফারেন্সে স্বাক্ষর দেন। ১৯৮৩ সালের মার্চে ব্যাংককেঅনুষ্ঠিত রেলওয়ে মন্ত্রীদের সভায় তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। জুলাই মাসে তিনি কোরিয়া সফরে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৪ সালের ৩০মার্চ তিনি গিনির প্রেসিডেন্ট আহমদ সেকুতুরের শেষকৃত্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধি করেন।
 
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মাহবুব আলী খানের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ট। ১৯৭৫ সালের পরে, জিয়াউর রহমান সরকারের সময় নৌ-বাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি তৎকালীন সরকারের যোগাযোগ উপদেষ্টা ছিলেন। সৎ ও অভিজ্ঞ মাহবুব আলী খানকে পরবর্তী সরকার বাংলাদেশের যোগাযোগ ও কৃষিমন্ত্রী দায়িত্ব প্রদান করে। মাহবুব আলী খান শহীদ জিয়া সূচিত সবুজ বিপ্লব ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম সহযোগি হিসাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভের পর তিনি দেশের রাস্তাঘাট, সেতু নির্মানসহ অবকাঠামো উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখেন । ১৯৮৪ সালের ৬ আগস্ট সকালে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে একটি প্রশিক্ষণ বিমান ভূপাতিত হলে রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান ছুটে যান দূর্ঘটনা স্থলে। সেখানে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে স্থানান্তর করা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। এরপরই মাত্র ৪৯ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন নিভৃতচারী এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। রেখে যান কর্ম, উদ্যোম, সততা, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের অনন্য নজির ।
 
  • লেখক সাংবাদিক

চামড়াশিল্পের উত্থানের সুযোগ ফের বেহাত হবে?


আহাদ আহমেদ

করোনা-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক চামড়াবাজার নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। সুযোগের সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশও। চীনের বাজার এই খারাপ সময়েও চালু ছিল। দুনিয়ার ট্যানারি শিল্প যখন উৎপাদন প্রায় বন্ধ রেখেছে, তখন ইউরোপের এই কেমিক্যাল কোম্পানিগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে চীন। ইতালি-ভারত ইত্যাদি দেশের চামড়াশিল্প সংকটে। তখন বিশ্ববাজারে আমাদের চামড়া পণ্যের বিরাট সুযোগ উপস্থিত হয়েছে করোনা এবং আনুষঙ্গিক আরও কিছু কারণে। সুযোগের সেই ফল হাতে তুলে নেওয়ার আয়োজন তো দেখা যাচ্ছেই না, বরং দেখা যাচ্ছে উল্টো গতি।

২০২০ সালের কোরবানি ঈদের পর আগের বারের মতোই আবহাওয়া চরম গরম। কাঁচা চামড়ার জন্য এটা অত্যন্ত বৈরী পরিবেশ। অতি উচ্চ তাপমাত্রা ও কাঁচা চামড়ার মূল্যপতনের ফলে লবণ লাগানোর খরচ উটকো বলে গণ্য হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে লবণের চেয়ে চামড়ার মূল্য কম। ছাগলের চামড়ার প্রায় শূন্য মূল্যের কারণে লবণ দেওয়া বন্ধ করেছে আড়তদারেরা। সরকারের উচিত ছিল সাভারে জরুরি ভিত্তিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা করা।

কাঁচা চামড়ার বড় আন্তর্জাতিক উৎস উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপ প্রায় ধরাশায়ী। এসব দেশের পশুসম্পদ ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। কোভিড-১৯-মুক্ত ‘কাঁচা চামড়া’ সনদ নিয়েও বিতর্ক আছে। ভারতে রাজনৈতিক কারণে চামড়ার বাজার স্থায়ী হুমকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। অন্য কারণেও ভারতের চামড়াশিল্প অভাবনীয় অবস্থার মধ্যে পতিত। গো-সুরক্ষা ও রাজনৈতিক বাগাড়ম্বিতা এই খাতে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করে ফেলেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে রাসায়নিক কাঁচামাল আমদানির বেলায় ‘নন-পেমেন্ট’ প্রথার ফলে এরা অবিশ্বস্ততার অলিখিত ‘সনদপ্রাপ্ত’ হয়েছে। কিছু ভারতীয় কোম্পানি নিম্নমানের দেশীয় রাসায়নিক ব্যবহার করছে। ফলে ,কমপ্লায়েন্স নিয়েও ভারতের সংকট স্থায়ী হতে পারে। চীনের সঙ্গে বিরোধ ভারতীয় বাজারে মন্দা ভাবের সৃষ্টি হবে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো তাদের জন্য কঠিন। দুনিয়াব্যাপী চামড়াজাত কার সিট, আপহোলস্ট্রি (সাজসজ্জার উপকরণ) বাজারের উঠে দাঁড়ানো এখন প্রায় অসম্ভব। কারণ, গাড়ির বিক্রি প্রায় ৫০ ভাগ কমে এসেছে।

ইতালি করোনায় যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, তাতে ফ্যাশন হাউসের কাজ ছাড়া জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদনে তাদের অংশগ্রহণ কমে যাবে। এদিকে ইউরোপ ও আমেরিকার জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার বড় মাপে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। পশ্চিমা উৎপাদকেরা চীনে বিনিয়োগ নিয়ে হাজির হচ্ছে। ফলে, ইউরোপ-আমেরিকার ফ্যাশন শিল্প আর চীনের সমন্বয়ে চীনভিত্তিক এক বিশাল চামড়া, ফুটওয়্যার, চামড়াজাত পণ্যের বাজার বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। বাংলাদেশ হতে পারে সেই বিশ্ববাজারের অন্যতম শরিক। উল্লেখ্য, চীনের বাজার বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। আট হাজারের ওপর পণ্যের ওপর থেকে ৯৭ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে।


এসব বিষয় মাথায় রেখে বাংলাদেশকে কিছু কাজ করতে হবে। যেমন ১. কাঁচা চামড়ার চোরাচালান বন্ধ করা, ২. চামড়ায় মুল্য সংযোজন করা ও বাজারজাত করার নীতি নেওয়া। এ দুটি কাজ করা গেলে আগামী চার থেকে পাঁচ বছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পারবে বাংলাদেশ। অর্থাৎ বর্তমানের প্রায় ১০ গুণ! এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চামড়া পণ্য উৎপাদকদের ‘রপ্তানি গিল্ড’ গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। এরা নিম্নতম মূল্য নির্ধারণ করে দেবে। যেনতেন মূল্যে চামড়া বিক্রয়ের রাস্তা থেকে সরে আসাই হবে এই খাতের মূল লক্ষ্য। কস্ট ম্যানেজমেন্ট করে ৬০ থেকে ৭০ সেন্টে চামড়া বিক্রি করাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

গৌরবের সঙ্গে বলা হয়ে থাকে, চামড়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। কিন্তু বাস্তবে এক দশক ধরেই এই খাত পতনশীল; শুধু সিদ্ধান্তহীনতায় আর দুর্নীতির শিকার হয়ে। ইপিবির তথ্যানুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রায় ১৬ শতাংশ বাজার পতন হয়েছে। ২০১৩-১৪ সাল থেকে এ খাতের আয় ১ দশমিক শূন্য ৮ থেকে ১ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করেছে। অন্যদিকে, ভারতের ৩ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের বিপরীতে চীনের আয় ১০ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান করছে ৯৪৮ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। বাংলাদেশে ২০১৬-১৭ সালকে চামড়া বর্ষ হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চামড়াশিল্পের পতন সেই সময় থেকেই শুরু। শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে প্রতি সপ্তাহে বৈঠকের কথা! কিন্তু যাঁরা ট্যানারি চালাবেন, তাঁদের এত সময় নেই। আর যাঁরা প্রতি সপ্তাহে মিটিং চালাবেন, তাঁদের শিল্প চালানোর সময় নেই—এটাই বাস্তবতা।

বাংলাদেশ ১৮০ থেকে ২০০ মিলিয়ন বর্গফুট চামড়া উৎপাদন করে। প্রক্রিয়াজাত চামড়া, জুতা, চামড়াজাত পণ্য হিসেবে রপ্তানি হয় ১৪০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন বর্গফুট। শুধু নতুন এলাকা সাভারের সামগ্রিক উৎপাদন ৪০০ থেকে ৪৫০ মিলিয়ন বর্গফুট ধরা হয়েছে। ১৫৫টি ট্যানারির অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেখানে, যাদের অধিকাংশের এক প্রজন্মের তো দূরের কথা কস্মিনকালেও চামড়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। শুধু হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পের নিবন্ধন থাকার সুবাদে এখানে জমি বরাদ্দ পেয়েছে অনেকে। তাদের অনেকেই সুযোগটাকে শুধু রিয়েল স্টেট ব্যবসা হিসেবে দেখছে। সাভারে শিল্প স্থানান্তর সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো, ইটিপি স্থাপনা নিয়ে যে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, তা পিছিয়ে দিয়েছে বাজারকে। বেশ কিছু ক্রেতা ভিয়েতনাম ও এশিয়ার অন্যত্র উৎপাদকের খোঁজ করছে।

তারপরও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের সমান দক্ষতা অর্জন করতে পারে। তার জন্য পুরো ট্যানারি খাতকে ৫০ থেকে ৬০টি শিল্পে নামিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। প্রতিযোগিতামূলক দরপতন কমানো সম্ভব এভাবেই। একইভাবে জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের জন্য শিল্পের সংখ্যাও ৬০ থেকে ৭০-এ নামিয়ে আনা দরকার। বিশ্ববাজারের ধারা পরিবর্তিত হবে এবং প্রাকৃতিক পণ্যের বাজার বিকশিত হবে। এর আগাম প্রস্তুতি কি আমাদের আছে? কোনো একটি খাতের উন্নতি সেই খাতের পরিচালকদের যৌক্তিক সততার ওপরও নির্ভরশীল। এই খাতের নামে ঋণ নিয়ে লুটে নেওয়াদের তাই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

মনে রাখা দরকার, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ থেকে ট্যানারিজাত হয়ে জুতা, জ্যাকেট, ব্যাগ তৈরি পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এই খাতের সঙ্গে জড়িত। এই খাতে যে অভিজ্ঞতা, দক্ষ শ্রমিক ও কর্মী তৈরি হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে শক্তির জায়গা। বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্প মাত্র ৫ বছরেই ১০ বিলিয়ন ডলার আয়ের স্তরে উঠতে পারে, যদি:

১. আধুনিক ও টেকসই প্রযুক্তিনির্ভর খাত হিসেবে একে গড়ে তোলা হয়। টেকসই প্রযুক্তি মানে পানি ও রাসায়নিক ব্যবহারে সচেতন হওয়া। পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা চালু রাখা।
২. ট্যানারি শিল্পের মালিকদের সমন্বয়ে রপ্তানি গিল্ডের ‘প্রাইস সেন্টার’ গঠন করা। তাঁদের প্রধান কাজ হবে চামড়ার ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা। কোনো ট্যানারি এই মূল্যের নিচে চামড়া বিক্রি করলে তার রপ্তানি ৬ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা। রপ্তানির ক্ষেত্রে এই ‘রপ্তানি গিল্ডের’ সনদ বাধ্যতামূলক করা।
৩. ক্রমান্বয়ে সব রপ্তানিমুখী ট্যানারির জন্য এলডব্লিউজি (লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ নামে আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থার সনদ) কমপ্লায়েন্স বাধ্যতামূলক করা।
৪. ট্যানারি শিল্পের শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম মজুরি, নিরাপত্তা ও মানবিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করা।
৫. ‘বায়ারস ইনসেনটিভ’ হিসেবে আমদানি মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ফ্লাইট কস্ট ও হোটেল ভাড়ার ওপর ১০ থেকে ২৫ শতাংশ ক্যাশব্যাকের ঘোষণা দেওয়া।
৬. কাঁচা চামড়া ও কেমিক্যাল আমদানি ক্ষেত্রে বন্ডেড ওয়্যার হাউসের পাশাপাশি সব বাণিজ্যিক ও শিল্প আমদানিকারকের জন্য কনসলিডেটেড ১০ শতাংশ মোট ট্যাক্স নির্ধারণ করা—যাতে সব ধরনের শিল্প প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে রাসায়নিক কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারে।
৭. ব্যাংকঋণের মধ্যে স্বচ্ছতা আনা।

সর্বোপরি ট্যানারি খাত ও সরকারের যৌথ নীতি গ্রহণ করতে হবে, যার স্লোগান হবে ‘লক্ষ্যমাত্রা ১০ বিলিয়ন’।

  • লেখক চামড়াশিল্পের সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তা।

প্রতিটি বিচার বহির্ভূত হত্যা রাষ্ট্রের ভিত নাড়িয়ে দেবার অপরাধ


ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা


এই বছর জানুয়ারি মাসের সংসদ অধিবেশনে বসে বিপুল বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম সরকারি এবং বিরোধী দলের বেশ কয়েক জন সংসদ সদস্য ধর্ষণের শাস্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ক্রসফায়ারকেই বেছে নিয়েছেন।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু ধর্ষণে অভিযুক্তদের ক্রসফায়ারে হত্যার কথা তোলার পর পরই সেটিকে সমর্থন করে দীর্ঘ বক্তব্য দেন আরেক সংসদ সদস্য, যিনি নিজেও মন্ত্রী ছিলেন, কাজী ফিরোজ রশিদ। এই দু’জন যে কেবলমাত্র সাংসদ বা মন্ত্রী ছিলেন তাই নয়, তারা দু’জনই বাংলাদেশের পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ, যাকে বলে সিজনড পলিটিশিয়ান। মজার বিষয় হলো সংসদে ক্রসফায়ারের সমর্থনে সাংসদদের এটাই প্রথম বক্তব্য নয়। অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে ২০১৬ এবং ২০১৯ সালেও কাজী ফিরোজ রশিদ ধর্ষণে অভিযুক্তদের ক্রসফায়ারে দেবার দাবি তুলেছিলেন। এ ধরণের বক্তব্য একজন আইন প্রণেতার খোদ সংসদে দাঁড়িয়ে দেবার ইমপ্যাক্ট কী হতে পারে তা না বোঝার কোনো কারণ নেই।

এ তো গেল ‘বিরোধী দল’ এর সাংসদদের কথা। এবার অপার বিষ্ময়ে লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ন এক ব্যক্তি সরকার দলীয় সাংসদ জনাব তোফায়েল আহমেদ তাদের দুইজনকে সমর্থন করে বললেন, “এখানে দরকার কঠোর আইন করা।

আর দ্বিতীয়ত হল, যে এই কাজ করেছে তার আর এই পৃথিবীতে থাকার কোনো অধিকার নাই”। এই বিষয়ে সর্বশেষ মুখ খোলেন তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী যিনি তার তরিকা মতোই ক্রসফায়ারের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের বেহেশত নিশ্চিত করে ফতোয়া দেন যে, “আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে বলছি এদের (ধর্ষকদের) ক্রসফায়ার করলে কোনো অসুবিধা নাই”।

আমরা দেখেছি পেয়াজের দাম নিয়ে সিন্ডিকেটের কথা বলতে গিয়ে এই সংসদেই অতীতেও ক্রসফায়ারের দাবি উঠেছিল। সর্বশেষ করোনাকালে বসা বাজেট অধিবেশনে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি দমনের দাওয়াই হিসাবেও ক্রসফায়ারের কথা বলা হয়েছে। যারা সংসদে দাঁড়িয়ে এ ধরণের দাবি তুলেছেন, তারা প্রত্যেকেই সিনিয়র পলিটিশিয়ান, কয়কবারের সাংসদ এবং মন্ত্রীও ছিলেন। সুতরাং মুখ ফসকে এধরণের কথা তারা সংসদে বলেছেন সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ৩৫০ জনের এই সংসদে একজন সাংসদ অবশ্য তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, “২০১৯ সালে গড়ে প্রতিদিন একজনের বেশি মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড খুব সম্ভবত বৈধ হতে যাচ্ছে। কারণ, আমরা গতকাল দেখেছি সরকার ও বিরোধী দল – দুই দলই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে কথা বলছে”। প্রতিবাদি এই সদস্য সংসদে প্রথম বারের মত আসা এবং সবচেয়ে শেষে যোগ দেয়া বিএনপি’র সংরক্ষিত আসনের একমাত্র মহিলা সাংসদ।


সম্প্রতি একটি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। প্রতিটি বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের পরে আইন-শৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যেমন বিবৃতি দেয়া হয়, তেমন একটা বিবৃতি আমরা পেয়েছি তাদের পক্ষ থেকে যেখানে পুলিশকে আক্রমণের কথা ছিল, ছিল সেটা প্রতিহত করতে পাল্টা গুলির কথা। মজার বিষয় এতে বাদ ছিল না হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষটির গাড়ি ও রিসোর্ট থেকে মদ, গাজা, ইয়াবা এবং অস্ত্র উদ্ধারের তথ্যও। এতই গতানুগতিক, এতই ক্লীশে এই ‘গল্প’ যে শিশুরাও আজকাল আর বিশ্বাস করে না এসব, তারাও জানে আসলে কী ঘটেছে। প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন বলছে পুলিশের সংকেত পেয়ে মেজর (অবঃ) সিনহা গাড়ি থামান এবং নিজের পরিচয় দিলে প্রথমে তাদের চলে যাওয়ার সংকেত দেয়া হয়। পরে পরিদর্শক লিয়াকত আলি তাদের পুনরায় থামান এবং পিস্তল তাক করে গাড়ি থেকে নামতে বলেন। মেজর সিনহা গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই লিয়াকত তাকে তিনটি গুলি করেন। তার সঙ্গে থাকা সিফাতের ভাষ্যও তাই। পরিবারের দাবি তাকে স্পষ্টতই হত্যা করা হয়েছে। ময়না তদন্তের পর কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা জানান মেজর সিনহার বুকে ও পিঠে জখমের দাগ ছিল। সিনহার শরীরের ওপরের অংশ করদমাক্ত এবং বুক ও গলা গুলিবিদ্ধ ছিল। হাতে হাতকড়া লাগানোর দাগ ছিল বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন মাঠকর্মী ঘটনার ভিডিও রেকর্ড করতে চাইলে পুলিশ তার মুঠোফোন ও পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেয়। সংস্থাটির প্রতিবেদন আরও বলে ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতাল ১ ঘণ্টার পথ। অথচ মেজর সিনহাকে হাসপাতালে নিতে পুলিশের সময় লাগে ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। অতিরিক্ত ৪৫ মিনিট অতিবাহিত করা পুলিশের একটি অপকৌশল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

রাষ্ট্র বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ওপরে এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে এই করোনাকালের এই ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ১৫৮ জন মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় একজন মানুষ। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৩৮৮ আর ২০১৮ তে ছিল ৪৬৬ জন অর্থাৎ গত কয়েক বছরে প্রতিদিন গড়ে একজনের বেশি মানুষ এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। আর গত ১০ বছরের হিসাব টানলে এই সংখ্যা ২০০০ ছাড়িয়ে যাবে। একরামুল বা সিনহার মত দুই/একটি অতি আলোচিত হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কোনোটিই মানুষ কিংবা মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। এমনকি মানবাধিকার সংস্থাগুলো পর্যন্ত কেবলমাত্র একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেই তাদের দায় সেরেছে।



কোন সুস্থ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে পারেনা। অপরাধী যেই হোক, তার অপরাধের মাত্রা যত ব্যাপকই হোক না কেন প্রচলিত বিচার ব্যাবস্থা ছাড়া কারো মৃত্যু ঘটানো কোন সভ্য রাষ্ট্রের কাজ না। প্রতি নিয়ত এই ধরণের ঘটনার কথা শোনার ফলে মানুষের মধ্যে এই বিভৎসতার প্রতি এক ধরণের অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে, যার সাথে যুক্ত হয়েছে বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, ফলে বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে মানুষ এই ধরণের ঘটনায় এক ধরণের উল্লাস প্রকাশ করে সমর্থন দিয়ে থাকে। যেমন কিছু দিন আগেই ধর্ষণের একজন আসামীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে যাবার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ির পাশে বহু মানুষের হাততালি দেয়ার ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল। আবার একরামুল হত্যার সময় তার কন্যার সাথে তার কথোপকথনের অডিও ছড়িয়ে পরলে তা বহু মানুষকে আঘাত করে। নড়বড়ে রাষ্ট্র কাঠামোতে মানুষের উল্টো পথে যে যাত্রা তাতে মানুষ তার মত করে অপরাধী নির্ধারণ করে এবং সেই মত তার কি ধরণের শাস্তি পাওয়া উচিত সেটিও তারাই ঠিক করে। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের তীব্র অনাস্থা, নানা সময় অপরাধীদের বিচার না হওয়া, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, হতাশা মানুষকে প্ররোচিত করে এই ধরণের ঘটনায় সমর্থন জানিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে।

একটি বিষয় খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝতে হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যা রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। সেটি হোক একরামুল, সিনহা, বদি বা অন্য কেউ। অপরাধ যাই হোক না কেন সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে আদালতের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কারো শাস্তি নিশ্চিত করা যায়না। যত দিন পর্যন্ত আমরা সকল বিচার বহির্ভূত হত্যার বিচার সমান ভাবে না চাইবো, সকল বিচার বহির্ভূত হত্যাকে সমান অপরাধ বলে গন্য করে সমান ভাবে ঘৃণা করতে না শিখবো, কিছু মৃত্যুতে শোক আর কিছু মৃত্যুতে আনন্দ জারি রাখব, ততদিন পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক ডেমাগগরা জনপ্রিয়তার লোভে সংসদে কিংবা বাইরে বিচার বহির্ভূত হত্যার পক্ষে তাদের অবস্থান জারি রাখবেন। ভেঙ্গে পড়া রাষ্ট্র কাঠামোয় এর চেয়ে বড় অভিশাপ আর কি হতে পারে?

  • লেখক রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী  

 

ডিজিটাল সেবায় ইলেকট্রনিক সিগনেচার


এম এন ইসলাম
 
বিশ্বায়নের নানা কর্মযজ্ঞ আর ডামাডোলে প্রস্তুতি চলছিল চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের। এর মধ্যেই করোনার আঘাতে ব্যবসার নানা কর্মকাণ্ডে প্রযুক্তি আরও বেশি আপন হয়ে উঠছে। তথ্যপ্রযুক্তির নানা ধরনের পরিষেবা বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশেও দ্রুতগতিতে বাড়ছে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য। নতুন ধারণা নিয়ে দেশে নিয়মিত উঠে আসছে স্টার্টআপগুলো। সামাজিক নিরাপত্তা মেনে চলার প্রবণতার কারণে ই-কমার্সের মতো পরিষেবার ব্যবহার ও ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু ডিজিটাল কর্মকাণ্ডে পরিষেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা নিয়ন্ত্রকেরা কতটা তৎপর? ব্যবহারকারীর তথ্যের নিরাপত্তা বা আর্থিক নিরাপত্তাব্যবস্থাকে সুরক্ষিত, আধুনিকায়ন করা হলে বিশ্বমানের ডিজিটালাইজেশনের পথে থাকার গতি পাবে বলা যায়। তথ্যের নিরাপত্তাসহ আইনি ব্যাপারগুলোয় পরিষেবা প্রতিষ্ঠান বা সার্ভিস প্রোভাইডারের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রকদেরও ভূমিকা রয়েছে। আধুনিকায়ন বা পর্যাপ্ত ইকোসিস্টেম তৈরির জন্য এগিয়ে আসতে হবে নিয়ন্ত্রণকারীদের। প্রতিটি লেনদেন নিরাপদ বা প্রক্সিমিটি নিশ্চিত রাখার জন্য ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সিগনেচার বা ডিজিটাল সার্টিফিকেট অপরিহার্য।

ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সিগনেচার আসলে কী? মোটাদাগে বা সহজ কথায় বলা যায়, ইলেকট্রনিক সিগনেচারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করে ইউনিক এনক্রিপশন যুক্ত করে পাঠানো হয়, যাতে প্রেরকের তথ্য সঠিক বলে নিশ্চিত ধরা হয়।

পৃথিবীর অনেক দেশেই ইলেকট্রনিক লেনদেন বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ই-গভর্নমেন্টের নানা পরিষেবা নিরাপদ, সুরক্ষিত রাখতে ডিজিটাল সিগনেচার ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে ওই সমস্ত দেশের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। ই-গভর্নমেন্ট, ই-কমার্স, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোয় ডিজিটাল সিগনেচার ব্যবহার না করলে সেবাদানকারী, ব্যবহারকারীসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা বেশ কঠিন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে নানা ধরনের নথিপত্রের বিনিময়েও ডিজিটাল সিগনেচার খুবই দরকারি উপাদান হিসেবে উন্নত অনেক দেশেই ব্যবহার হচ্ছে।


ইলেকট্রনিক সিগনেচারকে ডিজিটালাইজেশন ইকোসিস্টেমের একটি বড় উপাদান বলা যেতে পারে। তাই ডিজিটাল পরিষেবার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে এটা নিয়ে কাজ করা উচিত। দেশে অবশ্য ইতিমধ্যে ইলেকট্রনিক সিগনেচার ব্যবহারের আইন ও অবকাঠামো তৈরি হয়েছে।

অপ্রতিসম (Asymmetrie) ক্রিপ্টোগ্রাফি (Cryptography) বা ক্রিপ্টোগ্রাফিক (cryptographic) প্রটোকলই আসলে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সিগনেচারের প্রতিরূপ। যেমন ধরা যাক, ক নামের ইন্টার ব্যাংকিং ব্যবহারকারী খ–কে ৫০ হাজার টাকা পাঠাবে। ক ব্যাংকিং সিস্টেমে লগইন করে, ডিজিটাল সিগনেচার যুক্ত করে লেনদেন সম্পন্ন করবে, যাতে নিশ্চিত হয় ক–ই ওই লেনদেন করেছে। কিংবা ব্যবহারকারী কোনো ই-কমার্স সাইটে লগইন হয়ে কোনো পণ্য কিনতে চাইছে আর পণ্যের দাম পরিশোধের জন্য তার ভার্চ্যুয়াল ওয়ালেট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করার জন্য তাকে ডিজিটাল সিগনেচার যুক্ত করে লেনদেন সম্পন্ন করতে হবে। ট্যাক্সে সার্ভিসের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার করা যেতে পারে। ডিজিটাল সিগনেচার ব্যবহারের জন্য পাবলিক কি (Key) আর প্রাইভেট কি (Key) থাকতে হয়। ইলেকট্রনিক সিগনেচারের মেরুদণ্ড হচ্ছে পাবলিক কির (public key) অবকাঠামো। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে বিশ্বস্ত সার্টিফিকেট কর্তৃপক্ষ (Certificate Authority)। সহজ কথায় বলতে গেলে সার্টিফিকেট কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয় আইন, বিশ্বমানের সঙ্গে নিয়মনীতি মেনে তার সিস্টেম প্রস্তুত করে।

ব্যবহারকারী সাধারণত তার কম্পিউটার, এক্সটারনাল ড্রাইভ, ক্লাউড ড্রাইভ বা মোবাইলে ডিজিটাল সিগনেচার সংরক্ষিত রাখে। যখন ব্যবহার করার দরকার পড়ে, তখন সংরক্ষিত ড্রাইভ থেকে এনে ব্যবহার করতে পারে। অনেক দেশেই সার্টিফিকেট বা সিগনেচার রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষ ব্যাংক বা আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে। তবে সার্টিফিকেট অথোরিটি সরকারি নিয়ম মেনে কিছু কোম্পানি, যাদের বিশ্বমানের পাবলিক কি অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা আছে, তারা পরিচালনা করে থাকে। এ ধরনের সিগনেচার ব্যবহার করার জন্য ব্যবহারকারী, পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের সচেতনতাও জরুরি। প্রযুক্তি নিয়ে নানা সেবা বা পরিষেবা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের তাদের ব্যবসার তথ্য বা ব্যবহারকারীর তথ্যের সুরক্ষার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে ইলেকট্রনিক সিগনেচার প্রচলনে এগিয়ে আসতে হবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, বিগ ডেটা আর ডেটার ভার্চ্যুয়ালাইজেশনের ব্যাপকতায় নানা ধরনের বাণিজ্যিক পদ্ধতি অচিরেই বহুগুণ বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা হবে নিরাপদ ব্যবসা ব্যবস্থাপনার। কোভিড-১৯–এর ধাক্কা সামলিয়ে প্রযুক্তি ব্যবসার ব্যবস্থাকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ইলেকট্রনিক সিগনেচার কাজে লাগবে।

  • লেখক প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টিকন সিস্টেম লিমিটেড
  • কার্টসি — https://bit.ly/3kc4WjD 

শুধু মাধবীর জন্য — ৪

মো: আসাদুজ্জামান



মাধবী,
‘তুমি আমার কোমল প্রাণ, মৌমাছি চোখ তোমার মধুর চেয়েও মিষ্টি, কেন তোমাকে লিখতে গেলাম... ?”
 
প্রেম ও দ্রোহের তুর্কি কবি, কবি নাজিম হিকমতের জেলখানার চিঠির অনুবাদ করে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এভাবেই প্রেম নিবেদনের উপাখ্যান তৈরী করেছিলেন! আজ আমি তোমাকে লিখছি কোন কারাগার থেকে নয়, লিখছি কবি নবারুন ভট্রাচার্যের মৃত্যু উপত্যকার দেশ থেকে, জল্লাদের রঙ্গমঞ্চ থেকে! এখন আমার মাঝে প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ আর দ্রোহ কাজ করছে। লজ্জা করছে, নিজেকে হেলাল হাফিজের উত্তর পুরুষের ভীরু কাপুরুষের উপমা মনে হচ্ছে। একজন স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া সেনা কর্মকর্তাকে কক্সবাজারে পুলিশ যেভাবে গুলি করে হত্যা করেছে সে বিষয়ে প্রতিবাদ, ঘৃণা, ক্ষোভ, ধিক্কার জানানোর ভাষা কোন বাংলা অভিধানে পেলাম না। সে আমার স্বজন, বন্ধু, পরিচিত কেউ নয়, সে আমার মানব সভ্যতার অংশ, সে একজন মানুষ । বহুবার তোমাকে বলেছি মাধবী, এদেশে বিনাবিচারে হত্যা মানুষের জীবনকে বিভীষিকাময় করবে, কেউ এখানে নিরাপদ নয়! আমার ভবিষ্যতবাণী আজ দেখলে তো? একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, একজন টগবগে যুবক, একজন সৃষ্টিশীল মানুষ মেজর সিনহাকে কিভাবে গুলি করে হত্যা করলো পুলিশের এক সাব ইন্সপেক্টর! থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশ ছিলো বলেও তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। কি বর্বর, কি অসভ্যতার উদাহরণ, কতটা নরপশু এরা। খুনীদের ডিফেন্স এ বহুল প্রচলিত ইয়াবাজাতীয় গল্প সাজানো হয়েছে যে গল্প আমার তোমার মত দেশের কেউ বিশ্বাস করছে না। খুনীদের এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। পরিবার-স্বজনের অভিযোগ মেজর সিনহা নির্দোষ, তাকে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগ সত্য না মিথ্যা তা প্রমানের জন্য পুলিশের প্রথম এবং প্রধান আইনী দায়িত্ব হলো নিয়মিত মামলা রুজু করে ওসিসহ সংশ্লিষ্ট আসামীদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা, তদন্ত করা। যদি তারা নির্দোষ প্রমাণিত হয় তাহলে তারা খালাস পাবে। এটাই নিয়ম, এটাই আইন, এটাই ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসনের বাণী। কিন্ত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় ফৌজদারী কার্যবিধির আওতায় গৃহীতব্য পদক্ষেপকে পাশ কাটিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন যার কোন আইনী সংযোগ ফৌজদারী কার্যবিধিতে আমি পেলাম না। এধরনের কমিটি গঠন করা যায় The Commission of Inquiry Act, 1956 এর আওতায়। এই আইনের অধীন কমিশন সিভিল কোর্ট এর ন্যায় ক্ষমতা প্রয়োগ করে সাক্ষি হিসাবে যে কাউকে ডাকতে পারবে। তবে, কমিশনের সামনে প্রদত্ত বক্তব্য সংশ্লিষ্ট স্বাক্ষির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য মূল্যহীন ।


মাধবী, সরকার বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আমি মনেকরি, মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় সরকারের এই মনে করা,  এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল, per in curium!
 
তবে হ্যাঁ, এই ধরনের সিদ্ধান্ত যদি সরকারের পলিসি হয় যার মাধ্যমে বিনা বিচারে এভাবে হত্যা করার সংস্কৃতি তারা চালু রাখতে চায় তাহলে আমার বলার কিছু নেই। সরকার যদি মনেকরে একজন সেনা কর্মকর্তার এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হলে প্যান্ডোরার বক্স ওপেন হয়ে যাবে, অতীত এবং ভবিষ্যতের সব ক্রসফায়ারের ঘটনায় মামলা হতে পারে যা তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য চ্যালেন্জ, তাহলে তদন্ত কমিটি গঠন করে সময় ক্ষেপন করা কোন ভুল নয়, নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদী করার কৌশল মাত্র! সেক্ষেত্রে আমার বলার কিছু নেই।
 
মাধবী, তোমাকে নিয়ে, তোমার প্রতি প্রণত হয়ে, হ্বদয়ের ভালোবাসা ব্যক্ত করার কোন emotion আজ কাজ করছে না! মেজর সিনহাকে এভাবে হত্যা করার যন্ত্রণা আমার ভালো লাগা, ভালোবাসার সব ইমোশনকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, আমার আমিকে বিমর্ষ করে তুলছে। কি যে যন্ত্রনাময় যাপিত জীবন এটা তোমাকে বোঝানো যাবেনা, তোমার উপেক্ষার থেকেও যন্ত্রনাময়, তোমার জন্য অপেক্ষার থেকেও হৃদয়গ্রাহী কষ্ট এটা, তুমি বুঝবে না। ভালো থেকো মাধবী। 

  • আইনজীবি ও রাজনৈতিক কর্মী

মাধবীর জন্য ৩ — কল্পনার দেশের বিচার ব্যবস্থা

মোঃ আসাদুজ্জামান 


প্রাণেশ্বরী মাধবী আমার,

তুমি তো জানো  —  তুমি আমার স্বপ্ন, কল্পনা আর প্রাণাধিক মানবী! তুমি অস্তিত্বহীন হলেও কল্পনার নিখুঁত আঁচড়ে আমার জীবনে অনবদ্য, অনন্যা, আমার আঁধার কালোসময়ে আঁধার মানিক সম! মনটা আজ ভীষন বিক্ষিপ্ত। ইদানীং তোমার সাথে কথপোকথনের সময় সমসাময়িক সময়ের রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থা, মানুষের অধিকার হরণ, বিচার বিভাগের জীর্ণতা চিন্তার মাঝে ঢুকে পড়ে, তুমি হারিয়ে যাও অনন্ত অতলে। তোমাকে আজ এক মায়াবী রাষ্ট্রের বিচারাঙ্গনের কথা শুনাবো, যে গল্প বাস্তবের চেয়েও বাস্তব, তোমার কল্পনাতেও এই ব্যবস্থার এতো অবনতি আসবে না। আইনজীবি হিসাবে বিচার কর্মক্ষেত্র তথা বিচার বিভাগ নিয়ে আমার আগ্রহটা একটু বেশী! বিচারঙ্গন নিয়ে আমার আগ্রহ থাকলেও আমার কল্পনার সমস্ত জগত জুড়ে শুধু তুমি, অন্য কেহ নয়! কোন ভুল বুঝ না যেন।

মাধবী, তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ, ‘জাস্টিস ইজ ডিভাইন-ন্যায় বিচার স্বর্গীয়’ - এটা অনেক পুরানো একটি প্রবাদ বা তত্ত্ব । অনেক গল্প সিনেমায় এভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে আমাদের গভীরে তাই ঢুকেছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেটা দেখেছি এবং দেখিও। তবে, যে কল্পনার রাষ্ট্রের কথা বলছি সেখানে এটা ক্রমাবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। নতুন তত্ত্ব হলো - ‘জাস্টিস ইজ ডিভাইডেড - ন্যায় বিচার বিভক্ত’। এই তত্ত্ব আজ সেই দেশের বিচার বিভাগ ক্ষয়িষ্ণু ধারায় প্রবাহিত। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাবে সেই দেশ আজ গণতন্ত্রহীন, স্বৈরাচারের চারণক্ষেত্র । সেখানে যারা আইন আদালত নিয়ে একটু কাজ করে শুধু তাঁরাই নয়, সেদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যে কেউ এই তত্ত্বের অস্তিত্ব জানান দিবে। সমবেত কণ্ঠেই তারা বলবে, ন্যায় বিচার রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের vicious cycle এ বন্দি। সরকারি দলের নেতা কিংবা দুর্বৃত্তদের হাতেই অজস্র নাগরিক বিচারহীনতার শিকার হন। সে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেনো। এর প্রথম এবং প্রধান কারণ রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন বা criminalisation of politics এবং যার ফলে বিচার বিভাগ কিংবা বিচার বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোন অফিস কিংবা ব্যক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে উন্নত হতে দেওয়া হয়নি বা সঠিক ভাবে Institutionalised করা হয়নি ।

জানো মাধবী, আমার কল্পনার সেই দেশে দুর্বৃত্তদের চৌকি পেরিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রাথমিক সিঁড়ি তথা থানা-পুলিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পৌঁছানো এখন দুরহ ব্যাপার। সেখানে পৌঁছানোর আগে স্থানীয় রাজনৈতিক দূর্বৃত্তদের বিষাক্ত থাবা পেরোতে হয়। থানা পুলিশ বিচার বিভাগ নয়, তবে ফৌজদারী বিচারব্যবস্থার কিংবা ন্যায় বিচার বা বিচার যাই বলি না কেনো সেটা প্রাপ্তির প্রাথমিক স্তর। সেখানে বিচারপ্রার্থী একা গেলে অনেকটা উপেক্ষিত হয়, বিরোধী দলীয় কারও সাহায্যে গেলে অপমানিত হতে পারে, সরকার দলীয় লোকের মাধ্যমে গেলে সন্মানিত হবে এট নিশ্চিত। এটা এক ধরনের ‘ডিভাইডেড জাস্টিস’! সেদেশের আইনশৃঙ্খলা  রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্যান্য সরকারী সংস্থা অনেক মানবিক কাজ করেন, অনেক জনন্দিত কাজের জন্য তাঁরা সমাদৃতও বটে। কিন্তু বিরোধী দলীয় নেতা কর্মীদের দমনপীড়নে, ভিন্নমত রুখতে, রাতের নিকশ কালো আঁধারে মোমবাতির আলোয় ভোট কাটতে কিংবা গনতন্ত্র হত্যায় তাদের ভূমিকা সর্বগ্রাসী, সর্বনাশা, দেশ ধ্বংসের উন্মত্ত নগ্ননৃত্য। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতার এমন দেশ, সে দেশের নাগরিকগন চায়নি মাধবী? এটা আমি নিশ্চিত ।

মাধবী, ন্যায় বিচারের ধারণা সম্পর্কে বলা হয়, Justice should not only been done, it should also seen to have been done! কিন্ত ঐ দেশের বিচার ব্যবস্থা উল্টো পথে চলছে। সম্প্রতি, কিছু কিছু মামলাতে সেদেশের জনগন উপলব্ধি করলো Injustice is not only been done, injustice is also seen to have been done!

সে যাইহোক, বিচারের জন্য সেদেশের মানুষ আদালতে যায়, সেখানে মামলার মেরিটের সাথে দেখা হয় আইনজীবি কে? বড় কোন হোমড়া চোমড়া না কি সাধারন কিংবা তরুন কোন আইনজীবি? সরকার দলীয় আইনজীবি নাকি বিরোধী দলীয় আইনজীবি? মামলার মেরিটের আগে উক্ত বিষয়গুলো মামলায় প্রতিকারের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। এই সংস্কৃতি আবহমান কাল থেকে সেখানে প্রচলিত থাকলেও, নীতিনৈতিকতার অবক্ষয়ের ফলে এই যুগে এটা অনেকটা দৃশ্যমান ভাবে প্রতিভাত! এটাও এক ধরনের ‘ডিভাইডেড জাস্টিস’, ‘ডিভাইন’ নয়! একজন বিচারপ্রার্থী আদালতের দ্বারস্থ হলে তাকে পুলিশ-কেরানী-মুহুরীর চক্রে ঘোল খেতে হয়। তারপর উকিল সাহেবরা তো আছেই! সেদেশের উকিল সাহেবদের স্বভাব চরিত্র এবং পয়সার প্রতি হ্যাংলামো তো তোমার জানার কথা! সেখানে উকিল সাহেবদের সম্পর্কে নাগরিকদের ধারনা খুব বেশী উন্নত নয়, সেই আদিকাল থেকেই। তারপর থাকে পেশকার-পিওন-আরদালী। সব পেরিয়ে বিচারকের সামনে গেলে তখন মেরিটের আগে উক্ত বিষয়গুলো আসে! ইদানীং শোনা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক লেনদেন, নেপোটিজম, সরকারের নিয়ন্ত্রন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিচারকে কলুষিত করছে সেখানে! এটাও এক প্রকার ডিভাইডেড জাস্টিস, ডিভাইন নয় মাধবী!
মাধবী, সেই দেশের সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে তোমাকে আর নতুন করে কি কথা বলবো! আমার দেশের এই প্রান্তর নিয়ে আমার প্রতিদিনের দহনের স্বাক্ষী তুমি! কল্পনার ঐ দেশের ন্যায় বিচারের ধারনা বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত ন্যায় বিচারের ধারনার থেকে কিছুটা হলেও distinct and separate। আমার এক কল্পিত বন্ধু তার পেশাগত জীবনের গত আড়াই দশক ধরে দেখেছে কিভাবে সেখানকার অনেক মাননীয় বিচারপতি মহোদয়গন ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা আইনজীবি সহকর্মীদের নির্লজ্জ-পর্দাহীনভাবে উন্মুক্ত আদালতে প্রশংসার জোয়ারে ভাসাতে থাকেন। এই ধরনের আচরনে উনাদের লজ্জা না লাগলেও, যে আইনজীবি বন্ধুকে এভাবে প্রশংসা করা হয় তিনি প্রথমদিকে কুন্ঠিত কিংবা বিব্রত হন। পরবর্তীতে অবশ্য উপভোগ এবং ভোগ করেন। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা প্রশংসা শুনতে ভালোবাসেন, আর আমার বন্ধুর বিজ্ঞ ক্ষমতাধর সহকর্মীবৃন্দতো রক্ত মাংসের মানুষ। যতদিন দল ক্ষমতায় থাকে ততদিনে সেখানে গোটা শহর ছড়িয়ে কারাগার পর্যন্ত পৌঁছে যায় কোন দেবতা কোন ফুলে তুষ্ট, অর্থাৎ, কোন বিচারকের সামনে কোন আইনজীবির নৈবেদ্য নিবেদন গ্রহনযোগ্য! পেশাগত জীবনে এই সংস্কৃতি দেখতে দেখতে আমার বন্ধুটি বড্ড ক্লান্ত মাধবী ।

আমার মনে পড়ে, কোন এক মামলায় আমারও এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। কোন এক মামলায় আমার প্রতিপক্ষ ছিলেন সাবেক এক মন্ত্রীর পুত্র । মান্যবর প্রিজাইডিং বিচারপতি ফাইল ধরেই আমার বক্তব্য পেশ করার পূর্বে আমাকে একটু বসতে বলে অন্যপক্ষের আইনজীবি, মন্ত্রি পুত্রকে পোডিয়ামে ডাকলেন, তাঁর কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর বাবার কুশলাদি জানলেন। এরপর প্রায় আধাঘন্টা বিচারপতি মহোদয় মন্ত্রী বাহাদুরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, আমার একবারও মনে হয়নি তিনি এভাবে প্রশংসা করতে বিব্রত বোধ করছেন। পাশে বসা তাঁর ব্রাদার জাজ নির্বাক হয়ে শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে! এক পর্যায়ে, আমি বললাম, মাই লর্ড, মন্ত্রী মহোদয় এখনো বেঁচে আছেন, ফুল কোর্ট সভায় মৃত ব্যক্তিদের যেভাবে গুণকীর্তন করা হয়, সেভাবে না করলেও চলবে, উনার কানে গেলে উনি মাইন্ড করতে পারেন, একটু থামুন, আমার মামলাটি এখানে শুনানী করতে চাই না। মনে হলো, হিজ লর্ডশীপ জগতে ফিরলেন, মামলা দ্রুত শুনে রায় দিলেন, ফলাফল নিশ্চয়ই আপনাদের বলতে হবে না। কয়েকদিন পর তিনি আপীল বিভাগে এলিভেটেড হয়েছিলেন।

মাধবী, তোমাকে যে দেশের বিচার ব্যবস্থার কথা বলছি সেখানে মন্ত্রীর সন্তান, ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাধর কিংবা পাতি নেতা, বিচারপতির সন্তান কিংবা স্ত্রী উচ্চ আদালতে প্র্যাকটিসে বিশেষ আনুকূল্য পান এটা সর্বজন বিদিত! এটাও এক ধরনের ডিভাইডেড , নট ডিভাইন, জাস্টিস!

জানো মাধবী, ঐ দেশটার সুপ্রীমকোর্ট সংবিধানের অভিভাবক! অভিবাবক দুর্বল হলে, অন্য সদস্যরা বখাটে হয়, চোর , ডাকাত, নৈরাজ্যবাদী কিংবা নষ্টামীর চরম সীমায় পৌঁছায়। যেমনটি হয়েছে ঐদেশের সকল সেক্টরে। সেই দেশের সুপ্রিম কোর্ট তথা সংবিধানের অভিভাবকের দুর্বলতার কারণে সংবিধান আজ পদদলিত, সেদেশ আজ গনতন্ত্রহীন, নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিষ্পেষিত। গণতন্ত্রের অন্যতম মৌল উপাদান ভোট বা ভোটাধিকার আজ সেখানে কাগজে আছে বাস্তবে নেই। বিনা বিচারে হত্যা, গুম, নির্যাতন আজ ফ্রাংকেনস্টাইন সেখানে। এ সবই সেখানকার সুপ্রিমকার্ট এর দুর্বলতা কিংবা নীরবতার ফসল বলে আমি মনে করি। সুপ্রীমকোর্ট এসব ক্ষেত্রে খুবই টেকনিক্যাল হয়ে যায়, পাশকাটানোর কৌশল অবলম্বন করেন। আর এই সুযোগেই গনতন্ত্রের সংগ্রামকে নস্যাৎ করতে নীতি নৈতিকতাহীন রাজনৈতিক দূর্বৃত্বায়ন সচল হয়, খুন-গুম-হেফাজতে মৃত্যু-ভোট ডাকাতির পথ ধরে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়,স্বৈরাচারের শিকড় প্রথিত হয়, যা সেখানে হয়েছে।

মাধবী, অনেক অর্জন, অনেক সাহসী রায়, অধিকাংশ মামলায় ন্যায় বিচার করার নিরন্তর প্রচেষ্টা থাকলেও, সেখানকার বিচার বিভাগে আজ লোভ এবং ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে সময় পার করছে। লোভের জায়গা হলো উচ্চতর পদে যাওয়া, ভালো পোস্টিং কিংবা এখতিয়ার পাওয়া কিংবা অবসরের পর সেদেশের আইন কমিশন কিংবা অন্য কোন ট্রাইবুনাল বা আপীল ট্রাইবুনালে চাকরী পাওয়া। আর ভয়ের জায়গাটা হলো , কোন রকম হেনস্তা না হওয়া, জোরপূর্বক অসুস্থ বানিয়ে বাসায় অতন্দ্র প্রহরায় ছুটি না কাটানো কিংবা দেশ ছাড়তে বাধ্য না হওয়া, ঠিক যেমনটি ঘটেছিলো সেদেশের একজন সার্ভিস প্রধান বিচারপতির সাথে। এসবই সেই দেশের বর্তমান বিচারাঙ্গনের চিত্র। বিদ্যমান প্রধান বিচারপতিকে যেভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে তা সমসাময়িক বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে সেদেশের কোন ন্যায় বিচারক পদত্যাগ করেন নি, তাদের বিবেক কিছু বলে নি মাধবী। সেদেশে বিচারকগন সহকর্মীর অধিকার লংঘন করে উপরে উঠতে চায়, কুন্ঠিত কিংবা বিব্রত হন না। কেউ না জানুক, তুমি তো জানো মাধবী , আমার বিশেষ সেই বন্ধুটি সেই নিগ্রীহিত প্রধানবিচারপতির ফ্যান ছিলাে না, তার কোন সুবিধাভোগী কিংবা উচ্ছিষ্টভোগী ছিলো না, তার favouratism এর beneficiary ছিলাে না। সে তার ঘোরতর সমালোচক ছিলো। কারন, সেদেশের গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য তার ভূমিকাও কম নয়, সেও বিচার বিভাগের অভিভাবকত্বের এখতিয়ারকে সংকুচিত করেছিলো। আর যখনই যে কোন কারনেই হোক ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে, তখনই তার পরিণতি সে ভোগ করেছে। আর এটা ছিলো ঐ দেশের সব বিচারপতিদের জন্য একটা বার্তা, ভয়ের বার্তা। স্বাধীন দেশের একজন প্রধান বিচারপতি যখন অন্য কোন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চায়, নিশ্চয়ই তাকে বলতে হয় এদেশে গণতন্ত্র নেই, এখনকার বিচারবিভাগ একজন প্রধান বিচারপতির উপর হয়ে যাওয়া অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না, ন্যায় বিচার দিতে পারে না। তাহলে সে দেশের সাধারন মানুষের কথা একবার ভাবতো মাধবী!

জানো মাধবী, আমাদের সুপ্রিমকোর্টে নিয়ে গর্ব এবং অহংকার করার মত অনেক কিছু আছে, এটি আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন, এর ভেতরকার সবুজ মনোরম পরিবেশ, ফুলের বাগান, পাখির ডাক আমাকে টানে, মুগ্ধ করে। তুমিতো জানো, কতটা দুরন্ত ও বিমোহিত হই এই প্রাঙ্গনের জন্য! তুমি ঈর্ষান্বিত হইও না, তোমার সাথে কারও তুলনা করি না। তুমি জেনে আনন্দিত হবে যে, এখানে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি আছে। এখানকার প্রবীণ আইনজীবীগণ নীতি নৈতিকতা আর জ্ঞান গরিমায় বিদগ্ধজন। তরুন আইনজীবিদের প্রানোচ্ছল মেধার প্রয়োগ আর সৃষ্টিশীলতা অনন্য। কিন্ত আমার ভয় হয় এরা হারিয়ে না যায়, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের cycle এ এরা নষ্ট হয়ে না যায়! তাহলে আমাদের, আমার এবং বাংলদেশের মানুষের এই রক্তস্নাত অর্জন-আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের সংবিধান, আমাদের সুপ্রিমকার্ট অরক্ষিত হয়ে পড়বে! বিদগ্ধ জনের অভাবে এখানে বিরানভূমি হবে, সমৃদ্ধ লাইব্রেরীর প্রয়োজনীয়তা হারাবে , আমাদের গর্বের স্বাধীনতা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের কাছে হারিয়ে যাবে!

আজ আর নয় মাধবী! শুধু বলবো, তুমি কেমন যেন হিংসুটে হয়ে গেছো, আমাকে তোমার উপেক্ষা পোড়ায়, নীল বেদনা দেয়। তুমি যখন ভালোবাসবে তখন একবুক সমুদ্র নিয়ে ভালোবাসবে, এক বুক সমুদ্র, ঠিক আমার মতো !

  • লেখক — আইনজীবি ও রাজনৈতিক কর্মী।