সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
‘বাবার আইসিইউ সাপোর্টটা খুব দরকার ছিল, কিন্তু তা পাওয়া যায়নি। বাবার চিকিৎসাই হলো না, তিনি মারা গেলেন। আমি ডাক্তার হয়েও কিছু করতে পারলাম না।’ এই আক্ষেপ একজন সন্তানের। একজন চিকিৎসক সন্তান মুমূর্ষু বাবাকে নিয়ে তার চেনাজানা আটটি হাসপাতালে ঘুরেও ব্যর্থ হয়েছেন ভর্তি করাতে। শেষ পর্যন্ত ‘বিশেষ তদবিরে’ কভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলেও সেখানে পাননি আইসিইউ সাপোর্ট। সেখানেই মৃত্যু হয় কভিড রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ডাক্তার সুস্মিতার বাবা অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকারের। আটটি হাসপাতালই কভিড টেস্ট করতে হবে অথবা আইসিইউ নেই জানিয়ে ফেরত দিয়েছে তাকে। এর মধ্যে এমন হাসপাতালও আছে যেখানে আগে চাকরি করেছেন ডাক্তার সুস্মিতা। সে হাসপাতালের পরিচিতজনরাও সদয় হননি তার প্রতি। এমনকি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তির পরে দুদিনেও করা হয়নি তার বাবার সেই কাক্সিক্ষত করোনাভাইরাস শনাক্তের টেস্ট, যা ছিল না বলে আটটি হাসপাতাল ফিরিয়ে দিয়েছিল তাকে। এমনকি মৃত্যুর পরে ডাক্তার সুস্মিতার অনুরোধ সত্ত্বেও করা হয়নি কভিড টেস্ট। সেই আক্ষেপ জানিয়ে সুস্মিতা বলেছেন, ‘আমি আমার বাবাকে নিয়ে সাফার করেছি, এটা নিয়ে আমি কথা বলব। বিশেষ করে নরমাল যারা পেশেন্ট, কভিড-১৯ না, আমার বাবার মতো কিডনি পেশেন্ট, তারা কী করবেন, তাদের জন্য কী করছেন? কারণ আমি যে হাসপাতালেই গিয়েছি সবাই বলেছে, টেস্ট (রিপোর্ট) আনেন। আমি টেস্টটা কোথায় করাব?
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ |
আমি টেস্টটা কোথায় করাব- এই প্রশ্নের সুরাহা এখনো দিতে পারেনি কর্র্তৃপক্ষ। দেশে করোনা রোগী শনাক্তের পর দুই মাস পেরিয়ে গেলেও ডাক্তার সুস্মিতার মতো অসংখ্য মানুষের এই প্রশ্নের উত্তর এখনো দিতে পারেনি সরকার। এমনিতেই আমাদের আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে কম টেস্ট হচ্ছে বাংলাদেশে। ১৩ মে পর্যন্ত প্রতি মিলিয়নে (দশ লাখে) ভারতে ১ হাজার ২৭৫, পাকিস্তানে ১ হাজার ৩৮৫, শ্রীলঙ্কায় ১ হাজার ৭৫৯, নেপালে ২ হাজার ৬২৩, ভুটানে ১৫ হাজার ৭৬৩, মালদ্বীপে ২১ হাজার ৭৮৪টি টেস্ট হয়েছে। আর বাংলাদেশে প্রতি মিলিয়নে টেস্ট হয়েছে মাত্র ৮৩০টি। ওই সব দেশ যদি করোনা টেস্টের কিট পেতে পারে তবে বাংলাদেশ কেন পায় না?
করোনা টেস্ট কম হওয়াতে করোনা বিস্তার রোধ করা যেমন দুরূহ হয়ে পড়ছে, তেমনি এর ফলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া রোগীরা। জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যথা এর যে কোনো একটি উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে গেলে তাদের পরিণতি যে কী হয় তা স্পষ্ট হয়েছে অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকারের আট হাসপাতালে ঘুরে নবম হাসপাতালে গিয়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনায়। তার মৃত্যুর পরে অনেকেই এই প্রশ্নটি তুলেছেন যে, সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিবের মতো প্রিভিলেজড বা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তির যদি এই রকম পরিস্থিতিতে পড়ে মারা যেতে হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে কী ঘটছে এই দেশে?
অন্যদের কী অবস্থা হয় তার দুয়েকটা রিপোর্টও যে সংবাদমাধ্যমে আসছে না এমন নয়। কিন্তু তারা সাধারণ মানুষ বলে হয়তো আলোচনায় আসেন কম। কারণ আমরা অসাধারণদের নিয়ে আলোচনা করতেই বেশি ভালোবাসি। ১১ মে সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে, ‘তিন ঘণ্টা হাসপাতালে ঘুরে মারা গেল ছেলে, খবর শুনে বাবারও মৃত্যু’। রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২৪ বছরের যুবক রিমন সাউদ জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে রাত ৩টায় নিজেদের গাড়িতে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন। কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরে কেউ ভর্তি না নেওয়ায় পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। ভোর ৬টার দিকে সেখানেই মারা যান রিমন। বাড়ির দোতলা থেকে হেঁটে নেমে গাড়িতে উঠে হাসপাতালে আসা ছেলের মৃত্যুর খবরটা সইতে পারেননি বাবা। তাই ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান বাবাও। এই খবর পড়লে বা শুনলে কার না বুকে ব্যথা হয়! কিন্তু এমন খবর প্রায় প্রতিদিনই শুনতে বা পড়তে হচ্ছে আমাদের।
দৈনিক ভোরের কাগজের ক্রাইম রিপোর্টার আসলাম রহমানও করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন বলে আক্ষেপ করেছেন তার সহকর্মীরা। যদিও তার চূড়ান্ত রিপোর্টে জানা যায় তিনি কভিড আক্রান্ত ছিলেন না। যদিও এই ধরনের রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেন।
এমন সাসপেক্টেড কভিড বা যাদের কভিডের মতো উপসর্গ আছে তারাই বেশি বিপদগ্রস্ত। মৃত্যুর হারও তাদের মধ্যেই বেশি। সংবাদমাধ্যমে আসা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটেই ২ মে থেকে ১১ মে পর্যন্ত ১০ দিনে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ১১৯ জন। এদের মধ্যে মাত্র ১১ জনকে করোনা পজিটিভ রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। বাকি ১০৮ জনই করোনা সাসপেক্ট! অর্থাৎ তারা করোনা কি না তা নির্ধারণই করা হয়নি। শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি করা ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৮ মার্চ থেকে ৯ মে পর্যন্ত সারা দেশে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৯২৯ জন (ঢাকা ট্রিবিউন, ১২ মে ২০২০)।
হাতপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে এই যে মৃত্যু হচ্ছে তাতে অনেকেরই রাগটা গিয়ে পড়ছে চিকিৎসকদের ওপর। তারা হয়তো তলিয়ে দেখেন না যে, এর পেছনে চিকিৎসকদের দায় কতটা আর ব্যবস্থাপনার ঘাটতি কতটা। সরকার যদি ঢাকা মেডিকেলের মতো সব সরকারি হাসপাতালে কভিড রোগীদের ভর্তির সঙ্গে ভিন্ন ফ্লোরে আলাদা করে কভিড সাসপেক্ট রোগীদেরও চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দিত আর তা মিডিয়ায় প্রচার চালানো হতো, তাহলে হয়তো কভিড উপসর্গ নিয়ে রোগীরা সব হাসপাতালে ছুটতেন না। তাতে এই সব রোগীর ঝুঁকি কমে যেত অনেক। আর যে টেস্টের জন্য রোগীদের এত বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে তাও কী করে বাড়ানো যায় সে চেষ্টায়ও ব্যাপক ঘাটতি আছে কর্তৃপক্ষের।
একদিকে স্বাস্থ্য খাতে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ। মোট জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ২৭ শতাংশ ব্যয় করা হয় আমাদের স্বাস্থ্য খাতে। তার ওপর চুরি-দুর্নীতি তো আছেই। ফলে সেই কম বরাদ্দেরও কতটুকু যে শেষ পর্যন্ত দেশবাসীর স্বাস্থ্যসেবায় কাজে লাগছে সে এক বড় প্রশ্ন। আমাদের মন্ত্রী, এমপিরা সাধারণ রোগের চিকিৎসা করাতেও জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ করে বিদেশে চলে যান। যাদের টাকা খরচ করে তারা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেন, সেই সাধারণ জনগণের জন্য তারা ভালো মানের চিকিৎসা ব্যবস্থাটা পর্যন্ত গড়ে তুলেননি এই দেশে। এমনকি এমন মাননীয়রা চিকিৎসা নিতে পারেন এমন মানের একটা হাসপাতালও তারা তৈরি করতে পারেননি। তারা হয়তো ভাবেননি যে, এমন দিনও আসতে পারে যখন অনেক টাকা আর ক্ষমতা থাকার পরেও বিদেশে যেতে পারবেন না। এই দেশেই চিকিৎসা নিতে হবে তাদের।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আজকের এই ভঙ্গুর অবস্থা দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার ফল। একযুগ ধরে টানা ক্ষমতায় থেকে উন্নয়নের যে গল্প করছিল সরকার, সে গল্পের ফানুস ফুটো করে দিয়েছে করোনা। তবে আগের সেই সব কথা বলে এখন আর লাভ নেই। এখন যা আছে তাই দিয়েই সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে আগে।
সংবাদমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম ৬০ দিনে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ বাংলাদেশে, সুস্থতার হার সবচেয়ে কম। করোনাভাইরাসের সূচকে এশিয়ার পরবর্তী ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে বাংলাদেশকে। তার ওপর সরকার পোশাক কারখানা, রেস্তোরাঁ, দোকান, শপিংমল খুলে দিয়ে করোনা বিস্তারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। বাড়ছে আক্রান্তের হার। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছেন চিকিৎসক, পুলিশ, সাংবাদিকসহ যারা করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে লড়ছেন তারা। বাড়ছে মৃত্যু। তাই করোনার বিস্তাররোধে বিশেষজ্ঞ মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যাপ্ত টেস্ট করাসহ যা যা করণীয় তা সবই করতে হবে সরকারকে। সব নিয়মও মেনে চলতে হবে দেশবাসীকে। আর হাসপাতালগুলোকে সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় এনে এমন পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে যাতে আর একজন মানুষও বিনা চিকিৎসায় মারা না যান।
- লেখক - চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
- কার্টসি - দেশ রুপান্তর / মে ১৪, ২০২০
No comments:
Post a Comment