সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় এ দেশের ৫০ লাখ অসচ্ছল মানুষ একটা আশার আলো দেখা শুরু করেছিল। তারা ভেবেছিল, যাক ঈদের আগে আমরা হয়তো আড়াই হাজার টাকা পেতে যাচ্ছি। এই করোনাকালে যখন খেয়ে বেঁচে থাকা দায়, সন্তানের মুখে দুবেলা ভাত তুলে দেওয়া অনেকের জন্যই অসম্ভব, তখন একসঙ্গে আড়াই হাজার টাকা হাতে পাওয়া তাদের জন্য চাট্টিখানি কথা নয়!
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ |
এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী লাইন ধরে দশ টাকা সের দরে চাল কিনে কোনো মতে চালিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু সেই সাশ্রয়ী দরে চাল কেনার সুযোগটাও তাদের ভাগ্যে সইল না। সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করল সারা দেশে চাল চুরির খবর। দরিদ্র মানুষের প্রাপ্য চাল জায়গা করে নিল সরকারদলীয় নেতাদের গুদামে। মণে মণে, টনে টনে চাল। সরকারপ্রধান কত রকম হুঁশিয়ারি দিলেন। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ত্রাণের ‘অনিয়মের’ সঙ্গে যারা যুক্ত হবে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। র্যাব, পুলিশ হানা দিল অবৈধভাবে সরকারি চাল মজুদ করা গুদামে। কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হলো। কিন্তু যে চোর ধর্মের কথাই শোনে না, সে কি আর হুঁশিয়ারিতে ভয় পায়! জনপ্রতিনিধিদের এই চাল চুরির খবর দেশীয় গণমাধ্যম ছাড়িয়ে জায়গা করে নিল আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট লিখে দিল, ‘বাংলাদেশে করোনা মোকাবিলার টাকা যাচ্ছে দুর্নীতিবাজদের পকেটে।’ করোনাকালের দুর্যোগে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের দেওয়া ত্রাণ মেরে দিচ্ছে জনপ্রতিনিধিরা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেল যে ১০ টাকা সের চাল বিক্রিই বন্ধ করে দিতে হলো সরকারকে। বলা হলো, ত্রাণ দেওয়ার নতুন পদ্ধতি খুঁজছেন তারা। এতে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গেল যে সরকারের চেয়ে চাল চোরদের জোর বেশি! গরিব মানুষ পড়ল মহাবিপদে। দেশজুড়ে করোনার বিস্তাররোধে চলছে লকডাউন। অনেকেরই কাজ নেই। হাতে টাকা নেই। ত্রাণের দেখা নেই। এমন অনেক নেই-এর সঙ্গে যুক্ত হলো ‘দশ টাকা সের চাল নেই’।
এই দুশ্চিন্তাটা কিছুটা হলেও দূর হলো প্রধানমন্ত্রীর নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণায়। কিন্তু ঈদের মাত্র এক সপ্তাহ আগে এসে তাদের মাথায় ভর করল আবার দুশ্চিন্তা। তারা জেনে গেলেন, ৫০ লাখের সবাই টাকাটা এখনই পাচ্ছেন না। জানা গেল, তালিকার ৫০ লাখের মধ্যে প্রম দফায় টিকেছে মাত্র সাড়ে সাত লাখ হতদরিদ্রের নাম! নানা অসংগতি থাকায় শুরুতেই ৫০ লাখ থেকে ঝরে পড়েছে ১০ লাখ। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব জানিয়েছেন, শুধু এই ১০ লাখই নয়, আরও বাতিল হবে। কারণ তাদের নাম, পেশা, মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্রে অসংগতি রয়েছে।
কিন্তু ৫০ লাখের মধ্যে ১০ লাখের বেশি মানুষের ক্ষেত্রে এই অসংগতিটা কেন হলো? এর যথাযথ উত্তর সংগত কারণেই দেওয়া কঠিন। তবে এর উত্তর মিলতে পারে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু শিরোনাম থেকেই। দুস্থদের থেকে অবৈধভাবে অর্থ আদায়ের অভিযোগ ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে (বাংলা ট্রিবিউন, ১৭ মে ২০২০), প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মনিটরিংয়ে নগদ সহায়তার দুর্নীতি ধরা পড়ে (সময় টিভি, ১৭ মে ২০২০), নগদ টাকায় নয়ছয় (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭ মে ২০২০), দুস্থের টাকায় সচ্ছলের ভাগ (দেশ রূপান্তর, ১৭ মে ২০২০), প্রধানমন্ত্রীর নগদ অর্থ সহায়তা তালিকায় অনিয়মের তদন্ত শুরু (দি ডেইলি স্টার, ১৭ মে ২০২০), প্রধানমন্ত্রীর নগদ অর্থ সহায়তা তালিকায় এক মোবাইল নম্বর ২০০ বার (দি ডেইলি স্টার, ১৬ মে ২০২০), দুস্থদের দেওয়া সরকারি টাকার নামের তালিকায় শিক্ষকের স্ত্রী! (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ১৭ মে ২০২০), ২৫০০ টাকার সরকারি সহায়তা তালিকায় ৪ মোবাইল নম্বর ৩০৬ বার! (যুগান্তর, ১৬ মে ২০২০), ২৫০০ টাকার তালিকায় নাম গরিবের, নম্বর মেম্বারের (সময় টিভি, ১৬ মে ২০২০), ৯৯ নামের পাশে ১ জনের ফোন নম্বর (কালের কণ্ঠ, ১৬ মে ২০২০), কোটিপতিরাও ওএমএসের তালিকায় (দি ডেইলি স্টার, ১৪ মে ২০২০), ৫৩ দুস্থের নামের পাশে ইউপি চেয়ারম্যানের পিএসের মোবাইল নম্বর ( ইত্তেফাক, ১৬ মে ২০২০), ৪০ জনের নামের পাশে এক মেম্বারের মোবাইল নম্বর (কালের কণ্ঠ, ১৫ মে ২০২০)। শিরোনামের আধিক্য দিয়ে আর পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানো ঠিক হবে না। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত নগদ অর্থ সহায়তা কর্মসূচি, যাকে সরকার বলছে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার, তাতে যে কী কা- ঘটেছে আর কেন ৫০ লাখের তালিকা থেকে ১০ লাখের বেশি বাদ দিতে হয়েছে তা বোঝার জন্য এই কয়টা শিরোনামই কি যথেষ্ট নয়?
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎপরতা ও তালিকা থেকে ১০ লাখের বেশি অর্থাৎ ২০ শতাংশের বেশি বাতিল করা দেখে অনুমান করা যায় যে, এ নগদ সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সত্যিই আন্তরিক। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন, চালচুরির যে অপবাদ দলীয় নেতাদের গায়ে লেগেছে সেই একই সিল যেন এবার আর না পড়ে। তাই প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। এতে নাম, মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ম্যাচ না করলে সে নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। ১০ লাখ বাদ যাওয়া দেখে বোঝা যাচ্ছে, যন্ত্র তার কাজটি ঠিক মতোই করেছে। এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আমাদের বুঝ দিচ্ছেন যে এই নগদ সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম করার সুযোগ নেই। কেউ অনিয়ম করলে সেটা এভাবেই বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং যা হচ্ছে তা স্বচ্ছতার সঙ্গেই হচ্ছে।
আসলেই কী বিষয়টা এত সরল? একজন জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের লোক তার মোবাইল নম্বরের সঙ্গে শত শত নাম জুড়ে দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতে চেয়েছিলেন সেটা সম্ভব হয়নি, মানলাম। কিন্তু যে চেয়ারম্যান, মেম্বার বা প্রশাসনের ব্যক্তিরা এমন ভয়াবহ দুর্যোগকালেও এই জালিয়াতি করতে পারেন তারা যে জঘন্য চোর সেটা তো প্রমাণিত। তাহলে সেই চোরদের দেওয়া বাকি তালিকাটি যে সঠিক হয়েছে তার নিশ্চয়তা কী? ধরা যাক, তারা এই তালিকায় তাদের পরিবারের সদস্য, সচ্ছল আত্মীয়-পরিজন ও দলীয় লোকদের নাম ঢোকালেন যারা এ নগদ অর্থ সহায়তার হকদার নয়। তাদের নাম, মোবাইল নম্বর, পেশা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর সবই ঠিক আছে। একশ’তে একশ’ ম্যাচ করেছে। এই দুর্নীতি কি ধরতে পারবে কোনো প্রযুক্তি? সংবাদমাধ্যমে তো এমন রিপোর্ট এসেছে যাতে জানা গেছে সরকারি দলের কোটিপতি নেতারাও ওএমএসের তালিকায় আছেন। নগদ অর্থ সহায়তা পাওয়ার জন্য নাম ঢোকাতে হতদরিদ্রদের থেকে চেয়ারম্যান টাকা নিয়েছেন বলেও রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই দুর্নীতি কি ধরার সাধ্য আছে কোনো প্রযুক্তির?
এ দুর্নীতি রোধ করতে পারত যে পদ্ধতি তার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বাম জোট থেকেও অনুরূপ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এরা সবাই দাবি করেছিলেন, করোনা মোকাবিলার জন্য একটা জাতীয় কমিটি গঠনের। কিন্তু সরকার তা নাকচ করে দেয়। সে প্রস্তাব নাকচ না করে যদি সব প্রধান রাজনৈতিক দলের সদস্য, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি করা হতো, তাহলে হয়তো এমনটি হতো না। সে ক্ষেত্রে একটা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ তৈরি হতো। বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিরাজমান তাতে কোনো সুবিধা-বণ্টনের তালিকা সরকারি দলের লোকদের করতে দিলে তাতে যে ভিনড়বমতের কোনো মানুষের নাম ঠাঁই পায় না এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। সেটা জেনেও যখন তালিকা করার দায়িত্বটা সরকারি দলের নেতা ও প্রশাসনের লোকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তখন যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
আগেই বলেছি, নগদ অর্থ সহায়তা দলীয় লোকরা পেলেও তা যেন হতদরিদ্ররা পায় সে ইচ্ছে হয়তো সরকারের ছিল। কিন্তু সে নির্দেশ পালনে সততার পরিচয় দেননি সরকারি দলের তৃণমূলের নেতারা। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে তৃণমূল পর্যন্ত যে অনৈতিক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেছে তার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন রাষ্ট্রকে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে সৃষ্ট সেই জনপ্রতিনিধিরা এখন এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন যে সরকার প্রধানের কোনো আদেশ, নির্দেশ, ধমকও কানে তোলার প্রয়োজন বোধ করেন না।
- কার্টসি - দেশ রূপান্তর/ মে ২১, ২০২০
No comments:
Post a Comment