শহীদুল্লাহ ফরায়জী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার একই ধরনের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুই ধরনের নীতি অনুসরণ করছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর মেয়রসহ কাউন্সিলরদের কমপক্ষে ১০০ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য। কারণ বিদ্যমান সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ শেষ না হলে পরবর্তী সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব গ্রহণ আইনত নিষিদ্ধ। স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ এ বলা হয়েছে, কর্পোরেশনের মেয়াদ উহা ঘটিত হইবার পর উহার প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হইবার তারিখ হইতে পাঁচ বছর হইবে। ফলে নির্বাচন যখনই হোক কর্পোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়া ছাড়া দায়িত্ব গ্রহণের কোন আইন নেই।
অনুরুপভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এই ধরনের সাংবিধানিক বিধান রয়েছে। কোন একটি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে পরবর্তী সংসদ দায়িত্ব নিতে পারবে না। কারণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ হ্রাস করার কোন সাংবিধানিক এখতিয়ার সরকারের নেই।
আমাদের সংবিধানে সংসদ ভাঙ্গার দুইটি বিধান রয়েছে
১. রাষ্ট্রপতি সংসদ ভাঙিয়া দিলে, ২. প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।
কিন্ত আমাদের নবম সংসদ ও দশম সংসদ কোনটাই রাষ্ট্রপতি ভেঙ্গে দেননি সুতরাং নবম এবং দশম সংসদকে অবশ্যই পাঁচ বছর সম্পন্ন করার কথা। সংসদের মেয়াদ একদিনের জন্যও হ্রাস করা যায়না সাংবিধানিক বিধিনিষেধের কারণে। এটা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭২(৩) নিশ্চিত করেছে। ৭২(৩)এ বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়ে থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বছর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে:”
আমাদের সংবিধানে সংসদ নির্বাচনের দুটি প্রক্রিয়া অনুসরণের নির্দেশনা আছে। সংবিধানের ১২৩ এর (৩) বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নববই দিনের মধ্যে এবং (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে: তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ উক্ত উপ-দফায় উল্লেখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরুপে কার্যভার ভার গ্রহণ করিবেন না।
নবম এবং দশম সংসদ নির্বাচন ভেঙ্গে যাবার পূর্ববর্তী ৯০দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংবিধান একটি শর্ত যুক্ত করেছে। শর্তটি হচ্ছ কোনক্রমেই মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী সংসদের সদস্যগণ কার্যভার গ্রহণ করবেন না। অর্থাৎ ৯০ দিন পূর্বে নির্বাচন হতে পারবে সাংবিধানিক শর্তে। সুতরাং শর্ত লঙ্ঘনের এখতিয়ার কারো নেই। কিন্তু নবম এবং দশম সংসদের বেলায় সংসদের মেয়াদ থাকা অবস্থায় পরবর্তী সংসদ শপথ নিয়েছে। সংবিধান যেটাকে শর্ত যুক্ত করেছে সরকার সেটাকে করেছে শর্ত শূন্য। এটা সংবিধানের সুষ্পষ্ট লংঘন।
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর নির্বাচিত মেয়রগণ যদি ১০০ দিন অপেক্ষা করে কার্যভার গ্রহণ করতে হয়,সেখানে জাতীয়ভাবে অধিকতর গুরুত্ব পূর্ণ সংসদ নির্বাচনের পর কী ভাবে নবনির্বাচিত সদস্যগণ পূর্ববর্তী সংসদের মেয়াদপূর্তির পূর্বেই কার্যভার গ্রহণ করেন।
সরকার ক্ষমতা তৃষ্ণার কারণেই সংবিধান লঙ্ঘন করছে। এই প্রশ্নটি নির্বাচন কমিশন বা অন্য কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান উত্থাপনই করছে না।
এখানে দুই ক্ষেত্রেই বিধি দ্বারা আরোপিত বাধ্যবাধকতা থাকায় উভয় ক্ষেত্রে একই ধরনের আচরণ করতে হবে। রাষ্ট্রের আচরণ হবে ন্যায় সঙ্গত, কোনক্রমেই খেয়াল খুশি মতো নয়। একই ধরনের আইনের দুই ধরনের প্রয়োগ করা যায় না। ভুল কখনো বৈধতা সৃষ্টি করতে পারে না।
সংসদ সদস্যদের সংবিধান লঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি রোধে আমার প্রস্তাবনা হলো : সংবিধানের ১২৩(৩) সংশোধন করা। মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভেঙ্গে যাবার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য সংবিধানের ১৮তম সংশোধনী আনয়ন করা। তাহলে এক সংসদের মেয়াদ থাকা অবস্থায় অন্য সংসদের শপথ নেয়ার কোনো প্রশ্ন থাকবে না, সরকারের ক্ষমতার তৃষ্ণা দ্রুত পূরণ হওয়ার ক্ষেত্রে কোন অন্তরায় থাকবে না।
আমাদের আইনের শাসন, ভোটাধিকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতকিছুইতো গেল, অন্তত চক্ষুলজ্জাটুকু থাক।
- কার্টসি - মানবজমিন/ মে ১৬, ২০২০
No comments:
Post a Comment