আলী রীয়াজ
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সম্প্রতি জরুরি সেবাদানে নতুন নিয়োগ পাওয়া দুই হাজার চিকিৎসকের উদ্দেশে বলেন, কোভিড-১৯ যদি না আসত, তাহলে আপনাদের হয়তো নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হতো না। কাজেই কোভিড আপনাদের জন্য একটি আশীর্বাদ হিসেবেই এসেছে…কোভিডের কারণেই আপনারা এ নিয়োগ পেয়েছেন (বিবিসি বাংলা, ১৩ মে ২০২০)।
সরকারি চাকরি পাওয়া বাংলাদেশে নিশ্চয়ই ভাগ্যের ব্যাপার। প্রায় দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে তাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু কর্মসংস্থানের হার কমেছে (প্রথম আলো, ৫ মার্চ ২০২০)। ফলে সরকারি চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তরুণদের জন্য উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে বিসিএস। এ রকম সময়ে সরকারি চাকরি ‘ভাগ্যের বিষয়’। তদুপরি এই চিকিৎসকেরা অনেক দিন অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত চাকরি পেয়েছেন। সরকার যেন তাঁদের প্রতি দয়া করেছে, এমন একটা মানসিকতা দেখতে পাই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথার মধ্যে। তাঁর কথায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিমুখী বাগাড়ম্বরের অসারতা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। করোনাভাইরাসের মুখে কেন গোটা জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা এমনভাবে ভেঙে পড়ল, তার উত্তরের খানিকটা এখানেই পাওয়া যায়।
জাহিদ মালেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে না হোক, গণমাধ্যমের ভোক্তা হিসেবে এটা তো জানতেই পারতেন যে সারা বিশ্বে যে তিন লাখের বেশি মানুষ এই ভাইরাসে মারা গেছেন, যাঁরা এতে আক্রান্ত হয়ে জীবন-মরণ লড়াই করছেন, যাঁরা এর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচেছেন, তাঁরা বা তাঁদের নিকটজনদের জন্য এই ভাইরাস আশীর্বাদ নয়। দেশের ভেতরের অবস্থা যদি বিবেচনা করেন, তবে সেখানেও একই কথা। প্রকৃতপক্ষে যেসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই মহামারির সময়ে এই পেশায় যোগ দিলেন, তাঁরাই আসলে ভাইরাস-আক্রান্ত ও সাধারণ মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এলেন।
সরকারের বলা উচিত ছিল, এই দুর্দিনে আপনারা আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এলেন। দেশে দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি এভাবেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হচ্ছে, সম্মান জানানো হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে ভঙ্গুর জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার দায় তুলে দেওয়া হয়েছে চিকিৎসকদের কাঁধে। সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, দুর্নীতি, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের অভাব, সমন্বয়হীনতা—সবকিছুর দায় এখন চিকিৎসকদের কাঁধেই। বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে মালিকেরা কী করবেন, সেদিকে তাকিয়ে থেকেছে সরকার। অথচ আইন আছে, যা ব্যবহার করে সরকার এই হাসপাতালগুলোকে রোগীদের সেবাদানে বাধ্য করতে পারত। এগুলো নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মাথাব্যথা নেই।
করোনাভাইরাস অবশ্যই কারও কারও জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। ত্রাণ বিতরণের শুরু থেকেই তাদের আমরা দেখতে পেয়েছি। ত্রাণ চুরিতে মেতে উঠেছিলেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে একসময় সরকার ওএমএসের কার্যক্রম স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল। তা আবার চালু হয়েছে, ত্রাণের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সচিবদের। কিন্তু অবস্থার কতটা উন্নতি হয়েছে, তা সবার জানা। বলা হয়েছে ভিক্ষুক, ভবঘুরে, রিকশাচালক, চায়ের দোকানিসহ হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ, যাঁরা কোনো সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর অন্তর্ভুক্ত নয়, তাঁদের জন্য হচ্ছে বিশেষ ওএমএস সুবিধা। কিন্তু ওএমএস কার্ডের তালিকায় আওয়ামী লীগের ধনীদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে; কিছু ঘটনা জানা গেছে আর অনেক জানা যায়নি বলাই নিরাপদ।
করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারের জন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি নগদ অর্থসহায়তা কর্মসূচির কথা বলা হচ্ছিল। অর্থনীতিবিদ, সামাজিক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তরফে বলা হয়েছে যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন বাঁচানো এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পথ হচ্ছে দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্তদের হাতে নগদ অর্থ তুলে দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলে তাতে এর অনুপস্থিতি অনেককেই বিস্মিত করে। বারবার এর তাগিদ দেওয়া হয়। অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, ‘১ কোটি বিত্তহীনের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ দিন।’ (প্রথম আলো, ১২ এপ্রিল ২০২০)। সরকার দেরিতে হলেও সেই উদ্যোগ নেয় এবং প্রধানমন্ত্রী ১৪ মে এ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন।
তার পরের দুই দিনের গণমাধ্যমে এ নিয়ে যা খবর বেরিয়েছে, তার কয়েকটি শিরোনামই যথেষ্ট, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার নিতে ৪টি মোবাইল নম্বরে ৩০৬ ব্যক্তির নাম’; (যমুনা টিভি, ১৬ মে ২০২০); ‘সরকারি সহায়তা তালিকায় ২০০ জনের নামের পাশে একটি মোবাইল নম্বর!’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ মে ২০২০)। ‘এক মোবাইল নম্বরেই ৯৯ জনের নাম’ (সিলেট টুডে ২৪, ১৬ মে ২০২০)। এই তালিকা অল্প কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এসব ব্যক্তির জন্য করোনাভাইরাস অবশ্যই আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করতে চাই, অর্থনীতির আসন্ন সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে বাজেট সহযোগিতা হিসেবে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ সংগ্রহ করবে। মাথাপিছু আড়াই হাজার টাকার অর্থ বিতরণে এই অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির পরে এই প্রশ্ন কি অবান্তর, সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের স্বচ্ছতা, জবাবদিহির কী ব্যবস্থা হবে?
ত্রাণ বা নগদ অর্থ লুটপাটের এই ঘটনাই শুধু আশীর্বাদের লক্ষণ নয়; বাংলা প্রবাদ ‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ’ তো আর এমনি এমনি প্রচলিত হয়নি। ভালো করে তাকালে দেখা যাবে যে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর ক্ষেত্রেও আছে নানা ফাঁকফোকর। একসময় বলা হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য চলতি মূলধন হিসাবে বরাদ্দকৃত ৩০ হাজার কোটি টাকা থেকে ঋণখেলাপি কোনো প্রতিষ্ঠান সুবিধা পাবে না। এ–ও বলা হয়েছিল যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ঋণ মন্দ হিসেবে শ্রেণিবিন্যস্ত হওয়ার পর ইতিমধ্যে যদি তিনবারের বেশি নবায়ন করা হয়ে থাকে, তবে ওই প্রতিষ্ঠানও এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ সুবিধা পাবে না (যুগান্তর, ১৩ এপ্রিল ২০২০)। কিন্তু ১১ মে জানা গেছে, ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় শিল্প খাতের জন্য সরকার ৩০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ করেছে, তাতে খেলাপিদের ঋণ দেওয়ার যে বিধিনিষেধ ছিল, তা তুলে নেওয়া হয়েছে।’ (বিডিনিউজ২৪, ১১ মে ২০২০)। ঋণখেলাপিদের জন্য করোনাভাইরাস কি আশীর্বাদ হয়ে উঠল? এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘ঋণখেলাপিরাই তো প্রণোদনার সব অর্থ খেয়ে ফেলবে। অন্যরা বা ভালো উদ্যোক্তারা কিছুই পাবে না। এতে ব্যাংকগুলো আরও সংকটে পড়বে। তাদের জন্য অশনিসংকেত।’(বিডিনিউজ ২৪, ১১ মে ২০২০)।
এই দুর্দিনে যাঁরা লুণ্ঠন করতে পারছেন শুধু তাঁদের জন্যই নয়, করোনাভাইরাস আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে কিছু কিছু সরকার ও রাষ্ট্রের জন্যও। দেশে দেশে নাগরিক অধিকার সীমিত করা হচ্ছে; এমন আইন তৈরি হচ্ছে যা মানুষের কথা বলার অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা চাপিয়ে দিচ্ছেন কঠোর নিয়ন্ত্রণ।
বাংলাদেশে এই ধরনের আইন নতুন করে তৈরি করতে হয়েছে তা নয়, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের খড়্গ আগে থেকেই আছে। তার ব্যবহারে সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা যে সামান্য পিছপা নন তা সহজেই দৃশ্যমান। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আটক হচ্ছেন, মামলা হচ্ছে; অভিযোগ ‘গুজব’ ছড়ানোর কিংবা ‘ষড়যন্ত্রের’, নিদেনপক্ষে ফেসবুকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে ‘মানহানিকর মন্তব্য’ করার। বিচারবহির্ভূত ব্যবস্থা তো আছেই। ভিন্নমত দমন ও সমালোচকদের শায়েস্তার এই চর্চা গত কয়েক বছরের, এখন করোনাভাইরাস হয়ে উঠেছে অজুহাত। নাগরিকদের ওপরে সরকারের নজরদারি বেড়েছে; কিন্তু নাগরিকেরা সরকারের ওপর নজরদারি করলে, ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি চাইলেই নেমে আসছে খড়্গ। করোনাভাইরাস কারও কারও জন্য সত্যিই মনে হয় আশীর্বাদ হিসেবে হাজির হয়েছে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো
- কার্টসি - প্রথম আলো/ মে ১৯, ২০২০
No comments:
Post a Comment