— ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা
রাজনৈতিক বাকযুদ্ধে কিছু কথা এতবার এতভাবে বলা হয়েছে যে সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা এখন আর কেউ চিন্তাও করেনা। রাজনীতির মাঠে আওয়ামেলীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি’কে ঘায়েল করার জন্য গত এক যুগের বেশি সময় ধরে ব্যবহৃত সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র ছিল সম্ভবত যে কোনো প্রসঙ্গে বলা – বিএনপি তার শাসন আমলে দুর্নীতিতে ৫ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ব্যাংক কেলেঙ্কারি, শেয়ার বাজার লুট কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডাকাতি থেকে শুরু করে ৩৭ লাখ টাকার পর্দা, ১০ হাজার টাকার বটি মার্কা প্রকল্প-দুর্নীতি কিংবা বিদ্যুৎ খাতের মত হরিলুট নিয়ে যখনই প্রশ্ন তোলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ এক বাক্যে উত্তর দিয়েছে এসব বিষয়ে প্রশ্ন তোলা ৫ বারের দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের মুখে মানায় না। এমনকি তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানে যখন আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠনের দ্বিতীয়/তৃতীয় সারির নেতার ঘরে শত কোটি টাকার কাগজ, ঢাকায় শতাধিক ফ্ল্যাট/বাড়ির খবর পাওয়া গেছে তখনও সেটা নিয়ে টু শব্দটি করার আগেই বলা হয়েছে চোর ধরতে গিয়ে আমরাই চোর হয়ে গেলাম।
বাংলাদেশ দুর্নীতিতে প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবার ‘গৌরব’ অর্জন করে ২০০১ সালে। ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনটি হয়েছিল বছরের শেষের দিকে, অক্টোবর মাসে। ওই বছরের প্রায় পুরোটা সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। তাই বাংলাদেশের ওই বছরের আমলনামার পেছনে একমাত্র ভূমিকা ছিল আওয়ামী লীগের। বছরের শেষের দিকের তিন মাস তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল ক্ষমতায়। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক ধরণের সরকারগুলোর সময় দুর্নীতির প্রকোপ অনেক কম থাকে, কিন্তু এর আগেই আওয়ামী লীগ এত ভয়ঙ্কর পরিমাণ দুর্নীতি করেছে যে, বাংলাদেশের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া তাতে ঠেকে থাকেনি।
দুর্নীতির এই ‘গৌরব’ বিএনপি’র ওপর আরোপিত হয় কারণ ২০০১ সালের রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় ২০০২ সা্লে, বিএনপি’র শাসন আমলের প্রথম বছর। এই বছর, ২০২১ সালে ঠিক যেমন প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালের রিপোর্ট। আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যখন বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে তখন মাত্রই জনগণের ভোটে ভূমিধস বিজয় নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ যখন ২০০১ এ ক্ষমতা ছেড়ে যায়, তখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১০ এ ০.৪, অর্থাৎ একেবারে তলানিতে। এর পরের চার বছর বিএনপি’র শাসনামলে পরিস্থিতির অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। ২০০২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্কোর ছিল যথাক্রমে ১.২, ১.৩, ১.৫ ও ১.৭। আর ২০০৬ সাল, বিএনপি সরকারের শেষ বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২, অর্থাৎ বিএনপির পুরো সময়টি ব্যয় হয়েছে বীভৎস দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রনে।
২০০২ সাল থেকে দুর্নীতির সূচকে সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকার পেছনে আওয়ামী লীগের চাপিয়ে দেয়া দুর্নীতির জঞ্জাল যেমন ছিল, তেমনি ছিল সেই সময়ে বাংলাদেশের চাইতে অনেক দুর্নীতি পরায়ন দেশ সেই সূচকে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া। যেমন ২০২০ সালের সূচকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১৭৯ টি দেশ, কিন্তু ২০০২ এর সূচকে অন্তর্ভুক্ত দেশের সংখ্যা ছিল ১০২ টি। সোমালিয়া, দঃ সুদান, সিরিয়া, ইয়েমেন, সুদান, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইকোয়েটরিয়াল গিনি, লিবিয়া, উত্তর কোরিয়া, গিনি বিসাউ, আফগানিস্তা্ন, তুর্কমেনিস্তা্ন, কঙ্গো, বুরুন্ডি, কোমরস, হন্ডুরাস, চাদ এর মতো কিছু দেশ এবারের সূচকে বাংলাদেশের নীচে আছে। কিন্তু এই দেশগুলো আজকের মত ২০০২ সালে দুর্নীতির সূচকে বিবেচিত হয়নি। হলে আর যাই হোক বাংলাদেশ ‘চ্যাম্পিয়ন’ হত না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর রিপোর্টে সেই সময়ের স্কোরের প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছিল, ১০ এর স্কেলে যে সব দেশের স্কোর ২ এর নীচে সেসব দেশের দুর্নীতি সবচেয়ে বীভৎস। বিএনপির শেষ বছরে বিএনপি ২ স্কোর করে সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের নীচে ছিল মিয়ানমার। বাংলাদেশের স্কোর যখন ২ মিয়ানমারের স্কোর তখন ১.৯। এক যুগের বেশী একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সময়ে ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী মিয়ানমার আমাদের চাইতে দুই পয়েন্ট বেশি পেয়ে আমাদের চেয়ে নয় ধাপ উপরে আছে। অর্থাৎ যে মিয়ানমার ছিল বাংলাদেশের নিচের অবস্থানে সেও এই এক দশকে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে অনেক খানি।
২০০১ সালের ০.৪ থেকে ২০০২ এ তিনগুন অর্থাৎ ১.২ স্কোর করা পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করে যে মাত্র এক বছরের শাসনামলে বিএনপি বিস্ময়কর মাত্রায় দুর্নীতি কমিয়ে এনেছিল। এর পরবর্তী ইতিহাস কেবলই ধারাবাহিক উন্নতির। আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য আর বিএনপির দুর্ভাগ্য যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এই সূচক ১৯৯৫ সালে চালু করলেও বাংলাদেশকে প্রথমবার এই সূচকে বিবেচনা করা হয় ২০০১ সালে। ফলে এর আগে কোনও তথ্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নেই। থাকলে আওয়ামী লীগ বিএনপি’র বিরুদ্ধে ‘পাঁচবারের দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন’ এই অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পেত কিনা সেটা ভীষণভাবে প্রশ্ন সাপেক্ষ।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের রিপোর্টে আফগানিস্তান, মিয়ানমার এবং মালদ্বীপের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। কারণ এই তিনটি দেশই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে তাদের আগের স্কোর থেকে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। এর মধ্যে আফগানিস্তান আমাদের চাইতে কম স্কোর করা সত্ত্বেও (আমাদের স্কোর ২৬ এর বিপরীতে তাদের স্কোর ১৯) তাদের ক্রমাগত উন্নতি প্রসংসিত হয়েছে। বলা বাহুল্য গত এক যুগে বাংলাদের ইতিহাস ক্রমাবনতির। এই বছরও বাংলাদেশ নেমে গেছে আরও দুই ধাপ। এই প্রেক্ষাপটে ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নতি ছিল অসাধারণ। আওয়ামে লীগ যে সূচক রেখে গিয়েছিল ০.৪ এ, বিএনপি তার পাঁচ বছরের শাসন আমলে সেটিকে নিয়ে গিয়েছিল ২ এ। কিন্তু প্রোপাগান্ডার এমনই শক্তি যে আওয়ামে লীগের রেখে যাওয়া অবস্থার যে বিস্ময়কর উন্নতি বিএনপির আমলে হয়েছিল সেটি ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে চ্যাম্পিয়নের খবরটি যেটি আদতে আওয়ামে লীগের ৯৬ থেকে ২০০১ শাসন আমলের রেখে যাওয়া অবস্থার ফসল।
বিএনপির সর্বশেষ সরকারটি দুর্নীতি দমন করে সুশাসন নিশ্চিত করার পথে একেবারেই সঠিক পথে ছিল। আওয়ামী লীগ যে বীভৎস দুর্নীতির জঞ্জাল রেখে গিয়েছিল, সেটাকে সাফ করার জন্য ৫ বছর কোনোভাবেই যথেষ্ট সময় ছিল না, কিন্তু বিএনপি তার সর্বোচ্চ চেষ্টাটি করে দেশকে একটা চমৎকার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। এই সময়ের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে উন্নতির গ্রাফটি প্রমাণ করে বিএনপি যদি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারত, তাহলে দেশ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে এক অসাধারণ পর্যায়ে চলে যেত। কিন্তু হয়নি সেটা। এরপর কেবলই পিছিয়ে যাবার গল্প। গত এক যুগের বেশী সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ভয়াবহ দুর্নীতি বাংলাদেশকে লজ্জার মুখে ফেলে দেয় বিশ্ববাসীর সামনে। সরকারের নানা ব্যঙ্গ বিদ্রুপের শিকার পাকিস্তানের অবস্থান আমাদের চাইতে ২২ ধাপ উপরে। আর নেটিজেনরা বাংলাদেশের সাথে তুলনা করে যে দেশটি নিয়ে নানা রকম ট্রোল করে, সেই উগান্ডার অবস্থানও আমাদের চাইতে উপরে।
বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের অতি উচ্চকিত প্রোপাগান্ডাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ এবং ‘শুদ্ধি অভিযান’; যদিও এই অভিযানেই বেরিয়ে এসেছে ভয়ংকর সব তথ্য। তবে সত্যিকারের সদিচ্ছা থাকলে একটি দেশ যে বিস্ময়কর উন্নতি করতে পারে তার এক অসাধারণ উদাহরন হতে পারে মালদ্বীপ। এই বছরের দুর্নীতির সূচকে দেশটি যা দেখিয়েছে তা স্রেফ ম্যাজিক। গত বছরের তুলনায় এক বছরে এই দেশটি ১৪ পয়েন্ট বেশি পেয়েছে যাতে তার অবস্থানের উন্নতি হয়েছে ৫৫ ধাপ। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশটি ১৩০ থেকে ৭৫ এ উঠে এসেছে। মালদ্বীপই প্রমাণ করে রাজনৈতিক বুলির বাইরে গিয়ে কোন দেশ যদি দুর্নীতি দমনে সত্যিকারের সদিচ্ছা রাখে তাহলে ম্যাজিক ঘটানো সম্ভব।
দেশের দুর্নীতি এখন কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে সেটি বোঝানর জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দুইজনের দুটি উক্তি পাঠকের জন্য রেখে যাচ্ছি। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি কিছু দিন আগে দুদকের সাথে বৈঠকে বলেছেন - দুর্নীতি উন্নয়নের বড় অন্তরায়। এর আগে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন – দুর্নীতি না হলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত।
লেখক জাতীয় সংসদ সদস্য ও আইনজীবী।