— ড. খন্দকার মারুফ হোসেন
২৬ মার্চ থেকে আমরা বছরব্যাপি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের শুভক্ষণে বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি- মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং নাম জানা অজানা লাখো শহীদকে।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা আশা করেছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে তার ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন। অত্যন্ত দূঃখজনক হলেও সত্যি সেদিন তিনি তার ভাষণে স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তার ভাষণে স্বায়ত্বশাসনের দাবি ও জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ছিল। অনেকে দাবি করেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চই নাকি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। যদি সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করেই থাকেন তবে ১৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে আলোচনায় কিসের দর কষাকষি হয়েছিল। আমরা স্বাধীনতা দিবস হিসাবে ৭ মার্চ পালন না করে ২৬ মার্চে পালন করি কেন? বাস্তবতা হচ্ছে, তখনও আওয়ামী লীগ চাচ্ছিলো পাকিস্তানে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি এবং আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা।
২৫ মার্চের ব্যর্থ আলোচনার পরে যখন ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে চলে গেলেন, তখনও অনেকে আশা করেছিল শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। তাজউদ্দিন আহমেদ, সিরাজুল আলম খানসহ তৎকালিন অনেক নেতা-ই শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তখন চারপাশে শোনা যাচ্ছিল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের নামে নিরস্ত্র বাঙালির উপর হত্যাযজ্ঞের খবর। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও স্বাধীনতা ঘোষণা না করে সকলকে হতাশায় রেখে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। তার এই গ্রেফতারের পরে আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের বেশিরভাগ নেতা সীমানা পাড়ি দিয়ে ভারতে পলায়ন করেন। তখন মুক্তিকামী বাঙালিদের মধ্যে চরম হতাশা সৃষ্টি হয়।
অপারেশন সার্চলাইটের পরে ২৫ মার্চ গভীর রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালিন মেজর জিয়াউর রহমান মুক্তিকামী বাঙালি জাতির জন্য আশীর্বাদ হিসাবে আভির্ভূত হন। মেজর জিয়াউর রহমানই প্রথম ব্যক্তি যিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি একটি ড্রামের উপর দাড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘We Revolt’, আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছি। তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালিন মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, লেফটেনেন্ট শমসের মবিন চৌধুরীসহ বাঙালি সেনা অফিসার ও সৈন্যদের নিয়ে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানি কর্ণেল জানজুয়াকে গ্রেফতার করেন এবং নিজ হাতে তাকে পরাজিত করে বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। মেজর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে অস্ত্রাগার বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের জন্য খুলে দেয়া হয়। পরবর্তীতে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি সেনা কর্মকর্তাগণ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করে প্রথমে তিনি নিজ নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণা বেতারের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ আবারও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত তৎকালিন কর্ণেল জিয়াউর রহমানের লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি তার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭ টা ৪৫ মিনিটে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের বহিঃনোঙ্গরে থাকা একটি জাপানি জাহাজে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা রেকর্ড করা হয়। যা পরবর্তীতে রেডিও অস্ট্রেলিয়া কর্তৃক সংগৃহিত হয় এবং সারা বিশ্ব তা শুনতে পায়। এছাড়া আগরতলা থেকে মনিটরকৃত এ ঘোষণা ইন্ডিয়া নিউজ এজেন্সির মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত কিছু রেফারেন্স নিচে তুলে ধরা হলোঃ
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে দিল্লিতে দেয়া এক রাষ্ট্রীয় ভোজ সভায় বলেছিলেন “Mr. President, your position is already assured in the annals of the history of your country as a brave freedom fighter who was the first to declare the Independence of Bangladesh”, অর্থ্যাৎ “জনাব রাষ্ট্রপতি, আপনার অবস্থান ইতোমধ্যে দেশের ইতিহাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন”।
যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ২৯ মার্চ ১৯৭১ তারিখের দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় “Curfew eased by army in East Pakistan” শীর্ষক নিবন্ধনে বলা হয় “The Indian news agency reported that “Free Bangla Radio” has claimed that a provisional Bangla Desh Government had been set up by Major Jia Khan, commander of the “army”. He had appealed for diplomatic and for recognition and material aid.” অর্থ্যাৎ “ভারতীয় বার্তা সংস্থা জানিয়েছে যে ”স্বাধীন বাংলা বেতার” দাবি করেছে সেনাবাহিনীর কমান্ডার মেজর জিয়া খান একটি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং সার্বিক সহায়তার জন্য আবেদন করেছেন।” এখানে মেজর জিয়াউর রহমানকে ‘মেজর জিয়া খান’ হিসাবে সম্বোধন করা হয়েছে।
মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ বীরউত্তম তার ‘Bangladesh at War’ শীর্ষক বইয়ের ৪৪-৪৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন “মেজর জিয়া ২৫ মার্চ রাত্রিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পরে ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মোকাবেলার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান”।
মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম তার ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক বইয়ের ৭৯ ও ৮০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “এভাবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। সাড়ে সাত/আটটা বাজে। এমন সময় ইথারে ভেসে এলো মেজর জিয়ার জলদ গম্ভীর কণ্ঠ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলছেন”।
তাজউদ্দিন আহমেদের রাজনৈতিক সচিব হোসেন তরফদার তার ‘মূলধারা ৭১’ শীর্ষক বইয়ের ৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন “২৭ শে মার্চ সন্ধ্যায় ৮-ইবির বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া তার প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসাবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তিনি শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন”।
কলম্বিয়া ইউনির্ভাসিটি নিউজ লেটারে প্রকাশিত ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর প্রদত্ত বক্তব্যের একাংশে বলেছিলেন “The cry of Independence arose after Sheikh Mujib was arrested and not before. He himself, so far as I know, has not asked for Independence even now” অর্থ্যাৎ “শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার পরই স্বাধীনতার দামামা শুরু হয়েছিল, তার আগে নয়। তিনি নিজেও, যতদূর আমি জানি, এখনও স্বাধীনতার দাবি করেন নি”।
ড. ওয়াজেদ মিয়া ২০০২ সালের ১৩ মার্চ তারিখে ‘দি নিউ নেশন’ পত্রিকায় প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন “Bangabondhu neither declared independence or handed over any written document to anybody” অর্থ্যাৎ “বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণাও করেননি বা কারও হাতে কোনও লিখিত দলিল হস্তান্তর করেন নি।”
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম তার ‘স্বাধীনতা-৭১’ শীর্ষক বইয়ের ৪১৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন “তার ঘোষণার শুরুটা ছিল এই রকম ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি”।
মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তার ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস’ শীর্ষক বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন “বেতার কেন্দ্র থেকে যারা মেজর জিয়ার ভাষণ শুনেছিলেন তাদের নিশ্চয় মনে আছে, মেজর জিয়া তার প্রথম দিনের ভাষণে নিজেকে ‘হেড অফ দি স্টেট’ অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রপ্রধান রূপেই ঘোষণা করেছিলেন।”
ভাষাসৈনিক অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭-৭৫’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন “রেডিও সেটে ২৭ শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র হইতে ‘স্বাধীন বাংলা রেডিও’র ঘোষণা শুনিতে পাই। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হইতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলার ডাক ধ্বনিত হইয়াছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিন দিশেহারা, হতভম্ব ও মুক্তিপ্রাণ বাঙালী জনতা শুনিতে পায় এক অভয়বাণী, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়িবার আহ্বান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ের সংবাদ”।
ভারতের সাংবাদিক জ্যোতি সেনগুপ্ত তার ‘হিস্টরি অফ ফ্রিডম মুভমেন্ট অফ বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন “মেজর জিয়া ও তার বাহিনী ২৬ মার্চ ভোর রাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ওইদিন সন্ধ্যায় বেতারের মাধ্যমে সর্বপ্রথম নিজের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন”।
বিখ্যাত লেখক ও কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ তার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছিলেন “২৭শে মার্চ শনিবার রাত আটটায় রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে এই দেশের বেশ কিছু মানুষ অদ্ভুত একটা ঘোষণা শুনতে পায় মেজর জিয়া নামের কেউ একজন নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা দিয়ে বলেন – ‘আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’ বলে তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধের ডাক দেন। দেশের মানুষের ভিতর দিয়ে তীব্র ভোল্টেজের বিদ্যুতের শক প্রবাহিত হয়।”
এছাড়া এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার বীর উত্তমসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বইয়েও পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে কেবলমাত্র জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথের সময় ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হিসাবে ঘোষণা দিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বীকৃতি দান করেন।
মেজর জিয়াউর রহমান শুধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে ক্ষান্ত হননি, তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে ১ নম্বর ও পরবর্তীতে ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে গঠিত ‘জেড ফোর্স’ এর অধিনায়ক হিসাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখেন। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিলেট হানাদার মুক্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের পরে জিয়াউর রহমানের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বচিত অবদানের জন্য তৎকালিন বঙ্গবন্ধুর সরকার তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের পরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। তৎকালিন সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হয়। ৩ থেকে ৭ নভেম্বর দৃশ্যতো বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিল না। বাংলাদেশের জনগণ হয়ে পড়ে দিশেহারা। ঠিক সে সময়ে সিপাহী-জনতা বিপ্লব ঘটিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে সামরিক আইন জারি বা ক্ষমতা দখল করেন নি। ১৯৭৮ সালে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে ৭২-৭৫ এর দুঃশাসনের কালিমা থেকে দেশকে উত্তরণ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী লাখো শহীদের রক্তে কেনা মহান স্বাধীনতার প্রধান চেতনা গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে সকল পত্রিকা বন্ধ করে বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা ও অব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ শুনতে হয়। জোরপূর্বক বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয় ৭২-৭৫ এ।
সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল – বিএনপি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন এবং আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। তিনিই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে ‘৭২ এর সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ছিল না। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে আমাদের সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সন্নিবেশিত করেন। ধর্ম নিরপেক্ষতার স্থানে মহান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস এবং সকল ধর্মের সমান অধিকার প্রবর্তন করেন। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তিনি নারী উন্নয়নের জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও মহান স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশে ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রবর্তন করেন। শিশুদের মেধা বিকাশের জন্য শিশু পার্ক, শিশু একাডেমি, নতুন কুড়ি প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেন। ১৯ দফা কর্মসূচি প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর রাষ্ট্রে রূপান্তর করেন। আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার তিনিই। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। দেশ যখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে উন্নতির শিখরে যাচ্ছে, ঠিক তখনি জিয়াউর রহমানকে দেশি বিদেশী চক্রান্তে শাহাদাত বরণ করতে হয়।
শহীদ জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে শহীদ জিয়ার আদর্শ ও দর্শনকে বুকে ধারণ করে বিএনপির নেতাকর্মীবৃন্দ দলকে সুসংগঠিত করেছে। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি সফল হয়েছে। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত করেছে। সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে শহীদ জিয়ার গড়া দল বিএনপি। যতবার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে, ততবারই বিএনপি জনগণের ভোটে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু দেশি বিদেশী চক্রান্তে এক এগারোর সৃষ্টি হয়, যেখানে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ষড়যন্ত্রের নির্বাচনের মাধ্যমে শহীদ জিয়ার আদর্শে গড়া বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়েছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছরে মুক্তিযুদ্ধের মূল আকাঙ্খা গণতন্ত্র বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৩০ তারিখের নির্বাচন ২৯ তারিখ রাতে ভোটডাকাতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে পূনরায় হত্যা করেছে। দেশ আজ স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট ও নব্য বাকশালিদের দখলে। আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার আজ শূন্যের কোঠায়। জাতীয় থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত। দেশ আজ দুর্নীতি, দু:শাসন, অপশাসন, গুম-খুন, অপহরণ ও মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বর্তমান করোনাকালিন সময়ে স্বাস্থ্যখাতসহ বিভিন্ন সেক্টরে যে অরাজকতা হয়েছে তা নজিরবিহীন। বিরোধী মতের মুখ বন্ধ করতে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ হাজার হাজার বিএনপির নেতাকর্মী মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় জর্জরিত। সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে দু’বছর মিথ্যা মামলায় কারাগারে রেখে, এখন গৃহবন্দি করে রেখেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই সরকারের প্রতিহিংসার কারণে দেশের বাইরে অবস্থান করছে। সরকার এতটাই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পড়েছে যে, স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বীর উত্তম খেতাব কেড়ে নিতে চাচ্ছে।
দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে শহীদ জিয়ার আদর্শকে বুকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বেগম খালেদা জিয়ার পূর্ণাঙ্গ মুক্তি ও তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার পরিস্থিতি জনগণকে সাথে নিয়ে বিএনপিকেই সৃষ্টি করতে হবে। দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হলে বর্তমান ফ্যাসিস্ট, বাকশালি, স্বৈরাচারি ও মাফিয়া সরকারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। তবেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর লক্ষ্য পূরণ হবে এবং দেশ গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসবে।
লেখক–
ড. খন্দকার মারুফ হোসেন
সদস্য, জাতীয় নির্বাহী কমিটি বিএনপি
ও অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ঢাকা।