Search

Wednesday, April 28, 2021

নিরাপদ সড়ক আইন স্রেফ এক ‘প্রতারণা’!

রুমিন ফারহানা

মেয়েটার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ব্যাংকে। সেখানেই কাজ করে সে। বয়স ২৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে হবে; দেখতে গড়পড়তা বাঙালি মেয়ে যেমন হয়। আমার অ্যাকাউন্ট সে দেখাশোনা করতো বলে তার সঙ্গে সম্পর্কটা কেবল কাজের মধ্যেই আটকে থাকেনি। আলাপে আলাপে একসময় মেলে ধরেছিল তার জীবনের কথা। পরিবারটি ছোট, বাবা-মা এক ভাই আর সে। বাবা অসুস্থ, মারও বয়স হয়েছে, একমাত্র ভাইটি বিছানায়। উপার্জনশীল ব্যক্তি বলতে সে একা। সুতরাং পরিবারকে টিকিয়ে রাখার বাইরে নিজের জীবন নিয়ে তার আর কোনও পরিকল্পনা নেই। প্রথমবার যখন পরিবারের কথা বলছিল মেয়েটি, বারবার আটকে আসছিল গলা, চোখে পানি। ভাইটি ছিল অত্যন্ত মেধাবী। ভালো গান গাইতো, ছবি আঁকতো, ক্রিকেট খেলতো। একটা সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গত কয়েক বছর ধরে শয্যাশায়ী। এখন হুইল চেয়ার আর বিছানায় তার জীবন বন্দি। পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক বছর হলো। সংসারের পুরো ভার এখন মেয়েটির ওপরে। 

একটা সড়ক দুর্ঘটনা কেবল একটি ব্যক্তি নয়, আঘাত হানে পুরো পরিবারের ওপর। মেয়েটি তো তবু নিজেকে ভুলে হলেও টিকিয়ে রাখতে পেরেছে পরিবারটিকে, কিন্তু এমন দুর্ঘটনার পরে বহু পরিবার স্রেফ পথে বসে যায়। হাল ধরার মতো একটা মানুষও থাকে না। 

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে একেবারে সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ জানায়, ২০১৯ সালে মোট চার হাজার দুইটি সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ২২৭ জন নিহত ও ছয় হাজার ৯৫৩ জন আহত হয়েছিলেন। আরেকটি সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, ২০১৯ সালে দেশে পাঁচ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত হয়েছে। তবে উভয় সংগঠনের মতেই আগের বছরের চাইতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি আর নিরাপদ সড়ক চাই’র মতে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে প্রাণহানি বেড়েছে যথাক্রমে ৮.০৭ এবং ১৭.৭৫ শতাংশ। 

নিশ্চিতভাবেই ২০২০ সালেও এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা বলবৎ থাকতো, কিন্তু সেটা কিছুটা কম দেখাচ্ছে  করোনার কারণে। লকডাউন, কঠোর বিধিনিষেধসহ নানান কারণে মানুষের চলাচল ছিল অতি সীমিত। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ৬৮৬ জন।  আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৬০০ জন। আর নিরাপদ সড়ক চাই’র মতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৯৬৯ জন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও ৫ হাজার ৮৫ জন। গত বছরের এক- চতুর্থাংশ সময় করোনার কারণে সারা দেশে ‘সাধারণ ছুটি’র কারণে মালবাহী গাড়ি ছাড়া দূরপাল্লার যানবাহন প্রায় চলেইনি। অর্থাৎ গত বছরের মৃত্যুর সংখ্যা মূলত নয় মাস বা তারও কম সময়ের পরিসংখ্যান। 

বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান একটা ভগ্নাংশই জানায় আমাদের। আলোচিত সংস্থা দুটি পত্রিকায় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ থেকেই তথ্য পেয়ে থাকে। এসব রিপোর্টের প্রধান সমস্যা হলো, এতে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত মানুষের সংখ্যা জানা যায়; জানা যায় না মারাত্মক আহত মানুষ যারা দুর্ঘটনায় কয়েকদিন পরে মারা যান। এ কারণেই দেখা যায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন মারা গেছে। সরকারি–বেসরকারি ও নিজস্ব সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে মৃতের সংখ্যা এত বেশি। 

দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা জানলেও আমরা জানতে পারি না, খোঁজ রাখি না আহতের কথা। আহতদের মধ্যে যারা মারা যায়নি তাদের একটা অংশ পুরো সুস্থ হয়ে ওঠে। আর তাতে তাদের চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর জন্য পরিবারকে কতটা চাপের মধ্যে পড়তে হয় সেই পরিসংখ্যানও আমরা জানি না। আমরা জানি না মারাত্মক আহতদের মধ্যে কত মানুষ আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে নিজের এবং পরিবারের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে, যেমন আমি শুরুতেই আমার ব্যক্তিগত পরিচিতার পরিবারের কথা বলছিলাম। 


জুলাই ২৯, ২০১৮, বাসচাপায় নিহত শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম, ১৬ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব, ১৭ 


বহু মানুষের দুর্বিষহ আহত পঙ্গু জীবন, মৃত্যু আর হাহাকারের পরও সড়কে নিরাপত্তা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছিল সরকার। এরমধ্যেই ঘটে সেই বীভৎস দুর্ঘটনা। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত ও দশ শিক্ষার্থী আহত হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয় পুরো দেশ। স্কুল-কলেজে পড়া শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা, এই লক্ষ্যে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ, আইন ভঙ্গকারী চালকদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন, মিছিল, রাস্তা অবরোধ, গাড়ির লাইসেন্স পরীক্ষা, রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাদের দাবির মুখেই সরকার পাস করতে বাধ্য হয় ‘নিরাপদ সড়ক আইন, ২০১৮’।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আইনটি পাস হলেও সেটি কার্যকর করা হয় পরের বছর পহেলা নভেম্বর থেকে। কিন্তু তখন পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও কর্মবিরতির মুখে সরকার চারটি ক্ষেত্রে আইনটির প্রয়োগ ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত বন্ধ রাখে। পরে সেই বন্ধ থাকার মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ফলে আইনটি আংশিকভাবে কার্যকর হলেও এখন পর্যন্ত প্রধান কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ আটকে রয়েছে। আইনের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা – সংসদে পাস করা একটা আইনের কিছু ধারা অকার্যকর থাকছে সংসদে আইনের কোনও সংশোধন ছাড়াই। পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের চাপের মুখে সরকারের টালবাহানা আমাদের কাছে নিশ্চিত পূর্বাভাস দিয়েছিল এই আইন নিয়ে আখেরে কী ঘটতে যাচ্ছে। ঘটেছেও তাই।

এ আইনটি এখন সংশোধন করার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে। শাস্তির আওতা কমানো, শাস্তি কমানো, চালক হবার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ অন্যান্য যোগ্যতা শিথিল করা, গাড়ির আকার পরিবর্তন করার অনুমতি দিয়ে মালিক-শ্রমিক পক্ষের প্রায় সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। যে মালিক পক্ষ আর শ্রমিক পক্ষের মূল নেতা সংসদ সদস্য এবং ক্ষমতাসীন দল এবং ‘সরকারি’ বিরোধী দলের অতি প্রভাবশালী নেতা তাদের স্বার্থ রক্ষা না করে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা হবে, বর্তমান বাংলাদেশকে ন্যূনতম চিনলে এমন প্রত্যাশা কেউ করবেন না। 

বাংলাদেশে আইন থাকা মানে সেটার সুষ্ঠু প্রয়োগ হবে সেটা নয় কোনোভাবেই। এই দেশে আইন তার নিজের গতিতে চলে না। একটা মোটামুটি কঠোর আইন থাকলেও অতি ক্ষমতাশালী মালিক-শ্রমিক সমিতিগুলোর প্রভাবে খুব কঠোরভাবে প্রযুক্ত হবে এমন আশা এই দেশবাসী করে না। তবে এমন একটা আইনের একটা প্রতীকী মূল্য আছে, এতে বোঝা যেত – এই রাষ্ট্র সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, পঙ্গুত্ব এবং মানুষের শারীরিক, আর্থিক ভোগান্তিকে আমলে নিয়েছে। আইনের শাস্তির ভয় এক ধরনের রেফারেন্স হিসেবে কাজ করে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের সতর্ক করতে পারতো যেটা দুর্ঘটনার পরিস্থিতিকে কিছুটা হলেও ভালো করতে পারতো। কিন্তু সেই আই ওয়াশটাও মালিক-শ্রমিক-সরকার জোট মানতে রাজি না।   

নিরাপদ সড়ক আইন কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা, বেপরোয়া চালকদের নিয়ন্ত্রণ করা এর কোনোটাই সরকারের উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল যেকোনোভাবে আন্দোলন ধামাচাপা দেওয়া। ২০১৮ সালে এই দেশের কিশোর-কিশোরীরা একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল, তারা রাস্তায় নিরাপত্তা চেয়েছিল। সবকিছুর পরে তখন আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল তাদের এই ত্যাগ স্বীকার সফল হয়েছে। কিন্তু আইনটি নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি দেখে একটা শব্দই মনে আসে – ‘প্রতারণা’।



লেখক  আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।  সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ


No comments:

Post a Comment