-------------------------------
মো: হারুন-অর-রশিদ
-------------------------------
তিনি মরে গিয়েও প্রমাণ করলেন মরেন নাই। লাখ লাখ নেতাকর্মীর অশ্রু আর শোকের মাতমই প্রমাণ করেছে, তিনি মরে গেছেন কিন্তু বেঁচে আছেন তাদের হৃদয়ে। তিনি আর কেউ নন, শফিউল বারী বাবু। মানুষ মরণশীল। যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবধারিত। পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা আল ইমরানের ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘কুল্লুনাফসিন জাইকাতুল মাউত’। কিন্তু কিছু মৃত্যু আছে যা দেহের প্রস্থান হয় মাত্র, তবে তার কর্ম তাকে চিরজীবনের জন্য মানুষের হৃদয়ে বাঁচিয়ে রাখে। মানুষ তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে অনন্তকাল। শফিউল বারী বাবু তেমন একটি নাম। মাত্র ৫১ বছর বয়সে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কাঁদিয়ে গত ২৮ জুলাই ভোর ৪টায় জাতীয়তাবাদী আদর্শের এই অগ্রসৈনিক না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার মৃত্যুতে তার নিজ হাতে তৈরি করা হাজার হাজার নেতাকর্মী শোকে মুহ্যমান।
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর |
আদর্শের রাজনীতিতে আপসহীন, অত্যন্ত সাহসী এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানের অধিকারী এই নেতার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি ছিলেন সেরা সংগঠকদের অন্যতম। ছাত্ররাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে সাংগঠনিক নেতৃত্বের বিচক্ষণতা, দৃঢ়তা ও আপসহীনতা তাকে রাজনৈতিক প্যারামিটারের এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। সব স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তার ছিল বলিষ্ঠ প্রতিবাদী ভূমিকা। বিশেষ করে এক-এগারোর সময়ে ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দীনের অবৈধ মাইনাস রাজনীতির বিরুদ্ধে তার সাহসি ভূমিকা ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে একটি আলাদা অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল। সর্বদায় দুই ঠোঁটের মাঝখানে হাসির রেখা ফুটিয়ে মৃদুভাষী শফিউল বারী বাবু নেতাকর্মীদের কথাই শুনতেন। সিদ্ধান্তের বেলায় বুঝা যেত, তিনি কত বড় মাপের সংগঠক ছিলেন। তার মেধা ও বিচক্ষণতা এবং বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাই তাকে একজন সত্যিকারের রাজনৈতিক সংগঠকে পরিণত করেছিল। তিনি কর্মীদের কাছে এতটাই প্রিয় ছিলেন যে, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে ছাত্রলীগের এক নেতা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘তার সব সদস্যই তার জন্য বুলেটের বিপরীতে বুক পেতে দিতে কুণ্ঠাবোধ করত না।’
আমার সাথে এই মহান নেতার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনের প্রাক্কালে। তিনি ওই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। আমি তার হলের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমান হল) ছাত্র। এই কারণে আমাকে অনেক বেশি আদর করতেন এবং ওই নির্বাচনে আমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও দিয়েছিলেন। তখন থেকেই যখন দেখা হতো সালাম বিনিময় করলেই তার জবাব দিয়ে কেমন আছিস জিজ্ঞেস করতেন। ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর শফিউল বারী বাবুকে সভাপিত ও আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাত সদস্যের কমিটি ঘোষণা করলে আমি স্বেচ্ছাসেবক দল করতে আগ্রহী হই। সাইফুল ইসলাম ফিরোজ ভাই (সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) এই কমিটিতে থাকায় আরো বেশি আগ্রহী হই। যদিও আমাকে জাসাসের দফতর সম্পাদক করার ছিল। ফিরোজ ভাইকে বলার পর তিনি বাবু ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। স্বেচ্ছাসেবক দল করব শোনে বাবু ভাই খুব খুশি হলেন। কিছু দিন পরই দফতরে কাজ করার জন্য দায়িত্ব দিলেন। দফতরে কাজ করার সুবাদে ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা আরো বেশি বৃদ্ধি পায়। আমি লেখালেখি করি এটা তিনি খুব পছন্দ করতেন। মাঝে মধ্যে কিছু উপদেশও দিতেন।
দফতরে দায়িত্বপালনরত অবস্থায় ২০১৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হই।
মঙ্গলবার, মার্চ ৬, ২০১৮, জাতীয় প্রেসক্লাবের সম্মুখ থেকে গ্রেপ্তার হন শফিউল বারী বাবু |
কারাগারে গিয়ে প্রিয় নেতা আবদুুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, ইয়াছিন আলীসহ অসংখ্য নেতাকর্মীর সাক্ষাৎ পাই। ৬ মার্চ মিন্টুরোডস্থ ডিবি অফিসে তৃতীয়বারের মতো রিমান্ডে গেলে শুনতে পাই বাবু ভাই গ্রেফতার হয়েছেন। সংবাদটা শুনেই বুকের মধ্যে একটা চাপ সৃষ্টি হলো। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, মিছিলে ম্যাডামের মুক্তি চেয়ে ‘আমার নেত্রী আমার মা বন্দী থাকতে পারে না’ রাজপথে এই স্লোগান দেয়ার আর কেউ থাকল না। যাই হোক তাকেও ডিবি অফিসে নিয়ে আসা হলো। তিন দিন রিমান্ড খাটার পর একই দিনে আলাদা আলাদা পুলিশ প্রিজন ভ্যানে করে কোর্টে নেয়া হলো। কোর্ট থেকে সোজা কারাগারে। তারপর কারাগারে প্রতিদিনের কত স্মৃতি চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে।
প্রতিদিন সকাল-বিকাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দীদের আবাসস্থল যমুনা থেকে সূর্যমুখীতে ছুটে যেতাম ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য। গেলেই বিস্কুট, ফল খেতে দিতেন। সুবিধা-অসুবিধা জিজ্ঞেস করতেন। সেখানেও আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন জেলের মধ্যে কারা কারা কষ্টে আছে তাদের লিস্ট করার জন্য। কারা আইনের সুবিধা পাচ্ছে না, জামিন হচ্ছে না, টাকার অভাবে উকিল নিয়োগ দিতে পারছে না, কার বাসায় খাবার নেই, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন দিতে পারছে না তাদের লিস্ট করে দিলে তিনি সব রকম ব্যবস্থা করতেন। একজন নেতার এমন মহানুভবতায় জেলখানার সব শ্রেণীর বন্দীর মুখে শফিউল বারী বাবু নামটি মানবদরদি নেতা হিসেবে উচ্চারিত হয়। জেলখানায় অনেক নেতা ছিলেন, কেউ কারো খোঁজও রাখতেন না। আমি জেলখানায় গিয়েই সবার মুখে আবদুুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলের ব্যাপক প্রশংসা শুনতে পাই। তিনি চলে আসার পর বাবু ভাই জেলে যান। কর্মীর প্রতি একজন নেতার কী পরিমাণ ভালোবাসা থাকতে পারে তা শফিউল বারী বাবুকে জেলখানায় নিজ চোখে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
অনেক জনদরদি নেতার নাম শুনেছি, তাদের জীবনী পড়েছি। কিন্তু শফিউল বারী এক ও অনন্য। মধ্যবয়সী একজন নেতা কী করে সব শ্রেণীর নেতাকর্মীর এত ভালোবাসা অর্জন করতে পারেন তা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে।
সেবার ব্রত নিয়েই রাজনীতির হাতেখড়ি বাবুর। দেশ ও জনগণের পক্ষে আজীবন কাজ করে যাওয়া শফিউল বারী বাবু ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকাকালে শহীদ জিয়া প্রবর্তিত জাতীয়তাবাদী আদর্শ বুকে ধারণ করে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর তার রাজনৈতিক গুণের জ্যোতির্ময় আলো সারা দেশের হাজার হাজার ছাত্রের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদেরকে ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হন। একজন শফিউল বারীর রাজনৈতিক গুণাবলি লিখে শেষ করা যাবে না।
আমরা যারা একসাথে জেলখানায় ছিলাম, তাদের মধ্যে কাজী ইফতেখায়রুজ্জামান শিমুল, আব্দুর রহিম হাওলাদার সেতু, করিম সরকার, এইচ এম রাশেদ, আলমগীর, মামুন, মোর্শেদ, রমিজ ও আমি নিজেসহ অনেকের সাথে প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন। মামুন, আলমগীর, রমিজ এবং আমাকে কাশিমপুর কারাগারে চালান করে দেয়ার জন্য নিয়ে গেলে বাবু ভাই নিজে জেলগেটে গিয়ে চালান ঠেকিয়ে ছিলেন। তারপর সবাই আমাকে বলেছিলেন, বাবু ভাই, কারো জন্য এতটা উদ্বিগ্ন হননি যতটা আপনার জন্য হয়েছিলেন। এই ঋণ কোনো কিছুর বিনিময়েই শোধ করতে পারব না। আমার লেখা একটি বই তাকে দেয়ার জন্য বাসায় গেলে তিনি সেটি হাতে নিয়ে ছবি তোলার জন্য সাহাবউদ্দিন সাবুকে বললেন এবং ছবি ভালো তুলতে না পারায় সাবুকে বকা দিয়েছিলেন। এই স্মৃতিগুলো মুছে ফেলা খুব সহজ হবে না।
বাবু ভাই তার স্ত্রী বিথিকা বিনতে হুসাইনকেও মানবতার কল্যাণে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। ‘অর্পণ বাংলাদেশ’ নামে সেবা সংগঠনের মাধ্যমে শত শত দুস্থ, অসহায় মানুষকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। এমন একজন নেতাকে হারিয়ে আমরা বাকরুদ্ধ। তার রেখে যাওয়া দু’টি মাসুম সন্তানের জন্য এবং তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনাই প্রতিটি নেতাকর্মীর ব্রত হওয়া উচিত। মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতের উচ্চ স্থান দান করে।
No comments:
Post a Comment