------------------------------------
— রুমিন ফারহানা
------------------------------------
গণতন্ত্রের মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ায় |
বেগম খালেদা জিয়া — কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি বাংলাদেশের হৃৎস্পন্দন, ১৭ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক ও বাহক, গণতন্ত্রের আরেক নাম। ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচার বিরোধী এক দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিলে তিলে অবিসংবাদী নেতায় পরিণত হন বেগম খালেদা জিয়া। তার গৃহবধূ থেকে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান হয়ে ওঠার পথটি খুব মসৃণ ছিল না। তিনি ছিলেন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, জেড ফোর্সের অধিনায়ক, বীর উত্তম, সাবেক সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি এবং আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের যোগ্য সহধর্মিনী। চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে বহুবার রাজপথে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, গৃহবন্দী হয়েছেন তিনি। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র নেতা যিনি কোনও নির্বাচনে কোনও দিন কোনও আসন থেকে পরাজিত হননি। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত তার নাম।
আমরা প্রায়ই বলি ‘পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়’। প্রায় সব ক্ষেত্রে কথাটা সত্যিও। তারপরও কিছু কিছু মানুষের কীর্তি এমনভাবে সবকিছু ছাপিয়ে যায় যে ‘কেউ অপরিহার্য নয়’এর সীমা ছাড়িয়ে যায়। বেগম খালেদা জিয়া তাদেরই একজন। একটার পর একটা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করা কর্তৃত্ববাদী চরিত্রের এই সরকার তার ক্ষমতা প্রলম্বিত করার পথে সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করেছিল দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের এই প্রধানকে। আর সেই কারণেই এক এগারোর সময়ে যে নেতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা ছিল ৪ টি, গত এক যুগে এই সরকারের আমলে তার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ টিতে। এমনকি ২০১৮ সালে বর্ষীয়ান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কারাবরণও করতে হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ এক কালো অধ্যায়।
কীভাবে মিথ্যা অভিযোগে বেগম জিয়াকে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, সেটার খুঁটিনাটি তথ্য এই দেশের মানুষ জানে। সেই বিষয়ে তাই আর বিস্তারিত আলোচনা অপ্রয়োজনীয়। শুধু এটুকু বলি, একজন আইনজীবী হিসেবে আমি নিজে দুদকের মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত অভিযুক্তদের মামলায় কাজ করেছি এবং আপিল গ্রহণকালেই জামিন পেতে দেখেছি। স্থায়ী জামিন নিয়ে তাদের অনেকেই এখন বিদেশেও আছেন। এটা যদি হয় একজন সাধারণ অভিযুক্তের ক্ষেত্রে, তাহলে বেগম জিয়ার মতো একজন মানুষের ক্ষেত্রে কী হওয়ার কথা ছিল?
জামিন লাভের ক্ষেত্রে প্রধান যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়, তার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ হলো—ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা এবং সামাজিক অবস্থান। আর যে বিষয় আদালত দেখে তা হলো—অভিযুক্তের পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা এবং সাক্ষীকে ভয়ভীতি দেখানো বা আলামত নষ্ট করার ভয় আছে কিনা। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আদালত যেকোনও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিক জামিন দিতে পারেন। এই আশঙ্কাগুলোর কোনটি বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে সত্য, সেটা বিচারের ভার আমি পাঠকদের ওপরই ছেড়ে দিলাম। পরবর্তীতে নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি মিললেও কার্যত গৃহবন্দীই ছিলেন তিনি। কোনও ক্রমেই যেন রাজনীতি তার কাছ ঘেঁষতে না পারে তা নিশ্চিত করেছিল সরকার।
দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির তথ্য কমবেশি দেশের প্রতিটা মানুষের কাছেই আছে। এর মধ্যে ১১ এপ্রিল দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার করোনা ধরা পড়ে। শারীরিক পরীক্ষার জন্য গত ২৭ এপ্রিল তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর তাঁর অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে চিকিৎসকদের পরামর্শক্রমে সিসিইউ তে স্থানান্তর করা হয়। শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে মেডিক্যাল বোর্ড তাঁর বিদেশে চিকিৎসার সুপারিশ করলে দেশনেত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে বিদেশে চিকিৎসার আবেদন জানানো হয়।
আবেদনটির ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হলে আইনমন্ত্রী জানান, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়ার সাজা ও দণ্ডাদেশ স্থগিত করে যে শর্তে তাকে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তা শিথিল করে এখন তাকে বিদেশে যেতে দেওয়ার সুযোগ নেই। আইনগতভাবে এই ব্যাখ্যা সঠিক নয়, কারণ ফৌজদারী কার্যবিধি , ১৮৯৮ এর ৪০১ ধারায় সরকারকে ক্ষমতায় দেওয়া হয়েছে সাজাপ্রাপ্ত আসামীর বিষয়ে শর্তহীন কিংবা শর্তযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার । ৪০১ (১) এবং ৪০১(৪ক) ধারা ভালো করে পড়লে দেখা যায়, আদালত যদি বিদেশ যেতে নিষেধ করে কোন আদেশও দেয় তাহলেও সরকার বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে। অর্থাৎ ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার চাইলে যে কোন সময়, যে কোনও দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য যেতে পারেন বেগম খালেদা জিয়া।
401.(1) When any person has been sentenced to punishment for an offence, the Government may at any time without conditions or upon any conditions which the person sentenced accepts, suspend the execution of his sentence or remit the whole or any part of the punishment to which he has been sentenced.
(4A) The provision of the above sub-sections shall also apply to any order passed by a Criminal Court under any section of this Code or of any other law, which restricts the liberty of any person or impose any liability upon him or his property.”
৪০১(৪ক) ধারা পড়লে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, কোন আইনে যদি কোন আদালত কোন ব্যক্তির (সাজাপ্রাপ্ত কিংবা সাজাপ্রাপ্ত নয়) চলাফেরার স্বাধীনতা খর্ব করে কোন আদেশ দেন সেক্ষেত্রেও সরকার তা স্থগিত করে তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে । এই ক্ষমতা সরকারের সহজাত। দুদক আইন, ২০০৪ এ সরকারের এই ব্যাপক সহজাত ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়নি । ফলে, দুদকেরও এখানে বলার কিছু নেই। অতীতের নজির বলে এরকম অবস্থায় বহু রাজনীতিবিদই বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কেবল তিন বারের প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ, জনপ্রিয়তম দল বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদী দলের প্রধান। করোনা মহামারীতে পুরো বিশ্ব যখন কাঁপছে, প্রতিদিন আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যাকে ছাপিয়ে নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে তখন সরকার ৭৬ বছরের অসুস্থ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ন্যুনতম মানবিকতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ আশা করেছিল অন্তত এই বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করবে না সরকার। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী আবারও শিকার হলেন সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহংসার। বিষয়টি দেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছে। কর্তৃত্বপরায়ন সরকারের অমানবিকতার আরও একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে এই ঘটনাটি।
- লেখক জাতীয় সংসদ সদস্য ও আইনজীবী
No comments:
Post a Comment