Search

Sunday, May 30, 2021

৩০শে মে— বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মমতম দিন



৩০শে মে ১৯৮১, দিনটা ছিলো শুক্রবার। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টির রাত। জানালার কাচে আছড়ে পরছে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা। সময় ভোর চারটা। বৃষ্টি কমে এসেছে। রাতের সুনসান নীরবতা ভেঙে হঠাৎ একটি সামরিক গাড়িবহর তড়িঘড়ি করে ছুটে গেলো চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের দিকে। সার্কিট হাউজের গেট অতিক্রম করে গাড়ি থেকে নেমে রকেট লাঞ্চার থেকে সার্কিট হাউজের দেয়াল উদ্দেশ্য করে একটা রকেট ছুঁড়ে মারলো লে. কর্ণেল ফজলে হোসেন। দেয়াল ফুঁড়ে তৈরি হলো যাতায়াতের পথ। সেই পথেই এগিয়ে গেলো আক্রমনকারী দলের ১৬ জন সদস্য। আততায়ীর গুলিতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করলেন স্বাধীনতার ঘোষক, রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরউত্তম, সেক্টর কমান্ডার, জেড ফোর্সের প্রধান, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। 

মাত্র ৪২ বছর বয়সে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে পরিচিতি পাওয়া একটি রাষ্ট্রের দায়িত্বভার আসে জিয়াউর রহমানের কাঁধে। তাঁর মাত্র ৪ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশকে তিনি শূন্য থেকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে কারণেই বুঝি ৩০শে মে ১৯৮১ বাংলাদেশের ললাটে দুর্ভোগের যে কালো মেঘ ছেয়ে গিয়েছিল তারই ছায়া পড়েছিল প্রকৃতিতে। অঝর ধারায় ঝরেছিল প্রকৃতি সেদিন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কারো জানাজায় এত মানুষের সমাগম হয়নি যেমনটি হয়েছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জানাজার। কোটি কোটি মানুষের চোখের পানিতে সেদিন চির নিদ্রায় শায়িত হন বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, আমাদের রাখাল রাজা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। 

অনেকেই রাজনীতির ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর নানান ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। আমি প্রশ্ন করি এই জাতির জীবনে যদি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর না আসতো, তাহলে কী হতো? কী হতো যদি ৩ নভেম্বরের পর থেকে কার্যত কোনো সরকার না থাকা বাংলাদেশ আরো বেশ কিছুদিন সেভাবে চলতো? কোনও বহিঃশত্রুর আক্রমণের হুমকি তৈরি হলে চেইন অব কমান্ড পুরোপুরি ভেঙে পড়া একটা সেনাবাহিনী কী করত তখন? কিংবা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্ৰুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে সেটা দেশকে কোন পরিস্থিতিতে নিয়ে যেত?

১৯৭৫ এর ৪৫ বছর পর এই ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে এই নভেম্বর মাসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি - ভাগ্যিস একজন জিয়াউর রহমান সেদিন এই জাতির ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল এবং ধীরে ধীরে সেটা যতটা খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছিল সেটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকেই ভীষণ বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সেই বিপদ থেকে এই রাষ্ট্র ৭ নভেম্বর বেরিয়ে এসেছিল এত অসাধারণভাবে যার চাইতে ভালো কিছু আর হতে পারত না।ওই দিনটিতেই সামরিক-বেসামরিক মানুষ ফিরে গেল সেই মানুষটার কাছে যে মানুষটা সাড়ে পাঁচ বছর আগে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়া একটি জাতিকে পথ দেখিয়েছিলেন।

আজকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর অবাক বিস্ময়ে ভাবি, ২৫ শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণের ওপর যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন 'অপারেশন সার্চলাইট' এর পর পুরো জাতি হয়ে পড়ে রক্তাক্ত, ভীত, দিকনির্দেশনাহীন, তখন কী হত যদি সেই মানুষগুলোর ত্রাতা রূপে আবির্ভূত না হতেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান? স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গোটা জাতির মনে সেদিন আস্থা সাহস আর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। যখন দেশের বড় বড় মাথাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি তখন সেনাবাহিনীর মেজর পদে দায়িত্ব পালনরত এই মানুষটি তাঁর সাহসে, শক্তিতে, দেশপ্রেমে ধারণ করেছিলেন গোটা বাংলাদেশকে। আর তাই ২৫ মার্চ ১৯৭১ হোক কিংবা ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ হোক বারে বারেই বাংলাদেশের মানুষ তাদের ক্রান্তিকালে ত্রাতার ভূমিকায় দেখেছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে। 

জিয়ার তুলনা কেবলই জিয়া। বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য যে মাত্র সাড়ে ৪ বছর দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। এই সাড়ে ৪ বছরে একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের মতো (Just like a perfect statesman) বাংলাদেশকে ১০০ বছরের উন্নয়নের পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বহুদলীয় গণতন্ত্র থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, কৃষি বিপ্লব, প্রবাসী শ্রমিক কোথায় নেই তাঁর হাতের ছোঁয়া? 

এরপর একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে জিয়া ক্রমাগত ছাড়িয়ে যেতে থাকেন নিজেকে। স্বাধীনতার পর পর সমাজতন্ত্রের নামে সবকিছুকে রাষ্ট্রীয়করনের মধ্য দিয়ে যে অদক্ষতা ও দুর্নীতির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয় সেখান থেকে জাতিকে মুক্ত করে আনেন তিনি। আজকে গার্মেন্ট কারখনার মাধ্যমে যে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের রমরমা তার সূচনা করেছিলেন জিয়া। একজন রাজনীতিবিদ ভাবেন আগামীর নির্বাচন নিয়ে আর একজন রাষ্ট্রনায়ক চিন্তা করেন আগামী ১০০ বছরে জাতি কোথায় যাবে। নানামুখী কালজয়ী পদক্ষেপ নেয়ার মধ্য দিয়ে জিয়া বারবারই নিজের রাষ্ট্রনায়কত্বের প্রমাণ দিচ্ছিলেন। 

১৯৭৪ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে পুরো রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তন করা হয়েছিল। যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল, স্বাধীনতার মাত্র ৪ বছরের মাথায় তা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে। স্পিরিট অব দ্য কন্সটিটিউশনকে ধ্বংস করে বাকশালের নামে এক দলীয় শাসন কায়েম করা হয়। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ দলটিও জীবন ফিরে পেয়ে যাত্রা শুরু করে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র, সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, যে গণতন্ত্র সেটা আবারও তার চিরচেনা রূপ ফিরে পায় তাঁর মাধ্যমেই। আওয়ামী লীগ ভোট ছাড়া ক্ষমতায় আছে আজ সাড়ে ১২ বছর। এই পুরোটা সময় সংসদে তাদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও বাকশাল গঠন করবার সাহস তারা আর করেনি।  

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বাদ বাংলাদেশের মানুষকে দিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতার পরপরই সকল সংবাদপত্র বাতিল করে দেশে মাত্র চারটি সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি দেয়া হয়। এই চাপা, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মানুষকে মুক্ত করে মানুষের চিন্তা, মত ও বাক প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করেন তিনি। বাকশাল গঠনের পর    শেখ মুজিবর রহমান নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে নিম্ন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ/অপসারনের কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধীন করে ফেললে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তার অবসান ঘটান শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের মাটিতে সত্যিকার অর্থেই সেপারেশন অব পাওয়ার নিশ্চিত করেছিলেন তিনি।

এই দেশের এক কোটির বেশি মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকে, যার প্রধান অংশটি থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। মূলত এই মানুষগুলোর পাঠানো রেমিট্যান্সই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যুক্ত হওয়া ২২লক্ষ মানুষ কী করতো, কেউ কি একবারও ভেবে দেখছি? বিদেশে কর্মী এভাবে না যেতে পারলে তার ফলশ্রুতিতে তৈরি হওয়া বেকার সমস্যা এই দেশের সামাজিক অস্থিরতা কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারতো অনুভব করি আমরা? এই দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভর করে আছে রেমিটেন্স এর ওপরে। কতটা ভবিষ্যতদ্রষ্টা হলে একজন মানুষ আজ থেকে চার দশকেরও বেশি সময় আগে এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন এবং কর্মীদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো শুরু করেন।

এখনকার বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচ দিতে দিতে আমাদের পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নেমে যাচ্ছে। এটা এক ভয়ংকর পরিস্থিতি। তাই বেশ কিছুদিন থেকে সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। শহীদ জিয়া তাঁর সময়ে এই ভূপরিস্থ পানি ব্যবহারের জন্য খাল কাটা কর্মসূচি সারা দেশে চালু করেছিলেন।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই দেশের বিরাট সমস্যা হয়ে উঠতে পারে সেটা জেনেই পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি চালু করেন তিনি। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে খাদ্য মজুদের জন্য বড় বড় গুদাম তৈরি করা হয় তার সময়ে। শিক্ষাকে সব মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, গণশিক্ষা এবং বয়স্ক শিক্ষা চালু করেন তিনি।  রাষ্ট্রের সাথে পল্লীর জনগণের সম্পর্ক তৈরি করার জন্য গ্রাম সরকার, আনসার-ভিডিপি তাঁরই অবদান। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নাগরিকদের উৎসাহ প্রদান করার কথাও ভুলে যাননি তিনি - চালু করেছিলেন একুশে এবং স্বাধীনতা পদক।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এর যে মিথ্যে প্রপাগ্যান্ডা চালানো হয়, সেটা আসলেই ছিল তাঁর সময়ে। নিজে ছিলেন যে কোনও রকম দুর্নীতি থেকে একেবারেই মুক্ত শুদ্ধতম মানুষ আর লড়াই করে যাচ্ছিলেন সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করার।

একথা বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হয় না বর্তমানে যে বাংলাদেশ আমরা দেখছি তার মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার হাত ধরেই। জিয়ার তুলনা কেবলই জিয়া। সততা, দেশপ্রেম,কর্মনিষ্ঠা, কঠিন নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রম, সৃজনশীল চিন্তা, অসাধারণ প্রশাসনিক দক্ষতা সবকিছুর সমন্বয় একজন মানুষের মধ্যে হওয়াটা প্রায় অসম্ভব। এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল তাঁর মধ্য দিয়ে। তিনি নিজেও কি জানতেন, তাঁর হাতে সময় খুব কম? না হলে কেন হাতে পাওয়া প্রতি পল অনুপলকে কাজে লাগিয়ে মাত্র সাড়ে ৪ বছরে দেশকে পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি? ক্ষমতার কেন্দ্রে আসার পর থেকেই তিনি দেশ জাতির স্বার্থে এমন সব পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিলেন যা বহু মানুষের কায়েমি স্বার্থে আঘাত হানতে শুরু করে যার অনিবার্য পরিণতি ৩০ শে মে, ১৯৮১। 


  • লেখক - রুমিন ফারহানা 
  • বিএনপি নেত্রী ও আইনজীবী। 


No comments:

Post a Comment