Search

Thursday, April 22, 2021

এদেশের মাটিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের কবর হবে তো?

— ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

গত ১১ই এপ্রিল একটি অত্যন্ত দুঃখজনক সংবাদ শিরোনাম হল প্রতিটি গণমাধ্যমের। সংবাদটি যতটা দুঃখজনক, ঠিক ততটাই ভীতিকর – করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৭৪ বছর বয়সী তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি যে কেবল সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী কিংবা বিএনপির মতো বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রধান তাই নন, তাঁর ব্যক্তিগত ক্যারিশমা, দৃঢ়চেতা আপসহীন মনোভাব, ঋজু, প্রখর ব্যক্তিত্বের কারণে দলের বাইরেও আপামর জনসাধারনের হৃদয়ে তাঁর একটা বিশেষ জায়গা আছে। স্বাভাবিকভাবেই করোনার এই দ্বিতীয় ধাক্কায় যখন চারপাশে কেবল বাড়ছে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা তখন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এই খবরটি নিঃসন্দেহে দেশে এবং দেশের বাইরে থাকা কোটি মানুষের হৃদয়কে কাঁপিয়ে দিয়েছে। মানুষ নীরবে চোখের পানি ফেলেছে, স্রষ্টার দরবারে প্রিয় নেতার রোগমুক্তির প্রার্থনা জানিয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া


বাংলাদেশের ৫০ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে তিনি কেবল প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীই নন বরং তিনি এমন এক নেতা যিনি কোনও দিন কোনও নির্বাচনে কোনও আসন থেকে পরাজিত হননি। তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে আছে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায়, বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে তাঁর নাম অমোচনীয় কালিতে খচিত হয়ে আছে। আর তাই বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ প্রার্থনায় নত হয়েছে তার এই খবর শুনে।

এর মধ্যে গত ১৮ই এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর দেখে চমকে উঠেছি আমি, চমকে উঠেছে দেশের মানুষ। করোনা আক্রান্ত খালেদা জিয়ার জন্য গত ১২ এপ্রিল বাদ আসর সোনামিয়া মেস্তরি বাড়ির দরজা জামে মসজিদে দোয়ার আয়োজন করেন ফেনী সদর উপজেলার পশ্চিম ফাজিলপুর ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদ। দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন মসজিদের ইমাম মেরাজুল ইসলাম। স্থানীয়রা বলেন, বিষয়টি জানতে পেরে মসজিদ কমিটির সভাপতি নুরুল আফসার এ বিষয়ে হুজুরকে কৈফিয়ত তলব করেন। কৈফিয়তের সঠিক জবাব দিতে না পারায় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।



বাংলাদেশে যখন নির্বাচন হতো সে সময়ের কথা বলছি। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেই নির্বাচনগুলোতে সকল আসন থেকে জয়লাভ করলেও সবসময়ই নিজের জন্য বেছে নিয়েছেন ফেনী। আর তাই তাঁর নিজ এলাকা ফেনীতে তাঁর জন্য দোয়া আলাদা গুরুত্ব বহন করে। তাঁর এই গভীর সঙ্কটে তাঁর নিজ এলাকায় দোয়া না হওয়াটাই তো ভীষণ অস্বাভাবিক। শুধু তাই না, একজন অসুস্থ মানুষের জন্য, তিনি যেই হোন না কেন, যে কেউ যে কোনও সময় তাঁর জন্য দোয়া করতে পারেন। এখানেও যখন রাজনৈতিক পরিচয় দেখা হয় এবং দোয়া করবার অপরাধে ইমাম চাকুরিচ্যুত হন, তখন আমরা আবারও দেখতে পাই গত এক যুগে এই রাষ্ট্রটির মূল কাঠামটিকে কীভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই রাষ্ট্রের সংবিধান এবং আইন এই নিশ্চয়তা দেয় যে নাগরিকদের মধ্যে যে কোনও পরিচয়ের কারণে বৈষম্য সৃষ্টি করা যাবে না। রাষ্ট্র কিংবা একজন নাগরিক ওপর নাগরিকের প্রতি তাঁর কোনও পরিচয়ের কারণে সেটা করলে তা হবে স্পষ্ট সংবিধান লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এই দেশে বহুকাল থেকেই এসব কেবল কথার কথা।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়লো দু’টি ঘটনার কথা। তথাকথিত কঠোর/সর্বাত্মক লকডাউনে ঢাকার রাস্তায় চিকিৎসকের সাথে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট এর তীব্র বাদানুবাদের ঘটনাটি এখনো ভীষনভাবে আলোচনায় আছে। একজন নাগরিক স্রেফ একজন নাগরিক হিসাবে তাঁর সাংবিধানিক, আইনগত অধিকার ভোগ করবেন। প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা (সংবিধানের ভাষায় ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’) তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন শুধুমাত্র তাঁর প্রশাসনিক পরিচয়ে। কিন্তু একজন উচ্চ শিক্ষিত নাগরিক এবং প্রজাতন্ত্রের দুইজন ক্ষমতাশালী কর্মচারী এসব থেকে সরে গিয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ পরিচয়কে বড় করে তুললেন। কারণ তারা খুব ভালভাবেই জানেন এই রাষ্ট্র এখন আর সাধারণ নাগরিকদের জন্য নয়; শুধু ক্ষমতার বলয়ে থাকা একটি বিশেষ গোত্রের মানুষের।


পটুয়াখালী জেলা শহরে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘পটুয়াখালীবাসী’র ইফতার আয়োজন দেশের মানুষের প্রশংসায় ভেসেছিল। পটুয়াখালী জেলা শহরের সার্কিট হাউজ থেকে সোনালী ব্যাংক মোড় পর্যন্ত সড়কটি ইফতারের আগে সাজানো থাকে সারি সারি প্যাকেট ও পানির বোতলে। এগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাশেই রাখা থাকে একটি ছোট ব্যাগ। রোজার শুরু থেকে প্রতিদিন ইফতারের আগে এ দৃশ্য দেখা যায় সড়কটিতে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া রোজাদাররা যে যার মতো করে একটি প্যাকেট নিয়ে চলে যান। ইতোমধ্যে এই দৃশ্যটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকদিন না যেতেই খবর এলো ইফতার দানকারী সংগঠনটির আহ্বায়ক মাহমুদুল হাসান রায়হান মারধরের শিকার হয়েছেন। তিনি জানান, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি কাজী আলমগীর ও চার-পাঁচটি মোটরসাইকেলে করে তার সহযোগীরা তার ওপর এ হামলা চালান। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাকে তিনি বলেন, "প্রথমে তারা এসে বলে যে তুই কী হয়ে গেছস? তোকে ফান্ড দেয় কে? তোমরা  প্রোগ্রাম করো আমাদের জানাইছ?" "আমি ইফতারের আয়োজন করি বলে জানালে, তারা আমাকে প্রোগ্রাম করতে নিষেধ করে চলে যায়", বলেন রায়হান। "এর পাঁচ মিনিট পর তারা আবার ঘুরে আসে। এসে কোনো কথা ছাড়াই মারধর শুরু করে। লাঠিসোটা ছিল না। হাত দিয়েই মারে। শুধু আমাকেই মারে", যোগ করেন তিনি।

দেশের একজন সাধারণ নাগরিক এমন একটি আয়োজন করে বাহবা নেবে ক্ষমতাসীন দলকে পাশ কাটিয়ে কিংবা তাদের সাথে আলোচনা করে অনুমতি না নিয়ে, সেটা এই দেশে হবার নয়, সেটা না জানার কিংবা ভুলে যাবার মাশুল দিলেন রায়হান। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্যই প্রকাশিত করে এই দেশের বর্তমান পরিস্থিতি। ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত না থাকলে তাকে মার খেতে হবে এবং তার আগে শুনতে হবে অনিবার্য প্রশ্ন – ‘তুই কী হয়ে গেছস?’

গত এক যুগের একটির পর একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, বিরোধী দল মত দমন, সকল সাংবিধানিক আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে সর্বত্র দলীয়করন, সেপারেশন অব পাওয়ারের নূন্যতম বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট না রাখা এই রাষ্ট্রের মূল কাঠামোটিকে ভেঙে ফেলেছে। বর্তমান বাংলাদেশকে দেখলে মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্যের বেশি কিছু আর মনে হয় না।

আওয়ামী শাসনামলে বাংলাদেশে ক্রমাগত চাষ হয়েছে তীব্র বিভেদ আর ঘৃণার। এখানে একটি দল সরকার, রাষ্ট্র সবকিছুকে পরস্পরের মধ্যে বিলীন করে ফেলেছে। এমন রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন দলের বাইরের ‘নিরপেক্ষ’ নাগরিকই বঞ্চিত হয় তার সাংবিধানিক অধিকার থেকে। আর কোনও নাগরিক যদি হয় সরকার বিরোধী, বিশেষ করে সরকারের অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে থাকা দলের রাজনৈতিক কর্মী তাহলে তাঁর কপালে থাকে বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, হামলা-মামলার হয়রানি।

এমন একটা টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্রই হচ্ছে এটা ক্রমাগত আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠবে, উঠছেও। এই রাষ্ট্রের একজন অতি সন্মানিত সিনিয়র সিটিজেনের অসুস্থতার জন্য দোয়া করা এই রাষ্ট্রে এখন ইমামের জন্য অপরাধ; চাকুরিচ্যুতি হয় তাঁর। এতেই শেষ হবে এই বীভৎসতা? ইতিহাস বলে হবে না, আরও আগ্রাসী হয়ে উঠবে ক্ষমতাসীন দলটি। শুধুমাত্র সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ দল বিএনপি করাটা অচিরেই হয়তো এত বড় অপরাধ হয়ে উঠবে যে এই ‘সাম্রাজ্যে’ কবর দিতে বাধা দেয়া হবে পরলোকগত বিএনপি নেতা-কর্মীদের মরদেহ।





লেখক — জাতীয় সংসদ সদস্য ও আইনজীবী।

No comments:

Post a Comment