বিদায়ী বছরে অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক ছিল নিম্নমুখী। বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থান কমে যাওয়া, বছর শেষে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি দুর্বিষহ করে তুলেছে নিন্মআয়ের মানুষের জীবন। দূরদর্শী নীতির অভাবেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আর্থিক খাতের সুশাসনকে ব্যাহত করেছে। এ ছাড়া বৈষম্য বৃদ্ধি, সীমিত উৎপাদন সক্ষমতা, দেশ থেকে টাকা পাচার বৃদ্ধি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিকাঠামোর অদক্ষতা অর্থনীতিতে মধ্যমেয়াদি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’র বার্ষিক পর্যালোচনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ অবস্থার উত্তরণে আর্থিক খাতে প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার, ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে সমন্বয়ের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। রোববার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
উন্নয়ন অন্বেষণ বলছে, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। গত ৫ বছর ধরে এ প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে। কিন্তু এর সুফল সাধারণ জনগণের নাগালের মধ্যে পৌঁছানোর জন্য দূরদর্শী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতা দূর করে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। কিন্তু গত কয়েক বছরে এ ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেই। এতে বৈষম্য বেড়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের হার কমেছে। ফলে অনেক উন্নয়নের কথা বলা হলেও সাধারণ মানুষ খুব বেশি সুফল পায়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ২০১৬ সালের আয়-ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্য দূরীকরণের বার্ষিক গড় হার কমেছে। ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে গড়ে প্রতিবছর ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমেছে। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৬- এ ৫ বছরে দারিদ্র্য কমেছে গড়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে। একই সময়ে অতি দারিদ্র্য দূরীকরণের বার্ষিক গড় হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ধনী-দরিদ্র্যের বৈষম ক্রমেই বাড়ছে। ২০১০ সালে দেশের ১০ শতাংশ দরিদ্র্য মানুষের মোট জাতীয় আয়ে ২ শতাংশ অবদান ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে তা কমে ১ দশমিক ০১ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ২০১০ সালে দেশের ১০ শতাংশ ধনী লোকের মোট জাতীয় আয়ে অবদান ছিল ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। কিন্তু ২০১৬ সালে তা বেড়ে ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থ্যাৎ গরিব আরও গরিব হচ্ছে, বিপরীতে ধনীদের সম্পদ বাড়ছে।
অর্থনীতির অন্যতম একটি উদ্বেগের বিষয় হল কর্মসংস্থান হ্রাস। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বার্ষিক হার ৩ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থনীতিতে এর ব্যাখ্যা হল- সুবিধাবঞ্চিতদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়নি।
গবেষণা সংস্থাটির রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বিদায়ী বছরের মে থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। অক্টোবরে তা বেশি বেড়েছে। ২০১৭ সালের মে থেকে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এ সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ দশমিক ৮৯ শতাংশে উন্নীত হয়। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হারও নিন্মআয়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ২০১০ সালে দেশে মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩১৮। ২০১৬ সালে তা কমে ২ হাজার ২১০ ক্যালরিতে নেমে আসে।
অর্থনীতিতে আরও একটি সমস্যা হল- উৎপাদন সক্ষমতা কমছে। জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির, বাড়ছে অর্থ পাচার এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সৃষ্টি হয়েছে অস্থিতিশীলতা। ২০১১-১২ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি গড়ে এক শতাংশেরও কম। ২০১১-১২ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের হার ছিল ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ, ২০১২-১৩ সালে ২১ দশমিক ৭৫, ২০১৩-১৪ সালে ২২ দশমিক ০৩, ২০১৪-১৫ সালে ২২ দশমিক ০৭, ২০১৫-১৬ সালে ২২ দশমিক ৯৯ এবং ২০১৬-১৭ সালে ২৩ দশমিক ০১ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে।
অন্যদিকে দেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছে। ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি এবং ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। জিডিপির অন্যতম খাত কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার কমছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। এরপর ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ৩ দশমিক ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়লেও সেবা খাত স্থবির।
অর্থনীতির অন্যতম একটি সূচক হল রাজস্ব আয়। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামো অনুসারে জিডিপির ২২ শতাংশ হারে রাজস্ব আয় হওয়া উচিত। কিন্তু ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ হার ছিল ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৬৬, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১০ দশমিক ৭৮, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০ দশমিক ২৬ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ। এর অর্থ হল- রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এতে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
- যুগান্তর, জানুয়ারি ১, ২০১৮