Search

Monday, March 19, 2018

‘মাইনাস ওয়ান’ ‘মাইনাস টু’

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী


এ রকম পরিস্থিতি আরেকবার হয়েছিল, ২০০৭ সালে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্ঘাতময় অবস্থায় সে সময় ক্ষমতা দখল করেছিল জে. মইনউদ্দিন আহমদ। তার শিখণ্ডি ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ। তারা ক্ষমতা দখল করেই বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিদায় করে দিতে চেয়েছিলেন এই দুই নেত্রীকে। তারা দুই নেত্রীকেই গৃহবন্দী করে তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের না-হক মামলা দায়ের করে তাদের হেনস্থা করতে শুরু করেছিল। মামলা দিয়ে হেনস্থা করার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তাদের লক্ষ্য ছিল, বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করে তাদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করা।

এতে প্রায় সাথে সাথে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকারকে (যা ১-১১ সরকার বলে পরিচিত) এই বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন যে, এই সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল। অর্থাৎ লগি-বৈঠার যে আন্দোলনে তার দলের লোকেরা একদিনেই পিটিয়ে হত্যা করেছিল ১১ জন নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে, সে আন্দোলনের ফসল নাকি ছিল এক-এগারোর সরকার। 

শেখ হাসিনা শুধু এই সরকারকে স্বাগত জানাননি, তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, এক-এগারোর সরকার যা কিছু সিদ্ধান্ত নেবে, তার সব কিছুকেই ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বৈধতা দেবে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া কিছুতেই দেশ ছেড়ে যেতে চাননি। তিনি বারবার বলছিলেন, বাংলাদেশের বাইরে তার কোনো ঠিকানা নেই। 

সুতরাং যা-ই কিছু ঘটুক না কেন, তিনি বাংলাদেশেই থাকবেন। এক-এগারোর সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সৌদি দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হলো, খালেদা জিয়াকে যদি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে সৌদি আরব পাঠানো হয়, তাহলে সৌদি সরকার তাকে ভিসা দেবে না। বেগম খালেদা জিয়ার মনোভাব কী, এটা জানার জন্য সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তারা তার সঙ্গে দেখা করেন এবং নিশ্চিত হন যে, তিনি স্বেচ্ছায় সৌদি আরব চলে যেতে রাজি নন। তাই খালেদা জিয়াকে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার বিদেশে পাঠাতে পারেনি। 

এর ফলে এক-এগারোর সরকার যে ‘মাইনাস টু’ ফরমুলা নিয়েছিল, তা আর বাস্তবায়িত হতে পারে না। খালেদা জিয়া দেশেই থেকে যান এবং তিনি শেখ হাসিনাকেও জোর করে বিদেশে রেখে দেয়া, তাকে বাংলাদেশে আর ঢুকতে না দেয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। এতে সামরিক সরকার প্রাথমিকভাবেই হোঁচট খায়। তারপর বহু অপকীর্তিও কিন্তু খালেদা জিয়াকে টলাতে পারেনি। প্রকৃতিগত কারণে শেষ পর্যন্ত মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারকে রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছে। তারা একটি পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর নীলনকশা করে। 

ড. শামসুল হুদার নেতৃত্বে তারা যে নির্বাচন কমিশন গঠন করে সে ছিল পাতানো খেলাই। এই নির্বাচন কমিশন কোনো নিয়ম-নীতির মধ্য দিয়ে করা হয়নি। বরং করা হয়েছিল বল প্রয়োগের মাধ্যমে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার থেকে শুরু করে অপরাপর নির্বাচন কমিশনারকে রাষ্ট্রপতির চায়ের দাওয়াত দিয়ে হুমকি দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠন করা হয় নতুন নির্বাচন কমিশন। অনেকের এমনও মত আছে যে, সে নির্বাচন কমিশন নাকি খুব দক্ষতার সাথে নির্বাচন পরিচালনা করেছিল। এটি ডাহা মিথ্যা। 

সেই নির্বাচনে বহু ক্ষেত্রে ১০-১৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল। কিভাবে এটা সম্ভব হলো, তার কোনো জবাব নির্বাচন কমিশন দিতে পারেনি। পথেঘাটে পাওয়া যাচ্ছিল ব্যালট পেপারের মুড়ি। সেগুলো যখন জনসমক্ষে আসতে শুরু করল, তখন শামসুল হুদা নতুন আইন করলেন যে, যার কাছে মুড়ি পাওয়া যাবে তাকে গ্রেফতার করা হবে। বহু ভোটকেন্দ্রের আশপাশে পেয়েছিল এরকম মুড়ি। এভাবে শামসুল হুদা কমিশন একটি নির্বাচন করে মইন-ফখরের নির্দেশে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল।

নির্বাচন কমিশন এখানেই থেমে থাকেনি। তারা প্রথমে সেনা শাসকদের নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করেছিল। বিএনপি ভাঙার জন্য তারা বেছে নিয়েছিল আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে। শামসুল হুদা ও মান্নান ভূঁইয়া ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। ফলে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে নেই এমন কাজও তারা করেছে। দল ভাঙার অপপ্রয়াসের জন্য বেগম খালেদা জিয়া যখন মান্নান ভূঁইয়াগংকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। তখন শামসুল হুদার সে কি ক্রোধ! যা সত্যি সত্যি হাস্যকর ছিল এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে অত্যন্ত বেমানান। এদিকে আওয়ামী লীগকে ভাঙার জন্য সেখানে গঠন করা হয় সংস্কারপন্থী গ্রুপ। এই গ্রুপে ছিল রাজ্জাক, আমু, তোফায়েল ও সুরঞ্জিত। তারা আওয়ামী লীগে সংস্কার আনার জন্য বেশ কতকগুলো প্রস্তাব উত্থাপন করেন। একই রকম প্রস্তাব উত্থাপন করেন মান্নান ভূঁইয়ারাও। কিন্তু সেসবে কোনো ফল হয়নি। 

চূড়ান্তভাবে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দলই টিকে থাকে। পরে সেখানে শেখ হাসিনা আবদুর রাজ্জাক ছাড়া প্রায় সবাইকে দলে ফিরিয়ে নেন। কিন্তু জানিয়ে দেন যে, ফরগিভ করেছেন, ফরগেট করেননি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার মান্নান ভূঁইয়ার বহিষ্কারের সময় এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বলে বসলেন, ১৫ বছর দলের সাধারণ সম্পাদক হয়ে রয়েছেন, এ রকম ব্যক্তিকে কোনো শোকজ নোটিশ না দিয়ে বহিষ্কার করা সম্পূর্ণ বেআইনি। 

যা হোক, মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের ‘মাইনাস টুু’ ফরমুলা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। বরং জনগণের অপরিসীম ঘৃণা নিয়ে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকারকে বিদায় নিতে হয়েছে। 

এবারের খেলা ভিন্ন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ একদলীয় বিনা ভোটের এক নির্বাচন করে। তাতে ৫ শতাংশ ভোটার অংশ নিয়েছিল কি না সন্দেহ। সে নির্বাচন এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে, অর্ধশত কেন্দ্রে একজন ভোটারও ভোট দেয়নি। এমন কি আওয়ামী লীগের যে ১৪ দলীয় জোট তাদের পোলিং এজেন্টরাও ভোট দেয়নি। সে ভোট বিএনপি বর্জন করেছিল। শুধু বিএনপি নয়, আওয়ামী জোটের বাইরে অন্য কেউই ২০১৪ সালের ভোটে অংশ নেয়নি। 
ওই নির্বাচনে ১৫৩ আসনে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করেনি। সুতরাং বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ জোটের প্রার্থীরা নির্বাচনের বিজয়ী হয়ে এসেছে। আর নির্বাচিত হয়েই বিএনপির ওপর একেবারে খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হয়। এ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে ৭৮ হাজার, আসামি ১৮ লাখ। বিএনপি নেতাদের এক একজনের মাথার ওপর শতাধিক মামলা ঝুলছে। অসংখ্য নেতাকর্মী কারাগারে। এ ছাড়া শারীরিক নির্যাতনের শিকার বিএনপির হাজারে হাজারে নেতাকর্মী। বিএনপি নেতাকর্মীদের গুম-খুন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ আবারো ‘মাইনাস ওয়ান’ ফরমুলায় এগিয়ে যাচ্ছে। এবারে এর পেছনে মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন নেই। কিন্তু স্বৈরাচারী মানসিকতাই এর পেছনে কাজ করছে। 

এবার তারা রাজনীতি থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে ও তার পরিবারকে চিরদিনের মতো বিদায় করতে চায়। একসময় এটা কল্পনারও অতীত ছিল যে, সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে এক ভুয়া মামলায় আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়া গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে বন্দীজীবন-যাপন করছেন। বলা হচ্ছে, কুয়েত সরকারের অনুদানে যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠিত হয়, তাতে আড়াই কোটি টাকা তছরুপ হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক হিসেবে দেখা যায় যে ওই আসল টাকা সুদে-আসলে এখন ছয় কোটি টাকা হয়েছে। সুতরাং একে তো তছরুপ বলা যায় না। কোনো ভুল হয়ে থাকতে পারে, ভুল কোনো অপরাধ নয়। তার সহজে সংশোধনযোগ্য। কিন্তু সরকার সে দিকে না গিয়ে সেই ভুলটাকে বিবেচনায় নিয়ে খালেদা জিয়াকে নাজিমুদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারে বন্দী করে রেখেছে। জনমানবহীন সেই কারাগারে তিনি একাই বন্দী, সেখানে আর কোনো মানুষ নেই। 

বেগম খালেদা জিয়া যেমন আদালতে বলেছেন, তেমনি তার আইনজীবীরা বলেছেন, তিনি কোনো অন্যায় করেননি। ন্যায়বিচার পেলে তিনি দ্রুতই বেরিয়ে আসবেন। এখানেও মানুষের মনে সংশয়ের দোলাচল থেকেই গেল। নিন্ম আদালনের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা হাইকোর্টে আপিল করেছিলেন। হাইকোর্ট তার চার মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। এর বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ ছুটে গিয়েছিলেন চেম্বার আদালতে। চেম্বার বিচারপতি ‘নো অর্ডার’ দিয়ে তা বিবেচনার জন্য আপিল বিভাগের ফুলকোর্টে পাঠান। সেখানে আবার থমকে গেল খালেদা জিয়ার জামিন। আসামিপক্ষের আইনজীবীদের কোনো বক্তব্য না শুনেই আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার জামিন গত ১৪ মার্চ রোববার পর্যন্ত স্থগিত করেছেন। 

আসামি পক্ষের আইনজীবীরা বারবার বলছেন, তাদের বক্তব্য শোনা হোক। কিন্তু প্রধান বিচারপতি তাদের জানিয়ে দেন তাদের বক্তব্য রোববারই শোনা হবে। 

আবার রোববার যাতে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও খালেদা জিয়া কারামুক্ত হতে না পারেন তার আয়োজনও পাকাপাকি আছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কুমিল্লায় বাস পোড়ানোর মামলা করেছিল সরকার। সে মামলার জামিন আবেদন খারিজ হয়ে গেছে এবং তাতে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়েছেন। ফলে এ মামলায় খালেদা জিয়াকে নতুন করে জামিন আবেদন করতে হবে। এরপর কোন মামলা আসে কে জানে! 

সরকারের লক্ষ্য খালেদা জিয়াকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা। কারণ সরকার জানে তাদের পায়ের তলায় মাটি নেই। যদি একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে সরকারের পরাজয় হবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। অতি সামান্য আসনে সরকার দলের সদস্যরা জয়ী হয়ে আসতে পারে। 

এখন সারা দেশে বিএনপি পুলিশের শত উসকানির মুখেও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাচ্ছে। তাতে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটছে। পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সারা পৃথিবী বলছে, আগামী নির্বাচন হতে হবে সব দলের অংশগ্রহণে। সরকার বলছে, কেউ যদি নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে তার সরকারের কী করার আছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যাপারে তারা কোনো পদক্ষেপ নেবে না। ফলে পরিস্থিতি এখন ঘোলাটে। যেসব মামলায় খালেদা জিয়াকে আসামি করা হয়েছে, এক-এগারো সরকারের আমলে সে সময় একই ধরনের মামলায় শেখ হাসিনাকেও আসামি করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেসব মামলা প্রত্যাহার করা হয়। এটি এক যাত্রায় দুই ফল, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কারো কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার আশা করছে, খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারলে বিএনপিতে ভাঙনের সৃষ্টি হবে। এবং সেই ভাঙনে বিএনপির একটি অংশ জাতীয় পার্টির সাথে মিশে যাবে। জাতীয় পার্টির এরশাদও একই কথা বলেছেন। 

শেখ হাসিনার এই নীলনকশার সম্পর্কে বেগম খালেদা জিয়া ও তার দল সচেতন রয়েছে। দেশের মানুষ এখন একদলীয় শাসনে অতিষ্ঠ। তারা বিএনপির পতাকা ছেড়ে চলে যাবে বলে মনে হয় না। সরকার ব্যাংকগুলো লুট করছে। শেয়ারবাজারে কারসাজিতে লাখ লাখ মানুষ ফতুর করেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, সরকারদলীয় চাঁইরা দুর্নীতিতে ডুবে গেছে, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র চরম দলীয়করণের শিকার। 

ফলে বাংলাদেশে এখন অব্যবস্থাপনা চরমে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন, ভারতীয় আধিপত্যবাদ রুখে দিয়েছিলেন, দেশে ফ্রি মার্কেট ইকোনমি চালু করেছিলেন। যার ফলে বাংলাদেশ চরম দরিদ্র অবস্থা থেকে উঠে এসেছিল। আন্তর্জাতিক বন্ধু ও অংশীদাররা বাংলাদেশে প্রশ্নবিদ্ধ গণতন্ত্র চায় না। কারণ উপমহাদেশে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল অধিকতর গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসরমান। খালেদা জিয়ার জামিন পেতে কম সময় লাগুক বা বেশি সময় লাগুক, সেটি হয়তো বিবেচ্য বিষয় না। বিবেচ্য বিষয় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন কি না। বিএনপি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, খালেদা জিয়াকে ছাড়া তারা আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেবে না। 

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য ১০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে। বিশ্বস্ত সূত্র বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে জানিয়েছে, ‘শেখ হাসিনা সরকার যদি বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে রাজি না হয়, তাহলে ভারত যেন বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে সহায়তা থেকে বিরত থাকে।’ 

আবার অনেকেই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, সরকার যদি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলা নিয়ে এগিয়েই যেতে থাকে, তবে তা ফের ‘মাইসাস টু’-তে পর্যবসিত হতে পারে।

  • নয়াদিগন্ত / ১৮-৩-১৮

ভোক্তার নাভিশ্বাস


- সিনান পাশা


বৃহস্পতিবার, মার্চ ১৫,  বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালন হলো । রাস্তায় এর বাহারী পোস্টার। বাজারে ওটা ‌উধাও, ওটা নিখোঁজ। চড়া দাম। ভোক্তাদের ভোগ নয়, দুর্ভোগের অন্ত নেই। পাবলিক পারসেপশনকে থোড়াই তোয়াক্কা না করার যুগে বলতেই হবে, আরে! কেন ভোক্তারা ৬০/৭০টাকার চাল তো ভালোই খাচ্ছেন।এটা হলো উন্নয়নের দুর্বার গতির একটা পরিমাপ। দেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ প্রায়। তবে ভোক্তারা আশঙ্কা করছেন, ওটা ক্রিকেট ও পেয়াঁজের মতো অচিরেই সেঞ্চুরি করবে। চালের বাজার? ও কথা আর বলার নয়।

বাহারি দাবি করেছিলেন আমাদের কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রীরা। বাংলাদেশ চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ তো বটেই।ফাইন চালও রপ্তানি করছে। ভতু‌র্কি ও সার দেওয়া হচ্ছে প্রচুর। আর চালকলের মালিক তারা তো আহলাদে আটখানা। ভারতের চালের বাজারই তো বাংলাদেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। জানিয়ে দিয়েছেন অামাদের চাল ব্যবসায়ীরা। বলছে চাল কিনবেন অামাদের বলুন! খাদ্যমন্ত্রী , বাণিজ্য মন্ত্রী - চালব্যবসায়ীদের সাথে একাধিকবার বৈঠকে বসার কথা শুনেছি। তাতে কোনো ফল হয়নি। বরং চাল-পেঁয়াজ ও অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। খাদ্যমন্ত্রী মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া থেকে ‘চমৎকার’  আতপ চাল এনেছিলেন যা খেতে আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অভ্যস্থ নয়। সিদ্ধ চালের একটা সমস্যা হলো সে চাল ন্যায্যমূল্যে সরকার দিলেও তা অনেক ক্ষেত্রেই বেচাল বাঁকাপথে চাল পলিশিং মি‌লে চলে যায়। মাঝখান থেকে যা‌দের যা কামানোর তারা কমিয়ে নিয়েছে। ভোক্তার কোনো উপকার হয়নি।

পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হবার বিরুদ্ধে ‌ঘোষিত যুদ্ধে সরকার হার মেনেছেন। তারা বলেছেন এই ফাঁসাফাঁসি শেষ করার নয়। এমনকি পরীক্ষার হলে বই খুলে পরীক্ষা দেবার অত্যাভিনব পদ্ধতির কথাও ভাবছেন তারা। ডিজিটাল ব্যাপারটাই এ্খন শিক্ষাঙ্গনের কাল। যে ভাত রাঁধে সেই আগুন এখন শিক্ষাঙ্গন পোড়াচ্ছে। এখানেও সেই তিন অবস্থা হবে না তো!

গমের আটার ব্যাপারে সাধারণ ভোক্তাদের কাছ থেকেই শুধু নয়। নানা সরকারি-বেসরকরি প্রতিষ্ঠান থেকেও নানা অভিযোগ উঠেছে তবে সেসবের কোনো সহজ  প্রতিকার হয়েছে বলে জানা যায়নি। বরং জাহাজ ভরা চাল বা গমকে দেশের ভেতরেই পশুখাদ্য নাম দিয়ে মানুষের বাজারেই বিক্রি হবার নানা অভিযাগ শোনা গেছে।

পেঁয়াজের মতো যেসব পণ্য  আমদানি ও দেশের ভেতরের উৎপাদন মিলে উদ্বৃত্ত হলেও বাজারে দাম বাড়ার অস্বাভাবিক প্রবণতা দেখা গেছে। আর এসবই মধ্যস্বত্বের কারসাজি বলে প্রমাণিত। সরকার বাজার মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম হয়নি। কেননা, ব্যবসায়ীরা রাজনীতির বিবেচনায় সব‌চেয়ে মূল্যবান বলে মনে হযে‌ছে। সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা অশুভ আঁতাতের কথা এখন ওপেন সিক্রেট।

গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ সরাসরি ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা করছেন বলে মনে করার সঙ্গত কারণ আছে। তারা ভোক্তদের শত আপত্তি ও অভিযোগের মুখে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবেই বলে সাফ জা‌নিয়ে দিয়েছেন। এতে যারা এলএনজি বাজারজাত করছেন সেই উদ্যোক্তাদের লাভ হবে। পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য আছে সেসবের বেলায় ইন্ধনশক্তি কমিশন যে গণশুনানির ব্যবস্থা করেছেন কোনোটাতেএ ভোক্তাদের বক্তব্য বিবেচনা লাভ করেনি। তাঁরাও মনে হয় আমাদের বিচার ব্যবস্থায় পাবলিক পারসেপশনকে অবহেলা করার ‘আইনি’ প্রবণতায় লিপ্ত হয়েছেন।

জ্বাল‌ানি তেলের ব্যাপারে এতোদিন আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুন্নত দেশগুলির অনকূলে থাকলেও এখন অার থাকছে না সেই অজুহাতে বাংলাদেশও জ্বালানি ‌তেলের দাম বাড়াবে এমন আভাস প্রবল। ভোজ্য তেলের দামও বাড়‌ছে।

বিশ্ব ভোক্তা দিবসের প্রকাশিত ক্রোড়পত্রে আমরা জানছি আজকের দিবসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের  শ্লোগান হচ্ছে ‘ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণ’।  এটা হয়ে থাকতে পারে তবে ভোক্তাসাধারণের গায়ে লাগেনি। তবে বাজারের আগুণে যে তাদের গায়ে জ্বর আসছে কি না ভোক্তারা তা বলতে পারবেন। তারাই ভুক্তভোগী।   

লাশের নামটা - ‘জাকির হোসেন মিলন’

#ZakirHossainMilon

দিপক চন্দ্র 



ছেলেটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। অভিযোগ আছে। পুলিশ তার হাত ও পায়ের বিশটা আঙুল থেকে নখ উপড়ে ফেলেছিলো। ছেলেটার একমাত্র অপরাধ , সে বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য সমাবেশে গিয়েছিলো। এদেশের একজন বুদ্ধিজীবীরও গতরাতে খাদ্য গিলতে কিন্তু কোনই সমস্যা হয়নি। আমার পরিচিত একজন য়ুনিফর্মওলার গতকাল সকালে য়ুনিফর্ম পরতে কোনো গ্লানি হয়নি। গত মাসে তাদের বেতন হয়েছে ঠিকঠাক। বাংলাদেশের সব য়ুনিফর্ম গতরাতে হ্যাঙ্গারে ঘুমাতে গিয়েছে এই আশ্বাসে যে সকালবেলা তারা প্রচুর প্রচুর আব্রু ঢাকবে। বিলকুল সব ঠিক। গাছের পাতাটিও নড়বে না। নড়বে কি?

শুধূ যাদের দু-বছরের একটা ছোট্টো মেয়ে আছে, তারাই হয়তো শুধু কাজ করতে পারছে না আজকে।

আপনারা দয়া করে লাশটার নামটা মনে রাখবেন।

জাকির হোসেন মিলন

জাকির হোসেন মিলন

জাকির হোসেন মিলন

লাশটার সত্যিই একটা মেয়ে ছিলো। মেয়েটার নাম আয়েশা। আয়েশা তার বাবার কোলে চড়তে পছন্দ করতো!  কী আশ্চর্য! সে তার বাবার কাছে যেতে চাইছে শুধু গত চারদিন ধরে। অথচ, এক সপ্তাহ পর পুরা বাংলাদেশ ভুলে যাবে, শুধু আয়েশা তার বাবার কোলে মাথা গুঁজতে পারবে না। অাজকের একুশ শতকে শোকের আয়ু একটা জিতে যাওয়া টিটোয়েন্টির সমান। হবে কি এর বেশি। হবে কি কালের কপোল তলে এক ফেঁটা জল।

আয়েশার বাবাকে য়ুনিফর্ম পরা মানুষেরা পিটিয়ে মেরেছে। তারা সময় নিয়ে, রেখে ঢেকে, রয়ে সয়ে - পয়লা সবক দিতে বেঁধে নিয়ে পিটিয়েছে একটা পিতাকে। খুবই ছাপোষা সাধারণ পিতা - এদেরকে মেরে ফেললে কিছু হয় না কারো - শুধু আয়েশা ছাড়া। আমাদের পুলিশের হাত ডিফেন্সলেস মানুষকে চুপিসারে  পিটিয়ে মেরে ফেলায় খুবই চমৎকার!

আমার বাবা ৭০ এর দশকে সৈনিক ছিলেন এদেশে। তাদের বিরুদ্ধে আজকের দিনের যেকোনো য়ুনিফর্ম-পরিহিত কেউ অভিযোগ করবেন যে তারা প্রফেশনাল ছিলেন না। অাদৌ!

অভিযোগ সত্য। তারা আসলেই প্রফেশনাল ছিলেন না। আমি যখনই আমার বাপ-চাচাদের কথা কল্পনা করি, কেন যেন মনে হয়, তাদের কেউ না কেউ, আয়েশার বাবার হত্যাকাণ্ড আজ সকালে মেনে নিতেন না। তাদের মধ্যে কেউ না কেউ আজ সকালে পুরোপুরি নন-প্রফেশনালই থাকতেন। তাদের মাঝে কেউ না কেউ তার দুই বছরের আয়েশার চোখে তাকিয়ে বাংলাদেশের সব বাবাকে দেখতে পেতেন।

অবশ্যই বাংলাদেশে ওরকম নন-প্রফেশনাল য়ুনিফর্ম আর নেই।

আজ রাতেও বাংলাদেশের সব য়ুনিফর্ম গত রাতের মতো ঘুমাতে যাবে এই ভেবে যে সকালবেলা তারা প্রচুর প্রচুর আব্রু ঢাকবে।

Dhaka air among the worst


Dhaka city again ranked as one of the most polluted in the world yesterday, according to the air quality index prepared by the US Environmental Protection Agency.

In the rating, the Bangladesh capital ranked fourth in a list of the most polluted cities in the world with an index value of 195.

Kathmandu was rated the most polluted with a value of 208.

According to the index, the air pollution level across the world varies from hour to hour and day to day.

In late February of this year, according to the same index, Dhaka ranked as the most polluted city in the world with a score of 339 and its air was classified as “very unhealthy.”

The index has six categories indicating growing levels of public health hazards.

An air quality value over 300 indicates hazardous air while below 50 is considered to be healthy air. "Unhealthy" AQI is 151 to 200. At its current level, “everyone may begin to experience some adverse health effects, and members of the sensitive groups may experience more serious effects”.

Statistics of Bangladesh's Department of Environment show that the air quality index had the highest score of 501 in Dhaka on March 11. It was 338 in Gazipur and 308 in Narayanganj on the same day.

Among all the cities of the country, the highest pollution in March was recorded in Narayanganj with a score of 538.

According to medical experts, dust concentration in the air usually increases five times during the dry season, and dust particles from construction sites worsen the situation. Inhaling dust can severely damage the respiratory system and cause various lung diseases as well as viral and bacterial infection.

In Dhaka, air pollution level significantly comes down during monsoon, according to the department's findings.

Air quality ranging from 0-50 is considered good, 51-100 is moderate, 101-150 caution, 151-200 unhealthy, 201-300 is very unhealthy and 301-500 is extremely unhealthy.

  • Courtesy: The Daily Star Mar 19, 2018

৯৭ জন খুঁজছে যাঁকে, তিনি আছেন মুন্সিগঞ্জে!

  • নজু সর্দার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী।
  • নজুর ব্যবসা মিরপুরের চলন্তিকা ও ঝিলপাড় এলাকায়।
  • নজুকে ধরতে ৯৭ জনের একটি দল কাজ করছে।
  • কখনো গ্রেপ্তার হননি নজু।


নজু সর্দারসহ ঢাকার শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও পুলিশের ৯৭ জনের দল ঢাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। আর নজু মুন্সিগঞ্জের ‘জান্নাতুল ভিলা’য় বসে তাঁর ‘মাদক সাম্রাজ্যের’ খোঁজখবর রাখছেন। আজ পর্যন্ত কখনো নজু গ্রেপ্তার হননি, তিনি এসবে খুব একটা পাত্তা-টাত্তাও দেন না বলে কথিত আছে।

ঢাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে যখন থেকে মাদকের কেনাবেচা শুরু, তখন থেকেই নজুর নাম বিক্রেতাদের তালিকার প্রথম পাঁচজনের মধ্যে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশকে হাতে রেখে তিনি মিরপুরের চলন্তিকা ও ঝিলপাড় এলাকায় আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে মাদক বিক্রি করে আসছেন। ঢাকার রূপনগর থানা সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছরে চলন্তিকা বস্তিতে নজুসহ মাদক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ৮৩টি মামলা করেছে। গত ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশ স্থানীয় সাংসদকে নিয়ে নজুর ডেরায় অভিযানও চালায়।

প্রশ্ন উঠেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি সত্যিই নজু সর্দারকে ধরতে চায়? মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ খোরশিদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ৭৮ জন, এপিবিএনের ৯ জন ও পুলিশের ১০ জনকে নিয়ে গত ১১ মার্চও অভিযান হয়েছে। নজুর খোঁজে চলন্তিকাতেও গেছেন বাহিনীর লোকজন। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নজু সর্দার ওরফে নজরুল কাজী ওরফে নজু কাজী মিরপুরের চলন্তিকায় এখন খুব একটা যান না। তিনি মুন্সিগঞ্জেই থাকেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলে বড়জোর বরিশালে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। গেল সপ্তাহ থেকে তিনি মুন্সিগঞ্জেই থাকছেন। শহরের সবচেয়ে দামি জায়গা মানিকপুরে তাঁর ছয়তলা ভবন জান্নাতুল ভিলা। কখনো সেখানে, কখনো-বা মধ্য কেওরে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। গ্রামের বাড়ির চারতলা ভবনের কাজ তিনি প্রায় শেষ করে এনেছেন, টাইলস বসানোর কাজ চলছে এখন। পুরোদমে চলছে আল নাহিয়ান বাইতুন নুর জামে মসজিদ তৈরির কাজ। জানা গেছে, শুধু মুন্সিগঞ্জেই কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক তিনি। বরিশালেও তাঁর বেশ কিছু সহায়সম্পত্তি আছে। পরিবারটির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, নজু এখন নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে আরেকটি ডেরা তৈরির চেষ্টা করছেন। তবে মাদক বিক্রির কাজটা মিরপুরের চলন্তিকা বস্তির ২৫টি ঘর থেকেই তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। গোটা পরিবার এই কাজে তাঁকে সাহায্য করে।

গত ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি মিরপুরের চলন্তিকায় স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ টানা অভিযান চালায়। ওই অভিযানের সময় একটি ঘর থেকে স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস মোল্লা নজু সর্দারের মা সুফিয়া বেগমকে বের করেন। দুটি রামদাসহ গ্রেপ্তার হন নজু সর্দারের ভাগনে রিয়াজ। অভিযোগ আছে, নজুর মা সুফিয়া খাতুন, দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরা ও শাশুড়ি ফেলানি চলন্তিকায় মাদক কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁদের সহযোগিতা করেন নজুর বোন শান্তি ও লীলা। বিভিন্ন স্পটে কবে কে থাকবেন, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সামাল দেবে কে, সেসবও ঠিক করেন তাঁরা। ২০১৬ সালে র‍্যাব-৪ নজু সর্দারকে ধরতে ওই বস্তিতে যখন অভিযান চালায়, তখন এই নারীরাই বস্তির ভেতর বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করেন ও নজুকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। জানা গেছে, তোফা ও বাবুল সর্দার কারওয়ান বাজারে গাঁজা বিক্রি দিয়ে মাদকের বেচাকেনায় যোগ দেন। মিরপুরে এই কাজে যুক্ত হন নজু সর্দার। তোফা কাজী মুন্সিগঞ্জের সিবাইপাড়া, শাঁখারিপট্টিতে একটি মাদকের আড্ডা চালান। সেখান থেকে মাস তিনেক আগে তোফা সর্দারের ছেলে পরানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বাবুল সর্দার এখনো মিরপুরে মাদকের কেনাবেচায় জড়িত। বাবুল সর্দারের ছেলে রাসেল কাজী, নজুর বোন রানীর তিন ছেলে রাজন, রিফাত ও রিয়াজ, নজুর মেয়ে-জামাই শান্ত সম্পদের হিসাব-নিকাশ রাখেন।

নজু সর্দারের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বইন, সবই আপনার জানা। ছোট ভাইটার দিকে তাকায়া একটু রহম করেন।’ কেন ‘রহম’ চান জানতে চাইলে তিনি আবারও বলেন, সবারই সবকিছু জানা। মাদক বিক্রি কেন করেন এমন প্রশ্নে বলেন, তাঁর নামে অন্যরা এসব করে। তিনি নির্দোষ।

নজু সর্দারের উত্থান
গত সপ্তাহের শনিবার মধ্য কেওরে নজু সর্দারদের গ্রামের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা হয়। জানা গেল, নজু সর্দারের বাবা আবদুল আলী কাজী কৃষিকাজ করতেন। তিন ছেলে, পাঁচ মেয়ে নিয়ে তাঁর কায়ক্লেশে জীবন কাটছিল। দারিদ্র্য ঘোচাতে একপর্যায়ে বড় ছেলে তোফাজ্জল কাজী ওরফে তোফা কাজী ওরফে তোফা সর্দার ও মেজ ছেলে বাবুল কাজী ওরফে বাবুল সর্দার ঢাকায় চলে আসেন। তাঁরা রাজধানীর কারওয়ান বাজারে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তুলতেন। নজু সর্দার তেমন কিছু করতেন না। পরিবারটির শিক্ষাদীক্ষাও কম। আবদুল আলী কাজীর ঘনিষ্ঠ একজন আত্মীয় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওদের ধারেকাছে থাকলে মানুষ হব না, আব্বা-আম্মা এই ভয় করত। তাই বসতভিটা ছেড়ে খেতের মধ্যে আব্বা জমি কিনেছিল। কোনো রকমে একটা ঘর তুলেই আমরা ভিটা ছেড়ে চলে আসি।’ ভয়টা কিসের জানতে চাইলে তিনি বলেন, মিরপুরের চলন্তিকায় ওরা ‘কী কী’ করে বলে তাঁরা শুনেছেন।
মধ্য কেওরে বাড়ি তুললেও গ্রামের লোকজনের সঙ্গে তাঁদের তেমন একটা যোগাযোগ নেই। আলাউদ্দীন মিয়া নামে গ্রামের এক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, বছরে একবার ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার নজু সর্দারের মা সুফিয়া বেগম গ্রামের লোকজনকে দাওয়াত করে খাওয়ান। তিনি কলার ভেলা সাজিয়ে ভেতরে খাবারদাবার, আগরবাতি, মোমবাতি জ্বেলে পানিতে ভাসান। গান-বাজনারও আয়োজন করেন। প্রতিবছরই এই আয়োজনের জাঁকজমক বাড়ছে। ওই সময় ছাড়াও কাজীবাড়ির লোকজনকে দল বেঁধে মাঝেমধ্যে মধ্য কেওরের বাড়িতে আসতে দেখা যায়। 

গ্রামের বাড়ির আত্মীয়স্বজনের পুলিশ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ। শহরের মানিকপুরের ছয়তলা ভবনের নিচতলায় একটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানো আছে। ভবনের আশপাশে কাউকে দেখা গেলেই পরিবারের লোকজন সতর্ক হয়ে যান। শনিবার ওই ভবনের ছবি তোলার সময় হঠাৎ একটি মোটরসাইকেলে করে এসে হাজির হন নজু সর্দারের ভাই বাবুল সর্দারের ছেলে রাসেল কাজী। এসেই জেরা করতে শুরু করেন। পরে প্রথম আলোর স্থানীয় প্রতিনিধির বাসায় গিয়েও হাজির হন তিনি।

মুন্সিগঞ্জে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আজিজুল হক জানান, মাদক বিক্রেতাদের ব্যাপারে কেন্দ্র থেকে তাঁরা তথ্য পান। নজু সর্দার সম্বন্ধে কিছু জানেন না। আর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন কেবল বললেন, পুলিশ কাজ করছে। নিয়মিত অভিযান ও গ্রেপ্তার চলছে।
তারপরেও নজু সর্দার কেন সবার চোখের আড়ালে রয়ে গেলেন, সেই প্রশ্নের জবাব আর পাওয়া যাচ্ছে না।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের কাছে মাদক বিক্রেতাদের তালিকা আছে এবং নিয়মিত এই তালিকা হালনাগাদ করা হয়। এমন একজন মাদক বিক্রেতা এভাবে সহায়-সম্পত্তি করছেন, সেটা পুলিশ জানবে না—এটা একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে, যাঁরা মাদক নিয়ে কথা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে কর্তৃপক্ষ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। জিরো টলারেন্সের কথা শোনা যাচ্ছে, এর সঙ্গে মানুষ কিছু কাজও দেখতে চায়। নইলে পুলিশের ভাবমূর্তির যে প্রশ্ন, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

  • প্রথমআলো/ ১৯-৩-১৮

স্কুলের খেলার মাঠ দখল করে যুবলীগের কার্যালয়!


সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠ দখল করে কার্যালয় বানিয়েছে স্থানীয় যুবলীগ। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটিও যুবলীগকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে বিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীর তৈরি করেছে।

বিদ্যালয় ও স্থানীয় সূত্র জানায়, যুবলীগের এই নেতাদের পৃষ্ঠপোষক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুন্সি কামরুজ্জামান। তিনি বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতিও। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ নেতা হয়ে যুবলীগের কার্যালয় উচ্ছেদ করতে পারি না। তারপরও তাদের একাধিকবার বলেছি। কিন্তু তারা আমার কথা শুনছে না। তাই কার্যালয়ের জায়গা ছেড়ে দিয়েই মাঠের সীমানাপ্রাচীর দিয়েছি।’

মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়কের নির্মাণসামগ্রী রেখে প্রায় পাঁচ বছর ধরে মাঠ দখল করে রেখেছিল তমা গ্রুপ। তারা তাদের শ্রমিকদের জন্য মাঠের উত্তর পাশে একটি দোতলা ভবনও বানিয়েছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে আড়াই বছর আগে মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে পানির পাম্প বসিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে অবৈধ কার্যালয় করেছে যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কমিটি।

গত ২৬ অক্টোবর উড়ালসড়কটি উদ্বোধনের পর মাঠ থেকে মালামাল সরিয়ে নিয়েছে তমা গ্রুপ। কিন্তু তাদের করা দোতলা ভবনটি নিজেদের ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যুবলীগের কার্যালয়টি অপসারণ করা হয়নি।

সিদ্ধেশ্বরী রোডের বাসিন্দা আহমেদ সবুর ও শওকত আলী বলেন, মাঠটিকে তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। না হলে মাঠটি একসময় অস্তিত্ব হারাবে। একাধিক বাসিন্দা অভিযোগ করেন, প্রায় প্রতিরাতে ওই কার্যালয়ে আড্ডা বসে। আছে মাদক সেবনের অভিযোগও।

জানতে চাইলে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি সেলিমুজ্জান রেজা বলেন, ওই কার্যালয়টি দলের নয়। কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. মাকসুদ এটি তৈরি করেছেন। তিনি তাঁর পক্ষের নেতা-কর্মীদের নিয়ে সেখানে বসেন।

মাকসুদও স্বীকার করেছেন তিনি এটা ব্যক্তিগত অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে তাঁর দাবি, স্কুলের সাবেক সভাপতি তপন চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে এটা করা হয়েছে। এ জন্য স্কুলকে মাসে এক হাজার টাকা ভাড়া দেওয়া হয়।

সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) শেখ ফরিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী স্কুল কর্তৃপক্ষ কাউকে জমি ইজারা দিতে পারে না, দেয়ওনি। তিনি বলেন, মাঠটি সংস্কার ও দেখভালের দায়িত্ব বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি কামরুজ্জামানের। তাই মাঠের ভেতর যুবলীগের কার্যালয় থাকবে কি না, তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন।

  • Courtesy: Prothom Alo Mar 19, 2018

প্রায় ৩৫ শতাংশ বন্দী মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট: আইজি প্রিজন



কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন বলেছেন, দেশের কারাগারে যত বন্দী আছে, তার ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

রোববার বেলা পৌনে ১১টার দিকে কারা সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন আইজি প্রিজন। কারা সপ্তাহ ২০১৮ উপলক্ষে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সৈয়দ ইফতেখার জানান, বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে গড়ে ৭৫ হাজার বন্দী আছে।

আইজি প্রিজন বলেন, অভিনব কায়দায় কারাগারে মাদক ঢুকছে। কেউ গিলে মাদক আনছে। শুকনা মরিচের ভেতরে করে আনছে। কেউ আনছে পেঁয়াজের ভেতরে করে।

সৈয়দ ইফতেখার বলেন, ‘আমাদেরও অনেক ভুল-ত্রুটি আছে। কারারক্ষীর সংখ্যাও কম।’

আইজি প্রিজন জানান, গত এক বছরে কমপক্ষে ২০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

কারা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় তথ্য দেয় না বলে অভিযোগ করেন সাংবাদিকেরা। জবাবে আইজি প্রিজন বলেন, কী ধরনের তথ্য চাওয়া হচ্ছে, সেটাও বিষয়।

  • Courtesy: Prothom Alo mar 19, 2018

Sunday, March 18, 2018

মানুষ ভালো আছে!

গোলাম মোর্তোজা


চারিদিকে ‘উন্নয়ন’র নানা গল্প! দৃশ্যমান প্রমাণ পদ্মা সেতু, দু’তিনটি চার লেনের রাস্তা, কয়েকটি ফ্লাইওভার। মানুষ ভালো আছে, আয় বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও কিনতে মানুষের সমস্যা হচ্ছে না! বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার হয়েছে, বিচার হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে! বেশকিছু উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা বেড়েছে।

ক্ষমতাসীনদের মুখ থেকে একথা প্রতিদিন কয়েকবার শোনা যায়। তারা টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, বলেন রাজনৈতিক সমাবেশে। টেলিভিশনের টকশোতেও শোনা যায় প্রতিরাতে।

এই কথাগুলো যে পুরোপুরি অসত্য, তা তো নয়। আবার বাস্তবতা যদি এমন হয়, তাহলে দেশের মানুষের তো খুশি থাকার কথা। যদি বলি যে দেশের মানুষ খুশি বা ভালো নেই, তীব্র প্রতিবাদ হবে এ কথার। যুক্তি দেওয়া হবে পাল্টা যুক্তিও দেওয়া যাবে। সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। সাধারণ মানুষের কথা যদি একটু কান পেতে শোনা যায়, তবে ক্ষমতাসীনদের বক্তব্যের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। এর কারণ কী? মানুষ কী যত পায়, তত চায়? না কি ‘ভালো আছে’ বলতে যা বোঝানো হয়, তার ভেতরে ত্রুটি বা দুর্বলতা আছে? সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে দেখি।

১. আলোচনার শুরুতেই সরকারি পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের ‘খানা আয় ব্যয় জরিপ’র প্রাথমিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় গড়ে বেড়েছে ৩২ হাজার ৪৪১ টাকা। আর সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় গড়ে কমেছে ১০৫৮ টাকা।

এই গরিব মানুষ মানে দিনমজুর শ্রেণি। ক্ষমতাসীনরা সর্বত্র বলেন, শ্রমের মজুরি বেড়েছে, ১৫০ টাকার মজুরি ৪০০ টাকা হয়েছে। মানুষ ভালো আছে, গরিব মানুষ বেশি ভালো আছে। তাই যদি হয় তাহলে সরকারি হিসাবে ৫ শতাংশ গরিব মানুষের আয় কমে গেল কেন? এই জরিপ তো বেসামরিক কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান করেনি। তার মানে মানুষের ভালো থাকার যে গল্প করা হচ্ছে, তা আসলে পুরোপুরি সত্যি নয়। গল্পের ভেতরে বড় রকমের সমস্যা আছে।

২. ঢাকা শহরের রাস্তায় নামেন। যে কোনো একজন মানুষের কাছে জানতে চান, কেমন আছেন? প্রায় ৯৯ ভাগ নিশ্চিত হয়ে বলা যায় বলবেন, ভালো নেই?

বলতেই পারেন এটা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। হ্যাঁ মানুষ অধিকাংশ ‘ভালো নেই’ বলতে অভ্যস্ত। কিন্তু ‘ভালো থেকে’ও ভালো নেই বলবে, এতটা সরলিকরণ নয় বিষয়টি।

৪৭ বছরের বাংলাদেশে রাজধানীর মানুষের জন্যেও গণপরিবহন নেই। মানুষ কীভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবে, কোনো সরকার তা ভাবল না। একদিকে সাধারণ মানুষের পরিবহন নেই, অন্যদিকে যানজট এমন একটা অবস্থায় পৌঁছালো যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকতে হয় সব মানুষকে।

একথার সঙ্গে সঙ্গেই বলা হবে, যানজট একদিনে তৈরি হয়নি। সমাধানও একদিনে হবে না। কাজ চলছে, সমাধান হবে।

৩. কাজ বলতে, নগর ঢাকায় ফ্লাইওভার তৈরি হলেই, যানজট সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ফ্লাইওভার বেশ কয়েকটি তৈরি হলো। ঢাকা শহরের যানজট সমস্যার সমাধান হলো না।

ফ্লাইওভারের ফলে এক জায়গার যানজট আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হলো।

তারপর বলা হলো, মেট্রোরেল তৈরি হলেই যানজট, সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মেট্রোরেল তৈরি হচ্ছে। নিশ্চয় মেট্রোরেলের কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। যানজট সমস্যার কী সমাধান হবে? মেট্রোরেল চালু হলে, উত্তরা থেকে খুব সহজে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত চলে আসা যাবে। কিন্তু যানজট সমস্যার সমাধান হবে না। নিচে দিয়ে গাড়ি-রিকশা-বাসের যানজট থাকবেই। মেট্রোরেল সারা শহরে বিস্তৃত করার সুযোগ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে। 

আর ফ্লাইওভার নির্মাণের সঙ্গে মানুষের ভালো থাকার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।

ফ্লাইওভার দেখে আনন্দিত হন যাদের গাড়ি আছে তারা। ঢাকা শহরে এমন মানুষের সংখ্যা ৯ শতাংশের বেশি নয়।

৪. গ্রামের কৃষকের কাছে গিয়ে জানতে চান, কেমন আছেন?
উত্তর পাবেন, ভালো নেই। না, এত সরাসরি তিনি উত্তর দেবেন না। আলুচাষি বলবেন, উৎপাদন তো খুব ভালো হয়েছে। দাম তো পেলাম না। লোকসান দিতে হলো। টমেটো চাষি বলবেন, গতবার তো ভালোই দাম পেয়েছিলাম। এবার তো পুরাই লোকসান। ব্যাংকের ঋণ শোধ করব কীভাবে? ধান চাষি কৃষক হাহাকার করছেন, খরচের সমান দাম না পেয়ে। ভালো আছেন মূলত দেশের কিছু অঞ্চলের সবজি ও ফল চাষিরা। কিন্তু এটা তো সমগ্র বাংলাদেশের খুব কমসংখ্যক চাষি। বৃহত্তর অংশই তো ভালো নেই।

গ্রামের দিনমজুরদের মজুরি বেড়েছে, তাও সত্য। শুভঙ্করের ফাঁকি হলো, গ্রামে সারাবছর কাজ থাকে না। বছরের তিন চার মাস কাজ ছাড়া থাকতে হয়। ফসলের মৌসুমে কাজের লোক পাওয়া যায় না। মৌসুম শেষে লোক থাকে, কাজ থাকে না।
গ্রামে কাজ না পেয়ে, শহরে বা ঢাকায় আসার প্রবণতা শুধু বাড়ছেই, কমছে না। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে যিনি রিকশা চালান, তার আয় বেড়েছে- ব্যয় বেড়েছে তার চেয়েও বেশি।

৫. গ্রামের যে কৃষক অনেক কষ্ট করে সন্তানকে পড়াশোনা করিয়েছেন। চাকরির জন্যে তাকে ১০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। জমি বিক্রি করে তিনি ঘুষ দেন।

ইয়াবাসহ মাদক গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেছে। দেখার বা ব্যবস্থা নেয়ার কেউ নেই। যারা দেখবেন বা ব্যবস্থা নেবেন তারাই মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক। সাধারণ মানুষের ভালো না থাকার এটা খুব বড় একটা কারণ। যারা ইয়াবার হাজার হাজার কোটি টাকার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে, তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ‘মাদকবিরোধী সপ্তাহ’ পালন করার দৃশ্য টেলিভিশনে দেখেন সাধারণ মানুষ।

৬. তাহলে কেউ কি ভালো নেই? না, কেউ কেউ ভালো আছেন। যারা ফ্লাইওভার তৈরি করছেন, তারা ভালো আছেন। ৩০০ কোটি টাকার বাজেটে কাজ শুরু করে, তা ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় শেষ করছেন। যারা ৪ লেনের রাস্তা নির্মাণের কাজ পেয়েছেন, তারা ভালো আছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে সবচেয়ে নিম্ন মানের রাস্তা নির্মাণ করছেন। রাজধানীর ভালো ফুটপাত, ভালো রোড ডিভাইডার ভেঙে নতুন করে গড়ার কাজ যারা পেয়েছেন, তারা ভালো আছেন।

আর ভালো আছেন ব্যাংক থেকে যারা লোন নিয়েছেন এবং যারা দিয়েছেন। শেখ আবদুল হাই বাচ্চুরা ভালো আছেন, তারা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যাংক থেকে জনগণের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে নিয়েছেন। সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা যারা নিয়েছেন, তারা ভালো আছেন। একজন তানভীর জেলে থাকলেও, সুবিধাভোগী সবাই নিরাপদেই আছেন। একদা গাড়ি চোর ইউনুছ বাদল সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ভালো আছেন। ১০০ কোটি টাকা মসজিদ নির্মাণের জন্যে দিয়ে পরকালেও ভালো থাকা নিশ্চিত করছেন। 

তারা ভালো আছেন যারা প্রতি বছর নিয়ম করে লক্ষাধিক কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন। যারা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা বা মালয়েশিয়া চলে যাওয়া নিশ্চিত করে রেখেছেন।
তারা ভালো আছেন যারা তৃতীয় বিশ্বের টাকায়, প্রথম বিশ্বে থেকে প্রথম শ্রেণির জীবনযাপন করেন।

৭. কাগজের হিসাবে বাংলাদেশ নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হয়েছে। এখন উন্নয়নশীল দেশ হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিজন মানুষের ঋণ ৪৬ হাজার টাকা। বিদেশ থেকে আনা ঋণে কিছু অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। ‘উন্নয়ন’র জন্যে অবকাঠামো নির্মাণ খুব জরুরি। এসব অবকাঠামো যদি একটা বড় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সঠিক ব্যয়ে নির্মিত হতো, নিশ্চয় তা ভালো ব্যাপার হতো। প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ৫ বা ১০ গুণ বেশি ব্যয়ে নির্মিত এসব অবকাঠামো শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষের ভাগ্য বদলে কতটা ভূমিকা রাখবে, বড় প্রশ্ন সেটা নিয়ে। মনে রাখতে হবে, অবকাঠামো নিজে উন্নয়ন নয়, উন্নয়নের সহায়ক। নির্মিত হচ্ছে ঋণের টাকায়। সে ঋণ সুদসহ শোধ করতে হবে। এখন যে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তা শোধ করা শুরু হবে ১০ বা ১৫ বছর পর থেকে। অবকাঠামো যদি পরিকল্পিত না হয়, কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হবে না। কিন্তু ঋণ শোধ করতে হবে। সমস্যাটা তৈরি হবে তখন। এখন প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ, জনগণের নামে ঋণের অর্থ আছে, হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে। একই ফর্মুলায় বিপদে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশ কাগজে ‘উন্নয়নশীল’ দেশ হলেও, তা ধরে রাখার জন্যে, টেকসই করার জন্যে যে পরিকল্পনা তার খুব বড় রকমের অনুপস্থিতি দৃশ্যমান। 

বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি। যা ছিল তাও ধ্বংসের পথে। শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও, টেকসই পথে এগোয়নি বিদ্যুৎ খাত। চুরির উৎসব চলছে। কৃষক ঠিকমতো ঋণ পায় না, ক্ষমতার কাছের ঋণখেলাপি ধনীর তালিকায় নাম লেখায়। কৃষকের ঋণ মাফ হয় না, এসব খেলাপিদের হাজার হাজার কোটি টাকা মাফ করে দেয়া হয়। ফলে মানুষের ভালো থাকার গল্পের পাশাপাশি, খুব বড় রকমের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ।


  •  SHAPTAHIK/Editor : Golam Mortoza

EU wants probe into disappearance, extrajudicial killings



Shakhawat Hossain

Expressing its grave concern over the incident of enforced disappearances and extrajudicial killings, the Council of the European Union has called on Bangladesh and a few other countries to effectively investigate the incidents in an impartial and transparent manner.

The council approved conclusions on EU priorities in United Nations Human Rights Fora 2018 at a meeting in Brussels on February 26, according to a release posted on its website.

According to the conclusions, the European Union called on all states to ensure that ensure appropriate prosecution of those responsible for enforced disappearances and extrajudicial killings.

It also expresses concerns over such cases notably in Bangladesh, Libya, Syria, Myanmar, Crimea Sevastopol, Russian Federation, the Philippines, Pakistan, Burundi and Venezuela.

The union will continue to be engaged in the fight against torture and other
cruel, inhuman or degrading treatment or punishment, in particular when used by law enforcement personnel and security forces, resolved the council.

‘The EU will continue in all its external relations to promote respect for diversity by protecting and promoting human rights of persons belonging to national minorities, including already acquired rights, in accordance with applicable UN and Council of Europe norms and standards,’ it stated.

Asked on Wednesday, home minister Asaduzzman Khan declined to comment on the issue. 

Law minister Anisul Huq could not be reached despite repeated attempts. In several occasions, he, however, expressed concerns about the incidents of enforced disappearance and extrajudicial killing, but advised journalists to highlight the country’s role in sheltering a large number of Rohingyas in Bangladesh.

Even on Human Rights Day in 2017, the law minister had declared that the government was investigating reported incidents of enforced disappearance and extrajudicial killings. 

By mid-December 2017, the law minister publicly announced that he would follow up the cases.
The National Human Rights Commission has, however, claimed that over 150 cases remained unresolved over the years while its chairman Kazi Reazul Hoque said that many reports came to them without identification of the suspects.

According to rights organisation Odhikar, at least 408 people were subjected to enforced disappearance between January 2009 and November 2017. On December 4, 2017, former diplomat Muhammed Maroof Zaman, who served Qatar and Vietnam as ambassador from Bangladesh, went missing when he was going to Hazrat Shahjalal International Airport to pick his daughter. His whereabouts is still unknown. 

- Shakhawat Hossain is Dhaka-based freelance journalist. 

  • http://weeklyholiday.net 



উন্নয়নের ধারাবাহিকতা না ক্ষমতায় কালনিরবধি?

মো: মতিউর রহমান


বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থেকেই একাদশ সংসদ নির্বাচন তথা জাতীয় নির্বাচন করবে বলে মনে হয়। আমাদের দেশে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কোনো দল বা জোট পরপর দুইবার ক্ষমতায় যেতে পারে না। এর কারণ হলো এক দিকে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি তথা লুটপাট, দলীয় ও অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মাস্তানি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি, অন্য দিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া, মামলা-মোকদ্দমা ও জেল-জুলুমে হয়রানি এবং শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও নেতাকর্মীদের ধরাপাকড়, দমন-পীড়ন করা।

উল্লেখ্য, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জঙ্গিবাদের হুমকিকে রাজনীতিকীকরণ করেছে। এর সুযোগ নিয়ে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা এখনো যেন জরুরি অবস্থায় আটকে আছেন। এ কারণে জনগণ ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং সুযোগ পেলে বা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটায়। এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা সহায়ক যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এ ধরনের সরকারের দরকার নেই বলে বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা মনে করেন। আর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার সংবিধানকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির এ দাবিকে অসাংবিধানিক রূপ আখ্যা দিয়ে তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠে আর জায়গা নেই বলে অন্যদের উঠতে নিষেধ করার মতো। 

জাতি হিসেবে আমরা বিস্মৃতিপ্রবণ হলেও জনগণ এত দ্রুত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুর আন্দোলনের কথা ভুলে যায়নি। সেই আন্দোলনে জনজীবনের চরম নৈরাজ্য নেমে এসেছিল। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পুরো দেশকে অচল করে দিয়েছিল। এমনকি বাসে আগুন দিয়ে মানুষমারা হয়েছিল। আর আন্দোলনের অংশ ও কৌশল হিসেবে কথিত জনতার মঞ্চ এক দিকে যানবাহন চলাচলে স্থবিরতা সৃষ্টি করেছিল, অন্য দিকে সৃষ্টি করেছিল প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা। 

প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী এ ধরনের কার্যক্রমে যোগদান করতে পারে না। এমন হঠকারী কাজ একটা নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তুল্য এবং সেই কারণে দেশদ্রোহিতার শামিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করা ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ে পড়ে না। জনতার মঞ্চ ছিল একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীদের মঞ্চ। অন্য দিকে, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ ছিল জাতির ভাষাগত ও জাতিগত অস্তিত্বের লড়াই।

ভাবতে অবাক লাগে যে, সেই আওয়ামী লীগ এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামগন্ধও সহ্য করতে পারছে না। তারা ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘দানব’ বলে প্রচার করেছে। আর এখন সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে। কিন্তু ১৯৯৬ সালেও তো দেশের সংবিধান ছিল। সংবিধানের জন্য জনগণ নয়, জনগণের জন্যই সংবিধান।

অতীতে প্রয়োজনে একাধিকবার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কেননা, সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় যে, চিরদিন অপরিবর্তনীয়। আর ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল ব্যতিক্রমধর্মী সরকার। সেনাসমর্থিত ওই সরকার তৎকালীন সেনাপ্রধানের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে জনতুষ্টিমূলক এমন কতকগুলো কাজ হাতে নেয়, যা ছিল তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত এবং সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর স্পিরিটের পরিপন্থী। তাদের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ছিল মূলত আইওয়াশ। এর আবরণে তারা নিজেদের পদ ও পদমর্যাদা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি আখের গুছিয়ে নেন। এ কারণে মইন ইউ আহমেদের পক্ষে বছরের পর বছর বিদেশে আয়েশি জীবনযাপন এবং আরেকজন জেনারেলের পক্ষে পাঁচ তারকা হোটেল তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে অন্যদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াও শিকার হন। অবশ্য শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি দৃশ্যত তীব্র উষ্মা প্রকাশ করলেও তিনি কিন্তু এক-এগারোর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রত্যক্ষ বেনিফিশিয়ারি। 

এ ক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্ন ও বিস্ময় রয়েছে। তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মইন ইউ আহমেদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন না কেন? মইন ইউ আহমেদকে বিদেশ যেতে দিলেন কেন এবং লে. জেনারেল মাসুদউদ্দীন চৌধুরীকে দীর্ঘদিনের জন্য অস্ট্র্রেলিয়ায় হাইকমিশনার করে পাঠালেন কেন? এটা একধরনের দ্বিচারিতা। প্রতিপক্ষ অভিযোগ করেছে, ভারতের মধ্যস্থতায় সেনাপতিদের সাথে আপস করেই নাকি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আরূঢ় হয়েছিল। 

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য অতীতের সব তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মন্দ বলা যাবে না। এক-এগারোর আগের সব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। উচ্চ আদালত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।

সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ) সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি উচ্চ আদালতের মতের অনুরূপ সুপারিশ করলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তা পাল্টে যায় এবং তার অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। ক্ষমতায় থেকে এবং সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করার অতীত অভিজ্ঞতা মোটেও শুভ হয়নি। আর আওয়ামী লীগের অধীনে অতীতে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হতে পারেনি। এর ব্যতিক্রম ছিল ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিএনপি সব ক’টিতে জয়ী হয়। সুতরাং অংশগ্রহণমূলক হওয়াই শুধু অন্বিষ্ট নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়াও জরুরি। 

ক্ষমতাসীন দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আগে ‘দানব’ বললেও হালআমলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার লক্ষ্যে মহাসড়কে ওঠা ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতা’ বজায় রাখা ধুয়া তুলেছেন। ভাবখানা এমন যে, উন্নয়নে শুধু তাদের দলেরই পারঙ্গমতা আছে, অন্য কোনো দলের নেই। এর মধ্যে একটা অহঙ্কার এবং আত্মম্ভরিতার ভাব ফুটে ওঠে। কিন্তু এ কথাও অনস্বীকার্য, এ দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অতীতে ক্ষমতায় ছিল এমন সব দলেরই অবদান আছে। উন্নয়ন কারো একচেটিয়া অধিকার ও পারঙ্গমতার বিষয় হতে পারে না। যদি তাই হয়, তাহলে তো বর্তমান সরকারের দৃঢ়োক্তি (না দম্ভোক্তি?) অনুযায়ী তাদের কালনিরবধি ক্ষমতায় রাখতে ও থাকতে হয়। সে ক্ষেত্রে তো ভোটারবিহীন নির্বাচন কিংবা ক্ষমতা জবরদখল বৈধ হয়ে যেতে পারে গুরুত্বহীন। সে অবস্থায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোট ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল গুরুত্বহীন ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, উন্নয়ন বলতে শুধু নির্মাণ কাজ বা বস্তুগত উন্নয়নকে বোঝায় না। গণতন্ত্র তথা আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং কর্তৃত্ববাদী তথা একচেটিয়া শাসনের মনোভাব থাকলে এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ ও মুক্ত গণমাধ্যম না থাকলে রাষ্ট্রের সার্বিক ও প্রকৃত উন্নয়ন হয় না। ভৌত উন্নয়নের সাথে গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও উন্নয়ন একান্ত আবশ্যক। অন্যথায় অন্যসব উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। গণতন্ত্রের উন্নয়ন হলে এর অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও উন্নয়ন ঘটবে।

ক্ষমতাসীনদের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, ক্ষমতার মোহ তাদের ভালোই ধরেছে। আর এ কারণেই বিরোধী নেত্রীকে জেলে রেখে সরকারি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আগাম ভোট চাওয়া শুরু হয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকা সংবাদ শিরোনাম করেছেন খালেদা জিয়া কোর্টে, শেখ হাসিনা ভোটে। গণতন্ত্রের এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা হলো, অধিকারের সমতা যা বেপরোয়াভাবে হরণ করা হয়েছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, ‘ক্ষমতার গুরুতর অসাম্যের মধ্যে নিহিত থাকে অবিচার।’ গণতন্ত্র আজ রাহুগ্রস্ত। প্রশাসন ও পুলিশ দলীয় ব্যাধিগ্রস্ত, সুশাসন নির্বাসিত। আর নির্বাচন কমিশন নিয়ে সবাই সংশয়গ্রস্ত। নির্বাচনকে মাথায় রেখে সংসদ সদস্যদের ইচ্ছামাফিক প্রকল্প গ্রহণ করায় এবং নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া ও ভোটকেন্দ্রে সেনা মোতায়েনের দাবি উপেক্ষিত হওয়ায় বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে, এমন নির্বাচনের আশা সুদূরপরাহত বলে মনে হয়। 

  • লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
  • নয়াদিগন্ত/১৮-৩-১৮