অরূপ দত্ত
শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের প্রায় পৌনে সাত একর জায়গায় চলছে জাহাজ তৈরির ধুন্ধুমার যজ্ঞ। জায়গাটা ব্যবহারে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডকে অনুমোদন দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে ইজারা চুক্তির আগেই সেখানে সব ধরনের নির্মাণকাজ চলছে। নদীর পাড়ের আরেক অংশে গড়ে উঠেছে ভূমি কার্যালয়। এ ছাড়া কিছুদূর পরপরই ইট-বালু বিক্রিসহ বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে নদীর তীর।
গত ২৫ মার্চ সকাল থেকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় দিনভর প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে এ অবস্থা দেখা যায়। অথচ ২০০৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল, নদীর ঢাল থেকে দেড় শ মিটারের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি কোনো স্থাপনা বা ভরাট জায়গা থাকবে না। যেসব সরকারি ভবন আগে থেকেই তৈরি এবং জনস্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলো বহাল থাকতে পারে। তবে নতুন ভরাট ও নির্মাণ নিষিদ্ধ।
হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা জানা সত্ত্বেও মদনগঞ্জে মাহমুদনগর ট্রলার ঘাটের পাশে নদীর পাড়ে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডকে জাহাজ নির্মাণের অনুমোদন দেয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। নৌকাযোগে ঘুরে মদনগঞ্জ মাহমুদনগর ট্রলার ঘাট এলাকায় দেখা যায়, নদীর তীরে বিভিন্ন নৌযানের অংশ তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্য পড়ছে নদীতে। উপস্থিত একজন কর্মকর্তা মো. মহসীন জানান, নদীর পাড় ছাড়াও ভেতরে অন্তত ৩৩ একর জায়গায় নৌযান তৈরি হচ্ছে।
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করেন, এখানে আগে ‘আলিয়া’ ও ‘আল্লার দান’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠান ছোট লঞ্চ তৈরি করত। বিআইডব্লিউটিএ প্রতিষ্ঠান দুটিকে অনুমোদন দিয়েছিল। পরে আদালতের দোহাই দিয়ে তাদের তুলে দেওয়া হয়।
কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সকে অনুমোদন দেওয়া হলো কেন? জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ বন্দরের যুগ্ম পরিচালক গুলজার আলী বলেন, অনুমোদনের পরে তিনি এখানে বদলি হয়ে আসেন। তাই বিষয়টি তাঁর জানার কথা নয়। তবে কোনো অভিযোগ থাকলে তাঁরা দেখবেন।
নিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসনের সঙ্গে ইজারা চুক্তি (ডিড) চূড়ান্ত না হলে এ ধরনের ডকইয়ার্ড চালু করা যায় না। গত মাসেও এ চুক্তি হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ বলেন, আগেই চুক্তির সব আয়োজন শেষ হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে ১৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা জমাও দেওয়ার কাজ শেষ হয়েছিল। জেলা প্রশাসনের আনুষ্ঠানিকতায় একটু সময় গেছে।
তাহলে আগেই নির্মাণকাজ চলছে কেন? এ প্রশ্নে আবদুর রশিদ বলেন, নিয়মটা হচ্ছে, সরকারি জায়গা আগে দখলে নিতে হবে, তারপর ইজারা। তিনি দাবি করেন, তাঁদের ডকইয়ার্ডে নদীর জায়গা নেই। নদীর পাড়ে কিছু করতে হলে বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন লাগে, তাই তাদের অনুমোদন নিয়েছেন।
নদীর জায়গায় ভূমি কার্যালয়
শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে প্রায় নদীর মধ্যে দেয়ালঘেরা একটি স্থাপনা। নৌকায় চড়ে কাছাকাছি গিয়ে দেখা যায়, নদীর তীরের নিচু অংশ ভরাট করে সীমানাদেয়াল দেওয়া হয়েছে। তীরে উঠে দেখা যায়, প্রধান ফটকের পাশে দেয়ালে লেখা, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, বন্দর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়’। ভেতরে একটি বড় একতলা ভবন। সীমানাদেয়ালের পূর্ব পাশে ৩০ ফুট পাকা সড়ক।
বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক গুলজার আলী বলেন, নদী থেকে ওপরের এই সড়কটির দূরত্ব প্রায় আড়াই শ ফুট। ওই সড়ক পর্যন্ত নদীর সীমানা। সীমানার ভেতরেই এই ভূমি কার্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে।
ভেতরে গিয়ে পাওয়া গেল কার্যালয়ের প্রধান ব্যক্তি ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. ছায়েদ হোসেনকে। তিনি জানান, ১৫ শতাংশ জায়গা নিয়ে এই কার্যালয়।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনার বিষয়টি মনে করিয়ে দিলে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বলেন, এই জায়গা নদীর সীমানায় পড়েছে, নাকি এর বাইরে, তা তিনি জানেন না। তবে এখানে ভূমি কার্যালয় করার বিষয়ে অনেক আগেই ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পান তাঁরা।
বিআইডব্লিউটিএর একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যেকোনো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে বিআইডব্লিউটিএ ও জেলা প্রশাসন যৌথভাবে কাজ করে। তহশিল কার্যালয়টি জেলা প্রশাসনের অধীন হওয়ায় তাই উচ্ছেদ কর্মসূচি দেওয়া যাচ্ছে না।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক রাব্বি মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটি নদীর জায়গায় পড়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। তিনি বলেন, ভূমি অফিস বা জেলা প্রশাসন নিশ্চয়ই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
ডকইয়ার্ড ও ইট-বালুর ব্যবসা
বন্দর এলাকার ইসলামপুর, একরামপুর, মদনগঞ্জসহ নদীর তীরের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় কিছুদূর পরপর ডকইয়ার্ড। নতুন লঞ্চ, কার্গো তৈরি হচ্ছে, রং লাগানো হচ্ছে। সবই চলছে নদীর তীর ছাড়িয়ে পানির অংশে। বেশির ভাগেরই কোনো নাম নেই। টার্মিনালের বিপরীত দিকে বন্দর এলাকায় দেখা যায় সৈয়দ ডকইয়ার্ড, সাওদা ডকইয়ার্ড, মীর সাওদা ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স ওয়ার্কস। একরামপুরে রয়েছে সরকার ইঞ্জিনিয়ার্স ওয়ার্কস, আবুল হোসেন ডকইয়ার্ড, ইসলামপুরে সুন সিং শিপবিল্ডিং লি., মদনগঞ্জে নূর এ চান ডকইয়ার্ড, সরকার শিপ বিল্ডিং লিমিটেড, শেফা ডকইয়ার্ড ইত্যাদি। বেশির ভাগ ডকইয়ার্ডের উপস্থিত লোকজন দাবি করেন, বিআইডব্লিউটিএ থেকে তাঁরা অনুমোদন নিয়েছেন। তবে বিআইডব্লিউটিএ থেকে বলা হয়, কিছু ডকইয়ার্ডকে আগে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। কোনোটারই এখন মেয়াদ নেই।
বন্দর ভূমি কার্যালয়ের সীমানাদেয়ালের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে নদীর প্রায় ৪০০ মিটার জায়গাজুড়ে ইট ও বালুর স্তূপ। এগুলো এখান থেকেই বিক্রি হচ্ছে। উপস্থিত একজন লোক কাজে তদারকি করছিলেন। নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক আবদুর রহমান বলে পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, তাঁর ‘স্যার’ জায়গাটা ইট-বালু-সিমেন্ট-রড বিক্রির জন্য অনুমোদন নিয়েছেন। কিন্তু ‘স্যারের’ নাম বলতে তিনি রাজি হননি।
বিআইডব্লিউটিএর কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে ইট-বালু ব্যবসার জন্য একাধিক কোম্পানি আবেদন করলেও কাউকে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি।
শীতলক্ষ্যায় মাঝে মাঝে নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা টংঘর ও দোকানপাট উচ্ছেদে অভিযান হয়। কিন্তু নদীর বড় দখল বা বাণিজ্যিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটিএর অভিযান হয় না।
- Courtesy: Prothom Alo,/Apr 30, 2018