- মামলার এজাহারে একটি ভাঙচুর হওয়া লেগুনা জব্দের তথ্য।
- তবে গাড়িটি অক্ষত পড়ে আছে থানায়।
- পুলিশ বলছে, লেগুনা ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে।
- মালিক ও চালক বলছেন, কিছুই হয়নি।
- ১০৩ আসামির ৪৮ জন বিএনপি প্রার্থীর নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির সদস্য।
যে লেগুনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের অভিযোগে পুলিশ গাজীপুর বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দিয়েছে, সেটি অক্ষত অবস্থায় পড়ে রয়েছে টঙ্গী থানার প্রাঙ্গণে। আর মামলার আসামিদের অধিকাংশই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের নিকটাত্মীয় ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বশীল ব্যক্তি।
বিএনপি বলছে, তাদের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করতে পুলিশ এই মিথ্যা মামলা দিয়েছে। বেছে বেছে নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত নেতাদের আসামি করেছে, যাতে পরে নির্বাচন হলেও ফাঁকা মাঠের সুবিধা নিতে পারে সরকারি দল।
রোববার আদালতের নির্দেশে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হওয়ার দেড় ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ হাসান সরকারের বাড়ির আশপাশে অভিযান চালিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানসহ ১৩ জনকে আটক করে। ছয় ঘণ্টা পর নোমানকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকি ১২ জনসহ ১০৩ জনের নাম উল্লেখ করে পরদিন ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে টঙ্গী থানায় মামলা করে পুলিশ। এজাহারে অজ্ঞাতনামা আসামি আছে আরও এক শ থেকে দেড় শ জন। এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে ৪৮ জনই বিএনপির মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে আছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ইচ্ছা করেই পুলিশ এ ধরনের মামলা করে থাকে। আসামিদের হয়রানি করা হবে, টাকা আদায় করা হবে। পরে নির্বাচন হলেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের পালিয়ে থাকতে হবে। এই মামলায় যে ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়, সেটাও হাসান সরকারের বাড়ি থেকে কয়েক শ গজ দূরে ময়মনসিংহ মহাসড়কের স্টার হেভেন রেস্তোরাঁর সামনে। ঘটনার সময় বলা হয়, রোববার বিকেল সাড়ে ৪টা, আর মামলা দায়ের হয় সোমবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে। মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে একটি লেগুনা গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ-১১-৬০৮০), কাচের টুকরা ও ১০টি ইটের টুকরা। মামলায় বলা হয়, ঘটনাস্থল থেকে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আরও এক শ থেকে দেড় শ নেতা-কর্মী পুলিশ দেখে পালিয়ে যান। তাঁরা একটি লেগুনা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে আড়াই লাখ টাকার ক্ষতি করেছেন।
কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার বিকেল চারটায় মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা গাড়িটি অক্ষত অবস্থায় থানায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তাতে ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগেরও কোনো আলামত দেখা যায়নি। লেগুনার ভেতরে বসে ছিলেন গাড়িটির মালিক গাজীপুরের কামারিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আলামিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৬ মে (রোববার) বেলা পৌনে তিনটায় লেগুনাটি রিক্যুইজিশন করে পুলিশ। সাড়ে চারটার দিকে টঙ্গীর চেরাগ আলী এলাকা থেকে তিন-চারজনকে আটক করে ওই গাড়িতে তোলা হয়। থানার দিকে যাওয়ার পথে গাড়ি নষ্ট হওয়ায় পুলিশ অন্য গাড়ি নিয়ে চলে যায়। গাড়িটি ঠিক করে ফেরার পথে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে থানার সামনে থেকে আবার আটক করে গাড়িটি থানার ভেতরে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রথম আলোর কাছে একই বিবরণ দিয়েছেন গাড়িটির চালক রকিবও। গাড়িটিতে আগুন দেওয়া বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি বলে নিশ্চিত করেন তাঁরা দুজন।
মামলায় আসামিদের মধ্যে আছেন গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব কাজী ছাইয়েদুল আলম, বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির গণমাধ্যম কর্মকর্তা মাজহারুল আলম, গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ইজাদুর রহমান। আসামি করা হয়েছে বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের চার চাচাতো ভাই সালাহ উদ্দিন সরকার, পাপ্পু সরকার, নকিব উদ্দিন সরকার ও অপু সরকারকেও। সালাহ উদ্দিন সরকার টঙ্গী অঞ্চলের বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক। হাসান সরকারের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে মামুন সরকার, ফুফাতো ভাই টঙ্গী পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক বশির ও মামাতো ভাই নবীনও আসামি।
এ ছাড়া ৭ থেকে ১২ নম্বর ওয়ার্ড মিলিয়ে কোনাবাড়ী ইউনিটের দায়িত্বে থাকা ইদ্রিস সরকার, ১৯ থেকে ২৩ নম্বর ওয়ার্ড মিলিয়ে কাউনতিয়া ইউনিটের দায়িত্বে থাকা নাজিম উদ্দিন চেয়ারম্যান, ১৩ থেকে ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা সুরুজ, ২৩ থেকে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড মিলিয়ে গাছা ইউনিটের দায়িত্বে থাকা হাজি সামাদ ও ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা নাসির উদ্দিনকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডের একাধিক কাউন্সিলর, বিএনপির বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনকেও আসামি করা হয়েছে।
হাসান উদ্দিন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন স্থগিত হওয়ার খবর পেয়ে ওই দিন তাঁর বাড়ি ও কলেজগেট এলাকায় জড়ো হয়েছিলেন নেতা-কর্মীরা। কিন্তু কোনো ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, ‘আমাকে কর্মী-সমর্থকশূন্য করে খালি মাঠে নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে গণগ্রেপ্তার ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।’
এই মামলার বিষয়ে টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, কাউকে হয়রানির জন্য নয়, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই মামলা করা হয়েছে। থানা থেকে লেগুনাটি ছাড়িয়ে নিতে তার মালিক মিথ্যা কথা বলছেন।
মামলার এজাহারে তথ্যের গরমিল আছে। সালাহ উদ্দিন সরকার ও তাঁর ভাতিজা মামুন সরকারকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের দুজনের পিতার নাম একই লেখা হয়েছে। আসামির তালিকায় আছেন কাশিমপুর এলাকার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শওকত হোসেন সরকার। আসামির তালিকায় আছেন ‘মিসেস শওকত’ নামে একজন। যদিও শওকত হোসেনের স্ত্রী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় বিএনপির নেতারা। সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ফজলুল হক মুসল্লি, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হান্নান মিয়া, কাউন্সিলর সবদের হাসান ও সফি উদ্দিন, হেফাজতে ইসলামের মুফতি নাসির উদ্দিন, মুফতি মাসুদ, কোনাবাড়ী নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ইদ্রিস আলীসহ টঙ্গী ও গাজীপুরের কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী এবং বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও আছেন আসামির তালিকায়।
গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বিএনপির জনসমর্থন দেখে হতভম্ব ও ভীত হয়ে পড়েছে।
সিটি নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পর হতাশ ভোটার ও প্রার্থীরা। আর হতাশার পাশাপাশি আতঙ্ক যোগ হয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে। আটক হওয়ার ভয়ে আছেন অনেকে। গাজীপুরের ভোটারদের মধ্যেও মামলাটি এখন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে বহু বছর ধরেই বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ হচ্ছে। বিভিন্ন সময় হাইকোর্টের রায়েও এটি প্রতিফলিত হয়েছে। রাজনীতির মাঠে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ নিঃসন্দেহে আইনটির নগ্নতা প্রদর্শন ও অপব্যবহার।’ তিনি বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা এ ধরনের মামলাকে নির্বাচনে পরাজয় ঠেকানোর কৌশল হিসেবে দেখতে পারে জনগণ।
- ProthomAlo/09 may 2018