Search

Monday, July 9, 2018

পরিকল্পিত পরিবার মানবাধিকারের অংশ

পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি আরও সফলভাবে কার্যকর করতে হলে সেবাগ্রহীতাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পিত পরিবার মানবাধিকারের অংশ। দম্পতিদের কাছে মানসম্পন্ন সেবা সহজলভ্য করে তুলতে হবে। সেবার ক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে।

গত শনিবার রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘পরিবার পরিকল্পনা: সুরক্ষিত মানবাধিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা এসব মতামত দেন। প্রথম আলোএই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ), গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা ও আরটিএম ইন্টারন্যাশনাল এই আয়োজনে সহায়তা করে।

১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। দিনটি সামনে রেখে এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, একাধিক সাংসদ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি, অভিনেত্রীসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য অনেক। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহারের হার ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬২ শতাংশ হয়েছে। ১৯৭২ সালে দম্পতিপ্রতি সন্তান ছিল ৬ দশমিক ২ জন। এখন তা কমে হয়েছে ২ দশমিক ৩ জন। এসব উপাত্ত উল্লেখ করে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঋণাত্মক পর্যায়ে নিতে চাই না। এ ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত আছে। চীন তাদের জনসংখ্যা নীতি থেকে সরে এসে এখন দুই সন্তানের ওপর জোর দিচ্ছে।’

সাংসদ ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি বলেন, কোনো দম্পতি কত সন্তান কখন নেবেন, এ ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন ধরনের পদ্ধতি তাঁরা বেছে নেবেন, সেই স্বাধীনতা দম্পতির থাকতে হবে। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুত যেন শেষ না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি।

সাংসদ বেগম ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সফল করার জন্য সঠিক তথ্য-উপাত্তের বিকল্প নেই। বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের তথ্য-উপাত্ত আলাদা করে থাকা প্রয়োজন। চট্টগ্রাম ও সিলেট এলাকা পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এসব অঞ্চলের জন্য পৃথক কর্মসূচি নিতে হবে।

মূল বক্তব্য উপস্থাপনের সময় ইউএনএফপিএর টেকনিক্যাল কর্মকর্তা আবু সাইদ হাসান বলেন, বাংলাদেশের জনঘনত্ব বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ কর্মক্ষম হচ্ছেন। কিন্তু কর্মসংস্থান হচ্ছে ১২ লাখ মানুষের। বছরে ৫৮ লাখ নারী গর্ভধারণ করেন। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ। এতে গর্ভপাত যেমন বাড়ছে, আবার গর্ভপাতজনিত কারণে মাতৃমৃত্যুও বাড়ছে। তিনি বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সবার জন্য সহজলভ্য হলে ৪০ শতাংশ গর্ভপাত এড়ানো সম্ভব হবে। জোর করা যাবে না, তবে যাঁর সেবা প্রয়োজন তিনি যেন প্রয়োজনের সময় তা পান।

ইউএনএফপিএর ঢাকা কার্যালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সাথিয়া দোরাইস্বামী বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিকার’ বা ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এসব স্লোগানের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা সেবা এখন যুক্ত হয়েছে। এই সেবাকেও এখন অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, মানুষ যেভাবে সেবা চায়, যে পদ্ধতি গ্রহণ করতে চায়, তাকে তা-ই দিতে হবে। চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আগের মাঠকর্মী দিয়ে ২০১৮ সালের মাঠের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।

সরকারের কর্মকাণ্ডের বিবরণ দেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার। তিনি বলেন, দেশে খাবার বড়ি ও কনডমের ব্যবহার বেশি। জন্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুতে কোনো সংকট নেই। মাঠে জনবলের সংকট দূর করতে আট হাজার কর্মী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

অভিনেত্রী মৌসুমী বলেন, বুঝে না-বুঝে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা নানা অঘটনের শিকার হয়। কম বয়সী মেয়ে যখন দুই-তিন সন্তানের মা হয়ে যায়, তখন সে অসহায় হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক বড়। কোটি কোটি মানুষের সামনে পরিবার পরিকল্পনা ও মানবাধিকারের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে।

অধিকারের বিষয়টি ব্যাখ্যা করার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান মো. আমিনুল হক বলেন, ‘আমি আমার পরিবার নিয়ে যে পরিকল্পনা করি—কখন সন্তান নেব, কীভাবে তাকে বড় করে তুলব, কোথায় তার শিক্ষা হবে—নিজের এই পরিকল্পনা যদি দেশের সব মানুষের জন্য করি, তাহলেই কর্মসূচি সফল হবে।’ তিনি বলেন, অনেক মানুষ এখন সচেতন। পিছিয়ে পড়া বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ১০০ ভাগ দম্পতির কাছে এই সেবা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

তিন ঘণ্টার এই গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর উপদেষ্টা গওহার নঈম ওয়ারা।

গোলটেবিলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (আইইএম) আশরাফুন্নেসা বলেন, জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। দেশের কিশোরী মায়েদের সংখ্যা যেমন কমানো দরকার, পাশাপাশি এদের জন্য পরিকল্পনা থাকা দরকার।

দেশে আইইউডি ও ইমপ্লান্ট সরবরাহে কিছু সমস্যা আছে উল্লেখ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এফপি ২০২০-এর ফোকাল পারসন আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এই দুটি সামগ্রী বিদেশ থেকে আনতে হয়। এর সরবরাহের ব্যাপারে সরকারের আরও মনোযোগী হতে হবে।

অনুষ্ঠানে ঢাকা নার্সিং কলেজের দুজন ছাত্রী অংশ নেন। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী আসমা আকতার বলেন, পরিবার পরিকল্পনা মানে শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ নয়। মানুষকে বোঝাতে বা পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে মিডওয়াইফরা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেরাকের সহযোগী কর্মসূচি ব্যবস্থাপক তাসনিয়া আহমেদ বলেন, কর্মসূচি সফল করতে হলে পুরুষদের অংশগ্রহণ সমানভাবে জরুরি। 

অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মাসুমা বিল্লাহ বলেন, আর্থসামাজিক কারণে এখনো বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বেশি বয়সে বিয়ে হলে যৌতুকও বেশি দিতে হয়। বিয়ে হওয়া কিশোরীরা প্রসব-পূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী সেবাও কম পায়।

  • Courtesy: Prothom Alo /Jul 08, 2018

Sunday, July 8, 2018

‘হাতুড়ির নিচে জীবন’

গোলাম মোর্তোজা




কবি বা কবিতা নিয়ে কথা বলার সময় নয় এটা। আবার কবির কবিতাই তো সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ। এরশাদের সামরিক নিপীড়নের কালে কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’। মাত্র তিন শব্দের বাক্য দিয়ে কবি যা বুঝিয়েছেন, লক্ষ শব্দ লিখেও তা বোঝানো কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা কবিতার প্রাসঙ্গিকতা। যখনই লেখা হোক, বহু বছর বা যুগ পরেও তা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বারবার।

চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গেও পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’।

কোটা সংস্কার বিষয়ে বহুদিন ধরে কিছু তর্ক চলছে। কিছু প্রশ্ন সামনে আনা হচ্ছে। আজকের লেখায় সেই সব সাধারণ কিছু প্রসঙ্গ- প্রশ্ন বিষয়ে দু’একটি কথা দিয়ে শুরু করি।

১. ‘কোটা বাতিল করা যাবে না। আমি কোটার পক্ষে। কোটা থাকতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যে কোটা থাকতে হবে’- একথা বলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমালোচনা করছেন কেউ কেউ।

প্রথমত, সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে। কোটা সংস্কারের দাবিকে যৌক্তিক মনে করার অধিকার যেমন আছে, অযৌক্তিক মনে করারও অধিকার আছে।

দ্বিতীয়ত, কোটা থাকবে না, বাতিল করতে হবে- এ কথা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতরা কখনো বলেননি। যৌক্তিক শতাংশে কোটা থাকার কথাই তারা সব সময় বলে এসেছেন। কোটা বাতিলের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী কোটা থাকার কথাও তিনি বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সংসদে এবং সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য যদি কার্যকর হয়, তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নারী কোটা, জেলা কোটা থাকবে না।

সুতরাং যারা বলছেন ‘কোটা থাকতে হবে, বাতিল করা যাবে না’- তাদের দাবি করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আন্দোলনকারীদের অবস্থান আর আপনাদের অবস্থানে কোনো পার্থক্য নেই, নেই সমালোচনারও কিছু।

২. ‘ যারা আন্দোলন করছেন, তারাই শুধু মেধাবী? যারা কোটায় চাকরি পাচ্ছেন, তারা কি মেধাবী নয়? তারাও তো বিসিএসে প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই চাকরি পাচ্ছেন। সুতরাং তারাও মেধাবী।’

প্রথমত, বিতর্কটা কে মেধাবী, কে মেধাবী নয়- তা নিয়ে নয়। যিনি কোটায় চাকরি পাচ্ছেন তিনি মেধাবী নন, সে কথাও কেউ বলছেন না। মেধার ভিত্তিতে চাকরি আর মেধাবী, এই দুটি বিষয় সচেতন বা অসচেতনভাবে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যারা উত্তীর্ণ হবেন, তাদের ভেতর থেকে মেধার ভিত্তিতে চাকরি নিশ্চিত করা হোক। একথা সত্যি যে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন সবাই (কোটা সুবিধা প্রাপ্তরাও) । পাশাপাশি আরও বড় সত্যি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একজন হয়তো ৩০০তম হয়ে চাকরি পাচ্ছেন না। আর কোটা প্রাপ্তজন হয়তো ৭০০তম হয়ে চাকরি পাচ্ছেন। শুধু বিসিএস পরীক্ষায় ৫৬ শতাংশ চাকরি হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায়। এখানেই ‘মেধার ভিত্তিতে’ প্রসঙ্গ আসছে। কোটা প্রাপ্তজন মেধাবী নন, সেটা বলা হচ্ছে না। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ৩০০তম জন অবশ্যই ৭০০তম জনের তুলনায় মেধাবী এবং চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে তারই অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। যেহেতু সেটা ঘটছে না, সেহেতু দাবি তোলা হয়েছে ৫৬ শতাংশ নয়, কোটা ১০ বা ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক। এতে বৈষম্য কমে আসবে। আরও একটি তথ্য সবার জানা থাকা দরকার, ৫৬ শতাংশ কোটা শুধু বিসিএসের ক্ষেত্রে। অন্যান্য ক্ষেত্রে কোটা অনেক বেশি। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নন ক্যাডার চাকরিতে কোটা ৬১ শতাংশ। ৭০ শতাংশ কোটা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে। রেলওয়েতে কোটা ৮২ শতাংশ। ৯৬ শতাংশ কোটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে।

৩. ‘কোটা সংস্কারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন তারা বিএনপি-জামায়াত। তারা সরকারবিরোধী। তারা শিক্ষাঙ্গনে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে চায়।’- এই অভিযোগ ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ নেতা এবং মন্ত্রীদের।

প্রথমত, গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা গত তিন মাস অনুসন্ধান করে কোটা  আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতৃবৃন্দের কারও বিএনপি বা জামায়াত সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি। সুতরাং আন্দোলনকারীরা সবাই বিএনপি বা জামায়াত এই বক্তব্যের কোনো ভিত্তি পাওয়া যাচ্ছে না।

দ্বিতীয়ত, যে কোনো দাবি সরকারের কাছেই করতে হয়। সরকারের কাছে দাবি তোলা মানে সরকার বিরোধিতা নয়।

তৃতীয়ত, সরকারের বা সরকারের কাজের বিরোধিতা করার অধিকার দেশের সব নাগরিকের আছে। একইভাবে সমর্থন করার অধিকারও আছে। সরকারের কাজের বিরোধিতা করা মানে দেশের বিরোধিতা করা নয়, সরকার পতনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকাও নয়। সরকার আর দেশ বা রাষ্ট্র সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।

চতুর্থত, অস্থিতিশীল যে পরিবেশ তৈরি করা হলো, তার দায় কার? কোটা সংস্কারের দাবি প্রধানমন্ত্রী মেনে নেওয়ার তিন মাস পরও প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। কবে হবে সে বিষয়েও কোনো ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, প্রজ্ঞাপন জারির কোনো অগ্রগতি নেই।

আন্দোলনকারীরা একটি সংবাদ সম্মেলন করে তাদের অবস্থান জানান দিতে চেয়েছিলেন। তারা রাস্তায় নেমে আসেননি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট ডাকেননি, গাড়ি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করেননি। মনে রাখা দরকার, গাড়ি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা ছাড়া অন্যগুলো করার অধিকার তাদের আছে। সংবাদ সম্মেলনকারীদের উপর আক্রমণ করার অধিকার ছাত্রলীগের নেই। যে অধিকার নেই, সেই অধিকার প্রয়োগ করে ছাত্রলীগ নুরুলদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। এখানে ‘মারামারি’ হয়নি। শুধু ‘মারা’ হয়েছে। ছাত্রলীগ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নির্দয়ভাবে পিটিয়ে আহত করেছে। লোহার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে দিয়েছে। ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করেছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে। একজন শিক্ষার্থী এখনও নিখোঁজ।

আন্দোলনকারীরা পরিস্থিতি ‘অস্থিতিশীল’ করেছে তার পক্ষে একটিও তথ্য বা প্রমাণ নেই। ছাত্রলীগ পিটিয়ে-নিপীড়ন করে পরিস্থিতি ‘অস্থিতিশীল’ করেছে, তার পক্ষে ভিডিও চিত্রসহ যাবতীয় প্রমাণ আছে।

প্রথমত, যে কোনো দাবি বা আন্দোলনের সঠিক প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা না করলে, বিরোধী দল সুযোগ নিতে চাইবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। এই সুযোগ নিতে চাওয়ার দায় আন্দোলনকারীদের নয়। এই দায় সরকারের। যদি বিরোধী দল কোনো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে থাকে, সেটা নিয়েছে সরকারের ভুল দমননীতির কারণে।

৪. শিক্ষার্থীদের জীবন চলে গেল হাতুড়ির নিচে, দেখার কেউ থাকল না। ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন লোহার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কোটা আন্দোলনের নেতা তরিকুলের জীবন বিপন্ন করে দিয়েছে। ভিডিও চিত্রে মামুনের দানবীয়তা ধারণ করা আছে, এক্সরে রিপোর্টে আছে তরিকুলের টুকরো হয়ে যাওয়া পায়ের ছবি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মেরুদণ্ড।


‘হাতুড়ির নিচে জীবন’র কিছু খণ্ড চিত্র-

ক. তরিকুলকে রাজশাহী সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়নি। তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগ করেছেন তরিকুলের ভাই-বোন- বন্ধুরা।

খ. নুরুলকে ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছে। চিকিৎসা করা হয়নি। আনোয়ার খান মেডিকেলে আনা হয়েছে। পুলিশের ভয়ে মাঝরাতে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নুরুল নিজেই গণমাধ্যমকে সেকথা বলেছেন।

গাজীপুরের কোনো একটি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। দরিদ্র বাবা জমি বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ছেলের চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় এসেছেন।

গ. সবাই গাজীপুর থেকে চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় আসেন। নুরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। কোনো অপরাধ ছাড়া তাকে পিটিয়ে আহত করেছে ছাত্রলীগ। তার চিকিৎসার দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকার নিলো না। ঢাকা মেডিকেল বা বেসরকারি মেডিকেলে করতেও দিল না। তাকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে গাজীপুরে।

ঘ. ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের হুমকি দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

ঙ. কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ফারুককে শহীদ মিনারে লাথি- ঘুষি- পিটিয়ে অজ্ঞান করে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে গেছে ছাত্রলীগ। ভিডিও চিত্রে তা দেখা গেছে। একদিন পর জানা গেল ডিবি তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তুলে নিলো ছাত্রলীগ, পাওয়া গেল ডিবির কাছে!

চ. ‘আপনি কুলাঙ্গার ছেলের জন্ম দিয়েছেন। আপনার ছেলেকে গুম করে ফেলা হবে’- রাশেদের বাবাকে ফোন করে একথা বলেছেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেছেন রাশেদের বাবা। সোহাগ বলেছেন, রাশেদের বাবা অসত্য বলছেন।

জ. সাপ মারার মতো একজনকে দশ বারোজন মিলে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত এবং লোহার হাতুড়ি দিয়ে রড সোজা করার মতো আঘাত করে পায়ের হাড়-কোমর ভেঙে দেওয়া নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা প্রশাসন একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। সহস্রাধিক শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ১৪ জন তরিকুলদের নিপীড়নের প্রতিবাদ করেছেন। ভিসি এই ১৪ জনকে বলেছেন ‘সরকারবিরোধী’। তিনি বলেছেন, সরকারি সুযোগ সুবিধা নিয়ে শিক্ষকরা সরকারের বিরোধিতা করছেন।

শিক্ষকরা যে মুক্তচিন্তা, মুক্ত কথা বলার অধিকার রাখেন, ৭৩’র অধ্যাদেশ তাদের সেই অধিকার দিয়েছে, ভিসি মহোদয় তা ভুলে গেছেন।

ঝ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নিপীড়ন বা ছাত্রলীগের হামলা বিষয়ে প্রথম তিন দিনে কিছু জানেনইনি। ভিসি বলেছেন, গ্রেপ্তার ছাত্রদের দায় বিশ্ববিদ্যালয় নেবে না। ‘শিক্ষক সমিতির কাজ শিক্ষকদের স্বার্থ দেখা’- বলেছেন শিক্ষক নেতা। বলেননি যে, শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখা বা তারা নিপীড়িত হলে তাদের দেখা শিক্ষকদের দায়িত্ব নয়। এমন বাক্য না বলেও তা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। দুই হাজারের অধিক শিক্ষকের মধ্যে নিপীড়নের প্রতিবাদ করছেন অল্প কয়েকজন শিক্ষক। উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের পক্ষে শিক্ষক- আইনজীবী- সমাজকর্মীরা প্রতিবাদ করছেন। পুলিশ তাদেরও অপমান- অসম্মান করছেন।

৫. বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম মানুষের সাংখ্য প্রায় ১১ কোটি। এর মধ্যে কাজ নেই প্রায় সাড়ে ৪ কোটি কর্মক্ষম মানুষের। অর্থনীতির অবস্থা ভালো, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’-এই চিত্রের মাঝেও সাড়ে ৪ কোটি মানুষ বেকার।

পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, এই একটি পরিসংখ্যান তার প্রমাণ বহন করছে। যারা কোটা সংস্কারের আন্দোলন করছেন, তারা এই  কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীরই অংশ। আন্দোলনকারীদের উপর হামলা যারা করছে, তারাও এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অংশ। মূল সমস্যা কাজের নিশ্চয়তার অভাব। বিনিয়োগ বা কর্মক্ষেত্র বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ না দিয়ে, কোটা বৈষম্য দূর না করে, হাতুড়ি পেটা করে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দমন করা যাবে বলে মনে হয় না। আরও বড় হানাহানির আশঙ্কা তৈরির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
  • The Daily Star/ jul 8,2018 

দায় কার?

আসিফ নজরুল

হাতুড়ি দিয়ে নির্বিচারে পেটানো হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র তরিকুলকে। তরিকুলের অপরাধ, তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এই প্রতিবাদ সমাবেশকে দাঁড়াতেই দেয়নি ছাত্রলীগ। এঁদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রামদা, হাতুড়ি ও লাঠিসোঁটা নিয়ে চড়াও হন। নির্বিচার মারধরের একপর্যায়ে তরিকুলের পায়ের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়।

হাতুড়িওয়ালা আবদুল্লাহ আল মামুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা। হাতুড়ি হাতে তাঁর ছবি, হাতুড়ি দিয়ে তরিকুলকে আঘাত করার ছবি এবং তরিকুলের ভাঙা হাড়ের এক্স-রের ছবিতে এখন সামাজিক গণমাধ্যম সয়লাব হয়ে গেছে। মামুনের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন অনেকে। কিন্তু দোষটা কি আসলে শুধু হাতুড়িওয়ালা মামুন ও তাঁর মতো আক্রমণকারীদের?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতারা অস্বীকারও করেননি যে তাঁরা পিটিয়েছেন তরিকুলকে। তাঁরা নাকি ধারণা করেছিলেন যে তরিকুলদের সমাবেশে জামায়াত-শিবিরের লোক থাকতে পারে, এবং এই সমাবেশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণকারী কিছু ছাত্রলীগ নেতাও এমন বক্তব্য দিয়েছেন। এর সোজাসাপ্টা মানে হচ্ছে ছাত্রলীগ নেতারা মনে করছেন কেউ অস্থিতিশীলতা বা নাশকতার চেষ্টা করছে, শুধু এমন ধারণা হলেই তাঁরা তাকে হাতুড়ি, রামদা, লাঠি দিয়ে পেটাতে পারেন।

প্রশ্ন হচ্ছে এটা দেশের কোন আইনে লেখা আছে? বাংলাদেশে কোনো আইন বা সংবিধানে কি লেখা আছে যে কোনো সমাবেশে গোলযোগ সৃষ্টির আশঙ্কা থাকলে সেখানে নির্বিচার হামলা করে কারও হাড়গোড় ভেঙে দেওয়ার অধিকার সরকারি ছাত্রসংগঠনের রয়েছে? নেই। এ ধরনের আশঙ্কা সত্যি থাকলে কেবল পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, উপযুক্ত প্রমাণ থাকলে কাউকে গ্রেপ্তার করবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে এমন কোনো আশঙ্কাও ছিল না। এই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন প্রথম হামলা চালিয়ে আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হককে গুরুতরভাবে আহত করা হয়, সেদিন তাঁরা মাত্র একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করতে গিয়েছিলেন। অল্পসংখ্যক মানুষ সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে সেখানে গোলযোগের আশঙ্কা কীভাবে থাকে? বা শহীদ মিনারে পরবর্তী সময়ে নীরব মানববন্ধনে কীভাবে নাশকতার আশঙ্কা থাকে? দশ-পনেরোজন মিলে একজনকে পেটানোর সময় মরিয়াম নামের ছাত্রীটি তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গেলে কোন আশঙ্কায় তাঁকে লাঞ্ছিত করা হয়?

আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের লোক থাকতে পারে, তারা ইন্ধন দিতে পারে এই যুক্তিও হামলার পক্ষে দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের কোনো আইনে কি লেখা আছে যে বিএনপি-জামায়াত করলে সে কোনো সমাবেশে বা আন্দোলনে যোগ দিতে পারবে না? বাংলাদেশের কোনো আইন বা কোথাও এটি লেখা নেই।

কোনো সমাবেশে কারও হাতে অস্ত্র বা বিস্ফোরক থাকলে তাকে নাশকতার ইন্ধন বলা যেতে পারে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা বরাবর সমাবেশ করেছেন বঙ্গবন্ধু আর প্রধানমন্ত্রীর ছবি আর জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে। এসব কি নাশকতার ইন্ধন?

গোটা আলোচনায় এটি স্পষ্ট যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ওপর যে হামলাগুলো ঘটেছে, তা সম্পূর্ণ একতরফা এবং বেআইনি। সশস্ত্র হামলায় গুরুতর আঘাতের ঘটনা ঘটেছে, যা সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।

কিন্তু তারপরও এই হামলার দায় ছাত্রলীগের একার নয়। আমাদের এটিও বিবেচনা করতে হবে, তাদের এসব গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ ক্যামেরার সামনে নির্দ্বিধায় করার সাহস কে বা কারা দিয়েছে। তাদের নির্বিচার হামলার ঠিক আগে আগে হয় পুলিশ আক্রমণের স্থান ত্যাগ করেছে অথবা নিষ্ক্রিয় থেকেছে। পুলিশ এই আক্রমণে কোনো বাধা দেবে না এটি না জানলে কীভাবে তাঁরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে হামলা করেন? এটা তাঁদের কারা জানাতে পারে নিশ্চিতভাবে? এসব অপরাধ করার পরও ছাত্রলীগের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, তঁাদের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করার সাহস পায়নি, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নেননি। রাষ্ট্রের পুলিশ, গোয়েন্দা, আদালত এমন নিষ্ক্রিয় হয়ে যান কোন শক্তির দাপট বা হস্তক্ষেপে?

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অসামান্য অবদান রেখেছে ছাত্রলীগ। এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনকে ওই শক্তিই পেটোয়া বাহিনীতে রূপান্তর করছে। ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক বর্বরতার ঘটনাগুলোর মূল দায়দায়িত্ব তাদেরই। 

দায়দায়িত্ব আমাদেরও আছে। আমাদের কেউ কেউ অতীতে ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলে বিভিন্নভাবে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। অথচ এত বড় বর্বর আক্রমণের ঘটনাগুলোর পর আমাদের সেসব প্রখ্যাত মানবাধিকারকর্মী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও আইনজীবীর অনেকে নিশ্চুপ রয়েছেন। দায় আমাদের এসব মৌসুমি বিবেকবানদেরও।

দায় রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতিগুলোরও। এঁদের অনেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের ঢল দেখে একে ন্যায়সংগত আখ্যায়িত করে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। আজ সেই আন্দোলনের নেতাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা ও হয়রানিমূলক মামলার পর তাঁরা নিশ্চুপ থেকেছেন, কেউ কেউ এমনকি শোচনীয় ও দায় এড়ানো বক্তব্য প্রদান করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেই দিয়েছেন আঠারো বছরের ওপরের কারও দায়দায়িত্ব তাঁর নিজের। অথচ তাঁর মনে রাখা উচিত ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অভিভাবক হওয়ার কথা তাঁরই। আর আঠারো বছরের ওপরের ছাত্রদের পাশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসমাজের দাঁড়ানোর মধ্য দিয়েই রচিত হয়েছে এ দেশের বহু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

আশার কথা, বাম ছাত্রসংগঠনসহ কিছু মানুষ এই নৈরাজ্যকর সময়ে তবু প্রতিবাদ করেছেন, রাস্তায় নেমেছেন। একটি ন্যায়সংগত আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, তাঁদের চিকিৎসা দিতে বাধাদান ও হয়রানিমূলক মামলার প্রতিবাদ করা মৌলিক একটি মানবাধিকার। এই প্রতিবাদ না থাকার মানে হাতুড়ি আর রামদাকে মেনে নেওয়া, পুলিশ আর সরকারি ছাত্রসংগঠনের অনাচারকে মেনে নেওয়া, নিজেকে বিবেকবর্জিত বা পলায়নপর মানুষ হিসেবে ঘোষণা করা।

আমরা বেশির ভাগ সুবিধাভোগী মানুষ যদি এমন হয়ে যাই, তাহলে এই সমাজে শক্তিতন্ত্র আরও জেঁকে বসবে। এক অশুভ শক্তির প্রতিবাদ না করতে পারলে অন্য অশুভ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর নৈতিক শক্তিও আমরা হারিয়ে ফেলব। 

কোটা সংস্কার আন্দোলন বৈষম্যমূলক ও দুর্নীতিবান্ধব একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন। সরকার এটি ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারলেই তা সবার জন্য মঙ্গলকর হতো। দেরিতে হলেও কোটা সংস্কারের জন্য সরকার কমিটি ঘোষণা করেছে। এই কমিটি গঠনকে আমরা স্বাগত জানাই।

কমিটির কাজ দ্রুত শেষ করে ন্যায়সংগতভাবে কোটা সংস্কারের পদক্ষেপ নিলে এই আন্দোলনের পেছনে অশুভ শক্তি আছে কি না, এ নিয়ে সরকারকে দুর্ভাবনায় থাকতে হবে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার করে নিলে ছাত্রসমাজের ক্ষোভ ও মনোবেদনাও বহুলাংশে হ্রাস হওয়ার কথা। আর আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এটিও প্রমাণিত হবে যে এসব হামলার পেছনে সরকারের কারও কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না।


  • আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ৮, ২০১৮ 

আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে শিক্ষকদের পদযাত্রা


কোটা নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, যে ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক, লজ্জাজনক ও অবিশ্বাস্য। এটা পাকিস্তান বা ব্রিটিশ আমলে ঘটেনি।

রোববার বেলা ১১টায় ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকবৃন্দের’ ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে পদযাত্রা বের করেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসের বাইরে সাম্প্রতিক নিপীড়ন, গ্রেপ্তার, সহিংসতা ও হয়রানির প্রতিবাদে এই পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। পদযাত্রাটি শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। শহীদ মিনারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খানের সঞ্চালনায় শিক্ষকদের একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ কথা বলেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘কোটা আন্দোলন যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত। এ জন্য ছেলে, মেয়ে, অভিভাবক, শিক্ষক সবাই এতে সমর্থন দিয়েছে। ৫৬ ভাগ কোটা অত্যন্ত অযৌক্তিক। আন্দোলন করেছে বলে সরকার কমিটি করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের ওপর নৃশংস বর্বর হামলা চালানো হয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে এভাবে নৃশংস হামলা আগে দেখিনি। যে অবস্থা চলছে, তাতে মানুষের নিরাপত্তা নেই। যারা আন্দোলন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। এটি যৌক্তিক নয়। কোটা সংস্কারের দাবি যেন বাস্তবায়ন করা হয়, এই প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তার দাবি জানাচ্ছি।’

সমাবেশে আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘আন্দোলন করার কারণে শিক্ষার্থীকে হাতুড়িপেটা করা হয়েছে। মেয়েদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। মিথ্যা হয়রানির মামলা করা হয়েছে। নানা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদ করার অধিকার বন্ধ করা গণতন্ত্রবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। সকল ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার চাই এবং হাতুড়িপেটাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চাই।’

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চেয়ে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক তাসনিম সিরাজ মাহবুব বলেন, ‘ভিন্নমতের বিরুদ্ধে গলা চেপে ধরার যে প্রবণতা তার নিন্দা জানাচ্ছি। হাসপাতাল থেকে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা না করে বের করে দেওয়ারও তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’

এ সময় সংবিধানে প্রতিবাদ করার অধিকার আছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সংবিধানে প্রতিবাদ করার অধিকার আছে। সেটি সমুন্নত রাখার সুযোগ দিতে হবে।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক আকমল হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। জামাত–শিবির ও বিএনপির সংশ্লিষ্টতা দেখানো হয়েছে। এখন যেকোনো দাবি তুললেই এ রকম করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্রদের দাবি প্রত্যাখ্যান করার ভাষা নিন্দনীয়। সরকারি হাসপাতাল থেকে শিক্ষার্থীদের যেভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে, তাতে বোঝা যায় গণতন্ত্র কোন অবস্থায় আছে।’

বক্তব্য শেষে পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন। তিনি বলেন, ‘সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সকল হামলাকারীর বিচার চাই, আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের নামে করা মিথ্যা মামলার প্রত্যাহার চাই, আক্রান্তদের চিকিৎসাব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে, নারী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের বিচার চাই এবং দ্রুত কোটা সংস্কারের প্রতিশ্রুত প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে দিতে হবে।’
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ৮, ২০১৮ 

নিরাপত্তাহীনতায় আন্দোলনকারীরা

  • প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা 
  • নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন আন্দোলনকারীরা
  • সপ্তাহজুড়েই হামলা চলেছে



কোটা সংস্কার নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মুক্তি চেয়েছেন হামলা-মামলা-নির্যাতন থেকে। গতকাল শনিবার সেগুনবাগিচায় ক্র্যাব মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের একজন নেতা তাঁদের দাবি-দফা উত্থাপনের পাশাপাশি কতটা নিরাপত্তাহীনতায় তাঁরা ভুগছেন সেই বর্ণনা দেন।

গত শনিবার কোটা সংস্কার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেছিল। ছাত্রলীগের হামলায় সেই সম্মেলনটি হতে পারেনি। পুরো সপ্তাহজুড়েই হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরপর গতকালই প্রথম সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করল।

ওই সংবাদ সম্মেলনে ৫৭ ধারায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানের বাবা-মা ও স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের ছাত্র রাশেদের রাজমিস্ত্রি বাবা নবাই বিশ্বাস অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ফোনে রাশেদকে গুম করে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। তাঁকে গালমন্দ করেছেন ‘কুলাঙ্গার’ ছেলে জন্ম দেওয়ার জন্য।

কর্মসূচি আহ্বানের এত দিন পর সংবাদ সম্মেলনের কারণ জানতে চাইলে, ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র আতাউল্লাহ বলেন, ‘আমরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছি না। আমাদের নেতাদের প্রায় সবাই হয় কারাগারে, না হয় নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে। আমার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। এখনো গায়ে জ্বর। আমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ হলের আবাসিক ছাত্র। হলে ফিরতে পারছি না। জানি না সংবাদ সম্মেলন শেষে আমি যে জায়গা থেকে আজ এসেছি, সেখানে ফিরতে পারব কি না।’

আতাউল্লাহ জানান, গত ৩০ জুন সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে ও পরদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হামলায় অনেকে আহত হয়েছেন। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে অনেককে। খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না কারও কারও। ঢাকা মেডিকেল কলেজ আহত শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বের করে দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলেছে, ওপরের নির্দেশে তাঁদের রাখা যাচ্ছে না। বেসরকারি একটি হাসপাতালও যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক ওরফে নুরুকে মাঝরাতে চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে বের করে দিয়েছে। 

মাহফুজ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নারীদের ওপর হামলা হয়েছে। থানায় ২৭ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর মুচলেকা দিয়ে একজন ছাত্রী বেরিয়ে এসেছেন। বেশির ভাগ নেতা কারাগারে, নয়তো নির্যাতন ও মামলার বিড়ম্বনা এড়াতে আত্মগোপনে আছেন। তাঁদের ফেসবুক পেজটি পর্যন্ত হ্যাক হয়ে গেছে। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা-কর্মীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

সরকারের উদ্দেশে আতাউল্লাহ বলেন, ‘আপনারা আমাদের ওপর যে নির্যাতন ও হামলা চালাচ্ছেন তা থেকে মুক্তি দিন।’ গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তি, রিমান্ডে নির্যাতন বন্ধ ও হামলায় আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসার উদ্যোগ নিতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

আতাউল্লাহর কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল আন্দোলনে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, অর্থায়ন ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। জবাবে তিনি বলেন, ‘১৭ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন শুরুর পর থেকে প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পায়নি। কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করলেই আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করব। প্রজ্ঞাপন জারি না হলে আন্দোলন চলবে।’ অর্থায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিকাশ ও রকেটের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে এই আন্দোলনের জন্য অর্থ চাওয়া হয়েছিল। সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীদের কেউ ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা, কেউ সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা পর্যন্ত পাঠিয়েছেন।

আতাউল্লাহ বলেন, তাঁরা কখনো কোটা বাতিল হোক তা চাননি। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সূর্যসন্তান। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের কথা একবারও বলেননি। তাঁরা শুধু যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছেন। 

রাশেদের শর্তহীন মুক্তি ও নিরাপত্তা দাবি

গতকালকের সংবাদ সম্মেলনে রাশেদ খানের বাবা নবাই বিশ্বাস, মা সালেহা বেগম, স্ত্রী রাবেয়া আলো উপস্থিত ছিলেন। নবাই বিশ্বাস বলেন, রাশেদকে গ্রেপ্তারের আগের দিন ঝিনাইদহ ছাত্রলীগের সভাপতি রানা কয়েকজনকে তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে তাঁর মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহের জন্য পাঠান। পরে তাঁকে ফোন করেন ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। সাইফুর তাঁকে বলেন, ‘আপনি কেমন সন্তান জন্ম দিয়েছেন, সে তো একটা কুলাঙ্গার। ছেলেকে এসব থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন, না হলে গুম করে দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, এখন তাঁকে বলা হচ্ছে তিনি রাজাকার, জামায়াত ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ছয় মাস। তিনি একজন সাধারণ মানুষ। দিনমজুরের কাজ করে যা রোজগার করেন, তা দিয়ে কোনোমতে চলেন।

রাশেদের মা সালেহা বলেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে আমার মণি কিছুই বলেনি। সে শুধু চাকরির জন্য দাবি করেছিল।’ রাশেদের স্ত্রী রাবেয়া বলেন, রাশেদ নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আন্দোলনে যাননি। সবার জন্য গিয়েছিলেন। পরিস্থিতি এখন এমন যে আর সবাই সুবিধা পেলেও রাশেদ পাবেন না। তাঁকে শর্তহীনভাবে দ্রুত মুক্তি ও নিরাপত্তা দেওয়া হোক। রিমান্ডে নেওয়ার পর গতকাল পর্যন্ত তাঁরা রাশেদের কোনো খোঁজখবর পাননি বলে জানান তিনি।

এদিকে নবাই বিশ্বাসের এমন অভিযোগের পর সাইফুর রহমান সোহাগ প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন বাপ হয়ে কীভাবে মিথ্যা কথা বলে? তার সঙ্গে কোনো দিন আমার কথাই হয়নি। হুমকি দেওয়া তো দূরে থাক।’ 

কারাগারে তারেক আদনান, মাহফুজ কোথায়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র তারেক আদনান ২ জুলাই রাত থেকে নিখোঁজ ছিলেন। তারেকের বাবা শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নিউমার্কেট, শাহবাগ ও রমনা থানা ঘুরেও তিনি ছেলেকে পাননি। পরে জানতে পারেন ছেলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তারেক আদনান এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছেলে যুক্ত ছিল এ কথা তিনি জানতেন। এর বাইরে তাঁর ছেলের অন্য কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ৯ জুলাই থেকে তারেকের পরীক্ষা শুরু। যেকোনো মূল্যে ছেলের মুক্তি চান শফিকুল ইসলাম।

তারেকের খোঁজ পাওয়া গেলেও মাহফুজ এখন কোথায় সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি সাত দিন পরও। রোববার পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয় দিয়ে একই মোটরসাইকেলে রাশেদ ও মাহফুজকে মিরপুরের ভাষানটেক থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রাশেদ খানের স্ত্রী রাবেয়া আলো। তিনি গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রাশেদকে যেদিন গ্রেপ্তার করা হয় সেদিন মাহফুজ তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। সকাল থেকেই একজন লোক তাঁদের বাসার আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। এ কথা জানলে রাশেদ ভয় পেয়ে যান এবং কাছেই একটি বাসায় লুকিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে রাশেদ ও মাহফুজকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনেন কয়েকজন লোক। পরে একটি মোটরসাইকেলে করে দুজনকেই হাতকড়া দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

ঢাকা মহানগর পু‌লি‌শের উপকমিশনার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান ব‌লেন, ডি‌বি রা‌শেদ খাঁন, ফাইজুর ও আতিক নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আর শাহবাগ থানা পু‌লিশ গ্রেপ্তার ক‌রে‌ছে নয়জনকে। মাহফুজ‌কে পু‌লিশ গ্রেপ্তার করে‌নি। 

ঢাকার বাইরে কর্মসূচি অব্যাহত

ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, হামলা এবং নারীদের লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে গতকাল চট্টগ্রামে ঝটিকা মিছিল হয়েছে। ‘সকল সাধারণ শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম’-এর ব্যানারে হওয়া এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রার্থীরা অংশ নেন। হামলার আশঙ্কায় তাঁরা ১৫ মিনিটের মধ্যেই তাঁদের কর্মসূচি শেষ করেন।

এদিকে কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গতকাল বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে মানববন্ধন করেন। ছাত্রলীগের হামলার দ্রুত এবং সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি করেন।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় জুবায়ের হোসেন (২২) নামে এক যুবককে পুলিশ কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ফেসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দেওয়া ও নাশকতার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল সকালে রায়পুর উপজেলার মিতালী বাজার কামাল টেলিকম থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় বিকেলে রায়পুর থানার উপপরিদর্শক মোতাহের হোসেন বাদী হয়ে থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেন।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ৮, ২০১৮ 

একদল অবিবেচকের কাহিনী

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

গত কয়েক দিনে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একদল অবিবেচকের অমানবিক কর্মকাণ্ড দেখলাম। তারা নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের ওপর যে মধ্যযুগীয় বর্বরতা নিয়ে হামলা চালাল, তার নজির শুধু তারাই। এর আগে গত এপ্রিলে এই ছাত্রদের ওপর তারা হামলা চালিয়েছিল। শুধু তারাই নয়, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল পুলিশ বাহিনী। খুব কাছে থেকে পুলিশের টিয়ার শেলে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিক। 

সে আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নয়টি কলেজের শিক্ষার্থীদের দ্রুত পরীক্ষা নেয়া। এর সাথে রাজনীতি ছিল না। অন্য কারো সাথে তাদের বিরোধও ছিল না। এটা তো খুব স্বাভাবিক যে, একজন শিক্ষার্থী যথাসময়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে চাইবে, প্রবেশ করতে চাইবে কর্মজীবনে। কিন্তু ছাত্রলীগ ও পুলিশ তাদের যেভাবে মারধর করল সেটা কল্পনার অতীত ছিল। কিন্তু আমরা কল্পনা করতে পারি বা না পারি, বাংলাদেশ এখন এমনি মগের মুল্লুক।

গত প্রায় তিন মাস ধরে শিক্ষার্থীরা একটি নতুন আন্দোলন করছে। সে আন্দোলন হলো কোটা সংস্কার। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ চাকরি দেয়া হয় কোটার ভিত্তিতে। ফলে মেধাবীরা ক্রমেই চাকরি জীবন থেকে পিছিয়ে পড়ছে। 


কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল এই ৫৬ শতাংশ কমিয়ে এনে তাকে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা হোক। সে দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন দেশের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং সমাজের সচেতন লোক। কিন্তু তাতে কোনো ফায়দা হয়নি। সরকার কোটা সংস্কারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জারিই রেখেছিল। কিন্তু আন্দোলন থেমে থাকেনি। শত নির্যাতন সত্ত্বেও আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে গেছে। সে আন্দোলন শুধু ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছিল না, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ছাত্রদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চলছিল। তাতে তারা মোটেও দমে যায়নি। কোটা সংস্কারের দাবি অব্যাহত থাকে। এরই একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা দেন যে, কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো। যদিও সেটা আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজের দাবি ছিল না। তাদের দাবি ছিল সংস্কার। কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই পদ্ধতি বাতিল করাই ভালো।

কারণ কোটা থাকলে তা বাড়ানো বা কমানোর জন্য আবার আন্দোলন শুরু হবে। সুতরাং কোটা বাদ। এতে ছাত্রসমাজের মধ্যে একধরনের স্বস্তি নেমে এসেছিল; কিন্তু তাদের বক্তব্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা আইন নয়। আইনের জন্য অবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। সঙ্কটের শুরু হয় সেখান থেকেই। প্রধানমন্ত্রী তো ঘোষণা দিলেন। 


কিন্তু নৌ-পরিবহনমন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জোর গলায় চেঁচিয়ে বলতে থাকলেন- কোটা বাতিল করা চলবে না। প্রধানমন্ত্রীর কোনো ঘোষণার বিরুদ্ধে এর আগে আমরা কারো মুখে কোনো কথা শুনিনি। কিন্তু এবারই প্রথম সে ধরনের কথা শুনতে পেলাম। এ নিয়ে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নিজেও আর কোনো বক্তব্য দেননি। পরে তিনি নিজের কথা ঘুরিয়ে বললেন যে, এর জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। তারা বসে সিদ্ধান্ত নেবেন, কিভাবে কি করা যায়। অথচ এ রকম তো কথা ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কোটা পদ্ধতি না থাকারই কথা ছিল। তাহলে প্রতিবন্ধী বা সমাজের সুযোগবঞ্চিতদের চাকরি-বাকরির কী হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। যেহেতু বিশেষ ব্যবস্থার অপশনটি রইল, তাহলে কথা তো সেখানে শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কথা রাখেননি। তিনি আবার মুক্তিযোদ্ধা কোটার কথা তুললেন।

ইতোমধ্যে ছাত্রসমাজ আবার সমাবেশের ডাক দিলো। এর মধ্যে গত ৩০ জুন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সে সম্মেলন শুরু হওয়ার প্রায় সাথে সাথে ছাত্রলীগের কয়েক শ’ কর্মী কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর তাদের বেধড়ক মারধর করে। এমনকি পরে তারা খুঁজে খুঁজে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে বহু সংখ্যক ছাত্রের ওপর চড়াও হয়। এ রকম পৈশাচিক কাণ্ড ছাত্রলীগ নানা কারণে আগেও ঘটিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং সংবাদমাধ্যমে সেসব হামলার বিস্তারিত সচিত্র বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। 

একজন আন্দোলনকারীর ওপর ১০-২০ জন ছাত্রলীগ কর্মী কিল-ঘুসি লাথি দিয়ে আহত করেছে। আর আহত শিক্ষার্থীদের পরে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে। কোটা আন্দোলনের নেতা রাশেদ খানকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। তাকে আটক করার আগ মুহূর্তে এক ফেসবুক ভিডিও বার্তায় ভীত রাশেদ আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমাকে বাঁচান, আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে ধাওয়া দিয়েছে ডিবি পুলিশ। ভিডিওটি শেয়ার করুন।’ কিন্তু পুলিশ তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে আটক করে। কিন্তু যারা এই বর্বর হামলা চালাল, সেই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

৩ জুলাই ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগ যে পৈশাচিক বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কোটা আন্দোলনকারীরা সমবেত হওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাদের একজনকে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা মাথা থেঁতলে দিয়েছে। হাতপায়ে কিল ঘুসি লাথি মেরেছে, যেন তাদের ধুলায় মিশিয়ে দিতে চায়। রক্তাক্ত ওই আন্দোলনকারীর অবস্থা করুণ। তার উঠে দাঁড়ানোর কোনো অবস্থা ছিল না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে আরো মারাত্মক ঘটনা। একজন ছাত্রকে ১০-১২ জন ছাত্রলীগ লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করেছে। একজন ছাত্রলীগ সদস্য তার মাথা হাত পিঠে অবিরাম হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছে। তার পুরো ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগ শুধু ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে তা নয়, তারা ছাত্রীদের ওপরও হামলা চালিয়ে নির্লজ্জ বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে এবং আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, যারা এ রকম পৈশাচিক বর্বরতার ঘটনা ঘটাল, পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। ঢাকার শহীদ মিনারে সে দিন যখন আন্দোলনকারীদের ওইভাবে পিষে মারার চেষ্টা করছিল, তখন পুলিশ তাদের বাধা তো দেয়ইনি, বরং নীরবে সে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ এসেছে পরে। এসে আহত মৃত্যুপথযাত্রী ছাত্রটিকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগের মামলা দেয়া হয়েছে।


এ দেশে এ ঘটনা নতুন নয়। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে আমরা আইয়ুব খানের ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশনের (এনএসএফ) কীর্তিকলাপ দেখেছি। তারাও ছাত্র সমাজের ওপর এভাবে চড়াও হয়েছে। কিন্তু ছাত্রলীগ যে নির্যাতন করল তাতে এনএসএফের নির্যাতন ম্লান হয়ে গেছে। এটা কাক্সিক্ষত ছিল না। তবে ছাত্রলীগের এই পৈশাচিকতার ঘটনা নতুন নয়। তারা বহু আগেই এনএসএফকে হার মানিয়ে দিয়েছে। এনএসএফ যত না পিষে মারতে চেয়েছে, তার চেয়ে বেশি চেয়েছে ভয় দেখাতে। ছাত্রলীগ ভিন্ন মতাবলম্বীদের পিষে মেরে ফেলারই চেষ্টা করেছে। 

অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তারা এনএসএফকেও হার মানিয়েছে। পেছনে সরকার আছে, পুলিশ বাহিনী আছে- সেই জোরে তারা এসব কর্মকাণ্ড করছে। কিন্তু এসব জোর শেষ পর্যন্ত থাকে না। আমরা এনএসএফের ষণ্ডাদের রাস্তাঘাটে মরে পড়ে থাকতে দেখেছি। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানকালে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটা সময় আসবে যখন হ্যারিকেন দিয়ে খুঁজেও কোনো ছাত্রলীগ পাওয়া যাবে না। এ রকম অবস্থা আমরা ১৯৭৫ সালেও একবার দেখেছিলাম। শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের পতনের পর গাঁঠরি বোঁচকা নিয়ে ছাত্রলীগারদের হলগুলো থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাতে দেখেছি। তার আগের দিনও যারা ছাত্রলীগের প্রতাপশালী মাস্তান ছিল পরদিন আর তাদের হলে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইতিহাসের সাক্ষ্য এমনই। সরকার বা ছাত্রলীগ ক্ষমতার দম্ভে এখন কেউই অনুমান করতে পারছে না যে, তাদের পরিণতি কী হতে পারে। ক্ষমতা অনন্তকালের নয়। একসময় ক্ষমতা চলে যায়। তখন গাঁঠরি বোঁচকা নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে হয়। তখন যদি এই সাধারণ ছাত্ররা তাদের ধাওয়া করে এবং তাদের পরিণতি যদি আজকের নির্যাতিত ছাত্রদের মতো হয় তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না।


সামান্য একটু উদাহরণ দিচ্ছি। ২ তারিখেই আমরা দেখেছি, ছাত্রলীগের এই পৈশাচিকতা সত্ত্বেও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাশে মানববন্ধন করেছে। সিলেটেও সাধারণ ছাত্ররা ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে। রাজশাহীতেও বের করা হয়েছে মশাল মিছিল। আর তিন তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। সুতরাং হলফ করেই বলা যায়, সামনে ছাত্রলীগের জন্য বড় দুর্দিন অপেক্ষা করছে।

এবার খানিকটা আত্মসমালোচনা করা যাক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কিংবা তারও আগে থেকেই এ দেশের সংবাদপত্রগুলো সব সময় নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। পক্ষে দাঁড়িয়েছে নায্যতার, তার জন্য সংবাদপত্রগুলোর ওপর দলনপীড়ন কম হয়নি। কিন্তু সত্য প্রকাশের নীতিতে সংবাদপত্রের সম্পাদক-প্রকাশকেরা অবিচল ছিলেন। তখন টেলিভিশন ছিল না। এত সব স্যাটেলাইট চ্যানেলও ছিল না। এখন সংবাদপত্র আছে, বহুসংখ্যক টেলিভিশন চ্যানেল আছে। কিন্তু সরকারের রোষানল থেকে বাঁচার জন্য কোনো মিডিয়াই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না যে, তারা যথাযথভাবে আন্দোলনকারীদের সপক্ষে দাঁড়িয়েছে। স্যাটেলাইট টেলিভিশনগুলোর বিপদ অনেক বেশি। তাদের ওপর হুমকির খড়গ সব সময় জারি রয়েছে। সরাসরি সম্প্রচার কিংবা সরকারের পছন্দ নয় এমন খবর প্রচারের বিরুদ্ধে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অধিকাংশ চ্যানেলের অনুমতি দিয়েছি আমি। যে দেয় সে নিতেও পারে’। এর চেয়ে স্পষ্ট হুমকি আর কিছুই হতে পারে না। ফলে আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে তাদের ওপর নির্যাতনের খবর অতি সামান্যই প্রকাশ হয়েছে।

কেননা ইতোপূর্বে সরকার চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ গড়ে ওঠেনি। ফলে এ যাত্রায় টিভি চ্যানেলগুলোতে আমরা ছাত্রলীগের বর্বরতার চিত্র দেখতে পাইনি। কিন্তু সত্য চাপা থাকে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সে বর্বরতার ভিডিওচিত্র প্রকাশ হয়েছে। প্রকাশ হয়েছে স্থিরচিত্রও। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ দেখেছে, নব্য স্বৈরাচারী কায়দায় সরকার বাংলাদেশে কী কাণ্ড করছে।

সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদপত্র ছাড়া বেশির ভাগ সংবাদপত্রই যেন এত বড় ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সংবাদপত্রের মালিকদের বেশির ভাগ সরকার সমর্থক। ফলে তারা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন খবর প্রকাশ থেকে বিরত থাকে, আর অনেকেই বিরত থাকে ভয়ে। তাই দেখা যায়, দু-চারটি সংবাদপত্র ছাত্রলীগের পৈশাচিক বর্বরতার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ১৯৭২-১৯৭৫ সালেও সংবাদপত্রের ওপর এমন দলনপীড়ন চলেছিল, কিন্তু তখন প্রতিবাদ ছিল। সাংবাদিকদের সংগঠন ডিইউজে-বিএফইউজে বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ করেছে। পত্রিকায় লিখেও তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দাবি করেছে। কিন্তু সরকার একের পর এক কালাকানুন জারি করে গেছে। আজ সবাই নিশ্চুপ। বিভক্ত সমাজের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ কোনো পদক্ষেপ নেই। কিন্তু আজ আমরা যে দাসত্ব মেনে নিচ্ছি রুখে না দাঁড়ালে আগামীতেও একই রকম দাসত্ব করে যেতে হবে।

জার্মান নৌবাহিনীর দুর্র্ধর্ষ সাবমেরিন অধিনায়ক ছিলেন নায়মোলার। পরে চিন্তাবিদ ও লেখক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং হিটলারের নাৎসিদের হাতে কারারুদ্ধ হন। জার্মান জাতি নিষ্ক্রিয় ছিল বলেই হিটলার তাদের স্তব্ধ করে দিতে এবং নাৎসি শাসন চালু করতে পেরেছিলেন। 

ব্যাপারটাকে নায়মোলার বর্ণনা করেছেন এভাবে :
‘প্রথমে ওরা এলো কমিউনিস্টদের ধরতে, আমি প্রতিবাদ করিনি/কেননা আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না।/এরপর এরা সোস্যালিস্টদের ধরতে এসেছিল, আমি প্রতিবাদ করিনি/কারণ আমি সোস্যালিস্ট ছিলাম না।/এরপর এরা এলো ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের ধরতে, আমি প্রতিবাদ করিনি,/কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়নপন্থী ছিলাম না।/এরপর এরা এলো ইহুদিদের ধরতে, আমি প্রতিবাদ করিনি,/কারণ আমি ইহুদি ছিলাম না।/সবশেষ ওরা আমাকে ধরতে এলো/তখন আর আমার হয়ে প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না।’ তেমন পরিস্থিতি কাম্যকারো কাছে কাম্য হতে পারে না।


  • কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/ জুলাই ৮,২০১৮

নির্বাচন কমিশন এখন সরকারের দাস - মাহমুদুর রহমান

অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান বর্তমান সরকারের অধীনে কোনোভাবেই সম্ভব হবে না ব‌লে মন্তব্য ক‌রে‌ছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। আর এজন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য নিজ নিজ এলাকায় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার ডাক দিয়েছেন তিনি। 

মান্না বলেন, নির্বাচন কমিশন তো এখন সরকারের দাস। খুলনায় যে নির্বাচন হয়েছে তার ফলাফল দেখেছেন। মৃত ব্যক্তি ভোট দিয়ে চলে যায়! বোঝেন তাহলে কি রকম নির্বাচন হয়েছে? গাজীপুরে কী হয়েছে আপনারা দেখেছেন।

শ‌নিবার, ৭ জুলাই, জাতীয় প্রেসক্লাবে “নতুন রাজনৈতিক দল, গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচন বিকাশে নির্বাচন কমিশন ও সরকারই প্রধান বাধা” শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তি‌নি এসব কথা ব‌লেন।

মান্না বলেন, ‘সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের কালো আইন ৯০ বি ধারা বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। বর্তমান অবৈধ সরকারের আইন আমরা মানি না।’ 

ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের আইন নেই। ৯০ বি ধারা বাতিল হওয়া প্রয়োজন। আমি আপনাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছি।’ ছাত্রলীগের গুণ্ডা বাহিনী দ্বারা সরকার কোটাবিরোধী আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করছে বলেও এসময় মন্তব্য করেন তিনি। 

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বর্তমান সরকার কোনও রাজনৈতিক দল যাতে গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য যত ধরনের আইন করা দরকার তা করবে। নির্বাচনের পূর্বে ভোটারের অগ্রীম স্বাক্ষর প্রমাণ করে কোনও দল বা ব্যক্তি যাতে করে নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারে। উক্ত স্বাক্ষর সংবিধান পরিপন্থি।’ 

বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধপূর্ব নির্বাচিত ও স্বাধীনতাযুদ্ধে মূল নেতৃত্বদানকারী দলটিই স্বাধীন রাষ্ট্রে সরকার গঠন করার পর প্রহসনমূলক নির্বাচনের পর একটি সংসদ এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থা জাতিকে উপহার দিয়েছে। ৭৫’র পরবর্তীকালে কাগজে-কলমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা চালু হল বটে, কিন্তু সরকার বিরোধী দল ও মতকে সহজভাবে গ্রহণ করা হল না এবং প্রহসনমূলক নির্বাচন ব্যবস্থাও অব্যাহত থাকল।

বক্তারা আরও বলেন, রাজনীতির প্রতি বিতশ্রদ্ধ ১/১১’র সেনা সমর্থিত অরাজনৈতিক সরকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মারমুখী অবস্থান নিয়ে প্রথমদিকে জনগণের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিল। কিন্তু তাদের মাথায় ক্ষমতায় স্থায়ী হওয়ার সাধ জেগে ওঠায় তারা দুই নেত্রীকে দেশান্তরী করার মাধ্যমে মাইনাস-টু ফর্মুলা কার্যকরের দূরভিসন্ধিমূলক প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করে। এতে দুই নেত্রীর প্রতি গড়ে উঠা গণঅসন্তোষ গণসহমর্মিতায় রূপ নেয়।

সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ডাকসু’র সাবেক জি.এস ও বাংলাদেশ জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. মুস্তাক হোসেন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক,লেখক ও কলামিস্ট ড. ইসা মোহাম্মদ, সাবেক এম.পি, এড. তাসমিন রানা, পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মানবাধিকার আন্দোলনের সভাপতি খাজা মহিব উল্লাহ শান্তিপুরী, বাংলাদেশ কংগ্রেসের চেয়ারম্যান এড. কাজী রেজাউল হোসেন, বাংলাদেশ দেশপ্রেমিক পার্টির চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ডা. গোলাম মোর্শেদ হাওলাদার ও রিপাবলিকান পার্টির চেয়ারম্যান আবু হানিফ হৃদয় প্রমুখ।

  • কার্টসিঃ ব্রে‌কিং‌নিউজ বিডি/ জুলাই ৮,২০১৮ 

নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিতে ১২ ব্যাংক

বাড়ছে খেলাপি ঋণ


ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। গত মার্চ শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংক বড় ধরনের নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিতে পড়েছে। এর মধ্যে ৮টি বেসরকারি খাতের ব্যাংক। সব মিলিয়ে পুরো ব্যাংক খাতে এখন সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। আগে সরকারি ব্যাংকগুলোতেই এ ঘাটতি ছিল প্রকট। এখন তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকও।

বেসরকারি খাতের যেসব ব্যাংকে সঞ্চিতির ঘাটতি রয়েছে, সেগুলো হলো সোস্যাল ইসলামী, এবি, ন্যাশনাল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, আইএফআইসি, প্রিমিয়ার ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক আগে থেকেই এ তালিকায় রয়েছে। আর সঞ্চিতির ঘাটতি থাকা অপর তিন ব্যাংক হলো রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, বেসিক, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্চভিত্তিক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী সরকারি, বেসরকারি, বিদেশিসহ সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, সেগুলোর গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে আলাদা হিসাবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সে জন্য এ নিরাপত্তা সঞ্চিতির বিধান রাখা হয়েছে। ঋণের মান অনুযায়ী খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ সঞ্চিতিরও বিধান রয়েছে। ব্যাংকগুলো সঞ্চিতি রাখতে না পারায় এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ সুবিধা দিয়ে তিন বছরে তা সংরক্ষণের অনুমতি দিচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকগুলোর খারাপ অবস্থার প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন সূচকে। পরিচালকেরাই ব্যাংকগুলো খারাপ করেছেন। তাই ব্যাংকগুলোকে ভালোভাবে টিকিয়ে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।

গত মার্চ শেষে সরকারি-বেসরকারি মোট ১২টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫৯৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি সোনালী ব্যাংকের। মার্চ শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সর্ববৃহৎ এ ব্যাংকের সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। এরপরই বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ৩০৭ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ২৬৮ কোটি এবং অগ্রণী ব্যাংকের ১ হাজার ৯ কোটি টাকা।

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি ১৫৫ কোটি টাকা। অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার অনিয়ম ও পাচারের কারণে ব্যাংকটি বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। এ ছাড়া বড় গ্রাহকদের ঋণও নিয়মিত ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংকটি। ফলে ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতিও রাখতে পারছে না।

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ২০০ কোটি টাকা। এ ব্যাংকটির সংকটাবস্থা কাটাতে মালিকানার পরিবর্তন হলেও কোনো উন্নতি হয়নি। আর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার পরিবর্তনের পর সংকটে পড়েছে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক। গত মার্চ শেষে ব্যাংকটির সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৩৬ কোটি টাকা।

এ ছাড়া আইএফআইসি ব্যাংকের ঘাটতি ২৯ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১১৪ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৪০ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১১৯ কোটি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৬৭ কোটি টাকা।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন-উর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বাড়ায় চাহিদামতো সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা যায়নি। এ জন্য আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ সুযোগ নিয়েছি। পরের দুই বছর এসব সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হবে।’

এদিকে সরকারের মেয়াদ যত ঘনিয়ে আসছে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। কারণ, অনেক প্রভাবশালী ঋণ নিয়ে সময়মতো কিস্তি শোধ করছে না। ফলে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ দিনকে দিন শুধুই বাড়ছে। আর ঋণের টাকা ফেরত না আসায় ব্যাংকগুলো পড়েছে অর্থসংকটে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ২২ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। আর ২০১৭ সালের মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এ বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের সঙ্গে ৪৮ হাজার ১৯২ কোটি টাকার অবলোপন যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/জুলাই ৮,২০১৮ 

‘আজকে আমার ছেলে, কালকে আপনার ছেলে... এভাবেই দেশটা চলবে’


কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলায় আহত নুরুল হকের বাবা ইদরিস হাওলাদার বলেছেন, সচেতন নাগরিক হিসেবে তার ছেলে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। তাকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পেটানো হয়েছে। ছেলের ওপর হামলা হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আজকে আমার ছেলে, কালকে আপনার ছেলে, পরশু দিন তার ছেলে-- এভাবেই দেশটা চলবে। আমরা মরে যাবো তারাই বেঁচে থাকবে।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের ব্যানারে আয়োজিত সমাবেশে এভাবেই নিজের ছেলের কথা বলছিলেন নুরুলের বাবা ইদরিস হাওলাদার। এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। 

হামলাকারীদের বিচার ও গ্রেপ্তার ছাত্রনেতাদের মুক্তি দাবি করে সমাবেশে বক্তব্য দেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ আনু মোহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, লেখক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রমুখ।

পেশায় কৃষক ইদরিস বলেন, ছেলের ওপর হামলার খবর পেয়ে পটুয়াখালী থেকে তিনি ঢাকায় এসেছেন। জমি বিক্রি করে ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি করিয়েছেন। আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় ডিবি পুলিশ নুরুকে তুলে নিয়ে যায়। এক ঘণ্টা পরে তারা তাকে ছেড়ে দেয়। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে পেটানো হয়েছে। তার সারা শরীরে এত ব্যথা যে নিজে উঠেও দাঁড়াতে পারছে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

এখন গাজীপুরে একটি হাসপাতালে নুরুলের চিকিৎসা চলছে বলে তিনি জানান। ছেলের চিকিৎসার জন্য জমি বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে এসেছেন।

গত ৩০ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় সকাল ১১টার দিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। 

এসময় সংগঠনটির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হককে বেধড়ক মারধর করা হয়। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি বলে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ রয়েছে। পরে আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখান থেকেও তাকে মধ্যরাতে বের করে দেওয়া হয় বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
  • কার্টসিঃ The Daily Star/ jul 7,2018 

আটকে গেল শিক্ষা আইনের খসড়া

ফের আটকে গেল শিক্ষা আইনের খসড়া। খসড়াটিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১২ ধরনের পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। এখন নতুন করে খসড়া তৈরি করতে ১০ই জুলাই মঙ্গলবার সব পক্ষ নিয়ে বৈঠক ডেকেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। খসড়ায় বেশ কয়েকটি অসঙ্গতি ও বিদ্যমান কয়েকটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারা-উপধারা থাকায় ফেরত পাঠানো হয়। শিক্ষায় বিদ্যমান সব আইনগুলোকে একত্র  করে একটি আমব্রেলা আইন (এক ছাতার নিচে সব) করে খসড়া তৈরি করে পাঠাতে বলা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, খসড়ায় ব্যাপক অসামঞ্জস্য, বৈপরীত্য ও বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের সঙ্গে অসঙ্গতি থাকায় আবারো এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ফেরত পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ফলে বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা আইন আলোর মুখ দেখছে না। মূলত খসড়া প্রণয়নে দূরদর্শিতার অভাব, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের ধারা বিবেচনায় না নেয়া, শিক্ষাবিদদের মতামত উপেক্ষা করা ও খসড়া প্রণয়নকারীদের গাফিলতির কারণেই ছয় বছরের বেশি সময়েও শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

পর্যবেক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, আইন হবে না এটা বলার কোনো সুযোগ নেই। মন্ত্রিপরিষদ থেকে যেসব পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে তা সংযোজন-বিয়োজন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, শিক্ষা আইন না থাকলেও সবকিছু তো একটা আইনের মধ্য দিয়েই চলছে। আইন করতে গিয়ে এসব বিষয় সামনে এসেছে। তাই সব আইনকে একত্র করে একটা আমব্রেলা আইন করা হবে। সেজন্য সব পক্ষকে ডাকা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক আইন, ১৯৯০ রয়েছে। নতুন করে আইন করতে হলে এ আইন রহিত বা এ আইনের মধ্যে ঢুকাতে হবে। কিন্তু খসড়া বাধ্যতামূলক প্রাথমিক আইনের কিছু ধারা শিক্ষা আইনে রাখা হয়েছে আবার কিছু বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে। 

এছাড়াও নোট ও গাইড নিষিদ্ধকরণ এবং পাবলিক পরীক্ষা অপরাধ আইন থাকা সত্ত্বেও এগুলোর শাস্তির ধারাগুলো প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে রাখা হয়েছে। এসব ধারা শিক্ষা আইনে রাখতে হলে পুরনো দুটি আইন সংশোধন করতে হবে। এজন্য এ দুটি ধারা আদৌ শিক্ষা আইনে রাখার প্রয়োজন রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে। পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন, ১৯৮০’ এবং ‘পাবলিক পরীক্ষা সংশোধনী ১৯৯২’-এর চার নম্বর ধারায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। এখন প্রশ্নফাঁসের শান্তি বাড়াতে হলে আগে আইন বাতিল করতে হবে। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের নোট বা গাইড বই মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ। 

১৯৮০ সালের নোট বই (নিষিদ্ধকরণ) আইনে এই বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। এই আইন লঙ্ঘনের দায়ে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এক আদেশে নোট বইয়ের পাশাপাশি গাইড বইও নিষিদ্ধ করা হয়। 

এরপর ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের এই আদেশ বহাল রাখে। এখন নোট-গাইড নিষিদ্ধ করতে হলে আগের আইনের কী হবে সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে। এছাড়াও প্রস্তাবিত আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন আইন, বিধি, প্রবিধান, রীতি পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইন বা সংশোধনীর বিষয়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত বা পর্যবেক্ষণ (যদি থাকে), আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের উদ্দেশ্য ও এর সম্ভাব্য প্রভাব এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন, চুক্তি, কনভেনশন, সমঝোতা স্মারক, সিদ্ধান্ত, প্রটোকল খতিয়ে দেখার নির্দেশনা দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। 

গত ২৬শে এপ্রিল শিক্ষা আইনের খসড়া পরীক্ষায় গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি বিভিন্ন ধারা-উপধারা পর্যালোচনা করেন। এতে বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতি দেখে সন্তুষ্ট না হয়ে কমিটির পর্যবেক্ষণ দিয়ে তা ফেরত পাঠানো হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি আইনের খসড়ায় নানা রকম ত্রুটি, পরস্পরবিরোধী তথ্য এবং ভাষাগত সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারা-উপধারা রয়েছে বলে পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন। 

এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন) মু. ফজলুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে যেসব পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে তা একত্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন করে আবার তা পাঠানো হবে। 

তিনি বলেন, যেহেতু পর্যবেক্ষণ এসেছে এতে কিছু সময় লাগতে পারে। তবে আইন হবে এটা নিশ্চিত বলা যায়। এর আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পর্যবেক্ষণ আসার পর তা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে শিক্ষার সব দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হয়, বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে কী কী আইন/বিধি/প্রবিধানমালা বিদ্যমান আছে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইন শাখায় প্রেরণপূর্বক কোনো মতামত থাকলে তা পাঠাতে হবে। এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পর্যবেক্ষণের পর সেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তাও বলা হয় চিঠিতে। এতে বলা হয়, বিদ্যমান আইনের বিধান ও প্রস্তাবিত খসড়া আইনের বিধানসমূহের সামঞ্জস্য/অসামঞ্জস্য পর্যবেক্ষণ ও যাচাইক্রমে উদ্যোগী মন্ত্রণালয় খসড়াটি পুনর্বিন্যাস করবে। বিদ্যমান আইনের বিধান ও প্রস্তাবিত খসড়া আইনের বিধানসমূহের সামঞ্জস্য/ অসামঞ্জস্য পর্যবেক্ষণ ও যাচাইক্রমে উদ্যোগী মন্ত্রণালয় খসড়াটি পুনর্বিন্যাস করবে।

‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’র আলোকেই ‘শিক্ষা আইন, ২০১১’ প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০১২ সালে শিক্ষা আইনের প্রথম খসড়া তৈরি করা হয়। পরে সংযোজন-বিয়োজন শেষে ২০১৩ সালের ৫ই আগস্ট জনমত যাচাইয়ের জন্য এই খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ দিয়ে সেটি ফেরত পাঠানো হয়। 

এক পর্যায়ে নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীদের আন্দোলন, কওমি মাদরাসার মালিকদের হুমকিসহ নানা বিতর্ক দেখা দিলে এই আইন প্রণয়নের কাজ থমকে থাকে। পরে আবারো এই খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য পাঠানো হলে এতে নানা রকম অসঙ্গতি থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। সর্বশেষ গত বছর খসড়া আইন ফের মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দিয়েও কয়েক দিনের মধ্যে তা তুলে নেয়া হয়। এরপর কর্মকর্তা পর্যায়ে কাজ শেষে খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করা হয়। 

  • Courtesy: Manabzamin/Jul 08, 2018