Search

Sunday, July 15, 2018

সাতক্ষীরায় বিকেলে গ্রেপ্তার, রাতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত

সাতক্ষীরার সদর উপজেলায় গতকাল শনিবার দিবাগত গভীর রাতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুজন নিহত হয়েছেন। গতকাল বিকেলে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পুলিশ বলছে, এ দুজন আন্তর্জাতিক মাদক চক্রের সদস্য ছিলেন।
নিহত দুজন হলেন কলারোয়া উপজেলার কেড়াগাছি গ্রামের আবুল কালাম আজাদ (৪৫) ও সদর উপজেলার বাঁশদাহ গ্রামের দেলোয়ার হোসেন (৪১)।

সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুফ আহমেদের ভাষ্য, মাদক ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ ও দেলোয়ার হোসেনকে গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে বাঁশদাহ এলাকা থেকে দুই কেজি গাঁজা, ১৫ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার হয়। পরে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাঁরা স্বীকার করেন, আন্তর্জাতিক মাদক দলের সঙ্গে তাঁরা জড়িত। ভারত থেকে মাদক নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন। গতকাল রাতেই তাঁদের একটি বড় চালান আসার কথা ভারত থেকে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী রাত আড়াইটার দিকে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাঁদের নিয়ে সীমান্তসংলগ্ন বাঁশদাহ এলাকায় কয়ারবিল এলাকায় যান। কয়ারবিল সেতুর পাশে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে ওত পেতে থাকা মাদক চক্রের সদস্যরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশও আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়। এ সময় গ্রেপ্তার আবুল কালাম আজাদ ও দেলোয়ার হোসেন পালানোর চেষ্টা করেন। গোলাগুলির একপর্যায়ে মাদক চক্রটি কয়ারবিলের পাটখেত থেকে হাওয়ালখালীর দিকে চলে যায়। পরে পুলিশ এলাকা তল্লাশি করে কয়ারবিলের বেড়িবাঁধের ওপর থেকে আবুল কালাম আজাদ ও দেলোয়ার হোসেনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে। তাঁদের সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাস্থল থেকে তিন কেজি গাঁজা, ২০ বোতল ফেনসিডিল, একটি ওয়ান শুটারগান ও একটি গুলি পাওয়া যায়।

কর্তব্যরত চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদ জানান, মৃত অবস্থায় দুজনকে আজ রোববার ভোর পাঁচটার দিকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে পুলিশ। একজনের কপালে ও একজনের গলায় গুলির চিহ্ন রয়েছে।

ওসি আরও জানান, এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করার প্রস্তুতি চলছে। গুলি বিনিময়কালে সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শেখ সুমন হাসান, মাজেদ আলী, কনস্টেবল তুহিন আক্তার, সোহেল মাহমুদ ও মহব্বত হোসেন আহত হয়েছেন। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

  • Source: Prothom Alo /Jul 15, 2018

Government primary education management mired in failures

FIVE thousand and thirty-six out of the total 64,122 government primary schools, which accounts for about 7.85 per cent, running with less than 100 students — and 13.44 per cent of them, or 677 schools, running with less than 50 students, as the final draft of the Bangladesh Primary Education Annual Sector Performance Report 2017 says — points to failures of the government in its primary education management. Such a sorry situation of the schools shows that they are faced with poor classroom teaching, inadequate number of teachers and lack of oversight, which together have pushed students to kindergartens.

The highest number of students in a single government primary school, as the primary education performance report draft says, is 3,768 while the lowest number of three students in a single school is in Barisal. While in many of the cases, poor learning in government primary schools has pushed students to kindergartens — as the number of kindergartens increased from 10,537, with more than 1.2 million students, in 2012 to 20,601, with more than 2.23 million students, in 2017 — in many others, what may be the case is that the government has set up schools without assessing the need for the schools in many areas.

Whatever the reasons are for the plight of these schools, the situation now calls out education managers, or the government for that matter, on doing a school mapping so that some of them could be merged, if not closed, to better use the available resources for education. 

There are schools in some areas set up on political considerations, which is echoed in the statement of the director general of the primary education directorate who said that many of the schools have been founded by influential quarters, which makes it tough for the government to merge them. But the government needs to rise above partisan considerations in righting the wrong that has happened in the primary education sector. Against this backdrop, the government planning to set up 1,000 more primary schools, as the finance minister said in his budget speech for the 2019 financial year, would only compound the situation unless the government first does the needs assessment. 

The government, through the Bangladesh Bureau of Educational Information and Statistics, should immediately launch a survey to assess the needs in view of the locations and consider the school-going age population, between six and 14 years, in areas of the locations to better plan the establishment or merger of schools.

When the government has plans to set up 1,000 more schools after it has just finished setting up 1,500 more primary schools, it has become imperative for the government to first look into the needs of the existing schools vis-à-vis locations and school-going age population of the areas. There is no denying that the nation needs more schools, but it needs them where they are needed, and in an improved environment with better facilities, so that people can send their children to government schools. The government must attend to the failures in its primary education management.

  • Courtesy: New Age/ Editorial /Jul 15, 2018

Saturday, July 14, 2018

উন্নয়নের গোপন রহস্য...


রুমীন ফারহানা

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের রাজনীতির ভাষা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে — সরকারি দলের সভা-সমাবেশ, প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে শুরু করে পাতিনেতার নির্বাচনি প্রচারণা, টক শো, সরকারি বিজ্ঞাপন, স্থানীয় থেকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্রই যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তা হলো ‘উন্নয়ন’। বাংলাদেশ নাকি এমনই উন্নতি করেছে যে, বিশ্বের তাবৎ মোড়ল রাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়নের রহস্য জানতে চায়।

গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ২০১৪ সালের পট পরিবর্তনের পরে, উন্নয়নকে সুপরিকল্পিতভাবে গণতন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফেলা হয়েছে। যেন একটি থাকলে অন্যটি না থাকলেও চলে। উন্নয়নের যে তত্ত্ব আওয়ামী লীগ হাজির করেছে তা হলো ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’, ‘সীমিত গণতন্ত্র’ কিংবা ‘বেশি উন্নয়ন, কম গণতন্ত্র’ ইত্যাদি। এসব অবশ্য আমাদের কমবেশি জানা। কারণ আইয়ুব খান তার সামরিক শাসনের সময়ও এ ধরনের একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন। সেই সামরিক জান্তারও ‘উন্নয়ন’ শব্দ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ ছিল। এমনকি উন্নয়নের দশকও পালন করেছিলেন তিনি। যদিও অবশ্য এর পরপরই তার পতন ঘটে।

আরও একটি মজার তত্ত্ব সরকার আবিষ্কার করেছে। উন্নয়নের জন্য নাকি সরকারের ধারাবাহিকতা আবশ্যক। অর্থাৎ উন্নয়ন চাইলে একই সরকারের বারবার ক্ষমতায় থাকা জরুরি, সেটা যে কায়দায়ই হোক না কেন। এর পেছনে কী প্রমাণ আছে তা সরকারই ভালো বলতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, উন্নত দেশগুলোতে এমনকি ঘরের পাশে ভারতেও সরকার আসে সরকার যায়। তাতে উন্নয়নে কোনও ব্যাঘাত ঘটে বলে শোনা যায় না। সরকারের মতে, পরিবর্তন মানেই উন্নয়নের পথে হোঁচট খাওয়া। উন্নয়নের এ নতুন তত্ত্ব স্বাভাবিকভাবে কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন—

১. উন্নয়ন বলতে কী বোঝায়?
২. গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক কী?
৩. একটি অপরটির বিকল্প হতে পারে কিনা?
৪. গণতন্ত্র ও সুশাসন ছাড়া উন্নয়ন কতটা টেকসই হতে পারে?
৫. উন্নয়নের দোহাই পেড়ে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষায় যে কোনও উপায় অবলম্বন কতটা যুক্তিযুক্ত?
৬. গণতন্ত্রের বিকল্প কী হতে পারে?
৭. সবচেয়ে জরুরি হলো মানুষ আসলে কী চায়?

গত কয়েক বছরে সরকারের যে প্রচার-প্রচারণা, তাতে মনে হতেই পারে উন্নয়ন মানেই প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি ও কিছু ব্রিজ, ফ্লাইওভার নির্মাণ অর্থাৎ অবকাঠামোগত উন্নয়ন। মজার বিষয় হলো— এর সঙ্গে সুশাসন, মানুষের জীবনযাত্রার মান, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আইনের শাসন, বৈষম্য বৃদ্ধি, দারিদ্র দূরীকরণের হার কমে আসা, সর্বস্তরে জবাবদিহিতার অভাব, অর্থনৈতিক খাতের চরম নৈরাজ্য, বিচারহীনতার বিষয়গুলো সচেতনভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে আলোচনার বাইরে। যে উন্নয়ন সাধারণ মানুষের জীবন স্পর্শ করে না, সেই উন্নয়ন কোনোভাবেই সার্বিক অর্থে কল্যাণকর হতে পারে না।

‘সাপ্তাহিক’-এর ৪ জানুয়ারি ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর ২০১৭-১৮ সালের অর্থনৈতিক পর্যালোচনা বলছে— যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দাবি করা হচ্ছে, তার সঙ্গে জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বৈষম্য আর কমেছে দারিদ্র্য দূরীকরণের হার। যাকে সহজ ভাষায় বললে দাঁড়ায়— এখানে ধনী আরও ধনী হচ্ছে, দরিদ্র হচ্ছে দরিদ্রতর। যেখানে ২০০৫ থেকে ২০১০ সালে দারিদ্র্য দূরীকরণের হার ছিল গড়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে তা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ২ শতাংশে। একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে, অতি দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রেও। যা ২০০৫ থেকে ২০১০ সালে ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ, সেটাই ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে কমে এসেছে ০ দশমিক ৮ শতাংশে।

গবেষণা বলছে— দেশের দরিদ্রতম ১০ শতাংশ লোক যেখানে ২০১০ সালে মোট জাতীয় আয়ের ২ শতাংশের অধিকারী ছিল, ২০১৬ সালে তা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ০১ শতাংশে। অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ লোক ২০১০ সালে মোট জাতীয় আয়ের ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশের মালিক হলেও ২০১৬ সালে তারা ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ আয়ের অধিকারী হয়। আরও সহজ ভাষায় বলতে গেলে, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বলছে— বাংলাদেশে গত ছয় বছরে জিডিপি বৃদ্ধির দিনগুলোতে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। আর সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে ১ হাজার ৫৮ টাকা।

কথায় কথায় এখন বলা হয় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা। মাথাপিছু আয় আরেক শুভঙ্করের ফাঁকি। এখানে হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ারবাজার লুটেরা, সরকারি, বেসরকারি ব্যাংকের বড় বড় ঋণখেলাপির অবিশ্বাস্য অঙ্কের লুটের সঙ্গে গড় করা হয় দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, গার্মেন্ট কর্মী আর রিকশাচালকের আয়। এতে না স্পষ্ট হয় লুটেরা শ্রেণির অবিশ্বাস্য লুট, না বোঝা যায় শ্রমজীবী মানুষের দৈন্যদশা। পুরোপুরি লেজেগোবরে কাণ্ড।

উন্নয়নের এই রাজ্যে বিনিয়োগ থাকে স্থবির হয়ে আর লাফিয়ে বাড়ে বেকারের সংখ্যা। পরিসংখ্যান বলছে, ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ। দেশে তৈরি হয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আর দেশে কাজ না পেয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় ১ কোটির ওপর মানুষ। যাদের কাঁধে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি, যাদের ঘামেভেজা টাকায় আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখি, সেই প্রবাসী শ্রমিক, গার্মেন্ট কর্মী আর কৃষকের জীবনমানের কোনও উন্নতি হয় না।


বলে রাখা ভালো, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরির শীর্ষে আছে বাংলাদেশের নাম। বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে গিয়ে ১৩ বছরে লাশ হয়ে ফিরেছেন ৩৩ হাজার শ্রমিক। প্রতিদিন সংবাদের বড় অংশ জুড়ে থাকে সৌদি আরব থেকে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার খবর। তাদের অনেকে লাশ হয়ে, কেউবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফিরেছেন। রানা প্লাজার বীভৎসতা বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কতটা অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করে আমাদের কর্মীরা। সবচেয়ে কম মজুরি আর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কাজ করে বাংলাদেশের শ্রমিক। যেকোনও উৎসবে মালিক যখন প্রমোদভ্রমণে যান, তখনও হয়তো শ্রমিকের তিন মাসের বেতন বাকি। কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না আর সরকার খাদ্য উদ্বৃত্তের গল্প শোনায় মানুষকে। দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যায্য আন্দোলন করতে গিয়ে কৃষকের সন্তান খায় হাতুড়ির বাড়ি, যায় রিমান্ডে, শোনে ৩৮ টাকায় খাবার আর ১৫ টাকায় বাসস্থানের খোটা। সরকারের একবারও মনে পড়ে না এই সাধের বিশ্ববিদ্যালয় চলে আমাদের টাকায় যেখানে মিশে আছে কৃষক, শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষের ঘামেভেজা রক্ত জল করে আনা টাকা।

জনগণের টাকায় একদিকে লুটেরা শ্রেণি বছরে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার করে আর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে বছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা রেমিটেন্স পাঠান আমাদের প্রবাসী ভাইরা। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বলছে— গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা, যা আমাদের জাতীয় বাজেটের দুই গুণ। আন্তর্জাতিক ঝুঁকি যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে— বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে। যদিও রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন পাচ্ছে ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষেরা। আইন করে ব্যাংকগুলো তুলে দেওয়া হচ্ছে এক একটি পরিবারের হাতে। মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে ব্যাংক। এখন ব্যাংকের নীতি নির্ধারিত হয় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকের (বিএবি) মাধ্যমে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি কার্যকর করে মাত্র। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তো নিজের ভারবহনে সক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। নজীরবিহীনভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নাই হয়ে গেছে ৮০০ কোটি টাকা, যার বিচার তো দূরস্থান, তদন্ত রিপোর্ট পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। এদিকে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপী ঋণ নিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ।

সরকারের লোক কথায় কথায় চীন ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টেনে বলতে চায়, সেখানে তো গণতন্ত্র নেই, কিন্তু উন্নয়ন হচ্ছে। এখানে মনে রাখা দরকার, সেসব দেশে গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকলেও উন্নয়ন হয়েছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। অন্যদিকে পৃথিবীর বহু দেশ আছে যেখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন দুটোরই ঘাটতি ছিল। ফলে উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়েছে। যেমন ফিলিপাইন কিংবা জিম্বাবুয়ে। সেইসব দেশের মতো বাংলাদেশেও গণতন্ত্র আর সুশাসনের চরম ঘাটতি আছে। প্রশ্ন জাগে, এত উন্নয়নের পরও সরকার কেন বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে পারছে না? এটা প্রমাণিত যে সুশাসনের অভাব মানুষকে নিরাপত্তাহীন করে বিনিয়োগ বিমুখ করে তোলে। গণতন্ত্র আর সুশাসনহীন উন্নয়নের ছোট্ট একটি উদাহরণ হলো— বিশ্বে নজিরবিহীন ব্যয়বহুল রাস্তা নির্মাণ হয় বাংলাদেশে, অথচ সবচেয়ে খারাপ রাস্তার তালিকায় এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, ঘরে ঘরে উন্নয়নের খবর পৌঁছে দিতে। বলেছেন, যত উন্নয়ন তিনি করেছেন তাতে মানুষের ভোট না দেওয়ার কোনও কারণ নেই। ভোট না দিলে বুঝতে হবে উন্নয়নের প্রচার সঠিকভাবে হয়নি। প্রকৃত উন্নয়ন যা গণমানুষের জীবনকে উন্নত করে তা প্রচারের জন্য মাইক বা বিলবোর্ড লাগে না। মানুষ আপনাআপনি তার সুফল পায়, মনেও রাখে।

কিন্তু যে উন্নয়ন কেবল গুটিকয়েক মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে, যাতে সাধারণ মানুষের প্রতি বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই জোটে না, তেমন উন্নয়নের প্রচার যত জোরেই হোক না কেন তা মানুষকে স্পর্শ করে না। গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন ও ন্যায্যতা ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় কাজ না করে যতই দুর্নীতি আর লুটপাট সহযোগী অবকাঠামোগত উন্নয়নের গল্প শোনানো হোক না কেন, মানুষ কিন্তু ঠিকই বোঝে। কিছু মানুষকে হয়তো কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো যায়। কিন্তু সব মানুষকে সবসময় বোকা বানানো অসম্ভব।


  • লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
  • কার্টসি — banglatribune.com 


Wednesday, July 11, 2018

ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক বিশিষ্টজনদের


বর্তমানে দেশে এক ধরনের বিচারহীন ও জবাবদিহিতা শূন্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান রাষ্ট্র ও সরকার কঠোর থেকে কঠোরতর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে রেখেছে। জনগণের সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামকে পুলিশি নির্যাতন ও দলীয় পেটোয়া বাহিনী (গুন্ডাবাহিনী) দিয়ে দমন করে রাজনৈতিক মতামতকে সংকুচিত করে রেখেছে। এর জন্য নাগরিকদের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধের সংগ্রাম করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন দেশের বি‌শিষ্টজনেরা। 

বুধবার, ১১ জুলাই, দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় কমিটি আয়োজিত ‘ফ্যাসিবাদ ও জনগণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস রুখে দাঁড়াও’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন।

সম্প্রতি কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও সরকারের পেটোয়া বাহিনী ছাত্রলীগের বর্বর হামলা, নির্যাতন, গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, আহতদের চিকিৎসায় সরকারি কর্তৃপক্ষের বাধা দেয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আলোচকগণ ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদালয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা এবং নির্যাতনকারীদের রক্ষা করে তাদের সহায়তা করার তীব্র নিন্দা জানান। 

বৈঠকে বক্তারা বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে র‌্যাব-পুলিশ বাহিনী দিয়ে সারা দেশে এ পর্যন্ত ১৬৩ জনকে বিনা বিচারে ও পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। এখনও সেটি চলমান রয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের লাগামহীন দুঃশাসন ও লুটপাটের অপরাধকে আড়াল করতে এক ধরনের ত্রাস সঞ্চারের জন্য বিনা বিচারে মানুষ খুন করার এই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।’ 

বামপন্থি তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বদরুদ্দীন ‍উমর বলেন, ‘আমাদের দেশে বর্বরোচিত যেসব কাজ হচ্ছে সেগুলো বিশ্বের অন্য কোনও দেশে হচ্ছে না। আজকে যারা ব্যবসায়ী শ্রেণি, যারা লুটপাট করছে তারাই দেশের শাসক শ্রেণি। তারা নিজেদের চুরির টাকা দিয়ে নমিনেশন নিয়ে ভোট লুট করে ক্ষমতায় বসছেন।’

তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ একটা গুন্ডাবাহিনী। তারা নানা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হলো তাদের পেছনে শেখ হাসিনা রয়েছে।’ 

সরকার নির্বাচন কমিশনকে শেষ করে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেশের সরকার পরিবর্তনের কোনও অবস্থা নেই। নির্বাচন কমিশনকে অকার্যকর করে শেষ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। জনগণের ভোটে নয়, আগামী নির্বাচনে জিততে হলে অন্য কিছু করতে হবে। তা না হলে এই সরকার আবার ক্ষমতায় আসবে। বর্তমানে দেশের মানুষ একটি আগ্নেয়গিরির উপরে আছে, জনগণ এখন শুকনো পাতার মত হয়ে গেছে। তাই সরকারের এসব নিপীড়নের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারে না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বড় শয়তান হচ্ছে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সংগীতশিল্পীরা। জনগণ কোনও প্রতিরোধ গড়লে র‌্যাব-পুলিশ পেটায়, ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক শ্রেণির মানুষেরা প্রতিরোধ যেন গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য ভেতরে ভেতরে কাজ করছে। তারা প্রতিরোধের গোড়া মেরে দিচ্ছে। এরা পাকিস্তান আমলেও খেয়েছে, এখনও খাচ্ছে। এরাই আবার আজীবন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাচ্ছে। কিন্তু মৃত্যুর পরে কী হবে তাদের? এরাই দেশের বড় ক্ষতি করছে।’ 

বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘অপরাধের প্রতি জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়ে চিহ্নিত ও প্রমাণিত অপরাধীর সাজা রাষ্ট্রীয়ভাবে মাফ করে তাকে নিরাপদে দেশত্যাগ করার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। নজিরবিহীন দুর্নীতি ও লুটপাটকারীদের বিচার না করে এবং মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে সরকার। অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে এই ভণ্ডামিই সরকার জনগণের সামনে তুলে ধরে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে।’

দেশের নাগরিকদের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করে তাদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান ও মৌলিক অধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা করারও দাবি জানান তিনি।

বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘যে নেক্কারজনক ঘটনা আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, তার জন্য শিক্ষক হিসেবে আমি লজ্জিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পচন ধরেছে, আমরা একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করি। শিক্ষার্থীরা বলছে- হলে থাকতে হলে বড় ভাইদের পা ধরতে হয়। বড় ভাইদের প্রটোকল মেনে চললেও উঠতে-বসতে চড়-থাপ্পড় খেতে হয়। শুধু তাই নয়, বর্তমানে ছাত্র নেতাদের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার নজিরও রয়েছে। এতে ছাত্র নেতারা মাথায় চড়ে বসছে। কোটার দাবি শুধু চাকরি পাওয়ার দাবি নয়, এটি সংবিধান স্বীকৃতির দাবি। তরুণ সমাজ আজ জেগে উঠেছে।’

তিনি বলেন, ‘নীরব একটা ষড়যন্ত্র চলছে, আমরা সবাই এর সাথী, মিডিয়াও এর সাথী। যে রাষ্ট্র যত বেশি লাঠিপেটা করবে সেটাই ওই রাষ্ট্রের জনবিচ্ছিন্নতার তত প্রমাণ।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম. নূরুন্নবী বলেন, ‘আমাদের দেশে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। তবে দেশে সত্যিকার অর্থে কোনও গণতন্ত্র নেই আজ। একটা দল সংবিধানের কথা বলে বলে অন্য দলকে ঠেকাচ্ছে। অথচ তারা নিজেরাই সংবিধান বিরোধী কাজ করছে। বর্তমান সরকার নিজেই সংবিধান বিরোধী। এখন এলাকার গলির সন্ত্রাসী কর্যাক্রম সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে চলে গেছে। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এটা লোভ দেখানো, এটা সার্থক হবে না। কারণ যারা মাদকের মূলহোতা সরকার তাদের আইনের আওতায় আনছে না।’ 

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘মাদকবিরোধী অভিযানের নামে শত শত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। অন্তত ৩৫ হাজার মানুষকে জেলে ভরে রাখা হয়েছে।’ 

তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কারের আন্দোলন এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় আন্দোলন। কিন্তু এটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারছি না। এটাকে ধরে রাখতে পারছি না। যারা মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভাঙিয়ে চলছে, তারা এটি হতে দিচ্ছে না।’ 

আয়োজক সংগঠনের সভাপতি বদরুদ্দীন উমরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আকরাম হোসেন, মানবাধিকার কর্মী শিরীন হক ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ নেতা বিনায়ন চাকমা প্রমুখ।
  • কার্টসিঃ ব্রেকিং নিউজ বিডি/ জুলাই ১১,২০১৮  

‘আমার মণিকে তোমরা বাঁচতে দাও, মুক্তি দাও’

রাশেদের মায়ের আর্তনাদ

ছেলের মুক্তির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন রাশেদের মা সালেহা খাতুন। গতকাল শাহবাগে। 

ঝিনাইদহের সালেহা বেগম এর আগে কখনো ঢাকায় আসেননি। এবারই প্রথম। ছেলের হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়ার সুযোগ তাঁর হলো না। এর আগেই চিনতে হলো ডিবি অফিস, ডিএমপি, শাহবাগ থানা, সিএমএম কোর্ট। তিনি এখন ভিক্ষা চান ১০ দিনের জন্য পুলিশি রিমান্ডে থাকা একমাত্র ছেলে রাশেদ খানকে। ছেলেহীন এই শূন্যতার হাহাকার থেকে তিনি মুক্তি চান।

সালেহা বেগমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল গতকাল মঙ্গলবার, শাহবাগের একটি খাবারের দোকানে বসে। শুরুতেই হাত জোড় করে বললেন, ‘আমার মণিকে তোমরা মাফ করে দাও। ভিক্ষা দাও। আমার মণিকে আমি ঢাকায় আর রাখব না গো। গ্রামে নিয়ে চলে যাব। শুধু মুক্তি দাও। সেও বাঁচুক। আমিও বাঁচি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষার্থী রাশেদ খানকে সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয় থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কার্যালয়ে নেওয়া হয়। এক ঝলক দেখার জন্য সকাল থেকে সালেহা বেগম দাঁড়িয়ে ছিলেন ডিবি অফিসের ফটকে। দেখে মনে হয়েছে, ছেলে ভালো নেই। সর্বস্ব দিয়ে যে ছেলেকে মানুষ করেছেন, তাঁর যে এমন হাল হবে স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। তিন-তিনটি মামলার আসামি এখন রাশেদ খান। তিনি কি মুক্তি পাবেন? কখনো কি তাঁর কায়ক্লেশে চলা সংসারের দায়িত্ব একমাত্র এই ছেলেটি বুঝে নেবেন? এমন হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘোরে সালেহার। কূলকিনারা পান না। শুধু চান, ছেলে ফিরে আসুক।


সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে তৈরি ছাত্রদের মঞ্চ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান। বাবা নবাই বিশ্বাস রাজমিস্ত্রি, মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। রাশেদের দুটি বোন। একজন তাঁর বড়, অন্যটি ছোট। শ্রমজীবী দম্পতি দাঁতে দাঁত চেপে সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করে গেছেন। রাশেদ খান এতকাল তাঁদের বিমুখ করেননি।

সালেহা বেগম বলছিলেন, ছেলে পঞ্চম, অষ্টম, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে সরকারি ও ব্যাংকের বৃত্তির টাকা পেয়েছেন। আর বাকিটা তাঁরা জুগিয়েছেন ঘাম ঝরিয়ে। ‘এমনও দিন গেছে, রাশেদের আব্বা হয়তো বাজার থেকে পাঁচ কেজি চাল কিনে এনেছে। পরে ছেলে ফোন করে বইখাতা কিনতে টাকা চেয়েছে। চাল ফিরিয়ে দিয়ে তিনি ছেলেকে টাকা পাঠিয়েছেন। শুধু পানি খেয়ে আমরা রাত পার করেছি। এমবিএ ভর্তির সময় ছাগল বিক্রি করেছি। ভেবেছিলাম, পড়াশোনা শেষ। কষ্টের দিনও শেষ। হলো না।’

এখন এই যে তিনি ঢাকায় এলেন, ছেলের জন্য ছোটাছুটির খরচ কী করে চলছে? সালেহা বেগম জানান, ছেলের বাবার কিডনিতে সমস্যা। অস্ত্রোপচারের জন্য কিছু টাকা জমিয়েছিলেন। সেই টাকা ভেঙে ভেঙেই এখন চলছে।

রাশেদ খানের নামে জটিল সব মামলা। মায়ের মাথায় ধরে না। কথার ফাঁকে সালেহা বেগম মামলার কাগজপত্র এগিয়ে দিলেন। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মামলা একটি। এর বাইরে পুলিশের অভিযোগ, রাশেদের প্রত্যক্ষ মদদে, পরিকল্পনায় ও নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা ৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টা থেকে ২টার মধ্যে হাতে লোহার রড, পাইপ, হ্যামার, লাঠি নিয়ে বেআইনি ‘জনতাবদ্ধে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে অনধিকার প্রবেশ করে ভাঙচুর ও মালামাল চুরি করে নিয়ে যান। তাঁর নির্দেশেই ভিসির বাসভবনের আসবাব ভাঙচুর করে আগুনে পুড়িয়ে দেন, সিসি ক্যামেরার রেকর্ড সংরক্ষণের যন্ত্র (ডিভিবার) নষ্ট করে ফেলেন। কোনো স্বার্থান্বেষী মহলকে বিশেষ সুবিধা করে দিতে রাশেদ এসব অপকর্ম করেছেন।

সালেহা বেগম গতকাল বলেন, ‘আমার মণি তো কোনো অন্যায় করেনি। সে শুধু একটা চাকরি করতে চেয়েছিল। সে তো সরকারি চাকরিই করতে চেয়েছিল। সরকারকে ফেলতে যাবে কেন?’
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ১১,২০১৮ 

Tuesday, July 10, 2018

চাপে পড়ে ছেলের হত্যা মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন মা


থানায় হত্যার পর এক কিশোরকে ক্রসফায়ারে নিহত দেখানোর গুরুতর অভিযোগ উঠেছে ওয়ারী থানার পুলিশের বিরুদ্ধে। তবে পুলিশের দাবি, গত ৬ এপ্রিল রাতে ওয়ারীর টয়েনবি সার্কুলার রোডের একটি গলিতে ডাকাতির প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পুলিশ অভিযান চালায়। পুলিশ ও ডাকাতদের পাল্টাপাল্টি গুলির মধ্যে ডাকাতদের একজন মারা যায়। 

পুলিশ বলছে, নিহত ব্যক্তির নাম ‘ছোট’ রাকিব। বয়স ২২ বছর। খুনসহ একাধিক ছিনতাইয়ের মামলায় তাঁর নাম আছে। কিন্তু নিহত রাকিবের পরিবারের দাবি, তার বয়স ১৫ বছর এবং নাম রাকিব হাওলাদার।

এ ঘটনায় নিহত রাকিবের মা রীতা হাওলাদার গত ১১ এপ্রিল পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলা করেছিলেন। আসামি ছিলেন ওয়ারী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম, থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সেলিম, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জ্যোতিষ চন্দ্র রায় ও পুলিশের সোর্স মোশাররফ হোসেন। বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছিল। পরে পুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং ওপর মহলের প্রচণ্ড চাপের মুখে মা-ই কিশোর সন্তানের হত্যা মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। যদিও আদালতে তিনি বলেছেন, তাঁর ছেলেকে খুন করা হয়েছে। তাঁর কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। তিনি আল্লাহর কাছে বিচার চান। আদালত ইতিমধ্যে মামলার সব আসামিকে অব্যাহতি দিয়েছেন। 

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘যদি ধরে নিতে হয় রাকিবের মা ভয়ে পিছিয়ে গেছেন, আর মামলা চালাতে চাননি, তাহলে এটাও আমাদের জন্য অশনিসংকেত।’ অন্যদিকে, চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবদুল হালিম বলেন, ‘পুলিশ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভয়ভীতি দেখানোর পরিপ্রেক্ষিতে যদি মামলা প্রত্যাহার হয়ে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব ছিল বিষয়টি তদন্ত করার।’ 

ঘটনা যেভাবে ঘটে 

নিহত রাকিবের পরিবার ও প্রতিবেশীরা বলছেন, দুটি সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছে রাকিব। তার বিরুদ্ধে ওয়ারী থানায় একটি ছিনতাইয়ের মামলা আছে। কোনো হত্যা মামলা নেই। রাকিবের পরিবার বলছে, ওয়ারী থানার এএসআই জ্যোতিষ চন্দ্র রায় গত ৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টার দিকে কাপ্তানবাজার মুরগিপট্টির মোড় থেকে তাকে ধরে নিয়ে যান। খবর পেয়ে রাকিবের মা রীতা হাওলাদার পরদিন থানায় যান এবং ছেলেকে সেখানে দেখতে পান। তিনি জ্যোতিষ চন্দ্র রায়ের কাছে ছেলেকে ধরে আনার কারণ জানতে চান। জ্যোতিষ রায় তাঁকে বলেন, রাকিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দেবেন। রাকিবের বাবা মহসিন হাওলাদারও মোবাইলে কথা বলেন এএসআই জ্যোতিষের সঙ্গে। থানায় আরেক পরিচিত এসআই শাহ আলমকে ঘটনা জানিয়ে সহায়তা চান রাকিবের মা।

আদালতে দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছিল, বাদী রীতা হাওলাদার থানায় যখন এএসআই জ্যোতিষের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন ওসির কক্ষ থেকে রাকিবের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। রাকিবের মা থানায় আছেন—এমন তথ্য গিয়ে ওসিকে জানান জ্যোতিষ। রীতা হাওলাদার ওসি রফিকুলের কক্ষে গিয়ে দেখতে পান, রাকিবের মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা। পরনে প্যান্ট নেই। শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন। ওসি রফিকুল এবং ওসি (তদন্ত) সেলিম তাঁর ছেলে রাকিবকে লাথি মারছেন। পরে এএসআই জ্যোতিষ, ওসি (তদন্ত) সেলিম ও সোর্স মোশাররফ থানা থেকে রাকিবের মাকে চলে যেতে বলেন। পরদিন রীতা হাওলাদার থানার কনস্টেবল মো. আলীর কাছে রাকিবের জন্য এক প্যাকেট খাবার দেন। কিন্তু ওসি সেই খাবার ফেরত দেন এবং জানাতে বলেন, থানায় রাকিব নামের কেউ নেই।

রাকিবের মা রীতা প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেকে কিছু খাওয়াতে চান বলে তিনি জ্যোতিষকে জানান। জ্যোতিষ তুইতোকারি করে তাঁকে থানা থেকে চলে যেতে বলেন। রাকিবকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে জ্যোতিষ বলেন, ‘তোর ছেলের কাছে অনেক তথ্য আছে। তথ্য নেওয়ার পর ছেড়ে দেব।’ থানা থেকে চলে না গেলে তাঁকে গ্রেপ্তার করার হুমকি দেন ওসি (তদন্ত) সেলিম। এরপর ভয়ে তিনি চলে আসেন। সেদিন সন্ধ্যা সাতটার পরে আর থানায় ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হলে এএসআই জ্যোতিষ বলেন, ‘আমি কোনো কথা বলব না। এ ব্যাপারে যা বলার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলবে।’

পরদিন ৬ এপ্রিল শুক্রবার সকালে রীতা হাওলাদার আবার থানায় যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘থানার গেটে পৌঁছে শুনি, লোকজন বলাবলি করছে, আহা রে, ছেলেটারে মাইরা ফেলাইছে। থানা এখন ধুইতাছে। মরাটারে জয়কালী মন্দিরের কাছে নিয়ে আবার ক্রসফায়ার দিছে।’ রীতা হাওলাদার বলেন, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলের লাশ গ্রহণের সময় দেখতে পান, ছেলের ডান হাত ভাঙা, মাথা ফাটা, পেটে আঘাতের চিহ্ন ও দুটি পায়ের জোড়াগুলো থেঁতলানো।

বাদী জানান, যেদিন মামলা করা হয়, সেদিনই তাঁকে আদালত এলাকা থেকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। পুলিশ মারধর করে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়েছে বলে আদালতে অভিযোগ করেন রাকিবের মা। আদালতকে লিখিতভাবে তিনি জানান, ১৯ এপ্রিল বিকেলে এসআই জাকির হোসেনের নেতৃত্বে ৮ থেকে ১০ জন তাঁর বাসায় এসে কাগজে ও স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করতে বলেন। রাজি না হলে বাদী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে বাদীর চোখে আঘাত লাগে। জোর করে সই নিয়ে যায়। আদালতের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে বাদী সেদিন বলেন, আসামিরা থানার দায়িত্বে থাকলে তাঁর পক্ষে আর মামলা চালানো কিংবা সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে হাজির করা সম্ভব নয়।

পুলিশের দাবি, ওয়ারী থানার টিপু সুলতান রোডের কাছে টয়েনবী সার্কুলার রোডে ডাকাতদের গুলিতে নিহত হয় রাকিব। ছবি: আবদুস সালাম

এরপর ১০ মে বাদী মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। অবশ্য এর আগে গত ৩০ এপ্রিল বিচারকের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বাদী রীতা বলেছেন, রাকিবকে হত্যা করা হয়েছে। আবার এটাও বলেছেন, আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই তাঁর। মামলা তোলা প্রসঙ্গে রীতা প্রথম আলোকে বলেছেন, মামলা করার পর পুলিশ যে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিয়েছিল, তা লিখিতভাবেই তিনি জানিয়েছিলেন। বড় বড় জায়গা থেকে চাপ এসেছে। মামলা না তুললে এলাকায় থাকতে পারবেন না বলে হুমকি দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে আদালতের কাছে তিনি বলেন, রাকিবকে হত্যা করা হলেও আর মামলা চালাতে চান না। আল্লাহর কাছেই তিনি বিচার চান।

মামলার পর গত ১৪ মে ওয়ারী থানার ভিডিও ফুটেজ (৪ এপ্রিল দিবাগত রাত ১০টা থেকে ৬ এপ্রিল সকাল ৮টা) সিডি আকারে আদালতে জমা দেওয়ার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী জোনের উপকমিশনারকে (ডিসি) নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে থানার সব পুলিশের নাম ও ছবি জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কর্মকর্তা। উল্লিখিত সময়ে কোন পুলিশ সদস্য কী গাড়িতে কী পোশাকে দায়িত্বরত ছিলেন, সেই তালিকাও চান আদালত। পাশাপাশি নিহত রাকিবের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাগজ চান আদালত।

এ ব্যাপারে ওয়ারী জোনের ডিসি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আদালত যা চেয়েছিলেন, সবই দেওয়া হয়েছে। পুলিশের পাঠানো রাকিবের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, তার বিরুদ্ধে (রাকিব) থাকা মামলার কাগজপত্র, সহযোগী আসামিদের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি মহানগর দায়রা আদালতে পাঠানো হয়।

যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে ওয়ারী থানার কোনো ভিডিও ফুটেজ আদালতে দেওয়া হয়েছিল কি না, তা প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।

৫ জুলাই রীতা হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা করার পর পুলিশ হত্যার হুমকি দিয়েছিল মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য। প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও চাপ দিয়েছিলেন মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য, না ওঠালে এলাকাছাড়া করবেন। বাধ্য হয়ে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছিলাম। কিন্তু আদালতে বলে এসেছি, আমার ছেলে রাকিবকে থানাতে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। আমি বিচার চাই। আবার আমি মামলা চালাতে চাই।’

রীতার আইনজীবী মোশতাক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর থেকে পুলিশ বাদীকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়েছে। বিষয়টি আদালতকেও জানানো হয়েছে। পাশাপাশি আপস করার জন্য তাঁকে চাপ দেওয়া হয়।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর হাকিম মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূর বাদী রীতা হাওলাদার এবং রীতার বাবা আবদুল লতিফ সরকারের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। গত ২৩ মে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অভিযোগকারীর মামলা প্রত্যাহারের দরখাস্ত হতে প্রতীয়মান হয় যে অভিযোগকারী মামলা চালাতে আগ্রহী নন।’

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ জুন আদালত বলেছেন, বিচার বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলা প্রত্যাহারে বাদীর দরখাস্ত থেকে প্রতীয়মান যে বাদী মামলা চালাতে আগ্রহী নন। পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যালোচনায় দেখা যায়, মামলাটি অগ্রসর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, অগ্রসর হলেও মামলার কোনো ফলাফল হবে না। মামলাটি নথিজাত করে আসামিদের অব্যাহতির আদেশ দেন আদালত।


রাকিবের মায়ের দাবি, ওয়ারী থানায় রাকিবকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। ছবি: আবদুস সালাম

মামলা প্রত্যাহারে চাপ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তৎকালীন ওসি রফিকুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কাউকে কোনো চাপ দেওয়া হয়নি।’ বর্তমানে রাজধানীর বাড্ডা থানায় ওসির দায়িত্বে আছেন। 

রাকিব হাওলাদারের নানা আবদুল লতিফ সরকার ওয়ারীর ৩৮ নম্বর ওয়ার্ল্ডের কাপ্তানবাজার ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি। ২০ বছর ধরে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন। লতিফ সরকার বলেন, ‘আমাদের নেতা মহিউদ্দিন মহী ভাইয়ের ভাগনে তালহা খুনে জড়িত ছিল রাকিব নামের এক ছিনতাইকারী। কিন্তু পুলিশ আমার নিরীহ নাতি রাকিবকে থানায় ধরে নিয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলে। পরে ক্রসফায়ার দেখিয়েছে। বাস্তবে সে তালহা খুনে জড়িত ছিল না। মামলা প্রত্যাহার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন আপস করতে। পুলিশও কথা বলেছে। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, নানা চাপ ছিল।’

আসামি মোশাররফ ও কিছু প্রশ্ন

রাকিবের বাবা মহসিন হাওলাদার ডিজিটাল ব্যানার তৈরি করেন। তিনি দুটি সিনেমায় অর্থ লগ্নি করেন। কিন্তু দুটিতেই বড় লোকসান হওয়ায় একেবারে পথে বসে যান। বছর তিনেক আগে জয়কালী মন্দিরের সামনের রাস্তায় একটি টং দোকান তুলে ছেলে রাকিবকে বসিয়ে দেন। সে দোকানে চা, কলা, বিস্কুট বিক্রি করত। একই জায়গায় পুলিশের সোর্স মোশাররফেরও দুটি অবৈধ দোকান আছে। জয়কালী মন্দিরসংলগ্ন এলাকায় হানিফ উড়ালসড়কের নিচ ও আশপাশে এমন ৩০-৩৫টি টং দোকান আছে। দোকানগুলো থেকে থানা-পুলিশের হয়ে প্রতিদিন ৩০ টাকা করে চাঁদা তোলেন মোশাররফ।

রাকিবের মা দাবি করছেন, বছর দেড়েক আগে সোর্স মোশাররফ তাঁর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ধার নেন। কিন্তু টাকা শোধ করতে গড়িমসি করায় বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে তিনি মোশাররফকে অপমান করেন। এরপর থেকে মোশাররফ তাঁদের পেছনে লাগেন। রাকিবের বাবা মহসিনের দাবি, প্রতিদিন চাঁদা দিলেও মোশাররফের সঙ্গে সমস্যা হওয়ার পর থেকে ওয়ারী থানা-পুলিশ একাধিকবার তাঁর টং দোকানের বিরুদ্ধে নন-প্রসিকিউশন (অধর্তব্য) মামলা করেছে। এসব মামলায় আদালত ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা জরিমানা করতে পারেন। আর আসামি হাজির না হলে পরোয়ানা জারি করেন। রাকিবের বাবার নামে এমন একটি পরোয়ানাও ছিল।


রাকিবের পরিবার বলছে, শিশু শিল্পী হিসেবে রাকিব দুটি সিনেমায় অভিনয় করেছে। ছবি: সংগৃহীত


সরেজমিনে দেখা যায়, রাকিবের মৃত্যুর পর থেকে হানিফ উড়ালসড়কের নিচে থাকা সোর্স মোশাররফের দোকান বন্ধ রয়েছে। এক মাস ধরে তাঁকে এলাকায় দেখাও যাচ্ছে না। সেখানে অন্য একাধিক টং দোকানের মালিক প্রথম আলোকে জানান, সোর্স মোশাররফ তাঁদের কাছ থেকে প্রতিদিন ৩০ টাকা করে চাঁদা নেন। দোকান থেকে চাঁদা তোলার কথা স্বীকার করেন মোশাররফ হোসেন। চাঁদার টাকা কাকে দিতেন, জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশকে।’

রাকিবকে ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন মোশাররফ। তবে দোকানের বিরুদ্ধে মামলা করা নিয়ে রাকিবের বাবা-মায়ের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব হয় স্বীকার করে মোশাররফ বলেন, ‘পুলিশের সামনেই রাকিবের মা আমাকে জুতা ছুড়ে মেরেছিলেন। তবে আমি তাঁর কাছ থেকে কোনো টাকা ধার নিইনি।’ রাকিব কীভাবে মারা গেছে, তা জানেন না দাবি করে মোশাররফ বলেন, ‘শুনেছি ক্রসফায়ারে মারা গেছে।’ রাকিবের মৃত্যুর পর পুলিশের করা মামলায় তাঁর ছেলে রাজীবের সাক্ষী হওয়ার বিষয়ে মোশাররফ বলেন, সেই রাতে সে দোকানে ছিল। পুলিশ ডেকে নিয়ে সাক্ষী করেছে। কয়েক দিন আগে ছেলেকে ওমানে পাঠিয়ে দিয়েছেন বলেও জানান মোশাররফ।

আপনার দোকান বন্ধ, এলাকায়ও থাকছেন না; কেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা ক্যাচাল লাগছে, তাই দূরে আছি।’


মামলার বাদী রাকিবের মা রীতা অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁর চোখের নিচে আঘাত করে। 


পুলিশের সঙ্গে রাকিবের মায়ের কথোপকথন

রাকিব হাওলাদারকে থানায় ধরে এনেছিলেন ওয়ারী থানার এএসআই জ্যোতিষ চন্দ্র রায়। থানায় রাকিবের মা একাধিকবার তাঁর কাছে ধরনা দিয়েছেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য জ্যোতিষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলব না। আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলবেন।’

তৎকালীন ওসি রফিকুল ইসলামের কক্ষে রাকিবকে মারধর করতে দেখেছেন মা রীতা হাওলাদার। কিন্তু ওসি প্রথম আলোকে বলেন, রাকিব নামের কাউকে তাঁরা ধরেননি। রাকিবের মায়ের থানায় আসার তথ্য পুরোপুরি মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি।

তবে রাকিবের কথিত ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনার পর করা মামলার বাদী এসআই শাহ আলম সেদিন রাকিবের খোঁজে তার মা রীতা হাওলাদারের থানায় যাওয়ার কথা স্বীকার করেন।

এসআই শাহ আলম রাকিবের পরিবারের দীর্ঘদিনের পরিচিত। রাকিবের মা রীতা হাওলাদার তাঁকে কাকা ডাকেন। পরিচিত এএসআই জ্যোতিষও। সাবেক ওসি রফিকুল ইসলামও প্রথম আলোকে বলেছেন, রাকিবের বাবা-মা এবং নানাকে (আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ মৃধা) এসআই শাহ আলম অনেক দিন থেকে চেনেন। অথচ পুলিশ ‘ক্রসফায়ারের’ পরে মামলায় রাকিবকে অজ্ঞাতনামা হিসেবে দেখায়। 

এই মামলার পর রাকিবের মা রীতা হাওলাদার এসআই শাহ আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার কথা বলেন। তাতে দেখা যায়, এসআই শাহ আলম রীতাকে বলছেন, ‘তোমাকে সেদিন থানায় দেখছি, আমি অস্বীকার করছি না। তুমি ছেলেকে খুঁজতেছ। তুমি দেখছ না, আমি সেদিন কী কাজে যেন ব্যস্ত ছিলাম।’

রাকিবের মা বলছেন, ‘আমি কাকা আপনাকে থানায় বলেছিলাম, আমার ছেলেকে ওরা মারতেছে। কিন্তু আপনি গুরুত্ব দিলেন না। কম্পিউটার রুমে চলে গেলেন।’ শাহ আলম বলেন, ‘শোনো, আমার ঊর্ধ্বতন অফিসার যদি কোনো কাজ করেন, তখন ওই ব্যাপারে আমি না, কারও নাক গলানোর অধিকার নাই।’

রীতা হাওলাদার বলেন, ‘...আর মরা মানুষটারে কেমনে ক্রসফায়ার করে, কন? আমার কি কোনো শত্রু আছে কাকা?’ শাহ আলম বলেন, ‘তুমি এখন যে প্রশ্ন করো, বাবা রে, তোমার সঙ্গে কথা বললে আমাগো পাপ হয়ে যাবে।’

রীতা হাওলাদার বলতে থাকেন, ‘মরা মানুষরে কেউ ক্রসফায়ার দেয়। আমার বাচ্চার বয়স মাত্র ১৫ বছর। আল্লাহ এ খুনের বিচার করবে।’

শাহ আলম তখন বলেন, ‘হ, তুমি আল্লার কাছেই কও। যে লোকে তোমার ছেলেকে মারছে, তারও ছেলেমেয়ে আছে। তার ছেলেমেয়েরও যেন এমন হয়। তুমি না কইলেও মার্ডার কেস কোনো দিন চাপা থাকে না। এই যে নারায়ণগঞ্জে সাতটা লোক খুন হলো। কীভাবে বস্তামস্তা বান্দে লাশ ডুবাই দিছিল। লাশ কিন্তু ভেসে উঠছে।’

আরও একবার এসআই শাহ আলমকে ফোন করেছেন রীতা হাওলাদার। রীতা বলছেন, ‘কাকা, জ্যোতিষকে (এএসআই) আমার ছেলের মোবাইল ফোনটা দিতে কন। স্মৃতিটা রাখি। টাচ মোবাইলটা। সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে কিনে দিয়েছি। ওটার ভেতর পোলার ছবি আছে।’ শাহ আলম বলেন, ‘রাকিবরে কে ধরে আনছিল; জ্যোতিষ? আচ্ছা, আমি জ্যোতিষের সঙ্গে কথা বলব।’

ছেলের মোবাইল ফোন ফিরে পেতে পরিচিত এসআই শাহ আলমকে আরেক দিন ফোন করেন রীতা হাওলাদার। শাহ আলম বলেন, ‘জ্যোতিষের সঙ্গে দেখা হয়নি। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করে লই। আর যদি না হয়, তাহলে আমি একটা মোবাইল কিনে দিব।’ রীতা হাওলাদার বলেন, ‘কাকা, ওটা আমার পোলার স্মৃতি!’

আরেক কথোপকথনে শাহ আলম রীতা হাওলাদারকে বলছেন, ‘আমার চোখের পানি কয়বার মুছছি, দেখছ। আমার বিশ্বাস হয় না রীতার পোলা মারা গেছে। আমার এখনো সত্যি বিশ্বাস হয় না। আমি তো লতিফ ভাইকে (রাকিবের নানা) কইছি, আপনার নাতি তো ছোট মানুষ। অনেকবার বাসায় গেছি। ও তো আমারে নানা ডাকে।’

তালহা থেকে শুরু 

২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর বেসরকারি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খন্দকার আবু তালহা ওয়ারীর গোপীবাগে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন। নয় দিন পর তালহাকে খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন আবদুর রহমান ওরফে মিলন ও বেলাল হোসেন ওরফে সবুজ নামের দুজন। তাঁরা আদালতে বলেছেন, তালহা খুনে তাঁদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ‘টোকাই রাকিব’ নামের একজন। তবে তার বিস্তারিত পরিচয়, ঠিকানা জবানবন্দিতে নেই।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, তালহা খুনের দুদিন পর ওয়ারী থানায় ২০০ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে একটি মামলা হয়। সেখানে এক আসামির নাম ছিল মো. রাকিব। ওই মামলায় পুলিশ রীতা হাওলাদারের ছেলে রাকিব হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে এবং প্রায় তিন মাস সে কারাগারে থাকে। কিন্তু তালহা হত্যার নয় দিন পর গ্রেপ্তার দুজনের জবানবন্দিতে আসা ‘টোকাই রাকিব’, তালহা হত্যার দুদিন পর এক ব্যক্তির করা ছিনতাই মামলার আসামি ‘মো. রাকিব’ আর কথিত ক্রসফায়ারে নিহত ‘ছোট রাকিব’ কি একই জন?

তালহা খুনের মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ওয়ারী থানার এসআই হারুন-অর-রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জবানবন্দিতে রাকিবের পুরো ঠিকানা বলেনি তারা। ওয়ারী এলাকায় তো অনেক রাকিব আছে।’

পুলিশ বলছে, ডাকাতদের গুলিতে রাকিব ওয়ারীর টয়েনবি সার্কুলার রোডের এই দোকানের সামনেই গুলিবিদ্ধ হন। 


৩৫ নম্বর বনগ্রাম লেন, ওয়ারীর বাসিন্দা মহসিন হাওলাদার ও রীতা হাওলাদারের ছেলের নাম রাকিব হাওলাদার। ছিনতাইয়ের মামলায় নাম মো. রাকিব হলেও আটক হয়ে জেল খেটেছে কিশোর রাকিব হাওলাদার। ওই ছিনতাই মামলার বাদীর নাম ওমর ফারুক। তিনি ২৪ নম্বর ফোল্ডার স্ট্রিটের সিটি টেলিকমের কর্মচারী ছিলেন। তিনি এখন আর সেখানে কাজ করেন না। এজাহারে থাকা ফোন নম্বরটি এই অফিসের ছিল।

এই রাকিবই যে তালহা খুনে জড়িত, তা কি পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে? জানতে চাইলে ওয়ারী থানার তৎকালীন ওসি রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হ্যাঁ, এই রাকিবই।’ তাহলে যখন ছিনতাই মামলায় রাকিব হাওলাদার আটক ছিল, তখন তাকে তালহা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখাননি কেন? জবাবে ওসি বলেন, ‘এই রাকিব তো তখন আমার মাধ্যমেই জেলে গেছে। সে-ই যে তালহাকে মেরেছে, তা তো তখন আমি জানতাম না। ১৬ দিন পর (আসলে ৯ দিন পর) যখন তালহা খুনে জড়িত সবুজ ও মিলন ধরা খায়, তখন জানতে পারি রাকিবের নাম।’ এরপর ছয় মাস পার হয়ে গেল, রাকিব হাওলাদার জামিন পেয়ে চায়ের দোকান চালাচ্ছে, বাসা থাকছে, এত দিন তাকে তালহা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়নি কেন? জবাবে ওসি বলেন, ‘এখানে একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে। রাকিবকে তালহা খুনের মামলায় কীভাবে গ্রেপ্তার দেখাব? রাকিবের কি শেষ আছে? এক ছিনতাইকারী আরেক ছিনতাইকারীকে চেনে না। একজনের ফোন নম্বর আরেকজন জানে না। কেবল চেহারার বর্ণনা দিতে পারে।’ আবার রফিকুল ইসলাম এ-ও বলেন, তালহা খুনে জড়িত থাকার পাশাপাশি এই ‘ছোট’ রাকিব মুক্তার নামের আরেকজন খুনেও জড়িত ছিল। ২ এপ্রিল জয়কালী মন্দির এলাকায় ছিনতাইয়ের টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে মুক্তার খুন হয়। এ মামলায় গ্রেপ্তার আসামি জিসান ও শামীম আদালতে বলেছেন, মুক্তারের গলায় ছুরি দিয়ে আঘাত করে এই রাকিব। ওয়ারী জোনের ডিসি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, তালহাকে খুন করেছিল রাকিব। সে ছিনতাইকারী। 

তালহা খুনের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাহ আলম। তিনি ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত রাকিব খুনের মামলারও বাদী। আবার তিনি ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনায় ডাকাতির প্রস্তুতির অভিযোগে করা মামলাও বাদীও তিনি। সেই মামলায়ও ক্রসফায়ারে নিহত রাকিব আসামি। এই শাহ আলমকেই রাকিব নানা ও রাকিবের মা কাকা বলে ডাকেন।

তালহা হত্যা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে শাহ আলম বলেন, ‘এখনো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাইনি। পেলে অভিযোগপত্র দেব।’ দুজন তো ধরা পড়েছে আর কে আছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাঁদের সঙ্গে “ছোট” রাকিবও ছিল।’ এই রাকিব কি গ্রেপ্তার হয়েছেন? শাহ আলম বলেন, ‘রাকিবকে তো অ্যারেস্ট করা যায়নি। পরবর্তীকালে জানতে পেরেছি, বঙ্গভবন রোডে ক্রসফায়ারে মারা গেছে। এই রাকিবই ১০০ ভাগ তালহা খুনে জড়িত ছিল।’ কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে সে-ই তালহা হত্যায় জড়িত ছিল? জবাবে শাহ আলম বলেন, ‘মামলার আগের তদন্ত কর্মকর্তা হারুন–অর–রশিদ গুলিবিদ্ধ ওই ডাকাতকে দেখে বলে ওঠেন, এই রাকিবকেই তিনি খুঁজছিলেন।’ আপনি এই রাকিবকে চিনতেন? শাহ আলম বলেন, ‘রাকিবের বাবা-মাকে চিনি। জয়কালী মন্দিরের ওখানে রাকিবদের দোকান ছিল। সেখানে তার বাবা-মাকে দেখেছি। কিন্তু রাকিবকে বাস্তবে দেখেননি।’ তার বয়স কত হবে? শাহ আলম বললেন, ‘১৯-২০ বছর হবে।’ কিন্তু তিনি মামলায় রাকিবের বয়স দেখিয়েছেন ২২ বছর। রাকিবের মৃত্যুর পর রাকিবের মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে শাহ আলম বলেন, ‘না।’

আইনজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা যা বলছেন

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও আইনজীবী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচার হওয়া উচিত। এই যে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে, এটাও আমাদের বিবেচনায় আনা উচিত কোন পরিস্থিতিতে আমরা বাস করি।’ 

চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশু রাকিবের মৃত্যুর ঘটনাটা লোমহর্ষক। আইন অনুযায়ী রাকিবের মায়ের বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন। পুলিশ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভয়ভীতি দেখানোর পরিপ্রেক্ষিতে যদি মামলা প্রত্যাহার হয়ে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল বিষয়টি তদন্ত করার। বাদীর মামলার প্রত্যাহারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত অসম্পূর্ণ রাখা উচিত নয়। ভুক্তভোগী যে মামলা করেছেন, তা পুনরুজ্জীবিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। একজন শিশুকে মেরে ফেলার মতো এমন গুরুতর অভিযোগের মামলা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ আইনে নেই।’

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ১০,২০১৮ 

Monday, July 9, 2018

তরিকুলের ওপর হামলাকারী কারা


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে তরিকুলের ওপর হামলার যেসব ভিডিও ও ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের লাঠি, রাম দা ও হাতুড়ি নিয়ে আঘাত করতে দেখা গেছে। গত ২ জুলাইয়ের ওই হামলায় তরিকুলের ডান পায়ের দুটি হাড় ভেঙে যায়।

তরিকুলের ওপর হামলাকারীদের মধ্যে ১১ জনকে চিহ্নিত করেছে দ্য ডেইলি স্টার। এদের মধ্যে ১০ জনই সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

হামলার পর থেকে চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত তাদের সবাইকেই ক্যাম্পাসে দেখা গেছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে তারা এখন প্রচারণা চালাচ্ছেন।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, হাতুড়ি দিয়ে তরিকুল ইসলামের ওপর হামলা চালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন। তরিকুলের পায়ে ও কোমরে লোহার হাতুড়ি দিয়ে সে আঘাত করে। তার বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিয়ান এলাকায়। সে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসম্পাদক।

হামলা সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে গতকাল বলেন, ‘ওই ব্যাপারে কথা বলতে চাই না।’

তরিকুল যখন যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল, মামুনের সঙ্গে রমিজুল ইসলাম রিমু ও লতিফুল কবির মানিক তার ঘাড়ে ও পিঠে লাথি মারছিল। রমিজুল ইসলাম রিমু ছাত্রলীগের রাবি শাখার সহসভাপতি। আর লতিফুল কবির মানিক মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের কর্মী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের সড়কে ফেলে পেটানোর সময় তরিকুল হাত দিয়ে তার মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। এসময় ছাত্রলীগের কর্মী জন স্মিথ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিশু ও রিমু এগিয়ে গিয়ে লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করেন। মানিক ব্যাডমিন্টন কভার থেকে একটি রামদা বের করে রাম দা’টির ভোঁতা দিক দিয়ে তরিকুলকে আঘাত করেন। তখনও হাতুড়ি ও বাঁশের লাঠি দিয়ে আঘাত অব্যাহত ছিল।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, তরিকুলকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিলেন রাবি শাখা ছাত্রলীগের অনুষ্ঠান ও পরিকল্পনা বিষয়ক সহসম্পাদক সৌমিত্র কুমার রানা। অন্যান্য ছবিতে সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান লাবন ও চার জন সহসভাপতি—আহমেদ সজীব, গুফরান গাজী, শোভন কায়সার ও মিজানুর রহমান সিনহাকে লাঠি নিয়ে পেটাতে দেখা যায়।

এ ব্যাপারে রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে ক্যাম্পাসে সহিংসতার চেষ্টা করছিল কিছু ছাত্র। জামায়াত-শিবির ও বিএনপির লোকজন ছাত্রদের উষ্কানি দিচ্ছিল। ‘তাদেরকে প্রতিহত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা সেটাই করেছি।’

একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাতুড়ি নিয়ে হামলাকারী মামুন দাবি করেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরাই তাদের ওপর হামলা চালাতে গিয়েছিল। ‘ওরা হামলা করতে এলে আমরা তাদের ধাওয়া করি। তাদের মধ্যে একজন পড়ে গেলে আমরা সবাই মিলে মারধর করি… ঘটনা এটাই।’ হাতুড়িসহ হামলার অস্ত্র তাদের কাছ থেকেই পাওয়া গিয়েছিল বলে তার দাবি।

নিজের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ভালো আছি।

হাসিমুখে গর্বভরে বলেন, ‘অনেক সাংবাদিক আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছে, আমি ক্যাম্পাস থেকে পালিয়েছি কিনা। আমি পালাইনি। আমি ক্যাম্পাসেই আছি এবং আমার ওপর কোনো মানসিক চাপ নেই।’

হামলায় তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশান বা ছাত্রলীগের কেউ যোগাযোগ করেছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, না…না কেউ আমাকে কিছু বলেনি।’

যোগাযোগ করা হলে রাবি প্রক্টর লুতফর রহমান বলেন, ঘটনাটি ক্যাম্পাসের বাইরে ঘটায় তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি দেখবে।

হামলাকারী ও হামকার শিকার সবাই রাবির ছাত্র ছিল জানানোর পর তিনি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা সেখানে ছিলেন। তারাই আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। পুলিশ বিষয়টি দেখবে।

ছবি ও ভিডিওতে যাদেরকে হামলা চালাতে দেখা গেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন, কেউ লিখিত অভিযোগ করলে তারা বিষয়টি দেখবেন।

  • The Daily Star/ jul 9, 2018 

চলে যা ভাই…


ইসরাফিল খসরু


গত বেশ কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেদম প্রহার, নিষ্ঠুর নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচেছ আমাদের তরুণ ‘কোটা-সংস্কার-আন্দোলন’ এর নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। এদের অধিকাংশই দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থী ছেলেমেয়ে। বলা হচ্ছে, এঁদের বিরুদ্ধে মারমুখী অবস্থান নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। যদি ধরেও নিই এতে ছাত্রলীগের কোন ভূমিকা নেই, তাহলে প্রকাশ্য দিবালোকে জনস্মুখে সংবাদকর্মীদের সামনে এমন সন্ত্রাসী কাজ করার সাহস কোথা থেকে পেল তারা? সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল এই ঘটনাগুলোতে আইন-শৃংখলা বাহিনীর দৃশ্যমান অনুপস্থিতি। 

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে কয়েকটি প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে।    এক — তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি, আইনশৃংখলার দায়িত্ব পুলিশ কতিপয় যুবকদের হাতে তুলে দিয়েছে? যদি তা হয় তাহলে জনগণের কাছে কি বার্তা পৌঁছায়? দুই —  সরকার কি আন্দোলনটিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে না ন্যায্য অধিকারের অবস্থান থেকে দেখছে। তিন — দেশের সাধারণ জনগণের ভাবনা কি? তারা কি এটিকে শুধুমাত্র ছাত্রদের আন্দোলন হিসেবে দেখছে? 

এই প্রশ্নমালার উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের কাছে কিছু জিনিস পরিস্কার হয়। 

প্রথমে —   আইনশৃংখলা বাহিনীর নির্লিপ্ততা যা একটি অশনি বার্তাই দেয়। বার্তাটি হচ্ছে একটি যৌক্তিক আন্দোলনেও জনগণের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় না। এই ছাত্ররা বাংলাদেশেরই জনগণ এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তা পাওয়া তাদের অধিকার। প্রথমে মানুষ বুঝে নিচ্ছে সরকারের নির্দেশেই তারা নিস্ক্রিয় থাকছে। কাজেই, ধরে নেয়া যায়, এই আইন-শৃংখলা বাহিনী সরকারের সেবার জন্য, জনগণের নয়।

সরকারের আচরণ থেকে এটি পরিস্কার, সরকার এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। এটি যে অধিকারের আন্দোলন সেটিকে সরকার মেনে নিচ্ছে না। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বারবার এই আন্দোলনে  জামাত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা ও পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলে আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। অথচ সরকার যদি এই আন্দোলনকে অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখত, তাহলে এর সমাধান দেখতে পেতাম। 

যেখানে এপ্রিল ১১, ২০১৮, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন সাধারন শিক্ষার্থীদের ‘কোটা-সংস্কার’ দাবি তিনি মেনে নিয়েছেন এবং আন্দোলনকারীরা সেই আশ্বাসের বিশ্বাসের নিরিখে আন্দোলন স্থগিত রাখে, সেইখানে দীর্ঘ অপেক্ষার পরও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বিলম্বিত হচ্ছে এর বাস্তবায়ন। ইতোমধ্যে কোটা পদ্ধতিতে ৩৭তম বিসিএসের ফলাফলও দিয়ে দেয়া হয়েছে, যদিও ৩৭তম থেকেই কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবি ছিল।  তার উপর আন্দোলনকে বিতর্কিত করে ভিন্নাখাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। এসবকে সরকারের সদিচ্ছার অভাবের আলামত হিসেবেই দেখা স্বাভাবিক। এখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, এই বিষয়ে তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করা। 

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ‘কোটা-সংস্কার-আন্দোলন’ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণের ভূমিকা কি হতে পারে? তারা যদি এই আন্দোলনকে শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হিসেবে দেখে, তাহলে এই আন্দোলন খুব বেশি গতি পাবে না। এইক্ষেত্রে এই বার্তাটিও সর্বমহলে পৌঁছাবে যে দেশে কোন যৌক্তিক আন্দোলন হলে তাতে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে না, সেইখানে শুধু যে শ্রেণির আন্দোলন তারাই শুধু অংশ নেবে। অথচ চলমান  ‘কোটা-সংস্কার-আন্দোলন’  যা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মেধাভিত্তিক উজ্জ্বল এক বাংলাদেশ গড়ার, সেই আন্দোলনে যদি জনগণ সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে আন্দোলনকারীদের আমরা এখনি বলে দিতে পারি —    "চলে যা ভাই, এই দেশে তোদের কোন ভবিষ্যত নাই।" মেধার মূল্যায়ন ও বিকাশের জন্য আমাদের ছেলেরা রাস্তায় মার খাবে কিন্তু আমরা তাদের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে একটি উজ্জ্বল বাংলাদেশের আশা করব, সেই ধারণাটিই ভুল। সেইক্ষেত্রে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। 

  • লেখক বাংলাদেশের একজন হতভাগা নাগরিক। 

রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে এগিয়েছে চীন

সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রক্রিয়া শেষ মুহূর্তে আটকে যায়। এর পর থেকে ফাইলবন্দি প্রকল্পটি। সোনাদিয়ায় না হলেও মিয়ানমারের রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পথে অনেকটাই এগিয়েছে চীন। সোনাদিয়া থেকে ২৮৯ কিলোমিটার দূরে রাখাইনের কিয়াকপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণে চীনা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত। শিগগিরই এ বিষয়ে চুক্তি হবে বলে জানিয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম সিনহুয়া।

কিয়াকপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে চায়না ইন্টারন্যাশনাল ট্রাস্ট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনের (সিআইটিআইসি) নেতৃত্বে চীনের ছয়টি গ্রুপ অব কোম্পানির কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে আলোচনা করছে মিয়ানমার। কিয়াকপিউয়ে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে আহ্বান করা দরপত্র প্রক্রিয়ায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে যোগ্য বিবেচিত হয় সিআইটিআইসির নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়াম। প্রকল্প দুটির মধ্যে রয়েছে একটি শিল্পপার্ক। অন্যটি গভীর সমুদ্রবন্দর। মূলত কিয়াকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অংশ হিসেবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মিয়ানমারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সিআইটিআইসি এ বিষয়ে শিগগিরই চুক্তিতে পৌঁছবে বলে আশা করছে উভয়পক্ষ।

মিয়ানমারের বাণিজ্যমন্ত্রী থান মিয়েন্ট সিনহুয়াকে বলেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় অর্থনৈতিক করিডোরের অংশ হিসেবে কিয়াকপিউয়ের গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করা হবে। দুই দেশের জন্যই এটি সমান লাভজনক হবে। এছাড়া সমুদ্রবন্দরটির কল্যাণে উন্নয়ন হবে রাখাইন রাজ্যেরও। স্থানীয়দের জন্য বিপুল কাজের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখবে গভীর সমুদ্রবন্দরটি।

গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের আওতায় রয়েছে মাদেই আইল্যান্ড টার্মিনাল ও ইয়ানবাই আইল্যান্ড টার্মিনাল। এতে জাহাজ নোঙরের সুবিধাসম্পন্ন মোট ১০টি বার্থ থাকবে। শিল্পপার্ক ও গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে রাস্তা ও সেতু নির্মাণের কাজও রয়েছে প্রকল্পটির আওতায়। ২০ বছরে মোট চারটি ধাপে গভীর সমুদ্রবন্দরটির নির্মাণকাজ শেষ হবে। নির্মাণ সম্পন্ন হলে বার্ষিক ৭৮ লাখ টন বাল্ক কার্গো ও ৪৯ লাখ টিইইউএস কনটেইনার ধারণ সক্ষমতা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করবে গভীর সমুদ্রবন্দরটি।

কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বাংলাদেশও অনেকটা এগিয়েছিল। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার গঠনের পর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়। জাপানের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সে সময় এর সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও পরিচালনা করে। দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত করতে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১১-এর খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। এরপর প্রকল্পটিকে ফাস্টট্র্যাক মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়। প্রকল্পটির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয় একটি কমিটিও।

গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা হয়নি। এর পর থেকে এক প্রকার ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে প্রকল্পটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূ-রাজনৈতিক কারণে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজে গতি আসেনি। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ভূ-রাজনৈতিক কোনো প্রভাব আমাদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে। এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে সামনে এগোতে হলে আমাদের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সবাইকে নিয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাই আমরা। বিষয়টি সবার কাছে গ্রহণযোগ্যভাবে তুলে ধরার দরকার ছিল। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেটি তুলে ধরতে পারিনি আমরা।

মিয়ানমারে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের আগ্রহ বরাবরই ছিল বলে জানান সাবেক এ রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যখন গভীর সমুদ্রবন্দরের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়, সে সময়ও মিয়ানমারের কাছে চীনের প্রস্তাবটি ছিল। অল্প দূরত্বে গভীর সমুদ্রবন্দর থাকলে তার অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই হয়তো সোনাদিয়া গুরুত্ব পাচ্ছে না।

রাখাইনের কিয়াকপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী সিআইটিআইসির নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়ামের অন্য অংশীদারগুলো হলো— চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি, চায়না মার্চেন্টস হোল্ডিংস (ইন্টারন্যাশনাল), টিইডিএ ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিং, ইউনান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ ও থাইল্যান্ডের চারোয়েন পোকফান্ড গ্রুপ অব কোম্পানিজ। মিয়ানমারের স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রকল্প দুটি নির্মাণ ও পরিচালনাকাজ সম্পন্ন করবে সিআইটিআইসি কনসোর্টিয়াম। ২০১৪ সালে মিয়ানমার সরকারের ঘোষিত মিয়ানমার স্পেশাল ইকোনমিক জোন ল’ ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করা হবে। 

বিশ্লেষকদের মতে, চলমান রোহিঙ্গা সংকটের মূলেও আছে রাখাইনের কিয়াকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর এ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরেই নির্মাণ করা হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দরটি। 

ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির বলেন, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে যে অস্থিরতা তার অন্তর্নিহিত কারণ এ অঞ্চলের সম্পদ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীও এর শিকার।

গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর নাফ নদী পাড়ি দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে থাকে। সেই সময় থেকে নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা।

  • Courtesy: BanikBarta /Jul 09, 2o18

আগামী সপ্তাহে মজুরি প্রস্তাব দেবে মালিক ও শ্রমিক পক্ষ

তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ডের দ্বিতীয় সভা রোববার বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে মালিক ও শ্রমিক কোনো পক্ষই মজুরি প্রস্তাব দেয়নি। উভয় পক্ষই ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে প্রস্তাব জমা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। 

রাজধানীর তোপখানা রোডে রোববার বিকেলে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ডের দ্বিতীয় সভা শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। সভায় মালিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি কাজী সাইফুদ্দিন আহমদ, শ্রমিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি ফজলুল হক, পোশাকশিল্পের মালিক প্রতিনিধি তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, পোশাকশিল্পের শ্রমিক প্রতিনিধি জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক বেগম শামছুন্নাহার ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। তবে বোর্ডের নিরপেক্ষ সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ মো. কামাল উদ্দীন উপস্থিত ছিলেন না।

বৈঠক শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মজুরি নির্ধারণে কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেসব বিষয়ে নিয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। তবে গত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মজুরি প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা ছিল। উভয় পক্ষই জানিয়েছে, তাদের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তারা আমাদের কাছে কিছু সময় চেয়েছে। সে জন্য আমরা সাত দিন সময় দেওয়া হয়েছে। মজুরি বোর্ডের তৃতীয় সভা ১৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যেই মালিক ও শ্রমিকপক্ষ প্রস্তাব দেবে।’ 

মালিকপক্ষের প্রতিনিধি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘পোশাক খাত হচ্ছে দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন ইন। যাতে কোনো রকম আঘাত না আসে এবং শ্রমিকেরা যাতে ভালোভাবে চলতে পারেন এবং পোশাক খাত যাতে ভালো থাকে, সে জন্য মালিকের সক্ষমতা ও শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে আমরা একটি হিসাব দাঁড় করতে চাই। সেটি প্রায় শেষ পর্যায়ে। সে জন্য আমরা ১০ দিন সময় চেয়েছিলাম। তবে আট দিন পেয়েছি।’ আগামী সভার আগেই মজুরি প্রস্তাব জমা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। 

মজুরি বোর্ডের কার্যক্রম ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করা হচ্ছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, আগস্ট মাসে মজুরি বোর্ডের ছয় মাস শেষ হবে। তারপর আরও তিন মাস নেওয়ার সুযোগ আছে। আশা করছি, এর মধ্যেই কাজ শেষ হবে। আর সময় নিতে হবে না। 

শ্রমিক প্রতিনিধি জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক বেগম শামছুন্নাহার ভূঁইয়া বলেন, ‘আমাদের মজুরি প্রস্তাব মোটামুটি তৈরি। তবে গ্রেডের সংখ্যা সাতটি থেকে কমিয়ে পাঁচটি করায় মজুরি হার নির্ধারণে একটু ঝামেলা হয়েছে। মালিকপক্ষ যেহেতু দেয়নি, তাই আমরাও কিছুটা সময় পেলাম। কারণ এক পক্ষের প্রস্তাবে তো আলোচনা হবে না।’ 

অপর প্রশ্নের জবাবে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, উভয় পক্ষ মজুরি প্রস্তাব দেওয়ার পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানা পরিদর্শন করবে মজুরি বোর্ডের সদস্যরা। এরপরই আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 

পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ এবং মজুরি বোর্ডের কার্যক্রম নিয়ে সরকার ও মালিকপক্ষের ‘টালবাহানা’ বন্ধের দাবিতে মজুরি বোর্ডের সামনে প্রতীকী অনশন করেছে গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। 

এ ছাড়া নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ের সামনে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতা-কর্মীরা পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা এবং গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতা-কর্মীরা নিম্নতম মজুরি ১৮ হাজার নির্ধারণের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।


উল্লেখ্য, গত ১৯ মার্চ মজুরি বোর্ডের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ এপ্রিল দ্বিতীয় বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে এসে সেটি স্থগিত করা হয়। 

পোশাকশিল্পের জন্য ১৯৮৪ সালে প্রথম নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠিত হয়। তখন পোশাকশ্রমিকদের জন্য ৬২৭ টাকা নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে বোর্ড। পরে ১৯৯৪ সালে ৯৩০ টাকা, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা এবং ২০১০ সালে ৩ হাজার টাকা এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালে ৫ হাজার ৩০০ টাকা নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। ৫ হাজার ৩০০ টাকা মজুরির মধ্যে মূল মজুরি ৩ হাজার টাকা, বাড়ি ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা এবং চিকিৎসা, যাতায়াত ও খাদ্যভাতা ১ হাজার ১০০ টাকা। একেকটি মজুরি কাঠামো পাঁচ বছরের জন্য গঠন করা হয়।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ৯, ২০১৮