মামুনুর রশীদ
- রূপনগর আবাসিক প্রকল্পের ২২ একর আয়তনের লেক পুরো ভরাট করে দখল করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
- জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে পুরো এলাকা।
- দখলের নেতৃত্বে রূপনগর থানা আ. লীগের সভাপতি রজ্জব হোসেন ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন
- দখলের নেতৃত্বে ৭ নম্বর ওয়ার্ড আ. লীগের সভাপতি কাজী আবদুল হাই
- দখলের নেতৃত্বে রজ্জব হোসেন সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ্ এবং আবদুল হাই সাংসদ আসলামুল হকের অনুসারী।
মিরপুরে রূপনগর আবাসিক প্রকল্পের ২২ একরের একটি লেক পুরো ভরাট করে দখল করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। দখলের নেতৃত্বে আছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রজ্জব হোসেন, ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আবদুল হাই হারুন ও রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন ওরফে টেনু।
রজ্জব হোসেন ঢাকা-১৬ আসনের সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্ এবং আবদুল হাই হারুন ঢাকা-১৪ আসনের সাংসদ আসলামুল হকের অনুসারী।
লেকটি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে আছে। ১০ বছর ধরে এটি দখল হলেও দুবার অভিযান চালানো ছাড়া কিছুই করেননি।
রূপনগর এলাকার ভূ-উপরিভাগের পানি ধরে রাখা এবং জলাবদ্ধতা যাতে না হয়, সে জন্য প্রকল্পে বিশাল এই লেকটি রাখা হয়। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লেকটি মিরপুর এলাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত। নগর-নিসর্গের ক্ষেত্রেও তা যুক্ত করতে পারত ভিন্ন মাত্রা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আগে কমবেশি দখল হলেও ২০০৯ সালের পর লেক দখল উৎসবে রূপ নেয়। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতা ছাড়া পুরো লেক দখল কোনোভাবেই সম্ভব হতো না বলে মনে করেন তাঁরা।
১০১ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা রূপনগর আবাসিক প্রকল্পে ১ হাজার ২০০টি প্লট আছে। শিয়ালবাড়ী মোড় থেকে রূপনগর প্রধান সড়ক ধরে সামনে আধা কিলোমিটার এগিয়ে হাতের ডান পাশে লেকটির অবস্থান। দেখা যায়, লেকে গড়ে তোলা হয়েছে হাজার হাজার বস্তিঘর। আছে অন্যান্য স্থাপনাও।
প্রায় এক সপ্তাহের সরেজমিন পরিদর্শনের সময় বস্তিবাসী, এলাকার বাসিন্দা, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীসহ অন্তত ৮০ জনের সঙ্গে কথা হয়। স্থানীয় এসব ব্যক্তি জানান, ২০১২ সালে আরামবাগ ঈদগাহ ময়দান ও বঙ্গবন্ধু শিশু উদ্যানের নামে লেকের উত্তর-পূর্ব অংশ ভরাট করা শুরু হয়। সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ্ এর উদ্বোধনও করেন। পরে এলাকাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তর ওই কাজ বন্ধ করে দেয়। তারা লেক দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও তা আর হয়নি।
এসব কথার সূত্র ধরে উত্তর-পূর্ব কোণে আরামবাগ অংশে গিয়ে দেখা যায়, লেকের বিস্তীর্ণ অংশ ভরাট করে সেখানে একটি ঈদগাহ বানানো হচ্ছে। ঈদগাহ জামে মসজিদের নামফলকে লেখা, ‘১১ মে, ২০১৭। উদ্বোধন করেন সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্’। মসজিদ থেকে ভরাট করা অংশ পেরিয়ে লেকের ভেতরের অংশে গিয়ে দেখা যায়, ভরাট হতে বাকি আছে এমন অল্প কিছু জায়গায় বাঁশ ও বেড়া দিয়ে ঘর তোলার কাজ করছেন পাঁচ-ছয়জন। এই এলাকা পড়েছে ডিএনসিসির ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, লেকের এই অংশ দখলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রজ্জব হোসেন। সঙ্গে আছেন রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন ওরফে রবিন। তাঁরা লেকের ওপর গড়ে তোলা প্রায় ২ হাজার ঘর থেকে প্রতি মাসে ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা করে ভাড়া আদায় করেন। সে হিসাবে প্রতি মাসে ৬০ লাখ টাকা ভাড়া ওঠে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কয়েকবার রজ্জব হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। প্রতিবার তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা জানান, মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে রজ্জব হোসেন গা ঢাকা দিয়ে আছেন।
জানতে চাইলে সম্প্রতি মিরপুরে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বসে সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্ প্রথম আলোকে বলেন, লেকের যে অংশ ভরাট করে মসজিদ ও ঈদগাহ মাঠ বানানো হয়েছে, তা গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নয়; হামদর্দ ল্যাবরেটরিজের। তারা যেহেতু এখানে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করছে না, তাই এলাকার বাসিন্দাদের দাবির মুখে এই মাঠ বানানো হয়েছে।
২০১২ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর আরামবাগ ঈদগাহ ময়দান ও বঙ্গবন্ধু শিশু উদ্যানের নামে লেক ভরাটের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল—এই তথ্য জানালে সাংসদ বলেন, ‘তখন লেকের ওপর কিছু বস্তিঘর ছিল। তাতে আগুন লাগার পর এলাকাবাসী আর বস্তি রাখতে চাননি। আমারও তাতে সায় ছিল। সে সময় আরামবাগে একটি রাস্তা উন্নয়নের সময় তোলা মাটি লেকের ভেতরে ফেলা হয়। বাচ্চারা সেখানে খেলতে শুরু করে। পরিবেশ অধিদপ্তর বলল, এখানে কোনো খেলার মাঠ হবে না। কিন্তু আমরা তো আর বাচ্চাদের খেলার ব্যাপারে নিষেধ করতে পারি না।’
প্রধান অভিযুক্ত রজ্জব হোসেনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে ইলিয়াস মোল্লাহ্ বলেন, ‘এই এলাকায় আমাদের ৭৯ শতাংশ পৈতৃক সম্পত্তি আছে। রজ্জব সেগুলো দেখাশোনা করে। এর বাইরে সে আর কী করে, তা জানি না।’ তিনি বলেন, ‘লেক দখল করে খায় সবাই। নাম হয় হাজি রজ্জবের।’
বস্তিবাসী ও স্থানীয় নেতারা জানান, লেকের পশ্চিম অংশে প্রায় দেড় হাজার ঘরের মালিক রমজান আলী মাতবর ও তাঁর ভাই ছাত্তার আলী মাতবর। এই অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আবদুল হাই ওরফে হারুন। এতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবাশ্বের চৌধুরীর নীরব সমর্থন আছে। নীরব ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি।
জানতে চাইলে কাজী আবদুল হাই প্রথম আলোকে বলেন, ‘লেকের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য আমি গত কয়েক বছরে পরিবেশ অধিদপ্তর, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশনে অন্তত ৫০টি দরখাস্ত দিয়েছি। সেই আমার বিরুদ্ধেই যদি এমন অভিযোগ ওঠে, তা দুঃখজনক।’ তাঁর দাবি, লোকে আসলে অন্য হারুনের কথা বলেছেন। তাঁদের একজন রূপনগর আবাসিক এলাকার ১৯ নম্বর রোডে বাসিন্দা। আরেকজন থাকেন ৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। এঁরা দুজনই লেক দখলে যুক্ত ও আওয়ামী লীগ করেন।
আরেক অভিযুক্ত রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন ওরফে টেনু বলেন, ‘আমি ২৫ বছর ধরে এই এলাকায় আছি। ছোটখাটো ব্যবসা করে খাই। আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ কেউ প্রমাণ করতে পারলে আমি নিজেই নিজের বিচার করব।’
সাংসদ আসলামুল হক দেশের বাইরে থাকায় এই দখলদারদের বিষয়ে তাঁর অবস্থান জানা সম্ভব হয়নি।
বিশাল এই লেকের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন। তিনি বলেন, ‘একসময় এই লেক বোটানিক্যাল গার্ডেন ও মিরপুর সেনানিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। শীত মৌসুমে হাজার হাজার অতিথি পাখি ভিড় করত।’ তিনি বলেন, ‘লেকটি যে প্রক্রিয়ায় দখল হয়েছে, তাতে এই দায় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।’
লেক রক্ষা করতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান খন্দকার আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অনেক আগেই লেকটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসাকে দেওয়া হয়েছে। কবে ওয়াসার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা দেখে বলতে হবে।’
তবে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান লেক হস্তান্তরের প্রশ্নে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আইনগতভাবেই গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এটি করতে পারে না। কারণ, জলাশয় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কখনোই ওয়াসার না। আমরা রূপনগর খালের দায়িত্ব নিয়েছি। লেকের না।’
এরপর মিরপুর গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ডিভিশন-১-এর কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১৯৮৭ সালে করা মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে রূপনগর আবাসিক এলাকার এই লেকটির আয়তন ২২ একরের (৬৬ বিঘা) কমবেশি। লেকের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে এর আগে দুবার অভিযান চালানো হয়। কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত লেক রক্ষা করতে পারিনি।’ কারণ জানতে চাইলে এই প্রকৌশলী বলেন, ‘যাঁরা এই দখলদারির সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা সবাই রাজনৈতিকভাবে খুব শক্তিশালী। কিছুদিন আগে আমাদের এক সার্ভেয়ারকে (জরিপকারক) বস্তির ভেতরে আটকে রেখেছিল কয়েক ব্যক্তি। পরে পুলিশ দিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে।’
সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘লেকটি রক্ষা করতে কেবল গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে এমন নয়। ঢাকার বুকে এমন একটি উন্মুক্ত জলাশয় বাঁচিয়ে রাখতে রাজউকেরও ভূমিকা আছে। রাজউক সেই ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এই দুটো সংস্থাই গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আবার স্পষ্ট হলো, মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই।’
জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘লেকটি রক্ষার ব্যাপারে অবশ্যই রাজউকের ভূমিকা রাখা উচিত ছিল। কিন্তু গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আমাদের কিছু জানায়নি। আমরা শুনেছি, লেকটি খুবই ছোট করে নিয়ে আসা হয়েছে। ওয়াসাও এটা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। বিষয়টি আমি দু-একটা মিটিংয়ে বলারও চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাজ হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘এবার বিষয়টি একটু গুরুত্ব দিয়ে দেখব। দেখি কী হয়।’
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ২, ২০১৮