উদ্বিগ্ন পরিবেশ অধিদপ্তর
নিহাল হাসনাইন ও আমির হোসাইন
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার মেঘনা নদীর তীরঘেঁষে ৮৩ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে আমান ইকোনমিক জোন। এ জোনেই আমান গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আমান সিমেন্টের একটি অংশ চলে গেছে নদীর ভেতরে। সিমেন্ট কারখানার পরেই রয়েছে জেটি। এর কিছুদূর পর গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান আমান শিপইয়ার্ড। এরও অংশবিশেষ চলে গেছে নদীর অভ্যন্তরে।
আমান ইকোনমিক জোনের বিরুদ্ধে মেঘনা নদী দখলের সত্যতা পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরও। সরেজমিন পরিদর্শন করে ঢাকা অঞ্চল কার্যালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়। ইকোনমিক জোনের নদী দখলের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের পরিদর্শক দল আমান ইকোনমিক জোনের অভ্যন্তরীণ ও আশপাশ এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখেছে, মেঘনা নদীর প্রায় ৩০ একর জায়গা ড্রেজারের মাধ্যমে বালি ফেলে ভরাট করা হয়েছে। ওই অংশে আমান ইকোনমিক জোনের কোনো সীমানা পিলার ছিল না। সরেজমিন পরিদর্শনে ভরাটকৃত জায়গাটি মেঘনা নদী ও নদীর ফোরশোর এলাকা মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। নদীর জায়গা বালি ফেলে ভরাট করার মধ্য দিয়ে আমান ইকোনমিক জোন পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ৬ঙ ধারা ভঙ্গ করেছে।
পাশাপাশি আমান ইকোনমিক জোনের কর্মকর্তাদের গ্রহণযোগ্য বক্তব্য থাকলে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তা দাখিল করার অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে। একই সঙ্গে বিষয়টির নিয়মানুগ সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের ভরাট কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমান ইকোনমিক জোনের পক্ষ থেকে কোনো তথ্যপ্রমাণ দাখিল করা হয়নি বলে জানান অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের (ভারপ্রাপ্ত) উপপরিচালক নয়ন মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, আমান ইকোনমিক জোন শিপইয়ার্ডের নামে যে জায়গা বালি ফেলে এরই মধ্যে ভরাট করে ফেলেছে, তা সরেজমিন পরিদর্শন করে নদী দখলের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে ঠিক কী পরিমাণ নদীর জায়গা দখল করেছে, তা নির্ধারণে উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে।
গতকাল সরেজমিন আমান ইকোনমিক জোন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মেঘনা নদীর তীরে হারিয়া গোবিন্দ, সোনামোহি, বৈদ্যের বাজার মৌজা নিয়ে গড়ে ওঠা জোনটির নিজস্ব সীমানায় সুবিশাল প্রাচীর। এ প্রাচীরের পরে নদীর ভেতর আরো অন্তত ৩০০ গজ জায়গা বালি ফেলে ভরাট করছে আমান ইকোনমিক জোন। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
জানতে চাইলে আমান গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (প্রশাসন) তানভীর আহমেদ মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আমাদের কোনো নোটিস পাঠানো হয়নি। আমান ইকোনমিক জোন ঘেঘনা নদীর কোনো জায়গা দখল করেনি। কেউ যদি এমন তথ্য দিয়ে থাকে, সেটি ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে।
পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে আনন্দবাজার ঘাটে নৌকা চালাচ্ছেন আব্দুল জলিল। পৈতৃক সূত্রে তিনি বৈদ্যের বাজার মৌজায় ৮০ শতাংশ জমি পেয়েছিলেন। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত সেই জমিতে নিয়মিত চাষও করেছেন। একপর্যায়ে মেঘনার এ পাড় ভাঙতে শুরু করে। তলিয়ে যায় পুরো বৈদ্যের বাজার ও এর আশপাশ এলাকার জমি। নদীতে তলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জলিলের কাছে ওই জমির সিএস খতিয়ান ছিল। কিন্তু তলিয়ে যাওয়ার পর আরএস বা বিএস খতিয়ানে ওই সম্পত্তির জায়গা হয়নি। অবশেষে ২০১৫ সালের প্রথম দিকে ৬ লাখ টাকায় ৮০ শতাংশ জমির সিএস কাগজ বিক্রি করে দেন জলিল। এমন সিএস খতিয়ানে শুধু আব্দুল জলিলই নয়, জমি বিক্রি করেছেন হারিয়া গোবিন্দ, সোনামোহি, বৈদ্যের বাজার মৌজার অনেকে। এসব জমি কিনে মেঘনার তীরে গড়ে উঠেছে আমান ইকোনমিক জোনসহ বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর ভূমি অফিসের কানুনগো মতিয়ার রহমান জানান, ১৯৭২ সালের নদী আইনের ১৩৫ নং অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ভরা মৌসুমে পানি যতদূর পর্যন্ত যাবে, তার পুরোটাই নদীর জমি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে নদী শুকিয়ে গেলে ফোরশোর ভূমি হিসেবে আগের মালিক পুনরায় তার ওই জমির দখল পাবেন। কিন্তু কোনোভাবেই সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। শুধু চাষাবাদের কাজে ওই জমি ব্যবহার করা যাবে। সে হিসাবে আমান ইকোনমিক জোন আইন ভঙ্গ করে নদীর জায়গা ভরাট ও স্থাপনা নির্মাণ করছে।
২০১৬ সালে কোয়ালিফিকেশন লাইসেন্স পায় আমান ইকোনমিক জোন। অনুমোদন পাওয়ার দুই বছরের মাথায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নদীর ফোরশোর জমি বালি ফেলে ভরাট করার অভিযোগ ওঠে।
তবে মেঘনা নদীর জমি দখলমুক্ত করতে এরই মধ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক রাব্বি মিয়া। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমান ইকোনমিক জোন নদী দখল করেছে কিনা, তার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখতে এবং দখলমুক্ত ও পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ইকোনমিক জোনের বেশ কয়েকটি নারায়ণগঞ্জে। এসব ইকোনমিক জোনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে যখনই আমাদের মতবিনিময় হয়, তখনই তাদের নদী ও পরিবেশ আইন মেনে কাজ করার পরামর্শ দিই।
তার পরও কৌশলে নদী দখল হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবাদীরা। তাদের অভিযোগ, কয়েক দফা নিষেধ করার পরও আমান ইকোনমিক জোনের নদী দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু বলা হচ্ছে না।
আমান ইকোনমিক জোন নদীর জায়গা ভরাট করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান নারায়ণগঞ্জ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক গুলজার হোসেন। তিনি বলেন, কারো জায়গা যদি নদীর মধ্যে চলে যায়, সেটা নদী। সে জায়গা কেনাবেচা করলেও তা টিকবে না। কারণ ভরা বর্ষায় নদীতীরের যে পর্যন্ত পানি যাবে, সে পর্যন্ত নদীর জায়গা। আমান অর্থনৈতিক অঞ্চল যদি নদীর জায়গা ভরাট করে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে মামলা করা হবে।
- কার্টসিঃ বনিকবার্তা/সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৮
No comments:
Post a Comment