- গত বছর ইসির সংলাপে কয়েকটি বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সুপারিশ আসে
- আওয়ামী লীগসহ সাতটি দলের দাবি ছিল ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে
- বিএনপিসহ ১২টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছিল
- শেষ সময়ে শুধু ইভিএমে ভোট নেওয়ার সুযোগ তৈরির প্রস্তাব করে ইসি
- প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সিইসি বললেন, কিছু আসনে ইভিএম থাকবে
শেষ মুহূর্তে এসে ইভিএম নিয়ে অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ইসি সুর নরম করেছে। যদিও আগামী জাতীয় নির্বাচনে সীমিত পরিসরে হলেও ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হচ্ছে।
গতকাল সোমবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, আইনের সংশোধনী পাস হলে এবং সবার সমর্থন পেলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দৈবচয়নের ভিত্তিতে কিছু আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহারের চেষ্টা করবেন তাঁরা।
গত বছর অংশীজনদের সঙ্গে ইসির সংলাপে জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার, ‘না’ ভোটের বিধান চালু করাসহ কয়েকটি বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সুপারিশ এসেছিল। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়গুলো ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল ইসি। এর মধ্যে শেষ সময়ে এসে শুধু ইভিএমে ভোট নেওয়ার সুযোগ তৈরি করার প্রস্তাব করেছে ইসি। এটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সাতটি দলের দাবি ছিল। বিপরীতে বিএনপিসহ ১২টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছিল। আর সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি করেছিল ২৫টি দল। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০।
নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহারের দক্ষতা ও কারিগরি সক্ষমতা ইসির নেই। ভোটাররাও ইভিএমের সঙ্গে সেভাবে পরিচিত নন। এ অবস্থায় শেষ মুহূর্তে ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনা এবং সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আইন সংস্কারে ইসির উদ্যোগ অহেতুক বিতর্ক তৈরি করেছে। গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে তাড়াহুড়া করা ঠিক হবে না।
এই বিতর্কের মধ্যে গতকাল রাজধানীতে ইভিএম ব্যবহার-সংক্রান্ত এক কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সিইসি নুরুল হুদা বলেন, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আরও পরে হবে। ইসি এখনো আরও পেছনের পর্যায়ে আছে। আইন সংশোধনের প্রস্তাব সরকারের কাছে যাবে, সেখান থেকে মন্ত্রিসভা হয়ে সংসদে যাবে। প্রকল্প অর্থ মন্ত্রণালয়ে যাবে আর্থিক সংস্থানের জন্য।
সিইসি বলেন, জাতীয় সংসদে আইন পাস হলে, ইসির সক্ষমতা অর্জিত হলে এবং ইভিএম মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলে, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন পেলে যতখানি সম্ভব ইভিএম ব্যবহার করা হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু আসনে ইভিএম ব্যবহার করার চেষ্টা করা হবে। ২০১০ সালের চেয়ে এখনকার ইভিএম অনেক উন্নত বলে দাবি করেন তিনি।
ইভিএম প্রযুক্তি ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি দিয়ে সিইসি বলেন, বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে সুই-সুতা থেকে শুরু করে হাজার রকমের জিনিসপত্র দরকার হয়। ইভিএম পদ্ধতিতে এসব প্রয়োজন হবে না। একজনের ভোট অন্যজনও দিতে পারবেন না।
এত টাকা ব্যয়ে ইভিএম কেনার প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনার জবাবে সিইসি বলেন, দেশের নাগরিক যাঁরা কর দেন, তাঁরা অবশ্যই জানতে চাইবেন তাঁদের টাকা অপচয় হচ্ছে কি না। ইভিএমের কোনো তহবিল ইসির কাছে আসবে না, এটা নিশ্চিত করেই ইসি এগিয়েছে। আলাদাভাবে চিঠি দিয়ে এ দায়িত্ব সরকারের কাছে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, জনগণকে আস্থায় নিয়ে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে তারপর ইভিএম ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমদিকে সীমিত সংখ্যক সংসদীয় আসনে ইভিএমের পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা যেতে পারে। এটাই হওয়া উচিত। ইসি যদি সে সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই হবে যথাযথ।
বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের জন্য একটি আইনি কাঠামো প্রণয়ন এবং তা প্রয়োগ করে ভোটারদের নির্দ্বিধায় ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। এই লক্ষ্যে ইসি গত বছর অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ করেছিল। সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল, কিছু মন্ত্রণালয়কে নির্বাচনের সময় ইসির অধীনে নেওয়াসহ ছয়টি সুপারিশকে ‘সাংবিধানিক বিষয়’ হিসেবে চিহ্নিত করে ইসি বলেছিল, এ ক্ষেত্রে তাদের কিছু করার নেই। নির্বাচনী আইনের সংস্কার, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করাসহ ৩৪টি প্রস্তাব ও সুপারিশকে ইসি নিজেদের এখতিয়ারভুক্ত বলেছে। কিন্তু এসব বিষয়েও কার্যকর উদ্যোগ নেই।
এসব সুপারিশ এক পাশে রেখে কমিশনের ভেতরে-বাইরে আপত্তি ও সমালোচনার মুখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ইভিএম ব্যবহারের বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে ইসি। গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের আপত্তির মুখে এই অনুমোদন করা হয়।
ইসি সূত্র জানায়, গতকাল সোমবার এই প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ে মতামত নিয়ে তা উঠবে মন্ত্রিসভায়। মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেলে এটি বিল আকারে সংসদে উঠবে। ৯ সেপ্টেম্বর থেকে সংসদের অধিবেশন বসছে। এই অধিবেশনে বিলটি পাস হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের আইনি সুযোগ তৈরি হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের নরম সুর বেশি সন্দেহজনক। ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। কিন্তু এর মধ্যে দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রক্রিয়া কেন? নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ইসির সংলাপে অনেকগুলো সুপারিশ এসেছিল। সেনা মোতায়েন, হলফনামা যাচাই-বাছাই, তৃণমূল প্যানেল থেকে প্রার্থী মনোনয়নসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল। সবকিছু বাদ দিয়ে শেষ মুহূর্তে শুধু ইভিএম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আরপিও সংশোধনের উদ্যোগে মানুষের সন্দেহ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। শেষ সময়ে এসে ইসি অহেতুক বিতর্ক তৈরি করছে।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৮
No comments:
Post a Comment