সম্পাদকীয়
অপরাধ সংঘটিত হলে তার বিচার করার জন্য আইন আছে, আইন প্রয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ আছে এবং আদালত আছে। অপরাধের শিকার ব্যক্তি কিংবা তাঁর স্বজন বিচার চাইতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারস্থ হবেন, মামলা করবেন। তার পরেই শুধু বিচারের আইনানুগ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি বিচারপ্রার্থীর মামলাই গ্রহণ না করে, তাহলে বিচারের কোনো পথ থাকে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। হত্যা, ধর্ষণসহ নানা গুরুতর অপরাধের বিচারপ্রার্থীরা মামলা করার জন্য থানায় গেলে পুলিশ মামলা গ্রহণ করে না—এমন অভিযোগের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হয়।
এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে গত ৩১ জুলাই ময়মনসিংহ শহরে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডের কথা। সেদিন দুপুরে যুবলীগের দুটি পক্ষের সংঘর্ষে শেখ আজাদ নামে মহানগর যুবলীগের এক সদস্যকে গুলি করে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। প্রকাশ্য দিনের আলোয় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে; কিন্তু যুবলীগ সদস্যের স্ত্রী মামলা করার উদ্দেশ্যে লিখিত অভিযোগ নিয়ে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানায় গেলে পুলিশ মামলাটি গ্রহণ করেনি। স্বামীকে হারিয়ে সংক্ষুব্ধ নারীটি নিরুপায় হয়ে আদালতে রিট আবেদন করেন। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট মামলাটি নথিবদ্ধ করার জন্য ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার পুলিশকে নির্দেশ দিলে শুক্রবার পুলিশ মামলাটি নথিবদ্ধ করে।
প্রশ্ন হলো ময়মনসিংহ থানার পুলিশ মামলাটি নিতে রাজি হচ্ছিল না কেন। এর উত্তরে এ দেশের আইন প্রয়োগচর্চার ক্ষেত্রে একটি সাধারণ প্রবণতা ফুটে ওঠে: প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করতে গেলে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ মামলা নিতে অপারগতা কিংবা অস্বীকৃতি জানায়। বর্তমান ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, নিহত শেখ আজাদের স্ত্রী তাঁর স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে যে ব্যক্তিদের আসামি করে মামলাটি করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের তালিকায় আছেন মোহিত উর রহমান ওরফে শান্ত নামের এক যুবক, যিনি একাধারে ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের ছেলে।
ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা হলেই যেখানে থানা-পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে রাজি হয় না, সেখানে মোহিত একজন মন্ত্রীর ছেলে! হাইকোর্টের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার পুলিশ যে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা নিচ্ছিল না—এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু ক্ষুব্ধ হওয়ার ও প্রতিবাদ জানানোর জোরালো কারণ আছে। হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের আইনি প্রতিকারের জন্য আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের যেখানে আপন দায়িত্ববোধ থেকেই এগিয়ে যাওয়া উচিত, সেখানে মামলা নথিবদ্ধ না করে বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে অসহযোগিতা করা অবশ্যই নিন্দনীয়। উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত হত্যা মামলা গ্রহণ না করা আইনের শাসনের নীতি অগ্রাহ্য করার শামিল।
শেষ পর্যন্ত যখন মামলাটি গ্রহণ করা হয়েছে, তখনো নিহত শেখ আজাদের স্বজনদের স্বস্তি বোধ করার কারণ ঘটেনি। কারণ, পুলিশ মামলা গ্রহণের পর ধর্মমন্ত্রীর ছেলে মোহিতসহ ২৫ জন আসামির কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি। মন্ত্রীর ছেলে তো আইনের ঊর্ধ্বে নন, আইনের চোখে সবাই সমান। তাহলে তাঁকেসহ অন্য আসামিদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না—এই প্রশ্নের সঙ্গে এই সংশয়ও থেকে যাচ্ছে যে মামলাটি পরিচালনার ক্ষেত্রে পুলিশের গাফিলতি থাকতে পারে। আমরা এ বিষয়টির ওপরেই বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই: আদালত নির্দেশ দিয়েছেন বলে মামলা গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই যেন পুলিশের দায়িত্ব-কর্তব্য শেষ হয়ে না যায়। হত্যার বিচার ও হত্যাকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার পথে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব যেন বাধা সৃষ্টি না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৮
No comments:
Post a Comment