রাজধানীতে বাড়ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। গত দুই মাসে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৫ ব্যক্তির সাতজনই ছিলেন মোটরসাইকেল আরোহী। একইভাবে ২০১৭ সালে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার ২৭ শতাংশই ঘটে মোটরসাইকেলে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করা সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
ঢাকার মতো জনবহুল, যানজট ও দুর্ঘটনাপ্রবণ শহরে মোটরসাইকেলের মতো দুই চাকার বাহন কোনোভাবেই উপযুক্ত নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) কার্যকরী উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। তবে বিআরটিএ মোটরসাইকেল নিবন্ধন দেয়ার ক্ষেত্রে পুরোপুরি লাগাম ছাড়া। খোদ বিআরটিএর হিসাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে শুধু রাজধানীতে দৈনিক গড়ে ২৭২টি নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধন পেয়েছে। মোটরসাইকেল নিবন্ধন বৃদ্ধির কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকির পাশাপাশি রাস্তায় বিশৃঙ্খলাও বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকাসহ সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের তথ্য প্রকাশ করে নিসচা। বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানান সংগঠনটির চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেন, গত দুই মাসে (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) ঢাকায় বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৫ জন। এর সাতজনই মোটরসাইকেল আরোহী। ২০১৭ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা গেছে, তার ২৭ শতাংশ মোটরসাইকেলে।
সংবাদ সম্মেলনে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ২০১৫ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৬২৬টি। একইভাবে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে দুর্ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ২ হাজার ৩১৬ ও ৩ হাজার ৩৪৯টি। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত (সেপ্টেম্বর) ২ হাজার ৬৭২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল সাত লাখ। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২২ লাখ। মোটরসাইকেলচালকদের একটা বড় অংশ কিশোর। তাদের বেপরোয়া চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি।
নিসচা সারা দেশে ২২ লাখের হিসাব দিলেও বিআরটিএর পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল রয়েছে ২৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই চলাচল করছে প্রায় ৫ লাখ ৭৮ হাজার মোটরসাইকেল। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত নিবন্ধন পেয়েছে ৬৫ হাজার ৩৩২টি। গড় হিসাবে এ সময়ে ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন ২৭২টি করে নতুন মোটরসাইকেল নেমেছে।
নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিআরটিএর পরিচালক (প্রকৌশল) নুরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের তত্পরতার কারণে বর্তমানে কেউ আর হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল ব্যবহার করছেন না। ট্রাফিক আইনও মেনে চলছেন। এর মধ্যেও যখন কেউ ট্রাফিক আইন ভাঙার চেষ্টা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিকভাবেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে মোটরসাইকেল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। যারাই আসছে, আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো যাচাই করে তাদের নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে। মোটরসাইকেল নিবন্ধন বিআরটিএর রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস।
বিআরটিএর এ কর্মকর্তা মোটরসাইকেল আরোহীরা ট্রাফিক আইন মেনে চলছেন বা মানতে বাধ্য হচ্ছেন উল্লেখ করলেও সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। বেশির ভাগ পয়েন্টেই আরোহীরা ট্রাফিক সিগন্যাল না মেনে ফাঁকফোকর দিয়ে চলছেন। এখনো ফুটপাত দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। তবে দুজনের বেশি আরোহী না থাকা ও চালক-আরোহী সবাইকে হেলমেট ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় মোটরসাইকেলে বিভিন্ন কোম্পানি অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা শুরু করার পরই মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে ঢাকায় উবার, পাঠাও, ওভাই, স্যাম, চলো, ইজিয়ার, আমার বাইক, সহজ রাইডার্স, বাহন, আমার রাইড, ঢাকা রাইডার্স, ঢাকা মটোসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারের সুবিধা দিচ্ছে। রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর বদৌলতে ক্রমবর্ধমান মোটরসাইকেল ঢাকার যানবাহন ব্যবস্থাপনাকে বিশৃঙ্খল করে তুলছে বলে মত দিয়েছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, দুই চাকার গাড়ি কখনই নিরাপদ বাহন নয়। বাণিজ্যিকভাবে যখন ব্যবহার হয়, তখন এগুলো আরো অনিরাপদ হয়ে ওঠে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে। দুঃখের বিষয়, রাইড শেয়ারিং নীতিমালায় মোটরসাইকেলকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটা একটা ভুল পদক্ষেপ। মোটরসাইকেলের বেপরোয়া চলাচল ঠেকাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে আরো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
- কার্টসি: বণিকবার্তা / ০২ অক্টোবর ২০১৮