সম্পাদকীয়
জনদুর্ভোগ বাড়ানো সরকারের কাজ নয়
যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ ও শোভাযাত্রা করা সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার হলেও বিরোধী দলকে কদাচিৎ সেই সুযোগ দেওয়া হয়। যুক্তিসংগত বাধানিষেধ তখনই আরোপ করা যেতে পারে, যখন জনশৃঙ্খলা ভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু যাঁরা আইনের প্রয়োগ করবেন, তাঁরাই যদি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
যেখানে সরকারি দল বা জোট চাইলেই সভা-সমাবেশ করার অনুমতি পায়, সেখানে বিরোধী দলকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সংবিধানকে অস্বীকার করার শামিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ সরকারের সহযোগী বলে পরিচিত বিভিন্ন দল ও সংগঠন নানা উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করলেও নিকট অতীতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে সেই সুযোগ না দেওয়া ছিল দুর্ভাগ্যজনক। নানা বাগ্বিতণ্ডার পর ২২ দফা শর্তে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) বিএনপিকে গত রোববার সেখানে জনসভা করার অনুমতি দিয়েছে এবং বিএনপিও শান্তিপূর্ণভাবে জনসভা করে তাদের দাবিদাওয়ার কথা বলেছে। কোনো সমস্যা হয়নি। এ জন্য ডিএমপি ধন্যবাদ পেতে পারত, যদি না তারা জনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে মানুষকে দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দিত।
রোববার ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রবেশদ্বারে পুলিশ প্রহরা ও তল্লাশি চালানোয় এক অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সেদিন ঢাকা শহরে বাইরে থেকে যেসব যানবাহন ঢুকেছে, পুলিশ সেখানেই তল্লাশি চালিয়েছে। চিকিৎসা, পরীক্ষাসহ জরুরি কাজে আসা মানুষও তাদের এই অভিযান থেকে রেহাই পায়নি। সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, পুলিশের তল্লাশির কারণে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট হয়েছে গাবতলীতে। অনেক যাত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে, কেউ কেউ হেঁটে গন্তব্যে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
এ ব্যাপারে ডিএমপির পক্ষ থেকে ‘রুটিন তল্লাশির’ যে অজুহাত দেখানো হয়েছে, সেটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। রুটিন তল্লাশিটি কেন বিএনপির নির্ধারিত জনসভার দিন হবে? আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টির জনসভার দিন পুলিশকে কেন এ রকম তল্লাশি চালাতে দেখা যায় না? ঢাকার বাইরে থেকে কে জনসভায় এসেছেন, কে অন্য কাজে এসেছেন—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেটিই-বা কীভাবে ফারাক করবে? তারা যখন জনসভার অনুমতি দিয়েছে, তখন সেখানে যে কারও যাওয়ার পথও খোলা রাখতে হবে। পুলিশের দেখার দায়িত্ব কেউ জনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করে কি না; মোড়ে মোড়ে চৌকি বসিয়ে তল্লাশির নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা নয়।
যেখানে স্বাভাবিক অবস্থায়ই ঢাকা শহরের মানুষ যানজটে নাকাল, সেখানে একটি দলের জনসভার দিনে এ ধরনের তল্লাশি চালানো অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলেই মনে করি। এর আগেও বিএনপির জনসভা বা অন্য কোনো কর্মসূচির দিনে পুলিশকে তল্লাশি অভিযানে নামতে দেখা গেছে। আবার বিএনপি সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের জনসভা বা কর্মসূচিকেও এভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে। এই অপসংস্কৃতি থেকে আমরা কবে বের হয়ে আসতে পারব?
নির্বাচন সামনে রেখে সব দলই সভা-সমাবেশ করবে, নতুন নতুন কর্মসূচি নেবে। কর্মসূচি নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের খেয়াল রাখতে হবে যেন জনদুর্ভোগ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা যায়। ছুটির দিনের বাইরে ঢাকায় সভা-সমাবেশ না করার একটি দাবি ছিল নগরবাসীর পক্ষ থেকে। বিএনপিও সমাবেশটি করতে চেয়েছিল আগের দিন শনিবার। কিন্তু ১৪ দলের জনসমাবেশ থাকায় তারা কর্মসূচিটি এক দিন পিছিয়ে নেয়। ভবিষ্যতে কর্মসূচি নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম সমন্বয় হলে জনদুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমবে আশা করি। জনদুর্ভোগ বাড়ানো সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ নয়।
- কার্টসি: প্রথম আলো /০২ অক্টোবর ২০১৮
No comments:
Post a Comment