ইয়ামিন সাজিদ
শুরু থেকেই প্রকল্পের কাজে ধীরগতি ও অসঙ্গতি। শেষ পর্যন্ত কাজ অসমাপ্ত রেখে প্রকল্পই বাতিল। ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেও খুলনা অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ করতে পারেনি পেট্রোবাংলা। যদিও আর্থিক ক্ষত ঠিকই বইতে হচ্ছে। বাতিল হওয়ার পরও প্রকল্পের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে নেয়া ২৫০ কোটি টাকা ঋণ ৫ শতাংশ হারে সুদসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে।
কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা ও বাগেরহাটসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মোট ৮৪৫ কিলোমিটার গ্যাস বিতরণ লাইন নির্মাণের জন্য কেনা ১৪৮ কোটি টাকার পাইপও পড়ে আছে। অন্যান্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানির কাছে এসব পাইপ বিক্রির কথা থাকলেও তা অবিক্রীতই রয়ে গেছে। খুলনার শিরোমনি এলাকায় স্তূপাকারে ফেলে রাখা হয়েছে চীন থেকে আমদানি করা এসব পাইপ।
২০০৯ সালে পাস হওয়া ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ক’ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় মোট ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডিবির কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হয় ২৫০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাতিল হওয়ার আগে ৩৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ও করেছে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড।
পেট্রোবাংলা সূত্রগুলো বলছে, যেহেতু প্রকল্পটি সরকারের নির্দেশে নেয়া হয়েছে, গ্যাস না থাকায় সরকারই আবার এটি বন্ধ করেছে। ফলে প্রকল্পটি নেয়ার পর বরিশাল ও খুলনায় গ্যাস বিতরণের জন্য সৃষ্ট সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির এ ঋণ পরিশোধের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। যদিও চুক্তির সময় কোম্পানি গঠন ও ওই কোম্পানি ঋণ পরিশোধ করবে বলা হয়েছিল। তবে কোম্পানির আয় না থাকায় তারা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারবে না বলে পেট্রোবাংলাকে জানিয়েছে।
সুদসহ ঋণের অর্থ কে পরিশোধ করবে পেট্রোবাংলার পর্ষদ সভায় তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনাও হয়েছে। অর্থ বিভাগ থেকে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করার জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় সভায়। সে অনুযায়ী জ্বালানি বিভাগে একটি চিঠিও দেয়া হয়। এরপর এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলে চুক্তিটি যেহেতু পেট্রোবাংলা করেছে, সুদসহ ঋণও তাদেরই পরিশোধ করতে হচ্ছে।
জানা যায়, বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে চুক্তি স্বাক্ষর করে ইআরডি। পরে ইআরডি ওই টাকা পরিশোধ করে। কোথা থেকে আসবে সেটা ইআরডির বিবেচ্য নয়। ইআরডির বরাদ্দ থাকে, তা থেকে ঋণ পরিশোধ করা হয়। তবে এ ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে একটি সাবসিডিয়ারি লোন এগ্রিমেন্ট (এসএলএ) হয়। সে অনুযায়ী ইমপ্লিমেন্টিং এজেন্সি প্রকল্পের মালিক ঋণের টাকা সরকারকে পরিশোধ করে। সরকার ইআরডির মাধ্যমে তা ঋণদাতাকে পরিশোধ করে।
পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, এসএলএ অনুযায়ী তো সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির এ ঋণ পরিশোধ করার কথা। তবে কোম্পানিটির যে অবস্থা, তাতে এ ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা তাদের নেই। সম্ভবত পেট্রোবাংলাই এ ঋণ পরিশোধ করবে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করতে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে ২০০৬ সালে এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করে সরকার। এডিবি ও সরকারের যৌথ অর্থায়নে ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস নেটওয়ার্ক’ শীর্ষক একটি প্রকল্পও ২০০৯ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পাস হয়। খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া— এ পাঁচ জেলার জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নকাল ছিল ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহে ২০১১ সালে গঠন করা হয় সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। বিতরণ লাইন ও মিটারিং স্টেশন স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পাইপ-যন্ত্রপাতি কেনা হয়, সম্পন্ন হয় ভূমি অধিগ্রহণও। এসব কাজে ব্যয় হয় ৩৫০ কোটি টাকার বেশি। প্রকল্প শুরুর সাত বছরে খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচ জেলায় ৮৪৫ কিলোমিটার বিতরণ পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শুরু করতেই ব্যর্থ হয় বাস্তবায়নকারী সংস্থা। অগ্রগতি সন্তোষজনক না হওয়ায় অসমাপ্ত রেখেই প্রকল্প সমাপ্তের নির্দেশ দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। সেই সঙ্গে নির্দেশ দেয়া হয় প্রকল্পের জন্য কেনা পাইপ ও যন্ত্রাংশ বিক্রির।
চীন থেকে আমদানি করা প্রায় ১১ হাজার টন এপিআই পাইপ প্রকল্প বাতিলের পর থেকেই খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হয়। এগুলো কিনতে পেট্রোবাংলা রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানিকে নির্দেশ দিলেও মরিচা পড়া এসব পাইপের মান নিয়ে শঙ্কা থাকায় তা ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান।
চীন থেকে আমদানি করা এসব পাইপ স্তূপ করে রাখা হয়েছে খুলনার শিরোমনি এলাকায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, আবাসিক সংযোগের জন্য আনা প্রায় ১৫০ কোটি টাকার পাইপ পড়ে আছে একটি পরিত্যক্ত জমিতে। শিরোমনি এলাকার আফিল গেটে প্রায় এক একর জায়গাজুড়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে সেগুলো। সেখানে ২ থেকে ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাসের পাইপ রয়েছে। রোদ-বৃষ্টিতে দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় মরিচা ধরে এগুলো রঙ হারিয়েছে অনেক আগেই। পাইপের গায়ে মরিচার পুরু স্তর জমেছে। হালকা নড়াচড়াতেই মোটা স্তর ধরে মরিচা উঠে আসে।
জানতে চাইলে বাতিল হওয়া এ প্রকল্পের পরিচালক ও বর্তমানে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের দপ্তরে নিযুক্ত রেজাউল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, আবাসিক খাতে গ্যাস বিতরণের জন্য প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু গ্যাস না থাকায় পেট্রোবাংলা, অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান এডিবি ও বাংলাদেশ সরকার দেড় বছর আগে প্রকল্পটি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। পাইপসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ পেট্রোবাংলার অন্যান্য কোম্পানির কাছে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোনো পাইপ নষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই।
গ্যাসের লাইনে ব্যবহূত পাইপ আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউটের (এপিআই) নির্দেশনা মেনে তৈরি করতে হয় বলে এগুলো এপিআই পাইপ নামে পরিচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এপিআই পাইপের কাঁচামাল মাইল্ড স্টিলে সর্বোচ্চ দশমিক ২৬ শতাংশ কার্বন, দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ সালফার, দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ ফসফরাস ও ১ দশমিক ২০ শতাংশ ম্যাঙ্গানিজের মিশ্রণ থাকে। গ্যাস সংযোগে ব্যবহূত এ পাইপে কার্বনের পরিমাণ কম থাকায় ও মাটির নিচে স্থাপনের কারণে তা বিশেষ ধরনের কোটিং ও টেপ দিয়ে মোড়াতে হয়। তবে পাইপ তৈরির সময় এর উপরের স্তরে কোনো কোটিং ব্যবহার করা হয় না বলে তা বাইরের পরিবেশে খোলা অবস্থায় দীর্ঘদিন রাখা হলে অক্সিডেশনের কারণে আয়রন অক্সাইড তৈরি হয়ে মরিচা পড়ে। পাইপের মুখ খোলা থাকায় এর ভেতরেও বাইরের মতো মরিচা পড়লে পাইপের পুরুত্ব কমে যায়। এতে পাইপের আয়ুষ্কাল কমে যাওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে।
কার্টসি: বণিক বার্তা /০১ অক্টোবর ২০১৮
No comments:
Post a Comment