সেপ্টেম্বরেই চার হাজার মামলায় সাড়ে তিন লাখ আসামি
দশ বছরে বিএনপির প্রায় ২৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ৯৫ হাজারেরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি কাজে বাধা, নাশকতা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব মামলাকে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি। গত সেপ্টেম্বর মাসেই চার হাজার ৯৪টি মামলায় তিন লাখ ৫৭ হাজার ২১০ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এরমধ্যে এজাহারে নাম উল্লেখ করা হয়েছে ৮ হাজার ৪৮০ জনের। বাকিরা অজ্ঞাতনামা।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বিএনপি বলছে, নির্বাচন ও আন্দোলনকে সামনে রেখেই এসব ‘গায়েবি’ মামলায় নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে তাকে ‘মিথ্যা মামলা’য় কারাগারে রাখা হয়েছে। সিনিয়র নেতারা যেন নির্বাচনের প্রস্তুতি বাদ দিয়ে আদালতে ব্যস্ত সময় কাটান, সে জন্য তাদের নামে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করুক তা আওয়ামী লীগ চায় না। কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। আদালতের মাধ্যমেই মামলার সত্যমিথ্যা প্রমাণ হবে। এখানে আওয়ামী লীগের কিছু করার নেই। জানা যায়, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দফতর শাখা নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা নিয়ে কাজ করছে। পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা ও পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন খান এসব মামলার তথ্য সংগ্রহ করছেন।
গত ২০০৭ সাল থেকে গতকাল পর্যন্ত বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার কী অবস্থা তা নিয়ে একটি ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তথ্যমতে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩৪টি মামলা হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে আছে ৩৬টি মামলা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ১০৬টি, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ছয়টি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে ১১টি, তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২৩টি, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে ২০টি, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে ৫৪টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৮৪টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৬৭টি, ড. মঈন খানের বিরুদ্ধে দুটি, নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে ১২টি, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা আছে। এ ছাড়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে ১৩টি, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের বিরুদ্ধে ১৮টি, মেজর (অব.) হাফিজের বিরুদ্ধে ১৪টি, বরকত উল্লাহ বুলুর বিরুদ্ধে ১২৯টি, মো. শাহজাহানের বিরুদ্ধে ৩১টি, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ৮৬টি, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের বিরুদ্ধে ৪৮টি, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ১৪৭টি, খায়রুল কবির খোকনের বিরুদ্ধে ৫১টি, হাবিব-উন-নবী খান সোহেলে বিরুদ্ধে ৪৫৩টি, আসলাম চৌধুরী ও হারুন-অর রশীদের বিরুদ্ধে ৬৭টি, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বিরুদ্ধে ১৮৭টি, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এহছানুল হক মিলনের বিরুদ্ধে ৫৬টি, ঢাকা মহানগর বিএনপির উত্তর শাখার সভাপতি এম এ কাইয়ুমের বিরুদ্ধে ১৩৬টি, সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসানের বিরুদ্ধে ২৭টি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশারের বিরুদ্ধে ৪৭টি, যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নীরবের বিরুদ্ধে ১৫৮টি, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ২২৭টি, ছাত্রদল সভাপতি রাজীব আহসানের বিরুদ্ধে ১০৬টি এবং সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানের বিরুদ্ধে ১২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতাদের নির্বাচনের বাইরে রাখতেই নিত্যনতুন মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলায় বেগম জিয়াকে আজ কারাবন্দী করে রাখা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি নেতা-কর্মীরা এখন আর ভীত নন। তিনি বলেন, মামলা মোকাবিলা করে আমরা অভ্যস্ত। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে আমরা নির্বাচনে যেতে চাই। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এসব মামলা দিয়েও বিএনপির বিজয় ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।
বিএনপির এত বিপুল সংখ্যাক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে এখন খুন, গুম হচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনায় ভৌতিক মামলা হচ্ছে। দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক মামলা দায়ের করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশে ঢালাওভাবে এ ধরনের গায়েবি মামলা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিরোধী নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করা। আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো যাতে মাঠে থাকতে না পারে সেজন্য এসব মামলা করা হয়েছে।
মামলার রিট শুনানির অপেক্ষায়
গত সেপ্টেম্বর মাসে বিএনপির জ্যেষ্ঠ আইনজীবীসহ সারা দেশে ৩ লাখেরও বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা ৪ হাজার মামলা সংক্রান্ত একটি রিট আবেদন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। ওই রিট আবেদনে এসব মামলাকে ‘গায়েবি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর রিট আবেদনটি দাখিলের পর ২৪ সেপ্টেম্বর শুনানির জন্য বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি আহমদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করা হয়। তবে অ্যাটর্নি জেনারেলের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওইদিন শুনানি হয়নি। আগামী সপ্তাহে এ রিট আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবী মাসুদ রানা।
তিনি বলেন, আমরা আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করেছিলাম। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল সুপ্রিম কোর্টের অবকাশের পর শুনানি করতে চেয়েছেন। এখন অবকাশ শেষ হয়েছে। আমরা শুনানির প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করছি আগামী সপ্তাহে শুনানি হবে।
আগাম জামিনের চেষ্টায় নেতা-কর্মীরা
সারা দেশের বিভিন্ন ঘটনায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় আসামি হয়েছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরাও। গ্রেফতার এড়াতে আগাম জামিন নিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের এসব আইনজীবী। পাশাপাশি বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতাও আগাম জামিনের জন্য সুপ্রিম কোর্টে ভিড় জমাচ্ছেন। এর মধ্যে সরকারি কাজ ও পুলিশকে বাধা দেওয়া সংক্রান্ত নাশকতার অভিযোগে রাজধানীর হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন থানায় করা মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া গতকাল হাই কোর্ট থেকে আগাম জামিন পেয়েছেন।
এর আগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পল্টন ও আদাবর থানায় দায়ের করা আট মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম ও ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ সাতজনের আগাম জামিন মঞ্জুর করেছেন হাই কোর্ট। জামিনপ্রাপ্ত বিএনপির অন্যান্য নেতারা হলেন, অ্যাডভোকেট আবদুর রেজ্জাক খান, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামান, অ্যাডভোকেট ফেরদৌস ওয়াহিদা ও অ্যাডভোকেট তাহেরুল ইসলাম তৌহিদ। তার আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ ছয় আইনজীবী পল্টন, খিলগাঁও, মতিঝিলসহ বিভিন্ন থানায় দায়ের করা নাশকতার মামলায় আগাম জামিন নিয়েছেন।
বন্ধ হচ্ছে না গ্রেফতার
চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক ফারুক তাহের জানান, চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা-কর্মীদের গণগ্রেফতার ও তাদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা অব্যাহত রয়েছে। আতঙ্কে রয়েছেন বিএনপির কর্মী থেকে শীর্ষ নেতারা। গত দুই সপ্তাহে নগরীর ১৫টি থানায় তিন শতাধিক নেতা-কর্মীর নামে মামলা হয়েছে বলে নগর বিএনপি জানিয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে শতাধিক নেতা-কর্মীকে। গ্রেফতারের ভয়ে অনেকে নিজেদের বাসা-বাড়িতে থাকতে পারছেন না বলেও জানা গেছে।
নগরীর চান্দগাঁও থানায় সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার ও নগর বিএনপির সহসভাপতি মাহবুবুল আলমকে ১ নম্বর আসামি করে ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পাহাড়তলী থানায় গত ১৭ সেপ্টেম্বর ছয়জনকে আসামি করে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে নগর বিএনপির সহ যুববিষয়ক সম্পাদক আজাদ বাঙ্গালীকে। একই দিনে খুলশী থানায় মামলা করা হয়েছে বিএনপির ৪৫ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। হালিশহর থানায় চারজনকে আসামি করে গত ১১ সেপ্টেম্বর একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে নগর বিএনপির সদস্য আজিজুর রহমান বাবুলকে। একই দিনে নগরীর বন্দর থানায় সাতজনকে আসামি করে পুলিশ একটি মামলা দায়ের করেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে যুবদল নেতা মো. এরশাদকে।
১৫ সেপ্টেম্বর পতেঙ্গা থানায় বিএনপি নেতা মোহাম্মদ রফিক ও মোহাম্মদ লোকমানকে আসামি করে অজ্ঞাত ৭৫ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছে। আকবর শাহ থানায় ৫০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে আকবর শাহ থানা বিএনপির সভাপতি আবদুস ছাত্তার সেলিম, সহসভাপতি শহিদ উল্লাহ ভূইয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া গোলাপ। আসামির তালিকায় রয়েছেন— থানা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আইয়ুব খান, সাধারণ সম্পাদক মাইনুদ্দীন চৌধুরী মাইনু, থানা বিএনপি নেতা মহসিন তালুকদার, রফিক উদ্দীন, ফরিদুল আলম ও মো. সেলিম উদ্দীন প্রমুখ। নগরীর ডবলমুরিং থানার পুরনো একটি মামলায় গত সপ্তাহে গ্রেফতার হয়েছেন থানা বিএনপি নেতা নুরুল আলম, জাহাঙ্গীর আলম, মাহবুব আলম ও মো. ইদ্রিছ।
- কার্টসিঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন/২ অক্টোবর, ২০১৮