Search

Thursday, October 4, 2018

সব ভালোই ভালো নয়

বদিউল আলম মজুমদার

গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংবাদমাধ্যমকর্মী ও নাগরিক সমাজের ব্যাপক আপত্তির মুখে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ পাস করেছে। আইনটি ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পর্বতপ্রমাণ বাধা সৃষ্টি করবে বলে অনেকেরই আশঙ্কা। আরও আশঙ্কা, আইনটি ডিজিটাল অপরাধ দমন করার লক্ষ্যে প্রণীত হলেও এটি একটি কালাকানুন এবং এটির অপব্যবহার অনিবার্য, যেমন অপপ্রয়োগ হয়েছে ও হচ্ছে ২০০৬ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার। এটি সরকারের অন্যায় কাজের সমালোচনাকারীদের হয়রানির কাজে ব্যবহৃত হবে এবং আমাদের গণতান্ত্রিক পরিসরকে ভয়ানকভাবে সংকুচিত করবে।

এসব আশঙ্কা সত্ত্বেও আমাদের সম্মানিত তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী এটিকে ঐতিহাসিক আইন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, সব ভালোই ভালো নয়। আর প্রজ্ঞাবানদের মতে, ‘অল দ্যাট গ্লিটার্স ইজ নট গোল্ড’—চকচক করলেই সোনা হয় না।

উদাহরণ হিসেবে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের কথা ধরা যাক। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ এই আইনের জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। আবার পঁচাত্তর–পরবর্তীকালে এই আইনের অপব্যবহারের শিকার হয়েছিলেন আওয়ামী লীগেরই নেতা-কর্মীরা। জননিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০০ সালে প্রবল আপত্তির মুখ পাস করে। কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এর জন্য ব্যাপক মাশুল দিতে হয়েছিল।

আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও কিছু সিদ্ধান্ত যে পরবর্তী সময়ে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে, তার আরেকটি উদাহরণ হতে পারে ২০১১ সালে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী। স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০১০ সালে সরকার মহাজোটের অংশীদার সব দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে ১৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি ২৭টি বৈঠক করে, তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, ১১ জন শীর্ষ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ১৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক, ১৮ জন সম্পাদক, রাজনৈতিক দলের নেতাদের মতামত নেয়। বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রায় সবাই বিরোধী দলকে সম্পৃক্ত করার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে বহাল রাখার পক্ষে মতামত দেন। কমিটিও সে অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার রেখেই সংবিধান সংশোধনের সর্বসম্মত সুপারিশ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পরবর্তীকালে এ সুপারিশ বদলে যায় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়েই একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধন করা হয়, যদিও আমাদের সংবিধানের ৭ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধান ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’ বা ‘উইল অব দ্য পিপলে’এর প্রতিফলন হওয়া উচিত। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল একটি মীমাংসিত বিষয় এবং এ-সম্পর্কে একটি জাতীয় ঐকমত্যও বিরাজ করছিল।

একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞজনেরা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া (মেজোরেটারিয়ানিজম) বলে আখ্যায়িত করেন। জেমস মেডিসনের ভাষায়, এটি হলো ‘টিরানি অব দ্য মেজরিটি’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বেচ্ছাতন্ত্র, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, বিশেষত সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলও সরকারের অংশ। কিন্তু আমাদের দেশের ‘উইনার টেক অল’ বা বিজয়ীদেরই সবকিছু করায়ত্ত থাকার প্রক্রিয়ায় বিরোধী দল সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত। এ থেকে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা দখল করা এবং আঁকড়ে ধরে থাকার প্রচেষ্টার সংস্কৃতি আমাদের ওপর জেঁকে বসেছে।

তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে আইনকে ‘অস্ত্রে’ পরিণত করা হয়েছে। এর লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ রুদ্ধ করার মাধ্যমে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা। আমাদের ইতিহাসের শিক্ষা হলো, দলীয় সরকারের অধীনে অতীতে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। কারণ, ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে নির্বাচনী ফলাফল প্রভাবিত করা সম্ভব হয়েছে। আর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সাম্প্রতিক কালের লাগামহীন দলীয়করণ এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের পক্ষে জাতীয় নির্বাচনে জেতা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবির পেছনে উদ্দেশ্য ছিল ‘ভোট চুরি, সন্ত্রাস, কালোটাকা ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন’ করার প্রচেষ্টা বন্ধ করা (শেখ হাসিনা, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে’, ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা’, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মতে, ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যে অনিয়ম চলছে, সে অনিয়ম দূর করে একটা সুস্থ ধারা নিয়ে আসা একান্ত অপরিহার্য। এ দেশে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না, যদি না ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট হয়। আর সে কারণেই অন্তত আগামী কয়েকটি নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করবার একটা ব্যবস্থা নিলে এই অনিয়মগুলি দূর করা যেতে পারে’ (পৃ.৭৮-৭৯)।

২০১১ সালে একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পরে এসব নির্বাচনী অনিয়ম আমাদের দেশে আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের ভিত্তিতে সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা বহুলাংশে লোপ পায়, ফলে সরকারের স্বচ্ছ ও জবাবদিহি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রায় তিরোহিত হয়ে যায়। সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং সুশাসন সুদূরপরাহত হয়ে পড়ে। এমনই পরিস্থিতিতে সরকার ও দলের মধ্যে বিভাজন বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং ক্ষমতাসীনেরা প্রায় সর্বক্ষেত্রে বেপরোয়া ও বেসামাল হয়ে পড়ে। সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় অনেকে অনেক অন্যায় ও গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কারণ, ক্ষমতাসীনদের আর ভোটারদের সমীহ করার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়।

আর এসব বাড়াবাড়ির কারণে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকার/সরকারি দলের জনসমর্থনে ব্যাপকভাবে ভাটা পড়ে। তাই একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যাপক জনসমর্থন ও ভূমিধস বিজয় নিয়ে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও, ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন দলকে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হতে হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তাদেরকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কতগুলো অভিনব স্লোগান এবং নির্বাচন কমিশন ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের ওপর ভর করতে হয়েছে।

তবে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আসা সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলো একটি নজরদারির কাঠামো, যেখানে সংসদে এবং সংসদের বাইরে সরকারের কার্যক্রমের ওপর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নজরদারি থাকবে। সংসদে বিরোধী দল সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। সংসদের বাইরে বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম ক্ষমতাসীনদের অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর এমন ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস’ পদ্ধতি ভেঙে পড়ে। বস্তুত আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজমান ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং একদলীয় শাসন কায়েমের পথ সুগম হয়, যা সরকার ও সরকারি দলকে আরও বেসামাল হতে সহায়তা করে। বর্তমানে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে জনমনে যে সংশয়, তা সরকার ও সরকারি দলের এই নগ্ন ক্ষমতার দাপটেরই ফসল।

পরিশেষে, এটি সুস্পষ্ট যে সম্প্রতি সংসদে পাস করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আইনের মোড়কে একটি ভয়াবহ অস্ত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চরম দলীয়করণের শিকার, যা এক দিনে হয়নি এবং এক সরকারের আমলেও ঘটেনি। একটি পক্ষপাতদুষ্ট সশস্ত্র বাহিনীর হাতে এমন একটি অস্ত্র তুলে দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা হয়তো সাময়িকভাবে কিছু ফায়দা লুটতে পারবে, কিন্তু এর অপপ্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে যে অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হবে, তার মাশুল একদিন শুধু ক্ষমতাসীনদেরই নয়, পুরো জাতিকেই দিতে হবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে এটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য মঙ্গলকর হবে না। কারণ, আইনটি অপপ্রয়োগের ফলে তাদের প্রতি জনরোষ ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। তাই আশা করি, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দীর্ঘমেয়াদি পরিণতির কথা গভীরভাবে ভাববে।

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০৪ অক্টোবর ২০১৮

No comments:

Post a Comment