ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা সংশোধনের দাবিতে আগামীকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করবে সম্পাদক পরিষদ। বেলা ১১টায় এ মানববন্ধনে শুধু সম্পাদক পরিষদের সদস্যরা অংশ নেবেন। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করে সংগঠনটি।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। সম্পাদক পরিষদের লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন শেষে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি।
মাহফুজ আনাম বলেন, আমরা আইনটি বাতিল চাইনি। কতগুলো বিশেষ ধারার আমূল পরিবর্তন চেয়েছি। এ পরিবর্তন সম্ভব। আমরা আশা করব, ওই ধারাগুলো সংশোধন করে আইনটি সংশোধন করা হবে।
লিখিত বক্তব্যে শ্যামল দত্ত বলেন, আমাদের মৌলিক আপত্তি, বারবার প্রতিবাদ, সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে দুবার বৈঠক সত্ত্বেও মুক্ত সংবাদমাধ্যম, বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী কালাকানুন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে (ডিএসএ) আইনে পরিণত করায় আমরা যারপরনাই হতাশ, ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। তিনজন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর গণমাধ্যমবিষয়ক উপদেষ্টা প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রহণযোগ্য পরিবর্তন-পরিমার্জনার লক্ষ্যে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শুরু হবে। বিস্ময়করভাবে এসবের কিছুই করা হলো না। সম্পাদক পরিষদকে তিনজন মন্ত্রী যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এটি তার বরখেলাপ।
তিনি বলেন, তথ্যমন্ত্রীর অনুরোধে আমাদের মানববন্ধন কর্মসূচি স্থগিত রেখেছিলাম। তবে আবারো এ মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করছি। আগামীকাল সোমবার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেবেন শুধু সম্পাদক পরিষদের সদস্যরা।
উল্লেখ্য, গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়। এতে উদ্বেগ জানিয়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর দেয়া এক বিবৃতিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ২৯ সেপ্টেম্বর মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করে সম্পাদক পরিষদ। ২৬ সেপ্টেম্বর সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের কাছে চিঠি দেন তথ্যমন্ত্রী। চিঠিতে মানববন্ধন কর্মসূচি স্থগিত করে ৩০ সেপ্টেম্বর আইনটি নিয়ে বৈঠকে বসার আহ্বান জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মানববন্ধন কর্মসূচি স্থগিত রেখে বৈঠকে অংশ নিতে রাজি হয় সম্পাদক পরিষদ।
এরপর তথ্যমন্ত্রীসহ সরকারের তিন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগের কথা মন্ত্রিসভায় উত্থাপন ও আইনটির একটি সংশোধিত খসড়া প্রণয়নের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেন আইনমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী। তবে পরবর্তী দুটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে এটি উত্থাপন করা হয়নি। বরং এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতি এতে সই করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থান ও উদ্দেশ্য গণমাধ্যমকে জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ।
সংবাদ সম্মেলনে সাত দফা দাবি জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। দাবিগুলো হচ্ছে— সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা সুরক্ষার লক্ষ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা অবশ্যই যথাযথভাবে সংশোধন করতে হবে। এসব সংশোধনী বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনে আনতে হবে। পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালানোর ক্ষেত্রে তাদের শুধু নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু আটকে দেয়ার অনুমতি দেয়া যাবে; কিন্তু কোনো কম্পিউটার ব্যবস্থা বন্ধ করার অনুমতি দেয়া যাবে না। তারা শুধু তখনই প্রকাশের বিষয়বস্তু আটকাতে পারবে, যখন সংশ্লিষ্ট সংবাদপ্রতিষ্ঠানের সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করে কেন ওই বিষয়বস্তু আটকে দেয়া উচিত, সে বিষয়ে যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারবে। কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কোনো কম্পিউটার ব্যবস্থা আটকে দেয়া বা জব্দ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই উচ্চ আদালতের আগাম নির্দেশ নিতে হবে। সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীদের সাংবাদিকতার দায়িত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমেই আদালতে হাজির হওয়ার জন্য তাদের বিরুদ্ধে সমন জারি করতে হবে (যেমনটা বর্তমান আইনে আছে) এবং সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীদের কোনো অবস্থাতেই পরোয়ানা ছাড়া ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া আটক বা গ্রেফতার করা যাবে না। সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীর দ্বারা সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের গ্রহণযোগ্যতা আছে কিনা, তার প্রাথমিক তদন্ত প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে করা উচিত। এ লক্ষ্যে প্রেস কাউন্সিলকে যথাযথভাবে শক্তিশালী করা যেতে পারে। এ সরকারের পাস করা তথ্য অধিকার আইনকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ওপর প্রাধান্য দেয়া উচিত। ওই আইনে নাগরিক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য যেসব স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সেগুলোর সুরক্ষা অত্যাবশ্যক।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, ইনকিলাব সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দীন, নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবির, সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান, যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম, করতোয়ার সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, নয়াদিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দীন, ইনডিপেনডেন্ট সম্পাদক শামসুর রহমান, বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ঢাকা ট্রিবিউন সম্পাদক জাফর সোবহান, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শহিদুজ্জামান ও সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি।
- কার্টসিঃ বনিক বার্তা/১৪ অক্টোবর ২০১৮