সম্পাদকীয়
বিদেশে অর্থ পাচার যে অব্যাহত আছে তা নানাভাবেই প্রকাশ পাচ্ছে। নির্বাচনী বছর হওয়ায় বর্তমানে অর্থ পাচার হচ্ছে আরও বেপরোয়াভাবে। এমনটি মনে করার কারণ হল, নির্বাচনী বছরে সচরাচর অর্থ পাচার বেড়ে যায়। যাদের কাছে উদ্বৃত্ত টাকা আছে, তারা ওই অর্থ দেশে রাখা নিরাপদ মনে করেন না। তারা নানা অনিশ্চয়তায় ভোগেন। ভাবেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠতে পারে। তাতে তাদের সমস্যা হতে পারে। তাই তারা দেশে টাকা রাখতে চান না, যদিও অর্থ পাচার একটি বড় অপরাধ। অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই অর্থ পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
অর্থ পাচার বৃদ্ধি পাওয়ার একটি লক্ষণ হল, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করলেও ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বেড়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির হার যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশে যে হারে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, বিদেশে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি হারে। এটি অস্বাভাবিক। গত ১০ বছরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। বস্তুত অর্থ পাচারের ঘটনা সবসময়ই ঘটছে। সুইস ব্যাংকের রিপোর্ট, পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে পাচারের তথ্য রয়েছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ বছরে পাচার হয়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা। অঙ্কটি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো।
অর্থ পাচার হচ্ছে নানা পন্থায়। এর একটি হল, আমদানির নামে এলসি খুলে বিল পরিশোধ করা হচ্ছে; কিন্তু কোনো পণ্যই দেশে আসছে না। এছাড়া আমদানিতে বেশি মূল্য দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রফতানি মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং) এবং হুন্ডির মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচারের একটি বড় মাধ্যম হয়ে দেখা দিয়েছে রেমিটেন্স। একটি চক্র বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবাসীদের রেমিটেন্স সংগ্রহ করে তা বিদেশেই রেখে দেয়, আর দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় এর দায় শোধ করা হয়। আমাদের ধারণা, এর বাইরেও আরও নানাভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে। পাচারের ছিদ্রগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তা বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া গেলে রোধ হতে পারে অর্থ পাচার। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে তৎপর হতে হবে এবং নজরদারি বাড়াতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকাটাও জরুরি বটে।
অর্থ পাচার রোধে আরও একটি বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। যে অর্থ পাচার হয়ে যায়, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ভালো থাকলে সেই অর্থ দেশেই বিনিয়োজিত হতো। এর ফলে নতুন নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত, বাড়ত কর্মসংস্থানের সুযোগ। কাজেই অর্থ পাচার রোধে বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। দৃষ্টি দিতে হবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার বিষয়েও। স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ দেশে পুঁজির নিরাপত্তার অভাব অনেকাংশে দূর করে থাকে। বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থের বড় অংশ দুর্নীতির টাকা। কাজেই দুর্নীতির লাগামও টেনে ধরতে হবে শক্ত হাতে।
- কার্টসিঃ যুগান্তর/ ১১ অক্টোবর ২০১৮
No comments:
Post a Comment