সম্পাদকীয়
সরকারের নৈতিক বৈধতা
গত রোববার বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) ঢাকায় ‘গুণগত মান ও মর্যাদা নিয়ে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ: বাংলাদেশের অ্যাজেন্ডা’ শীর্ষক এক নাগরিক সংলাপের আয়োজন করেছিল। সেখানে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এবারের ভোটের পর যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তার নৈতিক বৈধতার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জরুরি।
আমরা তাঁর এ বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি। এমন বক্তব্য এসেছে সম্ভবত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনের হতাশাব্যঞ্জক অভিজ্ঞতার স্মৃতি থেকে, যে নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টিতেই সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। কারণ, প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল। অর্থাৎ নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হয়নি, এবং সেই কারণে ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সরকারকে আইনত বৈধ বলা হলেও তার গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি খোদ সরকারি মহলেও অনুভূত হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়েছিল। তাই একাদশ সংসদ নির্বাচন আসছে, তখন সবাই চাইছেন নির্বাচন যেন পূর্ণমাত্রায় অংশগ্রহণমূলক হয়।
প্রাথমিকভাবে সেই সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে: আসন্ন নির্বাচনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল বিএনপিসহ প্রায় সব দলই অংশ নিতে যাচ্ছে। এই সর্বজনীন অংশগ্রহণ ভোট গ্রহণের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সুনিশ্চিত করতে হলে নির্বাচন অবশ্যই সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে হবে। এই দায়িত্ব প্রধানত নির্বাচন কমিশনের। প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন মোটের ওপর সন্তোষজনক ছিল। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে, অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা পর্ব শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে সংঘাত–সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, যেভাবে বিরোধী দলগুলোর প্রার্থীরা এবং তাঁদের কর্মী–সমর্থকেরা হামলার শিকার হচ্ছেন, এতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। এসব হামলার আইনি প্রতিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা ইতিমধ্যে নানা প্রশ্ন ও সংশয়ের জন্ম দিয়েছে।
গতকালের এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে আমরা উল্লেখ করেছি, বিরোধী দলগুলোর প্রার্থীদের প্রচারকাজে বাধা দেওয়া এবং স্বয়ং প্রার্থীদের ওপর হামলা চালানোর ফলে নির্বাচনে সব প্রার্থীর সুযোগের সমতার নীতি লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই গুরুতর নির্বাচনী অপরাধের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয় থাকার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটি হামলার অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া নির্বাচন কমিশনের জরুরি দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা আসন্ন নির্বাচনের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর প্রার্থীদের ওপর হামলার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকজনকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা সব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করছেন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে পরিপূর্ণ সততা ও পক্ষপাতহীনতার সঙ্গে প্রতিটি অভিযোগ তদন্ত করতে হবে।
আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিতব্য সরকারের আইনগত বৈধতার তাগিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বক্তব্যে ঊহ্য থেকে গেছে, তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন আগামী সরকারের নৈতিক বৈধতার ওপর। এ বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে কোনো সরকারের আইনগত বৈধতাই যথেষ্ট নয়, তার নৈতিক বৈধতাও অত্যাবশ্যক। আমরা মনে করি, কোনো সরকারের আইনগত বৈধতা নৈতিক বৈধতা ছাড়া পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। পরবর্তী সরকারের নৈতিক বৈধতা নির্ভর করছে আসন্ন নির্বাচনের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার ওপর। নির্বাচন শুধু তখনই সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে, যখন তা সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮